আল্লামা নুরুল ইসলাম ওলীপুরী
গত ১১ নভেম্বর, সোমবার মুহাম্মদপুরস্থ বসিলা গার্ডেন সিটি মসজিদ সংলগ্ন মাঠে উচ্চতর ইসলামী শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান মা’হাদুল বুহুসিল ইসলামিয়ার উদ্যোগে বার্ষিক ওয়াজ ও দু‘আর মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে দীনে ইসলামের পরিপূর্ণতা ও এর গ্রহণযোগ্য চারটি উৎস সম্পর্কে বয়ান পেশ করেন মুনাযিরে যামান, আল্লামা নুরুল ইসলাম ওলীপুরী দা. বা.। বয়ানটির গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় আগ্রহী পাঠকের জন্যে তা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। রেকর্ড থেকে বয়ানটির শ্রুতিলিখন করেছেন মা’হাদের ইফতা বিভাগের ছাত্র মৌলবী সুহাইল আহমাদ ও মৌলবী আবু তলহা মাসউদ। প্রায় দেড়ঘণ্টাব্যাপী সে বয়ানের দ্বিতীয় অংশ আজ প্রকাশ করা হচ্ছে। -দারুত তাসনীফ
প্রথম অংশের পর…
আগেই বলেছিলাম, কুরআনের ব্যাখ্যা করার ছয়টি উৎস রয়েছে।
যারা এই ছয় উৎস থেকে কুরআনের ব্যাখ্যা করে গেছেন তাদের মধ্যে একজন হলেন ইমাম ফখরুদ্দিন রাজি রহ.। তিনি তিনটি বিরল গুণের সমষ্টি ছিলেন।
১. জগতশ্রেষ্ঠ ওলী।
২. জগতশ্রেষ্ঠ দার্শনিক
৩. জগতশ্রেষ্ঠ মুফাসসিরে কুরআন।
তাঁর লিখিত তাফসীরের নাম তাফসীরে কাবির। তাফসীরে কাবিরে আমি সবচেয়ে সুষ্পষ্টভাবে এই আয়াতের ব্যাখ্যা পেয়েছি। তার সারমর্মটা আপনাদেরকে শুনাই।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يا ايها الذين امنوا اطيعوا الله
হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর।
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের অন্যত্র ইরশাদ করেছেন,
ان الحكم إلا لله
‘হুকুম মানতে হবে একমাত্র আল্লাহর।’
এই দুই আয়াতে আল্লাহর হুকুম মানা ও তাঁর আনুগত্য করার আদেশ দেয়া হয়েছে। এতটুকু পর্যন্ত দুই আয়াতে কোনো গড়মিল নেই। কিন্তু প্রথম আয়াতের পরবর্তী অংশ-
واطيعوا الرسول
এবং রাসূলেরও হুকুম মানো । এখানে এসে গড়মিল দেখা দিলো। একবার বলা হলো- আল্লাহর হুকুম মানো, তাঁর হুকুম ছাড়া অন্য কারো হুকুম মানা যাবে না। তাহলে এ আয়াতে কেনো বলা হলো- রাসূলের হুকুম মানো?
তাহলে রাসূলের হুকুম মানলে তো আর একমাত্র আল্লাহর হুকুম মানা হলো না? এ প্রশ্নের জবাবও আল্লাহ তাআলা খুব পরিষ্কারভাবে অন্যত্র বলে দিয়েছেন,
من يطع الرسول فقد أطاع الله
যে রাসূলের হুকুম মানলো সে আল্লাহর হুকুমই মানলো। কারণ রাসূল নিজের পক্ষ থেকে কোন হুকুমই দেন না। হুকুমেরই ব্যাখ্যা করেন মাত্র। সেজন্যে রাসূলের হুকুম মানা যে কথা আল্লাহর হুকুম মানাও সে কথা।
আয়াতের পরের অংশের প্রশ্ন আরো জটিল। কিন্তু আয়াতের এ অংশের প্রশ্নোত্তরটি বুঝলে সে অংশের উত্তর খুব সহজেই বুঝে আসবে।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اولي الامر منكم
তোমাদের সমাধান দাতাগণের হুকুম মানো।
আল্লাহ এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা ছাড়া আমাদের জন্য সমাধানদাতা কারা? মুফাসসিরীনে কেরাম বলেছেন, সন্তানের জন্য মা-বাবা সমাধানদাতা, ছাত্রের জন্য উস্তাদ সমাধানদাতা, ছোটর জন্য বড় সমাধানদাতা, যেকোন অধীনস্থের জন্য উপরস্থ ব্যক্তি সমাধানদাতা। দেশের জনগণের জন্য সরকার সমাধানদাতা ।
সরকারের একটা সমাধানের কথা আপনাদেরকে বলি। পৃথিবীর যতগুলো দেশে আমার ভ্রমণ করার সুযোগ হয়েছে সব দেশের সরকারের একটা সমাধান দেখতে পেয়েছি। সেটা হলো ট্রাফিক সিগন্যাল। সিগন্যালে যদি লাল বাতি জ্বলে উঠে তাহলে গাড়ি চলা নিষিদ্ধ। আর যদি সবুজ বাতি জ্বলে ওঠে তাহলে গাড়ি চলা অনুমোদিত। এটা কি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দেওয়া সমাধান? না সরকারের দেওয়া সমাধান?
সুতরাং বুঝা গেলো আল্লাহ ও রাসূল ছাড়াও আরো সমাধানদাতা আছে। তবে এক্ষেত্রে একটি মুলনীতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধার্য করে দিয়েছেন। সেটা হলো, যার সমাধান মেনে নিলে আল্লাহর সমাধানের বিরুদ্ধাচরণ হয় তার সমাধান কোন মুসলমান মেনে নিতে পারে না। কাজেই মা বাবা যদি তার সন্তানকে আল্লাহর বিরুদ্ধে সমাধান দেয়, এমনিভাবে কোন ছাত্রকে তার উস্তাদ, কোন মুরীদকে তার পীর, কোন সদস্যকে তার দলনেতা, কোন জনগণকে তার দেশের সরকার -আল্লাহর বিরুদ্ধে সমাধান দেয় তাহলে তার এই সমাধান মেনে নেওয়া মুসলমানদের জন্য হারাম, হারাম, হারাম।
আল্লাহ এবং রাসূলের বেলায় সমাধান মেনে নিতে কোন শর্ত নেই। আর যত সমাধানদাতা আছে তাদের সমাধান মেনে নেওয়ার জন্য আল্লাহ হুকুম করছেন। তবে শর্ত হলো, সে সমাধান আল্লাহর সমাধানের বিরুদ্ধে যেতে পারবে না।
শরীয়তেও আল্লাহ এবং রাসূল সারল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া সমাধানদাতা আছেন। যেমন যারা আলেম নন তাদের জন্য আলেমগণ সমাধানদাতা। আপনি অযু কিভাবে করবেন, সমাধান দিবেন আলেমগণ। আপনি আপনার ইচ্ছামতো উযু করলে উযু হবে না। আপনি নামাজ কিভাবে পড়বেন, হজ কিভাবে আদায় করবেন, যাকাত কিভাবে প্রদান করবেন, সমাধান দিবেন আলেমগণ। আপনার ইচ্ছামতো করলে হবে না। ঠিক এমনিভাবে যেসমস্ত আলেমগণ মুজতাহিদ নন তাদের জন্য মুজতাদিগণ সমাধানদাতা। ইমাম আবু হানিফা রহ. একজন মুজতাহিদ ছিলেন। ইমাম শাফেয়ী , ইমাম মালেক, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. সকলেই একেকজন মুজতাহিদ ছিলেন । যে সকল আলেমগণ তাদের সমপর্যায়ের নন তাদের জন্য এ ইমামগণ সমাধানদাতা।
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা
اولي الامر منكم
দ্বারা এই শেষোক্ত সমাধানদাতা মুজতাহিদগণের কথা বুঝিয়েছেন। তুমি আলেম হও আর না হও যদি মুজতাহিদ না হয়ে থাকো তাহলে মুজতাহিদগণের সমাধান মানতেই হবে।
কাজেই ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী রহ. তাফসীরে কাবীরে লিখেন আল্লাহ তাআলা যে বলেছেন, আল্লাহর হুকুম মানো -এর অর্থ ইসলামের যে বিধি বিধান স্পষ্টভাবে কুরআন থেকে পাও সেটা কুরআন থেকে গ্রহণ করো। এরপর যে বলেছেন রাসূলের হুকুম মানো -এর মর্ম হল ইসলামের যে বিধান কুরআন থেকে না পাও রাসূলের হাদীস থেকে গ্রহণ করো।
ইসলামী শরীয়তে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলে বাইরে সমাধানদাতার ব্যাপারে এই দুটি উদাহরণ বুঝে থাকলে পরবর্তী কথাগুলো বুঝা আপনাদের জন্য সহজ হবে। আমরা সকল মুসলমান জানি এবং বিশ্বাস করি যে, ইসলামের বিধান মতে রমজান মাসে রোজা রাখা ফরজ। ইসলামের এ বিধানটি পেলাম কোথায়? আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার বেশ কয়েকটি আয়াতে রমজান মাসে রোজা রাখার বিধানটি ফরজ করেছেন। কিন্তু কতদিন রোজা রাখা ফরজ এর সমাধান কুরআনে নেই। এই না থাকার কারণ সম্পর্কে মুফাসসিরীনে কেরাম বলেন, কুরআনে উল্লেখ না থাকার উল্লেখযোগ্য একটি কারণ হল, অনেক বিষয় এমন আছে কুরআনে যদি আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে বলে দেন অথবা রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি হাদীসে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করে দেন তাহলে তোমাদের দুটি ক্ষতি হবে-
১. হয়তো তোমরা সংকটের মুখোমুখি হবে।
২. নয়তো তোমরা কম উপকৃত হবে।
বেশী উপকৃত হওয়ার জন্য এবং কোন সংকটের সম্মুখীন না হওয়ার জন্য অনেক বিধান আল্লাহ তাঁর কুরআনে বলেননি এবং রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও হাদীসে বলেননি।
এবার বুঝুন, আল্লাহ এখানে কতদিন রোযা রাখতে হবে তা কেন বলেননি! মুফাসসিরীনগণ বলেছেন, যদি আল্লাহ বলে দিতেন রমজান মাস আসা মাত্রই তোমাদের লাগাতার ৩০ দিন রোজা রাখতে হবে। এই ৩০-এর সংখাটা যদি আল্লাহ পরিষ্কাভাবে কুরআনে বলে দিতেন, তাহলে যে বছর রমজান মাসে ২৯ তারিখ বিকেল বেলা ঈদের চাঁদ দেখা যেতো, সে বছর ঈদের দিন রোজা রেখে আল্লাহর ঘোষিত ৩০-এর সংখ্যা পুরা করতে হতো। তখন সুবিধা না হয়ে আরো সংকট দেখা দিতো? তোমাদেরকে এই সংকট থেকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহ তাআলা এই সংখ্যা উল্লেখ করেননি। কাজেই এখন সংখ্যাটা পাওয়া যাবে ইসলামের বিধান পাওয়ার দ্বিতীয় ঠিকানা রাসূলের হাদীসে। হাদীস শরীফে রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে বছর রমজানের ২৯ তারিখ বিকালে ঈদের চাঁদ দেখা যাবে সে বছর ২৯টি রোজা রাখা ফরজ হবে। আর যে বছর রমজান মাসের ২৯ তারিখে চাঁদ দেখা যাবে না, সে বছর ৩০টি রোজা রাখা ফরজ হবে।
দেখুন, কোন মাসে কতদিন রোজা রাখা ফরজ এই প্রশ্নের সমাধান কুরআনে না পেয়ে আমরা পেলাম হাদীসে।
সুতরাং আল্লাহ তাআলার বাণী-
اطيعوا الله
-এর মর্ম হল ইসলামের যে বিধান কুরআনে পাও সেটা কুরআন থেকে গ্রহণ করো ।
اطيعوا الرسول
-এর মর্ম হল, ইসলামের যে বিধান কুরআনে পাওয়া যায় না বরং রাসূলের হাদীসে পাওয়া যায় সেটা সেখান থেকে গ্রহণ করো।
এরপর যে বললেন,
اولي الامر منكم
তোমাদের সমাধানদাতাদের হুকুম মানো। এখানে সমাধানদাতাগণ বলতে বুঝিয়েছে মুজতাহিদগণকে। এই উম্মতের মুজতাহিদগণ বাকি সমস্ত উম্মতের জন্য সর্বশ্রেষ্ট সমাধানদাতা। এরা যে সকল বিষয়ে কুরআন এবং হাদীসে স্পষ্ট কোন বিধান পাওয়া যায়না সে সকল বিষয়ে সমাধান দিবেন।
এখন কথা হল- তারা সমাধান দিবেন কোত্থেকে? তাদের পরিচয় ও যোগ্যতা সম্পর্কে একটু আলোচনা হওয়া দরকার। আল্লাহ তাআলা সূরায়ে নিসা’র ৮৩ নং আয়াতে একদল মানুষের হাতে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। কোন কারণে যদি আল্লাহ কুরআনে সমাধান না দেন, রাসূলও যদি হাদীসে এর সমাধান না দিয়ে থাকেন তাহলে একদল মানুষের হাতে এর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যারা কুরআন হাদীসের আলোকে গবেষণা করে তোমাদেরকে এর সমাধান বের করে দিবেন।
এই সমাধানকারীদেরকে ইসলামের পরিভাষায় মুজতাহিদ বলা হয়। তাদের গবেষণাকে ইজতিহাদ বলা হয়। তাদের গবেষণার নীতিমালাকে কিয়াস এবং গবেষণা করে সমাধান বের করাকে ইস্তিম্বাত বলা হয়।
এরাই সর্বশ্রেষ্ট সমাধানদাতা। সন্তানের জন্য মা বাবা, ছাত্রের জন্য উস্তাদ, মুরীদের জন্য পীর, সদস্যের জন্য দলনেতা, জনগণের জন্য সরকারও এতবড় সমাধানদাতা নয়; গোটা মুসলিম জাতির জন্য মুজতাহিদগণ যতবড় সমাধানদাতা।
এজন্যই আল্লাহ তাআলা বলেন, হুকুম মানো সমাধানদাতাগণের। এটা হল ঐ সমাধান যেটা কুরআন ও হাদীসে স্পষ্ট পাওয়া যায় না। যেমন: আজান, ইকামত এবং নামাজে মাইকের ব্যবহার জায়েয কি জায়েয নয় এর কোন সমাধান কুরআন ও হাদীসে পাওয়া যায় না। এধরনের বিষয়ের সমাধান বের করার জন্য আল্লাহ তাআলা একদল মানুষের হাতে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। এদের নাম হল মুজতাহিদ।
এরা যদি ঐক্যবদ্ধ সমাধান বের করেন তাহলে রাসূল এদের ব্যাপারে তাঁর হাদীস শরীফে অগ্রিম অনুমোদন দিয়ে বলেন,
إن الله لا يجمع أمتي أو قال أمة محمد على ضلالة(সহীহ মুসলিম:২১৬৭)
এ হাদীসের মর্ম হল যে সমাধান তোমরা কোরআনে পেলে না হাদীসেও পেলে না সে বিষয়ের সমাধান যদি মুজতাহিদগণ ঐক্যবদ্ধভাবে বের করে দিতে পারেন, তবে তা শতকরা একশত ভাগ নির্ভুল ইসলামি বিধান বলে গণ্য হবে। কুরআন-হাদীস যেমন শতভাগ নির্ভুল, মুজতাহিদগণের ঐক্যবদ্ধ সমাধানও শতকরা একশত ভাগ নির্ভুল ।
মুজতাহিদদের নির্ভুল ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তের একটি উদাহরণ
রাসূলের ইন্তিকালের পর রাসূলের খলিফা কে হবেন এটা একটা বিরাট প্রশ্ন ছিলো। এই প্রশ্নের জবাব কুরআনের কোন আয়াতে নাই। রাসূলের কোন হাদীসেও পরিষ্কারভাবে উল্লেখ নেই।
যে বিষয় কুরআন-হাদীসে উল্লেখ নেই অথবা উল্লেখ আছে অস্পষ্টভাবে অথবা সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ থাকলেও পরষ্পর বিরোধি সে বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা মুজতাহিদদেরকে ইজতিহাদ করে হুকুম বের করার দায়িত্ব দিয়েছেন।
রাসূলের ইন্তিকালের পর খলিফা কে হবেন । কুরআন, হাদীসে উল্লেখ না থাকায় সাহাবায়ে কেরামকে ইজতিহাদ করতে হয়েছে। তারা একটি হাদীসের আলোকে ইজতিহাদ করেছেন।
রাসূল যখন অন্তিম শয্যায় শায়িত । মসজিদে যেতে পারছিলেন না। তখন হযরত আবু বকর রা. কে নামাজের ইমামতির জন্য হুকুম করেছিলেন। তার কাছে আপত্তি জানানো হলো আবু বকর বড় কোমল হৃদয়ের মানুষ। তিনি যখন মুসল্লায় দাঁড়িয়ে ইমামতি করবেন; আপনার চিন্তায় ভেঙ্গে পড়বেন । কাঁদতে কাঁদতে নিজের নামাজও ভেঙ্গে ফেলবেন। জামাতের নামাজও ভেঙ্গে ফেলবেন। কাজেই এমন কোমল মানুষকে ইমামতির জন্য না দিয়ে সাহসী হযরত উমর রা. কে ইমামতি করার জন্য দিলে ভালো হয়। এ আপত্তির পরও রাসূল সাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকরকেই নামাযের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
একজনের পরিবর্তে আরেকজন দায়িত্ব পালন করাকে খেলাফত বলে। যিনি দায়িত্ব পালন করেন তাকে খলিফা বলে। বুখারী শরীফে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকর রা. কে নামাজের খলিফা নিযুক্ত করেছিলেন । এ হাদীস থেকে সাহাবায়ে কেরাম ইজতিহাদ করে হযরত আবু বকর রা. কে সমাজের খলিফা নিযুক্ত করেন।
এখানে আবু বকরকে খলিফা বানানোর সিদ্ধান্ত কুরআন-হাদীস থেকে পাওয়া যায়নি বরং সমাধানদাতাদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে। সকল সাহাবা ঐক্যবদ্ধভাবে হযরত আবু বকর রা. কে খলিফ নিযুক্ত করেন। এই ঐক্যবদ্ধভাবে ফায়সালা করার নাম ইজমা।
কুরআন ও হাদীস যেমন একশত ভাগ নির্ভুল ঠিক তেমনিভাবে উম্মতের ইজমাও একশতভাগ নির্ভুল।
ইজমার প্রকারভেদ
ইজমার তিনটি স্তর রয়েছে।
১ সাহাবাগণের ইজমা।
২ মুজতাহিদ ইমামগণের ইজমা।
৩ যুগশ্রেষ্ঠ আলেমগণের ইজমা।
তিনটা ইজমার তিনটা উদাহরণ পেশ করবো।
সাহাবাগণের ইজমা
যে ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের ইজমা হয়ে যায় সে ব্যাপারে কোনো মাযহাবের ইমামের কথা বলার অধিকার থাকে না। এ জন্যই হযরত আবু বকর রা. কে খলিফা বানানোর ব্যাপারে চার মাযহাবের কোন ইমামের কোন মন্তব্য নেই। মন্তব্য করার অধিকারও নেই।
মুজতাহিদ ইমামগণের ইজমা
মুজতাহিদদের ইজমা বুঝার আগে আমরা দু’জন ইমামের দু’টি মাসআলা জেনে নিই।
ইমাম আবু হানিফা বহ. এর মতে নামাজে রক্ত গড়িয়ে পড়লে নামাজ নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু বিবিকে স্পর্শ করলে উযু ভাঙ্গে না।
ইমাম শাফেয়ী রহ. এর মতে বিবিকে স্পর্শ করলে উযু ভেঙ্গে যায়। তবে রক্ত গড়িয়ে পড়লে নামাজ ভাঙ্গে না।
মুজতাহিদদের এইধরনের ভিন্ন ভিন্ন মতকে ভিন্ন ভিন্ন মাযহাব বলা হয়।
সাহাবায়ে কেরামের যুগে, তাবেঈদের যুগে এমনকি রাসূলের যুগেও মুজতাহিদদের অনুসরণ করে আমল করা হতো।
তাবে তাবেঈদের যুগে এসে একদল লোকের আবির্ভাব হল। তারা সুবিধা মতো মাযহাব মানতো। রক্ত গড়িয়ে পড়ার বেলায় ইমাম শাফেয়ী আর বিবিকে স্পর্শ করার বেলায় ইমাম আবু হানিফা রহ. এর মত গ্রহণ করতো।
বলুনতো এরা মাযহাবের অনুসরণকারী না মতলববাজ? মতলববাজ। এমন মতলববাজ নবীর যুগে ছিলো না, সাহাবাদের যুগে ছিলো না, তাবেঈদের যুগে ছিলো না। তাবে তাবেঈদের যুগ থেকে ধরনের লোক সৃষ্টি হয়েছে। এধরনের মতলববাজ লোক তৈরি হওয়ার পর মুজতাহিদরা ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন- প্রত্যেককে চার মাযহাবের যেকোনো একটার বিধান অনুযায়ী আমল করতে হবে। চার মাযহাবের বাইরে আমল করা যাবে না। আজকে একটা কালকে আরেকটা এমনটি করা যাবে না। এটাই হল মুজতাহিদ ইমামগণের ইজমা।
সুতরাং আমরা বুঝতে পারলাম, যেই বিষয়ের সমস্যাটা সাহাবায়ে কেরামের যুগে ছিলো না পরবর্তী যুগে দেখা দিয়েছে। সেই ব্যাপারে যদি মুজতাহিদগণ ঐক্যবদ্ধ সমাধান দেন তাহলে সেটাকেই বলা হয় মুজতাহিদদের ইজমা। সেটার ব্যাপারে যেসকল আলেম মুজতাহিদ নন তাদেরও দ্বিমত করার অধিকার থাকে না।
মাযহাব প্রসঙ্গে জরুরী একটি কথা
মুজতাহিদ ইমামগণের ভিন্ন ভিন্ন মতামত ও তাদের মাযহাব প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন মানুষের মনে তৈরি হয়। প্রশ্নটি হলো- কোন দেশের মানুষ কোন মাযহাব পালন করবে? এই প্রশ্নের জবাবও আরেক হাদীসের আলোকে স্পষ্ট।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত মুআজ রা. কে ইয়ামানের গভর্ণর বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন। তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তুমি কিভাবে সমাজে ফায়সালা করবে? তিনি বলেছিলেন কুরআনের বিধান অনুযায়ী। প্রশ্ন করলেন, সেখানে না পেলে? উত্তর দিলেন, হাদীসের বিধান মতে। প্রশ্ন করা হলো, সেখানেও না পেলে? মুআজ রা. বললেন, ইজতিহাদের মাধ্যমে। একজনের ইজতেহাদ ও মতামতকেই তো মাযহাব বলা হয়। রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই ইয়ামানবাসীদেরকে মুআজ ইবনে জাবালের মাযহাব মানার নিয়ম চালু করে দিয়েছেন।
সুতরাং এই হাদীসের মাধ্যমে সুষ্পষ্ট হয়ে গেছে যে, যে দেশে যার মাযহাব চালু আছে সেই দেশে তার মাযহাবের অনুসরণ করতে হবে। বাংলাদেশে চালু আছে হানাফি মাযহাব। সুতরাং এ দেশে শাফেয়ী মাযাহাব প্রচার করা এবং ইমামের পেছনে সূরা ফাতেহা পড়া নিঃসন্দেহে মতলববাজি।
এখনে আরেকটি প্রশ্ন হয় মাযহাব বা মত তো অনেকগুলি। তাহলে কোনটি কুরআন-হাদীস অনুযায়ী আর কোনটি কুরআন-হাদীস বিরোধী?
একটি উদাহরণের মাধ্যমে এই প্রশ্নের জবাব দেবো।…
পরবর্তী অংশে সমাপ্য … ইনশাআল্লাহ।