মুফতী হাফিজুর রহমান
যিকরের পরিচয় ও পরিধি
যিকর এবং দু‘আ ইহলৌকিক এবং পারলৌকিক উন্নত ও সমৃদ্ধ জীবন বিনির্মাণের অন্যতম এবং অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ দুটি উপাদান। এ যিকর এবং দু‘আর পুষ্পিত পথ বেয়েই একজন বিশ্বাসী মানুষ উঠে যেতে পারে কৃচ্ছ্র ও তাপস্য সাধনার স্বর্ণচূড়ায়। যিকরের শাব্দিক অর্থ বেশ ব্যাপক। স্মরণ করা, আলোচনা করা, উল্লেখ করা, সংরক্ষণ করা, মুখস্থ করা, সম্মান, প্রশংসা, প্রার্থনা ইত্যাদি অর্থগুলোর সবই যিকরের আভিধানিক অর্থের আওতায় পড়ে। পারিভাষিক অর্থে যিকর বলা হয়, হৃদয়ের এমন একটি অবস্থা যার মাধ্যমে মানুষ পঞ্চ ইন্দ্রীয় দ্বারা আহরিত বিষয়গুলোকে স্মৃতি বক্সে সংরক্ষণ করে রাখতে পারে। কোনো বিষয় হৃদয় জাগ্রত হওয়া কিংবা বাকশক্তিতে উচ্চারিত হওয়াও যিকরের পর্যায়ভুক্ত। এ জন্য বলা হয়, যিকর দুই শ্রেণিতে বিভক্ত। ১. আত্মিক যিকর ২. মৌখিক যিকর। (আততাওকীফ আলা মুহিম্মাতিত তা‘আরিফ ১/৩৪৯, আলকামুসুল মুহীত ১/৫০৭, তাজুল আরূস ২/২২২, লিসানুল আরব ৪/৩০৮)
সুতরাং যিকরের সংজ্ঞা অনুসারে প্রার্থনামূলক বাক্যও যিকরের পর্যায়ভুক্ত। পর্যায়োক্ত যিকরের আভিধানিক এবং পারিভাষিক অর্থ দ্বারা প্রতীয়মান হলো, যিকরের ক্ষেত্রে আল্লাহর নীরব ধ্যান সাধনা যেমন যিকরের পর্যায়ভুক্ত তদ্রূপ আল্লাহ নামের সরব কৃচ্ছ্র সাধনাও যিকরের পর্যায়ভুক্ত। এক্ষেত্রে মুখে ‘আল্লাহ’ নাম জপ করার নিরর্থকতা অন্বেষণ করার কোনো সুযোগ এবং অবকাশ নেই।
সারকথা, যিকর যেমন হৃদয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় তেমন ভাষায় ব্যক্ত করার মাধ্যমেও সম্পন্ন হয়। তবে শ্রেষ্ঠ ও উৎকৃষ্ট মানের যিকর হলো, ঐ যিকর যা ভাষা এবং হৃদয়ের সমন্বয়ে সম্পাদিত হয়। তবে যদি কেউ কোনো একটির মাধ্যমে যিকর আদায় করতে মনস্থ হয় তবে তার জন্য নীরব এবং আত্মিক যিকরের সমন্বিত রূপই উৎকৃষ্ট। (ইমাম নববী, আলআযকার ১/১৩)
তবে এখানে সবিশেষ লক্ষণীয় বিষয় হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত আযকার বা প্রার্থনামূলক বাক্যগুলোর ক্ষেত্রে নীরবত বা হৃত্বিকতার অর্থ হলো, এগুলো ন্যূনপক্ষে নিজ কানে শোনার মতো করে উচ্চারণ করে আদায় করা। এ প্রসঙ্গে ইমাম নববী রহ. বলেন, নামায কিংবা অন্য কোনো বিষয়ের শরীয়তসম্মত যিকর -চাই সেটা আবশ্যক পর্যায়ের হোক কিংবা কাক্সিক্ষত পর্যায়ের হোক- যিকর হিসেবে ধর্তব্য হবে না যতক্ষণ না তা নিজ কানে শোনার মতো করে উচ্চারণ করবে। যদি সে সুস্থ শ্রবণশক্তিসম্পন্ন হয় এবং তাতে কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকে। (আলআযকার ১/১৮)
আর যিকর নিছক তাসবীহ, তাহলীল, তাহমীদ এবং তাকবীরের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যের যাবতীয় কার্যক্রমই যিকর হিসেবে গণ্য। খ্যাতিমান তাবিয়ী আতা রহ. বলেন, যিকরের আসর হলো, ঐ আসর যেখানে হালাল, হারাম, ক্রয় বিক্রয়, নামায, রোযা, বিবাহ, তালাক, হজ প্রভৃতি বিষয়ের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করা হয়।
যিকরের মহত্ত্ব
ইসলামী শরীয়ায় যিকরের গুরুত্ব ও মহত্ত্ব অপরিসীম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
…আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও অধিক স্মরণকারী নারীÑ এদের জন্য আল্লাহ রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপ্রতিদান। (‘সূরা আহযাব’- ৩৫)
অন্যত্র বলেন,
তোমরা আমাকে স্মরণ কর; আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব। তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও; কৃতঘœ হয়ো না। (‘সূরা বাকারা’- ১৫২)
আর শুধু মানব শ্রেণিই আল্লাহর যিকরের দায়িত্ব পালন করে না। জিন ফেরেশতা থেকে শুরু করে পৃথীবীর তাবৎ প্রাণীকূল এবং জড়জগৎও আল্লাহর যিকরে ব্যাপৃত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
সপ্ত আকাশ, পৃথিবী এবং তাদের অন্তর্বর্তী সবকিছু তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং এমন কিছু নেই, যা তাঁর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না। কিন্তু তাদের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা তোমরা অনুধাবন করতে পারো না। (‘সূরা বানী ইসরাঈল’- ৪৪)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলছেন,
তোমরা কি দেখো না, আকাশম-লী ও পৃথিবীতে যারা আছে তারা এবং উড্ডীয়মান বিহঙ্গকুল আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে? প্রত্যেকেই জানে, তার ইবাদত ও পবিত্রতা ঘোষণার পদ্ধতি। (‘সূরা নূর’- ৪১)
আবু হুরায়রা রাযি. সূত্রে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
মুফাররিদগণ অগ্রগামী হয়ে গেছে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, আল্লাহর রাসূল! মুফাররিদ কারা? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, মুফাররিদ হলো, আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী নারী পুরুষ। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ৬৯৮৪, ইমাম নববী, আলআযকার ১/১৪)
দু‘আ প্রার্থনার তাৎপর্য
দু‘আ প্রার্থনা হচ্ছে, মুসলিম জীবন-সাধনার অবিচ্ছেদ্য একটি অঙ্গ। অভিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতা বলিষ্ঠভাবে এ কথা প্রমাণ করে, জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই শুধু কর্ম-প্রচেষ্টাই যথেষ্ট নয়। সফলতার জন্য কর্ম-প্রচেষ্টার সাথে সাথে দু‘আ-প্রার্থনারও আশ্রয় নেওয়া প্রয়োজন। কারণ অধিকাংশ সময়ই আমাদের ইচ্ছা-বাসনা, অভিপ্রায় ও কর্মকা- সফলকাম হয় না। অথচ আমাদের বিচার বুদ্ধি ও দূরদৃষ্টি অনুসারে যে কোনো কাজে আমরা সঠিক পন্থাই অবলম্বন করে থাকি। উপরন্তু দু‘আ-প্রার্থনা হচ্ছে মানসিক প্রশান্তির একটি উত্তম মাধ্যম। এতে তুষ্টি ও পরিতৃপ্তির নিয়ামত আপনা-আপনিই অর্জিত হয়। এ দু‘আর মাধ্যমে মানব হৃদয় অস্থিরতা ও সংকোচনশীলতার পর এক ধরনের স্থিরতা ও প্রশান্তি অনুভব করে। তাই দু‘আর পর দুঃখ-কষ্ট বিদূরীত হোক বা না হোক, কোনো আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ হোক বা না হোক, মানব-হৃদয় অবশ্যই স্বস্তি লাভ করে। বিনয়াবনত চিত্তে ও কাঁদো কাঁদো স্বরে দু‘আ প্রার্থনার ফলে মনের যাবতীয় চাপ ও গ্লানি প্রশমিত হয়। হৃদয়ের গহীনে দুঃখ-বেদনার যে কালো মেঘ ছায়া ফেলে তা বিন্দু বিন্দু অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে এবং দুঃখ-কষ্টের তীব্রতা ও তিক্ততা হ্রাস পায়। মানসিক শান্তির এ প্রক্রিয়ার দিকে ইঙ্গিত করেই পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
জেনে রেখো, আল্লাহর যিকর দ্বারা হৃদয়সমূহ শান্তি ও স্বস্তি লাভ করে। (‘সূরা হুদ’- ২৮)
আর দু‘আ-প্রার্থনা হলো যিকরের অন্যতম একটি শাখা। বস্তুত দু‘আ বা প্রার্থনা হচ্ছে প্রকৃতির অন্যতম ক্রিয়াশীল একটি শক্তি। সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা‘আলা যেমন ওষুধের মাঝে রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা প্রদান করেছেন তেমনি দু‘আ-প্রার্থনার মধ্যেও এক ধরনের ক্রিয়াশীল শক্তি রেখে দিয়েছেন। তাই ওষুধের ক্রিয়াশীলতার ব্যাপারে যেমন মনে কোনো সন্দেহ জাগ্রত হয় না, তেমনি দু‘আ-প্রার্থনায় নিহিত ক্রিয়াশীল ক্ষমতা সম্পর্কেও আমাদের মনে দ্বিধা-সংশয় থাকা উচিত নয়। সেই সাথে এটিও একটি অনস্বীকার্য সত্য যে, ওষুধে যথারীতি নিরাময় ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রেই তা ব্যর্থতায় পর্যবশিত হয়। অত্যন্ত পরীক্ষিত ওষুধ হাতে থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় রোগ-ব্যাধিকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয় না। ঠিক তেমনি দু‘আ কোনো কোনো ক্ষেত্রে উদ্দিষ্ট ফল লাভে কার্যকর হয়েছে বলে মনে নাও হতে পারে। তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। মৃত্যু, চিকিৎসা বিজ্ঞানের এ চরমোৎকর্ষের দিনেও এক বিরাট দুর্জ্ঞেয় রহস্য। কোনো কার্যকর ও শক্তিশালী ওষুধই তাকে প্রতিরোধ করতে পারে না। মৃত্যুর প্রতিরোধে চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই চূড়ান্ত ব্যর্থতা সত্ত্বেও ওষুধ সেবন বর্জন করার পরামর্শ দেবে এমন কোনো সচেতন (?) লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনুরূপভাবে কখনো কখনো যদি দু‘আ-প্রার্থনায় আপাতদৃষ্টিতে কোনো কাজ নাও হয়, তবুও তাকে নিষ্ফল বা নিরর্থক বলে একচোখা সিদ্ধান্ত নেওয়া কোনো ক্রমেই উচিত নয়। কারণ দু‘আ কার্যকর হওয়ার বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। এর চূড়ান্ত ফলাফল পার্থিব জগতে পরিলক্ষিত নাও হতে পারে। কিংবা হলেও তা অত্যাসন্ন বিপদ-বিপর্যয় রোধ হিসেবে কার্যকর হবে। নতুবা এর প্রতিদান পরকালীন কর্মপত্রে সন্নিবেশিত হয়ে দু‘আর কার্যকারিতা প্রকাশিত হবে। সত্য বলতে কি মানবÑপ্রকৃতির উপর ক্রিয়াশীল বস্তুগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত ক্রিয়াশীল হচ্ছে এ দু‘আ বা প্রার্থনা। পবিত্র কুরআনে দু‘আর ক্রিয়াশীলতার ব্যাপারটি নানা আঙ্গিকে আলোচিত হয়েছে।
দু‘আর মহত্ত্ব
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
তোমাদের প্রতিপালক বলেন, তোমরা আমাকে ডাক; আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। (‘সূরা মু’মিন’- ৬০)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
আহ্বানকারী যখন আমাকে আহ্বান করে তখন আমি তার আহ্বানে সাড়া দিই। (‘সূরা বাকারা’- ১৮৬)
অন্যত্র বলেন,
তোমরা বিনীতভাবে ও গোপনে তোমাদের প্রতিপালককে ডাক। তিনি সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না। (‘সূরা আ’রাফ’- ৫৫)
আনাস রা. সূত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে,
দু‘আ-প্রার্থনা হলো ইবাদত-উপাসনার প্রাণশক্তি। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ৩৩৭১)
অন্য বর্ণনায় আনাস রাযি. সূত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে,
তোমরা সবরকমের প্রয়োজনের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে। এমনকি জুতার ফিতা ছিড়ে গেলেও আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে। (মুসনাদে আবু ইয়ালা; হা.নং ১৩০, মাজমাউয যাওয়ায়েদ; হা.নং ১৭২২১)
অন্য এক হাদীসে আবু হুরায়রা রাযি. সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ প্রার্থনা করে না তার প্রতি আল্লাহ তা‘আলা রুষ্ট হন। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ৩৩৭৩)
দু‘আ মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম
বস্তুত দু‘আ-প্রার্থনার ইতিহাস মানুষের ইতিহাসের মতোই সুপ্রাচীন। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ আবহমানকাল ধরে স্রষ্টা সমীপে দু‘আ প্রার্থনা করে আসছে। বিপদাপদ থেকে মুক্তিলাভ এবং মহত্তর লক্ষ-উদ্দেশ্য অর্জনের নিমিত্ত মানুষ সর্বদাই দু‘আ-প্রার্থনার আশ্রয় নিয়েছে। দুনিয়ার প্রাচীনতম ধর্মগুলোর মাঝে অনাকাক্সিক্ষত শত আবর্তন বিবর্তন সত্ত্বেও তাতে দু‘আ-প্রার্থনার ধারণা আজও পুরো দস্তুর বিদ্যমান রয়েছে। কোনো কোনো ধর্মে শুধু দু‘আ-প্রার্থনাকেই মুক্তির একমাত্র পন্থা রূপে বেছে নেওয়া হয়েছে। এবং এ ব্যাপারে যথেষ্ট কঠোরতা ও কৃচ্ছ্রতার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
দু‘আ-প্রার্থনার বৈজ্ঞানিক দিক
এ পর্যন্ত আলোচিত বিষয়গুলো ছিল দু‘আ-প্রার্থনার ধর্মীয় দিক। আধুনিক দর্শন এবং বিজ্ঞান শাস্ত্রেও দু‘আ-প্রার্থনার ব্যাপারটি সমভাবে স্বীকৃত। ইতিহাস বলে, গ্রিক দার্শনিকরা বেশ উৎসাহের সাথে দু‘আ-প্রার্থনায় ব্যাপৃত হতো। দার্শনিক যিনো এক শ্রেণির পুরোহিতদের দু‘আ পদ্ধতির সমালোচনা করলেও তিনি দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেন, সৎ, পবিত্র এবং খোদাভীরু প্রকৃতির লোকদের দু‘আ-প্রার্থনা অবশ্যই কবুল হতে পারে। গ্রিক দর্শনের পথিকৃত সক্রেটিস দু‘আ-প্রার্থনার সত্যতার প্রতি পুরোপুরি বিশ্বাস রাখতেন এবং এ বিশ্বাস নিয়েই তিনি অনন্তের আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি বলেছিলেন,
স্রষ্টার কাছে আমার অবশ্য অবশ্যই প্রার্থনা করা উচিত। ইহকাল থেকে পরকালের দিকে আমার এ যাত্রা যেন সার্থক হয়- শুধু এ টুকুই আমার প্রার্থনা।
প্রখ্যাত বিজ্ঞানী চার্লস স্টেইনমিটস বলেন,
সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন আমরা নিজস্ব ল্যাবরেটরিগুলোতে দু‘আকে নিয়ে আসব এবং তার সহায়তায় প্রচ- শক্তিমত্তার অধিকারী হবো।
আমেরিকান মনস্তত্ত্ববিদ উইলিয়াম জেমস বলেন,
বিজ্ঞান যত কিছুই বলুক না কেন, আমি তো দেখতে পাচ্ছি, যতক্ষণ দুনিয়া টিকে আছে, ততক্ষণ দু‘আ ও উপাসনাও টিকে থাকবে।
পঞ্চাশ দশকের খ্যাতিমান রাষ্ট্রনীতিবিদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইসেন হাওয়ার বলেন,
বিশ্ব শান্তির স্বপ্ন কেবল তখনই সফল হতে পারে যখন আমরা এই সৎ উদ্দেশে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাবো যে, আমাদের সকল কর্ম-প্রচেষ্টাকে শান্তির কাজে নিয়োজিত করব এবং আন্তরিক ও নিষ্ঠাপূর্ণ দু‘আ-প্রার্থনাকে নিজেদের অভ্যাসে পরিণত করে নেব।
চিন্তাবিদ অর্ডিস হুইটম্যান বলেন,
দু‘আ-প্রার্থনা হচ্ছে মানুষের সবচেয়ে বড়ো প্রবোধ ও সান্ত¡না। আর দু‘আ-প্রার্থনা করার সময় এ মনোভাব থাকা উচিত, খোদা অবশ্যই আমার প্রার্থনা কবুল করবেন।Ñএটা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।
আমেরিকান দর্শন ও মনস্তত্ত্ব বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম জেমস বলেন,
এটা চিকিৎসা বিষয়ক অভিজ্ঞতা থেকেও বিশ্বাসের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে যে, বিশেষ অবস্থা বা পরিবেশে দু‘আ বা প্রার্থনা রোগ নিরাময়ে অত্যন্ত সহায়ক প্রমাণিত হয়। এ কারণে একে একটি বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি ভেবে এর প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করা উচিত। প্রকৃতপক্ষে নৈতিক রোগ-ব্যাধিতে তো দু‘আ বা প্রার্থনা আরো বেশি নিশ্চিতভাবে কার্যকর হয়। কাজেই একে নিরর্থক বা অর্থহীন ভাবা নৈতিক দিক দিয়েই একটি ক্ষতিকর কাজ।
ডা. আলেক্সিস ক্যারেল বলেন,
দু‘আ-প্রার্থনা হচ্ছে আমাদের দৈহিক ও মানসিক শক্তির সবচেয়ে বড়ো উৎস। কোনো মানুষ দু‘আ বা প্রার্থনার চেয়ে অধিক ক্রিয়াশীল কোনো শক্তি সৃষ্টি করতে পারে নি। দু‘আ একটি শক্তিÑএটি ততখানি বাস্তব, যতখানি বাস্তব মধ্যাকর্ষণ শক্তি। একজন চিকিৎসক হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা এই যে, মানুষ যখন সবরকম ওষুধ থেকে নিরাশ হয়ে যায় তখন দু‘আ বা প্রার্থনা তার সবচেয়ে বড়ো অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়। এটি তার সমস্ত হতাশা ও রোগ-ব্যাধি দূর করে দেয়।
মনস্তত্ত্ববিদ ডেল কার্নেগী বলেন,
আপনি যদি স্বভাব-প্রকৃতি কিংবা শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের দিক থেকে কোনো ধর্মীয় ব্যক্তি নাও হন তবু দু‘আ বা প্রার্থনা আপনার প্রত্যয় ও প্রত্যাশার চেয়েও বেশি আপনাকে সাহায্য করতে পারে। কেননা এটা অত্যন্ত কার্যকর জিনিস। (মাওলানা আশিক ইলাহী বুলন্দশহরী কৃত, মুহাম্মদ হাসান রহমতী অনূদিত কুরআন ও হাদীসের আলোকে ফাযায়েলে দোয়া ও আমল ৯-১৩)
এ সকল বিজ্ঞানী অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও দু‘আ-প্রার্থনা সম্বন্ধে তাদের ধারণা খুবই স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার। তারা ধর্মীয় মানদ-ে উত্তীর্ণ না হওয়ায় তাদের পরকালীন জীবন যদিও দিবপদসংকুল এবং ধুয়াশাচ্ছন্ন কিন্তু পার্থিব জগতে তাদের দু‘আ-প্রার্থনার কার্যকারিতার ব্যাপারটি একমাত্র মহান আল্লাহ তা‘আলার কাছেই সমর্পিত। ইচ্ছে করলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের জাগতিক প্রার্থনা কবুল করতেও পারেন। কুরআন হাদীসের ভাষ্য মতেও তাদের জাগতিক প্রাচুর্য এবং স্বচ্ছলতা স্বীকৃত। এসব উক্তির আলোকে প্রতীয়মান হলো, পৃথিবীতে বিদ্যমান ভ্রান্ত ধর্মগুলো এমনকি প্রচলিত দর্শন এবং বিজ্ঞানও দু‘আ-প্রার্থনার কার্যকারিতাকে অকপটে স্বীকার করে নিয়েছে। এতে করে দু‘আ-প্রার্থনার যে একটি বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক ভিত্তিও রয়েছে তাও বলিষ্ঠভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
দু‘আ কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত
এখানে বিশেষভাবে স্মর্তব্য যে, দু‘আ মনোনীত বা কার্যকর হওয়ার ব্যাপারেও কিছু পূর্বশর্ত রয়েছে। কোনো ব্যক্তি যদি নিজের বাস্তব জীবনে আল্লাহর নির্দেশনাবলি পালনে ব্যর্থ হয় এবং গ্রহণ-বর্জন বা হালাল-হারামের ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘনে কুণ্ঠাবোধ না করে তাহলে সে কেবল মুখে কুরআন-হাদীসের কিছু শব্দ বা প্রার্থনামূলক কিছু বাক্য উচ্চারণ করেই নিজেকে তার সুফল পাওয়ার যোগ্য বলে মনে করতে পারে না। মহান আল্লাহ তা‘আলা পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন,
সুতরাং তোমরা ডাকো তার আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে। (‘সূরা মু’মিন’- ১৪)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
আল্লাহ শুধু মুত্তাকী লোকদের (আমল) কবুল করেন। (‘সূরা মায়িদাহ’- ২৭)
আবু হুরায়রা রাযি. সূত্রে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
তোমরা দু‘আ কবুল হওয়ার ব্যাপারে পূর্ণ বিশ্বাসী হয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করো। জেনে রেখো! আল্লাহ তা‘আলা নির্লিপ্ত এবং অমনোযোগী হৃদয়বান লোকদের প্রার্থনা কবুল করেন না। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ৩৪৭৯)
অন্য এক হাদীসে উবাদাতা ইবনুস সামেত রাযি. সূত্রে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
যে কেউ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে আল্লাহ তার দু‘আ কবুল করবেন নতুবা এর বিনিময়ে তার আসন্ন বিপদ-আপদ দূর করে দিবেন। তবে শর্ত এই যে, সে কোনো গুনাহ বা সম্পর্কচ্ছেদের জন্য দু‘আ করবে না। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ৩৩৮১)
অন্য হাদীসে আবু হুরায়রা রাযি. সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
বান্দার দু‘আ কবুল করা হবে যদি না সে পাপ অথবা সম্পর্কচ্ছেদের জন্য দু‘আ করে এবং ফলাফল লাভের জন্য তাড়াহুড়া না করে। জিজ্ঞেস করা হলো, আল্লাহর রাসূল! তাড়াহুড়া কি? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাড়াহুড়া অর্থ এ কথা বলা, আমি এত এত দু‘আ করলাম অথচ আমার দু‘আ কবুল হতে দেখছি না। ফলে সে তখন ক্লান্তিবোধ করে এবং দু‘আ করা ছেড়ে দেয়। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ৭১১২)
অন্য বর্ণনায় আবু সাঈদ খুদরী রাযি. সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
যদি কোনো ব্যক্তি এমন দু‘আ করে যাতে পাপ এবং সম্পর্কচ্ছেদের বিষয় নেই তাকে তিনটি বিষয়ের মধ্য থেকে একটি বিষয় অবশ্যই দান করবেন। (১) হয় তার প্রার্থনা কবুল করবেন। (২) নয় তার সমপরিমাণ আসন্ন বিপদাপদ দূর করে দিবেন। (৩) নতুবা সমপরিমাণ প্রতিদান পরকালের জন্য সঞ্চয় করে রেখে দিবেন। (মুস্তাদরাকে হাকেম; হা.নং ১৮১৬)
অন্যত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
এক ব্যক্তি সুদীর্ঘ পথ সফর করে উষ্কখুষ্ক, ধূলোমলিন হয়ে আকাশ পানে হস্ত উত্তোলন করে বলে, হে আমার প্রতিপালক! হে আমার প্রতিপালক! অথচ তার আহার্য হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পরিচ্ছদ হারাম এবং হারাম উপার্জনেই তার আহার চলে। তাহলে এ ব্যক্তির দু‘আ কীভাবে কবুল করা হবে? (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ২৯৮৯)
দু’আ-প্রার্থনার স্থান কাল
যিকর এবং দু‘আ পবিত্রতম দুটি ইবাদত। সুতরাং এগুলো প্রতিপালনের জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং পবিত্র স্থান-কাল নির্বাচন করা জরুরি। সাথে সাথে যিকর-দু‘আর মর্মার্থগুলো হৃদয়পটে ভাসমান রাখাও বাঞ্ছনীয়। ইমাম নববী রহ. বলেন,
যেসব স্থানে বসে আমরা যিকর করব সে সব স্থানগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং নীরব-নিস্তব্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ যিকর একটি মাহাত্ম্যপূর্ণ শ্রেষ্ঠতর বিষয়। এ কারণে মসজিদ কিংবা অভিজাত পরিবেশে যিকর করার বিষয়ে প্রশংসা জ্ঞাপন করা হয়েছে।
আবু মাইসারাহ রাযি. বলেন,
অনুত্তম স্থানে আল্লাহর যিকর করা যাবে না। সাথে সাথে যিকরকারীর মুখাবয়বও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং দুর্গন্ধমুক্ত হওয়া উচিত। আর যিকরের মূল উদ্দেশ্য ও প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, হৃদয়ে আল্লাহর ধ্যান-জ্ঞান সৃষ্টি করা। সুতরাং এ বিষয়টি একজন যিকরকারীর মৌল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। সুতরাং সে এ উদ্দেশ্য অর্জনে প্রলুব্ধ হবে এবং যিকরের ক্ষেত্রে যে বাক্য বা শব্দাবলি পাঠ করবে সেগুলোর ব্যাপারে গভীর চিন্তা-ভাবনা করবে। এবং সেগুলোর অর্থসমূহ বোধগম্য করার চেষ্টা করবে। কারণ যিকরের ক্ষেত্রে চিন্তা-ভাবনা একটি কাক্সিক্ষত ও বাঞ্ছনীয় বিষয়। যেমনটি কুরআন পাঠের ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত। (আলআযকার ১/১৬-১৭)
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে যিকর এবং দু‘আর যাবতীয় আবশ্যক এবং কাক্সিক্ষত অনুসঙ্গগুলো বিবেচনায় রেখে যিকর-আযকার এবং দু‘আ প্রার্থনায় নিরত হওয়ার সক্ষমতা দান করুন।