মুফতী হাফিজুর রহমান
১০.৫০, ১২.০৭.’১৯, শুক্রবার, কাবা প্রাঙ্গন
গত শনিবার এসেছি। আজ শুক্রবার। সকাল দশটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। আরবের ভূমিতে জীবনে এই প্রথম। সুতরাং বাইতুল্লাহ চত্তরেও এই প্রথম। বাইতুল্লাহ প্লাজায় এক খণ্ড পৃথিবীর বাজার বসেছে। পুরো পৃথিবীটাই এখানে সংকুচিত হয়ে জায়গা করে নিয়েছে। পুরো পৃথিবীর তাবৎ দৃশ্যই এখানে বিরাজমান।
আজ এখানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বর্ণিল ঝলকানি। এতে আত্মিক জ্যোতি বাধাগ্রস্থ হয় কিনা কে জানে? আল্লাহর ঘরের বর্ণিল আয়োজন নাকি পৃথিবী ধ্বংসের উপসর্গ। এ কথা ঠিক, বাইতুল্লাহ প্রাঙ্গন তার আগের অবকাঠামোয় থাকলে হজ্বপুণ্যার্থীদের কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হতো। বাইতুল্লাহ প্রাঙ্গন বিস্তৃতিতে উমর রা.ই প্রথম সংস্কারের হাত দিয়েছিলেন। পুণ্যার্থীদের ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষে স্বাভাবিক সংস্কার কাম্য ও পুন্যময়ও বটে। কিন্তু জৌলুস বৃদ্ধি ও বর্ণাঢ্য অবকাঠামো রচনায় অসঙ্গতি আছে কিনা ভাবনার বিষয়। মহিয়ানের কি ইশারা এখানে কর্মরত বোঝা বড় দুঃসাধ্য।
মক্কার যে ধূলিগুলো রাসূলের পদস্পর্শ পেয়েছে তা কি আজো বেঁচে আছে? ওদের তো তিরোধান হয় না। জায়গা বদল হয় শুধু। তবে কি ধন্য ওই ধূলিগুলো প্রযুক্তির তলায় চাপা পড়ে আছে? ওদেরও কি তবে জীবন্ত সমাধি হয়েছে? যে জায়গাটিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীর প্রথম আলো বাতাস অবলোকন করেছিলেন সে জায়গাটি আজ গ্রন্থাগার রূপে চিহ্নিত হয়ে আছে দেখেছি। তবে সে জায়গাটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুনিশ্চিত জন্মভূমি কি না সে ব্যাপারে আমি সুনিশ্চিত হতে পারি নি। ইতিহাস গ্রন্থে এ নিয়ে মতবৈচিত্রও আছে। এ নিয়ে স্বতন্ত্র এ্যারাবিক গ্রন্থও রচিত হয়েছে।
আমি নবী পরশিত ধূলোর স্পর্শ পেতে চেষ্টা করেছি। মক্কার পথে প্রান্তরে অনেক হেঁটেছি। জীবনে এতধিক পায়চারি আর কখনো হয় নি। পবিত্র সে ধূলোর সান্নিধ্য পেয়েছি কি না বুঝতে পারি নি। হয়তো বুঝার সাধ্য হবে না কোনো দিন।
কাবার অধিপতি আগে ভাগেই জগত গ্রন্থে বলে রেখেছেন, হজ্বে এলে বিবাদ নিষিদ্ধ। এখানে না এলে এ নির্দেশনার নিগুঢ় মর্ম উপলব্ধ হবে না। হাতে কলমে নিষিদ্ধ এ বার্তার মর্মবাণী অনুধাবন করা যায়।
কাবা গৃহকে ঘিরে স্নায়ূবিক একটি রাজনীতি আকাশে বাতাসে উড়ে বেড়ায়। তুরস্কের মানুষগুলো বিশাল বিশাল শোডাউন করে প্রদক্ষিণব্রত পালন করে। দুআ দরুদের স্বর-শ্লোগানও বেশ সুউচ্চ। আরবের পুলিশগুলোও ওদের খানিকটা সমীহ করে। আচরণে ওরা এ বার্তাটি দিতে চেষ্টা করে, আল্লাহর এ পবিত্র ভূমি আমরা একসময় শাসন করেছি। আরবের হে কর্তাবাবুমণ্ডলী! শত্রুর সহযোগিতায় সে শাসনদণ্ড তোমরা কেড়ে নিয়েছো। খেলাফতের সুদীর্ঘ সবুজ ফিতাটিকে কেটে টুকরো টুকরো করে দিয়েছো।
ইরানের শিয়ারা কাবা ঘরটিকে খাবলে খেতে ওৎ পেতে বসে আছে। ইয়ামেনের হুথি বিদ্রোহ সে লালসারই কুৎসিত রূপায়ণ। সবটুকু দিয়ে সে বিদ্রোহটাকে বাঁচিয়ে রাখছে। ইরানী শিয়াদের বাইতুল্লাহ দর্শনকে সংকুচিত করাটা সে লালসা দমনেরই একটি প্রশংসিত উদ্যোগ। ওদের স্বপ্নটা হলো, কবাগৃহটাকে জাহেলি যুগের কাবায় রূপান্তরিত করা। তখন মুশরিকদের মূর্তিতে কাবাগৃহ অপবিত্র ছিলো। এখন ওরা চায় ওদের কথিত ইমামদের ছবি-মূর্তি যোগে কাবা ঘরের মর্যাদা ম্লান করে দিতে। ওদের স্বপ্ন অপূরণই থেকে যাক অনন্তকাল। রাজনৈতিক এ ডামাডোলে বাইতুল্লাহর আন্ডারগ্রাউন্ডকে অহর্নিশ সেনাবহর দিয়ে সাজিয়ে রাখতে হয়।
সাফা মারওয়ার দৌড়ব্রতকে নিতান্তই সাহজিক করে ফেলা হয়েছে। এক পাহাড় থেকে নেমে অন্য পাহাড়ে চড়া বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। সাফা মারওয়ার মধ্যভাগ আজ মসৃণ শীতল সমতল ভূমিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এ যেন প্রলম্বিত এক এসি কক্ষ। সাফা মারওয়ার এমন সংযোজন বিয়োজন কতটুকু শরীয়ত সঙ্গত তা নিয়ে পুনঃবিবেচনা হতে পারে। আরবের মানুষগুলো তোতা পাখির মত বিদাত কলরবে সিদ্ধহস্ত। তাদের মুখেই এসব সংযোজন বিয়োজন বিদাত হয়ে উঠার কথা।
সাফা অর্থ মসৃণ প্রস্তর। মারওয়া অর্থ শুভ্র প্রস্তর। সাফা হলো জাবালে আবু কুবাইসের অন্তিম চূড়া। আর মারওয়া হলো জাবালে কুআইকিআন এর অন্তিম চূড়া। পাহাড় দুটিতে অজ্ঞতার যুগে দুটি প্রতিমা স্থাপিত হয়েছিলো। মুশরিকরা প্রতিমা দুটি স্পর্শ করে পাহাড় দুটি প্রদক্ষিণ করতো। সাফা মারওয়া বস্তুত স্বতন্ত্র কোনো পর্বত নয়। এ দুটি যথাক্রমে আবু কুবাইস ও কুআইকিআন পর্বত দুটির দুটি চূড়া। আল্লাহর বিশেষ নিদর্শনের মর্যাদা লাভ করায় চূড়া দুটি স্বতন্ত্র পর্বতের মর্যাদা লাভ করেছে। যুগে যুগে ঘর বাড়ি, দোকান পাট, রাস্তা ঘাট, প্রবল স্রোত ও শাসকদের সংস্কারের ফলে সাফা-মারওয়া পর্বত দুটি নানা রকম ভাঙ্গা গড়ার সম্মুখীন হয়। সাফা-মারওয়ার মধ্যবর্তী অংশটিকে প্রথম কে মসৃণ ও সমতল করার কাজে হাত দেয় সে ব্যাপারে ইতিহাসে সুনির্দিষ্ট কোনো সূত্রের সন্ধান পাওয়া যায় না। কারণ মধ্যবর্তী এ অংশটি একটি উপত্যকা ছিলো। সেখানে উঁচু নিচু ও অমসৃণ অবস্থা বিরাজমান ছিলো। বাদশাহ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল আজীজ এসে মাসআর বিস্তৃতিতে বড় রকমের পরিবর্তন আনেন। এতে মাসআর অবকাঠামোয় পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃতি ঘটে। ফলে এ নিয়ে ফিকহবিদদের মাঝে বড় রকমের ফিকহী মতদ্বৈততা সৃষ্টি হয়।
সায়ি বা সা’য়ুন অর্থ দৌড়ানো। আজ সাফা মারওয়ার মধ্যকার যে জায়গাটিতে সবুজ আলোর প্রতিবিম্ব দৃষ্টিগোচর হয় এ জায়গাটিই মূলত হযরত হাজেরা আ. এর দৌড়ে পার হবার স্মৃতি চিহ্ন। এর পূর্বাপর ছিলো যথাক্রমে সাফা মারওয়া পর্বতদুটির সূচনাস্থল। উপত্যকার এ অংশটিতেই হাজেরা আ. দৌড়িয়েছিলেন। এর পূর্বাপর থেকে পাহাড় দুটিতে চড়ার কাজ শুরু করেছিলেন। আজ বিশেষত প্রশাসনিক সংস্কারের ফলে সাফা মারওয়ায় চড়ার জায়গা দুটি নিতান্তই সংকুচিত হয়ে পড়েছে। আজ সাফা মারওয়ার মধ্যকার পূর্ণ জায়গাটিকে মাসআ বা দৌড়ে পার হবার স্থান এবং পূর্ণ জায়গাটি অতিক্রম করাকে সায়ি হিসেবে অভিহিত করা হয়। যদিও সবটুকু জায়গা দৌড়ে পার হবার জায়গা নয় এবং সবটুকু জায়গা দৌড়ে অতিক্রমও করা হয় না। এটা মূলত অংশবিশেষ দ্বারা পূর্ণ বস্তুর নামকরণের নামান্তর।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, …যখন ভিস্তির পানি নিঃশেষ হয়ে গেল তখন হাজেরা ও তাঁর পুত্র ইসমাইল আ. তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়লো। হাজেরা আ. পুত্র ইসমাইলকে দেখছেন পিপাসায় কাতরাচ্ছে। তিনি এ দৃশ্য দেখতে না পেরে পানির সন্ধানে বের হলেন। সর্বনিকটে সাফা পর্বতটি দেখতে পেলেন। পাহাড়টির চূড়ায় চড়লেন। এরপর উপত্যকার দিকে মুখ করে তাকালেন কাউকে দেখা যায় কিনা। কাউকে দেখতে পেলেন না। সাফা পর্বত থেকে নেমে এলেন। যখন উপত্যকায় পৌঁছুলেন তখন তার পরিধেয় বস্ত্রের একাংশ তুলে ব্যথাতুর মানুষের মত দৌড়াতে শুরু করলেন। দৌড়িয়ে উপত্যকা পার হলেন। এরপর মারওয়া পর্বতে চড়ে চূড়ায় গিয়ে দাঁড়ালেন। এবং দৃষ্টি বুলালেন কাউকে দেখা যায় কিনা। কাউকে দেখতে পেলেন না।… সহিহ বুখারী, হাদিস ৩৩৬৪
কাবাগৃহের গিলাফ নিয়ে রয়েছে বিশাল আর্থিক কর্মযজ্ঞ। এর জন্য রয়েছে স্বতন্ত্র কর্মময় ব্যবস্থাপনা। কাবার গিলাফে দৃষ্টি বুলালে খুব সহজের উপলব্ধ হবে, এর পেছনে রয়েছে প্রকাণ্ড এক অর্থ ব্যয়ের প্রকল্প। এটা শরীয়ত অসঙ্গত অর্থ বাহুল্যের পর্যায়ে পড়ে কিনা পর্যালোচনা হতে পারে। ক্যালিগ্রাফির দুর্বোধ্য রীতিতে কাবা গিলাফে বাইতুল্লাহ সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো খচিত হয়েছে। কুরআনিক প্রবচনের সাথে অত্যধিক সংশ্লিষ্টতা ও সম্পৃক্তি থাকা সত্ত্বেও স্বর্ণিল বর্ণ খচিত আয়াতগুলোর পাঠোদ্ধারে বেশ গলদঘর্ম হতে হয়েছে। গিলাফের প্রস্তুতস্থল ও প্রস্তুতকারকের নামও খচিত হয়ে আছে কাবা গিলাফে। কাবা গেটে একই দৃশ্য বিদ্যমান। কাবাদ্বার যেন প্রলম্বিত এক স্বর্ণখণ্ড। কাবাগৃহে স্বর্ণের এমন অবাধ ব্যবহার শরীয়া রীতির পর্যায়ে পড়ে কিনা তা নিয়েও অধ্যয়ন-অনুসন্ধান হতে পারে। সামগ্রিকভাবে কাবাগৃহকেন্দ্রিক এতোসব দৃশ্যমান বাহুল্যায়োজন ও চারু শিল্পের চোখ ধাঁধাঁনো সমারোহ কাবাগৃহের মর্যাদার অনুকূলে যায় কিনা- পর্যালোচনার দাবি রাখে।