মুফতী হাফিজুর রহমান
আভিধানিক বিশ্লেষণ
লুকমা একটি আরবী শব্দ। এর আরবী রূপ হলো لقمة । লুকমা শব্দের আভিধানিক অর্থ গ্রাস, খাবার, খাদ্য। আরবী ভাষায় বলা হয়, هو لقم । মানে সে গ্রাস করেছে, মুখে নিয়েছে, গিলে ফেলেছে।
লুকমা বা গ্রাসের সাথে ভুলের সম্পর্ক
হাদীসের গ্রন্থগুলোতে আলী রা. এর একটি বক্তব্য বর্ণিত হয়েছে। আলী রা. বলেন, ইমাম যখন আহার্য প্রার্থনা করে তখন তোমরা তাকে আহার্য দান করো।- মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবাহ, হাদীস ৪৭৯৪। ফুকাহায়ে কেরাম বলেন, খাদ্য প্রার্থনার পন্থা হলো, নীরব হয়ে যাওয়। আলবাহরুর রায়িক ৪/১১। আলী রা. এ বক্তব্যের ব্যাখ্যা হলো, নামাযে ইমাম সাহেব যখন কিরাতে আটকে যায় এবং মুক্তাদীর কাছে এর সমাধান কামনা করে তখন মুক্তাদীর কর্তব্য হলো, পরবর্তী আয়াত বা সূরা বলে দিয়ে ইমামকে সহযোগিতা করা। আলী রা. এর বক্তব্য থেকেই উর্দু, ফারসী ও বাংলার ফিকহী পরিভাষায় লুকমা শব্দের প্রচলনটি এসেছে।
লুকমা এর পারিভাষিক অর্থ
উপমহাদেশীয় ফিকহী পরিভাষায় লুকমা দেয়া মানে ইমাম সাহেবের কিরাতগত ভুল ধরিয়ে দেয়া। আরবী ভাষায় অবশ্য নামাযে লুকমা দেয়াকে الفتح على الامام শব্দে ব্যক্ত করা হয়। তবে নামাযে ইমামের অন্যান্য ভুল ধরিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রেও ‘লুকমা দেয়া’ শব্দের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। লুকমা গ্রহণ করা মানে মুক্তাদী কর্তৃক সংশোধিত কিরাতাংশ গ্রহণ করা।
লুকমা দেয়ার বিধানগত রূপরেখা
ইমাম সাহেব যদি মৌলিকভাবে লুকমা প্রার্থনা করে তবে লুকমা দেয়া সুন্নাত। আর যদি লুকমা প্রার্থনা না করে তবে লুকমা দেয়া মাকরুহ। তবে যদি ভুলের কারণে আয়াতে এমন অর্থ বিকৃতি ঘটে যাতে নামায নষ্ট হয়ে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা তৈরি হয় কিংবা ছোট্ট তিন আয়াত পরিমাণ কিরাত না পড়েই আটকে গিয়ে কোনোভাবেই সামনে না পড়তে পারে তাহলে ইমাম সাহেব লুকমা প্রার্থনা না করলেও লুকমা দেয়া আবশ্যক এবং ইমামের জন্য সে লুকমা গ্রহণ করাও আবশ্যক।
ফুকাহায়ে কেরাম বলেন, মুক্তাদীর জন্য ইমামকে সাথে সাথে লুকমা দেয়া মাকরুহ। তদ্রূপ ইমামের জন্য মুক্তাদীকে লুকমা দেয়ার সুযোগ দেওয়াও মাকরুহ। যেমন আয়াত বেধে যাওয়ার পর নীরব হয়ে যাওয়া কিংবা আয়াতের পুনরাবৃত্তি করতে থাকা। যদি ইমাম সাহেব আয়াতে আটকে যায় তাহলে ফরজ পরিমাণ কিরাত হয়ে গেলে রুকুতে চলে যাবে অথবা অন্য আয়াতে চলে যাবে। তবে লক্ষ রাখতে হবে, অন্য আয়াতে চলে যাওয়ার দ্বারা যেন নামায নষ্ট হয়ে যাওয়ার মত অর্থ বিকৃতি না ঘটে। অথবা সে এক্ষেত্রে অন্য সূরা শুরু করে দিবে। ইমাম সাহেব ফরজ পরিমাণ কিরাত পড়ার পর কিংবা অন্য আয়াতে চলে যাওয়ার পর যদি মুক্তাদী লুকমা দেয় তাহলে কোনো কোনো ফকীহের মতে মুক্তাদীর নামায ভেঙ্গে যাবে। কারণ লুকমা দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে নামাজের সংশোধনের জন্য। এখানে নামাযের সংশোধনের জন্য মুক্তাদির কিরাত না হওয়ায় তার নামায ভেঙ্গে যাবে। কোনো কোনো ফকীহ এর মতে ইমাম সাহেব আয়াতে আটকে গিয়ে অন্য আয়াতে চলে যাওয়ার পর যদি মুক্তাদী লুকমা দেয় আর ইমাম সাহেব সে লুকমা গ্রহণ করে তবে ইমাম মুক্তাদী সকলের নামায নষ্ট হয়ে যাবে। আর যদি ইমাম লুকমা গ্রহণ না করে তবে শুধুমাত্র লুকমাদাতা মুক্তাদীর নামাজ নষ্ট হবে। যদিও মতদুটি প্রাধান্যপ্রাপ্ত নয়।-আলমুহীতুল বুরহানী ফিলফিকহিন নু’মানী ২০/৪৪৮, বাদাইউস সানায়ি’ ২/৪২২, আলবাহরুর রায়িক ৪/১১, আলইনায়াহ শরহুল হিদায়াহ ২/১৩৮
যে পরিমাণ কিরাত পড়ার পর রুকু করে দেয়ার সযোগ আছে সে পরিমাণ কিরাত পড়ার পর যদি ইমাম সাহেব আটকে যায় তাহলে তো ইমাম সাহেবের রুকু করে দেয়া উচিত। আর যদি এ পরিমাণ কিরাত পড়ার পূর্বেই ইমাম সাহেব আটকে যায় তাহলে তার উচিত যে সূরা মনে আসবে পড়া শুরু করে দেয়া। সেখানেই থেমে থাকবে না। ইমামের জন্য বেধে যাওয়া আয়াত বার বার পড়তে থাকা মাকরুহ। আর মুক্তাদীর জন্য উচিত হলো, লুকমা দেয়ার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া না করা। বরং সে এক্ষেত্রে নীরব থাকবে। হয়তো ইমাম রুকু করবে অথবা অন্য সূরা পড়বে কিংবা নিজেই বেধে যাওয়া আয়াতকে শুদ্ধ করে পড়তে পারবে। লুকমা দেয়ার ক্ষেত্রে মুক্তাদীর জন্য তাড়াহুড়া করা মাকরুহ। তবে ইমাম সাহেব যদি রুকু না করে অথবা অন্য সূরা না পড়ে কিংবা নিজেই বেধে যাওয়া আয়াতকে শুদ্ধ করে পড়তে না পারে তাহলে মুক্তাদী লুকমা দিবে।- ফাতাওয়ায়ে মাহমূদিয়া ২/১৮৫, ফাতাওয়ায়ে দারুল উলূম ৭/৮২, মাসায়েলে জুমুআহ ৯১, মাসায়েলে ইমামাত ১৭৯।