ইসলাম চর্চার দৈন্যদশা!

মুফতী হাফিজুর রহমান

লীলাবতীর মৃত্যু। হুমায়ূন আহমেদের একটি আলোচিত গ্রন্থ। গ্রন্থটিকে একটি ছোট সংকলন বলা চলে। এতে লেখকের আত্মজীবনীমূল কিছু গল্পও পরিবেশিত হয়েছে। নবিজী, লীলাবতির মৃত্যু, মানব এবং দানব নারিকেল-মামা, শিকড় মহেশের মহাযাত্রা সহ হুমায়ুন আহমেদ এর বেশ কিছু ছোটগল্পের সংকলন। কিছু গল্প লেখকের আত্মজিবনীমুলক! নবিজী পর্বে তিনি নবী জীবনী নিয়ে কথা বলেছেন। আবশ্যিক ক্রমে নবীকন্যাদের নিয়েও কথা এসেছে। নবীকন্যাদের নিয়ে তার উপস্থাপনা বিভ্রান্তিকর। তিনি লিখেছেন,

নবীজী তাঁর দ্বিতীয় ও তৃতীয় কন্যা রুকাইয়া ও কুলসুমকে বিয়ে দিয়েছিলেন আবু লাহাবের দুই পুত্রের সঙ্গে। একজনের নাম উৎবা, অন্যজনের নাম উতাইবা। দুই বোনকে একসঙ্গে না। রুকাইয়াকে প্রথমে। রুকাইয়ার মৃত্যুর পর কুলসুমকে।

অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যা রুকাইয়া রাযি. এর ইন্তিকাল হয়েছে একজন কাফেরের বিবাহাধীন থাকাবস্থায়! বিস্ময়কর তথ্য ! কোত্থেকে আহরণ করলেন তিনি এ তথ্য ? অথচ ইতিহাস বলছে, সূরা লাহাব অবতীর্ণোত্তর কালে তাঁদের উভয়ের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর উসমান রাযি. এর সাথে রুকাইয়া রাযি. বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দ্বিতীয় হিজরী সনে রুকাইয়া রাযি. এর ইন্তেকাল হলে তৃতীয় হিজরীতে উম্মে কুলসুম রাযি.ও উসমান রাযি. এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

তো দেখা যাচ্ছে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উভয় কন্যাই উসমান রাযি. এর সাথে বিবাহাধীন থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ সাহেব আমাদের কি তথ্য দিলেন? রুকাইয়া রাযি. এর মৃত্যুর পর আবূ লাহাব পুত্রের সাথে উম্মে কুলসুম রাযি. এর বিবাহ হয়েছিল- এমন আকাশ কুসুম বিস্ময়কর তথ্য তিনি কোথায় পেলেন? তিনি লিখেছেন ‘কুলসুম’। অথচ নবী কন্যার উপনাম হল ‘উম্মে কুলসুম’। দুটি শব্দের মাঝে ব্যবধান আকাশ পাতাল।

অনুসন্ধানে জানা গেলো, হুমায়ূন আহমেদ তার এ লেখনীতে ইংরেজি অনূদিত গ্রন্থ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক দুধমাতার নাম লিখেছেন ‘থুয়াইবা’। মূল নাম হল ছুয়াইবা। আরবী বর্ণমালা ث ছা’কে ইংরেজিতে th দিয়ে লেখা হয়। আর th এর উচ্চারণ ‘থ’ও হয়। তাই তিনি এটা লিখে দিয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদের অনুবাদ নির্ভর ইসলাম চর্চার আরেকটি নমুনা দেখার সুযোগ হয়েছিল অনেক আগে। ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের ২৭ অক্টোবর প্রথম আলোতে তাঁর একটি ছাপা হয়েছিল। সেখানে তিনি লিখেছেন,

আমাদের মহানবী (সা.) কাবা শরীফের ৩৬০টি মূর্তি অপসারণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। দেয়ালের সব ফ্রেসকো নষ্ট করার কথাও তিনি বলেন। হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি পড়ল কাবার মাঝখানের একটি স্তম্ভে। যেখানে বাইজেন্টাইন যুগের মাদার মেরির একটি অপূর্ব ছবি আঁকা। নবীজী (সা.) সেখানে হাত রাখলেন এবং বললেন- এই ছবিটি তোমরা নষ্ট করো না।

আরো লিখেছেন,

মহানবীর (সা.) ইন্তিকালের পরেও ৬৮৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ধর্মপ্রাণ খলিফাদের যুগে কাবা শরিফের মতো পবিত্র স্থানে এই ছবি ছিলো।

হুমায়ূন আহমেদ সাহেব তার এ ইতিহাসের রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন, দি লাইফ অব মুহাম্মাদ। আরব ইতিহাসবিদ ইবনে ইসহাকের সীরাত বিষয়ক গ্রন্থের অনুবাদ হিসেবে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে বইটি প্রকাশিত হয়। অনুবাদক আলফ্রেড গিয়োম। হুমায়ূন আহমেদের চিত্র বিষয়ক হাদীস জানা থাকলে ইতিহাসটা নিয়ে একটু ভাবতেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী কারণে কাবা শরীফের ভিতর প্রাণীর ছবি রেখে তাতে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশের পথ রুদ্ধ করে দিবেন ?

বস্তুত ইবনে ইসহাক রহ. নবী চরিত বিষয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন। কিন্তু তার সেসব রচনার কিছুই অবশিষ্ট থাকেনি। তার মৃত্যুর পর তার ছাত্র যিয়াদ আল-বাক্কা‘য়ী রহ. তার রচনাগুলো সম্পাদনা করে আবার লেখেন। কিন্তু সেগুলোও পরে নষ্ট হয়ে যায়। পরে বাক্কা‘য়ী রহ. এর ছাত্র ইবনে হিশাম সেসব রচনা পুনরায় সম্পাদনা করে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী গ্রন্থের রূপ দান করেন। ইবনে হিশাম সম্পাদিত সে রচনাই আজ সীরাতে ইবনে হিশাম নামে পরিচিত।

ইবনে ইসহাক রহ. এর অপর ছাত্র সালামা ইবনে ফযলও বাক্কা‘য়ী রহ. এর ন্যায় ইবনে ইসহাক রহ. এর রচনা সম্ভার সম্পাদনা করেছিলেন। কিন্তু সেগুলোও কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। এরপর সালামা রহ. এর ছাত্র ইবনে জারীর তাবারী রহ. সেগুলো পুনঃসম্পাদনা করেন। ইবনে জারীর রহ. সম্পাদিত রচনাই আজ তারীখে তাবারী নামে পরিচিত। তবে ইবনে হিশাম রহ. তার সম্পাদনা কালে ইবনে ইসহাক রহ. এর ভিত্তিহীন বর্ণনাগুলো বাদ দেন এবং আরো কিছু নির্ভরযোগ্য বর্ণনা সংযুক্ত করেন। আর ইবনে জারীর রহ. সম্পাদনা কালে ইবনে ইসহাক রহ. এর অধিকাংশ বর্ণনা উল্লেখ করেন এবং নিজেও অনেক বর্ণনা সংযুক্ত করেন। এতে তিনি ইবনে হিশাম রহ. এর মত এতটা সতর্কতা অবলম্বন করেননি।

এদিকে আলফ্রেড গিয়োম ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে তারীখে তাবারী এবং সীরাতে ইবনে হিশাম থেকে কেবল ইবনে ইসহাক রহ. এর বর্ণনাগুলো সংকলন করে এবং আরো কিছু বর্ণনা সংযুক্ত করে দি লাইফ অব মুহাম্মাদ নামের অনূদিত গ্রন্থটি তৈরি করেন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে তা ২০০৩ ও ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে পুনঃমুদ্রিত হয়। ইবনে ইসহাক রহ. এর জীবনী গ্রন্থের দুই দিকপাল ইবনে জারীর রহ. ও ইবনে হিশাম রহ. কেউই মাদার মেরির ছবি বিষয়ক বর্ণনাটি উল্লেখ করেননি। আলফ্রেড গিয়োম বিতর্কিত লেখক আযরাকী রচিত আখবারে মক্কা থেকে বর্ণনাটি উল্লেখ করেছেন। আখবারে মক্কা হল অপাংক্তেয় বর্ণনার এক বিস্তীর্ণ পাগাড়। মাদার মেরির চিত্র বিষয়ক বর্ণনাটি সেসব বর্ণনার অন্যতম।

উপরন্তু আমাদের বিশ্লেষণ মতে আলফ্রেড গিয়োমের ইংরেজি অনুবাদের বঙ্গানুবাদ করতে গিয়ে হুমায়ূন আহমেদ সাহেব আযরাকীর সে বর্ণনার মাঝে চরম অস্বচ্ছতার পরিচয় দিয়েছেন। মূলত হুমায়ূন আহমেদ নিশিকালীন জালানি সংগ্রাহকের ন্যায় হাতের নাগালে যা পেয়েছেন তাই তুলে দিয়েছেন। সেগুলো জালানি না সর্প তা নির্ণয় করে দেখার আগ্রহ বোধ করেননি। সুতরাং আলফ্রেড গিয়োম অনূদিত গ্রন্থটি বিধর্মীদের নবী বিদ্বেষী মনোভাবের প্রকৃষ্ট উদাহরণ বৈ কিছুই নয়। আমাদের ভাবতেও অবাক লাগে, এত বড় মাপের একজন লেখক হয়েও তিনি কিভাবে কোন ধরনের বিচার বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে বিধর্মীদের নবী বিদ্বেষী লেখা থেকে বর্ণনা গ্রহণ করলেন?

হুমায়ূন আহমেদের মত আজকাল অনেক শিক্ষিত, জ্ঞানী-গুণী, ডক্টর-ডাক্তাররাও অনুবাদ নির্ভর ইসলাম চর্চা করে থাকেন। বরং এর মাত্রা দিন দিন বেড়ে চলছে। কেউ কেউ তো ইংরেজি অনূদিত বই পড়ে রীতিমত গবেষক(?) হওয়ার খেতাবও অর্জন করেছেন। কিন্তু তাদের গবেষণাগুলোতে হুমায়ূন আহমেদের চেয়েও আরো মারাত্মক প্রমাদ দৃষ্টিগোচর হয়। ইসলাম চর্চা সব ভাষায়ই করা যায়। এতে ইসলামে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে কোন বইয়ে প্রকৃত ইসলাম জানা যাবে তা ধর্ম নিয়েই যাদের কর্ম তারাই ভালো জানেন। হুমায়ূন আহমেদও যদি এমন মারাত্মক দু’টি অদ্ভুত ইতিহাসের ব্যাপারে এসব বিষয়ে জানা শোনা কারো শরণাপন্ন হতেন তবে তিনি এমন ভুলের শিকার হতেন না। তাই আমাদেরও এ বিষয়ে সচেতনতা জরুরী।

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *