প্রসঙ্গ ফতোয়া : সুশীল সমাজ ও মিডিয়ার প্রতিক্রিয়া

ড. মুহাম্মদ আবদুল হাননান


লেখাটির প্রথমেই ‘সুশীল সমাজ’ শব্দটির একটি পরিচিতি প্রয়োজন। ইংরেজি ‘সিভিল সোসাইটির’-র বাংলা প্রতিশব্দ করা হয়েছে ‘সুশীল সমাজ’। প্রধানভাবে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত ইংরেজি শিক্ষিত নাগরিকদের ‘সুশীল সমাজ’-এর অন্তর্ভুক্ত মনে করা যেতে পারে। যদিও সুশীল সমাজের আরো নানা ব্যাখ্যা আছে এবং আরো ব্যাখ্যা আসতে পারে, আর আসাটাই স্বাভাবিক, তবে আমরা মোটামুটি কাছাকাছি পূর্বোক্ত ধারণাটি নিয়ে আলোচনাটিতে অগ্রসর হতে পারি।

এ প্রসঙ্গে ‘ফতোয়া’ শব্দেরও একটা পরিচিতি ব্যাখ্যা প্রয়োজন। আরবি ‘ফতোয়া’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে ‘আইন সম্বন্ধীয় মত’। [বাংলা একাডেমী আরবি-বাংলা অভিধান, ঢাকা ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১৮৬]। তবে ঠিক সাধারণ আইন সম্বন্ধীয় অভিমত নয় ফতোয়া, বরং ধর্মীয় আইনবিশেষজ্ঞ কর্তৃক প্রদত্ত ও প্রকাশিত বিধানকে ইসলামি পরিভাষায় ‘ফতোয়া’ বলা হয়েছে। [ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, দ্বিতীয় খ-, ১৯৮২, পৃষ্ঠা ৭৬]।

ব্যক্তি বিশেষ কর্তৃক উপস্থাপিত কোনো প্রশ্নের শরিয়ত সম্মত উত্তর দান করাই ফতোয়ার মূল উদ্দেশ্য। এতে পূর্ববর্তী নজির, ইংরেজিতে যাকে Precedent বলে, তাকে সামনে রাখা হয়। আর এ কাজটি করতে পারবেন একমাত্র তিনি, ইসলামি পরিভাষায় যাঁকে ‘মুফতি’ বলা হয়। একজন মুফতি কেবলমাত্র তার নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কোনো ফতোয়া দিতে পারেন না, যদিও বিচার-বিশ্লেষণে তাঁর নিজস্ব মত প্রকাশের অবকাশ রাখেন। [সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৭৬]।

ইসলামি শরিয়ায় ‘মুফতি’ কোনো বিচারক নন, তিনি হচ্ছে Juriesconsult (ধর্মীয় আইন বিষয়ে পরামর্শদাতা)। ইসলামি শরিয়ার বিধান যা ‘ফিকহ শাস্ত্র’ নামে অভিহিত, মুফতি এই শাস্ত্রে একজন পণ্ডিত এবং একমাত্র তিনিই পারেন ফতোয়া দিতে, আর ধর্ম বিশ্বাসী জনগণের কাছে তাঁর ফতোয়া গ্রহণযোগ্য হবে।

‘মুফতি’ এবং ‘সুশীল সমাজ’ সম্পর্কে আমরা এখানে একটা সাধারণ ধারণা পেলাম। এটা নিছক সাধারণ ধারণাই, কারণ এসব শব্দের রয়েছে ব্যাপক তাৎপর্য, যার ভেতরে প্রবেশ বিশদ ব্যাখ্যায় যাওয়া থেকে এই আলোচনায় বিরত থাকা যৌক্তিক মনে হয়েছে।

এখন আমরা দেখতে পারি, এই ‘ফতোয়া’ সম্পর্কে বাংলাদেশের সুশীল সমাজ ও মিডিয়া কী মনে করে। বাংলাদেশের সুশীল সমাজ ও মিডিয়া ‘ফতোয়া’ বিষয়ে এই একুশ শতকেও অন্ধকারে রয়েছে। অথবা বলা যায়, জেনেশুনেও ফতোয়া শব্দের অপব্যবহারের বিষয়টা তাঁরা এক রকম উপভোগই করেন। এর ফলে মিডিয়া নিজেরাও মাঝে মাঝে ‘ফতোয়া’ তৈরি করেন এবং তা প্রচারও করে থাকেন। পরে সুশীল সমাজ এই ফতোয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিবৃতি দেন, কলাম লেখেন।

বাংলাদেশে বিগত কয়েক দশকে কয়েকশত ‘ফতোয়া’ নামক ঘটনা মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে, যা মূলত কোনো ফতোয়াই ছিল না। বিশেষ করে গ্রামবাংলার বিভিন্ন সালিশ বৈঠকের রায়কে ফতোয়া বলে প্রচার করা হয়েছে। গ্রামের চেয়ারম্যান, সমাজের মাতব্বর অথবা বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি এবং কোথাও কোথাও মসজিদের সাধারণ ইমাম এসব সালিশ বৈঠকে উপস্থিত থেকেছেন। কিন্তু এদের কেউ ‘মুফতি’ নন। এদের সম্মিলিত রায়ে কোনো মুফতি উপস্থিত ছিলেন এমন ঘটনা বিরল। অথচ তাদের রায়কে ‘ফতোয়া’ বলে উল্লেখ করে মিডিয়ায় প্রচার করার ঘটনার তালিকাটি দীর্ঘ।

এ প্রসঙ্গে ১৯৯৩ সালে মৌলভীবাজারের ছাতক ছড়া গ্রামের এক সালিশ বৈঠকের ফয়সালার কথা উল্লেখ করা যায়। এই সালিশে নূরজাহান নামে এক গৃহবধূকে বিয়ে সংক্রান্ত জটিলতার প্রশ্নে কোমর সমান গর্তে দাঁড় করিয়ে ১০১টি পাথর ছুড়ে হত্যা করা হয়। ঘটনাটি সারাদেশকে আলোড়িত করেছিল। মিডিয়া এই সালিশের সিদ্ধান্তকে ‘ফতোয়া’ বলে প্রচার করে। পরে সুশীল সমাজ এ নিয়ে সারাদেশে তোলপাড় করে ইসলামের ফতোয়া রীতিরই বিরোধিতা করতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে নূরজাহান হত্যাকাণ্ডে ‘মুফতি’ মর্যাদার কেউ জড়িত ছিলেন না, বরং এতে নেতৃত্ব দেন মনির সর্দার নামক এক গ্রাম্য মোড়ল। অথচ এজন্য ইসলামকে এবং তাঁর শরিয়ার বিধানকে দায়ী করা হচ্ছিল।

প্রকৃতপক্ষে সুশীল সমাজ এবং মিডিয়া বারবার এক্ষেত্রে যে ভুলটি করে তাহলো, সালিশ ও ফতোয়াকে তারা এক করে ফেলে। এ কাজটি তারা কখনো করে অজ্ঞতা থেকে, কখনো কখনো করে থাকে ইসলাম বিদ্বেষী মনোভাব থেকে। ফতোয়া’র নাম করে কোনো নারী নির্যাতন বা সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টির পেছনে হাক্কানী আলেম-সমাজ অথবা মুফতি শ্রেণির কেউ জড়িত আছেন কি না তা না খুঁজেই তারা এ প্রচারণা চালিয়ে থাকেন।

অবশ্য আমাদের দেশে অতীতের কিছু কিছু ঘটনা এমন আছে যে, রাজনৈতিক আলেম সমাজ তাদের রাজনীতির স্বার্থে অনেক সময় ফতোয়া দিয়েছেন, এ এক কঠিন সত্য বটে। যেমন, পাকিস্তান আমলে ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগ বনাম যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে কিছু ফতোয়া প্রচার করা হয়েছিল, যা ছিল বিতর্কিত। যেমন, ‘মুসলিম লীগকে ভোট না দিলে বিবি তালাক হয়ে যাবে’। প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল ১৯৪৬ সালে প্রচারিত মাওলানা শামসুল হক ও শর্ষীনার পীর সাহেবের ফতোয়া, যখন ভারত থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্র জন্মের জন্য ভোট গ্রহণ চলছিল। তাঁরা এ সময় ফতোয়া দিয়েছিলেন যে, ‘মুসিলম লীগের বিরুদ্ধে ভোট দিলে কোরআন ও সুন্নাহর বরখেলাপ হবে’। এই ফতোয়াই ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগ ভিন্নভাবে ব্যবহার করে যে, ‘মুসলিম লীগে ভোট না দিলে বিবি তালাক হয়ে যাবে’। [বাংলাদেশে ফতোয়ার ইতিহাস, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৩৯]।

প্রকৃতপক্ষে এই জন্য ওলামা-হযরতদের দোষ দেওয়া যায় না। তাঁরা যে বিশেষ পরিস্থিতিতে ১৯৪৬ সালে ফতোয়া দিয়েছিলেন তাতো যুগ পরিপ্রেক্ষিতে সঠিকই ছিল। কিন্তু মুসিলম লীগের রাজনীতিকরা (ওলামারা নন) আরো প্রায় ১০ বছর পর তা নিজেদের স্বার্থে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে। মুসলিম লীগে অবস্থানকারী কোনো আলেম যদি তখন তা সমর্থনও করে থাকে, তাহলেও তাতে হাক্কানী আলেম-মাশায়েখদের দোষ নেই। কারণ রাজনৈতিক দলে যুক্ত আলেমদের নামের আগে ‘মাওলানা’ শব্দটি থাকলেও তিনি প্রধানত রাজনীতিকই। তাঁর রাজনৈতিক স্বার্থে তিনি তখন অনেক কিছু করতে চাইলে এবং অনেক কিছু বলতে চাইলেও তা দীনের স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কহীন। সুশীল সমাজ ও মিডিয়াকে এমন ওলামাকে ‘রাজনীতিবিদ’ হিসেবেই দেখতে হবে। যেমন, পাকিস্তান আমলের বামপন্থি নেতা প্রফেসর মোজাফফর আহমদ যদি তাঁর রাজনৈতিক স্বার্থে এমন কথা বলেন, যা সুশীল সমাজের কাছে অগ্রহণযোগ্য, তাহলে তো তাঁরা তখন সকল ‘অধ্যাপক-সমাজ’-কে এজন্য সমালোচনা করবেন না। বিষয়টি এমনই যে, কোনো ওলামা যখন রাজনৈতিক দলে যুক্ত থাকেন, তখন তাঁর নামের আগে ‘মাওলানা’ শব্দ বিশিষ্ট থাকলেও তিনি প্রধানভাবে আসলে রাজনীতিবিদ, সেভাবেই মিডিয়া ও সুশীল সমাজকে বিষয়টি দেখতে হবে, গোটা আলেম সমাজকে এজন্য জড়িয়ে ফেলা যথাযথ হয় না।

অন্যদিকে বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সুশীল সমাজের লোকেরাও অনেক সময় ‘ফতোয়া’ দিয়েছেন। এসব ‘ফতোয়া’ না হলেও মিডিয়া একে ফতোয়া হিসেবেই প্রচার দিয়েছে। ১৯৬৮ সালের ১১ই আগস্ট ঢাকায় পাকিস্তান কাউন্সিল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে জেনারেল আইয়ুব খানের দশ বছর পূর্তিতে এক সেমিনারের আয়োজন করেছিল। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেন,

‘আইয়ুব খান হলেন আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ (রসুল)’। [পাকিস্তান অবজারভার, ঢাকা, ১২ই আগস্ট ১৯৬৮]।

সুশীল সমাজ এবং রাজনীতিবিদদের কারণে

১.       অকারণে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ফতোয়া দেওয়ার এমন ঘটনার তালিকা অনেক দীর্ঘ।

২. ১৯৯৪ সালে একজন রাজনীতিবিদ এক অনুষ্ঠানে বলেন, … (অমুক) … সরকার শয়তানের বোন। [দৈনিক ইনকিলাব, ২রা অক্টোবর ১৯৯৪]

৩. একটি রাজনৈতিক দলের নেতা ঢাকায় এক জনসভায় বলেন, বিরোধী দল বিসমিল্লাহ খেয়ে ফেলতে চায়। [ভোরের কাগজ, ২রা অক্টোবর ১৯৯৪]

৪. একজন সামরিক নেতা নির্বাচনকে সামনে রেখে চট্টগ্রামের জনসভায় বলেন, আমরা যদি মুসলমান হই, তাহলে … অমুক মার্কায় ভোট না দিলে ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে। [সংবাদ, ১২ই মে ১৯৯৬]।

অনেক সময় সংবাদপত্র নিজেরাই ফতোয়া দিয়ে থাকে,

৫.       ১৯৯৭ সালে একটি পত্রিকা বিশেষ নিবন্ধে উল্লেখ করে, ‘বাংলাদেশে ইয়াজুয-মাজুয ও দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটেছে’। [দৈনিক দিনকাল, ৮ই ডিসেম্বর ১৯৯৭]।

প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নাম ধরে এ প্রচারণা চালানো হয়েছিল।

৬.       ১৯৯৮ সালে অন্য এক রাজনীতিবিদ ঢাকায় এক জনসভায় বলেন, ‘সরকারের পতন ঘটানো বাংলাদেশের মুসলমানদের ৬ নম্বর ফরয কাজ’। [সংবাদ, ৩০শে জুলাই ১৯৯৮]।

তালিকাটি দীর্ঘ করা যায়, কিন্তু এগুলো দেখানো মূল উদ্দেশ্য নয়। মূল উদ্দেশ্য হলো, এটা সুশীল সামাজ ও মিডিয়াকে উপলব্ধি করানো যে, এসব তথাকথিত ফতোয়ার সঙ্গে দেশের হাক্কানী আলেম সমাজের কোনো সম্পর্ক নেই। এসব তথাকথিত ফতোয়া’র পেছনে রয়েছে প্রতিপত্তি, ক্ষমতা ও নগদ লাভ, ধর্ম বা দীন কিংবা শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা করা উদ্দেশ্য নয়। সুতরাং সুশীল সমাজ ও মিডিয়ার উচিত হবে, এসব ‘ফতোয়া’ হিসেবে প্রচার না করা সালিশ, রাজনৈতিক বাহাস ইত্যাদি বলে উল্লেখ করা। এমনকি ‘ফতোয়াবাজ’, ‘ফতোয়াবাজি’ শব্দও এক্ষেত্রে ব্যবহার না করাই হবে সঙ্গত।

‘ফতোয়া’ হলো একটি ইসলামি বিধান, যা শরিয়তসম্মতভাবে একমাত্র ‘মুফতি’ ওলামা-হযরতরাই দেওয়ার অধিকার রাখেন। অন্য কেউ এরকম ফয়সালা দিলেও তাতে ‘ফতোয়া’ শব্দের ব্যবহার হবে অনৈতিক এবং অগ্রহণযোগ্য। রাষ্ট্র, সরকার এবং জনগণের এটা মানার কোনো প্রয়োজন নেই।

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *