মুফতী হাফিজুর রহমান
বর্তমানে বিবাহকেন্দ্রিক বহুল প্রচলিত গায়ে হলুদ প্রথাটি একটি হিন্দুধর্মীয় প্রথা। মুসলিম সভ্যতা সংস্কৃতির সাথে গর্হিত এ সংস্কৃতির সামান্যতম সম্পর্ক নেই। গায়ে হলুদ সম্বন্ধে সংসদ বাংলা অভিধান বলছে, গায়ে-হলুদ, বিবাহের অব্যবহিত পূর্বে পাত্রপাত্রীকে হলুদ মাখাইয়া স্নান করানর হিন্দু সংস্কার বিশেষ। পৃ. ১৬৯। কেউ কেউ প্রথম সারীর সাহাবী আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রা. এর হলুদ বর্ণ সংশ্লিষ্ট ঘটনা দ্বারা প্রচলিত গায়ে হলুদ প্রথাকে বৈধ বলতে চেষ্টা করেন। আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রা. এর ঘটনাটি নিম্নরূপ :
একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রা. এর সাক্ষাৎ হলো। তখন তাঁর দেহে হলুদ সুগন্ধির চিহ্ন ছিলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কি ব্যাপার আব্দুর রহমান ! তখন আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রা. বললেন, আল্লাহর রাসূল ! আমি এক আনসারী নারীকে বিবাহ করেছি। সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৯৩৭
উপরোক্ত ঘটনার আলোকে প্রচলিত গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানকে বৈধতা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ প্রচলিত গায়ে হলুদ প্রথার সাথে উক্ত ঘটনার সামান্যতম সম্পর্ক নেই। কারণ,
১। সাহাবীর গায়ে লেগে থাকা দ্রব্যটি ছিলো মূলত সুগন্ধি দ্রব্য, যেটা জাফরান বা জাফরান ও অন্যান্য দ্রব্যের সংমিশ্রণে প্রস্তুত করা হতো।
২। হাদীসে যে হলুদ বর্ণের উল্লখ রয়েছে তা ছিলো মূলত এ জাফরান ও অন্যান্য সুগন্ধি দ্রব্যের চিহ্ন।
৩। হলুদ সুগন্ধির ব্যবহারটা ছিলো বাসর রাতকেন্দ্রিক।
৪। জাফরান সংশ্লিষ্ট এ সুগন্ধি আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রা. নিজে ব্যবহার করেন নি। বরং সেটা তাঁর স্ত্রীর ব্যবহার করা রং থেকে তাঁর দেহে বা পোষাকে লেগেছিলো। কারণ হাদিসে পুরুষের জন্য জাফরান রং ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা এসেছে। সহীহ মুসলিম, হাদিস ২১১০। প্রথম সারির একজন সাহাবী নববী নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করবেন তা কল্পনাও করা যায় না। ইমাম বদরুদ্দীন আইনী রহ.ও এ বক্তবটি উল্লেখ করেছেন। উমদাতুল কারী ১৭/২৩৮
৫। হিন্দু ধর্মাবলম্বীগণ দীর্ঘস্থায়ী বিবাহিত জীবন, বংশবিস্তার, নবদম্পতির সুখ-শান্তি কামনা এবং অপশক্তির প্রভাব দূর করতে ধর্মীয় আবশ্যকীয় রীতি হিসেবে এ গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। যা স্পষ্ট শিরক।
৬। বস্তুত হিন্দুধর্মালম্বী ও আদিবাসী উপজাতীদের থেকেই গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের উৎপত্তি হয়েছে। সেখান থেকে মুসলিম সমাজে এর অনুপ্রবেশ ঘটেছে। মুসলিম সংস্কৃতিতে গায়ে হলুদের অবস্থান কোনো কালেই ছিলো না।
বাংলা পিডিয়া বলছে, বর-কনের দাম্পত্য জীবনকে যেকোনো ধরনের অকল্যাণ বা অপশক্তির অনিষ্ট থেকে মুক্ত রাখার কামনা থেকেই এসব লোকাচার পালন করা হয়। গায়ে হলুদ এ সবেরই একটি এবং এটি মূলত একটি মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান, যা প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত। হিন্দুসমাজে এ লোকাচার গাত্রহরিদ্রা বা অধিবাস নামে অভিহিত। বৈদিক যুগ থেকে ভারতীয় হিন্দুসমাজে গাত্রহরিদ্রা বা অধিবাস বিয়ের অনুষ্ঠানের অবশ্য পালনীয় শাস্ত্রাচার ও লোকাচার হিসেবে পালিত হয়ে এসেছে। বিয়ের এ রীতিগুলি মূলত মঙ্গোলীয় এবং অন্যান্য আদিবাসী উপজাতির নিকট থেকে গৃহীত। তবে বৈদিক আর্যদের আচার-অনুষ্ঠানের প্রভাবও এতে পরিলক্ষিত হয়। গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো বিয়ের তিনদিন, পাঁচদিন অথবা সাতদিন আগে বর ও কনের গায়ে হলুদ এবং অন্যান্য মাঙ্গলিক দ্রব্য মাখানো। হলুদ একদিকে পবিত্রতার প্রতীক, অন্যদিকে প্রসাধনী হিসেবেও উৎকৃষ্ট। আধিভৌতিক ও অপশক্তির প্রভাব দূর করতে হলুদ অত্যন্ত কার্যকর বলে একটি বিশ্বাস প্রচলিত আছে। এসব কারণেই গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের প্রচলন হয়েছে। গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে হলুদ ছাড়াও অন্যান্য উপকরণ ব্যবহূত হয়, যার মধ্যে রয়েছে ধান, দুর্বা, তিল, যব, সরিষা, মাষকলাই, সোন্দা, মেথি, গিলা, সুঁট, চন্দন, সিঁদুর, মেহেদি, মিষ্টি, মাছ, পঞ্চপ্রদীপ প্রভৃতি। এগুলির সবই সৌভাগ্য ও প্রজননের প্রতীক। দীর্ঘস্থায়ী বিবাহিত জীবন, বংশবিস্তার ও নবদম্পতির সুখশান্তি কামনাই এ অনুষ্ঠানের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য। বাংলাপিডিয়া ৪/৪৩-৪৪
বস্তুত কোনো কোনো হাদীস গ্রন্থে হলুদ বর্ণের বিষয়টি উল্লিখিত হলেও তা ছিলো মূলত জাফরান। মুসনাদে আহমাদের ১৩৮৯০ নম্বর হাদীসে জাফরান শব্দটির সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। আর যেসব হাদীসে হলুদ বর্ণের কথা উল্লিখিত হয়েছে সেখানে হলুদ বর্ণ দ্বারা নিরেট হলুদ বর্ণ উদ্দেশ্য নয়। কারণ হাদীসের দুর্লভ শব্দভাণ্ডার সম্বন্ধে প্রাজ্ঞ মুহাদ্দিসীনে কেরামের বক্তব্য মতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্দুর রহমান বিন আউফ রা. এর দেহে যা দেখেছিলেন, তা জাফরান দ্বারা তৈরিকৃত সুগন্ধি ছিলো। আলফায়িক ফি গরীবিল হাদীস ৩/২০৮, আততামহীদ ১/১৮০
আল্লামা নববী রহ. হলুন বর্ণের ব্যাখ্যায় বলেন, তা ছিলো জাফরান বা অন্য কোনো সুগন্ধি, যা বাসর রাতকে কেন্দ্র করে ব্যবহৃত হতো। শরহে মুসলিম, ৯/২১৬ সারকথা প্রচলিত গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানকে বিধানিক রূপ কোনো সুযোগ নেই।