মুফতি হাফিজুর রহমান
সকাল ১০.৫৪, শুক্রবার, ০২.০৮.’১৯, মসজিদে নববী
এখন মদীনায়। গত শনিবার এসেছি। আগামী সোমবার প্রত্যুষে মক্কায় চলে যাবো। মদীনা নগরিটাকে বেশ সুন্দর ও গোছালো মনে হচ্ছে। চার দিকে সমতল ভূমি। পাহাড়ি ভূমির কারণে মক্কা নগরীটাকে অতোটা সুন্দর করে গোছানো যায় নি। মসজিদে নববীর গেট পরিচিত সংখ্যায়নে হয়। গেট পরিচিতির এ সংখ্যায়ন পদ্ধতিটা আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছে। এসব পবিত্র গৃহে কারো নামে গেট হলে সেটা হোক সাহাবা আসলাফের নামে। অন্যথায় এর কান্তিময়তা ক্ষুণ্ন হয়। তবে কিছু গেট ব্যক্তি নামেও হয়েছে। এখানেও কিং ফাহদ, কিং সাউদ গেট আছে। জিনিসটা বেশ দৃষ্টিকটু। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম এসব মসজিদের সাথে নিজেদের নাম জুড়ে দেবার উপযোগিতা কি ‘তাহাদে’র আছে? যত কিছুই করুক। বাইতুল্লাহতে বিষয়টা আরো বেশি দৃষ্টিকটু। আগে থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম এর নামে কিছু গেট ছিলো। সেগুলোকে ম্রিয়মাণ করে রাখা হয়েছে। এর বদলে কিং ফাহদ গেট, আব্দুল আজিজ গেট ও আব্দুল্লাহ গেটকে বেশ দৃষ্টিনন্দন করে রাখা হয়েছে। অন্যসব গেটগুলো অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে। এ দেশের আলেম সমাজ অনেক ভালো ভালো কাজ করেন। শিরক বিদাত অপনোদনে যথেষ্ট ভূমিকা রাখেন। এগুলো প্রশংসনীয়। তবে সাথে এটাও স্বীকৃত, তাঁরা আরব সরকারের অনুগামী। তাঁরা শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় নিয়ে কথা বলেন, লেখালেখি করেন। যাঁরা পরিস্কার ভাষায় কথা বলেন তারা শাসকদের রোষানলে পড়লেও তাঁরা সফল। বাইতুল্লাহ চত্তরে যেমন জমকালো আয়োজনের মহোৎসব মসজিদে নববীতেও তার ব্যতিক্রম নয়। মূল মসজিদে নববীতে এতো পরিমাণ আলোর ঝলকানি ও চারুশিল্পের মহড়া যাতে মসজিদে নববীর স্বাভাবিক সৌন্দর্যও ব্যাহত হয়েছে বলে মনে হয়েছে। এগুলো সম্ভবত তুর্কি শাসকদের শিল্পিত কারুকাজ। চারু শিল্পের ধরণ দেখে তাই অনুমিত হয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সমাহিত পবিত্র জায়গাটির গাম্ভির্যময় স্বাভাবিক সৌন্দর্য বিনষ্ট করার মূল কারিগর বাদশাহ ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক। তিনি মসজিদ-সমাধিতে স্থাপনা তৈরিতে বেশ সিদ্ধহস্ত ছিলেন। উমর ইবনে আব্দুল আজীজ তখন মদীনার গভর্নর। বাদশাহ ওয়ালীদ থেকে মদীনার গভর্নরের নামে শাহী ফরমান এলো। তাতে বাদশাহ বললেন, আয়িশা রা. এর কুঠরিকে ভেঙ্গে দিতে হবে। এবং মসজিদে নববীর সাথে একে একাকার করে দিতে হবে। গভর্নর উমর ইবনে আব্দুল আজীজ রহ. মর্মাহত হলেন। মদীনার উলামায়ে কেরাম ও নেতৃস্থানীয় বক্তিবর্গকে নিয়ে বৈঠকের আয়োজন করলেন। বৈঠকে বাদশাহর শাহী ফরমানের বিষয়বস্তু তুলে ধরে অভিমত কামনা করলেন। সকলেই এক বাক্যে অসম্মতি জ্ঞাপন করলেন। মদীনাবাসীর অসম্মতির বিষয়টি উমর ইবনে আব্দুল আজীজ রহ. বাদশাহকে অবহিত করলেন। বাদশাহ অনড়। যা বলেছি তাই হবে। বিশিষ্ট তাবিয়ী যাঁরা ছিলেন স্পষ্ট ভাষায় প্রতিবাদ করলেন। কোনো কোনো বর্ণনা মতে জনৈক তাবিয়ীকে এ বিষয়ে কঠোর প্রতিবাদ করার কারণে শহীদ করে দেয়া হয়। ইতিহাস বলছে, যেদিন আয়িশা রা. এর মূল কুঠরিকে ভেঙ্গে দেয়া হয় সেদিন মদীনার ঘরে ঘরে কান্নার রোল পড়ে যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তিরোধানের সময় মদীনা নগরীতে যেমন বেদনা বিধুর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিলো তদ্রূপ একটি শোকাবহ মর্মান্তিক অবস্থা সৃষ্টি হয়। বাদশাহ ওয়ালীদ আয়িশা রা. এর কুঠরিটিকে গুড়িয়ে দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র সমাধিতে স্থাপনা তৈরির প্রথম বীয বপন করেন। পরবর্তী সময়ে ইবনে কালাউন নামের এক শাসক এসে তাতে কাষ্ঠ নির্মিত গম্বুজ তৈরি করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশনাকে চরমভাবে লঙ্ঘন করেন। প্রথম দিকে গম্বুজের কালার ছিলো শুভ্র-সাদা। পরবর্তীকালে কোনো এক শাসক এসে গম্বুজটিকে শিশা ঢালা আবরণ তৈরি করে অমরপক্ব করে দেন। তুর্কী শাসন কালে সবুজ তুলির আচড় দিয়ে গম্বুজটিকে শ্যামলিমা করে তুলা হয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র সমাধির উপর গেলাফ চড়ানোর প্রথাও এক সময় চালু ছিলো। বাইতুল্লাহর গেলাফের মতো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাকবারা আচ্ছাদনের জন্যে চিত্তাকর্ষক গেলাফও নানা প্রান্ত থেকে মদীনায় সমাগত হতো। আজ সে প্রথার প্রচলন না থাকলেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র মাকবারার উপর লাল সবুজের আবরণ ঠিকই বহাল আছে। এসব ক্রিয়াকাণ্ড রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিষেধাজ্ঞার চরম লঙ্ঘন। আজ বিদাতপন্থী কবর পুঁজারীদের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাকবারার বর্তমান চিত্র বড় ধরনের প্রমাণ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
সৌদী শাসনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব বাদশাহ আব্দুল আজিজ রহ. কবরস্থ অবৈধ স্থাপনাগুলো তুলে দিয়ে এক সময় সবুজ গম্বুজের দিকে মনোনিবেশ করেন। সবুজ গম্বুজের স্থাপনা ভেঙ্গে দিবেন কি দিবেন না এ ব্যাপারে আরবের আলেম সমাজের নিকট মতামত কামনা করলেন। সকল আরব্য আলেমের অভিমত দেন, সবুজ গম্বুজের এ স্থাপনা ভেঙ্গে দেয়া হোক। কারণ এটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশনার চরম লঙ্ঘন। বাদশাহ আব্দুল আজিজ রহ. সময় নিলেন। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য অনারব উলামায়ে কেরামকেও আহ্বান করলেন। অনারব উলামায়ে কেরামের প্রতিনিধি হয়ে আগমন করলেন বাগ্মী প্রতিভাধর শক্তিমান আলেমে দীন শাব্বির আহমাদ উসমানী রহ.। আরবের উলামায়ে কেরাম গম্বুজ ভাঙ্গার পক্ষে দলিল প্রমাণ ও যুক্তি তুলে ধরে বক্তব্য শেষ করলেন। এবার দাঁড়ালেন শাব্বির আহমাদ উসমানী রহ.। তিনি আরবী ভাষায়ও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। দীর্ঘ সময় নিয়ে আরবী ভাষায় বক্তৃতা দিলেন। তাঁর বক্তৃতার সারকথা ছিলো, অবশ্যই সবুজ গম্বুজের স্থাপনা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্পষ্ট নির্দেশনার চরম লঙ্ঘন। কিন্তু সাথে সাথে আমাদের আরো একটি বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন। তা হলো, হাজার বছর অবধি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র সমাধির উপর গম্বুজটি শোভা পাচ্ছে। এ যাবত কেউ এটাকে ভাঙ্গে নি। ফলে যুগপরম্পরায় এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সমাধি নিদর্শনে পরিণত হয়ে গেছে। এখন যদি এটাকে ভেঙ্গে দেয়া হয় তাহলে পৃথিবী ব্যাপী দীন ও হাদীস সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ সাধারণ মুসলমানদের মাঝে অরাজকতা ও ফেতনা সৃষ্টি হয়ে যাবে। অন্তত এ ফেতনা ও অরাজকতা নিরোধ কল্পে হলেও গম্বুজটি না ভাঙ্গা উচিত। এ বক্তব্য শুনে বাদশা আব্দুল আজিজ রহ. আরব উলামায়ে কেরামকে বললেন, আপনারা এ যুক্তি খণ্ডন করুন। আরবের আলেমগণ এ যুক্তি খণ্ডনে দণ্ডায়মান না হয়ে এ ব্যাপারে নীরব সম্মতি জ্ঞাপন করেন। ফলে আব্দুল আজিজ রহ. সবুজ গম্বুজ ভাঙ্গা থেকে নিবৃত্ত থাকেন।