শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. সম্পর্কে স্মৃতিচারণ মূলক নিবন্ধ: রহমতের শিশির ছোঁয়ায়

মুফতী মাহমূদুল আমীন



আটই আগস্ট, ২০১২ খ্রি. বুধবার।বা‘দ যোহর জামি‘আ ইসলামিয়া চরওয়াশপুরমাদরাসায় হাজির হলাম। অফিস রুমে প্রবেশ করেই জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়ারমুহতামিম আমার উস্তাদে মুহতারাম হিফযুর রহমান ছাহেব (মোমিনপুরী হুযুর) কে উপবিষ্ট দেখতেপেলাম। কিন্তু হুযুরকে আজ বড়ো বিষণœ মনে হলো। আমি ধীরেধীরে হুযুরের পাশে গিয়ে বসলাম। সালাম, মুসাফাহার পর হুযুরবললেন, আজ যোহর নামাজের পূর্বে হযরত শাইখুল হাদীস ছাহেব হুযুরইন্তিকাল করেছেন। একথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। ইন্না লিল্লাহ… পড়লাম। মোমিনপুরী হুযুরেরমতো আমার হৃদয়টাও ছেয়ে গেল বিষাদ বেদনায়। স্মৃতির বাতায়নে হারিয়ে গেলাম দূর শৈশবে…

আমি তখন অবিভক্ত রাহমানিয়ার মীযান জামা‘আতের ছাত্র। কোনো এক বন্ধে বাড়িতে গিয়েছি। শুনতে পেলাম এনজিওদের বিরুদ্ধে এক মহাসমাবেশ হবে। সমাবেশের স্থান বাহাদুরপুর। যেখান থেকে ফরায়েজী আন্দোলন নামে এক ঝড়ো আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। যে আন্দোলনের তীব্রতায় ল–ভ- হয়ে গিয়েছিল ইংরেজ বেনিয়া গোষ্ঠী এবং তাদের দোসরদের তখতে তাজ। হাজী শরীয়তুল্লাহ ও পীর মুহসিন উদ্দীন দুদুমিয়া রহ.-এর যোগ্য উত্তরসূরি শহীদ পীর মুসলিহুদ্দীন আবু বকর মিয়া র.-এর আহ্বানে এনজিও বিরোধী এ মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। যেহেতু আমার আব্বা ছিলেন বাহাদুরপুর শরীয়াতিয়া আলিয়া মাদরাসার ভাইস প্রিন্সিপাল এবং ঐ আস্তানার একজন অন্যতম দায়িত্বশীল, তাই আমি ঐ মহাসমাবেশের একজন কর্মী হয়ে গেলাম। সমাবেশের প্রধান অতিথি ছিলেন শাইখুল হাদীস রহ.। বিশেষ অতিথি ছিলেন হযরত মুফতী ফযলুল হক আমীনী ছাহেব এবং হাফেয মাওলানা উমর আহমাদ ছাহেব। এছাড়াও দেশ বরেণ্য ইসলামি নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। পীরমঞ্জিলের যে কামরায় পীর মুহসিন উদ্দীন আহমাদ দুদুমিয়া রহ. থাকতেন সমাবেশ শেষে শাইখুল হাদীস ছাহেব হুযুর সহ নেতৃবৃন্দ সে কামরায় বসলেন। বিদ্যুৎ ছিল না বিধায় আমি হাতপাখা দিয়ে সবাইকে বাতাস করছিলাম। তখন শাইখুল হাদীস ছাহেব হুযুর আমার দিকে তাকিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় বললেন, তুমি কে? তোমাকে চিনি চিনি মনে হয় (পরিচিত পরিচিত লাগছে)। তখন পীর আবু বকর মিয়া ছাহেব বললেন, হুযুর! এ তো আপনার মাদরাসার ছাত্র। আমাদের ভাইস প্রিন্সিপাল ছাহেবের ছোটো ছেলে। তখন হুযূর মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন, কিয়ামতের দিন যখন জান্নাতীগণ জান্নাতের দিকে রওয়ানা হবেন তখন কিছু লোককে দেখতে পাবেন যাদের এখনো জান্নাতে যাওয়ার ফায়সালা হয় নাই, তখন জান্নাতীরা বলবেন, ‘এদেরকে চিনি চিনি মনে হচ্ছে? তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, ‘এদেরকে যখন তোমাদের চিনি চিনি মনে হচ্ছে তখন এদেরকে তোমাদের সাথে জান্নাতে নিয়ে যাও।’ একথা শুনে সবাই হাসলেন। আর খুশির আতিশয্যে আমার আঁখিযুগল থেকে গড়িয়ে পড়ল ফোঁটা ফোঁটা অশ্র“। মনের গভীরে উথলে উঠল এক পরম আকুতি, ‘আজ যেমন হুযুর আমাকে চিনলেন পরকালেও যেন তিনি আমাকে চিনতে পারেন।

হযরত শাইখুল হাদীস ছাহেব হুযুর (র.) আজিমপুর যে কলোনির ঈদগাহে দীর্ঘদিন ঈদের নামায পড়িয়েছেন সেই সরকারি পার্টি হাউজ কলোনি মসজিদে আল্লাহ তা‘আলা আমাকে জুম‘আর নামায পড়ানোর তাউফেক দান করেছেন। রমজান মাসে ঐ মসজিদে তারাবিহও পড়ানোর তাউফিক হয়। ব্যথিত মনে আজীমপুর অভিমুখে রওনা হলাম। পথিমধ্যে সংবাদ পেলাম, আগামীকাল সকাল ১১ টায় জাতীয় ঈদগাহে হুযুরের জানাযা অনুষ্ঠিত হবে। তারাবিহর নামাযের পর হুযুরের ইন্তিকালের সংবাদটি এ‘লান করে দিলাম এবং জানাযার সময় এবং স্থানও বলে দিলাম। এরপর সবাই মিলে আমরা হুযুরের রুহের মাগফিরাত কামনায় দু‘আ করলাম। এই কলোনিতে যারা বসবাস করেন তাদের অধিকাংশই প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা। পরদিন তাদের বেশ কয়েকজনসহ হুযূরের জানাযায় হাজির হলাম। হাজার হাজার ওয়ারিছে নবীর এ শুভ্র সম্মেলনে তাঁরা অভিভূত হলেন। নামায শেষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের পরিচালক জনাব আনীসুর রহমান সাহেবের গাড়িতে চড়ে তিনি এবং তাঁর পুত্র সাইফুল্লাহ সহ আমরা হুযুরকে যেখানে কবর দেওয়া হবে সেই আটিবাজারের উদ্দেশে রওনা হলাম। গাড়িতে বসে জনাব আনীসুর রহমান সাহেবের অতীতের স্মৃতি মন্থন করে বলছিলেন:

আমি যখন সিরাজগঞ্জ জেলার ত্রাণ ও পুণর্বাসন কর্মকর্তা ছিলাম তখন মাদরাসাগুলোতে সাধ্যমতো সহায়তা করতাম। এজন্যে মাদরাসার উলামায়ে কেরামের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের বেতুয়া মাদরাসায় শাইখুল হাদীস ছাহেবের এক ছেলে পড়াতেন। সেই সুবাদে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ হুযুরকে মাঝে মাঝে বেতুয়া মাদরাসায় নিতে পারতেন। যখনই হুযুর ঐ মাদরাসায় যেতেন ওস্তাদগণ আমাকে ফোন করতেন। আমি হুযুরের সান্নিধ্যের একটু পরশ পেতে ছুটে যেতাম বেতুয়া মাদরাসায়। মাঝে মাঝে হুযুর আমার হাত ধরে গাড়িতে উঠতেন। একবার আমি আমার গাড়িতে না উঠে হুযুরের গাড়িতে উঠলাম। তখন হুযুর আমাকে তার পাশে বসতে বললেন। দু‘আ নেওয়ার জন্য আমার সন্তানদেরকেও হুযুরের কাছে নিয়ে যেতাম। হুযুরের সামান্য সোহবত আমার জীবনে অনেক কল্যাণ বয়ে এনেছে।

হুযুরের জীবনের নানা স্মৃতি মন্থন করতে করতে আমরা আটি বাজারের সন্নিকটে পৌঁছে গেলাম। আটি বাজারের উত্তর পাশ দিয়ে আঁকাবাঁকা হয়ে বয়ে চলেছে একটি সরু নদী। নদীটির উত্তর তীরে সবুজ শ্যামল গ্রাম। গ্রামটির মাঝ দিয়ে একটি ইট বিছানো রাস্তা পশ্চিম দিকে চলে গেছে। এ রাস্তা দিয়ে কিছুদূর অগ্রসর হয়ে ডানে একটি আঁকাবাঁকা মেঠোপথ। এ পথ ধরে আমরা চলতে লাগলাম। গ্রামের সীমানা পেরিয়ে সবুজের ঢেউ খেলানো সমারোহের মাঝে ইট দিয়ে বাঁধাই করা একটি ছোট্ট কবরস্থান। এই কবরস্থানেই হুযুরকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হবে। হুযুরের কবরে একটু মাটি দেওয়ার জন্য আমাদের পূর্বেই অনেকে চলে এসেছে। কিন্তু হুযুরের কফিন এখনো পৌঁছেনি। বেশ কিছুক্ষণ পর বহু মানুষের কাঁধে চড়ে হুযুরের দেহ এল। পরম মমতায় কবরস্থ করা হলো। হাজারো মানুষের সাথে আমরাও হুযুরের কবরে সামান্য তাজা মাটি দেওয়ার সৌভাগ্য পেলাম।

এরপর মাটি দিয়ে ফিরে এলাম, কিন্তু হুযুরের কবর যিয়ারত করতে মনটা ছটছট করছিল। তাই পরদিন আবারও রওয়ানা হলাম। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব জনাব নজরুল ইসলাম সাহেবের গাড়িতে চড়ে যাচ্ছিলাম। তিনিও সঙ্গে ছিলেন। যেতে যেতে তিনি শাইখুল হাদীস র.-এর সাথে তাঁর সাক্ষাতের এক মধুর স্মৃতি শোনালেন। তিনি বললেন:

আমি তখন বি.বাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার ইউএনও (উপজেলা নির্বাহী অফিসার)। হঠাৎ একদিন অন্তরে প্রবল বাসনা জাগল যে, শাইখুল হাদীস আল্লামা আজীজুল হক সাহেবের নাম অনেক শুনেছি, কিন্তু কোনোদিন তো তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করলাম না! তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করা দরকার। ধীরে ধীরে হুযুরের সাথে সাক্ষাৎ লাভের বাসনা প্রবলতর হতে লাগল। সরাইলের একজন আলেমের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তাঁর কাছে মনের বাসনা ব্যক্ত করলাম। তিনি জামে‘আ রাহমানিয়া মাদরাসার একজন শিক্ষকের মোবাইল নাম্বার আমাকে দিলেন। আমি ঢাকা এসে তাঁকে ফোন করলাম। তিনি বললেন, শাইখুল হাদীস সাহেব হুযুর মাদরাসায় আছেন, তবে বিকেল হয়ে গেছে বিধায় একটু পরে তিনি চলে যাবেন। আমি দ্রুত রাহমানিয়ায় হাজির হলাম। দোতলার বারান্দায় শাইখুল হাদীস ছাহেব হুযুর বসা ছিলেন। আমি সোজা সেখানে চলে গেলাম। আমাকে বসার জন্য চেয়ার দেওয়া হলো। কিন্তু আমি বসলাম না। হুযুরের ভাবগাম্ভির্যপূর্ণ নূরানী চেহারা প্রাণ ভরে দেখতে লাগলাম। হুযুর ‘আল্লাহ আল্লাহ’ যিকির করছিলেন। হুযুরের দিল থেকে উৎসারিত ‘আল্লাহ আল্লাহ’ ধ্বনি আমার দিলকেও সিক্ত করে দিচ্ছিল। আমাকে হুযুরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। কথার এক পর্যায়ে আমি হুযুরকে আফসোস করে বললাম: হুযুর! সারা বিশ্বে তো আজ মুসলমানদের খারাপ অবস্থা…। আমার কথা শুনে হুযুর গর্জে উঠলেন। বললেন, কে বলেছে মুসলমানদের খারাপ অবস্থা? কে বলেছে মুসলমানদের খারাপ অবস্থা? দুবার বলে আবারও যিকিরে লিপ্ত হলেন। উপস্থিত আলেমগণ আমাকে সান্ত¡না দিতে লাগলেন যাতে আমি কিছু মনে না করি। কিন্তু হুযুরের ধমকে আমার তো প্রকৃত বিষয় বুঝে এসে গেছে। আমি বললাম, হুযুর ঠিকই বলেছেন। প্রকৃত মুসলমানদের অবস্থা কখনো খারাপ হতে পারে না। আজ আমাদের মধ্যে পরিপূর্ণ ইসলাম নেই বিধায় আমাদের খারাপ অবস্থা …। আমি হুযুরের কাছে দু‘আ চাইলাম, হুযুর এতে খুব খুশি হলেন, দু‘আ করলেন এবং বললেন, দু‘আ খুব গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। ইতিমধ্যে হুযুরের গাড়ী এসে পড়েছে। হুযুরকে ধরে ধরে গাড়ীতে উঠানো হলো। হুযুরের গাড়ি আজীমপুর যাবে, আমিও আজিমপুর যাব। তাই হুযুরের গাড়িতেই আমাকে আরোহন করার অনুমতি দেওয়া হলো। আমি হুযুরের পাশে একটু দূরত্বে বসা ছিলাম। আমার মন চাচ্ছিলো হুযুরের গায়ের সাথে গা মিশিয়ে বসি। একটু বরকত নিই; কিন্তু এত বড়ো একজন বুযুর্গের গায়ের সাথে ঘেঁষে বসব, মনে দ্বিধা হচ্ছিল। এমন সময় হুযুর বললেন, কাছে এসে গায়ের সাথে গা লাগিয়ে বসুন। আমি সুবর্ণ সুযোগ মনে করে একদম হুযুরকে জড়িয়ে ধরে পাশে বসে রইলাম। হুযুরের গাড়ি প্রথমে তাঁর এক মেয়ের বাসার সামনে গিয়ে থামল। আমি হুযুরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। আর সাথে নিয়ে এলাম হুযুরের প্রতি গভীর মানবিক আকর্ষণ। কথায় কথায় আমরা কবরস্থানে চলে এলাম। গতদিনের ন্যায় আজ বেশি মানুষের ভিড় নেই। আমরা হুযুরের কবর যিয়ারত করলাম। নীরব শান্ত সমাহিত পরিবেশ। চারদিকে সবুজের ঢেউ খেলানো সমারোহ। মাঝে হুযুরের কবর। অদূরে টলটলে স্বচ্ছ পানির হ্রদ। ওপারে কয়েকটি ছায়াদার বৃক্ষ। এপারে কিছু সবুজ কলাগাছ। আমার মনে হলো, জান্নাতে তো নহর থাকবে, সবুজ বৃক্ষ থাকবে, থাকবে কাঁদি কাঁিদ কলাও। হুযুরের কবর-পাশের এই পরিবেশ হয়ত তাঁর সেই জান্নাতী জীবনের দিকেই ইশারা করছে। আয় আল্লাহ! সত্যিই যেন তাই হয়। তাঁর কবর যেন সিক্ত হয় রহমতের শিশির ছোঁয়ায়।

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *