আলেমগণের মর্যাদা এবং দায়িত্ব

সৈয়দ এনায়েতুল্লাহ


প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন করে। আবার সে শিক্ষার অনুপস্থিতিতেই মানুষ হয় পশুর চেয়েও অধম এবং জাতি হয় অন্ধকারাচ্ছন্ন।

পৃথিবীতে দু’প্রকার শিক্ষা চালু আছে। এক প্রকার হচ্ছেÑ ‘মানবীয় শিক্ষা’ বা ‘ইলমে ইনছানী’ এবং অপর প্রকার হচ্ছে ‘ঐশী শিক্ষা’ বা ‘ইলমে এলাহী’ । ‘মানবীয় শিক্ষা’ আবার দু’ভাবে অর্জিত হয়। এক- নিজস্ব বুদ্ধি বা আকল হতে, দুই- অন্যের অভিজ্ঞতা হতে। মানুষের বুদ্ধি শিশুকাল হতে জাগ্রত হয়ে ধীরে ধীরে তা বর্ধিত হয়ে যৌবনে পরিপক্ক হয়। আবার বৃদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে তা ক্রমশ লোপ পেয়ে থাকে। বয়সের কারণে মানুষের বুদ্ধির পার্থক্য হয়। আবার মানুষে মানুষেও বুদ্ধির তারতম্য হয়ে থাকে। সুতরাং মানুষের বুদ্ধি স্থিতিশীল নয়। এ অস্থিতিশীল বুদ্ধির উপর নির্ভরশীল শিক্ষা মানুষের ও জাতির বিপর্যয়ের কারণ হয়ে থাকে।

দ্বিতীয় প্রকার শিক্ষা হলো অন্যের অভিজ্ঞতা হতে লাভ করা। পঞ্চেন্দ্রীয়ের মাধ্যমে অপর মানুষ যে অভিজ্ঞতা লাভ করে তা হতে শিক্ষা গ্রহণ করা। অন্যের অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে এ শিক্ষা অর্জিত হয়। এ অভিজ্ঞতার মধ্যেও ভিন্নতা ও পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়, যার কারণে এ শিক্ষাকেও নিভর্রযোগ্য শিক্ষা বলে বিবেচনা করা যায় না। এ শিক্ষায় আজ যা সত্য আগামীতে তা মিথ্যা প্রমাণিত হতে পারে।

অপরদিকে ‘ঐশী শিক্ষা’ বা ‘ইলমে এলাহী’-এর তত্ত্ব সৃষ্টিকর্তার প্রেরিত তথ্যাদির ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত বলে তা কোনকালে মিথ্যা বা অকার্যকর প্রমাণিত হয়নি এবং হবেও না। সুতরাং ‘মানবীয় শিক্ষা’ কোন ভাবেই নির্ভরযোগ্য হতে পারে না, যদি না তা ‘ঐশী শিক্ষার’ সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।

সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা’আলা থেকে পাওয়া শিক্ষাই ‘ঐশী শিক্ষা’। নবী রাসূলগণকে ওহির মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা এ শিক্ষা প্রদান করেছেন। এ শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগ নবী রাসূলগণ মানুষকে দেখিয়েছেন। আসমানী কিতাব, হাদিস, ওলিদের আধ্যাত্মিক সাধনালব্ধ কাশফ ও এলহাম ‘ঐশী শিক্ষার’ অন্তর্ভুক্ত। একমাত্র ‘ঐশী শিক্ষা’ মানুষকে চারিত্রিক গুণাবলীতে গুণান্বিত করে শ্রেষ্ঠ মাখলুক হিসেবে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। সুতরাং এ শিক্ষায় শিক্ষিতরাই অপরিসীম মর্যাদার অধিকারী।

সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন ,

বলে দিন, রুহ আমার প্রভুর আদেশ বিশেষ এবং তোমাদেরকে অতি সামান্যই জ্ঞান দান করা হয়েছে। (সূরা বনী ইসরাঈল : আয়াত ৮৫)

সৃষ্টিকর্তা যে ক্ষেত্রে বলে দিয়েছেন মানুষকে অতি সামান্যই জ্ঞান দান করা হয়েছে সে ক্ষেত্রে মানুষ তার এ সামান্য মানবীয় জ্ঞানের উপর নির্ভর করে যে পরিকল্পনাই করবে তা বিফলে যাবে। ঐশীজ্ঞানকে উপেক্ষা করে শুধু বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করাতে যুগে যুগে মানুষ না-কামিয়াব হয়েছে। বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করেই ফেরআউন, নমরুদ, হামান না-কামিয়াব হয়েছে। অপরদিকে ঐশীজ্ঞানে জ্ঞানী নবী, রাসূল, সাহাবী, ওলীগণ ইহকাল ও পরকাল উভয় জাহানেই কামিয়াবি অর্জন করেছেন।

বর্তমানে ওলামাগণই ঐশী শিক্ষায় শিক্ষিত। সুতরাং সমাজকে নেতৃত্বদানের অধিকারী একমাত্র তাঁরাই। তাঁরা যদি তাঁদের এ দায়িত্ব পালন করতে এগিয়ে না আসেন তবে বুঝতে হবে তাঁদের মধ্যে শিক্ষার কোন গুণের কমতি দেখা দিয়েছে, যে কারণে তাঁরা তা করছেন না অথবা করতে পারছেন না।

সমাজকে সঠিক পথে পরিচালনা করার দায়িত্ব শিক্ষিত সমাজের। তাঁরা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে সমাজ মূর্খদের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে বাধ্য। সুতরাং সমাজকে যথাযথ পথে পরিচালিত করতে হলে ওলামাগণের সমাজের সকল কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা জরুরী।

‘ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা’। আল্লাহ তা’আলা স্বীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে আমাদের জন্য শরীয়তের যে বিধান দিয়েছেন তা পূর্ণাঙ্গ এবং চূড়ান্ত। পূর্ণাঙ্গ বা সম্পূর্ণ জীবন ব্যবস্থার মধ্যে জীবনের কোন দিকই বাকি থাকে না, আবার পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার মধ্যে কোন কিছু যোগ-বিয়োগেরও প্রয়োজন হয় না। পূর্ণাঙ্গ বলেই এতে অন্য কোন কিছুর প্রবেশের স্থান নেই। যেমন একটি পূর্ণ পানি ভর্তি গ্ল¬াসে অন্য কোন জিনিষ প্রবেশ করালে সে গ্ল¬াস হতে প্রবেশ করানো বস্তুর আয়তন পরিমাণ পানি বের হয়ে যাবে, ঠিক একই ভাবে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার মধ্যে অন্য কোন নিয়ম-কানুন প্রবেশ করালে প্রবেশকৃত নিয়ম-কানুন ঐ সময়ের ইসলামের নিয়ম-কানুনকে বের করে দেবে। আমরা যখন টেবিল-চেয়ারে বসে খেয়ে থাকি তখন খাওয়ার সময়ে বসার যে সুন্নাত তরিকা তা আমাদের নিকট হতে চলে যায়। সুতরাং চেয়ারে বসে টেবিলে রেখে খাওয়া জায়েয বলায় বর্তমানে সুন্নাত তরিকায় বসে খাওয়া সমাজ থেকে উঠে গিয়েছে।

ইসলাম সম্বন্ধে সর্বাধিক জ্ঞান ওলামাগণের। সুতরাং ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হওয়ায় এ জীবন ব্যবস্থার সর্বদিকের নেতৃত্ব ওলামাগণের নিকটই থাকার কথা। কিন্তু হচ্ছে তার বিপরীত। বর্তমানে সমাজকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে একেক ভাগের দায়িত্ব ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ তথা মূর্খ লোকদের হতে তুলে দেয়া হয়েছে। দেশ পরিচালনার কাজ এক দলের হাতে, আইন তৈরির কাজ আরেক দলের হাতে, চিকিৎসা ব্যবস্থা অপর আরেক দলের হাতে, বিচার ব্যবস্থা আরেক দলের হাতে, শিক্ষা ব্যবস্থা অন্য আরেক দলের হাতে। এভাবে সমাজকে বিভিন্ন ভাগে বিভিক্ত করে সমাজের সর্বোচ্চ জ্ঞানে জ্ঞানী ওলামা সমাজের হাত হতে সর্বদিকের নেতৃত্ব ছিনিয়ে নিয়ে শুধু মসজিদ এবং গুটিকতেক মাদ্রাসায়ে তাদেরকে আবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।  

রাজনীতি বলতে আমরা যা বুঝে থাকি তা হলো, সরকার কোন নীতিতে পরিচালিত হলে জনগণের নিকট সর্বোচ্চ উপকার পৌঁছানো যাবে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং জনগণকে সে নীতিতে সম্পৃক্ত করে দেশ পরিচালনার যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করে সে নীতির প্রতিফলন ঘটানো।

‘রাজনীতি’ কথাটির মধ্যে দু’টি শব্দ আছে। ‘রাজ’ ও ‘নীতি’ মিলে ‘রাজনীতি’। ‘রাজ’ বলতে সকল বড় বা শ্রেষ্ঠ বিষয়কে বোঝানো হয়ে থাকে। বড়, উন্নত, শ্রেষ্ঠ বিষয়ের সঙ্গে রাজ শব্দ যোগ করা হয়ে থাকে। যেমনÑ রাজপুরুষ, রাজবাড়ি, রাজহাঁস, রাজপথ ইত্যাদি। নীতির মধ্যে যে নীতি শ্রেষ্ঠ তা-ই রাজনীতি। সুতরাং দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে যে নীতি বা আদর্শ শ্রেষ্ঠ তাকেই রাজনীতি বলা যায়। অন্যকোন নীতিকে রাজনীতি বলা যাবে না। রাজনীতি হতে হলে নীতির মানদন্ডে তা শ্রেষ্ঠ হতে হবে। ইসলামের নীতি সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন হতে পাওয়া। সুতরাং ইসলামের নীতি-ই সর্বশ্রেষ্ঠ নীতি এবং এটি-ই হলো রাজনীতি।

যদি রাজার নীতিকে রাজনীতি বলা হয়ে থাকে তবে তাকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বিবেচনা করেই রাজা বলা হয়ে থাকে। ইসলামিক ব্যবস্থায় শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকেই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। সুতরাং একমাত্র ইসলামিক ব্যবস্থায়ই রাজার নীতিকে রাজনীতি বলা যেতে পারে।

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। সাহাবীগণ তাঁরই অনুসরণ করেছেন এবং তাঁরাই রাজনীতি করেছেন। বর্তমানের ওলামাগণ সেই রাজনীতির জ্ঞান রাখেন, কিন্তু তারা এ নীতি নিয়ে সমাজে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য এগিয়ে আসেছেন না। যার কারণে মুর্খতার নীতি সমাজে রাজনীতির নামে স্থান করে নিয়েছে।

আইন প্রণয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সুতরাং একাজের জন্য প্রয়োজন সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানীগণের । যে ক্ষেত্রে মানুষকে সামান্যই জ্ঞান দান করা হয়েছে সে ক্ষেত্রে মানুষ কিভাবে ঐশীজ্ঞানকে এড়িয়ে শুধু মানবীয় জ্ঞানের উপর নির্ভর করে নিজেদের সমস্য সমাধারে জন্য বিধি-বিধান তথা আইন তৈরি করার সাহস করে?

চক্ষু ভালো থাকলেই মানুষ দেখেনা। দেখার জন্য চক্ষুর সঙ্গে আরো একটি জিনিসের প্রয়োজন হয়, তা হলো বাহিরের আলো। একই ভাবে প্রকৃত জ্ঞানী হতে হলে প্রয়োজন অন্তর চক্ষের সঙ্গে ঐশীজ্ঞানের আলো। ঐশীজ্ঞানই সঠিক জ্ঞান এবং এ জ্ঞানের আলো মানুষকে সঠিক পথ দেখায়। এ আলো যাদের নিকট নেই তাদের নিকট অনেক বিষয়ই অন্ধকার। এদের বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে এরশাদ করেছেন,

তারা বধির, বোবা, অন্ধ, তারা পথে আসবে না। (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮)

তারা বধির, বোবা, অন্ধ; এ জন্যে কোন কথা তারা বুঝতে পারে না। (সুরা বাকারা : আয়াত ১৭১)

সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রব্বুল আ’লামীনের সিদ্ধান্তে যারা বধির, বোবা, অন্ধ তাদের উপর মানবের জীবন বিধান তৈরীর দায়িত্ব কোন বুদ্ধিমান জ্ঞানী ব্যক্তিগণ অর্পণ করতে পারেন না। সৃষ্টিকর্তার নীতিকে এড়িয়ে মানুষ নিজে নিজের জীবন বিধান, তথা আইন তৈরি করে সে অনুসারে জীবন পরিচালনা করলে তাতে তাদের ধ্বংস অনিবার্য। সুতরাং আইন তৈরির বিষয়টি ওলামাগণের দায়িত্ব ছিল, কিন্তু তাঁরা তা করতে পারছেন না।

চিকিৎসা ব্যবস্থায় মানুষের মানবীয় চিন্তা ও গবেষণালব্ধ রোগের ঔষধ যা কয়েক যুগ আগেও কার্যকর বলে গ্রহণ করা হতো তার অনেকগুলোই উপকারের চেয়ে অপকার বেশী করেছে বলে বর্তমানে বাতিল ও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অপরদিকে আল্লাহ রব্বুল আ‘লামীন কুরআনে বলেছেন ,

“মক্ষিকার পেট হতে রঙ-বেরঙের পানীয় নির্গত হয়, তাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিকার। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।” (সূরা আন-নাহল: আয়াত ৬৯)

আল্লাহ রব্বুল আলামীন যাকে রোগের প্রতিকার বলেছেন তা যে কত বড় প্রতিকার সে বিষয়টি কি মানুষের ভেবে দেখা উচিত নয়? এ প্রতিকার আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন কোনো নির্দিষ্ট রোগের সঙ্গে সর্ম্পক যুক্ত করেনি। সুতরাং মধু সর্বরোগের প্রতিকার বলে গ্রহণ করা উচিত।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে কোনো এক সাহাবী তাঁর ভাইয়ের অসুখের বিবরণ দিলে তিনি তাকে মধু পান করানোর পরামর্শ দেন। দ্বিতীয় দিনও এসে আবার সাহাবী বললেন, অসুখ পূর্ববৎ বহাল রয়েছে। তিনি আবারও একই পরামর্শ দিলেন। তৃতীয় দিনও যখন সংবাদ এলো যে, অসুখের কোনো পার্থক্য হয়নি, তখন তিনি বললেন, ‘আল্লাহর উক্তি নিঃসন্দেহে সত্য, তোমার ভাইয়ের পেট মিথ্যাবাদী। উদ্দেশ্য এই যে ওষুধের দোষ নেই। রোগীর বিশেষ মেজাজের কারণে ওষুধ দ্রুত কাজ করেনি। ’ এরপর রোগীকে আবার মধু পান করানো হয় এবং সে সুস্থ হয়ে উঠে। (তফসীরে মাআরিফুল কুরআন, সৌদি সরকার কর্তৃক মুদ্রিত, পৃষ্ঠা নং ৭৪৭ )

ঐশী শিক্ষায় মধুকে মানুষের রোগের প্রতিকার বলা হয়েছে, সুতরাং মধু কোন কালেই মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকারক বলে বিবেচিত হবে না। যদি কেউ ক্ষতিকারক বলে বিবেচনা করে থাকেন তবে বুঝতে হবে তার জ্ঞান পরিপক্ক নয়। কারণ সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা’আলা যা বলেছেন তার কোন কিছুই ভুল হতে পারে না।

রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালল্লাম এরশাদ করেছেন,

তোমাদের উপর দুটি বস্তু দ্বারা চিকিৎসা লাভ করা কর্তব্য, আর তা হলো মধু ও কুরআন মজিদ। (ইফাবা কতৃক প্রকাশিত তাফসীরে ইবনে কাছীর, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২৭)

হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, এক লোক রাসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমতে এসে নিবেদন করল, ‘আমার বুকে কষ্ট পাচ্ছি।’ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘কুরআন পাঠ কর।’

এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালল্লাম-এর খেদমতে এসে জানালো, ‘আমার গলায় কষ্ট হচ্ছে।’ তিনি তাকেও একথাই বললেন, ‘কুরআন পড়তে থাক।’ (ইফাবা কতৃক প্রকশিত তফসীরে মা‘আরিফুল কুরআন, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৯৮)

সূরা মু‘মিনূনের সর্বশেষ আয়াত নং ১১৫-১১৮ এর ফযীলত সম্পর্কে উল্লেখ আছে

আল্লাম বগভী ও সা‘লাবী রহ. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ এর একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, একবার তিনি জনৈক রোগাক্রান্ত ব্যক্তির কানে এই আয়াতসমূহ পাঠ করলে সে তৎক্ষণাৎ আরোগ্যলাভ করে। রসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে জিজ্ঞাস করলেন, ‘তুমি তার কানে কি পাঠ করেছ?’ তখন রসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘সে আল্লাহর কসম, যার হাতে আমার প্রাণ, যদি কোনো বিশ্বাসী ব্যক্তি এই আয়াতগুলো পাহাড়ের উপর পাঠ করে দেয়, তবে পাহাড় তার স্থান থেকে সরে যেতে পারে।’ (তফসীরে মাআরিফুল কুরআন, সৌদি সরকার কতৃক মুদ্রিত, পৃষ্ঠা নং ৯২৪)

ইমাম তিরমিযী রহ. আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণনা করেছেন যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সুরা ফাতেহা প্রত্যেক রোগের ঔষধবিশেষ। হাদিস শরীফে সুরা আল-ফাতিহাকে সুরায়ে শেফাও বলা হয়েছে। -(কুরতুবী)

আবদুল্লাহ্ ইবন আবু শায়বা রা. … খালিদ ইবনে সা‘দ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনিবলেন, ‘আমরা (যুদ্ধের উদ্দেশ্যে) বের হলাম। আমাদের সঙ্গে ছিলেন গালিব ইবন আবজার। তিনি পথে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এরপর আমরা মদীনায় আসলাম। তখনও তিনি অসুস্থ ছিলেন। তাঁকে দেখাশুনা করতে আসেন ইবন আবু আতীক। তিনি আমাদের বললেন, তোমরা এই কালোজিরা সঙ্গে রেখো। এ থেকে পাঁচটি কিংবা সাতটি দানা নিয়ে পিষে ফেলবে, তারপর তন্মধ্যে যায়তুনের কয়েক ফোঁটা তৈল ঢেলে দিয়ে                                       তার নাকের এদিক-ওদিকের ছিদ্র পথে ফোটা ফোটা করে ঢুকিয়ে দেবে। কেননা, আয়েশা রা. আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন,

এই কালোজিরা‘সাম’ব্যতীত সকল রোগের ঔষধ। আমি বললাম, ‘সাম’কি জিনিস? তিনি বললেন, ‘সাম’ অর্থ মৃত্যু। (সহীহ বুখারী)

কুরআন শরীফে এবং বিভিন্ন হাদিস শরীফে বর্ণিত ঔষধের বিষয় ওলামাগণের জ্ঞানে আছে। কিন্তু তাঁরা এসকল ঔষধ প্রয়োগ করে মানুষের চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করছেন না। বরং অনেকক্ষেত্রে তাঁরা নিজেরাও ইসলাম সম্পর্কে যারা অজ্ঞ তাদের নিকটই নিজেদের চিকিৎসার দায়িত্ব অর্পণ করছেন। সুতরাং চিকিৎসা ব্যবস্থা ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ লোকজনের হাতে চলে গিয়েছে।

বিচারের নীতি যা ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে পারে তা-ও ওলামা সমাজের জানা আছে। আমরা জানি নি¤œ আদালতকে উচ্চ আদালতের নির্দেশ ও নীতি অনুসরণ করতে হয়। বিচার দিবসের মালিক আল্লাহ তা‘আলা; যিনি সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক তাঁর আদেশ সকলকে মানতে হয়। এ কথা শুধু ওলামাগণ জানেন। ওলামাগণই সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ-নির্দেশের জ্ঞান রাখেন। মাওলানা রুমী বলেছেন,

শেষ ফলের প্রতি লক্ষ্য রাখে যেই চোখ সেই চোখই সঠিক দেখায় সক্ষম হয়। যেই চোখ শুধু উপস্থিত এবং উপরে উপরে দেখে ঐ চোখ প্রবঞ্চনা ও ভ্রমে পতিত হয়। (মছনবী শরীফ)

প্রতিটি কাজের শেষ ফলের প্রতি লক্ষ্য করে কাজ করার মধ্যে ঊভয় জীবনের সফলতা নির্ভর করে। বিচারক যদি তার বিচারকার্যের শেষ ফলাফলের দিকে লক্ষ্য রেখে বিচারকার্য সম্পাদন করেন তবে-ই ন্যায় বিচার নিশ্চিত হতে পারে। একমাত্র ওলামগণই পারেন শেষ বিচার দিবসে তার নিজের কার্যের ফলাফলের দিকে লক্ষ্য রেখে পৃথিবীতে বিচার কার্য সম্পাদন করতে।

সমাজে ওলামাগণই সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। যিনি নিজের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রব্বুল আ’লামীনকে চিনতে পারেন না তার যত জ্ঞানই থাকুক না-কেন তিনি মূর্খ ছাড়া আর কিছুই নন। যারা আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন কে চিনতে পারেন না তাদের নিয়ন্ত্রণে শিক্ষা ব্যবস্থা চলে গেলে সে ব্যবস্থায় আরও মূর্খ তথাকুরআন শরীফের ভাষায় বধির, বোবা ও অন্ধ জন্মলাভ করবে। যে শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষের চরিত্র সুন্দর করেনা তা প্রকৃত শিক্ষা নয়। কারিগরী বা টেকনিক্যাল শিক্ষা মানুষকে শিক্ষিত করে না, এদ্বারা পার্থিব বস্তুকেন্দ্রিককোন বিষয়ে জ্ঞান দেয়া হয় মাত্র। এ শিক্ষা মানুষকে প্রকৃতভাবে শিক্ষিত করে না। সুতরাং শিক্ষা ব্যবস্থা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত ওলামাগণের নিয়ন্ত্রণে থাকা জরুরী।

অর্থনীতি তথা ব্যবসা-বাণিজ্যে যে নীতির প্রয়োজন হয় তা-ও ওলামাগণের জ্ঞানের মধ্যে সর্বাধিক বিদ্যমান। ইহকাল এবং পরকালের বিষয় বিবেচনায় রেখে একমাত্র ওলামাগণই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কোন ব্যয় অপব্যয় এবং কোনটি অপব্যয় নয়।

আল্লাহ্ তা’আলা কুরআন শরীফে এরশাদ করেন,

হে বনী আদম! প্রত্যেক সালাতের সময় সুন্দর পরিচ্ছদ পরিধান কর। আহার কর ও পান কর, কিন্তু অপব্যয় কর না। নিশ্চয় তিনি অপব্যয়কারীকে পছন্দ করেন না। (সূরা আ‘রাফ, আয়াত ৩১)

ওলামাগণ অপব্যয় হতে মুক্ত। তাদের জীবন সাদাসিদা। সুতরাং তারা অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশী অবদান রাখতে সক্ষম। ব্যবসা ক্ষেত্রে বিক্রিত মাল ফেরত গ্রহণ করলে কি লাভ শুধু ওলামাগণই অনুধাবন করতে পারেন। দ্রব্যের দোষ-ত্র“টি প্রকাশ করে ব্যবসা করা তাদের পক্ষেই সম্ভব, যেহেতু পরকাল সর্বক্ষণ তাদের সম্মুখে থাকে।

কারিগরী বা টেকনিক্যাল শিক্ষা ওলামাগণের না থাকায় নির্দিষ্ট বিষয়ে শ্রমিক হওয়ার যোগ্যতা তাঁদের না থাকতে পারে, কিন্তু সমাজের সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা ওলামাগণেরই আছে। মানুষের চরিত্রের যত ভালগুণ আছে তা একমাত্র তাদের শিক্ষায়ই দেয়া হয়ে থাকে। আর নেতৃত্বের জন্যই প্রয়োজন উন্নত চরিত্র। বস্তুবাদী শিক্ষা মানুষের চরিত্র নিয়ে মাথা ঘামায় না। বস্তুগত উন্নতি এর প্রধান উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। এ জ্ঞান দ্বারা মানুষের নেতৃত্ব দেয়া চলে না। নেতৃত্ব দেয়ার জন্য চারিত্রিক যেসকল গুণাবলী প্রয়োজন তার সবই একমাত্র ওলামাগণের আছে। সমাজের উন্নতির জন্য সর্ব ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেয়ার গুণ ওলামাগণের থাকাসত্ত্বেও তারা সামাজের নেতৃত্বে আসতে পারছেন না। কেন এমন হচ্ছে তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে। সত্যের আগমনে মিথ্যা বিতারিত হওয়ার কথা। কিন্তু কেন সমাজে সত্যের আগমন ঘটছে না?

ইসলাম ধর্ম হলো সেই সরল পথ যার জন্য প্রার্থণা করতে বলা হয়েছে। হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, একদা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি সরল রেখা টেনে বললেন, এটা আল্লাহর পথ। অতঃপর এর ডানে বামে আরও কতক রেখা টেনে বললেন, এ সকল পথের প্রত্যেকটিতে আছে একেক জন শয়তান, যারা লোকদেরকে কুমন্ত্রণা দিচ্ছে ‘এ পথে আস, এটা সত্য পথ’। (মিশকাত শরীফ)

আমরা জানি একটি সরলরেখার উপর আরো একটি সরলরেখা টানতে হলে ঐ রেখার উপর দিয়েই সম্পূর্ণটা টানতে হবে, অন্যথায় ঐ সরলরেখার মতো সরল হবে না। কোন স্থানে একটু বাঁকা হলেই পরবর্তীতে মূল সরল রেখা হতে এর ব্যবধান ক্রমেই বাড়তেই থাকবে। যত দূরে যাবে ততই ব্যবধান বাড়বে। এক সময় দেখা যাবে মূল রেখার সঙ্গে নতুন আঁকা রেখার আর কোন মিলই নেই। একইভাবে হুবহু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণ করা না হলে ইসলাম এবং মুসলমাদের মধ্যে দূরত্ব ক্রমশঃ বাড়তেই থাকবে এবং এক সময় দেখা যাবে মুসলমান এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দেখানো দীনের মধ্যে আর কোন সম্পর্কই নেই। একই কারণে বর্তমানে ইসলাম এবং মুসলমানদের মধ্যেও প্রচুর দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।

শরীয়তের একটি নীতি হল, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা করে গেছেন বা আদেশ দিয়ে গেছেন, তা করা যেমন সুন্নাত, তেমনি তিনি যা করেননি বা আদেশ দেননি তা না করাও সুন্নাত; এবং এটিই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্যিকারের অনুসরণ।

কেহ কোন নমুনা বা মডেল প্রস্তুতকারককে দিয়ে যদি বলেন এই নমুনা বা মডেল অনুসারে মাল তৈরি করে দিতে হবে তবে প্রস্তুতকারক সে মডেল অনুযায়ী মাল তৈরি করে দিলে তা গ্রহণ করা হবে। একই ভাবে আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন শরীয়তের জন্য নমুনা বা মডেল হিসাবে হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেছেন,

নিশ্চয়ই তোমাদের জন্যে রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালল্লাম এর মধ্যে উত্তম অনুপম আদর্শ রয়েছে। (সূরা আল আহ্যাব, আয়াত ২১)

হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা দেখিয়েছেন তাকে আল্লাহ রব্বুল আলামীন স্বয়ং বলছেন ‘উত্তম অনুপম আদর্শ’। সুতরাং যখনই কেহ নমুনাকে অনুসরণ না করে নতুন কিছুকে অনুসরণ করার জন্য প্রেরণা দেবে তখনই বুঝতে হবে যে এটা শয়তানের পদাংঙ্ক।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শরীয়তের এমন কোন বিধান দেখিয়ে দেননি যা কোন যুগে বা কোন স্থানে পালন অসম্ভব। কারো কোন এবাদতের বিষয়ে মাজুরী (অক্ষমতা) অবস্থা দেখা দিলে তখন কি করতে হবে তার বিধানও শরীয়তের মধ্যে আছে। স্থান ও কালের ব্যবধানের কারণে কেহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সময়ে দেখিয়ে যাওয়া শরীয়ত অনুসারে কোন কাজ করতে না পারলে তা তার ব্যক্তিগত মাজুরী (অক্ষমতা) হিসাবে গণ্য হতে পারে। কিন্তু তাই বলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সময়ে যা নাজায়েয ছিল বর্তমানে স্থান ও কালের ব্যবধানে তা জায়েয হয়ে যাবে সেটা বিবেচনা করা সমীচীন হবে না। এ রকম কিছু করা হলে প্রকারান্তরে এটাই বুঝানো হবে যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দেখিয়ে যাওয়া শরীয়তের বিধান সর্বকালের ও সর্বযুগের উপযোগী ছিল না (নাউযুবিল্লাহ)।

কোন ব্যক্তি বিশেষের মাজুরীর (অক্ষমতার) বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ঢালাওভাবে সবার জন্য নাজায়েয বিষয়কে জায়েয বলা উচিত হচ্ছে কিনা তা বিবেচনা করে দেখা উচিত। শরীয়তে সূদ নাজায়েয, ঘুষ নাজায়েয, ছবি তোলা নাজায়েয। ইত্যাদি অনেক বিষয় আছে যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সময় যেমন নাজায়েয ছিল বর্তমানেও নাজায়েয থাকারই কথা। কিন্তু বর্তমানে আমাদের সমাজে সুদ, ঘুষ, ছবি তোলা ইত্যাদি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়ে জায়েয সুদ ও নাজায়েয সুদ, জায়েয ঘুষ ও নাজায়েয ঘুষ, জায়েয ছবি ও নাজায়েয ছবিতে পরিণত হয়েছে। যেমন অনেক ওলামায়ে কেরাম ফতোয়া দিয়েছেন প্রভিডেন্ট ফান্ডের সুদ নেয়া জায়েয, নিজের হক আদায় করতে কুকুরের মুখে হাড় দেয়ার মত ঘুষ দেয়া জায়েয, পাসর্পোটের ছবি তোলা জায়েয। মাজুরীর (অক্ষমতার) অবস্থা কোন ব্যক্তি বিশেষের জন্য যা জায়েয তা ঢালাওভাবে সবার জন্যে জায়েয বলা কি সমীচীন।

বর্তমানে মুসলমানগণ জায়েয বিষয়গুলোই পালন করতে চান। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাতের প্রতি তেমন আগ্রহ দেখান না। এর মূল কারণ হল বর্তমান ওলামাগণের অনেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি করেছেন এবং সাহাবাগণকে কি করতে বলেছেন তা না বলে কি জায়েয এবং কি নাজায়েয তা বলছেন। জায়েয-নাজায়েয ভাগ না করে রাসূল সালল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি করেছেন এবং সাহাবাগণকে কি করতে বলেছেন তা বলে দিলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাতের প্রতি মুসলমানগণের আগ্রহ সৃষ্টি হতে পারত।

অনেক সময় কারো ব্যক্তিগত সুবিধার দিক বিবেচনা করেই অনেক বিষয় জায়েয বলা হয়ে থাকে, কিন্তু এর মন্দের দিক বিবেচনাই করা হয় না। দীর্ঘদিন আমল করার পর এর ক্ষতির দিক ধরা পড়ে। তখন দেখা যায় মুসলমানগণ এ নাজায়েয বিষয়য়ের উপর আমল করে তাতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। এ অবস্থায় ক্ষতি থাকা সত্ত্বেও এ নাজায়েয বিষয় কেহ ছাড়তে রাজি হন না।

লক্ষ্য রাখতে হবে,

উপকার হাসিল করার চেয়ে ক্ষতি রোধ করাকে অগ্রাধিকার দেয়া বিধেয়। অর্থাৎ কোন একটি কাজে কিছু উপকার হয়, আবার ক্ষতিও হয়, এক্ষেত্রে ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে লাভ ত্যাগ করতে হবে। এমন উপকার সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য, যা ক্ষতি বহন করে। (সূত্র:- তফসীরে মাআরিফুল কুরআন; ১ম খণ্ড, সূরা আল-বাকারাহ এর ২১৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা; পৃষ্ঠা ৫৯৬ )

যুগের সঙ্গে বা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শরীয়তের বিধানের পরিবর্তনের কোন সুযোগ নেই। সমাজের অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শরীয়তের বিধানের মধ্যেও পরিবর্তন সাধন করার চিন্তা করাই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাধ্যমে প্রচারিত শরীয়তকে পরোক্ষভাবে অস্বীকার করা। এরকম কিছু পরিবর্তন করার কোন অনুমতি বা সুযোগ আল্লাহ্ তা’আলা এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে প্রদান করেননি।

হযরত আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমার সকল উম্মত জান্নাতে যাবে, ঐসমস্ত লোক ব্যতীত যারা অস্বীকার করবে। সাহাবা (রাযি.) জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলুুল্লাহ! (জান্নাতে যেতে) কে অস্বীকার করতে পারে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাবে এরশাদ করলেন, যে ব্যক্তি আমার অনুসরণ করল সে জান্নাতে দাখিল হল। আর যে ব্যক্তি আমার নাফরমানী করল অবশ্যই সে জান্নাতে যেতে অস্বীকার করল। (বোখারী) {সূত্র:-মুন্তাখাব হাদীস (নির্বাচিত হাদীস); মূল: হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ কান্ধলভী (রহ.) বাংলা অনু: হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ যুবায়ের ছায়েব গং; প্রথম প্রকাশ:জিলকদ, ১৪২২ হি. মাঘ, ১৪০৮ বাং; পৃষ্ঠা ৮৬; হা.নং ৯৭}

মানুষ সরাসরি পাপ কাজ করলে তা পাপ বলে বুঝতে পারে এবং কোন এক সময় সে তওবা করে ফেলে। ইবলিস গুনাহ ও অপরাধ দ্বারা মানুষের কোমর ভেঙ্গে দেয়, আর মানুষ তওবা ইস্তেগফার দ্বারা শয়তানের কোমর ভাঙ্গে। সুতরাং জায়েযের ছুরতে নাজায়েয কাজ করলে মানুষ তওবা করার প্রয়োজন মনে করে না। সাধারণত জায়েয কাজকে কেউ পাপ মনে করে না। সুতরাং সুদ, ঘুষ, ছবি ইত্যাদি জায়েয হয়ে গেলে এর জন্য তওবা করার বা এর থেকে বিরত থাকার কোন তাগিদ কারো মনে অনুভূত হয় না। ফলে সমাজ হতেও একে উচ্ছেদের কোন চেষ্টা করা হয় না।

যেসকল বিষয়ে শরীয়তের নাজায়েযকে জায়েয বলা হচ্ছে তা বিধর্মীদের নিকট হতে মুসলমান সমাজে এসেছে। বর্তমানে মুসলিম প্রধান দেশে নতুন কোন বিষয় চালু করতে হলে প্রথমে বৃটেন ও আমেরিকাতে তা কিভাবে করা হচ্ছে তার খবর নেয়া হয়ে থাকে এবং তাদের অনুকরণে সে কাজটি শুরু করা হয়। যদি এর বিপরীতে কাজটি কোন মুসলিম প্রধান দেশ প্রথম শুরু করত এবং অন্যেরা তা তাদের নিকট হতে গ্রহণ করত, তবে কাজটি শরীয়ত সম্মতভাবে করা হত। তখন নাজায়েযকে জায়েয করা প্রয়োজন দেখা দিত না। মুসলমান সারা বিশ্বের মানুষের কাছে সকল কাজের নমুনা হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা না হয়ে বর্তমানে মুসলমারা অন্যান্য জাতিকে তাদের নমুনা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। সেকারণে নাজায়েযকে জায়েয করতে হচ্ছে।

নামাযের বিষয়ে ¬রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের ছালাতকে ঠিক ঐ ভাবে সম্পাদন করবে যেভাবে আমাকে ছালাত সম্পাদন করতে দেখেছ। ’(মুসলিম শরীফ ও বেখারী শরীফ)

রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ভাবে নামায পড়েছেন এবং সাহাবীগণকে যে ভাবে নামায শিক্ষা দিয়েছেন এবং সাহাবীগণ যে ভাবে নামায পড়েছেন সেভাবেই নামায পড়া উচিত ছিল।

মাইকে আযান এবং নামায বর্তমানে জায়েয হয়েছে। কিন্তু রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবীগণের সময় কি ছিল? যুগের পরিবর্তনে আযান ও নামাজের নিয়মেরও পরিবর্তন হয়েছে। আযানের স্থান পরিবর্তন হয়েছে, নামাযে মোকাব্বির প্রথা উঠে গিয়ে মাইক এর স্থান দখল করে নিয়েছে। নামাযের অনুষ্ঠান সুন্দর করার দিকে খেয়াল করা হচ্ছে, কিন্তু তা কতটুকু কবুলিয়তের যোগ্যতা রাখছে তার খেয়াল করা হচ্ছে না।

রসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সময় মাইক ছিল না। সুতরাং রসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে মাইক ব্যবহার করেননি। এতে কেয়ামত পর্যন্ত আসা উম্মতের জন্যে নামাযে মাইক ব্যবহার না করাটাই সুন্নাত হিসেবে থাকবে। কেউ যদি মনে করেন যে, তখন মাইক আবিস্কার হয় নাই বলে রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা ব্যবহার করেনি। মাইক যদি এবাদতের মান বাড়াতো তবে মাইক আস্কিারের পর আল্লাহ তা’আলা রসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে পৃথিবীতে প্রেরণ করতেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীগণের চেয়ে বর্তমান উম্মত মাইকে নামায পড়ে বেশী মান ওয়ালা নামায পেয়েছে ধরণা করাও পাপ হবে।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তেকালের পূর্বে শনি অথবা রবিবার দিন কিছুটা সুস্থ বোধ করেন। অতএব দু’জন লোকের কাঁধে ভর দিয়ে যোহরের নামাযের জন্যে মসজিদে যান। সে সময় হযরত আবু বকর রা. সাহাবীদের নামায পড়াচ্ছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখে তিনি পেছনে সরে আসতে লাগলেন। তিনি ইশারা করলেন, পেছনে সরে আসার দরকার নেই। যাঁদের কাঁধে ভর দিয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে গিয়েছিলেন তাঁদের বললেন, আমাকে আবু বকরের পাশে বসিয়ে দাও। এরপর তাঁকে আবু বকরের ডান পাশে বসিয়ে দেয়া হয়। হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. তখন নামাযে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একতেদা করছিলেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে তাকবীর শোনাচ্ছিলেন। (সূত্র: আর রাহীকুল মাখতূম, আল্লামা ছফিউর রহমান মোবারকপুরী, আল কুরআন একাডেমী লন্ডন কতৃক প্রকাশিত। )

অসুস্থ হলে অনেকের চেয়ারে বসে টেবিলে সেজদা করার প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। এর পেছনে অনেক সময় চিকিৎসকের নির্দেশও থাকে। নির্দেশদাতা চিকিৎসকের কুরআন হাদিসের জ্ঞান আছে কিনা সে বিষয়ে কোন খোঁজ নেয়ার প্রয়োজনই মনে করা হয় না। বর্তমানে মসজিদে চেয়ার নিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসে নামায আদায় করার প্রবণতা দিন দিন বেড়ে চলেছে, এবং এর প্রবণতা সম্পদশালী এলাকার মসজিদগুলোতে বেশী। সংক্রামক রোগের মত তা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

‘হযরত আবু হোরায়রা রা. একদিন পেটের ব্যথার দরুন উপুড় হয়ে শুয়েছিলেন, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, পেটে কি ব্যথা হচ্ছে? তিনি উত্তর করিলেন, জী হ্যাঁ। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরশাদ করলেন, উঠে নামাজ পড়। কারণ নামাজে শেফা রয়েছে। -(ইবনে কাছীর)

এ থেকে দেখা যায় পেটের ব্যথার কারণে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা সত্ত্বেও হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উঠে নামাজ পড়ার জন্য বললেন। শুয়ে শুয়ে নামায পড়ার জন্যে বলেন নি। এ রকম অবস্থা হলে আমরা আদর দেখিয়ে বলতাম, উঠে নামায পড়া কষ্ট হবে, শুয়ে শুয়ে পড়ে নাও, তা জায়েয আছে, নয় কি?

নামাযের সময় আল্লাহর সম্মুখে বিনয় ও নম্রতার সাথে নামাযের কেয়াম, রুকু, সেজদা, বসা ইত্যাদির কাজ করা হয়ে থাকে। দাঁড়ানো ও বসার যে তরিকা আছে তা খুবই বিনয়ের সাথে হয়। কিন্তু কেউ চেয়ারে বসে নামাজ পড়লে সে বিনয়ের বসা হয় না। চেয়ারে বসা বিনয়ের প্রকাশ ঘটায় না, বরং এটা অনেক সময় অহঙ্কারের প্রতীক হয়ে থাকে। সুতরাং অসুস্থতার সময় চেয়ারে বসে টেবিলে সেজদা করে নামাজ পড়া জায়েয আছে বলা হলে মানুষ সামান্য অসুস্থতায় জায়েয কাজের উপর আমল করা শুরু করে দেয়। দেখা যায় অনেকে দাঁড়িয়ে হেঁটে মসজিদে আসছেন, কিন্তু মসজিদে এসে চেয়ারে বসে বসেই নামাজ পড়ছেন।

হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উম্মতের জন্যে আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন সমগ্র দুনিয়াকে মসজিদ করে দিয়েছেন এবং পৃথিবীর মাটিকে পাক বানিয়েছেন। মসজিদ কর্তৃপক্ষ নামাযীদের নামাযের জন্য সামর্থ অনুসারে মসজিদে সুন্দর ব্যবস্থাই করে থাকেন। তারপরও অনেক মুসল্লি¬ আছেন যারা নিজের জন্যে পৃথক জায়নামায নিয়ে আসেন। সমাজে সম্মান, পদমর্যাদা, সম্পদ ইত্যাদির কারণে এরকম পৃথক জায়নামায মসজিদে নিয়ে আসা এবং তাতে নামায আদায় করার প্রচলন হয়েছে। কিন্তু এর পরিণাম কি দাঁড়াচ্ছে তা আমরা খতিয়ে দেখছিনা।

মসজিদে সকলেই আল্লাহ্ তা‘আলার গোলাম। জাতি, গোত্র, বংশ, পদমর্যাদা, সাদা-কালো, ধনী-গরিব, রাজা-প্রজা, মালিক-গোলাম এর কোন পার্থক্য আল্লাহ রব্বুল আলামীনের নিকট নেই এবং তাঁর মসজিদেও নেই। আল্লাহর নিকট মানুষের পার্থক্য হয় তাকওয়া এবং পরহেজগারীর ভিত্তিতে। আল্লাহর ঘরে পৃথিবীর ইজ্জত, সম্মান, পদ, সম্পদ ইত্যাদির পার্থক্য তৈরী করা বা দেখানো নামাযের উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে। মসজিদে একজন পৃথক জায়নামাযে নামায পড়লে এবং একজন মসজিদের ব্যবস্থার উপর পাশাপাশি নামায পড়লে দু’জনের মধ্যে পার্থক্য হয়ে গেল। এতে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করা হয়। ইসলাম হল সহজ সরল ব্যবস্থা। সুতরাং মসজিদে কোন রকম পার্থক্য সৃষ্টিকারী ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত নহে। ওলামাগণের এ বিষয়ের প্রতি কি লক্ষ্য করা জরুরী নহে।

সমাজে একটি গল্প আছে এভাবে, এক শয়তান একটি দোকানে গুড়ের টিন হতে সামান্য গুড় দেয়ালে লাগিয়ে দিল। এতেই তার শয়তানী কাজ হয়ে গেল। বাকী কোন কাজ আর তার করতে হলো না। তার বাকী কাজ মানুষেরাই সমাধা করল। গুড়ের স্বাদ পেয়ে পিপিলিকা এসে সেখানে জমায়েত হলো। পিপিলিকাকে দেখে সেখানে টিকটিকিরা এলো। টিকটিকি দেখে সেখানে বিড়াল এলো। বিড়াল দেখে কুকুর এলো। বাকী যা হবার তা হয়ে গেল বিড়াল এবং কুকুরের স্বভাব অনুসারে তারা ঝগড়ায় লেগে গেল। তাদের ঝগড়ায় দোকানের কেরোসিনের টিন পড়ে গেল এবং তাতে কুপি বাতি পড়ে গিয়ে আগুন লেগে সমস্ত দোকান পুড়ে গেল। এক্ষেত্রে ঘটনার মূল হল দেয়ালে গুড় লাগানো।

দেয়ালে গুড় লাগানো একটি ক্ষুদ্র বিষয়; কিন্তু এর কারণে কত বড় ঘটনা সংঘটিত হল। এরকম ছোট ছোট কাজ যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসা¬ল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামগণ করেননি সেসব কাজকে জায়েযে পরিণত করা হলে এর উপর ভিত্তি করে মুসলিম সমাজে বড় বড় পাপ নির্দ্বিধায় বহাল থাকবে।

শরীয়তের পরিপন্থী কোন বিষয়ে ইসলামের আপোষ চলেনা এবং আপোষের কোন সুযোগও নেই। মক্কার কাফেরগণ রাসূলুল্লাহ সালল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসা¬ল্লাম-এর নিকট আপোষের প্রস্তাব দিয়ে বলে, এক বৎসর তাদের উপাস্যদের এবাদত করবে এবং এক বৎসর তারা তাঁর উপাস্যের এবাদত করবে। তখন সূরা কাফিরূন নাযিল হয়। এতে আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলে দিলেন, “বলুন হে কাফেরকূল, আমি এবাদত করি না তোমরা যার এবাদত কর। এবং তোমরাও এবাদতকারী নও যার এবাদত আমি করি, এবং অমি এবাদতকারী নই যার এবাদত তোমরা কর। তোমরা এবাদতকারী নও যার এবাদত অমি করি । তোমাদের কর্ম ও কর্মফল তোমাদের জন্যে এবং আমার কর্ম ও কর্মফল আমার জন্য। ” এতে কাফেরদের ক্রিয়াকর্মের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ এবং আল্লাহ তা‘আলার অকৃত্রিম এবাদতের আদেশ আছে। এ অবস্থায় অনৈইসলামিক জীবন ব্যবস্থার সঙ্গে মুসলমানগণের এবাদতের বিষয়ে কোন আপোষ নেই। আপোষহীনতাই ইসলামী জীবন ব্যবস্থার একটি বড় বৈশিষ্ট্য। মুসলমানগণের স্বকীয়তা আছে। নিজের জীবনে আপোষহীনভাবে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রয়োগ করা না হলে এ স্বকীয়তা কিছুতেই রক্ষা করা সম্ভব নয়।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামগণ তৎকালীন আরব সমাজের উল্টো পরিবেশের সঙ্গে আপোষ না করার কারণেই ইসলামী ব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল। একইভাবে হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ধর্মের বিষয়ে তাঁর জাতির সঙ্গে আপোষ করেননি। সে জন্য তাঁকে আগুনে নিক্ষেপ পর্যন্ত করা হয়েছিল। যত নবী রাসুল পৃথিবীতে আগমন করেছেন সকলেই তখনকার সমাজের সঙ্গে আপোষহীনভাবে ধর্মের বাণী প্রচার করেছেন এবং নিজেও এর উপর আমল করেছেন। সুতরাং সকলকেই কমবেশী তৎকালীন সমাজের নির্যাতন-নিপীড়ন লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে। বর্তমানে ওলামাগণ সমাজ ব্যবস্থার সাথে আপোষ করে চলছেন বলেই নাজায়েয বিষয়কে দু’ভাগে বিভক্ত করে জায়েয এবং নাজায়েয করা হচ্ছে। আপোষহীনভাবে নাজায়েযকে নাজায়েয বললে সমাজের সঙ্গে তাদের যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হত এবং এর পরিণামে যে নির্যাতন-নিপীড়ন তাঁদের উপর নেমে আসত তা থেকে তাঁরা রক্ষা পাচ্ছেন। কিন্তু নবী সাহাবীগণ-তো সমাজের দ্বন্দ্ব এবং নির্যাতন-নিপীড়নের ভয়ে হকের বিষয়ে কোন আপোষ করেননি। সে কারণেই উল্টো পরিবেশেও সত্য প্রতিষ্ঠিত হতে বাধ্য হয়েছিল।

বর্তমানেও ইসলামের সত্য এবং হক প্রতিষ্ঠিত করতে হলে ওলামাগণের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের ঈমানের পরিচয় দিয়ে হাত এবং মুখ দিয়ে নাজায়েযের মোকাবেলা করা প্রয়োজন। মসজিদ এবং মাদরাসায় নিজেদেরকে আবদ্ধ রেখে শুধু অন্তর দিয়ে ঘৃণা করলে চলবে না। দোয়া করিআল্লাহ ত’আলা আমাদের সকলকে প্রথম শ্রেণীর ঈমানদার হওয়ার তওফিক দান করুন ।

লেখক:

সাবেক জেলা জজ ও সাবেক মহাপরিচালক, দুর্ণীতি দমন কমিশন (দুদক)

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *