ড. মোহাম্মদ আবদুল হাননান
পবিত্র আল কুরআন আল্লাহ সোহবানাহু ওয়া তা’আলার প্রত্যাদেশের দলিল। প্রত্যাদেশগুলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সবটাই মানুষ। মানুষের হেদায়েতের জন্য প্রত্যাদেশগুলো মহান আল্লাহ, নবি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর মাধ্যমে প্রেরণ করেছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, প্রত্যাদেশগুলোতে আল্লাহ রব্বুল আলামিন মানুষের প্রকৃতি, চরিত্র ও অনেক বৈশিষ্ট্যও বর্ণনা করেছেন। যুগে যুগে মানুষের আচার-আচরণের অভিজ্ঞতা থেকেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা মানব প্রকৃতির এই বিশিষ্টতার কথা উল্লেখ করেছেন।
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, আমি তো সৃষ্টি করেছি মানুষকে শ্রেষ্ঠতম অবয়বে [সূরা তীন, আয়াত নম্বর ৪]। এরপর অন্যত্র রয়েছে, মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই দুর্বল। [সূরা নিসা, আয়াত ২৮]।
আল্লাহ এই মানুষকে ‘শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানতো না’ [সূরা আলাক আয়াত: ৫]। কিন্তু মানুষের মন কুচিন্তায় পূর্ণ। আল্লাহ বলছেন, ‘তার (মানুষের) অন্তরের কুচিন্তা সম্বন্ধে আমি অবহিত’ [সূরা কাফ, আয়াত ১৬]। আর আল্লাহ মানুষকে শ্রম নির্ভর করেই সৃষ্টি করেছেন [সূরা বালাদ, আয়াত ৪]।
আল্লাহ চান, মানুষ একটু বোঝার চেষ্টা করুক কী থেকে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে [সূরা তারিক, আয়াত ৫]। অন্যত্র, আল্লাহ এর উত্তর দিচ্ছেন, ‘মানুষ কি দেখে না, আমি তাকে শুক্রবিন্দু থেকে সৃষ্টি করেছি’ [সূরা ইয়াসিন, আয়াত ৭৭]।
অথচ অনেক আশা ও গর্ব করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছিলেন। ফেরেশতারা আশঙ্কিত হয়ে প্রতিপালককে বলেছিল, ‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে’? মানুষ সৃষ্টি সম্পর্কে ফেরেশতাদের এই আশঙ্কার প্রসঙ্গে আল্লাহ ছোট্ট একটি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি যা জানি তোমরা তা জান না’ [সূরা বাকারা, আয়াত ৩০]।
এ ব্যাপারে প্রতিপালকের দুটি শর্ত ছিল মানুষের প্রতি। প্রতিপালক মানুষকে বলেছিলেন, তোমরা ১. আমার এবাদত করবে আর ২. আমার কোনো শরিক করবে না [সূরা নূর, আয়াত ৫৫]।
এ দুটি বিষয়ে আল্লাহ তা’আলা খুব স্পর্শকাতর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, মানুষদের মধ্যে এরপর যারা এসব বিষয়ে অকৃতজ্ঞ হবে তারা সত্যত্যাগী বলে পরিগণিত হবে [সূরা নূর, আয়াত ৫৫]।
মতভেদ করা মানুষের বৈশিষ্ট্য
কিন্তু আল্লাহ জানতেন মানুষ এসব ব্যাপারে খুব মতভেদ করবে, ‘তোমার প্রতিপালক ইচ্ছে করলে সমস্ত মানুষকে এক জাতি করতে পারতেন; কিন্তু তারা মতভেদ করতেই থাকবে। ’ [সূরা হূদ, আয়াত ১১৮]। আর এজন্য তিনি শেষ পর্যন্ত মানুষকে একটামাত্র জাতি হিসেবে রাখেন নি। যদিও মানুষ ছিল একই জাতি (সূরা মুমিনুন, আয়াত ৫২ অথবা সূরা বাকারা, আয়াত ২১৩, এবং সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৯২]।
কিন্তু মানুষের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছিল অথবা মানুষই মতভেদ সৃষ্টি করে। [সূরা ইউনূস, আয়াত ১৯ অথবা সূরা বাকারা, আয়াত ২১৩]।
শুধু তাই নয়, মানুষ নিজের ধর্মকেও বহুভাগে ভাগ করেছে [সূরা মুমিনুন, আয়াত ৫৩]। অথবা নিজের কাজকর্মে তা একে অপরের বিরুদ্ধে বিভক্ত [সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৯৩]।
তর্ক প্রিয় মানুষ
মানুষ সৃষ্টি করার পর আল্লাহ তা’আলার একটি বড়ো পর্যবেক্ষণ (Observation) হলো, মানুষ খুব তর্ক করে। অথবা তর্ক প্রবণ এক মাখলুক হলো মানুষ। আল্লাহ খেদের সঙ্গে বলেছেন, ‘সে (মানুষ) প্রকাশ্যে তর্ক করে। আমার (আল্লাহর) ক্ষমতা সম্বন্ধে অদ্ভুত কথা বানায়। [সূরা ইয়াসিন, আয়াত ৭৮]। অন্যত্র, ‘তিনি (আল্লাহ) শুক্র থেকে মানুষ সৃষ্টি করেছেন, অথচ দেখো, সে প্রকাশ্যে তর্ক করে [সূরা নাহল, আয়াত ৪]। আবার ‘মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ সম্পর্কে তর্ক করে, তাদের না আছে জ্ঞান, না আছে পথের নির্দেশনা’। [সূরা লুকমান, আয়াত ২০]।
অথবা, ‘আমি মানুষের জন্য এই কুরআনে বিভিন্ন উপমা দিয়ে আমার বাণী বিশদভাবে বয়ান করেছি। (অথচ) মানুষ (এসব) বেশির ভাগ বিষয়েই তর্ক করে। [সূরা কাহাফ, আয়াত ৫৪]।
মানুষ উদাসীন চরিত্রের এবং অজ্ঞতায় পূর্ণ
মানুষের একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো, মানুষ মহান আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে উদাসীন। বিভিন্ন সময়ে বিপদে, আপদে, পরীক্ষায় মানুষের এই উদাসীনতা ধরা পড়ে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রব্বুল আলামীন মানুষের এই উদাসীন চরিত্রের কথাও তুলে ধরেছেন,
১. মানুষ সৃষ্টির চেয়ে আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করা তো আরো কঠিন। অবশ্য বেশির ভাগ মানুষ এটা জানে না। [সূরা মুমিন, আয়াত ৫৭]
২. আল্লাহর প্রকৃতির কোনো পরিবর্তন নেই। এ-ই সরল ধর্ম; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না। [সূরা রুম, আয়াত ৩০]
৩. সার্বভৌমত্ব তাঁরই (আল্লাহরই)। এবাদত করার জন্য তিনি (আল্লাহ) ছাড়া আর কেউ নেই। অতএব তোমরা মুখ ফিরিয়ে কোথায় চলেছ। [সূরা জুমার, আয়াত ৬]
৪. মানুষ তো নিজের উপর বড় জুলুম করে থাকে, আর সে বড়ই অজ্ঞ। [সূরা আহজাব, আয়াত ৭২]।
৫. সকল কাজেই আল্লাহর অপ্রতিহত ক্ষমতা, কিন্তু অনেক মানুষ তা জানে না। [সূরা ইউসুফ, আয়াত ২১]।
সীমালঙ্ঘন করা ও বিভ্রান্ত হওয়া মানুষের স্বভাব
আর স্রষ্টা এবং তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে মানুষের উদাসীনতার কারণেই মানুষ বিভ্রান্ত হয়। সেজন্য আল্লাহ জিজ্ঞেস করছেন,
১. হে মানুষ! তোমাকে কিসে তোমার মহান প্রতিপালক সম্পর্কে তোমাকে বিভ্রান্ত করে রাখল। [সূরা ইনফিতার, আয়াত ৬]।
২. মানুষ বরাবরই সীমালঙ্ঘন করে। কারণ মানুষ মনে করে সে অভাবমুক্ত। [সূরা আলাক, আয়াত ৬-৭]।
সন্দেহবাদী চরিত্রের মানুষ
মানুষের একটা প্রবণতা হলো মানুষ খুব সন্দেহপ্রবণ। সকল কিছুতেই তার সন্দেহ, সেটা স্রষ্টা কিংবা সৃষ্টি যা-ই হোক, মানুষের সন্দেহবাদী মন মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলছে। আল্লাহ বলছেন,
১. তিনিই তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, তারপর একটা কাল নির্দিষ্ট করেছেন। আর একটা নির্ধারিত সময়সীমা আছে যা তিনিই জানেন। তবু তোমরা সন্দেহ কর। (সূরা আনআম, আয়াত ২]।
২. হে মানব জাতি! পুনরুত্থান দিবস সম্পর্কে তোমাদের সন্দেহ! (সূরা হজ্জ, আয়াত ৫]।
মানুষ খুব অস্থির ও তাড়াহুড়ো করে
আল্লাহর দৃষ্টিতে মানুষ স্বভাবগতভাবে অস্থির এবং তাড়াহুড়ো খুব পছন্দ করে। এ বিষয়টিও পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বিবৃত করেছেন,
১. মানুষ যেভাবে ভাল চায়, সেভাবে মন্দও চায়। মানুষ তো খুব দ্রুততা ও তাড়াহুড়া প্রিয়। [সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ১১]
২. মানুষ তো সৃষ্টিই হয়েছে ভীরুরূপে অথবা স্বভাবগতভাবেই মানুষ অস্থির। [সূরা মা’আরিজ, আয়াত ১৯]।
মানুষের কৃপণতা ও অপব্যয়ী চরিত্র
মানুষ স্বভাবগতভাবে খুব কৃপণ। মানুষ মনে করে জীবনে যা সে কামাই করেছে, নিজের গুণেই তা সে করতে পেরেছে। ফলে সে খরচ করতে চায় না। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাখে। শয়তানও মানুষকে ভবিষ্যতের ভয় দেখায়, ফলে মানুষ সম্পদ জমা করতে থাকে এবং সঞ্চয়ের পাহাড় গড়ে তোলে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয় তা’আলা মানুষের এই ‘কার্পণ্য’ বৈশিষ্ট্যকেও পবিত্র কুরআনে তুলে ধরেছেন,
১. মানুষ তো বড়ই কৃপণ। [সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ১৩০]
২. যে অর্থ জমায় এবং বারবার তা গোণে… তাকে ফেলা হবে হুতামায়। … [সূরা হুমাজা, আয়াত ১০৪]
৩. … যে (মানুষ) মুখ ফিরিয়ে নেয়, আর দান করে সামান্যই, সে তো পাষাণ হৃদয়ের (মানুষ)। [সূরা নাজম, আয়াত ৩৩-৩৪]
৪. যে (মানুষেরা) অপব্যয় করে তারা তো শয়তানের ভাই। … (কৃপণের) মতো তোমার হাত যেন গলায় বাঁধা না থাকে…। [সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ২৬-২৯]
৫. … যে (মানুষ) সম্পদ জমা করে এবং আঁকড়ে ধরে রাখবে… জাহান্নাম সে মানুষকে ডাকবে। [সূরা মা’আরিজ, আয়াত ১৭-১৮]
৬. মানুষ যে ধন-সম্পদ নিয়ে কৃপণতা করে কেয়ামতের দিন সেই ধন-সম্পদই তার গলার ফাঁস হবে। [সূরা আল-ই-ইমরান, আয়াত ১৮০]
৭. যে মানুষ কৃপণতা করে এবং মানুষকে কৃপণতার নির্দেশ দেয়, … তারা জেনে রাখুক আল্লাহ তা’আলা অভাব থেকে মুক্ত। [সূরা হাদিদ, আয়াত ২৩-২৪]
৮. যে (মানুষেরা) কৃপণতা করে তারা আসলে নিজেদের উপরই কৃপণতা করে। [সূরা মুহাম্মদ, আয়াত ৩৮]
৯. (মানুষের মধ্যে) তারাই সফলকাম, যাদের মধ্যে কৃপণতা নেই। [সূরা তাগাবুন, আয়াত ১৬]
১০. বুদ্ধিজীবী ও সন্ন্যাসী যারা মানুষের ধন অন্যায়ভাবে ভোগ করে এবং মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিরত রাখে। সোনা-রূপা জমা করে আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। [সূরা তওবা, আয়াত ৩৪]।
মানুষ অকৃতজ্ঞ এক জাতি
আল্লাহ মানুষ থেকে কী আশা করেন! আল্লাহ আশা করেন যে, মানুষ সবসময় আল্লাহর শুকরিয়া (কৃতজ্ঞতা) আদায় করবে। এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি আয়াত আছে,
১. আর আল্লাহ তোমাদের মাতৃগর্ভ থেকে এমন অবস্থায় বের করেছেন যে, তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদের শোনার জন্য কান দিয়েছেন, দেখার জন্য চোখ দিয়েছেন এবং তোমাদের দিয়েছেন একটি দিল, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা বা শোকর প্রকাশ করতে পার। (সূরা নাহল, আয়াত ৭৮]।
২. আর তিনি তোমাদের দিয়েছেন চোখ, কান ও হৃদয়। তোমরা (মানুষেরা) এরজন্য খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। [সূরা সাজদা, আয়াত ৯]।
৩. আর আমি তো তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং তার মধ্যে তোমাদের জীবিকার ব্যবস্থাও করেছি। তোমারা খুব অল্পই কৃতজ্ঞতা আদায় কর। [সূরা আরাফ, আয়াত ১০]।
৪. তিনিই (আল্লাহ) তোমাদের কান, চোখ ও মন দিয়েছেন, (অথচ) তোমরা অল্পই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকো। [সূরা মুমিনুন, আয়াত ৭৮]।
৫. তিনিই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন আর তোমাদের দিয়েছেন দেখা ও শোনার শক্তি এবং একটি অন্তর। অথচ তোমরা অল্পই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। [সূরা মুলক, আয়াত ২৩]।
৬. তুমি কি তাদের দেখনি, যারা মৃত্যুভয়ে হাজারে হাজারে নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। … পরে তিনি (আল্লাহ) তাদের জীবিত করেছিলেন। আল্লাহ (সবসময়) মানুষকে অনুগ্রহ করে থাকেন। অথচ মানুষদের মধ্যে অনেকেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। [সূরা বাকারা, আয়াত ২৪৩]।
৭. যারা আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা বানায়, কেয়ামতের দিন সম্পর্কে তারা কী জানে। আল্লাহ তো মানুষকে অনুগ্রহই করেন। কিন্তু মানুষের বেশির ভাগই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। [সূরা ইউনূস, আয়াত ৬০]।
এই আয়াতগুলো অনেকটা ইতিবাচক শব্দ হিসেবে পবিত্র কুরআনে উল্লিখিত হয়েছে। আবার ইতিবাচক ও নেতিবাচকের মাঝামাঝিও অনেক আয়াত এ বিষয়ে রয়েছে। যেমন,
১. আমি তাকে (মানুষকে) পথের নির্দেশ দিয়েছি, হয় সে কৃতজ্ঞ হবে, না হয় সে অকৃতজ্ঞ হবে। [সূরা দাহর, আয়াত ২-৩]।
২. … তিনি (আল্লাহ) তোমাদের তাঁর কিছু নিদর্শন দেখাতে পারেন। প্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে। [সূরা লোকমান, আয়াত ৩১-৩২]
৩. … আল্লাহ কি কৃতজ্ঞ লোকদের সম্বন্ধে ভাল করে জানেন না। সূরা আনআম, আয়াত ৫৩]।
তবে পবিত্র কুরআনে মানুষের ‘শুকরিয়া’ চরিত্র বিষয়ে বেশির ভাগই নেতিবাচক, অর্থাৎ মানুষ যে ‘অকৃতজ্ঞ’ চরিত্রের সেই ভাষ্যটিই বেশি ফুটে উঠেছে,
১. মানুষ তো তার প্রতিপালকের প্রতি অকৃতজ্ঞ। [সূরা আদিয়াত, আয়াত ২]।
২. নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক মানুষের প্রতি অনুগ্রহশীল। কিন্তু (মানুষের) অধিকাংশই অকৃতজ্ঞ। [সূরা নমল, আয়াত ৭৩]।
৩. মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ। [সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৬৭]।
৪. যদি আমি মানুষকে আমার দয়া দেখাই এবং পরে (কখনো) এই দয়া থেকে বঞ্চিত থাকে, তখনই সে হতাশ ও অকৃতজ্ঞ হয়ে পড়ে। [সূরা হূদ, আয়াত ৯]।
৫. আমি (আল্লাহ) যখন মানুষকে দয়া দেখাই তখন সে খুব আনন্দিত হয়ে পড়ে। আর যখন নিজের কৃতকর্মে তার বিপদ ঘটে, তখন মানুষ হয়ে পড়ে অকৃতজ্ঞ। [সূরা শূরা, আয়াত ৪৮]।
৬. মানুষ (আল্লাহর) বান্দাদের মধ্য থেকে কাউকে কাউকে তাঁর (আল্লাহর সত্তার) অংশ গণ্য করে থাকে। মানুষ তো স্পষ্টই অকৃতজ্ঞ। [সূরা জুখরুফ, আয়াত ১৫]।
৭. তিনি (আল্লাহই) তো তোমাদের জীবনদান করেছেন। তারপর তিনিই তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন। আবার তিনিই তোমাদের জীবিত করবেন। মানুষ খুবই অকৃতজ্ঞ। [সূরা হজ্জ, আয়াত ৬৬]।
অকৃতজ্ঞ মানুষের জন্য বার্তা
মানুষ আল্লাহর অনুগ্রহের পরও অকৃতজ্ঞ হয়ে পড়লে আল্লাহর মনোবেদনার কারণ ঘটে। তখন তার জন্য রয়েছে আল্লাহর কাছ থেকে সমূহ বঞ্চনা, শাস্তি এবং গজব। আল্লাহ বলছেন,
১. আমি অকৃতজ্ঞ ছাড়া আর কাউকে শাস্তি দিই না। [সূরা সাবা, আয়াত ১৭]।
২. তোমরা (মানুষেরা) অকৃতজ্ঞ হলে জেনে রাখো, আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন। তিনি তাঁর বান্দাদের অকৃতজ্ঞতাকে পছন্দ করেন না। [সূরা জুমার, আয়াত ৭]।
৩. মনে রেখ … তোমরা কৃতজ্ঞ হলে তোমাদের প্রতি নেয়ামত আরো বাড়বে, আর অকৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমার শাস্তি হবে কঠিন। (সূরা ইব্রাহিম, আয়াত ৭]।
৪. … তোমাদের যা প্রয়োজন তিনি (আল্লাহ) তোমাদের তা দিয়েছেন। তোমরা আল্লাহর দানকে গণনা করলে তার সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না। অকৃতজ্ঞ মানুষ অতিমাত্রায় সীমালঙ্ঘনকারী। [সূরা ইব্রাহিম, আয়াত ৩৪]।
৫. আল্লাহ বিশ্বাসীদের রক্ষা করেন। তিনি কোনো বিশ্বাসঘাতক অকৃতজ্ঞকে ভালোবাসেন না। [সূরা হজ্জ, আয়াত ৩৮]।
৬. মানুষ কি মনে করে যে, তাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেওয়া হবে? সে কি স্খলিত শুক্র বিন্দু ছিল না? [সূরা কিয়ামা, আয়াত ৩৬]
৭. তোমরা (মানুষেরা) কি মনে কর যে, আল্লাহ তোমাদের এমনি ছেড়ে দেবেন। [সূরা তওবা, আয়াত ১৬]।
৮. সে (মানুষ) কি মনে করে যে, কেউ কখনো তাকে কাবু করতে পারবে না? … সে কি মনে করে যে, তাকে কেউ দেখে নি? আমি তাকে কি দুটো চোখ, জিহ্বা আর ঠোঁট দিই নি?… দুটো পথই কি আমি তাকে দেখাই নি? [সূরা বালাদ, আয়াত ৬-১১]
৯. যারা মন্দ কাজ করে তারা কি মনে করে যে, তারা আমার আয়ত্তের বাইরে থেকে যাবে? [সূরা আনকাবুত, আয়াত ৪]
১০. … মানুষ তা-ই পায়, যা সে করে। তার কাজের পরীক্ষা হবে, তারপর তাকে পুরো প্রতিদান দেওয়া হবে। [সূরা নাজম, আয়াত ৩৯-৪১]।
এরপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সরাসরি শাস্তির প্রকৃতি কী হবে তাও মানুষকে জানান দিয়ে রাখছেন। আল্লাহ বলছেন,
১. আমি অকৃতজ্ঞদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি শেকল, বেড়ি এবং লেলিহান আগুনের শিখা। [সূরা দাহর, আয়াত ৩]
২. অকৃতজ্ঞ অবস্থায় তুমি কিছুকাল জীবন উপভোগ করে নাও, তুমি হবে একজন জাহান্নামী। [সূরা জুমার, আয়াত ৮]
৩. … তোমাদের একদল প্রতিপালকের শিরক করে, … ভোগ করে নাও, শীঘ্রই জানতে পারবে। [সূরা নাহল, আয়াত ৫৫]।
৪. … এভাবে আমি অপরাধী সম্প্রদায়কে প্রতিফল দিয়ে থাকি। [সূরা ইউনূস, আয়াত ১৪]
৫. (সে) মানুষ ধ্বংস হোক, যে এতো অকৃতজ্ঞ। [সূরা আবাসা, আয়াত ১৭]।
মানব চরিত্রে সুবিধাবাদ
মানুষের চরিত্রের একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে অভিযোগ আছে যে, মানুষ খুব দ্রুত তার অবস্থান বদল করে। যখন বিপদ-আপদে পড়ে, তখন একরকম কথা বলে, আবার বিপদ থেকে মুক্ত হয়ে গেলে তার আসল চরিত্র প্রকাশ পায়। মানুষের এই সুবিধাবাদী চরিত্র সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে প্রচুর আয়াত রয়েছে। যেমন,
১. সে (মানুষ) যখন বিপদে পড়ে, তখন সে খুব হা-হুতাশ করে। আর যখন তা কেটে যায় তখন সে কৃপণ হয়ে যায়। [সূরা মা’আরিজ, আয়াত ২০-২১]
২. সমুদ্রের মাঝখানে যখন তোমরা বিপদে পড়ো, তখন তোমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য যাদেরকে ডাকো, তাদের ভুলে যাও। তারপর যখন আল্লাহ তোমাদের সৈকতে এনে উদ্ধার করেন তখন তোমরা আল্লাহর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও। সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৬৭]
৩. মানুষ যখন কষ্টের সম্মুখীন হয় তখন শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে আমাকে (আল্লাহকে) ডাকতে থাকে। যখন সে কষ্ট চলে যায়, তখন মানুষ এমন একটা ভাব করে যে, সে কখনো আমাকে ডাকেই নি। [সূরা ইউনূস, আয়াত ১২]
৪. তারা যখন নৌকায় উঠে… এবং যখন এর উপর ঝড়ো বাতাস বইতে থাকে… তখন তারা আল্লাহকে ডেকে বলে, ‘তুমি এর থেকে আমাদের বাঁচাও, আমরা শোকরবান্দা হব’। তারপর তাদের আল্লাহ যখন বাঁচিয়ে দেন তখন তারা আবার অনাচার করতে থাকে। [সূরা ইউনূস, আয়াত ২১-২৩]
৫. যদি তার (মানুষের) উপর আপতিত দুঃখ-কষ্টের পরে তাকে সুখ-ভোগ করাই, তখন সে বলতে থাকে আমার বিপদ দূর হয়ে গেছে। তখন (মানুষ) আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় এবং অহঙ্কার করে। [সূরা হূদ, আয়াত ৯-১১]
৬. ধৈর্যশীল মানুষের জন্য… নিদর্শন রয়েছে। যখন সমুদ্রের ঢেউ মানুষকে, আষ্টেপৃষ্ঠে ঢেকে ফেলে, তখন মানুষ ‘আল্লাহ আল্লাহ’ বলে ডাকতে থাকে। … যখন (আল্লাহ) তাদের সৈকতে ফিরিয়ে এনে উদ্ধার করেন তখন দেখা যায় কোনো কোনো মানুষ মাঝপথ দিয়ে হাঁটছে। [সূরা লোকমান, আয়াত ৩১-৩২]
৭. মানুষকে যখন দুঃখ দৈন্য স্পর্শ করে তখন সে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে ডাকতে থাকে। এরপর আল্লাহ যখন তাকে দয়া করে তখন মানুষ ভুলে যায় যে বিপদে পড়ে সে এর আগে আল্লাহকে ডেকেছিল। [সূরা জুমার, আয়াত ৮]
৮. মানুষ কষ্টের সময় আমাকে (আল্লাহকে) ডাকে। যখন আল্লাহর অনুগ্রহে কষ্ট থেকে মুক্তি লাভ করে তখন (মানুষ) বলতে থাকে, সে নিজের চেষ্টাতেই এ থেকে মুক্তি লাভ করেছে। [সূরা জুমার, আয়াত ৪৯]
৯. ধন সম্পদ প্রার্থনায় মানুষের কোনো ক্লান্তি থাকে না। … যখন আমি তাকে দয়া করে সুখের স্বাদ দিই। তখন মানুষ বলতে থাকে, ’এটা তো আমার প্রাপ্যই ছিল। আমি তো মনে করি না কেয়ামত বলে কিছু আছে’। … আবার তখন মানুষ বিপদে-আপদে অমঙ্গলে পড়ে যায়, যখন আবার দীর্ঘ প্রার্থনায় বসে যায়। [সূরা হা-মিম-সাজদা, আয়াত ৪৯-৫১]
১০. ওরা (মানুষ) যখন পানি পথে চলতে থাকে তখন পবিত্র মনে আল্লাহকে ডাকতে থাকে। আর আমি (আল্লাহ) যখন তাদের নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দিই, তখন মানুষ শিরক করা শুরু করে। আর এভাবেই মানুষ আমার (আল্লাহর) দান অস্বীকার করে। [সূরা আনকাবুত, আয়াত ৬৫-৬৬]
১১. আল্লাহ যখন মানুষকে দয়া এবং সম্মানিত করে, তখন মানুষ বলে ‘আমার আল্লাহ আমাকে সম্মানিত করেছেন’। আর যখন আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য উপকরণ কমিয়ে দেন, তখন মানুষ বলতে থাকে, আল্লাহ আমাকে হেয় করে দিয়েছেন। [সূরা ফাজর, আয়াত ১৫-১৬]।
আল্লাহর কাছে মানুষের মর্যাদা
বাস্তবিক এই যে, মানুষের এসব নেতিবাচক দিক পবিত্র কুরআনে নানাভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আর একথা সত্যও যে, এই নেতিগুণ ও প্রবণতা, মানুষের মাঝে বেশি করেই আছে। কুরআনে মানুষের এই নেতিগুণের উল্লেখের আসল তাৎপর্য হলো, মানুষ যাতে এর থেকে সাবধানে থাকে। কারণ ‘মানুষ তো ক্ষতিগ্রস্থ অবস্থানে আছে’ [সূরা আসর, আয়াত ২]।
অবশ্য মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কথাও কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। সূরা বাকারায় একটি আয়াতই এই জন্য যথেষ্ট যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এ ব্যাপারে সনদ দিচ্ছেন যে,
… এমন মানুষ ও (আল্লাহর রাজ্যে) আছে যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যারা জীবন সমর্পণ করে দিতে পারে। [সূরা বাকারা, আয়াত ২০৭]।
তাই মানুষ হলো এই জমিনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার খলিফা বা প্রতিনিধি। [সূরা ফাতির, আয়াত ৩৯]। শুধু তাই নয়, আকাশ পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহ রব্বুল আলামিন মানুষের অধীন করে দিয়েছেন। [সূরা লুকমান, আয়াত ২০]। এসব আয়াতের উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ রব্বুল আলামিনের কাছে মানুষের মর্যাদা অনেক বড়ো। সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষ তো আল্লাহ তা’আলার কাছে অলঙ্কৃত হয়েই আছে।