হাফিজুর রহমান
সারসংক্ষেপ
মানুষের জীবন ধারণের জন্য সম্পদ হলো প্রধানতম উপকরণ। জন্ম থেকে মৃত্যুবধি মানব জীবন সম্পদের উপর নির্ভরশীল। সুখময় জীবন ধারণের নিমিত্ত আল্লাহ মানুষকে সম্পদগত অনুগ্রহ জলে সিক্ত করেছেন। সম্পদ নির্ভর এ সুখময় জীবনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো স্রষ্টার সন্তুষ্টি সাধন। সহজ ও সাবলিল জীবন ধারণ করে একজন মানুষ যেন তার স্রষ্টা বিধিকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনায়াসে বাস্তবায়িত করতে পারে তার জন্যই মহামহিম কর্তৃক ধনৈশ্বর্যের এ অফুরন্ত আয়োজন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহকে সম্পদের ব্যবহার প্রণালী হাতে কলমে শিখিয়ে দিয়েছেন। কুরআন হাদীসের ছত্রে ছত্রে সম্পদ ব্যবহারের নীতি-বিধান প্রজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছে। সম্পদের আয় ব্যয়ে একজন মুসলিমকে কুরআনিক বিধি নিষেধগুলোকে আবশ্যিকরূপে মেনে চলতে হয়। কারণ সম্পদ উপার্জনে কালো আইন গ্রহণ করা হলে সে সম্পদ হারাম ও নিষিদ্ধ সম্পদের রূপ পরিগ্রহ করবে। হাদীসের বাণী মতে এ নিষিদ্ধ সম্পদই চাওয়া পাওয়া পূরণ ও জান্নাত প্রাপ্তির পথে প্রধানতম অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে সম্পদ ব্যবহারেও ইসলামের রয়েছে নিয়ন্ত্রণ বিধি। সম্পদ ব্যবহারে অনিয়ম হলে পরকালে রয়েছে তার জন্য চরম জবাবদিহিতা। সুতরাং ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিকসহ সর্ব ক্ষেত্রেই সম্পদ উপার্জন ও ব্যবহারের কুরআনিক মূলনীতিকে অনুসরণ করে চলতে হবে। আয় উপার্জনে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রবাহিত হবে জীবনমুখী শান্তি সুখের ফল্গুধারা।
মূলশব্দ : ধন-সম্পদ, মালিকানা স্বত্ব, ইসলামী আইন।
ভূমিকা
বিশেষ একটি উপলক্ষকে কেন্দ্র করে পৃথিবী নামের ছোট্ট এ গ্রহটিতে মানব সৃষ্টির সূচনা হয়েছে। মানুষের জীবন ধারাকে সচল রাখার নিমিত্ত আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন প্রয়োজনীয় যাবতীয় উপায় উপকরণ। মানুষ তার যাপিত জীবনে প্রতি মুহূর্তের প্রয়োজন পূরণে যেসব মাধ্যমের দ্বারস্থ হয় তাকেই আমরা সম্পদ নামে অভিহিত করি। এ সম্পদ মানব জীবন সচল ও সজীব রাখার প্রধানতম উপকরণ। এ সম্পদ ব্যবহারের চূড়ান্ত লক্ষ হলো, সম্পদ দাতা মহান স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন। ব্যবহারিক জীবনে সম্পদ ব্যবহারের আল্লাহপ্রদত্ত নীতিমালা অনুসরণ করতঃ কুরআন সুন্নাহর যাবতীয় নির্দেশনা পালন করেই মানুষকে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির কুসুমাস্তীর্ণ পথে চলতে হবে। নতুবা ইহকালীন এবং পরকালীন জীবনে নেমে আসবে মহামহিমের অসন্তুষ্টির বিষম খড়গ।
বস্তুত সমগ্র বিশ্বলোকে যা কিছু আছে সব কিছুর একচ্ছত্র মালিকানা স্বত্ব একমাত্র বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহর। তাঁর এ স্বত্তাধিকারে কারো কোনো অংশিদারিত্ব নেই। আল্লাহ বলছেন, মহাকাশ ও ভূমিতে যা কিছু আছে সব আল্লাহরই। আল্লাহর নিকটই সবকিছু প্রত্যানীত হবে। (Al-Quran 3:109 )| আকাশ ও পৃথিবীর চির স্বত্তাধিকার একমাত্র আল্লাহরই। (Al-Quran 3:180)। নিঃসন্দেহে পৃথিবী আল্লাহর। তিনি তাঁর ভৃত্যকুলের মধ্য হতে যাকে চান তাকে তার উত্তরাধিকারী করেন। (Al-Quran 7:128)। আল্লাহ তোমাদেরকে যে সম্পদ দিয়েছেন তা হতে তাদেরকে (অভাবীদেরকে) দান করো। (Al-Quran 24:33 )| মহাবিশ্ব ও পৃথিবীর চাবিকাঠি কর্তৃত্ব তাঁরই হাতে। তিনি যাকে ইচ্ছা তার জীবিকা বর্ধিত করেন। আর যাকে ইচ্ছা তার জীবিকা সীমিত করেন। তিনি সর্ববিষয়ে সবিশেষ অবহিত। (Al-Quran 42:12 )|
মূলগতভাবে সকল সম্পদ আল্লাহর। তিনিই এর মালিকানা স্বত্বের ধারক। মানুষ হলো আল্লাহ প্রদত্ত সে সম্পদের আমানতদার তথা বিশ্বস্ত ধারক। আল্লাহ বলেন, আমি পৃথিবীতে প্রতিধি নিয়োগকারী। (Al-Quran 2:30 )|
আল্লাহ মানুষকে এ পৃথিবীর প্রতিনিধিরূপে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং সম্পদের মালিকানার ক্ষেত্রে মানুষ প্রতিনিধি মাত্র। প্রতিনিধি ব্যক্তি মূল কর্তার চাহিদার বিপরীতে কাজ করার অধিকার রাখে না। প্রতিনিধিকে মূল মালিকের যাবতীয় বিধি নিষেধকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হয়। আর যে জিনিসের উপর ব্যক্তির ইচ্ছা বা চাহিদা চলে না সে তার মালিক হতে পারে না। মানুষের প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারটি অন্য আয়াতে আরো পরস্কিারভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে। আল্লাহ বলেন, তিনি ওই সত্তা যিনি তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি বানিয়েছেন। (Al-Quran 35:39 )|
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, আল্লাহ তোমাদেরকে যা কিছুর প্রতিনিধি করেছেন তা হতে ব্যয় করো। (Al-Quran 57:7 )|
মানুষকে আল্লাহ অনুগ্রহ করে এ সম্পদ দান করেছেন। সম্পদের সাথে দিয়েছেন সম্পদের বণ্টন ও ভোগ ব্যবহারের নিয়ম নীতি। সে সম্পদ বিধিকে পূর্ণাঙ্গরূপে অনুসরণ করেই মানুষকে সম্পদের প্রতিনিধি ধারক হতে হবে। সম্পদের আয় ও ব্যয়ে স্বেচ্চারিতা করার অধিকার আল্লাহ মানুষকে দেন নি। আল্লাহ মানুষকে একমাত্র তার বৈধ প্রয়োজন পূরণের জন্যই সম্পদ দান করেছেন। এর অন্যথা করার সুযোগ তার জন্য রাখা হয় নি।
সম্পদ পরিচিতি
সম্পদের সংজ্ঞা বা পরিচয় কি এ বিষয়ে বিশিষ্টজনদের কলম থেকে নানা ধরনের মত অভিমত উঠে এসেছে। আধুনিক অর্থশাস্ত্রে সম্পদের জন্য চারটি বৈশিষ্ট্যকে আবশ্যক গণ্য করা হয়- (১) উপযোগিতা (২) অপ্রাচুর্যতা (৩) হস্তান্তরযোগ্যতা (৪) বাহ্যিকতা। অর্থাৎ আধুনিক অর্থবিদ্যায় যেসব বস্তু সামগ্রীর উপযোগ ও বিক্রয় যোগ্যতা আছে এবং যেগুলোর যোগান সীমাবদ্ধ সেসব দ্রব্য সামগ্রীই সম্পদ হিসেবে পরিগণিত। অন্য একটি সংজ্ঞা মতে যেসব দ্রব্যের আর্থিক মূল্য রয়েছে তাই অর্থশাস্ত্রে সম্পদ বলে বিবেচিত। তবে অর্থ বিষয়ক পাঠ্যপুস্তকে সম্পদের সংজ্ঞায় সংকীর্ণতা লক্ষগোচর হলেও বর্তমানের অর্থনীতির পরিভাষায় সম্পদের সংজ্ঞায় বেশ ব্যাপকতা লক্ষণীয়। বায়ু, গ্যাস বিদ্যুৎ সৌর শক্তিসহ বিভিন্ন শক্তির মত অস্পৃশ্য বিষয়ও আজ সম্পদের মর্যাদা লাভ করেছে।
ইসলামী নীতি শাস্ত্রে সম্পদের প্রাচীন সংজ্ঞায় বেশ সংকীর্ণতা লক্ষ করা যায়। দৈর্ঘ প্রস্থ ভারসহ স্পর্শযোগ্য বস্তুনিচয়ই সেখানে সম্পদের শ্রেণীভুক্ত হওয়ার সুযোগ পেত। পরবর্তীতে এ সংজ্ঞায় বেশ ব্যাপকতা এসেছে। সম্পদের আরবী প্রতিশব্দ ‘মাল’ শব্দটির ধাতুগত অর্থ বেশ পরিচ্ছন্নভাবে এ ব্যাপকতাকে নির্দেশ করে। আরবী ‘মাল’ এর ধাতুগত অর্থ আকর্ষিত হওয়া, অবনমিত হওয়া, ঝুুঁকে পড়া। ধাতুমূলক এ অর্থ বিবেচনায় যেসব বিষয় মানুষের মাঝে আকর্ষণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় কিংবা যেসব বিষয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণবোধ তৈরি হয় তাই সম্পদ। অন্যদিকে পবিত্র কুরআনের ভাষ্য হলো,
ভূ-পৃষ্ঠের যাবতীয় কিছুই আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন। (Al-Quran 2:29)
এতে প্রতীয়মান হয়, ভূপৃষ্ঠে বিদ্যমান সবকিছুই মানুষের প্রয়োজন পূরণে কাজে আসে। অতএব ভূপৃষ্ঠের সবকিছুই সম্পদ হিসেব গণ্য হবে। তবে ইসলামী শরীয়ত ব্যপকতর এ সংজ্ঞার মাঝে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ বিধি আরোপ করেছে। অতি সম্মানজনক এবং অতি জঘন্যতম বিষয়কে আভিধানিক অর্থে ইসলামী শরীয়ত সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত দিলেও পারিভাষিক এবং মূল্য বিবেচনায় সেগুলোকে সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত দেয়নি। অতি সম্মানজনক অবস্থানের কারণে মানবদেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আভিধানিক অর্থে সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হলেও মূল্যমান বিবেচনায় এগুলো অমূল্য সম্পদ। এগুলোর মূল্যমান এতটাই সমৃদ্ধ ও প্রতুল যে এগুলোর মূল্য প্রদান করা মানুষের পক্ষে সাধ্যাতীত। তাই স্বাভাবিক এবং পারিভাষিক সম্পদের মত করে এগুলোতে লেনদেন করার অবকাশ ইসলামী শরীয়তে রাখা হয়নি। অন্যদিকে মদ শুকর প্রাণীর মরদেহ এগুলো এতটাই আবিলতাপূর্ণ ও জঘন্য প্রকৃতির যে এগুলো ন্যূনতম মূল্যের পর্যায়েও পড়ে না। তাই এগুলো আভিধানিক অর্থে সম্পদের পর্যায়ে পড়লেও পারিভাষিক অর্থে এগুলো সম্পদ বলে বিবেচিত নয়। ফলে এগুলোকে সম্পদের মত করে লেনদেন করার কোন সুযোগ নেই।
সম্পদের বিভাজন
সম্পদের বিভাজনের অন্ত নেই। অর্থনীতিবিদগণ নানা আঙ্গিকে সম্পদের বিভাজন এবং শ্রেণীভাগ দেখিয়েছেন। আলোচনার সুবিধার্থে নিম্নে আমরা সম্পদের কয়েকটি শ্রেণীভাগ উল্লেখ করছি।
মৌলিকতা বিবেচনায় সম্পদেরবিভাজন
মৌলিকতার বিচারে সম্পদ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত- (১) প্রাকৃতিক সম্পদ (২) কৃত্রিম সম্পদ।
(১) প্রাকৃতিক সম্পদ : প্রকৃতি আশ্রিত সকল শ্রেণীর সম্পদই প্রাকৃতিক সম্পদ। যথা জলবায়ু, বৃষ্টিপাত, মৃত্তিকা, নদ-নদী, কৃষিজ সম্পদ, খনিজ সম্পদ, খনিজ আকরিক, উদ্ভিদ, মৎস সম্পদ, বনজ সম্পদ, প্রাণী সম্পদ, সৌরশক্তি, প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, খনিজ তেল, চিনা মাটি, চুনাপাথর, নুড়িপাথর, গ-শিলা, কাঁচবালি, ইটের মাটি, পিট, সৈকত বালি, কঠিন শিলা, সিলিকা বালু, ইউরোনিয়াম, গন্ধক, ইত্যাদি। এ শ্রেণীর সম্পদ মানুষ সৃষ্টি করতে পারে না। তবে মানুষ তা আহরণ করে তার আঙ্গিকে বিবর্তন সৃষ্টি করে তাকে শৈল্পিক রূপ দিতে পারে। একটি দেশের উন্নয়নে প্রাকৃতিক সম্পদ এবং মানব সম্পদ পরিপূরক হিসেবে কাজ করে।
(২) কৃত্রিম সম্পদ : মানুষ তার মেধা শ্রমযোগে প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করে যেসব সামগ্রী তৈরি করে তাই কৃত্রিম সম্পদ। যথা- চেয়ার, টেবিল, কোদাল, পেনসিল, মোটর গাড়ি, ক্যালকুলেটর, এ্যারোপ্লেন ইত্যাদি।
মালিকানা স্বত্ব বিবেচনায়সম্পদের বিভাজন
মালিকানা বিবেচনায় সম্পদ পাঁচ শ্রেণীতে বিভক্ত- (১) ব্যক্তিগত সম্পদ (২) সমষ্টিগত সম্পদ (৩) রাষ্ট্রীয় সম্পদ (৪) জাতীয় সম্পদ (৫) আন্তর্জাতিক সম্পদ।
(১) ব্যক্তিগত সম্পদ : ব্যক্তির নিজস্ব মালিকানাধীন সম্পদই ব্যক্তিগত সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। ব্যক্তিমালিকানাধীন ভূমি-স্থাপনা, ফসলি জমি, গৃহসামগ্রী, শিল্প প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক স্থাপনা ও ব্যবসায়ী পণ্য প্রভৃতি-এসবই ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পদের শ্রেণীভুক্ত।
(২) সমষ্টিগত সম্পদ : জনস্বার্থে জনগণের স্বতস্ফূর্ত উদ্যোগে কিংবা প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় যেসব সম্পদ গড়ে উঠে তাই সমষ্টিগত সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। পথ-ঘাট, সাঁকো-ব্রিজ, মসজিদ-মাদরাসা, স্কুল-কলেজ, হাসাপাতাল ইত্যাদি এগুলো সবই সমষ্টিগত সম্পদের শ্রেণীভুক্ত। এজাতীয় সম্পদে সমাজের সকল মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত থাকে।
(৩) রাষ্ট্রীয় সম্পদ : যেসব সম্পদ বিশেষভাবে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং সেখান থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় জনস্বার্থে ব্যবহৃত হয় তাই রাষ্ট্রীয় সম্পদ বলে বিবেচিত। বিদ্যুৎ, গ্যাস, রেল, বিমান, রাষ্ট্রায়াত্তাধীন মিলকারখানা ইত্যাদি। এগুলো সবই রাষ্ট্রীয় সম্পদ বলে বিবেচিত।
(৪) জাতীয় সম্পদ : একটি দেশের ব্যক্তিক, নৈর্ব্যক্তিক সকল শ্রেণীর সম্পদের সমষ্টিকে জাতীয় সম্পদ বলে অভিহিত করা হয়। সুতরাং দেশের নাগরিকদের ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীনসহ সকল প্রকার সম্পদের সমষ্টিকেই জাতীয় সম্পদ হিসেবে গণ্য করা হবে।
(৫) আন্তর্জাতিক সম্পদ : এ মহাবিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যেসব সম্পদ কোন বিশেষ দেশ বা জাতির মালিকানাধীন নয়; বরং বিশ্বের সকল দেশ ও সকল জাতি সমান হারে তা থেকে সুবিধা লাভ করতে পারে তাই আন্তর্জাতিক সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। পৃথিবীর সাগর মহাসাগর, আন্তর্জাতিক নদ-নদী এবং আন্তর্জাতি প্রতিষ্ঠানসমূহ আন্তর্জাতিক সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত।
উৎপত্তিগত দিক থেকে সম্পদেরবিভাজন
উৎপত্তিগত দিক থেকে সম্পদ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত- (১) প্রাকৃতিক সম্পদ (২) উৎপাদিত সম্পদ (৩) মানবিক সম্পদ।
(১) প্রাকৃতিক সম্পদ : আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্ট প্রকৃতির যেসব বস্তু স্বয়ংক্রিয়ভাবে মানুষের প্রয়োজন পূরণ করে তাই প্রাকৃতিক সম্পদ বলে বিবেচিত। নদ-নদী, বনভূমি, খনিজ পদার্থ, সৌরশক্তি, জলবায়ু এসবই প্রাকৃতিক সম্পদের শ্রেণীভুক্ত।
(২) উৎপাদিত সম্পদ : প্রাকৃতিক সম্পদের মাঝে মানুষ তার বুদ্ধিমত্তা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করে যে সম্পদ সৃষ্টি করে তাকেই বলা হয় উৎপাদিত সম্পদ। যন্ত্রপাতি, ব্যবহার সামগ্রী, বিভিন্ন খাদ্য পণ্য, কলকারখানা, যানবাহন, পথঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎকেন্দ্র ইত্যাদি-এগুলোর সবই উৎপাদিত সম্পদের শ্রেণীভুক্ত।
(৩) মানবিক সম্পদ : মানুষের জ্ঞানিক বৈশিষ্ট্য এবং সৃজনশীল গুণাবলীকে মানবিক সম্পদ বলে অভিহিত করা হয়। স্বাস্থ্যগত ফিটনেস, প্রতিভা, দক্ষতা, উদ্যোগ, সাংগঠনিক ক্ষমতা ইত্যাদিকে মানবিক সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
প্রাকৃতিক সম্পদের শ্রেণীভাগ
প্রাকৃতিক সম্পদকে সাধারণত ৬ শ্রেণীতে ভাগ করা হয়- (১) কৃষি সম্পদ (২) খনিজ সম্পদ (৩) বনজ সম্পদ (৪) প্রাণীজ সম্পদ (৫) পানি সম্পদ (৬) বায়ু সম্পদ (৭) মৃত্তিকা সম্পদ (৮) শক্তি সম্পদ।
(১) কৃষি সম্পদ : ভূমি উৎকর্ষণ, চাষাবাদ, বপণ, রোপণ ইত্যাদি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে সব সম্পদ আহরণ করা হয় তাই কৃষি সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। ধান, পাট, আলু, গম ইত্যাদি কৃষি সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত।
(২) খনিজ সম্পদ : জল স্থলের তলদেশে মানুষের প্রয়োজন পূরণের জন্য মহান আল্লাহ তা‘আলা যেসব সম্পদ গচ্ছিত রেখেছেন তাকেই বলা হয় খনিজ সম্পদ। স্বর্ণ, রূপা, লোহা, তামা, তেল, গ্যাস, পেট্রোল, কয়লা, লবন, গন্ধক, চুনা পাথর, চীনা মাটি, কঠিন শিলা, সিলিকন বালুসহ বিভিন্ন রকমের ধাতব পদার্থ ও বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ খনিজ শিল্পের পরিধিভুক্ত।
(৩) বনজ সম্পদ : বনভূমি থেকে যেসব সম্পদ আহরণ করা হয় তাই বনজ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। পাহাড়ি বন, সমতলভূমির বন ও উপকূলীয় বনভূমি থেকে বনজ সম্পদ আহরণ করা হয়। বনজ দ্রব্যের মধ্যে রয়েছে চেরা কাঠ, গাছের খুটি, বাঁশ ইত্যাদি। বিজ্ঞানের থিউরি মতে প্রাকৃতিক পরিবেশকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে রাখা এবং মানুষের বাস উপযোগী করে রাখার জন্য মোট ভূখণ্ডের ২৫% ভাগ বনাঞ্চল থাকা একান্ত অপরিহার্য।
(৪) প্রাণীজ সম্পদ : মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণ এবং অন্যান্য প্রয়োজন পূরণের নিমিত্ত আল্লাহ তা‘আলা বিশ্বচরাচরে যেসব প্রাণী সৃষ্টি করেছেন তাই প্রাণীজ সম্পদ বলে বিবেচিত। মৎস, পশু পাখিসহ সকল প্রকার প্রাণীই প্রাণীজ সম্পদ বলে বিবেচিত।
(৫) পানি সম্পদ : প্রাণী এবং উদ্ভিদের জীবন চক্রকে সচল রাখার নিমিত্ত আল্লাহ তা‘আলা যে তরল উপাদান সৃষ্টি করেছেন তাই পানি সম্পদ বলে গণ্য। পূর্বোক্ত কৃষিজ, বনজ এবং প্রাণীজ সম্পদের অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে পানি সম্পদ মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। সাধারণত তিনটি উৎস থেকে পানি সম্পদ আহরণ করা হয়- (ক) বৃষ্টিপাত (খ) পুকুর, হাওড়, খাল-বিল, নদ-নদী, সাগর মহাসাগর (গ) ভূগর্ভস্থ জলভূমি।
(৬) বায়ু সম্পদ : পৃথিবীর জীববৈচিত্রকে সচল রাখার নিমিত্ত আল্লাহ তা‘আলা বায়ু নামের যে আবশ্যকীয় উপাদানকে সৃষ্টি করেছেন তাই বায়ু সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। সাময়িক সময়ের জন্য বায়ু প্রবাহ স্তিমিত হয়ে পড়লে এ বিশ্বচরাচর মুহূর্তের মধ্যে প্রাণহীন মরুভূমিতে পরিণত হতে বাধ্য। অন্যান্য সম্পদের মাঝে কর্তৃত্বের প্রতিযোগিতার মত বর্তমান বিশ্বে বায়ু সম্পদের মাঝেও কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা সাধনা চলছে।
(৭) মৃত্তিকা সম্পদ : মানুষ এবং স্থল প্রাণীর বসবাস ও উদ্ভিদ জগতের বংশ বৃদ্ধির লক্ষে আল্লাহ আল্লাহ তা‘আলা যে উপাদান সৃষ্টি করেছেন তাই মৃত্তিকা সম্পদ নামে বিবেচিত।
(৮) শক্তি সম্পদ : আল্লাহ তা‘আলা বিশ্বচরাচরে বিরাজমান বিভিন্ন উপাদানে অফুরন্ত শক্তির পসরা সাজিয়ে রেখেছেন। বিভিন্ন উৎস থেকে আহরিত শক্তির মাধ্যমেই সচল করে রাখা হয়েছে অধুনা যান্ত্রিক সভ্যতার চাকা। তাই আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতা বিকাশের পেছনে শক্তি সম্পদের রয়েছে বিস্ময়কর অবদান। এ যাবত মানুষ বেশ কিছু শক্তির আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছে। যথা, তাপশক্তি, বিদ্যুৎশক্তি, আনবিক শক্তি, সৌরশক্তি, চুম্বক শক্তি ইত্যাদি।
সম্পদের মালিকানা স্বত্ব
বিশ্বচরাচরে বিদ্যমান সকল প্রকার সম্পদই মহান আল্লাহ তা‘আলার অফুরন্ত দান। মানুষের প্রয়োজন পূরণে আল্লাহ তা‘আলা সবরকমের সম্পদের ব্যবস্থা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
তোমরা তাঁর নিকট যা কিছু কামনা করেছ তা তিনি তোমাদেরকে দান করেছেন। যদি তোমরা আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহসমূহকে গণনা করতে চাও তাহলে তার পরিসংখ্যান করে শেষ করতে পারবে না। (Al-Quran 14:34)
বস্তুত আল্লাহ প্রদত্ত মহাজগতের যাবতীয় সম্পদের প্রকৃত মালিকানা স্বত্ব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
নভম-ল ও ভূম-ল এবং তৎমধ্যবর্তী যা কিছু আছে সবকিছুর মালিকানা স্বত্ব এবং সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহর। তিনিই সর্ববিষয়ে শক্তিমান। (Al-Quran 5:127)
আর মানুষ হল সম্পদ ব্যবহারে তার প্রতিনিধি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
আল্লাহ তোমাদেরকে যা কিছুর উত্তরাধিকারী করেছেন তা হতে ব্যয় করো। (Al-Quran 57:7)
কিন্তু সম্পদের উপর যখন মানুষের সাময়িক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায় তখন সে এর নিগূঢ় মালিকানা স্বত্বকে বেমালুম ভুলে যায়। নিজেকে সম্পদের প্রকৃত স্রষ্টা ভেবে আমিত্ব ও অহংবোধের মরণঘাতি এক ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ফলে সূচিত হয় সম্পদকেন্দ্রিক যাবতীয় সামাজিক অনাচার ও অবিচার। অর্থনৈতিক এ অনাচরের প্রতিই আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে ইঙ্গিত করেছেন। শুআইব আ. যখন তাঁর সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক স্বেচ্চাচারিতার বিরুদ্ধে কথা বললেন, তখন তারা বলে উঠল,
হে শোআইব! তোমার সালাত কি আমাদের পিতৃপুরুষের উপাসনা এবং আমাদের ধন-সম্পদের যথেচ্ছা ব্যবহার বর্জন করতে তোমাকে নির্দেশ করে? (Al-Quran 11:87)
বস্তুত মানুষ সম্পদের প্রকৃত মালিকানা দাবি করার অধিকার রাখে না। কারণ মানুষ সম্পদ সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়। মানুষের পক্ষে শুধু উৎপাদনজনিত কিছু প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব। মূল সম্পদ সৃজনে মানুষের কোন হাত নেই। এ বিষয়টিই পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন আয়াত-প্রবচনে নানা আঙ্গিকে তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
১. তোমরা যে বীজ বপন কর সে সম্পর্কে চিন্তা করেছ কি? তোমরা কি তা অঙ্কুরিত কর, না আমি অঙ্কুরিত করি। (Al-Quran 56:63-64)
২. (তিনিই আল্লাহ) যিনি তোমাদের জন্য সবুজ বৃক্ষ থেকে আগুন সৃষ্টি করেন। অতঃপর তোমরা তা থেকে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত কর। (Al-Quran 36:80)
৩. আর তিনি আকাশ থেকে বারি বর্ষণ করেন। অতঃপর সেই পানি দ্বারা আমি বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ উৎপন্ন করি। অতএব তোমরা তা থেকে আহার কর এবং তোমাদের প্রাণীগুলোকে তাতে চারণ কর। (Al-Quran 20:53)
৪. তারা কি লক্ষ্য করে না, আমি নিজ হাতে সৃষ্ট বস্তুসমূহের মাঝে তাদের জন্য চতুষ্পদ প্রাণী সৃষ্টি করেছি। পরে তারা তার মালিক বনে যায়। (Al-Quran 36:71)
৫. তাদেরকে (অভাবীদেরকে) আল্লাহর ঐ সম্পদ থেকে দাও যা আল্লাহ তোমাদেরকে দিয়েছেন। (Al-Quran 24:33)
এ ধরনের অসংখ্য আয়াত-প্রবচনে বেশ সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে, সম্পদের সৃষ্টি এবং নিয়ন্ত্রণ জনিত মালিকানা স্বত্ব নিরঙ্কুশভাবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার। মানুষকে ভোগ-ব্যয়ের প্রতিনিধিত্বমূলক মালিকানা স্বত্ব প্রদান করা হয়েছে মাত্র। সুতরাং ইসলামী শরীয়ত পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার মত মানুষকে সম্পদের একচেটিয়া এবং অবাধ মালিকানা স্বত্ব প্রদান করেনি। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার মত মানুষের মালিকানা স্বত্বকে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত ঘোষণা করেনি। বরং মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত বিধান মতে বৈধ নিয়ন্ত্রণাধীকার শর্তে ভোগ-ব্যয়ের প্রতিনিধিত্বমূলক মালিকানা লাভ করবে। সুতরাং প্রকৃত মালিকের অভিপ্রায়ের বিপরীতে সম্পদে অর্জন, ভোগ, ব্যয়সহ কোন রূপ হস্তক্ষেপ করার আইনগত অধিকার মানুষের নেই। কেবলমাত্র তাঁর দেয়া বিধি-নিষেধ অনুসারে সম্পদের আয়, ভোগ ও ব্যবহারের অধিকার মানুষের রয়েছে। সুতরাং সম্পদ ব্যবহার কালে মানুষকে ভাবতে হবে, এসম্পদের একচ্ছত্র অধিপতি আমি নই। যাচ্ছে তাই করে এ সম্পদ ব্যবহারের অবারিত সুযোগ আমাকে দেয়া হয়নি। এ সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে মূল অধিপতির পক্ষ থেকে ব্যবহার বিধি প্রদান করা হয়েছে। সে বিধি মেনেই সম্পদ ব্যবহার করতে হবে। এটাই ইসলামী শরীয়ার নীতিগত মালিকানা দর্শন।
মালিকানা স্বত্বের পরিচিতি
মালিকানা শব্দের আভিধানিক অর্থ : মালিকানা শব্দটি মূলত ফারসী ব্যকরণিক শব্দ। আরবী মালিক শব্দের সাথে আনা উপসর্গ সংযুক্ত হয়ে ফারসী গুণবাচক বিশেষ্যে রূপ নিয়েছে। বাংলা ভাষায় এটি একটি বহুল প্রচলিত অর্থনৈতিক শব্দ। মালিকানার আভিধানিক অর্থ অধিকারিত্ব, স্বামিত্ব, প্রভুত্ব।
মালিকানার পারিভাষিক অর্থ : অর্থশাস্ত্রের মাঝে বিভাজন সৃষ্টির ফলে আবশ্যিকভাবে মালিকানা শব্দের পারিভাষিক অর্থের মাঝেও বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে।
সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় মালিকানা : সমাজাতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় যেহেতু ব্যক্তি-মালিকানা স্বীকৃত নয় তাই এখানে মালিকানার পারিভাষিক অর্থ হলো সম্পদের উপর রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণাধিকার।
পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় মালিকানা : পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় যেহেতু সম্পদের উপর ব্যক্তির একচেটিয়া এবং অবাধ মালিকানা স্বীকৃত তাই এখানে মালিকানা হল নির্দিষ্ট কোন জিনিসের উপর প্রদত্ত একধরনের অধিকার যা ভোগ ব্যবহারের দিক থেকে অসীম এবং ব্যয় ও হস্তান্তরের ব্যাপারে বাধাহীন এবং শর্তহীন।
ইসলামী অর্থব্যবস্থায় মালিকানা : ইসলামী অর্থব্যবস্থায় যেহেতু কারো নিরঙ্কুশ মালিকানা স্বীকার করা হয়নি তাই এখানে মালিকানা হল বস্তু কিংবা তার মুনাফায় শরীয়ত স্বীকৃত এক ধরনের অধিকার। যিনি এ অধিকার লাভ করবেন তিনি তার মালিকানাধীন বস্তু কিংবা তার মুনাফা ভোগ করতে পারবেন এবং প্রয়োজনে তা হস্তান্তরও করতে পারবেন।
মালিকানা স্বত্বের শ্রেণীভাগ
পূর্ণাঙ্গতা-অপূর্ণাঙ্গতা বিবেচনায় মালিকানা স্বত্ত্ব দুই শ্রেণীতে বিভক্ত- (১) সম্পূর্ণ মালিকানা স্বত্ত্ব (২) অসম্পূর্ণ মালিকানা স্বত্ত্ব।
(১) সম্পূর্ণ মালিকানা স্বত্ব : কোন সম্পদে নিরেট মালিকানা স্বত্ব এবং তা থেকে সুবিধা গ্রহণ এবং ব্যবহারের শরীয়ত সম্মত যাবতীয় অধিকার স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়াকেই সম্পূর্ণ মালিকানা স্বত্ব হিসেবে অভিহিত করা হয়। এজাতীয় সম্পদের স্বাতন্ত্র ও বৈশিষ্ট হলো, (ক) যতদিন সম্পদ অক্ষত থাকবে ততদিন তার নিরঙ্কুশ মালিকানাও অক্ষত থাকবে। (খ) স্বাভাবিক নিয়মে মালিকানা স্বত্ত্ব বিলুপ্ত হবে না। (গ) বৈধ লেনদেন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হস্তান্তর উপযোগী হবে। (ঘ) সম্পদাধিকারিকের জন্য তাতে যথাযথ ব্যবহার ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার স্বাধীনতা থাকবে। (ঙ) আধিকারিকের কর্মদোষে সম্পদ বিনষ্ট হলে তার উপর কোন প্রকার দায় আপতিত হবে না। তবে সে এক্ষেত্রে পরকালীন জবাবদিহিতা থেকে মুক্তি পাবে না। কারণ সম্পদ নষ্ট করা নিষিদ্ধ এবং হারাম। কখনো তাকে এ কারণে জাগতিক আদালতেও জবাবদিহি করতে হয়। যদি ইসলামী আদালতে সম্পদ ব্যবহারে অবাধ স্বেচ্ছাচারিতা এবং নির্বুদ্ধিতা প্রমাণিত হয় তবে তার সম্পদ ব্যবহারের উপর বিধি নিষেধ আরোপ করা হবে।
(২) অসম্পূর্ণ মালিকানা স্বত্ব : নিছক সম্পদের মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়া কিংবা নিছক সম্পদের সুবিধা ভোগের মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়াকেই অসম্পূর্ণ মালিকানা স্বত্ব বলে বিবেচনা করা হয়। এ জাতীয় সম্পদ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত-
(ক) নিছক সম্পদের মালিকানা স্বত্বাধিকার লাভ করা। যথা জনৈক ব্যক্তি তার বাসাটিকে আজীবন বসবাসের জন্য কারো নামে অসিয়ত বা উইল করল। এক্ষেত্রে যদি উইলকারী ব্যক্তি সম্পদ ভোগাধিকার প্রাপ্ত ব্যক্তির পূর্বে মারা যায় তাহলে উইলকৃত বাসাটি উইলকারী ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের মালিকানা স্বত্বে চলে আসবে। তবে বাসার বসবাস অধিকার উইল প্রাপ্ত ব্যক্তিই সংরক্ষণ করবে। তবে যদি উইল প্রাপ্ত ব্যক্তি মারা যায় অথবা ভোগাধিকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যায় তবে বাসার ভোগাধিকার মূল মালিকের উত্তরাধিকারীদের হাতে চলে আসবে। এবং তখন এসম্পদ তাদের জন্য সম্পূর্ণ সম্পদের মর্যাদা লাভ করবে।
(খ) সুবিধা প্রাপ্তির মালিকানা স্বত্ব। এ জাতীয় মালিকানা স্বত্ব লাভের পাঁচটি সূত্র বা প্রক্রিয়া রয়েছে- (১) ধার গ্রহণ (২) ভাড়া গ্রহণ (৩) ওয়াকফ দান (৪) অসিয়ত বা উইল (৫) নিছক ভোগাধিকার প্রদান।
(গ) স্থিতিশীল এবং স্থাবর সম্পত্তিতে সুবিধা প্রাপ্তির অধিকার। যথা, চলাচল এবং যাতায়াত অধিকার, ভূমি সিঞ্চনাধিকার, জলপ্রবাহাধিকার।
আধুনিক অর্থশাস্ত্রে মালিকানাকে সামগ্রিক বিচারে চার ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে- (১) ব্যক্তিগত মালিকানা (২) সামষ্টিক মালিকানা (৩) জাতীয় মালিকানা (৪) আন্তর্জাতিক মালিকানা।
ইসলামী অর্থবিদ্যায় মালিকানাকে প্রথমত দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে- (১) ব্যক্তিগত মালিকানা (২) সামষ্টিক মালিকানা।
সামষ্টিক মালিকানাকে আবার দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে- (ক) রাষ্ট্রীয় মালিকানা (খ) সার্বজনীন কিংবা আন্তর্জাতিক মালিকানা। সুতরাং ইসলামী অর্থব্যবস্থা মতে মালিকানার ক্ষেত্রে তিনটি বিভক্তি তৈরি হয়- (১) ব্যক্তিগত মালিকানা (২) রাষ্ট্রীয় মালিকানা (৩) আন্তর্জাতিক মালিকানা।
(১) ব্যক্তিগত মালিকানা
ব্যক্তি মালিকানা হল শরীয়ত স্বীকৃত এক ধরনের সীমিত অধিকার যা কোন বস্তু বা তার মুনাফায় কোন ব্যক্তি বিশেষের মালিকানাকে নির্ধারিত করে এবং সেগুলোতে তার অবাধ লেনদেনের অধিকার প্রদত্ত হয়।
ব্যক্তি মালিকানা লাভের সূত্রসমূহ
উত্তরাধিকার : কোন ব্যক্তির তিরোধানের পর তার পরিত্যক্ত অর্থ-সম্পদ ইসলামী শরীয়ার বণ্টন নীতি অনুসারে তার উত্তরাধিকারীদের মাঝে বণ্টিত হয়। উত্তরাধিকারী সদস্যবৃন্দ বণ্টিত সম্পদের যে অংশ লাভ করে তাতে তাদের বৈধ মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
ব্যবসা বাণিজ্য : ইসলামী নীতি শাস্ত্র মতে বাণিজ্য হল ক্রেতা বিক্রেতার পারস্পারিক সম্মতি ভিত্তিক সম্পদের পারস্পারিক বিনিময়। এজাতীয় বিনিময়ের ফলে ক্রেতা বিক্রেতা উভয়ই পারস্পারিক সরবরাহকৃত সম্পদের স্বত্বাধিকার লাভ করে।
কৃষি প্রক্রিয়া : ভূমি সম্পদে মহান আল্লাহ তা‘আলা অপার উৎপাদনী শক্তি সন্নিহিত রেখেছেন। চাষাবাদ ও বপন-রোপনের যথার্থ পদ্ধতি অবলম্বন করার মাধ্যমে ভূমি থেকে দ্রব্য সামগ্রী ও আহার্য উৎপন্ন করা হয়। ভূমি উৎপাদিত পণ্যে ভূস্বামী বা বর্গাচাষীর মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
ভূসম্পদ আবাদ করণ : সাধারণ অর্থে ভূমি বলতে পৃথিবীর স্থলভাগকে বুুঝানো হয়। তবে অর্থনৈতিক পরিভাষায় ভূপৃষ্ঠ এবং ভূপৃষ্ঠকে উৎপাদন উপযোগী করে তোলার জন্য আল্লাহ প্রদত্ত যাবতীয় প্রাকৃতিক দ্রব্য ও পরিবেশগত আনুকূল্যকে ভূমি সম্পদ নামে অভিহিত করা হয়। রাষ্ট্রের অন্তর্গত স্বত্ববিহীন অনাবাদি ভূমি রাষ্ট্রের অনুমোদন সাপেক্ষে আবাদ করে তাতে মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়। যে ব্যক্তি যতটুকু ভূমি আবাদ করবে সে ব্যক্তি ততটুকু ভূমির মালিকানা স্বত্ব লাভ করবে। রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
কেউ যদি অনাবাদী ভূমি আবাদ করে তবে তাতে তার মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। (Abu daud 1431, 3075)
তবে এ জাতীয় ভূমিতে মালিকানা স্বত্ব লাভের জন্য কয়েকটি শর্ত প্রযোজ্য। যথা, (১) কারো মালিকানাভুক্ত না হতে হবে। (২) কোন নগর সীমার অন্তর্গত ভূমি না হতে হবে। (৩) নাগরিকদের প্রয়োজনীয় কাজের জন্য নির্ধারিত না হতে হবে। (৪) তিন বছরের মধ্যে ভূমি আবাদের কাজ আরম্ভ করতে হবে। (৫) আবাদকারীর আবাদ করা সামর্থ থাকতে হবে। (৬) রাষ্ট্রপক্ষের অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে।
ভূগর্ভস্থ সম্পদ উত্তোলন : ভূগর্ভস্থ সম্পদ দুই প্রকার- (১) আল্লাহ সৃষ্ট খনিজ সম্পদ। (২) মানব গচ্ছিত গুপ্তধন।
(১) আল্লাহ সৃষ্ট খনিজ সম্পদ : খনিজ সম্পদ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত-
(ক) অগ্নিতাপে তরলযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ। যথা স্বর্ণ, রূপা, লোহা, পিতল, তা¤্র, কাঁসা, শিশা, পারদ। এজাতীয় খনিজ সম্পদ লাভ করলে তার এক পঞ্চমাংশ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে হবে। চাই তা উশরী ভূমিতে প্রাপ্ত হোক কিংবা খারাজী ভূমিতে প্রাপ্ত হোক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
খনিজ সম্পদ করমুক্ত। তবে ভূগর্ভস্থ সম্পদে রাষ্ট্রের জন্য এক পঞ্চমাংশ বরাদ্দ থাকবে। (Al-bukhari 1430, 1499)
এ শ্রেণীর সম্পদ যদি মালিকানাধীন ভূমিতে প্রাপ্ত হয় তাহলে ভূস্বামী এ খনিজ সম্পদের অবশিষ্ট চার পঞ্চমাংশের স্বত্বাধিকারী হবে। আর যদি মালিকাহীন ভূমিতে প্রাপ্ত হয় তাহলে সন্ধানপ্রাপ্ত ব্যক্তিই তার চার পঞ্চমাংশ সম্পদের স্বত্বাধিকারী হবে।
(খ) অগ্নিতাপে তরল অযোগ্য খনিজ সম্পদ। যথা চুনা, চুনা পাথর, রসাঞ্জন চূর্ণ, আর্সেনিক তথা স্বচ্ছ রসায়নিক খনিজ, পাথর, নীলকান্তমণি, লবণ ইত্যাদি।
(গ) তরল খনিজ। যথা আলকাতরা, পেট্রোল, তেল, গ্যাস ইত্যাদি।
(২) ভূগর্ভস্থ মানব গচ্ছিত গুপ্তধন : প্রাপ্ত গুপ্তধনে যদি ইসলামিক নিদর্শন পরিলক্ষিত হয় তাহলে তা বিধানগত দিক থেকে কুঁড়ানো সম্পদের পর্যায়ভুক্ত হবে। তার মূল মালিককে অনুসন্ধান করতে হবে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। মূল মালিকের সন্ধান না পাওয়া গেলে তা সদকা করে দিতে হবে। আর যদি তাতে ইসলামিক নিদর্শন পরিলক্ষিত না হয় তাহলে তাতে এক পঞ্চমাংশ আবশ্যক হবে। আর অবশিষ্ট চার পঞ্চমাংশ সন্ধানপ্রাপ্ত ব্যক্তির স্বত্বাধিকারভুক্ত বলে গণ্য হবে। তবে যদি গুপ্তধন কিংবা খনিজ সম্পদ নিজ মালিকানাধীন আবাস ভূমিতে প্রাপ্ত হয় তাহলে ইমাম আবূ হানীফা রহ. এর দৃষ্টিভঙ্গি মতে তাতে এক পঞ্চমাংশ আরোপিত হবে না। (Al-Zuhayli 1435, 3/212)
জলজ সম্পদ উত্তোলন : নদ-নদী, হাওড়, বাওড় এগুলো রাষ্ট্রীয় সম্পদ। আর সমুদ্র হল আন্তর্জাতিক সম্পদ। তবে বর্তমান আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন মতে প্রত্যেক রাষ্ট্র তার সীমান্ত সংশ্লিষ্ট ২০০ কিলোমিটার সামুদ্রিক এলাকার মালিকানা স্বত্ব সংরক্ষণ করে। রাষ্ট্র যদি নাগরিকদের ব্যক্তিগত পর্যায়ে সামুদ্রিক সম্পদ কিংবা নদ-নদীর সম্পদ আহরণের অধিকার প্রদান করে তবে সে আহরিত সম্পদের মালিকানা স্বত্ব আহরণকারী ব্যক্তিই সংরক্ষণ করবে। যেমন লবণ, মৎস, শৈবাল, মনি-মুক্তা ইত্যাদি। এজাতায় জলজ সম্পদ প্রাপ্তিতে রাষ্ট্রের জন্য কোন অংশ বরাদ্দ নেই। নিছক পানিসম্পদ মূলত চার শ্রেণীতে বিভক্ত- (১) সাধারণ নদীর পানি। যথা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা নদীসমূহের পানি। জনস্বার্থ লঙ্ঘন না করার শর্তে এ জাতীয় নদ নদীর পানি থেকে সুবিধা ভোগ করা প্রতিটি মানুষেরই সমান অধিকার রয়েছে। (২) ব্যক্তি মালিকানাধীন প্র¯্রবন, লেক, পুকুর, হাউজ, ছোট নদী ইত্যাদির পানি। এ জাতীয় জলাধার থেকে সকলের জন্য সুবিধা গ্রহণের অধিকার রয়েছে। তবে এ জাতীয় ক্ষুদ্র জলাশয় থেকে ভূমি সিঞ্চন জলাধার মালিকের অনুমোদন সাপেক্ষ। তার অনুমতি ব্যতিরেকে ভূমি সিঞ্চনের অবকাশ নেই। (৩) পাত্রে রক্ষিত পানি। এ জাতীয় পানি থেকে কারো জন্য সুবিধা গ্রহণের অধিকার নেই। তবে যদি কেউ পানি পিপাসায় মৃত্যু মুখে পতিত হয় তাহলে তার জন্য অনুমতি না হলেও প্রয়োজন পরিমাণ পানি গ্রহণ করে তার জীবন রক্ষা করার অবকাশ রয়েছে।
শিল্পায়ন ও কারিগরি প্রক্রিয়া : প্রকৃতিতে বিরাজমান নানা উপাদানের আঙ্গিক ও অবয়ব পরিবর্তন করে তাকে ব্যবহার উপযোগী করে তোলা, তার ব্যবহারের ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করা কিংবা তার মূল্যমান বৃদ্ধির এসব প্রক্রিয়াকেই শিল্পায়ন বা কারগরি প্রযুক্তি বলা হয়। প্রকৃতির কাঁচামালের আঙ্গিক পরিবর্তন করে যে ব্যক্তি নতুন কিছু তৈরি করবে বা আবিষ্কার করবে তার মালিকানা স্বত্ব তার হাতেই সংরক্ষিত থাকবে। আবিষ্কৃত এ যন্ত্র বা প্রযুক্তি বিক্রি করে ব্যক্তি যে অর্থ উপার্জন করবে তা তার ব্যক্তিগত সম্পদ বলে গণ্য হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
আমি অবশ্যই দাউদের প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ করেছিলাম… এবং আমি তার জন্য লৌহ নমনীয় করে দিয়েছিলাম। এজন্য যে, তুমি পূর্ণমাপের বর্ম তৈরি করবে এবং বর্মের জালি বয়ণকালে সামঞ্জস্য রক্ষা করে তা তৈরি করবে। (Al-Quran 34:10-11)
অন্যত্র বলেন,
আর আমি সুলাইমানের জন্য গলিত তামার এক প্র¯্রবন প্রবাহিত করে দিয়েছিলাম। কতিপয় জিন তাঁরই সম্মুখে তাঁর প্রতিপালকের নির্দেশে বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম আঞ্জাম দিত।… তিনি যা ইচ্ছা করতেন তারা তার জন্য তাই তৈরি করে দিত। সুউচ্চ প্রাসাদ, বিভিন্ন আকৃতি, হাউজ সদৃশ বৃহদায়তন পাত্র এবং সুদৃঢ়ভাবে স্থাপিত বৃহদাকার ডেকচি ইত্যাদি। অতএব হে দাউদ পরিবার! তোমরা কৃতজ্ঞতার সাথে (শিল্পকর্মের বিকাশে) কাজ করে যাও। (Al-Quran 34:12-13)
অন্যত্র তিনি বলেন,
হে বনী আদম! আমি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছি এমন পোষাক যা তোমাদের লজ্জা নিবারণ করে এবং তা তোমাদের ভূষণও বটে। (Al-Quran 7:26)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
যাকারিয়া আ. কাঠমিস্ত্রী ছিলেন। (Muslim 1430H, 2379)
ইসলামী শরীয়তে শিল্পের ব্যাপারে উৎসাহিত করা হলেও তার বিকাশ এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে কতিপয় বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। যথা, (১) বৈধ পন্থায় বৈধ উপকরণ ব্যবহার করে শিল্পকর্ম করতে হবে। সুতরাং শুকর কিংবা মানব দেহের কোন অংশ ব্যবহার করে শিল্পজাত পণ্য তৈরি করা হলে তা বৈধ হবে না।
(২) উদ্ভাবিত শিল্পের শরীয়তসম্মত বৈধ ব্যবহারের দিক থাকতে হবে। সুতরাং বাদ্যযন্ত্রের মত নিষিদ্ধ পণ্যের শিল্পকর্ম বৈধ হবে না।
(৩) উদ্ভাবিত শিল্প পণ্য দ্বারা মানুষ, দেশ ও জাতির দৈহিক, আত্মিক ও নৈতিক ক্ষতির সম্ভাবনা না থাকতে হবে।
(৪) উদ্ভাবিত শিল্প বৈধ হলেও তার ব্যবহারের ক্ষেত্রে বৈধতার সীমারেখা মেনে চলতে হবে। সুতরাং মোবাইল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ প্রভৃতি প্রযুক্তির ব্যবহারে বৈধতার সীমা লঙ্ঘন করা হলে তার ব্যবহার বৈধ হবে না।
শ্রম বিক্রয় : বস্তুত মানুষের শ্রমও ক্রয়-বিক্রয়যোগ্য একটি উল্লেখযোগ্য সম্পদ। সুতরাং মানব শ্রম বিক্রির মাধ্যমে যে সম্পদ অর্জিত হবে তাতে ব্যক্তির মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
পুরুষ যে সম্পদ উপার্জ করে তা তারই মালিকানাভুক্ত বলে গণ্য হবে। আর নারীরা যে সম্পদ উপার্জন করে তা তারই মালিকানাভুক্ত বলে গণ্য হবে। (Al-Quran 4:32)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
আল্লাহ তা‘আলা এমন কোন নবী প্রেরণ করেননি যিনি বকরী চরাননি। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আপনি? তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যা, আমিও কয়েক ‘কিরাত’ (বিশেষ পরিমাণ অর্থের আরবীয় পরিমাপক) অর্থের বিনিময়ে বকরি চরাতাম। (Al-bukhari 1430H, 2262)
ইসলামী শরীয়তে শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত সম্পদে মালিকানা স্বত্ব বৈধ হওয়ার জন্য কতিপয় বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। (১) শ্রমিকের শ্রমের ধরন ও পারিশ্রমিকের পরিমাণ শ্রম শুরু করার পূর্বেই নির্ধারণ করে নিতে হবে। (২) শ্রমিককে অবশ্যই নিষ্ঠার সাথে শ্রম দিতে হবে। যদি সময়ের ভিত্তিতে শ্রম চুক্তিতে আবদ্ধ হয় তবে শ্রমিককে পূর্ণ সময় সততার সাথে শ্রম দিতে হবে। কোন রূপ ফাঁকি দেয়ার চিন্তা করা যাবে না। আর যদি কর্মের ভিত্তিতে শ্রম চুক্তিতে আবদ্ধ হয় তাহলে কাজের গুণগত মান অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। (৩) বৈধ শ্রম হতে হবে। অবৈধ এবং নিষিদ্ধ শ্রমের মাধ্যমে উপার্জিত সম্পদের উপর মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে না। যথা মদসহ মাদক দ্রব্য তৈরি করা, সুদভিত্তিক কাজে শ্রম দেয়া ইত্যাদি। এ জাতীয় শ্রম অর্জিত সম্পদে মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে না।
পুরস্কার গ্রহণ : বৈধ পুরস্কার হিসেবে প্রাপ্ত সম্পদে ব্যক্তির মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। পবিত্র কুরআনে ঘোষণা হচ্ছে,
তারা বলল, আমরা বাদশার পরিমাপক পাত্র হারিয়ে ফেলেছি। সুতরাং যে ব্যক্তি তা এনে দিবে তাকে এক উট বোঝাই পণ্য দেয়া হবে এবং এ পুরস্কার প্রদানের দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। (Al-Quran 12:72)
দান, হেবা, হাদিয়া, ওয়াসিয়ত : আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে যদি কোন অভাবী ব্যক্তিকে কোন কিছু দেয়া হয় তা দান হিসেবে পরিগণিত হয়। যাকাত, সাদাকাতুল ফিতর, সাধারণ সাদাকাহ এসবই দান হিসেবে পরিগণিত। এসব প্রকিয়ার মাধ্যমে যে ব্যক্তি সম্পদ লাভ করবে তাতে তার বৈধ মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে।
কোন ব্যক্তিকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশে কিংবা তার নৈকট্য ও ভালোবাসা লাভের উদ্দেশে যদি কোন কিছু প্রদান করা হয় তাহলে তা হাদিয়া বা উপহার হিসেবে পরিগণিত হয়।
মরণোত্তর দানকে ওয়াসিয়ত বলে গণ্য করা হয়। অর্থাৎ যদি কোন প্রাপ্ত বয়স্ক সুস্থ মস্তিস্কের অধিকারী ব্যক্তি জীবিত কালে এ মর্মে ইচ্ছা ব্যক্ত করে যে, আমার তিরোধানের পর অমুক সম্পদের স্বত্বাধিকারী অমুক ব্যক্তি হবে তাহলে তার ইন্তেকালের পর তার রেখে যাওয়া সম্পদের এক তৃতীয়াং সম্পদে ওয়াসিয়ত প্রাপ্ত ব্যক্তির মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে যদি ওয়াসিয়ত প্রাপ্ত ব্যক্তি তার উত্তরাধিকারী সদস্য না হয়। ওয়াসিয়ত প্রাপ্ত ব্যক্তি তার উত্তরাধিকারী হলে ওয়াসিয়ত কার্যকর হবে না। তবে যদি অন্যান্য উত্তরাধিকারী সদস্যগণ এ ওয়াসিয়তকে স্বীকৃতি দেয় তাহলে তা কার্যকর হতে কোন বাধা নেই।
মহর আদায় এবং খুলা প্রক্রিয়া : বিবাহ শাদিতে স্ত্রী তার বৈবাহিক সম্পর্কের বিনিময়ে স্বামী থেকে যে সম্পদ প্রাপ্তির অধিকার লাভ করে তাকে মহর বলা হয়। অন্যদিকে স্বামী যদি কোনরূপ অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা লাভের শর্তে স্ত্রী কর্তৃক প্রস্তাবিত তালাক দিতে সম্মত হয় তাহলে এ জাতীয় আর্থিক সুবিধা গ্রহণকে খুলা বলা হয়। মহর কিংবা খুলা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাপ্ত সম্পদের মাঝে নারী পুরুষের মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।
ভরণ পোষণ : নারী তার স্বামী থেকে ভরণ পোষণ বাবদ যে সম্পদ লাভ করে তাতে তার মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।
সরকারী ভূমি থেকে সম্পদ আহরণ : সরকারী বনভূমি, জলাশয়, নদী-সাগর প্রভৃতি ক্ষেত্র থেকে রাষ্ট্রীয় অনুমোদন সাপেক্ষে সম্পদ আহরণ করা হলে তাতে ব্যক্তির মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।
(২) রাষ্ট্রীয় মালিকানা
ইসলামী শরীয়া মতে রাষ্ট্র হল প্রত্যাদিশক প্রতিনিধিত্বমূলক এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে আল্লাহ প্রদত্ত বিধানাবলির আলোকে জনগণকে পরিচালনা করার দায়িত্ব গ্রহণ করে। রাষ্ট্রের দায়িত্বাবলি যথাযথভাবে পালন করার স্বার্থে এবং সকল ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলা বিধানের লক্ষে তার অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। ইসলাম এ স্বাভাবিক প্রয়োজনকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় মালিকানার অধিকার প্রদান করেছে। বস্তুত সকল কিছুর প্রকৃত মালিকানা স্বত্ব একমাত্র আল্লাহর। রাষ্ট্র হল আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান। অতএব রাষ্ট্রের অন্তর্গত যাবতীয় সম্পদের প্রাথমিক মালিকানা স্বত্ব রাষ্ট্রই সংরক্ষণ করবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে গিয়ে রাষ্ট্রের প্রতিটি সদস্য সে সম্পদের মালিকানা লাভ করবে। ইসলামী শরীয়াতে সমাজতন্ত্রের ন্যায় রাষ্ট্রের যাবতীয় সম্পদের নিয়ন্ত্রণাধিকার রাষ্ট্রকে প্রদান করা হয়নি। অন্যদিকে পুুঁজিবাদের ন্যায় যাবতীয় সম্পদের নিরঙ্কুশ মালিকানা জনসাধারণের হাতেও ন্যাস্ত করা হয়নি। বরং সকল সম্পদের প্রাথমিক মালিকানা রাষ্ট্রের বিধায় ব্যক্তির মালিকানা রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত থাকবে। আবার যাতে ব্যক্তি মালিকানা ও রাষ্ট্রীয় মালিকানার মাঝে কোন রূপ সংঘাত সৃষ্টি না হয় তাই ব্যক্তি মালিকানা এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানার জন্য পৃথক পৃথক ক্ষেত্র নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। কোথাও যদি ব্যক্তি মালিকানা ও রাষ্ট্রীয় মালিকানার মাঝে সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে তাহলে সেক্ষেত্রে ইসলাম সামষ্টিক তথা রাষ্ট্রীয় মালিকানাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানার ক্ষেত্রসমূহ
ক. রাষ্ট্রের অন্তর্গত যেসব সম্পদ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষের মালিকানায় প্রদান করা হলে জনগণের স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে সেসব সম্পদে রাষ্ট্রীয় মালিকানা সংরক্ষিত থাকবে। যথা-
সরকারী চারণ ভূমি, বনভূমি, পার্ক-উদ্যান, সরকারী অর্থায়নে গড়ে তোলা খামার সমূহ।
সরকারী ভূমিতে বিদ্যমান খনিজ সম্পদ।
পানির উৎসসমূহ : যথা বৃহদায়ন জলাশয়, নদী-নালা, খাল-বিল, সমুদ্র, হ্রদ ইত্যাদি।
যোগাযোগ ব্যবস্থা : যথা সড়ক ও জনপথ, নৌপথ, আকাশ পথ, রেল লাইন ইত্যাদি।
জনকল্যাণে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান সমূহ : যথা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ডাক বিভাগ, চিকিৎসা কেন্দ্র, গবেষণা ইনষ্টিটিউট, ট্রেনিং সেন্টার, প্রশিক্ষণ ব্যুরো, ওয়াসা, বিদ্যুৎ, টেলিফোন ইত্যাদি।
খ. জনকল্যাণে ওয়াকফ কৃত সম্পদ : যথা মসজিদ, মাদরাসা, দাতব্য চিকিৎসালয় ইত্যকার ওয়াকফ সম্পত্তি।
গ. সরকারী অর্থায়নে গড়ে তোলা মিল-কারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান।
ঘ. মালিকানা বিহীন সম্পদ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
সকল চারণভূমিতে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আধিপত্য থাকবে। (Al-bukhari 1430H 2370)
আবূ উবাইদ কাসেম ইবনে সাল্লাম রহ. বলেন,
উমর রাযি. ‘রবাযা’র ভূমিকে চারণভূমি হিসেবে ঘোষণা দেয়ার পর বলেছিলেন, যদি আল্লাহর পথে ভার বহনকারী এসব উটগুলো না হত তাহলে আমি জগনণের নগর সীমার অন্তর্গত ভূমি থেকে সামান্য পরিমাণও চারণভূমির জন্য অধিগ্রহণ করতাম না। (Al-harabi, 1428H, 3/419, Al-bukhari 1430H 2370)
আবইয়ায ইবনে হাম্মাল রাযি. একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে একটি লবণ খনি তার নামে বরাদ্দ চাইলেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নামে লবণের খনিটি বরাদ্দ দিলেন। আবইয়ায ইবনে হাম্মাল রাযি. যখন মজলিশ ছেড়ে চলে গেলেন তখন উপস্থিতদের একজন বলল (আল্লাহর রাসূল!) আপনি জানেন কি তার নামে কি বরাদ্দ দিয়েছেন? আপনি তো তার জন্য একেবারে প্রস্তুত পানি বরাদ্দ দিয়েছেন। (অর্থাৎ বিনাশ্রমে উত্তোলনযোগ্য লবণ খনি তার নামে বরাদ্দ দিয়েছেন।) একথা জানার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নামের বরাদ্দ কেটে দিলেন। (Abu daud, 1431H 3064)
এসব হাদীসের আলোকে প্রতীয়মান হয় জন স্বার্থে এবং জনকল্যাণের উদ্দেশে রাষ্ট্রের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা এবং প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানা স্বত্বকে সংরক্ষণ করার অবকাশ রয়েছে।
(৩) আন্তর্জাতিক মালিকানা
বিশ্বচরাচরে এমন কিছু উপাদান রয়েছে যেগুলোর উপর প্রাণী ও উদ্ভিদের অস্তিত্ব নির্ভরশীল। এজাতীয় সার্বজনীন জীবনঘনিষ্ঠ উপাদানের উপর বিশেষ কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দেশ বা জাতির একচেটিয়া মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হওয়াকে ইসলামী শরীয়ত যৌক্তিক মনে করে না। বরং এজাতীয় উপাদানকে ইসলাম সার্বজনীন কল্যাণার্থে উন্মুক্ত রেখে দিয়েছে। আধুনিক পরিভাষায় এ জাতীয় অধিকারকে সার্বজনীন মালিকানা বা আন্তর্জাতিক মালিকানা হিসেবে অভিহিত করা হয়। যেমন আলো, বাতাস, পানি, পানিস্থ সম্পদ, বন, বনজ সম্পদ, বিশাল মরুভূমি, স্বউদগত তৃণলতা ইত্যাদি। এজাতীয় সম্পদ সার্বজনীন মালিকানাধীন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
তিন শ্রেণীর উপাদানে সকল মানুষের অংশীদারিত্ব রয়েছে। পানি তৃণলতা আগুন। (Abu daud, 1431H 3477)
হাদীসটিতে বাহ্যত তিনটি উপাদানে সকল মানুষের অংশীদারিত্বের কথা বলা হলেও তা এ জাতীয় সার্বজনীন সকল প্রকার সম্পদকে ব্যাপৃত করে। পানি বলতে পানিস্থ যাবতীয় সম্পদ, তাতে যান চলাচলের সবরকমের অধিকারও পর্যায়ভুক্ত হবে। যেসকল নদী আপন উৎস থেকে বিভিন্ন রাষ্ট্রের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সাগরে গিয়ে পড়েছে সেসকল নদীতে নৌ চলাচলের অধিকার রাষ্ট্রসীমার মধ্যে রাষ্ট্রের অনুকূলে সংরক্ষিত থাকবে। তবে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের প্রয়োজন পরিমাণ পানি সংরক্ষণের অধিকার সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের অবশ্যই থাকবে। প্রয়োজনাতিরিক্ত পানি আটকিয়ে রেখে অন্য রাষ্ট্রের অসুবিধা সৃষ্টির অধিকার কোন রাষ্ট্রের থাকবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
অন্যের অধিকৃত জমির উৎপাদন ব্যাহত করার মানসে প্রয়োজনাতিরিক্ত পানি আটকে রাখা যাবে না। (Ibn Anas, 1426H 29/2755)
সুনানে ইবনে মাজাহ এর একটি বর্ণনায় রয়েছে, ভূমি সিঞ্চন বিষয়ে জনৈক আনসারী সাহাবীর সাথে যুবাইর রাযি. এর কিছুটা জটিলতা দেখা দেয়। আনসারী সাহাবী বলছিল, তুমি পানি ছেড়ে দাও। আটকিয়ে রেখো না। যুবায়ের রাযি. আপন ভূমি সিঞ্চন করে তারপর পানি ছাড়ার প্রবক্তা ছিলেন। পানি সংক্রান্ত এ বিষয়টি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকটে উপস্থাপন করা হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মর্মে রায় দিলেন,
হে যুবায়ের তোমার জমি সিঞ্চিত হয়ে গেলে তুমি পানি ছেড়ে দিয়ো।… (Ibn Maja, 1426H 15)
হাদীসে উল্লেখিত তৃণলতা বলতে বন ও অরণ্য ভূমি এবং তথাকার উৎপাদিত যাবতীয় বনজ ও অরণ্যজ সম্পদকেও ব্যাপৃত করবে। তেমনিভাবে আগুন শব্দটিও আলো বাতাস, সৌর শক্তি জাতীয় সবরকমের সম্পদকেও ব্যাপৃত করবে।
ব্যক্তি মালিকানার উপর রাষ্ট্রীয়নিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা
বিশ্বচরাচরে বিদ্যমান যাবতীয় প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাথমিক মালিকানা স্বত্ব আল্লাহর। এরপর রাষ্ট্রপ্রধান তাতে প্রতিনিধিত্বমূলক স্বত্বাধিকার লাভ করে। তৃতীয় পর্যায়ে এসে দেশের নাগরিকগণ তার ভোগাধিকার লাভ করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
অনাবাদী ভূমির প্রাথমিক স্বত্বাধিকার আল্লাহর, তারপর রাসূলের (অর্থাৎ রাষ্ট্রপ্রধানের), তারপর তোমাদের। (Al-harabi, 1428H, 3/388)
তবে জনগণকে উশর এবং খারাজের বিনিময়ে ভূসম্পদে চাষাবাদ ও বসবাসের সাময়িক অধিকার বা মালিকানা স্বত্ব প্রদান করা হয়। ব্যক্তি স্বার্থ এবং জন স্বার্থ তথা সামষ্টিক স্বার্থের মাঝে বিরোধাভাস বা সীমাহীন বৈষম্য ফুটে উঠলে যেন ব্যক্তি স্বার্থকে সীমিত করে জনস্বার্থ রক্ষা করা সহজেই সম্ভব হয় এ কারণেই ব্যক্তি স্বার্থের মাঝে আইনগত সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করা হয়েছে। কারণ ব্যক্তি স্বার্থের তুলনায় জনস্বার্থ অগ্রগণ্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
শহরের বাইরে গিয়ে পণ্য বহনকারী মালিকদের থেকে কিছু ক্রয় করবে না। (Al-bukhari 1430H2150)
হাদীসটিতে ব্যবসায়ীদেরকে উদ্দেশ্য করে একথাটি বলা হয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মে শহুরে ব্যবসায়ীগণ পণ্য মালিক থেকে পণ্য কিনে শহরে এসে অধিক মূল্যে বিক্রি করবে। পণ্য মালিক হয়তো এতো অধিক মূল্যে বিক্রি করত না বা করতে পারত না। কারণ শহুরে ব্যবসায়ীর পণ্যের স্থানীয় দাম সম্বন্ধে আইডিয়া আছে। উপরন্তু তার ব্যবসায়িক টেকনিকও জানা আছে। এক্ষেত্রে শহুরে ব্যবসায়ী লাভবান হলেও শহরের ক্রেতা সাধারণ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যক্তি স্বার্থের উপর সামষ্টিক এবং জনস্বার্থকে প্রাধান্য দেয়ার উদ্দেশে এ প্রক্রিয়াকে নিষেধ করে দিয়েছেন।
বস্তুত স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ন্যায়সঙ্গত বৈধ মালিকানার উপর হস্তক্ষেপের অধিকার কারো নেই। না রাষ্ট্রীয় সংস্থার না বেসরকারী সংস্থার। তবে দেশের অস্বাভাবিক অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার বৃহৎ স্বার্থেই কেবল রাষ্ট্রের ব্যক্তি মালিকানার উপর নিয়ন্ত্রণারোপের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কোন রাষ্ট্রে যদি চরম খাদ্য সঙ্কট ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় তখন প্রথমত রাষ্ট্রীয় কোষাগারে রক্ষিত অর্থ সম্পদ যোগে এ সঙ্কট নিরসনের চেষ্টা করা হবে। এতে যদি সাধারণ মানুষের ন্যুনতম পর্যায়ের অন্ন বস্ত্র এবং বাসস্থানের যোগান দেয়া সম্ভব না হয় তাহলে দেশের বিত্তবান নাগরিকদের সঙ্কট নিরসনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হবে। তারা যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের মানবিক দায়িত্ব পালনে এগিয়ে না আসে তাহলে এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের জন্য চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে হলেও বিত্তবানদের অতিরিক্ত সম্পদ অধিগ্রহণ করে জনগণের খাদ্য সঙ্কট নিরসন করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। কারণ এ বিশ্বচরাচরের যাবতীয় সম্পদের মালিক আল্লাহ তা‘আলা। আর মানুষ হল আল্লাহর সৃষ্টি। সুতরাং আল্লাহর সৃষ্টির বিশেষ প্রয়োজনে আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদই ব্যবহৃত হবে। বস্তুত সৃষ্টিগতভাবে সকল সম্পদে সকল মানুষের যৌথ মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। তবে পারস্পারিক বিবাদ নিরসন এবং সম্পদ ভোগে শৃঙ্খলা আনয়ন কল্পে সম্পদের বৈধ দখল এবং অধিকার স্বত্বকে মালিকানার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ব্যক্তির মালিকানাভুক্ত সম্পদে অন্যের হস্তক্ষেপের অধিকারকে রহিত করা হয়েছে। ইসলামী শরীয়ার যাকাত বিধান ব্যক্তি মালিকানা সীমিত হওয়ার একটি প্রকৃষ্টি প্রমাণ। সম্পদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অবধি ব্যক্তির স্বাভাবিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু সে পরিমাণের বেশি হয়ে গেলে তাতে অন্যের মালিকানা চলে আসে। সে অতিরিক্ত সম্পদে তার আইনগত মালিকানা থাকে না। বরং নির্দিষ্ট সেই অতিরিক্ত সম্পদকে মূল মালিক তথা অনাথ অভাবী মানুষের হাতে নিজ দায়িত্বে পৌঁছে দেয়া তার জন্য আবশ্যক হয়ে পড়ে। সারকথা রাষ্ট্রের জন্য জনগণের বৃহৎ স্বার্থে ব্যক্তি মালিকানার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার অবকাশ রয়েছে। তবে এ নিয়ন্ত্রণাধিাকর আরোপের জন্য কয়েকটি ক্ষেত্র রয়েছে। যথা, (১) ভূমি আবাদ না করে পতিত ফেলে রাখা। (২) উৎপাদন করে রাষ্ট্রের যথাপ্রাপ্য অধিকার আদায় না করা। (৩) জনস্বার্থের প্রয়োজন পরিলক্ষিত হওয়া বা রাষ্ট্রের বিশেষ প্রয়োজন দেখা দেয়া। (৪) ভূমি মালিকানার বৈষম্য নিরসন কল্পে সুষম বণ্টনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়া। এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি সম্পদ অধিগ্রহণ করার অবকাশ রয়েছে। উমর রাযি. বলেন,
তিন বছর ভূমি অনাবাদি ফেলে রাখার পর সে ভূমিতে দখলদার ব্যক্তির কোন অধিকার থাকবে না। (Abu yusuf 1382H, 1/125)
উমর রাযি.আরো বলেন,
যদি কেউ তিন বছর পর্যন্ত ভূমি অনাবাদী ফেলে রাখে অতঃপর (রাষ্ট্রীয় অনুমোদন ক্রমে) অন্য কেউ এসে তা আবাদ করে তাহলে সে ভূমিতে দ্বিতীয় ব্যক্তির মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। (Ibn adam 1/256)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আকীক নামক স্থানের বিশাল এলাকা বিলাল ইবনে হারেস রাযি. কে চাষাবাদের জন্য দান করেছিলেন। কিন্তু তিনি বেশ কিছু ভূমি অনাবাদী ফেলে রাখলে উমর রাযি. তার খিলাফত কালে তাকে ডেকে এনে বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দখল স্বত্ব বজায় রাখার জন্য তোমার নামে এ ভূমি বরাদ্দ করেননি। বরং তিনি তোমাকে এ ভূমি দিয়েছিলেন যেন তুমি তা থেকে ফসল উৎপাদন কর। সুতরাং তুমি যতটুকু ভূমি উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করতে সামর্থ রাখ ততটুকু রেখে অবশিষ্ট জমি ফিরিয়ে দাও। (Al-harabi, 1428H3/399)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাকী নামক একটি ভূমিকে চারণ ভূমির জন্য অধিগ্রহণ করেছিলেন। (Al-bukhari, 1430H2370)
শেষ কথা
যে বিষয়ের মাঝে উপযোগ তথা প্রয়োজন পূরণ, মুখাপেক্ষিতা ও অভাব মোচনের সক্ষমতা আছে তাই আমাদের বৈশ্বিক পরিভাষায় সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত। মানুষের অভাব, মুখাপেক্ষিতা এবং প্রয়োজনের অন্ত নেই। রিপু তাড়িত প্রয়োজনীয়তা, বিলাসী চেতনা প্রসূত মুখাপেক্ষিতা, শাস্ত্রনিষিদ্ধ বিষয়াদির অভাবসহ অসংখ্য রকমের প্রয়োজনীয়তা-অভাব মানুষ তার যাপিত জীবনে বোধ করে। এসব বৈষয়িক শূন্যতা পূরণে যেসব উপায়-উপাদান হাতের নাগালে চলে আসে তাই আমাদের বৈষয়িক ভাবনায় সম্পদের মর্যাদায় ভূষিত হয়। কিন্তু রিপুতাড়িত যেসব প্রয়োজন, অভাব এবং মুখাপেক্ষিতার কথা আমরা জানি এ মহাজগতের মহান অধিপতি কি সেসব বিষয়কে প্রয়োজন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়? বাংলা প্রয়োজনের আরবী প্রতিশব্দ হল, জরুরত। এর ধাতুমূল হল যরর। যার সাদা মাঠা আবিধানিক অর্থ দাঁড়ায় ক্ষতি। অর্থাৎ জরুরত বা প্রয়োজন হল মানুষের এমন অভাব বা মুখাপেক্ষিতা মোচন যার অন্যথা হলে মানুষ দৈহিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সুতরাং মানুষের ক্ষতিপূরণ, সঙ্কট নিরসনই হল প্রয়োজন পূরণ। অতএব যেসব বিষয়ের মাঝে মানুষের সঙ্কট নিরসন এবং ক্ষতিপূরণের সক্ষমতা আছে তাই প্রকৃত অর্থে সম্পদ। রিপুতাড়িত অবিধানিক অভাব বিমোচনের সক্ষমতা যাতে বিদ্যমান তা আর যাইহোক সম্পদ বা ‘মাল’ এর পদমর্যাদা লাভ করতে পারে না। এটাই সম্পদের ইসলামিক দর্শন। ¯্রষ্টায় বিশ্বাসী একজন মুসলিমের জন্য ধনাত্মক এ দর্শনকে এড়িয়ে যাবার কোন সুযোগ নেই। ইসলামী অর্থদর্শন মতে যেসব বিষয় সম্পদের পরিধিভুক্ত নয় তাতে মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন নেই। কারণ ব্যবহারিক দিক থেকে যেগুলো সম্পদের পর্যায়ভুক্ত নয় তার সাথে মালিকানা স্বত্বের কোন সম্পর্ক নেই। প্রকৃত সম্পদের সাথেই কেবল মালিকানা বা স্বত্বাধিকারের আবশ্যিক সম্পর্ক বিদ্যমান। একটি বিষয় সম্পদ হয়ে উঠার পেছনে তার অর্জন-উপার্জন প্রক্রিয়ারও বিরাট অবদান রয়েছে। ইসলামিক নীতি স্বীকৃত শুদ্ধ প্রক্রিয়ায় যদি সম্পদ আহরণ বা উপার্জন হয় তাহলে তা আহরণকারী এবং উপার্জনকারীর জন্য প্রকৃত সম্পদ হিসেবে গণ্য হবে। এবং যথারীতি তাতে তার মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। পক্ষান্তরে আহরণ বা উপার্জন প্রক্রিয়া যদি অশুদ্ধ এবং অবিধানিক হয় তাহলে তা উপার্জনকারী এবং আহরণ কারীর জন্য সম্পদ বলে গণ্য হবে না। ফলে তাতে মলিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে না। মালিকানা বা অধিকার স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত না হলে তাতে ভোগ-ব্যবহারের আইনগত অধিকারও সৃষ্টি হবে না। বৈধ সম্পদ বৈধ উপায়ে উপার্জন করেও তাতে সবরকমের ভোগাধিকার বা ব্যয়াধিকার প্রয়োগ করা যায় না। বৈধতা এবং শুদ্ধতার যাবতীয় পর্যায় অতিক্রম করে সম্পদ হস্তগত হলে শুদ্ধতা এবং বৈধতার ধাপ মাড়িয়েই তাতে ভোগাধিকার কিংবা ব্যয়াধিকার প্রয়োগ করতে হয়। ভোগাধিকার এবং ব্যয়াধিকারে অনৈতিকতার আশ্রয় নেয়া হলেও নিরাপদ পরকাল আশা করা যাবে না। এর জন্যও জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দ-ায়মান হতে হবে। সুতরাং একজন মুসলিমের জন্য জীবন ধারনের আবশ্যিক তাগিদে শরীয়ত স্বীকৃত সম্পদ শরীয়তসম্মত পন্থায় উপার্জন এবং আহরণ করে শরীয়তসম্মত উপায়ে তাতে ভোগাধিকার এবং ব্যবহারিধকার প্রয়োগ করে সম্পদসহ এ মহাজগতের অধিপতির সান্নিধ্য এবং সন্তুষ্টি অর্জনে নিবিষ্ট হওয়া আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের তাওফীক দান করুন।
Bibiliography
(Al-Quran 2:29)
Abu daud, Sulayman Idnul As`ath Al-sijistani. 1431H. Sunanu Abi Daud. Egypt : Dar al-hadith.
Al-bukhari, Muhammad ibn Ismail. 1430 H. Al-jamiAs-Sahih. Egypt : Daru ibn hajham.
Al-Zuhayli, Oahbah Mustafa. 1435 H. Al-fiqhul islamiwa Adillatuhu. Dimask : Dar Al-fikr.
Muslim, Abul Husain Muslim Ibnul Hajjaj Al-QusairiAl-nishapuri. 1430 H. Al-Musnadus Sahih. Egypt : Daru ibn hajham.
Al-harabi, Ab ubaidAl-Qasim Ibn sallam, 1428 H. Kitabul Amwal. Riyad : Dar Al-Fazilah.
Ibn Anas, Abu Abdillah Malik Ibn Anas 1426H.Al-Muatta. Egypt : Dar al-hadith.
Ibn Maja, Abu Abdillah Muhammad ibn IazidAl-Qazbini. 1426H. Sunanu Ibn Majah. Egypt : Dar al-hadith.
Abu yusuf, Ia’qub Ibn Ibrahim. Kitabul Kharaj.Al-Maktabatus samilah.
Al-Qurashi Iahia Ibn adam. Al-Maktabatussamilah.