বর্তমান সময়ে কুরবানী ভাবনা: শরঈ ও যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি

মাওলানা ইরফান জিয়া

কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক ইবাদত। এটি শাআইরে ইসলাম তথা ইসলামের বিশেষ নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন,

وَالْبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُمْ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ لَكُمْ فِيهَا خَيْرٌ

‘আর কুরবানীর উট ও গরুকে তোমাদের জন্য আল্লাহর ‘শাআইর’ (বিশেষ নিদর্শন) -এর অন্তর্ভুক্ত করেছি, এতে তোমাদের মঙ্গল রয়েছে।’ সূরা হজ্জ, আয়াত: ৩৬

এ সূরারই অন্য আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,

ذَلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِنْ تَقْوَى الْقُلُوبِ

‘যা বলা হলো সেসব বিষয় স্মরণ রেখো। আর কেউ আল্লাহর শাআইরকে সম্মান করলে তা অন্তরস্থ তাকওয়া থেকেই উৎসারিত।’ সূরা হজ্জ, আয়াত: ৩২

কুরবানীর প্রতি সীমাহীন গুরুত্বারোপ করে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

من كان له سعة، ولم يضح، فلا يقربن مصلانا

‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করে না, সে যেনো আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস: ৩১৩২। মুসনাদে আহমাদ, হাদীস: ৮২৭৩

কুরবানী নিছক একটি ফজীলতপূর্ণ ইবাদতই নয়। বরং এটি সামর্থ্যবান নর-নারীর উপর ওয়াজিব।  কুরবানীর দিনগুলোতে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানী করবে না তাকে গুনাহগার হতে হবে।

সামর্থ্যবান দ্বারা উদ্দেশ্য হলো- প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ যিলহজ্জ ফজর থেকে ১২ যিলহজ্জ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক থাকবে সেই কুরবানীর জন্য সামর্থ্যবান বলে বিবেচিত হবে। -আল মুহীতুল বুরহানী ৮/৪৫৫; ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়া ১৭/৪০৫

শরীয়তের এ ওয়াজিব বিধানটি পালন করার ব্যাপারে বর্তমানে কিছু মানুষের মধ্যে অনিহা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিভিন্ন কারণে তারা এ বছর কুরবানী করতে চাইছেন না। কুরবানী করতে না চাওয়ার কারণগুলোকে সাধারণভাবে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।

১.   করোনার কারণে আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন।

২.   আর্থিক সঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও সংক্রমণের ভয়ে পশু কেনা, কুরবানী করা ইত্যাদির সাহস করতে পারছেন না।

৩.   বর্তমান সময়ে মানুষের আর্থিক দুরাবস্থার কথা বিবেচেনা করে কুরবানী না করে সেই টাকা গরীবদের মাঝে দান করে দেওয়াকে উত্তম মনে করছেন।

প্রথম সারির লোকদের ব্যাপারে হুকুম হলো, সত্যিই যদি তারা আর্থিকভাবে এমন দুর্বল হয়ে পড়েন যে, তাদের কাছে আর নেসাব পরিমাণ সম্পদও অবশিষ্ট নেই, তাহলেতো তাদের উপর কুরবানী ওয়াজিবই নয়। সুতরাং তাদের জন্য কুরবানী না করাতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু যদি আর্থিক দুর্বলতার অর্থ এই হয় যে, তারা আগে হয়তো কোটিপতি ছিলেন এখন লাখপতি হয়ে গেছেন বা আগে নেসাবের চেয়ে অতিরিক্ত অনেক সম্পদ ছিলো এখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত শুধু নেসাব পরিমাণ সম্পদ আছে- সে কারণে কুরবানী করতে চাইছেন না, তাহলে এই আর্থিক দুর্বলতা কোনোভাবেই ধর্তব্য হবে না। তাকে অবশ্যই কুরবানী করতে হবে।

দ্বিতীয় সারির লোক অর্থাৎ যারা ভাইরাসের ভয়ে কুরবানী করতে চাইছেন না, তাদের জন্যও সর্বোত্তম কর্তব্য হলো, যথাসাধ্য সতর্কতা অবলম্বন করে নিজেই কুরবানী করা বা কুরবানীর পুরো কার্যক্রম নিজেই তদারকি করা। কুরবানীর ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে ফজীলতপূর্ণ পদ্ধতি। এটা সম্ভব না হলে যদি সে কমপক্ষে কাউকে নিজের পক্ষ থেকে দায়িত্ব দিয়ে তার মাধ্যমে কুরবানী করায় তাহলেও কুরবানী আদায় হয়ে যাবে।

কিছু চিন্তাশীল মানুষ এ বছর গরুর হাট ইত্যাদি বন্ধ বা সীমিত করে দেওয়ার প্রস্তাব করছেন। তাদের মনে রাখা দরকার- কুরবানী একটি ইবাদত হওয়ার পাশাপাশি এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের অবশ্য প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। একে বন্ধ বা সীমিত করে দেওয়া হলে সাধারণ মানুষের মৌলিক একটি অধিকার ক্ষুণ্ন করা হবে। যেমনিভাবে করোনার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিলো, তেমনিভাবে কুরবানীর সময় যথাসাধ্য সতর্কতা মেনে কুরবানীর পশুর হাট স্থাপনের সুযোগ দেয়াটাই মানবাধিকারের দাবি।

তাছাড়া কুরবানীর পশু বিক্রয়ের সাথে অসংখ্য মানুষের সারা বছরের রুটি-রুজি সম্পৃক্ত। প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবমতে এদেশে খামারের সংখাই ১২ লাখ। এর পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোক্তার সংখাও কম নয়। প্রতিবছর প্রায় এক কোটি পশু এদেশে কুরবানী হয়ে থাকে। এতো বিপুল সংখ্যক পশু অবিক্রিত থাকলে দেশ ও জনগণ অর্থনৈতিকভাবে কত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়

এবার আসি তৃতীয় পর্যায়ের লোকদের আলোচনায়। যারা কুরবানী না করে সে টাকা গরীবদের মধ্যে দান করে দেয়ার চিন্তা করছেন। আসলে কুরবানী একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ইবাদত। নফল দান এটিও আলাদা একটি ইবাদত। একটির সাথে অন্যটির কোনো সম্পর্ক নেই। যেমনিভাবে নামায একটি ইবাদত, রোজা আরেকটি ইবাদত। নামায আদায়ের মাধ্যমে রোযার দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়, আবার শুধু রোযা রাখলে নামায আদায় হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ঠিক তেমনি নফল দানের মাধ্যমে কুরবানী আদায় হওয়াও সম্ভব নয়। তাছাড়া হুকুমের দিক থেকেও গরীবদেরকে দান করা হলো নফল। আর সামর্থবানের জন্য কুরবানী হলো ওয়াজিব। নফল দানের জন্য ওয়াজিব কুরবানী ছেড়ে দেয়ার কোনো অবকাশ নেই।

অথচ ওয়াজিব কুরবানী আদায় করার পরও কারো সামর্থ্য থাকলে তার জন্য গরীবদের সহযোগিতায় নফল দান করারও সুযোগ আছে। এমনকি ভালোভাবে লক্ষ করলে খোদ ওয়াজিব কুরবানীর মধ্যেও গরীবদের প্রভূত কল্যাণ রয়েছে। দেশের অসংখ্য মানুষ এমন আছেন যারা গোশত কিনে খাওয়ার সামর্থ্য রাখেন না। তারা সারা বছর কুরবানীর আসার অপেক্ষায় থাকেন। কুরবানীর সময়ে অসংখ্য খেটে খাওয়া মানুষ পশু কাটাকুটি করে দু’চার পয়সা উপার্জন করেন। অনেক মধ্য এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার যারা আত্মসম্মানবোধের কারণে আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করতে সঙ্কোচ বোধ করেন তারা কুরবানীর গোশতের হাদিয়া হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করেন। এতসব ফায়দার পরও কি বলা যাবে যে, কুরবানী না করে সে টাকা দান করে দিলেই দরিদ্রদের কল্যাণ হবে?

দেখুন, একজন মুসলমান কুরবানী পালন করে থাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে ওয়াজিব হুকুম পালন করে তাঁর কাছ থেকে বিনিময় পাওয়ার জন্য। আবার নফল দানও সে করে থাকে আল্লাহর কাছ থেকেই বিনিময় পাওয়ার প্রত্যাশায়। সুতরাং আল্লাহর পক্ষ থেকে বিনিময় পেতে হলে তাকে বিষয়টি যুক্তি দিয়ে বিচার করলে হবে না। বরং শরীয়তের হুকুম তালাশ করতে হবে। আর শরীয়তের হুকুম হলো, নফল কাজের জন্য ওয়াজিব তরক করার কোনো অবকাশ নেই।

তবে যদি কেউ এমন থাকে যে, ইতোপূর্বে সে নিজের ওয়াজিব কুরবানীর পাশাপাশি এক বা একাধিক নফল কুরবানীও দিতো। তাহলে তার জন্য নফল কুরবানীর পরিবর্তে সে টাকা প্রয়োজনগ্রস্তদের মাঝে দান করে দেওয়ার অবকাশ আছে।

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *