ইসলামী শিরোনামের ব্যবহার : স্বার্থকতা ও বাস্তবতা

মুফতী হাফিজুর রহমান

মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব। প্রভুর আনুগত্যই তার শ্রেষ্ঠত্বেরপ্রাণশক্তি। তাই মানব সমাজের জীবন চর্চার পুরোটাই নৈতিকতার পবিত্র শৃঙ্খলে আবদ্ধ। একজনমানুষের প্রাত্যহিক জীবন যাত্রার কোনো পর্বই ইসলামী শরীয়ার নীতি বহির্গত নয়। সাংস্কৃতিককিংবা উৎসব অনুরাগী শিরোনামে মুসলিম ব্যক্তি সত্তার কোনো আচরণই স্বতন্ত্র হতে পারেনা। হাদীসের ভাষ্য মতে পবিত্র ঈমানের ধারক ব্যক্তি প্রবঞ্চনার দ্বিমুখিতা অনুশীলন করতেপারে না। একজন সচেতন মুসলিম ব্যক্তি নামের ছদ্মাবরণে আদৌ প্রবঞ্চিত হতে পারে না। হাদীসেরনির্দেশনা মতে এ ব্যাপারটিতে সে সচকিত ও সবিশেষ যতœবান হতে বাধ্য।

সাধারণত একজন মুসলিম তার সহজাত পবিত্র অভিরুচির তাড়নায় ইসলামী বিষয়াবলীতে বিশেষ আগ্রহ লালন করে। তার ব্যক্তি চর্চার ধরণ যাই হোক- দীনী বিধান পরিপালনের আবশ্যকতাকে সে অকপটে স্বীকৃতি দেয়। নৈতিক আনুগত্য-অনুসরণকে মর্যাদার মনে করে। মুসলিমদের সহজাত এ পবিত্র দুর্বলতার ছিদ্রপথে ঢুকে পড়েছে অসংখ্য অভিনব কুসংস্কার। স্বার্থচিন্তার সবটুকু প্রয়োগ প্রাধান্য পাচ্ছে এ জায়গাটিতে। রাজধানীর অলিতে গলিতে ইসলামী নামের সমাহার লক্ষ্য করা যায়। আপামর জনসাধারণও সাইনবোর্ডের এ পরোক্ষ আহ্বানের মায়াজালে জড়িয়ে যাচ্ছে খুব সহজেই। মুসলিম সাধারণের পবিত্র এ ঝোঁক প্রবণতা ও সারল্যকে পুুঁজি করে ইসলামী শিরোনামে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান ও বিষয়গুলোর ইসলামী সার্থকতার সরল বিশ্লেষণ নিয়েই এ নিবন্ধের অবতারণা।

ইসলামী গান বা ইসলামী সঙ্গীত

গান শব্দটির শব্দগত তাত্ত্বিক বিশ্লেষনে আমরা যাবো না। পৃথিবীর প্রচলিত ভাষাগুলোতে শব্দের শাব্দিক বা আভিধানিক অর্থ আর পারিভাষিক অর্থ সর্বদাই এক ও অভিন্ন হয় না। দু’টি অর্থের মাঝে কদাচিৎ সুপ্ত ঘনিষ্ঠতা দেখা গেলেও একটি অন্যটির ক্ষেত্রে ব্যবহার্য নয়। বাংলা পরিভাষায় গান বলতে বুঝায় বাদ্যযুক্ত ললিত ধ্বনি। ভার্সিটিগুলোতে গান চর্চার নিমিত্ত ললিত কলা নামে স্বতন্ত্র্য বিভাগও বিদ্যমান। অভিধানগুলোতে এর অর্থ করা হয়েছে, গীতিকবিতা ও কণ্ঠসঙ্গীত। নৃত্য ও বাদ্যের সাথে গীতি বা সঙ্গীতের সাযুজ্য তো আরো প্রকট। চারুকলা বা ললিতকলা শাস্ত্রে সঙ্গীতের সংজ্ঞায়ন হয়েছে এভাবে- গীত, বাদ্য ও নৃত্য এ তিনটি ক্রিয়া একত্রে নিষ্পন্ন হলে যে পরিবেশ সৃষ্টি হয় শাস্ত্রমতে তাকেই সঙ্গীত বলে। সুতরাং শাস্ত্রীয় এ পরিভাষা লঙ্ঘনের আপাতত সুযোগ নেই। অতএব নৃত্যবাদ্যহীন গজলকে সঙ্গীত বলে চালনা করা কি নীতি সিদ্ধ? শুরুতে ইসলামী শিরোনাম যুক্ত হলেই কি সঙ্গীত থেকে নৃত্যবাদ্য ঝরে যাবে? বহুল প্রচলিত একটি শাস্ত্রীয় পরিভাষা নিছক একটি পবিত্র শিরোনাম যুক্তকরণেই কি পবিত্র হয়ে যাবে? ইসলামী সঙ্গীত বা ইসলামী গান শব্দদু’টি ব্যবহারের পূর্বে এসব বিষয় নিয়ে খানিকটা বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে। উন্মুক্ত শিল্পবোধ বা শৈল্পিক চেতনার নামে যাচ্ছেতাই বলা বা করা যায় না। অন্তত ইলমঘনিষ্ট মানুষদের এ জায়গাটিতে সচেতন হওয়া খুব বেশি প্রয়োজন।

ইসলামী ব্যাংক

ইসলামী ব্যাংক ইলমী ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে তুমুল আলোচিত একটি প্রসঙ্গ। পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা সমালোচনার অন্ত নেই। বস্তুত কালের প্রয়োজনে প্রকৃত ইসলামী ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা সত্যিই অসামান্য। এ ব্যাপারে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি কারো কাম্য নয়। তবে ইসলাম বা শরীয়া অনুসরণে অবহেলা করে এ নামের ব্যবহারে উলামায়ে কেরাম ঘোর আপত্তি করতে বাধ্য। অনুসন্ধানে দেখা গেছে প্রচলিত ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের ব্যাংক পরিচালনার নীতিমালা তৈরির ক্ষেত্রে শরীয়া পরিপালনে বেশ পরিপক্কতা দেখায়। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে তার কাঙ্ক্ষিত বাস্তবায়ন বা অনুশীলন দেখা যায় না। মূল কার্যক্ষেত্রে গিয়ে তারা সুদ-মুনাফার ব্যবধানকে ঘুচিয়ে ফেলেন। এসব বাস্তবতা বিবেচনায় উলামায়ে কেরাম যখন ইসলামী ব্যাংকের ইসলামী হওয়ার ব্যাপারে আপত্তি তোলেন তখন তাদেরকে ইসলামী ব্যাংকের বিরোধী পক্ষ বলে জ্ঞান করা হয় কিংবা ব্যাংক-অর্থনীতি বিষয়ে তাদের জ্ঞানের পক্কতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। অথচ ইসলামী ব্যাংকগুলোর পুরোধা ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ থেকেই সুস্পষ্ট স্বীকৃতি রয়েছে, ইসলামী ব্যাংকগুলো শতভাগ সুদমুক্ত নয় এবং সুদমুক্ত করা সম্ভবও নয়। অনেকে প্রসঙ্গ এড়াতে বলেন, আপনি কি শতভাগ গুনাহমুক্ত? তা না হলে ইসলামী ব্যাংকের শতভাগ সুদ মুক্তির প্রসঙ্গ তোলেন কেন? এই প্রশ্ন নিতান্ত অবান্তর। কারণ, ব্যক্তিজীবন কেন্দ্রিক অপরাধ আর ব্যক্তিজীবন ছাপিয়ে লাখো মানুষের জীবনকে পাপমগ্ন করার অপরাধ এক নয়। তদ্রƒপ অর্থ সংশ্লিষ্ট অপরাধের ভয়াবহতাও অন্যান্য অপরাধের মত নয়। হাদীসের ভাষ্যমতে হারাম অর্থে লালিত দেহ জান্নাতে যাবে না। তেমনি যে ব্যক্তির পানাহার, পোশাক-আশাক বৈধ নয় তার কোন কাকুতি-মিনতিও আল্লাহর কাছে পৌঁছবে না। সুতরাং সুদ বিষয়ক হারাম অপরাধকে ব্যক্তির বিচ্ছিন্ন অপরাধের সাথে তুলনা করে ছোট করে দেখার আদৌ অবকাশ নেই। মূলত ইসলামী ব্যাংকগুলো কর্তৃক ইসলামী ও শরীয়া শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে মুসলিম জনসাধারণকে কাছে টানার এহেন প্রবণতাকে উলামায়ে কেরাম ঘোর আপত্তির দৃষ্টিতে দেখে থাকেন। তাদের মতে, শরীয়া পরিপালনে যারা যতটুকু সফল তাদের শিরোনামে ততটুকুই উপস্থাপিত হওয়া উচিত; যাতে মানুষ প্রবঞ্চিত হওয়া থেকে বাঁচতে পারে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ পেতে পারে। এ প্রসঙ্গে উলামায়ে কেরামের যাবতীয় গবেষণা ও কার্যক্রম কেবলই পরকালীন দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা কেন্দ্রিক। আপামর জনসাধারণের প্রশ্ন-জিজ্ঞাসার সূত্র ধরেই তারা ইসলামী ব্যাংক সংক্রান্ত শরীয়াসম্মত পথ ও পন্থা আলোচনা করেন। ইসলামী ব্যাংকগুলোর সাথে তাদের কোন বিদ্বেষ বা শত্রুতা নেই; আবার প্রচলিত ধারার সাধারণ ব্যাংকগুলোর সাথেও তাদের দহরম-মহরম নেই। তাদের সকল চেষ্টা ও তৎপরতা নিছক আখেরাতমুখিতা ও উম্মাহর কল্যাণকামিতা থেকে উৎসারিত।

ইসলামী বীমা

বীমা একটি ফার্সী শব্দ; যার অর্থ দায়ভার, নিরাপত্তা। প্রচলিত অর্থব্যবস্থায় বীমা একটি অন্যতম আলোচিত বিষয়। বড়সড় আর্থিক প্রজেক্টের বীমার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে আইনগত বাধ্যবাধকতাও বিদ্যমান। এছাড়াও বীমা ব্যবস্থা একটি অর্থকরি পলিসিও বটে। ফলে অলিগলিতে বীমা প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। প্রচলিত বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দৃশ্যমান সুদসহ অন্যান্য শরীয়া অসঙ্গতি বিদ্যমান। এ কারণে সুদের অবৈধতার ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ মুসলিম জনসমাজকে বীমা পলিসিতে জড়িত করার নিমিত্ত বীমা শব্দের শুরুতে ইসলামী শিরোনাম যুক্ত করার প্রাদুর্ভাবও ঘটেছে বেশ আয়োজন করে। ভিতরে ইসলামী কিছু না রেখে কিংবা নামকেওয়াস্তে কিছু রেখে পোশাকী নামের এ সংযোজন ঘোরতর আপত্তিকর। শত্রুবিভীষণ কিংবা গৃহশত্রুর অনিষ্টতা বহিঃশত্রুর অনিষ্টতা থেকে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। কাজেই এ জাতীয় প্রবঞ্চনামূলক কর্মকাণ্ড থেকে নিজে বাঁচা ও উম্মাহকে বাঁচানো অপরিহার্য।

ইসলামিক টেলিভিশন

টেলিভিশন অর্থ দূরদর্শন। টেলিভিশন মানেই নাটক, ছায়াছবি, নৃত্যগান আর অশ্লীল বিজ্ঞাপনের সমারোহ। এগুলোই একটি টিভি চ্যানেলের মূল উপজীব্য। অধুনা টিভি চ্যানেলের নতুন একটি সংস্করণ হলো ইসলামিক টিভি। টিভিবিমুখ ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীকে টিভিমুখী করার চমৎকার প্রয়াস। টিভিতে প্রদর্শিত চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ চিত্রের পর্যায়ভুক্ত কি না এ নিয়ে অনেক আলোচনা পর্যালোচনা রয়েছে। আপাতত সেদিকে অগ্রসর হচ্ছি না। কিন্তু নারীমুখ দর্শনের নিষিদ্ধতা তো শক্তিময় প্রমাণসূত্রের ভিত্তিতেই প্রমাণিত। প্রচলিত ইসলামিক টিভিগুলো কি নারীমুখ প্রদর্শন থেকে পবিত্র? তাছাড়া টিভিবিমুখ মানুষ ইসলামিক টিভির কল্যাণে(?) টিভিমুখী হলে তাদের এ ঝোঁক কি শেষ অবধি ইসলামিক টিভির মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে? সংবাদ কিংবা ইসলামিক প্রোগ্রামের নামে শেষ অবধি তারা নাচ-গান সম্বলিত প্রোগ্রামেও চোখ রাখবে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এতে ইসলামী নামের কতটুকু সার্থকতা অর্জিত হবে? ইসলামী শিরোনামের দাবি তো ছিলো, টিভির আপাদমস্তক সওয়াব-পুণ্যির সমাহার থাকবে। ব্যাপারটি কি তাই হয়? তর্কের খাতিরে যদি এ শিরোনামের চ্যানেলগুলোকে বৈধ বলে অভিহিত করা হয় তবেও তো তাতে ইসলামী শিরোনামের সংযুক্তি শোভা পায় না। কোনো বিষয় শরীয়াগত দিক থেকে অনুমোদিত কিংবা আইনানুগ হলেই তাতে ইসলামী শিরোনামের সংযুক্তি করা যায় না। এমনটি যৌক্তিক হলে তো অনুমোদিত সকল কার্যক্রমে ইসলামী শিরোনাম শোভা পেতে থাকবে। ইসলামী দোকান, ইসলামী বিমান, ইসলামী বাস ও ইসলামী রিক্সার মত হাস্যকর আরো হাজারো রকমের অভিধা বেরিয়ে আসবে। কাজেই নিছক মুসলিম দর্শক টানার জন্য ইসলামী শিরোনাম সংযোজনের অনুমোদন কেউ দিবে না; না বিবেক, না শাস্ত্র।

ইসলামী নাটক

ইসলামী নাটক শব্দটিতেই কান্না-হাসির যুগপৎ উপাদান রয়েছে। নাটক আবার ইসলামী হয়? এক সময় ইসলামী মদের উপহাস শুনতাম। শব্দটি শুনে বড্ড হাসি পেত। বড় অদ্ভুত এ পৃথিবী। অদ্ভুত পৃথিবীর মানুষ। শব্দের ব্যবহারেও লালিত্য ও শিল্পবোধ, নৈতিকতা ও রুচিবোধ থাকতে হয়। শব্দের ব্যবহার যেন মানুষের হাস্যরসের উপাদেয় বস্তু না হয় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সচেতন থাকতে হয়। নাটক মানে অভিনয়। নাটক মানে কৃত্রিমতা। আর প্রচলিত নাটক মানে অনৈতিকতার প্র¯্রবণ। ইসলামী নাটকগুলো কি সে অনৈতিকতা বিদায় করতে পেরেছে? এগুলো কি অনৈতিকতা বিবর্জিত আপাদমস্তক নেকী-পুণ্যের বার্তাবাহক? অনুসন্ধিৎসু জবাব কিন্তু ইতিবাচক হবে না। সুতরাং ইসলামী শিরোনাম দেখেই এসব নাটক ফাটকে ঝাঁপ দেয়া যাবে না। এতে লাভ পুণ্যের কিছুই মিলবে না। উল্টো ইসলামী নাটকের নামে ইসলামী(?) গুনাহের ভাগী হওয়ার সুবিধা লাভ হবে।

ইসলামিক পার্টি/দল/ফ্রন্ট

ইসলামী বা ইসলামিক শিরোনামে রাজনৈতিক অরাজনৈতিক বহু দল উপদল রয়েছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে আজ মুসলিম দেশে ইসলামী শিরোনাম যুক্ত করে রাজনীতি করতে হয়। অথচ একজন মুসলিমের সকল কর্মকাণ্ডই হওয়া কর্তব্য ইসলামী বিধানকেন্দ্রিক। নামাজ পড়ার ক্ষেত্রে যেমন ইসলামী শিরোনাম যুক্ত করে বলতে হয় না আমি ইসলামী নামায পড়ছি তদ্রƒপ রাজনীতি করার ক্ষেত্রেও ইসলামী রাজনীতি বলার প্রয়োজন ছিল না। আমাদের দেশে ইসলামী রাজনীতির প্রবক্তা অনেক রাজনৈতিক দল ইসলামী রাজনীতির বিধানাবলীর পরিপূর্ণ বা আংশিক অনুসরণ করে না। কাজেই ইসলামী শিরোনাম দেখেই কোনো রাজনৈতিক পার্টিতে অধিভুক্ত হওয়া যাবে না। এ দেশে অনেক ইসলামিক পার্টির পুরোধা আছেন যাদের দৈহিক অবকাঠামোতে ইসলামিক বিষয়ের ছিটে ফোঁটাও নেই। বিশ্বাসগত দিক থেকে ইসলাম চর্চার দিকে তাকলে মাথায় হাত পড়ে যাবে। অথচ সরল মনের মুসলিম মানুষগুলো ইসলামিক নামধামের টাইটেল শিরোনাম দেখে মজে যান। এভাবে নিছক নাম শিরোনাম দিয়ে কোনো ব্যক্তি বা পার্টিকে পরিমাপ করা যায় না। আবার নাম শিরোনাম ইসলামী না হলেও ব্যক্তি ও দলের অনুশীলন কুরআন সুন্নাহকেন্দ্রিক হলেই চলবে। শিরোনাম বিযুক্তির কারণে তাতে কোনো রূপ ঘাটতি সৃষ্টি হবে না।

ইসলামী কার্টুন

হাসি কৌতুকের আরেক অধুনা মুদ্রণ ইসলামী কার্টুন। কার্টুন অর্থ ব্যঙ্গচিত্র, রঙ্গচিত্র, কৌতুকাত্মক বা ব্যঙ্গাত্মক চিত্র। ইসলামী বিধানে জীবচিত্রই তো নিষিদ্ধ। সেখানে জীবের ব্যঙ্গচিত্রের বিধান কি হবে তা সহজেই অনুমেয়। নিন্দনীয় এমন একটি অবিধানিক বিষয়কে ইসলামীকরণের দুঃসাহস প্রদর্শন করা আমাদের জন্য লজ্জাকর ব্যাপার। ইসলামের সুমহান ব্যক্তিদেরকে এসব কার্টুনে বিকৃতাকারে উপস্থাপন করা হয়। এসব কার্টুন মুভি নির্মাণ বস্তুত ইসলাম ও মুসলিম মনীষীদের অবমাননার নামান্তর। এগুলো যত সত্য কথাই বলা হোক, যত সত্য ইতিহাসই প্রচারিত হোক, তাতে কুরআন হাদীসের যত আলোচনাই থাকুক তাকে কোনোভাবেই ইসলামী অভিধায় ভূষিত করা যায় না। গোমূত্রে দুগ্ধ মিশ্রিত হলে মূত্রের মর্যাদা বেড়ে যায় না। সুতরাং কার্টুন যে বিষয়েরই হোক তা ইসলামী শরীয়া মতে নিষিদ্ধ। কার্টুনের শুরুতে নিছক ইসলামী শিরোনামের সংযোজন কার্টুনকে বিধানিক ও ইসলামিক বানিয়ে দিবে না। ইসলামী শিরোনামের এসব কার্টুনকে বা এর নির্মাণ ও প্রদর্শনীকে বৈধ জ্ঞান করার কোনোই অবকাশ নেই।

ইসলামী উপন্যাস

উপন্যাস মানে জাল গল্প, কল্পিত ঘটনা, কল্পনার কালিতে সুড়সুড়িমূলক উপস্থাপনা। উপন্যাসে নারী ঘটিত বিষয় বা প্রেম ভালবাসার উপাদান না হলে উপন্যাসের আবেদন চরমভাবে ক্ষুণœ হয়। এমনতরো উপন্যাসেরই ফাঁকফোকরে ইসলামিক কিছু ডায়ালগ ছেড়ে দিলেই তা ইসলামিক হয়ে যায় না। কাজেই এভাবে উপন্যাসের সাথে ইসলামী লেবেল এঁটে দিয়ে স্বার্থ উদ্ধার করা কোনোভাবেই বিধিত নয়। ইসলামী শিরোনামের বেশ কিছু উপন্যাস সম্বন্ধে ধারণা লাভ করার সুযোগ হয়েছে। সেখানে নানা রকম আপত্তিকর বিষয়ের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। বাজারে এমন ইসলামী উপন্যাসও রয়েছে যার লেখক তাকে ইসলামী বলতে রাজি নন; কিন্তু সেটাকে ইসলামী উপন্যাস হিসেবেই বাজারজাত করা হয়েছে। ইসলামী ইতিহাসের বিশেষ কিছু ঘটনার বাঁকে বাঁকে অসত্য কিংবা কল্পকথার সংযোজন ঘটিয়ে তাতে নারীত্বের মোহনীয় উপস্থাপন করে একে উপন্যাসের রূপ দেয়া নৈতিক দিক থেকে চরম বিপর্যয়কর। মোটকথা ইসলামী উপন্যাস মানেই ইসলাম সমর্থিত নয়। এসব উপন্যাসের পাঠকপ্রিয়তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দুরভিসন্ধিমূলক তৎপরতা চালানো বিধিসম্মত নয়।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মানে এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে দীনের জ্ঞান বিতরণ করা হবে। তদ্রƒপ ব্যক্তি জীবন ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিমণ্ডলে দীনী ইলমের বিশুদ্ধ চর্চা হবে। কারণ ইলম শুধু জানার নাম নয়; ইসলাম বিষয়ে জানা ও তা ব্যবহারিক জীবনে বাস্তবায়ন করার সমন্বিত নাম হলো ইলমে দীন বা ইসলাম বিষয়ক জ্ঞান। কোথাও শুধু দীনী শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা থাকলে সেটাকে ইসলামী প্রতিষ্ঠান বলে অভিহিত করা যায় না। আমাদের দেশে সরকার পরিচালিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসলামের শিক্ষা রয়েছে কিন্তু ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ইসলামের চর্চা নেই। এখানে শুধু ইসলামের শিক্ষা চর্চা হয়। সেই শিক্ষা বাস্তবায়নের ব্যাপারে কোনো গুরুত্ব দেয়া হয় না। অক্সফোর্ড ক্যাম্ব্রিজের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ আর মুসলিমদের ইসলামিক স্টাডিজ বা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে পার্থক্য তো ব্যক্তি জীবন ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ইসলামের চর্চা হওয়া না হওয়ার ভিত্তিতে। এ ব্যবধান যদি উঠিয়ে রাখা হয় তাহলে এ দু শ্রেণীর প্রতিষ্ঠানের মাঝে কোনো ব্যবধান পরিলক্ষিত হয় না। সরকার পরিচালিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনৈসলামিক কার্যকলাপের অন্ত নেই। কিন্তু নাম হয়েছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। এ নামকরণের সার্থকতা রক্ষা করা সরকারের গুরুদায়িত্ব।

ইসলামী গণতন্ত্র

গণতন্ত্র মানে মানবতন্ত্র। গণতন্ত্র শ্রেণীগত বৈষম্য ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির একটি উত্তম মাধ্যম বটে। গণতন্ত্রের অনৈসলামিক দিকগুলো বেশ পরিস্কার। ইসলাম ও গণতন্ত্রের মাঝে প্রভেদের দেয়াল বেশ উঁচু ও পুরু। দু’টিকে একাকার করা হলে গণতন্ত্র বা ইসলামের কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না; ইসলামী বিধান মেনে রাজনীতি করতে গেলে গণতন্ত্রের প্রয়োজন হবে কেন? গণতন্ত্র নিয়ে এত টানাহেঁচড়া কেন? গণতন্ত্র কখনো ইসলামী হতে পারে না। তবে যারা কিছু গণতান্ত্রিক কিছু ইসলামিক থিউরিতে বিশ্বাসী তারা ইসলামী গণতন্ত্রের ধারক হতে পারেন। দুগ্ধ-মূত্রের এরূপ পুঁতিগন্ধময় সমন্বয়ে আমরা বিশ্বাসী নই। এসব অদ্ভুত ইসলামীকরণে কিছু সরলমনা মানুষকে বিভ্রান্তির ভাগাড়ে ফেলে দেয়া ছাড়া আর কিই বা অর্জন হয়? মানুষ পোড়ানো, নাজায়েয হরতাল ধর্মঘটের নামে অন্যায়ভাবে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলাসহ কিছু গণ ও ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ড ব্যতিরেকে তেমন কিছুর উপস্থিতি পাওয়া যায় না এ গণতন্ত্রের মাঝে। সুতরাং শুরুতে ‘ইসলামী’ সংযুক্ত করা হলেই গণতন্ত্র ইসলামী হয়ে যাবে না। ইসলামায়নের মাধ্যমে গণতন্ত্রের ভ্রান্ত ও নিষিদ্ধ দিকগুলোকে বিদূরিত করা সম্ভব নয়। অতএব গণতান্ত্রিক ইসলামায়নের এ বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ ধারাকে পরিহার করা উচিত।

ইসলামী নাম

ইসলামী নামের অর্থ, শরীয়াগত দিক থেকে যে নাম রাখা সঙ্গত। যে নাম রাখা বিধানগত দিক থেকে সঙ্গত নয় তা অনৈসলামিক। নামের ইসলামিক-অনৈসলামিক এ সরল ব্যবধান সমাজে প্রচলিত নয়। সমাজের ধারণা হলো, নামটা আরবী ভাষার হলে ইসলামিক; অর্থ যাই হোক। আরবী ভাষার না হলে সেটা অনৈসলামিক; অর্থ যাই হোক। নাম প্রসঙ্গে সামাজিক এ ধারণা বিভ্রান্তিকর। বস্তুত নামের সাথে ইসলামিক অনৈসলামিক এ সংযোজনটাই অবাঞ্ছিত। ব্যক্তির ইসলামিক নাম হলে গ্রাম, ইউনিয়ন, থানা, জেলারও ইসলামিক নাম হওয়া চাই। শব্দটি আরবী হলেই কি তা ইসলামী হয়ে যায়? আরবী ভাষা কি ইসলামী ভাষা? অন্যান্য ভাষা কি তবে অনৈসলামিক? অর্থ বিবেচনা না করে আরবী শব্দ যোগে নামকরণ করা আদৌ উচিত নয়। মাহীন, গোলাম নবী, আব্দুল মুত্তালিব, খালেক, রায্যাক এ জাতীয় অসংখ্য আরবী ভাষার নাম সমাজে প্রচলিত আছে। অথচ এসব নামে নাম করণ বিধানগত দিক থেকে চরম আপত্তিকর। কুরআন হাদীসে থাকলেই সেটা ইসলামী বা বরকতপূর্ণ নাম হয় না। শয়তান, ফিরাউন, আবূ জাহেল, আবূ লাহাব-এগুলো কুরআন-হাদীসের শব্দ। তাই বলে কি এগুলো ইসলামী নাম? হাদীসে সুন্দর নাম রাখার কথা এসেছে। কুরআন-হাদীসের নামের কথা বলা হয়নি। শুধু আরবী নাম হলেই তা ইসলামিক হবে; অনারবী হলে অনৈসলামিক নাম হবে, ইসলামী শরীয়তে এমন কোনো সীমারেখা নির্ধারণ করা হয়নি। পৃথিবীর সকল ভাষাই আল্লাহর সৃষ্টি। কুরআনের ভাষ্যমতে ভাষাবৈচিত্রও মহান আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন হিসেবে পরিগণিত। উপরন্তু পূর্ববর্তী অধিকাংশ নবীদের নামই ছিল অনারবী। তবে কুরআন হাদীসের ভাষা হিসেবে সুন্দর অর্থবোধক আরবী নাম রাখা উত্তম। হাদীসের ভাষ্যমতে আব্দুল্লাহ, আব্দুর রহমান জাতীয় নামগুলো আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়। মুসলিম সন্তানদের এমন নাম রাখা চাই যাতে নামের মাঝেই মুসলিম পরিচয় ফুটে উঠে। এমন নাম রাখা সঙ্গত নয় যাতে ধর্মপরিচয় জিজ্ঞেস করে মুসলিম অমুসলিম নির্ণয় করতে হয়। আজকের সমাজে জাগতিক বিষয়ে নামী দামী অমুসলিম ব্যক্তিদের প্রতি অতিরিক্ত আদিখ্যেতা ও প্রেমবোধ থেকে তাদের নাম করণের হিড়িক দেখা যায়। প্রথমত এগুলোর অর্থের মাঝে সৌন্দর্য নেই; দ্বিতীয়ত এমন অনেক নাম রয়েছে যার অর্থ বের করা তো দূরের কথা সেটা কোন ভাষার শব্দ তাই খুঁজে বের করা দুষ্কর। তৃতীয়ত অমুসলিমদের সাথে অন্যায় কারণে ভালবাসার সম্বন্ধ সৃষ্টি করা এবং তাদের সাদৃশ্য গ্রহণ করা শরীয়াগত দিক থেকে চরম আপত্তিকর। হাদীসের ভাষ্যমতে যে ব্যক্তি যে সম্প্রদায় বা ব্যক্তির সাদৃশ্য গ্রহণ করবে সে তার শ্রেণীভুক্ত গণ্য হবে। অর্থাৎ পরকালীন শাস্তির ক্ষেত্রেও এতদুভয়ের সাদৃশ্য অটুট থাকবে। সুতরাং নাম রাখার ক্ষেত্রে বিধর্মীদের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণের মনোভাব থাকলে তা আদৌ বৈধতার পর্যায়ে পড়বে না।

ইসলামিক মুভি

প্রযুক্তির এ যুগে ইন্টারনেটে অসংখ্য ইসলামিক শিরোনামের মুভির সন্ধান পাওয়া যায়। মুভি অর্থ সচল ছবি, চলচ্চিত্র। এ যাবত নবী জীবন নিয়ে অসংখ্য চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। ইসলামী বিধান মতে চলচ্চিত্রই যেখানে নিষিদ্ধ সেখানে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিদের নিয়ে তা নির্মাণ করা কতটা জঘন্য তা সহজেই অনুমেয়। এগুলোর প্রথম উদ্যোক্তা ইয়াহুদী খ্রিস্টান। তাদের ক্ষেত্রে এটা না হয় মেনে নেয়া যায়। কিন্তু মুসলিমদের জন্য এ জাতীয় মুভি নির্মাণ করা কি করে যৌক্তিক ও বিধানিক হতে পারে। তদুপরি তার সাথে ইসলামিক লেভেল এঁটে দেয়া যে কতটা নিন্দনীয় তা বলাই বাহুল্য। ইরানের চলচ্চিত্রগুলোকে আমাদের সমাজে ইসলামিক মুভি হিসেবে জ্ঞান করা হয়। অথচ ইরানের শিয়া সম্প্রদায় তো মুসলিমই নয়। তাদের তৈরি চলচ্চিত্র ইসলামী হওয়া তো অনেক দূরের বিষয়। বস্তুত মুভি বা চলচ্চিত্র কখনো ইসলামী হতে পারে না। যেমন মদ কখনো ইসলামী হয় না। সুতরাং নামের শুরুতে ইসলামী লেবেল দেখেই তাকে বৈধ জ্ঞান করার অবকাশ নেই।

ইসলামিক টেরোরিজম

অদ্ভুত একটি শব্দ ইসলামিক টেরোরিজম। টেরোরিজম মানে সন্ত্রাসবাদ। অন্যায়ভাবে ত্রাস সৃষ্টি করাই হলো সন্ত্রাসবাদ। অন্যায়ের বিপক্ষে ন্যায়সঙ্গতভাবে ত্রাস সৃষ্টি করা হলো জিহাদ। ইসলামের আপাদমস্তকই তো ন্যায়ের ধারক। ইসলাম আর অন্যায়ের সহাবস্থান হতে পারে না কখনো। ইসলাম আর সন্ত্রাসবাদ পরস্পর সংঘর্ষিক দুই মেরুর দু’টি শব্দ। সুতরাং ইসলামিক টেরোরিজম কৌতুকপ্রদ হাসি উদ্রেককারী একটি শব্দ। শব্দটি মূলত পশ্চিমা চক্রের জিহাদ বিষয়ে ব্যাঙ্গাত্মক পরিভাষা। ইসলামী জিহাদকে তারা কৌতুকাত্মক উপস্থাপনায় ব্যাক্ত করে থাকে। অথচ জিহাদ ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি পবিত্র বিধান। পৃথিবীর সবুজ ভূমিতে শান্তির সুবাতাস প্রবাহিত করার অন্যতম উপায় হলো জিহাদের বাস্তবায়ন। দেহের ক্ষতিকর অংশকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণ করা যেমন আবশ্যক তদ্রƒপ পৃথিবীর দেহ থেকে জিহাদের মাধ্যমে দীন ও দুনিয়ার জন্য ক্ষতিকর সকল প্রয়াস অবদমিত ও অপসারিত করা আবশ্যক। পবিত্র এ জিহাদ দীনের শত্রুদের বড় আতঙ্কের বিষয়। কারণ তারা ইসলামের সোনালী ইতিহাসের পাঠ গ্রহণ করেছে। তারা ভালো করেই উপলব্ধি করতে পেরেছে, পবিত্র জিহাদের বাস্তবায়ন হলে তাদের জন্য এ পৃথিবী সঙ্কুচিত হয়ে পড়বে। তাদের হম্বিতম্বির সলিল সমাধি হবে। তাই তারা পবিত্র এ শব্দটিকে নানা উপায়ে বিতর্কিত করে চলেছে। মুসলিম জনসমাজকে জিহাদের ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ করে তুলছে। যাতে মুসলিম সমাজ কোনোভাবেই জিহাদের প্রতি উদ্বুদ্ধ না হতে পারে এবং সহজেই তারা জিহাদের ব্যাপারে অনাগ্রহী ও অনীহ হয়ে মুনাফেক উপাধী ধারণ করে পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করতে পারে। আজকের পৃথিবীতে কোথাও অন্যায়ের প্রতিবাদে জিহাদের আওয়াজ উচ্চকিত হলে তাকে অন্যায় বলে দমিয়ে দিতে সকল কুফুরী শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়। মোটকথা ইসলামী সন্ত্রাসবাদ নামে কোনো শব্দ পৃথিবীর অভিধানে নেই। এটা কুফরী শক্তির একটি শক্তিশালী কূটচাল। তারা কিছু দালাল তৈরি করে সন্ত্রাস ছড়ায় আর সেটাকে ইসলামী নাম দিয়ে বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করে। অন্তত কোনো মুসলিম এ কূটচালে বিভ্রান্ত হতে পারে না। সুতরাং জিহাদ আর সন্ত্রাস কখনো এক নয়। সন্ত্রাসবাদ দমনের পবিত্র লক্ষ্যেই জিহাদের উত্থান ঘটেছে। পবিত্র জিহাদের ব্যাপারে মুসলিমদেরকে ইতিবাচক ও আগ্রহমূলক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতেই হবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

ইসলামী বিপ্লব

ইসলামী বিপ্লব মানে ইরানের খোমেনী বিপ্লব। আমাদের জন্য ইরানের শিয়া বিপ্লবের ব্যাপারে আগ্রহ উদ্দীপনা প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। আমাদের সমাজে শিয়া সুন্নী ব্যবধানকে হানাফী শাফিয়ী ব্যবধানের মত সহজাত ব্যবধান ও সত্যের বৈচিত্র বলে জ্ঞান করা হয়। এ ধরনের মুক্তমনা ধারণা চরম পর্যায়ের বিভ্রান্তি। শিয়া বিশেষত খোমেনীপন্থী শিয়া সম্প্রদায় নিছক শিয়া; মুসলিম নয়। তাদেরকে মুসলিম হিসেবে বিবেচেনা করা ঈমানের জন্য চরম ক্ষতিকর। যারা কুরআনকে অসম্পূর্ণ বলে, নবী পত্নী আয়েশা রাযি. কে জাহান্নামী, ব্যাভিচারিণী বলে আখ্যায়িত করে উপহাস করে, যে ব্যক্তি আবূ বকর, উমর রাযি. সহ অসংখ্য সাহাবীকে কাফের সাব্যস্ত করে তার ‘মুসলিম’ হিসেবে অভিহিত হওয়ার কী অধিকার আছে! ওদের সাথে উদারতা দেখালে নবী আত্মা কষ্ট পাবে। রোজ হাশরে শাফাআত-সুপারিশের দ্বার রুদ্ধ হয়ে যাবে। সুতরাং ইসলামী বিপ্লব বলে ইরানী বিপ্লবকে মহিমান্বিত করা একজন মুসলিমের জন্য আদৌ বৈধ নয়। কারণ সেটা একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর বিপ্লব। এর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। এ বিপ্লবকে ইসলামী বিপ্লব জ্ঞান করা বিধিত নয়। ইসলামী বিপ্লব বলে এ বিপ্লবের প্রতি আগ্রাহান্বিত হওয়া কিংবা এ জাতীয় বিপ্লবকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা ইসলামী শরীয়া মতে গর্হিত কাজ।

ইসলামিক ডিগ্রি

ইসলাম বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের জন্য বিদেশ বিভূঁইয়ে পড়া শোনার ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের দেশের কলেজ ভার্সিটিগুলোতেও স্বতন্ত্র ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ রয়েছে। এগুলো প্রশংসনীয় ব্যবস্থাপনা। তবে ভার্সিটির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগগুলোতে যা কিছুর পাঠ দান করা হয় তা বিশুদ্ধ ইসলামিক কি না তা নিয়ে পর্যালোচনার অবকাশ রয়েছে। ভার্সিটির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ইতিহাস গ্রন্থগুলো দেখার সুযোগ হয়েছে। তাতে সাহাবা কেন্দ্রিক আলোচনাগুলোতে বেশ আপত্তিকর অসঙ্গতি বিদ্যমান। এ জাতীয় ইতিহাস পাঠে সাহাবায়ে কেরাম রাযি. বিশেষত মুয়াবিয়া রাযি. এর ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ মনোভাব সৃষ্টি হয়। সুলতান মাহমূদ গজনবীসহ মুসলিম শাসকদের নিয়েও রয়েছে আপত্তিকর উপস্থাপনা। শিয়া কিংবা ইয়াহুদী খ্রিস্টান রচিত ইসলামী ইতিহাসের অনুবাদ কিংবা তাদের রচিত ইতিহাস গ্রন্থ অবলম্বনে রচিত ইতিহাস গ্রন্থই এসব অসঙ্গতির মূল সূত্র। এ কারণেই ভার্সিটি লেভেল থেকে ইসলামিক ডিগ্রি ধারী ডক্টরদের চিন্তা চেতনায় বেশ প্রান্তিকতা ও অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হয়।

মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে গিয়ে যদি ইসলাম বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করা হয় তাতে আপত্তি ততো জোরালো হয় না। কিন্তু যদি ইউরোপ আমেরিকা গিয়ে ইয়াহুদী খ্রিস্টান পরিচালিত ভার্সিটিগুলো থেকে ইসলামের উপর ডিগ্রি গ্রহণ করা হয় তাহলে তা চরম বিস্ময় সৃষ্টি করে। ইহুদী খ্রিস্টান সম্প্রদায় ইসলামের জাত শত্রু। চর্মচোখে কালেভদ্রে মুসলিমদের ব্যাপারে তাদের আদিখ্যেতা পরিলক্ষিত হলেও তার পেছনেও থাকে তাদের টার্গেট বাস্তবায়নের সুপ্ত কূটকৌশল। ইহুদী খ্রিস্টান ও মুসলিমদের সম্পর্কের ধরণ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ইহুদী খ্রিস্টান সম্প্রদায় তোমার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হবে না যাবত না তুমি তাদের ধর্মাদর্শ গ্রহণ করবে। (সূরা বাকারা- ১২০)

কাজেই এমতাবস্থায় তারা যখন অক্সফোর্ড ক্যাম্ব্রিজে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ খুলে তখন স্বভাবতই তাদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে যায়। সুতরাং এ জাতীয় নামসর্বস্ব ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগগুলো মুনাফেকদের তৈরি মসজিদে যিরারেরই অধুনা সংস্করণ। প্রাচ্যবাদও হাদীস অস্বীকৃতির দীক্ষা এখান থেকেই সরবরাহ করা হয়। বিদগ্ধ গবেষক ড. মুসতাফা সিবায়ী রাহ. অক্সফোর্ড ক্যাম্ব্রিজের এসব ইসলামিক বিভাগগুলোর গভীরে প্রবেশের চেষ্টা করেছেন। তিনি বিভিন্ন কলা কৌশলে তাদের মূল এজেন্ডাগুলো উদ্ধার করে এনেছেন। তার রচিত কালজয়ী গ্রন্থ আস-সুন্নাহ ওয়া মাকানাতুহা ফিত-তাশরীয়িল ইসলামী’তে এসব বিষয়ের চুলচেরা বিশ্লেষেণ উদ্ধৃত হয়েছে। তাই অমুসলিম রাষ্ট্র থেকে ইসলামিক বিষয়ে ডিগ্রি নিয়ে আসা ডক্টর ও স্কলারদের বক্তব্য ও রচনাতে ফুটে ওঠে নতুন এক ইসলামের প্রতিচ্ছবি; যেখানে হাদীস আসারের কোনো বালাই নেই। হাদীস নামের সকল বর্ণনাই নাকি অপাংক্তেয়। খণ্ডিত চিন্তার ধারক হয়ে এই ডিগ্রিধারীরা সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ান। সুতরাং ডিগ্রিধারীদের নামের শুরুতে ইসলামিক দেখেই তাদের উপস্থাপিত ইসলামকে নিরেট ভাবা যাবে না।

দৈনিক পত্রিকার ইসলামী পাতা/ধর্মপাতা

 প্রচলিত দৈনিকগুলোতে ইসলাম বিষয়ে একটি পাতা বরাদ্দ রাখা হয়। এটা বেশ ইতিবাচক ও আশাব্যঞ্জক দিক। তবে সে বিভাগটিতে পাঠানো সব লেখাকেই বাছ বিচার ব্যতিরেকে ছেপে দেয়া হয়; যা চরম আপত্তিকর। লেখকের ইসলাম বিষয়ে বিশুদ্ধ একাডেমিক বিদ্যা আছে কি নেই কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারটিতে অনুসন্ধিৎসু মানসিকতা লালন করেন না। সমাজে ধর্মহীনতা ও ধর্মের নামে কূপমণ্ডুকতার বিষবাষ্প মূলত এভাবেই ছড়ায়। কেননা মুদ্রিত হরফে যা কিছুর সাক্ষাত হবে তাকেই বিশুদ্ধ ও আসল জ্ঞান করার মারাত্মক প্রবণতা সমাজে বিদ্যমান। মোকছুদুল মোমিনীন ও নেয়ামুল কোরআন জাতীয় অপাংক্তেয় বইগুলো তার জ্বলন্ত প্রমাণ। ‘কোরআনের পর্দাকে বোরকায় ঢাকল কারা?’, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’, ‘কবিদের এবাদাত অথবা প্রকৃতির সত্যপাঠ’, ‘কলমসৈনিক বরেণ্য আলেম মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন’ -এ জাতীয় আপত্তিকর শিরোনামের অসংখ্য নিবন্ধ প্রবন্ধ দৈনিকগুলোর ইসলামী পাতায় স্থাপন পায়। এভাবে মূলত ইসলাম প্রচারের নামে ইসলামের ক্ষতিসাধন করা হচ্ছে। এসব বিভ্রান্তিকর নিবন্ধ পাঠ করে মানুষ ইসলাম বিষয়ে ভুল বার্তা পাচ্ছে। সুতরাং সব ইসলামী পাতা বা ধর্মপাতা নিরেট ইসলামী বা বিশুদ্ধতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নয়।

শেষকথা

ইসলামী উপাধিযুক্ত কিছু শিরোনামের আলোচনা উপরে প্রদত্ত হলো। আমাদের সমাজে এ জাতীয় অসংখ্য শিরোনামের সন্ধান মিলবে, যেখানে নামটাই শুধু বিদ্যমান; নামের আবেদনের কোনো বাস্তবায়ন নেই। কোথাও কদাচিৎ ইসলামের কিছু থাকলেও তা কুসংস্কারাচ্ছন্ন। বিশেষত আর্থিক বিষয়াবলীতে এ শিরোনামের অবাধ ব্যবহার লক্ষ করা যায়। আপন স্বার্থ উদ্ধারের নিমিত্তে মানুষকে কাছে টানার মাধ্যম হিসেবে ইসলামের নামকে ব্যবহার করা হয়। তেমনিভাবে ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলে ‘হালাল’ শব্দটিরও একটি বাণিজ্যিক ব্যবহার বিদ্যমান। তাছাড়া মানুষ আরবী শব্দকেও ইসলামী শব্দের বিকল্প হিসেবে জ্ঞান করে থাকে। আরবী নাম শিরোনামকে সঠিক ইসলামের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করে। আরবী বা ইসলামী পরিভাষাগুলোর ব্যবহার দেখেই মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আশঙ্কার কথা হলো, আপামর মুসলিম জনসাধারণের এ দুর্বলতার সুযোগে খ্রিস্টানরা ইসলামী পরিভাষাগুলো ব্যবহার শুরু করেছে। ফলে তাদের ধর্মান্তর পলিসিতে গতিময়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলাফলও কাঙ্ক্ষিত। কাদিয়ানী ও শিয়ারাও একই পদ্ধতিতে মুসলিমদেরকে কাদিয়ানী ও শিয়া মতবাদে দীক্ষিত করছে। সুতরাং ইসলামী শিরোনাম বা পরিভাষার এ ছদ্মাবরণের ব্যাপারে মুসলিম সমাজকে সতর্ক ও সজাগ হতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে এ ব্যাপারে সচকিত হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *