ফতোয়া : একটি তাত্ত্বিক নিবন্ধ

মুফতী হাফিজুর রহমান                                               



ফতোয়া ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। উম্মাহ ও এর সদস্যদের বিভিন্ন সময়ে উত্থাপিতনানামুখী প্রশ্নের সঠিক ও সময়োচিত সমাধানে এটি একটি চলমান ব্যবস্থা। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেউম্মাহর বিশেষজ্ঞগণ তাদের মেধা, প্রজ্ঞা ও গবেষণার আলোকে জীবন চলার পথে নানারকম সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা প্রতিকারেরমাধ্যমে জাতির স্বাভাবিক চলার পথকে করে তোলেন স্বাচ্ছন্দ্য ও সাবলীল।

ফতোয়া শব্দের ধাতুগত বিশ্লেষণ

ফতোয়া; এটি একটি আরবি শব্দ। এর বিশুদ্ধ উচ্চারণ হলো ফতওয়া। বহুবচন ফাতাওয়া। ফতওয়ার ভিন্ন আরেকটি উচ্চারণ হলো ফুতইয়া। আরব বিশ্বে ফুতইয়া বহুল উচ্চারিত একটি শব্দ। ফতওয়া উচ্চারণের তেমন প্রসিদ্ধি সেখানে নেই।- ইবনে মানযুর আলমিসরী (৭১১ হি.), লিসানুল আরব ১৫/১৪৫।

ফুতইয়া উচ্চারণে ফতোয়া শব্দটি বুখারী, সহীহ মুসলিম, সুনানে বাইহাকী সুগরা, সুনানে বাইহাকী কুবরা, সুনানে নাসাঈ কুবরা, মুস্তাদরাকে হাকেম, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, মু’জামে তাবারানী আওসাত, মু’জামে তাবারানী কাবীর, আল মুনতাকা লিইবনিল জারুদ, মুআত্তা ইমাম মালেক, সুনানে আবূ দাউদ, সুনানে দারিমী, সহীহ ইবনে হিব্বান, সহীহ ইবনে খুযাইমা, মুসনাদে আহমদ, মুসনাদে আবু আওয়ানা, মুসনাদে ইবনে জা’দ, মুসনাদে ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহ, মুসনাদে বাযযার, মুসনাদে ইমাম শাফেয়ী, মুশকিলুল আসার লিত্তহাবী এবং মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাকের মতো জগৎখ্যাত হাদীস গ্রন্থগুলোতে একাধিকবার এসেছে।

পক্ষান্তরে ফতওয়া উচ্চারণটি সুনানে বাইহাকী কুবরা, মুস্তাদরাকে হাকেম, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, মুআত্তা ইমাম মালেক, মুসনাদে আবি ইয়ালা এবং মুসনাদে আহমদ হাদীস গ্রন্থে একাধিকবার এসেছে।

ফতওয়া শব্দটি মূল ক্রিয়া। এর মূল ধাতু হলো, فاء تاء ياء (ফা তা ইয়া)। অর্থ, তারুণ্যে অন্যের উপর প্রাধান্য লাভ করা, তারুণ্য, বদান্যতা, দানশীলতা।- আল মু’জামুল ওয়াসিত ৬৭৭, ইবনে ইমাদ, আল মুহীত ফিল্লুগাহ ২/৩৮২, আহমদ আলফাইউমী, আলমিসবাহুল মুনীর ২/৪৬২।

ফতওয়া শব্দটি বস্তুত আরবি فتى (ফাতান) শব্দ হতে নির্গত। আরবি ফাতান অর্থ নবীন, তরুণ। এর ক্রিয়াগত অর্থ, সে সদ্য তারুণ্যে পদার্পণ করেছে এবং শক্তিধর হয়ে উঠেছে। ফতওয়াটা যেন উদ্ভূত বিষয়ের সমস্যাটাকে বর্ণনার মাধ্যমে দূরীভূত করে শক্তিময় করে তোলে। افتى المفتى (আফতা আলমুফতী) মানে মুফতী মহোদয় নতুন করে একটি বিধান প্রণয়ন করলেন।- ইবনে মানজুর আলমিসরী (৭১১ হি.), লিসানুল আরব ১৫/১৪৫, মুরতাযা আয যাবিদী, তাজুল আরুস ১/৮৫৩১।

অভিধান গ্রন্থ আল মুগরিবে বলা হয়েছে, ফতওয়া শব্দটি আরবি فتى (ফাতান) শব্দ হতে নির্গত। (আর ফাতান অর্থ নতুন যুবক, নবীন, তরুণ)। কারণ ফতওয়া অর্থ নতুন কোনো বিষয়ে উত্তর প্রদান করা, নতুন কোনো বিধান প্রণয়ন করা, সমস্যাপূর্ণ কোনো বর্ণনাকে শক্তিময় করে তোলা।- ২/১২২।

ফতোয়ার আভিধানিক অর্থ

ফতোয়ার আভিধানিক অর্থ, কোনো প্রশ্নের জবাব দেওয়া, কোনো বিষয়ে ব্যাখ্যা বা পরামর্শ দেওয়া। প্রশ্ন বা বিষয়টি শরীয়তের কোনো বিধান বিষয়ক হতে পারে অনুরূপ পার্থিব কোনো বিষয়েরও হতে পারে। কুরআনের ভাষায়: ياايهاالملأ افتونى فى روياى ان كنتم للرويا تعبرون হে সভাসদবর্গ! যদি তোমরা স্বপ্নের ব্যাখ্যা জেনে থাকো তবে আমার স্বপ্নের ব্যাখ্যা দাও।- সূরা ইউনুস ৪৩

অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে, ياايهاالملا افتونى فى امرى ما كنت قاطعة امرا حتى تشهدون বিলকিস বলল, হে পরিষদবর্গ! আমার কাজে পরামর্শ দাও। তোমাদের উপস্থিতি ব্যতিরেকে আমি কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না।- সূরা নামল ৩২

ফতোয়ার পারিভাষিক অর্থ

ইবনে ইমাদ রাহ. বলেন, কোনো অস্পষ্ট বিষয়ের সুস্পষ্ট বর্ণনাই হলো ফতোয়া।- আলমুহীত ফিল লুগাহ ২/৩৮২।

মুনাবী রাহ. বলেন, প্রশ্ন কর্তার প্রশ্নকৃত বিধান বলে দেওয়াই হলো ফতোয়া।- আত তাওফীক ১/৫৫০।

আল্লামা জাওহারী রাহ. বলেন ফিকহ বিশেষজ্ঞ কোনো ব্যক্তিকে উদ্ভূত কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করা হলো; আর তিনি সে বিষয়ে উত্তর দিলেন- এর নামই ফুতইয়া কিংবা ফতওয়া।- আসসিহাহ ৮/৩৮২।

আরবি ভাষার নির্ভরযোগ্য প্রাচীন অভিধান গ্রন্থ আল কামুসুল মুহীত, মাজদুদ্দীন ফাইরুযাবাদী ১/১৭০২ ও লিসুনুল আরব, ইবনে মানজুর আফ্রিকী ১০/২৯২ তে ফতোয়ার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, الفتوى ما افتى به الفقيه অর্থ, কারো প্রশ্নের উত্তরে ফিকহ ও ফতোয়া-বিশেষজ্ঞ শরীয়তের যে বর্ণনা দেন তাই ফতোয়া।

আহমদ আল ফাইউমী রাহ. বলেন, কারো প্রশ্নের প্রেক্ষিতে ফতোয়া বিষয়ক প্রাজ্ঞ আলেমের বর্ণিত বিধানের নাম হলো ফতোয়া।- আল মিসবাহুল মুনীর ২/৪৬২।

বাংলাদেশ এশিয়া সোসাইটি প্রকাশিত, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত বাংলা পিডিয়ায় (নেট সংস্করণ) ফতোয়ার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘ফতোয়া বা ফতওয়া (আরবি الفتوى বহুবচন ফাতাওয়া আরবি الفتاوى) হলো, বিধান ও সমাধান, যা কোনো ঘটনা বা অবস্থার প্রেক্ষিতে ইসলামী শরীয়তের দলীলের আলোকে মুফতী বা ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞগণ প্রদান করে থাকেন। যখন কোনো ব্যক্তি সরাসরি কুরআন ও হাদীস কিংবা ফিকহের আলোকে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান বের করতে অপারগ হন তখন তিনি মুফতীর কাছে এই বিষয়ে সমাধান চান। এটিকে ইসলামের পরিভাষায় ইসতিফতা (আরবিاستفتاء ) বলে। মুফতী তখন ইসলামী শরীয়তের আলোকে সমস্যার সমাধান জানিয়ে দেন। এ সমাধান প্রদান করাকে ইসলামের পরিভাষায় ইফতা (আরবিতে افتاء) বলে। এবং প্রদত্ত সমাধান বা বিধানটিকে ফতোয়া বলে।’

সারকথা, ফতোয়া হলো সমসাময়িক মানব সমাজে উদ্ভূত নিত্য নতুন সমস্যা সম্পর্কে সে যুগের মুজতাহিদ আলেম কর্র্তৃক কুরআন সুন্নাহর ভিত্তিতে ও পূবসূরি বিদগ্ধ সত্যাশ্রয়ী আলেমগণের অনুসৃত নীতির আলোকে শরীয়তের বিধান বর্ণনা করা। সংক্ষেপে বিশেষজ্ঞ কর্তৃক জিজ্ঞেসিত বিষয়ে আল্লাহর নির্দেশনা কি তা অবহিত করণকেই ফতোয়া বলে।

ফতোয়ার শ্রেণী বিন্যাস

(ক) ফতোয়া প্রথমত তিন প্রকার: ১. বিধানগত ফতোয়া ২. ফিকহ বিষয়ক ফতোয়া ৩. বিচ্ছিন্ন ফতোয়া।

বিধানগত ফতোয়া

সরাসরি বিধানদাতা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে প্রণীত বিধানই হলো বিধানগত ফতোয়া। ফতোয়ার এ প্রকারটি প্রত্যক্ষ প্রত্যাদেশ কুরআনিক আয়াত-প্রবচন অথবা পরোক্ষ প্রত্যাদেশ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহরূপে কোনো সমস্যার সমাধানে প্রবর্তিত হয়েছে।

প্রত্যক্ষ প্রত্যাদেশ বিষয়ক বিধানিক ফতোয়া: ১. আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يستفتونك فى النساء قل الله يفتيكم فيهن অর্থ নারীদের ব্যাপারে তারা তোমার কাছে ফতোয়া জিজ্ঞেস করে। বলে দাও, আমি নারীদের ব্যাপারে ফতোয়া দেব।- সূরা নিসা ১২৭।

২. অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يسئلونك عن الاهلة قل هى مواقيت للناس والحج অর্থ : তারা তোমাকে চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দাও চাঁদ মানুষ এবং হজব্রতের জন্য একটি সময়সূচী।- সূরা বাকারা ১৮৯।

পরোক্ষ প্রত্যাদেশ বিষয়ক বিধানিক ফতোয়া: ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, জনৈক মহিলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে বলল, আমার মা জননী হজের মানত করেছিলেন। কিন্তু মানত পূর্ণ করার পূর্বেই তিনি ইন্তেকাল করেন। এখন কি আমি তার পক্ষ থেকে মানতের হজ পালন করতে পারব? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, পারবে। তুমি তোমার আম্মার পক্ষ থেকে হজ আদায় করে দাও।- সহীহুল বুখারী ২/৬৫৬/১৭৫৪। এ ধরনের বিধানগত ফতোয়ায় কুরআন, হাদীস পরিপূর্ণ হয়ে আছে।

ফিকহ বিষয়ক ফতোয়া

শরঈ মূলনীতির আলোকে মৌলিক কোনো বিধানের শাখা বিধান নির্ণয় কালে একজন বিজ্ঞ মুফতীর হৃদয়পটে যে বিষয়গুলো উদ্ভাবিত হয় তাই হলো ফিকহ বিষয়ক ফতোয়া। ফিকহী মাসআলা প্রণয়নকারী প্রাজ্ঞ ফকীহদের বৈশিষ্ট্য হলো, তারা বিপুল পরিমাণ শাখাগত মাসআলার রূপ দান করেন। যে মাসআলা সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। তবে তারা এসব মাসআলা শরঈ দলীল-প্রমাণের আলোকেই উদ্ভাবন করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ যদি কেউ তার স্ত্রীকে বলে আমি তোমাকে মুক্ত করে দিলাম তাহলে এর বিধান কি হবে? অথচ বিষয়টি সম্বন্ধে এ যাবৎ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি।

বিচ্ছিন্ন ফতোয়া

কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে কিংবা কোনো ঘটনা ঘটে গেলে তদ্বিষয়ক প্রশ্নের উত্তরে সম্মানিত মুফতী যে ফতোয়া প্রদান করেন তাই হলো বিচ্ছিন্ন ফতোয়া।

উদাহরণস্বরূপ জনৈক ব্যক্তি বাবা মা স্ত্রী পুত্র রেখে ইন্তেকাল করল। এখন প্রশ্ন করা হলো, মৃত এই ব্যক্তির ত্যাজ্য সম্পত্তি তার ওয়ারিসদের মাঝে কি নিয়মে বণ্টন করা হবে? এ ধরনের ফতোয়ার ক্ষেত্রে ইফতা শব্দটি তুলনামূলক বেশি ব্যবহৃত হয়।- জাস্টিস আল্লামা তাকী উসমানী, উসূলুল ইফতা ওয়া আদাবুহু ৮/১১।

(খ) ইমাম আবু হানীফা রা. এর নীতিমালা অনুসারে প্রদত্ত ফতোয়াসমগ্রকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে।

১. যাওয়াহিরুর রিওয়ায়াহ। ইমাম আবু হানীফা, ইমাম আবু ইউসুফ এবং ইমাম মুহাম্মদ রহ. এই ইমামত্রয় থেকে বর্ণিত ফতোয়াসমগ্র। এই ফতোয়া সমষ্টিকে মাসাইলুল উসূল, এবং যাওয়াহিরুর রিওয়ায়াহ নামে অভিহিত করা হয়। এই ফতোয়াগুলো ইমাম মুহাম্মদ রহ. এর গ্রন্থ ষষ্ঠক মাবসূত, যিয়াদাত, জামে সগীর, সিয়ারে সগীর, জামে কাবীর, সিয়ারে কাবীরে সংকলিত হয়েছে। এগুলোকে যাওয়াহিরুর রিওয়ায়াহ (সুস্পষ্ট বর্ণনা) নামে নামকরণের কারণ হলো, এগুলো মুহাম্মদ রহ. থেকে বিশুদ্ধ বর্ণনায় বর্ণিত হয়ে এসেছে।

২. গাইরু যাওয়াহিরির রিওয়ায়াহ। ইমামত্রয় থেকে বর্ণিত ফতোয়াসমগ্র। তবে এগুলো মুহাম্মদ রহ. এর কিতাব ষষ্টকে স্থান পায়নি। বরং মুহাম্মদ রহ. থেকে সংকলিত কাইসানিয়্যাত, হারুনিয়্যাত, জুরজানিয়্যাত এবং রক্কিয়্যাত প্রভৃতি ফতোয়া গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। এগুলোকে গাইরু যাওয়াহিরুর রিওয়ায়াহ বলা হয়। কারণ এগুলো ইমাম মুহাম্মদ রহ. থেকে বিশুদ্ধ বর্ণনায় বর্ণিত হয়ে আসেনি।

৩. ফাতাওয়া ওয়াকিয়াত। যেসব মাসআলা বিভিন্ন জন থেকে প্রার্থনার প্রেক্ষিতে পরবর্তী মুজতাহিদগণ উদ্ভাবন করেছেন এবং যে ব্যাপারে পূর্বসূরি ফকীহদের থেকে সুস্পষ্ট কোনো বর্ণনা নেই। আল্লামা জাস্টিস তাকি উসমানী, উসূলুল ইফতা ওয়া আদাবুহু ১১২।

ফতোয়া সংশ্লিষ্ট শব্দাবলি এবং তার সংজ্ঞা

১. ইফতা

আল্লামা ক্বালআজী রহ. বলেন, ১. ইফতা অর্থ, জটিল কোনো বিষয়ের সমাধান প্রদান করা। ২. কোনো হস্তক্ষেপের ব্যাপারে শরঈ বিধান বর্ণনা করা। উবষরাবৎধহপব ড়ভ ভড়ৎসধষ ষবমধষ ড়ঢ়রহরড়হ।- মু’জামু লুগাতিল ফুকাহা ১/৮০।

মুনাবী রহ. বলেন, ইফতা অর্থ, নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ের জিজ্ঞাসার প্রেক্ষিতে তার বিধান বর্ণনা করা।- আত্তাওকীফ ১/৭৯।

২. মুফতী

 মুফতী শব্দটি ইফতা মূল ক্রিয়ার কর্তা বিশেষ্য। সে মতে এর অর্থ ফতোয়া প্রদান কারী। পারিভাষিক অর্থে মুফতী বলা হয়, ফিকহ ফতোয়ায় পারদর্শী এমন এক বিশিষ্ট ব্যক্তি যিনি ফিকহী বিধানাবলি প্রকাশ করেন অথবা প্রশ্নকারীদের শরীয়তের বিধানাবলি শিক্ষা দেন। Mufti- expounder of the law।- মুহাম্মদ ক্বালআজী, মু’জামু লুগাতিল ফুকাহা ১/৪৪৫

মুফতীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে প্রসিদ্ধ আরবি অভিধান আল মুনজিদে বলা হয়েছে, মুফতী হলেন ফিকহ বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি যিনি ফতোয়া প্রদান করেন এবং শরীয়ত সংশ্লিষ্ট যে সব মাসআলা তার উপর আরোপিত হয় তার উত্তর প্রদান করেন।- আল মুনজিদ ফিল লুগাহ ৫৬৭।

John Milton cowan মুফতীর অর্থ করেছেন deliveror of formal legal opinions, official expounder of Islamic law।

অর্থাৎ বিধিবদ্ধ আইনি অভিমত প্রদানকারী, ইসলামী আইনের অফিসিয়াল বা দায়িত্বশীল ব্যাখ্যা প্রদানকারী।- ইন্টারনেট ব্লগ

সারকথা, মুফতী ফিকহ ফতোয়া বিশেষজ্ঞ এমন একজন আলেম যিনি প্রশ্নকর্তার উদ্দেশে তার প্রার্থিত বিষয়ে অন্ধ অনুকরণের ভিত্তিতে নয়; বরং গভীর অন্তর্দৃষ্টির সাথে স্বচ্ছ বিচার বোধকে কাজে লাগিয়ে শরিয়ার বিধিবিধান সুস্পষ্ট ভাষায় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন।

৩. ইস্তিফতা

ইস্তিফতা অর্থ ফতোয়া জিজ্ঞেস করা। হুবহু এ শব্দটি পবিত্র কুরআনে এসেছে। يستفتونك فى النساء অর্থ তারা তোমাকে নারীদের ব্যাপারে ফতোয়া জিজ্ঞেস করে।- সূরা নিসা ১২৭।

অভিধান গ্রন্থ আল মু’জামুল ওয়াসিতে বলা হয়েছে, استفتاه- سئله رأيه فى مسئلة অর্থাৎ ইস্তিফতা অর্থ হলো, কোনো ফকীহকে কোনো মাসআলার ব্যাপারে তার মতামত জিজ্ঞেস করা।- ৬৭৩।

আল মাওস্‘ুআতুল ফিকহিয়্যাতে বলা হয়েছে, ইস্তিফতা অর্থ, জটিল কোনো বিষয়ে সমাধান চাওয়া।- ৩২/২০।

৪. মুস্তাফতী

মুস্তাফতী ইস্তিফতা মূল ক্রিয়ার কর্তা বিশেষ্য। সে মতে এর অর্থ ফতোয়া জিজ্ঞেস কারী, কোনো মুফতীর কাছে কোনো জটিল বিষয়ে সমাধান প্রার্থনাকারী।- পূর্বোক্ত ৩২/২০।

বাংলা পিডিয়ায় বলা হয়েছে, ‘যখন কোনো ব্যক্তি সরাসরি কুরআন ও হাদীস কিংবা ফিকহের আলোকে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান বের করতে অপারগ হন তখন তিনি মুফতীর কাছে এ বিষয়ে সমাধান চান। এটাকে ইসলামের পরিভাষায় ইস্তিফতা (আরবিতে الاستفتاء) বলে। আর যিনি সে বিষয়ে সমাধান কামনা করেন তাকে মুস্তাফতী (আরবিতে المستفتى)।

৫. দারুল ইফতা

দার (আরবিতে دار) অর্থ গৃহ, ভবন, নিকেতন, প্রতিষ্ঠান, কার্যালয়, আবাস ইত্যাদি। আর ইফতা অর্থ ফতোয়া প্রদান করা। পারিভাষিক অর্থে, যে প্রতিষ্ঠান বা বিভাগ ফতোয়া প্রদানের দায়িত্ব পালন করে তাকে দারুল ইফতা বলা হয়।

৬. মাসআলা

মাসআলা, এটা একটি আরবি মূল ক্রিয়া। এর অর্থ প্রশ্ন করা, জানতে চাওয়া। বহুবচন মাসাইল। এ অর্থে মাসআলা ফতোয়ার সমর্থক। উপরোক্ত ফতোয়ার দ্বিতীয় বিভক্তিটি ফতোয়ার মূলনীতি গ্রন্থে মাসাইলু যাওয়াহিরির রিওয়ায়াহ, মাসাইলু গাইরু যাওয়াহিরির রিওয়ায়াহ শিরোনামে বিবৃত হয়েছে। আমরা উপরে সেগুলোকে ফতোয়া শিরোনামে বিভক্ত করেছি। কারণ ফতোয়া এবং মাসআলার মাঝে মৌলিকভাবে কোনো পার্থক্য নেই। ফাতওয়ায়ে তাতারখানিয়া, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া এবং ফাতাওয়ায়ে শামী প্রভৃতি বিখ্যাত ফতোয়া গ্রন্থগুলোর ফতোয়াগুলো সবই প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে লিখিত উত্তরমালা নয়। অতএব ফতোয়া এবং মাসআলার মাঝে মৌলিকভাবে পার্থক্য নেই। যদিও ইলমী পরিবেশে প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে লিখিত উত্তরকে ফতোয়া এবং ফিকহের গ্রন্থগুলোতে সংকলিত ফিকহী বিধানাবলিকে মাসআলা নামে অভিহিত করা হয়।

ফতোয়ার অপরিহার্যতা

ফতোয়া ইসলামী বিধানের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। ইসলাম থেকে ফতোয়াকে আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। মুসলমানের ব্যক্তি, পরিবার ও সামাজিক জীবনের সর্বত্রই ফতোয়ার প্রয়োজনীয়তা পরিলক্ষিত হয়। কারণ ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। যেখানে জীবন যাপন করতে হয় আল্লাহ ও তার রাসূলের বিধান অনুযায়ী। এজন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিধান কী তা জানা আবশ্যক। প্রতিটি বিষয়ের বিধান জ্ঞান যেহেতু সবার থাকে না তাই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যিনি বিশেষজ্ঞ তাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়ে তদানুযায়ী আমল করতে হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যদি কোনো বিষয়ে তুমি অবগত না হও তবে জ্ঞানীদের কাছ থেকে জেনে নাও।- সূরা আন নাহল ৪৩।

কুরআন অবতীর্ণ কালে কোনো বিষয়ে ফতোয়া জিজ্ঞেস করা হলে ক্ষেত্র বিশেষে আল্লাহ নিজেই ফতোয়া দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, লোকেরা আপনাকে নারীদের ব্যাপারে ফতোয়া জিজ্ঞেস করে। আপনি বলে দিন আল্লাহই তাদের ব্যাপারে ফতোয়া দিচ্ছেন।- সূরা নিসা ১২৭।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও। সহীহ বুখারী; হাদীস ৩৪৬১।

ফতোয়া একটি ধারাবাহিক চলমান প্রক্রিয়া। মানব সমাজ যতো দিন থাকবে ফতোয়ার প্রয়োজনীয়তাও তত দিন থাকবে। কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে কিংবা কোনো বিষয়ে অস্পষ্টতা ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দিলে তার সমাধান ও সংশয় নিরসনের জন্য অন্যকে জিজ্ঞেস করা মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি। সাধারণ মানুষ তো বটেই ক্ষেত্র বিশেষে আদালতও কোনো বিষয়ে স্পষ্ট হওয়ার জন্য ‘এমিকাস কিউরী’ নিয়োগ করে তাদের কাছ থেকে ফতোয়া নিয়ে থাকেন।

একজন মুমিন বা বিশ্বাসী মানুষ জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশনা মেনে চলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। মানব জীবনের এমন কোনো পর্যায় নেই যেখানে তিনি তাঁর আনুগত্যশীল থাকার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত। তিনি বিশ্বাস করেন কারো সামনে যদি মাথা নত করতে হয় তিনি হলেন একমাত্র আল্লাহ। কারণ সৃষ্টিকুলের অধিপতি এবং হুকুমের এখতিয়ার তারই। আল্লাহ নির্দেশ দিচ্ছেন, হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর, আনুগত্য করো রাসূলের এবং তাদের যারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতার অধিকারী। কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ হলে তা উপস্থাপিত কর আল্লাহ এবং রাসূলের নিকট। এটাই উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর।- সূরা নিসা ৫৯

যারা আল্লাহর দেওয়া জীবন বিধানকে পাশ কাটিয়ে মানব রচিত মতবাদ থেকে ফয়সালা অনুসন্ধান করেন তাদের ঈমান প্রশ্নোত্তীর্ণ নয়। যদিও তারা নিজেদের মুমিন বলে মনে করে। জীবনের বিস্তীর্ণ অঙ্গনে যে সমস্ত প্রশ্ন ও সমস্যার উদ্রেক হয় ইসলামে উপস্থাপিত জীবন দর্শন থেকে দ্বিধা সংকোচমুক্ত মনে তার সমাধান গ্রহণ করা ঈমানের অপরিহার্য দাবি। প্রথম যুগে মুসলিমদের জন্য তা যেমন অপরিহার্য ছিল আজকের মুসলিমদের জন্যও তা সমভাবে অপরিহার্য। সে যুগে মুসলিমদের অপরিহার্যতা পূরণের জন্য আল্লাহ নিজেই ফতোয়া বর্ণনা করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দেওয়া বিধান ব্যাখ্যা ও জারি করার মাধ্যমে তাদের প্রয়োজন মিটিয়েছেন। পরবর্তীতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মানিত সাহাবীগণ অত্যন্ত সতর্কতা ও গুরুত্বের সাথে ক্রমবর্ধনশীল মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রের চাহিদা পূরণে ইজতিহাদ ও কিয়াসের মাধ্যমে ফতোয়ার ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় পদ্ধতিগত ভিন্নতার কারণে গড়ে উঠেছে মাযহাব শিরোনামে বিভিন্ন মত দর্শন। তাই আজও ফতোয়ার অপরিহার্যতা ও প্রয়োজনীয়তা বিদ্যমান। কাল থেকে কালান্তরে কিয়ামত পর্যন্ত তা বিদ্যমান থাকবে ইনশাআল্লাহ।

ফতোয়ার আধিকারিক কে?

আল কুরআনে সূরা নিসার ১২৭ ও ১৭৬ নাম্বার আয়াতদ্বয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে সমকালীন মুসলমানদের ফতোয়া প্রার্থনার জবাবে আল্লাহ তা‘আলা নিজেই ফতোয়া প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন। এতে প্রতীয়মান হয় আল্লাহ তা‘আলা ফতোয়ার স্বত্বাধিকারী। আল্লাহর এ ঘোষণা ফতোয়ার মাহাত্ম্য ও মুফতীর মর্যাদাকে অতি উঁচু মর্গে উন্নীত করেছে। কার্যত আল্লাহ তা‘আলাই প্রকৃত মুফতী, ফতোয়ার মূল আধিকারিক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায় ফতোয়া প্রদানের দায়িত্ব পালন করেছেন। এটা ছিল তাঁর রিসালাতের সুমহান দায়িত্ব। সূরা নাহলের ৪৪ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা এ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করে বলেন, আমি আপনার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি। যাতে আপনি লোকদের উদ্দেশে ঐসব বিষয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ বর্ণনা করেন। এবং যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করতে পারে।

এ আয়াতে ‘তুবাইয়িনা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে ব্যাখ্যা করে বুঝানোর অর্থে। ফুকাহায়ে কেরাম ফতোয়াকে এ শব্দের বিশেষ্য পদ দিয়েই সংজ্ঞায়িত করেছেন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরে যারা ফতোয়া দিয়েছেন, এখনো দিচ্ছেন এবং ভবিষ্যতে দিবেন তারা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে দায়িত্ব পালনে তাঁর প্রতিনিধি। আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম জনতাকে তাঁদের কাছ থেকে জেনে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যদি তোমরা জেনে না থাকো তাহলে যাদের কুরআনের জ্ঞান আছে তাদের থেকে জেনে নাও।- সূরা নাহল ৪৩।

এ ব্যাপারে ইসলামের মূলনীতি হলো, যাকে ইলমের অমূল্য নেয়ামতে ভূষিত করা হয়েছে তিনি তা গোপন করবেন না। আল্লাহ তা‘আলা আম্বিয়ায়ে কেরামকে নির্দেশ দিচ্ছেন, যাদের কিতাব দেওয়া হয়েছিল তাদের কাছ থেকে গৃহীত অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিন। তাতে বলা হয়েছিল, তোমরা অবশ্যই মানুষের মাঝে কিতাবের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পেশ করবে। এবং তা গোপন করতে পারবে না।- সূরা আলে ইমরান ১৮৭।

অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন, ‘আপনি বলুন, নিঃসন্দেহে আমার রব প্রকাশ্য ও গোপন সকল অশ্লীলতা, পাপ পঙ্কিলতা, সত্যের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি, তোমাদের দ্বারা আল্লাহর সাথে অংশীদার নিরূপণ যার স্বপক্ষে তিনি কোনো প্রমাণ পাঠাননি এবং তার নামে তোমাদের এমন কোনো কথা বলা, যা তিনি বলেছেন বলে তোমাদের জানা নেই নিষিদ্ধ করেছেন।’- সূরা আ’রাফ ৩৩।

প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ সাহাবী আবু হুরায়রা রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, ‘যে ব্যক্তি না জেনে ফতোয়া প্রদান করবে তদজনিত পাপ তার উপরই বর্তাবে’।- সুনানে আবূ দাউদ; হাদীস ৩৬৫৭।

তিনি আরো বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি আমার প্রতি এমন কথা আরোপ করল যা আমি বলিনি সে যেন দোযখকে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়।- সহীহ বুখারী; হাদীস ১০৭।

আল্লামা ইবনুল কাইয়িম জাওযী রহ. কোনো কথা আল্লাহ তা‘আলার কি না তা না জেনে তাঁর নামে চালিয়ে দেওয়াকে এর ভয়াবহতা বিবেচনা করে শিরকের চেয়েও ধ্বংসাত্মক বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি এ ধরনের কথাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অধিকারের প্রতি দণ্ডযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।- ই’লামুল মুয়াক্কিয়ীন ১/৩৮।

মুফতীর শর্তাবলি

একজন মুফতীর মাঝে কি কি শর্তের উপস্থিতি আবশ্যক আল মাউসুআতুল ফিকহিয়্যায় তার একটা পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে। তাতে মুফতীর সাতটি শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে।

১. ইসলাম। মুফতী যিনি হবেন তার জন্য ইসলামের পবিত্র ধর্ম বিশ্বাসে দীক্ষিত হওয়া আবশ্যক। সুতরাং ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী কারো ধর্মীয় অভিমত ফতোয়া বলে বিবেচিত হবে না।

২. বয়সের পরিপক্বতা। একজন মুফতীকে অবশ্যই যথোপযুক্ত প্রাপ্ত বয়সে উপনীত হতে হবে। অপ্রাপ্ত কিংবা অপরিপক্ব বয়সী কারো ফতোয়া গৃহীত ফতোয়ার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হবে না।

৩. জ্ঞান বুদ্ধি। একজন মুফতীকে সুস্থ, স্বচ্ছ জ্ঞানবুদ্ধি সম্পন্ন হওয়া আবশ্যক। সুতরাং জ্ঞানবুদ্ধিতে অস্বচ্ছতা, অপরিপক্বতা কিংবা প্রতিবন্ধিতা আছে এমন কারো ফতোয়া ফতোয়া হিসেবে গৃহীত হবে না।

৪. ন্যায়পরায়ণতা ও সত্যনিষ্ঠতা। একজন মুফতীকে যথেষ্ট ন্যায়পরায়ণ ও সত্যনিষ্ঠ হতে হবে। সুতরাং অন্যায়াশ্রয়ী কোনো পাপ পঙ্কিলতায় অভ্যস্ত ব্যক্তি মুফতীর সুমহান আসনে অধিষ্ঠিত হতে পারে না।

৫. ইজতিহাদ। ইজতিহাদ অথর্, সর্বসম্মত গৃহীত দলীল প্রমাণের আলোকে শরঈ বিধান সম্বন্ধে ধারণা লাভ ও তা উদ্ভাবনের উদ্দেশে ফকীহের সবটুকু সাধ-সাধ্য ও শ্রম-সাধনা ব্যয় করা। একজন মুফতীর প্রধানতম শর্ত হলো, ইজতিহাদ। ইমাম শাফী রহ. বলেন, আল্লাহ তা‘আলার দীনের ব্যাপারে শুধু এমন ব্যক্তির জন্যই ফতোয়া প্রদান বিধিত যিনি কুরআনের নাসেখ-মানসুখ (রহিতকারী এবং রহিত কৃত আয়াত-প্রবচন), মুহকাম- মুতাশাবিহ (দ্ব্যর্থহীন এবং দ্ব্যর্থবোধক আয়াত প্রবচন), তাওয়ীল-তানযীল (কুরআনের মূল পাঠ এবং তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ) এবং এতদোভয়ের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে প্রজ্ঞাবান হবেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসের নাসিখ মানসুখ সম্বন্ধে গভীর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হবেন, কুরআন বিষয়ে যে পরিমাণ পাণ্ডিত্বের প্রয়োজন হাদীস বিষয়েও সে পরিমাণ পাণ্ডিত্বাধিকারী হবেন, ভাষা জ্ঞান, কাব্য জ্ঞান তথা কুরআন-সুন্নাহ বুঝার ক্ষেত্রে যেসব শাস্ত্রের প্রয়োজন সে সম্পর্কে সম্যক অবগতি লাভ করবেন, এগুলো সুবিচার বোধের আলোকে প্রয়োগ করবেন, দেশজ সার্বিক রীতিনীতির আবর্তন-বিবর্তন সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা রাখবেন এবং এসবের সাথে সাথে প্রখর মেধা সম্পন্ন হবেন। সুতরাং কারো মাঝে যদি এসব জ্ঞান গুণের সমাবেশ হয় তবে কেবল তিনিই ফতোয়া ফারায়েজ সম্বন্ধে কথা বলার অধিকার লালন করবেন এবং হালাল হারাম সম্বন্ধে ফতোয়া দিতে পারবেন। আর যিনি জ্ঞান-গুণের এ উচ্চতায় পৌঁছুতে পারবেন না তার জন্য ফতোয়া প্রদানের অধিকার অনুন্মুক্ত।- খতীবে বাগদাদী, আল ফকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ ৩০৯, আলমাউসুআতুল ফিকহিয়্যায় ইমাম শাফেয়ী রা. এর মুফতীর শর্তাবলি উল্লেখ করে মন্তব্য করা হয়েছে, এটাই হলো, ইজতিহাদের বস্তুনিষ্ঠ অর্থ। ৩২/২৮ তবে আল্লামা তুমুরতাশী রহ. বলেন, মুফতীর জন্য ইজতিহাদটা হলো প্রাধান্য শর্ত। ইবনে আবিদীন রাহ. বলেন, এর অর্থ হলো মুজতাহিদের উপস্থিতিকালে তিনিই মুফতী নিয়োগের ব্যাপারে প্রাধান্য পাবেন।- রদ্দুল মুহতার ৫/৪৯৮, ৫০৫ ইবনে দাকীকুল ঈদ রহ. হুবহু একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন।- আলমাউসুআতুল ফিকহিয়্যা ৩২/২৮।

৬. উন্নত প্রতিভাশক্তি। এর অর্থ একজন মুফতীকে বিপুল পরিমাণ নির্ভুলতা ও যথার্থতার প্রমাণ দিতে হবে। এবং তার মাসআলা উদ্ভাবন শক্তি বিশুদ্ধ ও গতিময় হতে হবে। সুতরাং অনুন্নত মেধার অধিকারী এবং যাদের ত্রুটিবিচ্যুতির পরিমাণটা তুলনামূলক বেশি তাদের জন্য ফতোয়া প্রদানের অধিকার অরক্ষিত।

৭. বিচক্ষণতা ও সচেতনতা। একজন মুফতীর মাঝে বিচক্ষণতা ও সচেতনতাবোধ থাকা আবশ্যক। ইবনে আবিদীন রহ. বলেন, মুফতীর জন্য গভীর বিচক্ষণ ও চৌকস হওয়া আবশ্যক। যাতে তারা নীতিহীন মানুষের চক্রান্ত ও ছলচাতুরী অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। কারণ অনেক মানুষ ছলচাতুরী, প্রবঞ্চনা ও জালিয়াতিপ্রসূত কথার মারপ্যাচে মিথ্যাকে সত্য করার ব্যাপারে বেশ সিদ্ধহস্ত। এক্ষেত্রে মুফতী মহোদয় অসচেতন হলে বড়ো ধরনের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।- ইবনে আবিদীন, রদদুল মুহতার ৪/৩০১

ফতোয়ার বিধান

যোগ্য মুফতীর জন্য ফতোয়া প্রদান ফরযে কেফায়া। সুতরাং অঞ্চল বিশেষে যদি একাধিক মুফতী বিদ্যমান থাকে তাহলে তাদের একজন এ দায়িত্ব পালন করলে অন্যরা এর দায়ভার থেকে মুক্তি পাবেন। তবে কিছু ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে ফতোয়া প্রদান করা ফরযে আইন বলে বিবেচিত। যথা,

১. কোথাও যদি কেবলমাত্র একজন মুফতী থাকেন তাহলে সে মুফতীর জন্য ফতোয়া প্রদান করা ফরযে আইন হয়ে পড়ে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, নিশ্চয় যে সকল লোক আমার নাযিলকৃত উজ্জ্বল নিদর্শনাবলি ও হিদায়তকে গোপন করে যদিও আমি কিতাবে তা মানুষের জন্য সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেছি, তাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলা অভিসম্পাত বর্ষণ করেন এবং অন্যান্য অভিসম্পাতকারীরাও অভিসম্পাত বর্ষণ করেন।- সূরা বাকারা-১৫৯

২. ফতোয়া প্রার্থীর যদি দ্রুত ফতোয়ার প্রয়োজন হয় এবং ফতোয়া প্রদান না করা হলে অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়া কিংবা আল্লাহর বিধান পরিত্যাগের প্রবল আশঙ্কা হয় তাহলে এক্ষেত্রে মুফতী মহোদয়ের জন্য ফতোয়া প্রদান করা ফরযে আইন।

৩. প্রশাসনের পক্ষ থেকে যদি ফিকহ ফতোয়ায় বিশেষজ্ঞ কোনো ব্যক্তিকে মুফতী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় তখন তার উপর ফতোয়ার দায়িত্ব পালন করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, হে ঈমানদারগণ আল্লাহর নির্দেশ মান্য করো। নির্দেশ মান্য করো রাসূলের, তোমাদের মধ্যে যারা প্রশাসক তাদের।- সূরা নিসা ৫৯।

ইমাম নববী রহ. বলেন, ফতোয়া প্রার্থীদের ফতোয়া প্রদান করা ফরযে কেফায়া। আর যদি সেখানে কেবলমাত্র একজন মুফতী থাকেন তবে সেক্ষেত্রে ফতোয়া প্রদান ফরযে আইন হয়ে পড়ে।- আল্লামা জাস্টিস তাকি উসমানী, উসূলুল ইফতা ওয়া আদাবুহু ২৮৬, ইমাম নববী, আলমাজমু ভূমিকাংশ ১/২৭।

আল্লামা মাহাল্লী রহ. বলেন, তাত্ত্বিক প্রমাণাদি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করা, দীনি বিষয়ে সমস্যার সমাধান প্রদান করা, সংশয় সন্দেহ বিদূরিত করা, তাফসীর হাদীস এবং ফিকহ বিষয়ক শরঈ জ্ঞান অর্জন করা- এসবই ফরযে কিফায়া। এসব বিষয়ে অভিজ্ঞ হয়ে যেন বিচারক এবং মুফতী পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। কারণ ধর্মীয় অঙ্গনে এ দু’টির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। রাষ্ট্রের ভিতরে সর্বজন বিদিত যোগ্যমান নির্দিষ্ট সংখ্যক মুফতী থাকা আবশ্যক। যাতে করে মানুষ তাদের ধর্মীয় সমস্যাবলি নিয়ে তাদের শরণাপন্ন হতে পারে। নামায কসর করা যায় এই পরিমাণ দূরত্বের মাঝে একজন করে মুফতী থাকা আবশ্যক বলে মত দিয়েছেন শাফী মাসলাকের উলামায়ে কেরাম।- জালালুদ্দীন মাহাল্লী, শরহু মিনহাজিত তালিবীন ৬/৩২৪।

ফতোয়ার নিষিদ্ধ বিধান

একজন মুফতী মানে সমাজে অবিসংবাদিত নেতা। সমাজের ধর্ম বিষয়ক যাবতীয় সমস্যার সমাধান দেওয়া একজন মুফতীর গুরু দায়িত্ব। ক্ষেত্র বিশেষে বিষয়টা তার জন্য ফরযে আইন হয়ে পড়ে। তবে কিছু ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে ফিকহ ফতোয়ার নীতিমালার আলোকে মুফতীর জন্য ফতোয়া দেওয়া নিষিদ্ধ।

১. মুফতী মহোদয় যথা নিয়মে ফতোয়া প্রদানে যোগ্য। কিন্তু প্রার্থিত মাসআলা বিশেষের বিধান সম্বন্ধে তার ধারণা নেই। এবং তড়িত গতিতে মূলনীতির আলোকে এর বিধান উদ্ভাবন করাও তার পক্ষে আপাতত সম্ভব নয়। অথবা সংশ্লিষ্ট মাসআলার দলীল প্রমাণের ব্যাপারে সে দ্বিধান্বিত এবং প্রমাণগুলোর মাঝে প্রাধান্য বিধান করা তার জন্য কষ্ট সাধ্য। এক্ষেত্রে মুফতীর জন্য ফতোয়া প্রদান বিধিত নয়। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বিচারক তিন প্রকৃতির। তার মধ্য থেকে এক প্রকৃতির বিচারক জান্নাতে যাবে। আর বাকি দুই প্রকৃতির বিচারক জাহান্নামে যাবে। জান্নাতী বিচারক হলো সেই বিচারক যিনি সত্য জানেন এবং তদানুযায়ী রায় প্রদান করেন। আর যে বিচারক সত্য জানে কিন্তু অবিচার করে এবং বিচারের ক্ষেত্রে জুলুমের আশ্রয় নেয় এবং তেমনিভাবে যে বিচারক না জেনে মানুষের মাঝে বিচারিক রায় প্রদান করে এরা উভয় জাহান্নামী।- সুনানে আবু দাউদ ৩/৩২৪/৩৫৭৫ বিচারকের এ বিভাজনের ক্ষেত্রে বিচার ব্যবস্থা এবং ফতোয়ার মাঝে কোনো ব্যবধান নেই। সুতরাং এমন পরিস্থিতিতে মুফতী মহোদয় ফতোয়া সেবা দান থেকে নিবৃত্ত থাকবেন। চূড়ান্ত বিধান নিরূপনের জন্য সময় নেবেন। নতুবা ফতোয়া প্রার্থীকে অন্য কোনো বিজ্ঞ মুফতীর কাছে সোপর্দ করবেন। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, যখন তাঁর বিদূষিতা সম্বন্ধে আয়াত অবতীর্ণ হলো তখন আবু বকর রা. আয়েশা রা.-এর মাথায় চুমু খেলেন। তখন আয়েশা রা. বললেন, আপনি আমার ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আমার বিদূষিতার কথা বললেন না কেন? তখন আবু বকর রা. বললেন, যে ব্যাপারে আমার নিশ্চিত ধারণা নেই সে ব্যাপারে মন্তব্য করলে কোন আকাশ আমাকে ছায়া দিবে? কোন জমিন আমাকে বহন করবে?- ইমাম বাইহাকী, আল মাদখাল ইলাস সুনানিল কুবরা ১/১৬৭/৬৪৭, নুরুদ্দীন হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৯/১৮৮/১৫৩০২।

২. মুফতী যদি আশঙ্কা বোধ করে, ফতোয়া প্রার্থী এ ফতোয়া পত্র নিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে অথবা তার প্রবল ধারণা হয়, এ ফতোয়া প্রকাশিত হলে সমাজে চরম বিবাদ-বিসংবাদ দেখা দিবে তবে এসব ক্ষেত্রে মুফতী মহোদয় ফতোয়া প্রদান থেকে নিবৃত্ত থাকবে। কারণ বিপর্যয় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে শান্তিময় পরিবেশ বজায় রাখা উত্তম।

আল্লামা আজুররী রহ. বলেন, যদি কোনো বিজ্ঞ মুফতীকে কোনো বিষয়ে মাসআলা জিজ্ঞেস করা হয় আর সে জানে যে এ মাসআলার সাথে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বিপর্যয়, অশান্তি জড়িত। এবং এ মাসআলা প্রকাশিত হলে মানুষের মাঝে বিবাদ-বিসংবাদ ছড়িয়ে পড়তে পারে তবে এক্ষেত্রে সে প্রার্থিত মাসআলার উত্তর প্রদান করবে না। বরং ফতোয়া প্রার্থীকে হিতৈষী মনোভাব নিয়ে তার জন্য উপযোগী কোনো পথ পন্থা বলে দিবে।- আল্লামা আজুররী, আখলাকুল উলামা ১/৪৩।

৩. যেসব প্রশ্নের জবাবে কোনো ধরনের উপকারিতা নেই সেসব অনর্থক প্রশ্নের উত্তর মুফতী মহোদয় প্রদান করবেন না। ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীদের থেকে শ্রেষ্ঠ কোনো সম্প্রদায়কে দেখিনি। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মাত্র তেরটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন; এর মাঝেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তিরোধান হয়ে যায়। আর সবগুলো বিষয়ই ছিল কুরআন বিষয়ক। যেসব প্রশ্নের উত্তরে তারা লাভ দেখতেন শুধু সেসব বিষয়েই তারা প্রশ্ন করতেন।- ইমামা দারিমী, সুনানুদ দারিমী ১/৫১, আল্লামা জাস্টিস তাকী উসমানী, উসূলুল ইফতা ওয়া আদাবুহু ২৮৬-২৯১।

ফতোয়া জিজ্ঞাসার বিধান

জীবন ঘনিষ্ঠ বিষয়াদির বিধান সম্বন্ধে যে অবগত নয় তার জন্য ফতোয়া জিজ্ঞেস করা আবশ্যক। কারণ শরীয়তের বিধান মতে ইমপ্লিমেন্টেশন তথা আমল করা প্রতিটি মুসলিমের জন্য জরুরি।

ইমাম নববী রহ. বলেন, কোনো ব্যক্তি কোনো বিষয়ের সম্মুখীন হলে তার জন্য সে বিষয় সম্বন্ধে বিধান জেনে নেয়া আবশ্যক। সুতরাং তার এলাকায় যদি যোগ্যমান মুফতী না থাকে তবে সফর করে হলেও বিজ্ঞ মুফতীর শরণাপন্ন হওয়া তার জন্য আবশ্যক। আমাদের পূর্বসূরিদের অনেকেই একটি মাত্র মাসআলার জন্য রাত দিন সফর করতেন।- আল্লামা শাতিবী, আল মুওয়াফাকাত ৫/৩৭১, ইমাম নববী, আলমাজমু’১/৫৪।

ফতোয়ার সংবেদনশীলতা

ফতোয়া চরম জটিল, কঠিন স্পর্শকাতর একটি বিষয়। ফতোয়া ব্যবহারে সামান্য অসতর্ক হলে দীন-দুনিয়ার চরম বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। কারণ ফতোয়া হলো আল্লাহর বিধান। আর মুফতী হলো সে বিধান বর্ণনায় আল্লাহর প্রতিনিধিত্বকারী। একটি মাসআলা বলা বা তাতে স্বাক্ষর করার অর্থই হলো, তিনি আল্লাহ তা‘আলার প্রতিনিধি হয়ে মাসআলা বলছেন কিংবা স্বাক্ষর করছেন। তাইতো বলা হয় মুফতী হলো, আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হয়ে স্বাক্ষরকারী।- আল্লামা তাকি উসমানী, উসূলুল ইফতা ১৩।

সুতরাং ফতোয়া ব্যবহারে বিষম যতœশীল হতে হবে এবং গভীর বিচক্ষণতা নিয়ে ফতোয়ার লেনদেন করতে হবে। যাতে আল্লাহ তা‘আলা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর মিথ্যা আরোপ না হয়ে যায়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আল্লাহর প্রতি এমন কথা আরোপ করাকে আল্লাহ নিষেধ করেছেন যে সম্পর্কে তোমাদের অবগতি নেই।- সূরা আল ইমরান-৩৩।

অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে, যেসব বস্তু সম্পর্কে তোমাদের জিহ্বা মিথ্যা রচনা করে সে সম্পর্কে বলো না এটা হালাল এবং এটা হারাম। কারণ এর অর্থ হবে, তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করছো। নিশ্চিত জেনো যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে তারা সফলকাম হয় না।- সূরা আন নাহল ১১৬।

অব্দুল মালিক বিন মারওয়ান রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবু হুরায়রা রা. কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে ব্যক্তিকে না জেনে ফতোয়া প্রদান করা হয়েছে তার যাবতীয় পাপের দায়ভার ঐ ব্যক্তির উপর বর্তাবে যে না জেনে তাকে ফতোয়া প্রদান করেছে। সুনানে আবূ দাউদ ৩/১৫৭২/৩৬৫৭।

অন্যত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমাদের মধ্যে ফতোয়ার ব্যাপারে যে বেশি দুঃসাহসী সে জাহান্নামের ব্যাপারে বেশি দুঃসাহসী।- সুনানে দারিমী ১/৫৭।

ইবনে আবি লাইলা রা. বলেন, প্রত্যেক সাহাবীই হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে আগ্রহ করতেন যে তার অন্য ভাই তার জন্য এ ব্যাপারে যথেষ্ট হবেন। তেমনিভাবে তারা ফতোয় দানের ব্যাপারেও আগ্রহ প্রকাশ করতেন যেন তাদের অন্য ভাইরা তাদের জন্য এ ব্যাপারে যথেষ্ট হয়ে যান।- সুনানে দারিমী ১/২৪৮।

সুফইয়ান ইবনে উয়াইনাহ এবং সাহনুন রহ. বলেন, ফতোয়ার ব্যাপারে অতিশয় ধৃষ্টতা প্রদর্শনকারী খুব স্বল্প মেধার অধিকারী। সুতরাং বিজ্ঞ মুফতীদের জন্য ফতোয়া দানের ব্যাপারে সীমাহীন সতর্ক ও সংবেদনশীল হওয়া উচিত। যেসব বিষয়ে কুরআন সুন্নাহর বিধান স্পষ্ট এবং সর্বসম্মত শুধু সেসব বিষয়েই ফতোয়া দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাবে। এছাড়া যেসব ক্ষেত্রে বিভিন্ন মত-পথ ও দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে এবং বিধানে বেশ প্রচ্ছন্নতা রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে খুব সতর্কতার সাথে পথ চলবে।

ইমাম মালেক রা.-এর ব্যাপারে বর্ণিত আছে, অনেক ক্ষেত্রে তাকে পঞ্চাশটি মাসআলা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হতো; কিন্তু তিনি একটি মাসআলারও উত্তর দিতেন না। বরং তিনি বলতেন, যিনি উত্তর দিবেন, উত্তর দেওয়ার পূর্বে তার কর্তব্য হলো জান্নাত জাহান্নামের সম্মুখে নিজেকে উপস্থাপন করা, সাথে সাথে জাহান্নামের মর্মন্তুদ শাস্তি থেকে কি করে নিষ্কৃতি মিলবে তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা। এরপর যেন সে উত্তর দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে।

আসরাম রা. বলেন, আমি ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রা. কে অসংখ্যবার বলতে শুনেছি ‘আমি জানি না’।- ইমাম নববী, আলমাজমু ১/৪০-৪১, আলমাউসুআ ৩২/২৪

ইমাম আবূ হানীফা রা. বলেন, আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে যদি ইলম উঠিয়ে নেয়ার আশঙ্কা না হতো তাহলে আমি কাউকে ফতোয়া দিতাম না, ফতোয়া প্রার্থীর জন্য হবে যেটা আনন্দঘন বিষয় আর আমার উপর হবে ঝুঁকিপূর্ণ এবং ভয়ংকর এক বোঝা।- উসূলুল ইফতা ১৬।

ফতোয়ার পরিধি

ফতোয়া ব্যবহারের কোনো সীমা রেখা নেই। পৃথিবীর অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সামগ্রিক বিষয়ে ফতোয়ার রাজত্ব সদর্পে বিদ্যমান। এ ফতোয়া ইসলামী জীবন ব্যবস্থার অন্যতম একটি অনুষঙ্গ। মুসলমানের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক এবং অর্থনৈতিক লেনদেনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে শরীয়তের বিধান জানা ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা আবশ্যক। আর এসবই ফতোয়ার আওতাভুক্ত। সুতরাং ফতোয়া বিশ্বাসিক, ব্যবহারিক, দায়িত্বগত ও গঠনগত বিধানাবলিসহ মানব জীবনের যাবতীয় বিধানাবলির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

ফতোয়ার মর্যাদা

ফতোয়ার মর্যাদা অপরিসীম। নিম্নে কয়েকটি পয়েন্টে ফতোয়ার মর্যাদার দিকটি সংক্ষেপে উপস্থাপিত হলো।

১. স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা নিজ বান্দাদের ফতোয়ার উত্তর দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, লোকেরা আপনাকে নারীদের সম্পর্কে ফতোয়া জিজ্ঞেস করে। আপনি বলে দিন, আল্লাহ নিজেই নারীদের সম্পর্কে ফতোয়া দিচ্ছেন।- সূরা নিসা ১২৭।

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, লোকেরা আপনার কাছে ফতোয়া জানতে চায়। আপনি বলে দিন, আল্লাহ তোমাদের কালালা (পিতামাতাহীন ও নিঃসন্তান উত্তরাধিকারী) সম্বন্ধে ফতোয়া দিচ্ছেন। সূরা নিসা ১৭৬।

২. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায় ফতোয়া প্রদানের এ মহান পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। আর এটা ছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রিসালাতের অন্যতম বিষয়। আল্লাহ তা‘আলা নিজেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ গুরু দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমি আপনার উপর কুরআন অবতীর্ণ করেছি। যাতে আপনি লোকদেরকে অবতীর্ণ বিষয়াবলি ব্যাখ্যাসহ বুঝিয়ে দেন। এবং যাতে তারা এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে।- সূরা নাহল ৪৪।

সুতরাং একজন মুফতী ফতোয়া প্রদানের দায়িত্ব পালনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতিনিধি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরে সাহাবায়ে কেরাম এবং তাদের পরে তাবিয়ীন পর্যায়ক্রমে ফতোয়া প্রদানের গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন।

৩. ফতোয়ার প্রতিপাদ্য বিষয় হলো আল্লাহ তা‘আলার বিধান বর্ণনা করা এবং তা মানুষের ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করা। প্রকারান্তরে এটা আল্লাহরই বাণী। তিনি ফতোয়া প্রার্থীকে বলছেন তোমার জন্য এ কাজ করা আবশ্যক, তোমার জন্য একাজ করা নিষিদ্ধ। এ কারণে আল্লামা কারাফী রহ. মুফতীকে আল্লাহর উদ্দেশ্যের ব্যাখ্যাদাতা দুভাষী বলে অভিহিত করেছেন। আর আল্লামা ইবনুল কাইয়িম রহ. মুফতীকে রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষ থেকে স্বাক্ষরকারী মন্ত্রীর সাথে তুলনা করেছেন। ইবনুল কাইয়িম রহ. বলেন, রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষ হয়ে স্বাক্ষরকারী মন্ত্রীর মর্যাদা এতটাই মূল্যবান ও সমুন্নত একটি পদ যার মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। এটা একটা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদমর্যাদা। তাহলে এ ভূম-ল ও নভোম-লের অধিপতি আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে স্বাক্ষরদাতার পদ মর্যাদার মাহাত্ম্য কী পরিমাণ হবে তা বলাই বাহুল্য।- ই‘লামুল ময়াক্বিয়ীন ১/১০, আল মাজমু ১/৪০।

ইবনুল মুনকাদির রহ. বলেন, আলেম হলো আল্লাহ এবং তার সৃষ্টির মাঝে সেতুবন্ধ। সুতরাং সে যেন গভীরভাবে ভেবে দেখে যে, সে এই দু পক্ষের মাঝে কি করে দায়িত্ব পালন করবে?- ইমাম নববী, আল মাজমু’ ১/৭৩।

ফতোয়া এবং বিচার ব্যবস্থা

বিচার হলো বাদী-বিবাদীর মাঝে সৃষ্ট দ্বন্দ্বকে আইনানুগ পদ্ধতিতে নিষ্পত্তি করে দেওয়া। বিচারকে আরবি ভাষায় কাযা বা হুকুম বলা হয়। এবং বিচারককে বলা হয় কাজী বা হাকিম। বিচার ব্যবস্থা অনেকটা ফতোয়া বিধানের মতোই। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দু’টির মাঝে ব্যবধান রয়েছে।

১. ফতোয়া হলো শরঈ বিধান বলে দেওয়া বা বর্ণনা করা। আর বিচার হলো বাদী বিবাদীর মাঝে সৃষ্ট বিরোধ নিষ্পত্তি করে দেওয়া।

২. ফতোয়ার বিধান প্রতিপালনে ফতোয়া প্রার্থী কিংবা অন্য কারো জন্য সৃষ্টির পক্ষ থেকে কোনোরূপ বাধ্যবাধকতা নেই। ইচ্ছে করলে সে এই ফতোয়া বিধান পালন করতে পারে আবার নাও করতে পারে। এবং এক্ষেত্রে সে অন্য মুফতীর শরণাপন্নও হতে পারে। পক্ষান্তরে বিচারিক বিধান হলো একটি বাধ্যগত বিষয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিবাদমান দুটি পক্ষের কোনো একটি পক্ষ যদি অপর পক্ষের বিরুদ্ধে কোনো মুফতীর দারুল ইফতায় মামলা দায়ের করে তাহলে মুফতী বিবাদী পক্ষকে দারুল ইফতায় হাজির হতে বাধ্য করতে পারবে না। অন্যদিকে সে যদি আদালতে মামলা দায়ের করে তাহলে বিবাদী পক্ষকে মামলার নির্দিষ্ট তারিখে আদালতে হাজির হতে হবে। এবং বিচারক মহোদয়ও তাকে কোর্টে হাজির হতে বাধ্য করতে পারবে। কারণ বিচারপতিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে দুটি পক্ষের মধ্যকার বিবাদকে নিষ্পত্তি করার উদ্দেশ্যে।- আল্লামা যারকাশী, আল বাহরুল মুহীত ৪/৪০১, ই’লামুল মুয়াক্কিয়ীন ১/৩৬।

৩. মুফতী ফতোয়া প্রদান করেন আভ্যন্তরীণ বিষয়াদির নিরিখে এবং ফতোয়া প্রার্থীকে সত্যবাদী বলে ধারণা করেন। অন্যদিকে বিচারপতি বাস্তবতার নিরিখে বিচার কার্য পরিচালনা করেন। ইবনে আবিদীন রহ. বলেন, এর উদাহরণ হলো, জনৈক ব্যক্তি এক মুফতী সাহেবের কাছে এসে বলল, আমি মিথ্যা মনে করে আমার স্ত্রীকে বলেছি তুমি তালাক। এক্ষেত্রে মুফতী মহোদয় ফতোয়া দিবেন, আপনার স্ত্রীর উপর তালাক পতিত হয়নি। পক্ষান্তরে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ালে বিচারপতি রায় দিবেন আপনার স্ত্রীর উপর তালাক পতিত হয়ে গিয়েছে।- রদ্দুল মুহতার ৪/৩০৬

৪. বিচারপতির বিচার হলো একটি বিচ্ছিন্ন বিষয়। বিচারিক রায় দণ্ডপ্রাপ্ত কিংবা রায় প্রাপ্ত পক্ষ ছাড়া অন্য কারো উপর প্রয়োগ হবে না। অন্যদিকে মুফতীর ফতোয়া একটি ব্যাপক ভিত্তিক শরঈ বিধান। এটা ফতোয়া প্রার্থী ছাড়া অন্যান্যদের উপরও প্রয়োগ হতে পারে। সুতরাং বিচারক বিশেষ কোনো ব্যক্তির পক্ষে বা বিপক্ষে নির্দিষ্ট কোনো রায় প্রদান করেন। আর মুফতী সর্বজনীন বিধান হিসেবে ফতোয়া প্রদান করেন।- ই’লামুল মুয়াক্কিয়ীন ১/৩৮।

৫. বিচার প্রক্রিয়া কেবলমাত্র বক্তব্য ভাষ্যেই সম্পন্ন হয়। আর ফতোয়া লিখিত, কর্ম সম্পাদন এবং ইশারা ইঙ্গিতেও সম্পন্ন হতে পারে। আল্লামা কারাফী, আলফুরুক ১/১১, আল ইহকাম ১৯৫, আলমাউসূআ ৩২/২১।

অনেক বিজ্ঞ আলেম একই সাথে মুফতীও ছিলেন এবং বিচারপতিও ছিলেন। বিচারপতি হিসেবে তার প্রশাসনিক ক্ষমতা ছিল। তবে তিনি বিচারপতির এজলাস থেকে যেসব সিদ্ধান্ত প্রদান করতেন কেবল সেসব সিদ্ধান্তই বিচারিক রায় হিসেবে গণ্য হতো। পক্ষান্তরে তিনি যখন জনসাধারণের প্রশ্নের উত্তরে ধর্মীয় অভিমত ব্যক্ত করতেন তখন তা নন-বিচারপতি মুফতীদের ফতোয়ার মতো নিছক ফতোয়া হিসেবে গণ্য হতো। তবে বিচারকের বিচার বিধির একটি স্বীকৃত নীতি হলো, বিচারপতি যদি বিশেষজ্ঞ আলেম না হন তাহলে তাকে শরীয়তের বিধান জানার জন্য মুফতীর শরণাপন্ন হতে হবে।

আল্লাহ তা‘আলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইফতা এবং বিচার উভয় দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। প্রথম দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যেসব বিধিবিধান বর্ণনা করেছেন তা ফতোয়া হিসেবে গণ্য। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যেসব সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন তা কাযা বা বিচার বলে গণ্য।

ইবনুত্তল্লা (৪৯৭ হি.) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিচারিক ফয়সালাসমূহের একটি সংকলন প্রস্তুত করেছেন। যার শিরোনাম হলো اقضية رسول الله صلى الله عليه وسلم (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিচারিক রায়সমূহ)। এতে শুধু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিচারিক রায়সমূহ উল্লিখিত হয়েছে। পক্ষান্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে যা কিছু বলেছেন তা ফতোয়া, আছার ও হাদীসের গ্রন্থসমূহে সংকলিত হয়েছে। মুফতী সাধারণত দীন ও শরীয়তের বিধান সম্পর্কে অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ হয়ে থাকেন। তার কোনো প্রশাসনিক ক্ষমতা থাকে না। বিচার করা কিংবা কোনো শাস্তি কার্যকর করার অধিকারও তার নেই। এমন কি কোনো আলেমকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মুফতী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলেও তিনি শুধু শরীয়তের বিধান বর্ণনা করারই অধিকার লাভ করেন। বিচার কিংবা শাস্তি প্রয়োগ করার অধিকার তার থাকে না। কারণ বিচার হচ্ছে বিচারকের কাজ আর শাস্তি কার্যকর করা রাষ্ট্রের অনুমোদিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাজ। মুফতীর ফতোয়ার আইনি দিক হলো, তিনি শরীয়তের বিধান বর্ণনা করেন। আর প্রত্যেক মুসলিম শরীয়তের বিধান প্রতিপালনের জন্য শরঈ আইন মতে আদিষ্ট। সুতরাং নিজের ঈমানের দাবিতে পরকালে আল্লাহর নিকট জবাবদিহির ভয়ে ফতোয়া অনুযায়ী আমল করতে বাধ্য। তবে ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধান যদি ফতোয়া প্রতিপালনে রুল জারি করে তবে ইহকালীন বিচারে সে তা প্রতিপালনে বাধ্য। তবে এই আইনি দিকটির কারণে মুফতী বিচার করা কিংবা শাস্তি কার্যকর করার অধিকার লাভ করেন না। বরং এর জন্য বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ রয়েছে।

আল্লাহর বিধান বলার ক্ষেত্রে সতর্কতা

কোনো একটি মাসআলা বা ফতোয়াকে ‘আল্লাহর বিধান’ বলার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিহাদের কাফেলা প্রেরণ কালে সেনাপতিকে উদ্দেশ করে উপদেশে বলতেন,… জিহাদের ময়দানে যদি তোমরা শত্রু বাহিনীর কেল্লা অবরোধ করো আর কেল্লায় অবরুদ্ধ শত্রু বাহিনী তোমাদের কাছে আল্লাহর বিধান মতে তাদেরকে কেল্লা থেকে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করে তবে তোমরা তাদেরকে আল্লাহর বিধান মতে অবতারণ করো না। বরং তোমরা তাদেরকে নিজেদের এবং তোমাদের সঙ্গী সৈন্যদের হুকুম মতে অবতারণ করবে। কারণ তোমরা জানো না যে, তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার যথার্থ বিধান প্রয়োগ করতে পারবে কি না?- সহীহ মুসলিম ৫/১৩৯/৪৬১৯।

এ কারণেই উমর রা. এর সম্মুখে যখন লিপিকার তাঁর ফরমান লিপিবদ্ধ করছিল তখন লিপিকার বলল, এগুলো আল্লাহ তা‘আলা আমীরুল মু‘মিনীন-এর হৃদয়ে উদ্ভাসিত করেছেন। তখন উমর রা. বললেন, এভাবে বল না। বল, এগুলো আমীরুল মু‘মিনীনের নিজেরই সিদ্ধান্তাবলী।

ইবনে ওয়াহহাব রা. বলেন, আমি মালেক রা. কে বলতে শুনেছি, আমাদের পূর্বসুরি এবং অনুসৃত কোনো মনীষীকে বলতে শুনিনি, যে এটা হালাল, এটা হারাম। এ ব্যাপারগুলোতে তাঁরা স্পর্ধা এবং দুঃসাহস দেখাতেন না। তাঁরা বলতেন, এটাকে আমি অপছন্দ করি এবং এ বিষয়টাকে আমি ভালো মনে করি, এরকম হওয়া উচিত, এ ব্যাপারটাকে আমরা যথার্থ মনে করি। তুমি কি আল্লাহর বাণী শুনোনি? ‘বল, আচ্ছা তোমরা নিজেরাই লক্ষ্য করে দেখো, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য যা কিছু আহার হিসেবে অবতীর্ণ করেছেন তোমরা সেগুলোর মধ্য হতে কোনটাকে হারাম আর কোনটাকে হালাল সাব্যস্ত করছো? বলো, তোমাদের কি আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন? না কি তোমরা আল্লাহর উপর অপবাদ আরোপ করছো?’- সূরা ইউনুস ৫৯।

একদা ইমাম মালেক রা. এর সম্মুখে একটি মাসআলা উপস্থাপন করা হলো। চিন্তা ভাবনা করে অভিমত ব্যক্ত করে বললেন, এটা আমার একটি ধারণা। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।- ইবনুল কাইয়িম, ই’লামুল মুয়াক্কিয়ীন ১/৩৯।

মুফতীর ভাতা গ্রহণ প্রসঙ্গ

মুফতীর জন্য উচিত হলো, বিনিময়হীনভাবে স্বেচ্ছায় ফতোয়া সেবা প্রদান করা। হ্যাঁ যদি মুফতী পারিবারিক প্রয়োজনে অন্য কোনো আয়ের উৎস গ্রহণ না করে নিরবচ্ছিন্নভাবে এ কাজে নিরত হয় তবে দুটি শর্ত সাপেক্ষে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ভাতা গ্রহণ করতে পারবে। (১) মুফতী অন্য কোনো আয়ের উৎস গ্রহণ করেনি। (২) রাষ্ট্রীয়ভাবে অন্য কোনো মুফতীকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

ফতোয়া প্রদান বিষয়ে সরকারপ্রধানদের দায়িত্ব ও ভূমিকা সম্পর্কে খতীবে বাগদাদী রা. বলেন, রাষ্ট্রপ্রধানের কর্তব্য হলো, যারা ফিকহের পাঠ দান ও ফতোয়া প্রদানে নিজেদেরকে নিরত রাখে তাদের জন্য এ পরিমাণ ভাতা নির্ধারণ করা যেন তারা জীবিকার চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে পারে। আর এটা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে প্রদান করবে।

আর যদি এলাকাটি এমন হয় যেখানে নিয়মতান্ত্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেই এবং কোষাগারও নেই অথবা রাষ্ট্রপ্রধানগণ মুফতীদের জন্য কোনো ভাতা নির্ধারণ করেনি ফলে জনসাধারণ মিলে মুফতীর জন্য ভাতা নির্ধারণ করে যাতে তারা ফতোয়ার ব্যাপারে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে পারে তাহলে এক্ষেত্রে তাদের জন্য ভাতা গ্রহণ করা বিধিত হবে।

ইবনে আবি গায়লান রা. বলেন, উমর ইবনে আব্দুল আজীজ রা. ইয়াজিদ বিন আবু মালেক এবং হারেস বিন ইয়সজুদকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে মানুষকে ফিকহ শিখানোর উদ্দেশ্যে পাঠালেন এবং তাদের জন্য ভাতা নির্ধারণ করলেন। তো ইয়াজিদ রা. ভাতা গ্রহণ করল। কিন্তু হারেস রা. ভাতা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালো। সুতরাং সে এ ব্যাপারে উমর বিন আব্দুল আজীজের কাছে পত্র পাঠাল। উমর ইবনে আব্দুল আজীজ প্রতি উত্তরে বললেন, ইয়াজিদ যে কাজটি করেছে তাতে আমি কোনো সমস্যা দেখি না। আল্লাহ আমাদের মাঝে হারেস বিন ইয়সজুদের মতো নিঃস্বার্থ লোক বৃদ্ধি করে দিন।- খতীবে বাগদাদী, আলফকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ ৩৯৮।

এরপর খতীবে বাগদাদী রা. উমর ইবনে আব্দুল আজীজ রা.-এর ঐ শাহী ফরমান বর্ণনা করেন যা তিনি হিমসের গভর্নরকে লিখেছিলেন। ‘যারা নিজেদেরকে ফিকহ ফতোয়ার সেবায় নিয়োজিত করে এবং জীবিকা উপার্জন পরিহার করে নিজেদেরকে মসজিদে (তৎকালীন সময়ের মাদ্রাসা ও দারুল ইফতা) তাদের প্রত্যেককে একশত দীনার করে প্রদান করুন। আমার পত্র পাওয়া মাত্রই এ আদেশ কার্যকর করবেন। সর্বোত্তম পুণ্যের কাজ তাই যা দ্রুত করা হয়।- প্রাগুক্ত ৩/১৯২।

মুফতী এবং প্রশাসনিক নিয়োগ প্রসঙ্গ

মুফতী এমন একটি মর্যাদাপূর্ণ পদবি যার জন্য প্রশাসনিক নিয়োগের প্রয়োজন নেই। কারণ ফতোয়া প্রদানের জন্য রাষ্ট্রীয় আইনি ক্ষমতার প্রয়োজন হয় না। বরং মুফতী সে আল্লাহ প্রদত্ত আইনি ক্ষমতা বলেই ফতোয়া প্রদান করে থাকেন। ফিকহ ফতোয়ার নীতিমালা, মুফতীর আচরণ বিধি সংক্রান্ত গ্রন্থাদিতে মুফতীর গুণাবলি ও শর্তসমূহ উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ফতোয়া প্রদানের জন্য মুফতীকে রাষ্ট্রের অনুমোদিত হতে হবে বলে কোথাও কোনো উদ্ধৃতি নেই। তবে ফতোয়া প্রদান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মাঝে ফতোয়ার দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা এবং ফিকহ ফতোয়ার যোগ্যমান স্বীকৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে তার এ যোগ্যতার স্বীকৃতি থাকতে হবে। উপরোক্ত যোগ্যতার অধিকারী ব্যক্তি ফতোয়া প্রদানের ক্ষেত্রে শরীয়তের পক্ষ থেকে শুধু অনুমতি প্রাপ্তই নন; আদিষ্টও বটে। এজন্য ফতোয়ার ব্যাপারে অন্য কারো অনুমতি বা অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। যেমন কুরআন শিক্ষা দান, তাফসীর বর্ণনা, হাদীস ও ফিকহ শিক্ষা দান, সীরাতুন্নবী আলোচনা, ওয়াজ নসীহত, আত্মশুদ্ধি, জীবন গঠন ও দীনী বিষয়ে রচনা ও সংকলনের জন্য সরকারের অনুমতি ও নিয়োগের প্রয়োজন হয় না।

ইসলামের প্রথম যুগ থেকে শুরু করে ইসলামী খেলাফত ও রাজ্য শাসনের শেষ সময় পর্যন্ত বিচারক ও হাকিমের নিয়োগ খলীফা বা তার অনুমোদিত সুলতানের পক্ষ থেকে হওয়া আবশ্যক ছিল। কারণ প্রশাসনিক নিয়োগ ব্যতীত কেউ এ দায়িত্ব পালন করতে পারত না। অন্য দিকে ফতোয়া প্রদানের দায়িত্ব ফকীহ ও মুফতীগণ নিজেরাই পালন করতেন। সাধারণ মানুষ তাদের শরণাপন্ন হতো আর তারা তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতেন। তবে এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা এই ছিল যে, কোথাও কোনো অযোগ্য লোক ফতোয়া দিলে স্বীকৃত ফকীহ ও মুফতীগণের পরামর্শক্রমে রাষ্ট্র তাকে এ কাজ থেকে নিবৃত্ত করত।

বিচারপতি ইমাম সাদউদ্দীন হারেসী বলেন, ফতোয়া দেওয়া একটি পুণ্যময় কাজ। এর জন্য সরকারি অনুমোদনের কোনো প্রয়োজন নেই। পূর্বসুরিদের কর্ম পন্থা এই ছিল যে, তারা ফতোয়া বিষয়ে সরকারি অনুমোদনের অপেক্ষা করতেন না।- ইবনে মুফলিহ, আল আদাবুশ শরঈয়া ৩/৩৯০

বাগদাদ ইউনিভার্সিটি ও সান‘আ ইউনিভার্সিটির শরীয়ত ও আইন এবং ফিকহে মুকারিনের অধ্যাপক ড. আব্দুল কারীম যায়দান রা. তার উসূলুদ দাওয়া গ্রন্থে ‘ফতোয়া প্রদানের অধিকার কার’ শিরোনামের অধীনে লেখেন, যে ব্যক্তি মুফতী হওয়ার যোগ্য কেবল সেই ফতোয়া দিতে পারেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে মুফতী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হোক বা না হোক। তিনি আরো বলেন, ফতোয়া প্রদানের অধিকার লাভের জন্য সরকারের অনুমোদন শর্ত নয়। কিন্তু ফতোয়া প্রদানকারী বাস্তবেই এ কাজের যোগ্য কি না তা নিশ্চিত হওয়া জরুরি।- আব্দুল কারীম যায়দান, উসূলুদ দাওয়াহ ১৬২

ফতোয়া প্রদানের ভিত্তি হলো যোগ্যতা; সরকারি নিয়োগ নয়। এজন্য কে ফতোয়া প্রদানের যোগ্য কে যোগ্য নয় তা নিরূপণের জন্য ফতোয়া সংশ্লিষ্ট গ্রন্থগুলোতে কিছু নিদর্শনাবলি উল্লেখ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে বিচারকের ক্ষেত্রে কে বিচারকের যোগ্য কে বিচারকের যোগ্য নয় তা নিরূপণের জন্য কোনো উপায় বা নিদর্শন বলা হয়নি। বরং স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, সরকারি নিয়োগ দান ছাড়া বিচারের কোনো বৈধতা নেই।

ফতোয়া প্রদান বিষয়ে সরকারপ্রধানদের দায়িত্ব ও ভূমিকা সম্পর্কে খতীবে বাগদাদী রা. বলেন, রাষ্ট্রপ্রধানের কর্তব্য হলো, যারা ফিকহের পাঠ দান ও ফতোয়া প্রদানে নিজেদেরকে নিরত রাখে তাদের জন্য এ পরিমাণ ভাতা নির্ধারণ করা, যেন তার জীবিকার চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে পারে। আর এটা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে প্রদান করবে।

এরপর খতীবে বাগদাদী রা. উমর ইবনে আব্দুল আজীজ রা.-এর ঐ শাহী ফরমান বর্ণনা করেন যা তিনি হিমসের গভর্নরকে লিখেছিলেন। ‘যারা নিজেদেরকে ফিকহ ফতোয়ার সেবায় নিয়োজিত করে এবং জীবিকা উপার্জন পরিহার করে নিজেদেরকে মসজিদে (তৎকালীন সময়ের মাদ্রাসা ও দারুল ইফতা) তাদের প্রত্যেককে একশত দীনার করে প্রদান করুন। আমার পত্র পাওয়া মাত্রই এ আদেশ কার্যকর করবেন। সর্বোত্তম পুণ্যের কাজ তাই যা দ্রুত করা হয়।- খতীবে বাগদাদী, আলফকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ ২/৩৭৪।

তো এই ফরমানের ভিতরে نصبوا انفسهم বাক্য এসেছে। যার অর্থ যারা নিজেদের নিয়োজিত করে। এখানে সরকারি নিয়োগ আবশ্যক নয়। যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তি সরকারি অনুমতি ছাড়াই ফিকহ ফতোয়ার কাজে নিয়োজিত হতে পারে।

মূলকথা ফতোয়া প্রদানের জন্য সরকারের নিয়োগ কিংবা অনুমতি শর্ত নয়। হ্যাঁ সরকারের সদিচ্ছা হলে জনসাধারণের চাহিদা অনুসারে অঞ্চল ভিত্তিক মুফতী নিয়োগ দিতে পারে।

এ প্রসঙ্গে ফিকহী বিশ্বকোষ আল মাউসু‘আতুল ফিকহিয়্যায় বলা হয়েছে, যদি প্রয়োজন দেখা দেয় এবং ফতোয়া সেবায় যদি কেউ স্বেচ্ছায় এগিয়ে না আসে তবে রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য কর্তব্য হলো, প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে মুফতী নিয়োগ দেওয়া। এবং এ ক্ষেত্রে একমাত্র যোগ্যমান ব্যক্তিকেই নিয়োগ দিবে। এবং এ কাজের জন্য যারা নিরত হবে রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তাদেরকে ভাতা প্রদান করা আবশ্যক। মুফতীর যোগ্যতা মনিটরিং করা সরকারের দায়িত্ব। কোনো অযোগ্য মুফতী এ কাজে প্রবৃত্ত হলে কিংবা কেউ ফতোয়ার অপব্যবহার করলে সরকার তাদেরকে এ থেকে নিবৃত্ত করবে।

খতীবে বাগদাদী রহ. বলেন, মুফতীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা সরকারের দায়িত্ব। যে ব্যক্তি ফতোয়ার যোগ্য হবে কেবল তাকেই মুফতী পদে নিয়োগ দিবে। আর যে ব্যক্তি এ পদের যোগ্য নয় তাকে এ পদে নিয়োগ দিবে না। সে পুনরায় যদি ফতোয়া প্রদানে প্রবৃত্ত হয় তবে তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি কার্যকর করবে। কে ফতোয়ার যোগ্য কে ফতোয়ার যোগ্য নয় এ ব্যাপারটি জানার জন্য রাষ্ট্রপ্রধান দেশের বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের সাথে সলাপরামর্শ করবে। এবং নির্ভরযোগ্য ও স্বীকৃত উলামায়ে কেরামের পরামর্শের ভিত্তিতেই ব্যাবস্থা গ্রহণ করবে।

ইবনুল কাইয়িম রহ. বলেন, যে ব্যক্তি ফতোয়ার যোগ্যতা অর্জন না করে ফতোয়ার আসনে সমাসীন হয়ে ফতোয়া প্রদান করে সে পাপিষ্ঠ এবং আল্লাহর অবাধ্য। আর যে রাষ্ট্রপ্রধান তাকে অনুমোদন দিবে সে ও গুনাহগার হবে।

ইবনুল জাওযী রহ. বলেন, অযোগ্য মুফতী এবং ফতোয়ার অপব্যবহারকারীদের নিবৃত্ত করা রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য আবশ্যক। অযোগ্য মুফতী তো ঐ ব্যক্তির মতো যে আরোহীদের পথ দেখায় অথচ সে নিজেই পথ চিনে না। অথবা ঐ অন্ধ ব্যক্তির মতো যে মানুষকে কেবলা দেখিয়ে দেয়। অযোগ্য মুফতীর ব্যাপারটি তো এর চেয়েও নিন্দনীয়। যে ডাক্তার রোগীদের ভালো চিকিৎসা দিতে জানে না তাকে নিবৃত্ত করা সরকারের দায়িত্ব। আর যে ব্যক্তি কুরআন, হাদীস না জেনে, ফিকহ ফতোয়া না শিখে ফতোয়া দানে প্রবৃত্ত হয় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব কী পরিমাণ তা বলাই বাহুল্য।- ই’লামুল ময়াক্কিয়ীন ৪/২১৭, আল মাউসুআতুল ফিকহিয়্যাহ ৩২/৪৬।

সারকথা ফতোয়া প্রদানের জন্য সরকারের অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। তবে জন চাহিদা সৃষ্টি হলে পর্যাপ্ত পরিমাণ মুফতী নিয়োগের ব্যাপারে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। তেমনিভাবে ফতোয়ার অপব্যবহার হলে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সরকারের দায়িত্ব।

ফতোয়াবাজী, ফতোয়াবাজ শব্দদ্বয়ের ব্যবহার প্রয়োগ

ফতোয়াবাজী শব্দটির মর্মার্থ বুঝতে হলে আমাদের একটু গভীরে যেতে হবে। ফতোয়া একটি আরবি শব্দ আর বাজী হলো ফার্সি শব্দ। এ দু’টি শব্দ মিলে একটি শব্দ গঠিত হয়েছে। যাকে বাংলা ব্যাকরণে দ্বিত্ব শব্দ বলে অভিহিত করা হয়। ফতোয়ার শাব্দিক অর্থ পিছনে আলোচিত হয়েছে। ফার্সী বাজী শব্দের অর্থ হলো ‘খেলা’। এর মূল ক্রিয়া হলো بازيدن (বাযিদান)। আর এর বর্তমান এবং ভবিষ্যত ক্রিয়ারূপ হলো بازد (বাযাদ) এবং এর আদেশক্রিয়া হলো باز (বায)। ফার্সী ভাষার এসব ক্রিয়া তৈরির আলাদা নীতিমালা সংশ্লিষ্ট ফার্সী ব্যকরণ গ্রন্থগুলোর মাঝে সুবিস্তর আলোচিত হয়েছে। ফতোয়াবাজী এর কর্তাবিশেষ্য হলো ফতোয়াবাজ। ফার্সি ব্যাকরণ মতে কোনো বিশেষ্যের সাথে যখন নির্দেশ ক্রিয়া যুক্ত হবে তখন সে দ্বিত্ব শব্দটি কর্তা বিশেষ্যের অর্থ দিবে। সে মতে ফতোয়াবাজের অর্থ হলো যে ব্যক্তি ফতোয়া নিয়ে খেলা করে বা ফতোয়া খেলোয়াড়। ফার্সি ব্যাকরণ অনুসারে যদি এ দ্বিত্ব শব্দটিকে আবার মূল ক্রিয়ায় আনা হয় তবে শব্দটির শেষে ي (ইয়া) বর্ণ যোগ করতে হবে। ফতোয়াবাজীর ক্ষেত্রে ফার্সি ব্যাকরণিক এ নীতিটিই প্রয়োগ হয়েছে। সুতরাং ফতোয়াবাজীর অর্থ হবে ফতোয়া নিয়ে খেলা করা। বাংলা ভাষায় বাজী বা বাজ যোগে অনেক শব্দ ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এর গঠনবিধি কিংবা ব্যবহারবিধি কিন্তু ফার্সি ব্যাকরণ থেকে ধার করা। এসব শব্দের ক্ষেত্রে যদি অন্য ভাষার ব্যাকরণকে অবহেলা করা হয় তবে বাংলা ভাষা বিজ্ঞানী কিংবা ব্যাকরণবিদরা এসব শব্দের গঠনপ্রকৃতি নিয়ে চরম হতাশায় ভুগবেন নতুবা ভুল ফর্মুলা দিয়ে বসবেন। যদিও সংসদ বাংলা অভিধানে বায শব্দটিকে দক্ষ, অভ্যস্ত, আসক্ত ইত্যাদি অর্থবাচক ফার্সি প্রত্যয় বিশেষ বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। মূলত এটা প্রত্যয় নয়; এটা একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ নির্দেশ ক্রিয়া। তো ব্যাকরণগতভাবে ফতোয়াবাজী শব্দ ব্যবহারে কোনো ক্ষতি নেই, ক্ষতিটা অন্যখানে। কারণ ফতোয়া ইসলামী আইনের একটি পবিত্র পরিভাষা। পবিত্র এ শব্দটির বিদ্রƒপ ব্যবহার কখনো কাম্য নয়। সব শব্দের মূল্যমান এক নয়। সব শব্দের সাথে সব ধরনের শব্দ যোগ করা যায় না। শব্দের ব্যবহারেও নীতি নৈতিকতা রয়েছে। বাজী, বাজ এই শব্দগুলো সাধারণত নীচাশয় ও নিন্দনীয় শব্দের সাথে সংযুক্ত হয়। যেমন ধোঁকাবাজ/বাজী, চাপাবাজ/বাজী, চিটিংবাজ/বাজী ইত্যাদি। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ফতোয়ার মতো পবিত্র শব্দটির সাথে বাজ অথবা বাজী শব্দ যোগ করে তার ব্যাপক ব্যবহার খুবই আপত্তিকর। কুরআনবাজী, নামাযবাজী, সংবিধানবাজী, একাত্তরবাজী প্রভৃতি মিশ্র শব্দগুলো যেমন ধর্মীয় ও আইনগত দিক থেকে আপত্তিকর তেমনি ফতোয়াবাজী শব্দটিও চরম আপত্তিকর।

ফতোয়া এবং আইনানুগ ব্যক্তির আইনানুগ মতামত

একটি সরল প্রশ্ন। ফতোয়া কি আইনানুগ ব্যক্তির আইনানুগ মতামত? এক্ষেত্রে যদি আমরা ইংলিশ কিংবা বাংলা বিশ্বকোষগুলো লক্ষ করি তাহলে একটি স্পষ্ট ধারণা চলে আসবে।

এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ব্রিটানিকায় মুফতী শব্দের অধীনে বলা হয়েছে, Mufti. Arabic MUFTI an Islamic legal authourity who gives a formal legal opinion (Fatwa) in answer to an inquiry by a private individual or judge (ই ৮/৩৯৪) অর্থ মুফতী হলো, আরবি (المفتى) মুফতী, ইসলামী আইনানুগ বিশেষ ব্যক্তি যিনি ব্যক্তিগত কিংবা বিচারিক বিষয়ের প্রশ্নের উত্তরে আইনানুগ মতামত ব্যক্ত করে থাকেন।

সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষে বলা হয়েছে, ফতোয়া; ধর্মীয় আইন বিশেষজ্ঞ অথবা মুফতী (Juriesconsult) কর্তৃক প্রদত্ত বা প্রকাশিত বিধানকে ফতোয়া বলা হয়। বিচারক বা ব্যক্তি বিশেষ কর্তৃক উপস্থাপিত প্রশ্নের উত্তর প্রদান ফতোয়ার উদ্দেশ্য। এই ফতোয়ার অনুসরণে বিচারক মোকদ্দমার বিচার করেন। এবং তার ব্যক্তিগত জীবন সুনিয়ন্ত্রিত করেন।- ২/১৭।

বাংলা পিডিয়ায় বলা হয়েছে, ফতোয়া আরবি শব্দ। ধর্মীয় আইন বিশেষজ্ঞ অথবা মুফতী কর্তৃক প্রদত্ত বা প্রকাশিত বিধান। এর উদ্দেশ্য একজন বিচারক বা একজন ব্যক্তি কর্তৃক উত্থাপিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দান।- ৭/৭৩

তো এনসাইক্লোপিডিয়ার মুফতীর ইংলিশ সংজ্ঞা থেকে ফতোয়ার সুস্পষ্ট সংজ্ঞা উৎসারিত হয়। আর তা হলো আইনানুগ ব্যক্তির আইনানুগ মতামত। তবে এই আইন মানব রচিত আইন নয়; আল্লাহ প্রদত্ত আইন।

ইসলামী বিশ্বকোষ ও বাংলাপিডিয়ায় ও ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির অভিমতকে ফতোয়া বলে অভিহিত করা হয়েছে। এখানে ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ বলা হলেও বস্তুত তিনি ইসলামী আইনানুগ ব্যক্তি। কারণ তিনি ইসলামী আইন মতে ফতোয়া দিতে বাধ্য। তেমনিভাবে ফতোয়ার মাত্রাগত ভিন্নতা বিবেচনায় ফতোয়া প্রার্থী ও তা প্রতিপালনে বাধ্য। কারণ ফরয, ওয়াজিব, সুন্নতের বাধ্যগত ভিন্নতার কারণে ফতোয়ার মাঝেও ব্যবধান ও ভিন্নতা সৃষ্টি হয়। কোনো কোনো ফতোয়ার ক্ষেত্রে অবহেলা ও শিথিলতার কারণে ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধান কঠিন কিংবা লঘু শাস্তি প্রয়োগ করেন। তবে যেসব ফতোয়া বিশেষত আল্লাহর অধিকার সংশ্লিষ্ট সেসব ব্যাপারে পার্থিব জীবনে নির্দিষ্ট কোনো দণ্ডাদেশ না থাকলেও পরকালে রয়েছে চরম জটিল দণ্ডাদেশ। সে দণ্ডাদেশ থেকে নিষ্কৃতির কোনো উপায় নেই। তবে এ ধরনের ফতোয়ার ক্ষেত্রে অবহেলার কারণে ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধান উপযুক্ত দণ্ডাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। ফল কথা ফতোয়া ইসলামী আইনানুগ ব্যক্তির আইনানুগ মতামত। মানব রচিত কিংবা দেশীয় আইনের সাথে এ আইনের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। কারণ ইসলামী আইন মানেই ফতোয়া। ইসলামী আইনের আলাদা কোনো সংজ্ঞা নেই। ইসলামী খেলাফত ব্যবস্থায় যারা বিচার কার্য পরিচালনা করতেন তারা সবাই ছিলেন মুফতী তথা ইসলামী আইনবিদ। দেশের বিজ্ঞ মুফতীরাই বিচারিক পদ অলংকৃত করতেন। কোথাও এর ব্যতিক্রম হলে বিচারক বিচার কার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে বিজ্ঞ মুফতীর ফতোয়া গ্রহণ করতেন এবং তদানুযায়ী রায় প্রদান করতেন।

ফতোয়ার পরিচয় দিতে গিয়ে মোহাম্মদ হাবীবুর রহমান বলেন, ফতোয়া ইসলামিক রাষ্ট্রের বিচারক ও আইন বিশারদের সুস্পষ্ট মতামতসমূহের এক প্রয়োগিক বহিঃপ্রকাশ।- ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স ও মুসলিম আইন ৫৯

অন্যদিকে মুসলিম সুলতানী আমলের আইন ব্যবস্থায় মুফতী ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রথম শ্রেণির আইন কর্মকর্তা।

মোহাম্মদ আব্দুল হালিম লিখিত বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থা গ্রন্থে বলা হয়েছে, …প্রধান বিচারপতির আদালতের সাথে যুক্ত আরও কতিপয় কর্মকর্তা হলেন নিম্নরূপ-

(ক) মুফতী (MUFTI) : প্রধান বিচারপতি তাকে নির্বাচিত করতেন এবং সুলতান নিয়োগ প্রদান করতেন। তিনি আইন বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করতেন। এবং বিচারক ও মুফতীর মাঝে মতদ্বৈতা দেখা দিলে সেক্ষেত্রে বিষয়টি সুলতানের কাছে চলে যেত। এবং সুলতান সিদ্ধান্ত দিতেন।- ৩০

ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ইসলামী আইন ও আইন বিজ্ঞান গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘আইন শব্দটি কেবল আইনজীবীগণ কর্তৃক ব্যবহৃত নয়; এটা জ্ঞানের অন্যান্য শাখায় ও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। যেমন, বৈজ্ঞানিকগণ মধ্যাকর্ষণের আইনের কথা বলেন, ধর্মতাত্ত্বিকগণ ওয়াহী ভিত্তিক আইনের কথা বলেন।’

অন্য দিকে ইসলামী আইনের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘ইসলাম হচ্ছে একমাত্র জীবন ব্যবস্থা যা মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনকে একই সূত্রে গেঁথে রেখেছে।

ইসলাম এক দিকে স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ককে সমুন্নত করে, অন্য দিকে সৃষ্টির সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক অটুট ও অব্যাহত রাখে। মানুষের এই দ্বিবিধ সম্পর্কের পরিগঠন ও পরিশীলনের জন্য ইসলামী শরীয়তে যে সকল নিয়মকানুন ও নীতিমালা বিবৃত হয়েছে তাই ইসলামী আইন।’

আরো বলা হয়েছে, ‘আরবি ফিকহ শব্দের প্রয়োগিক অর্থ আইন। কাজেই ইসলামী আইন হচ্ছে, মানব জাতিকে এ পৃথিবীতে সীরাতে মুস্তাকীমের পথে পরিচালিত করার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সুবিন্যস্ত বিধান।’- ২৩।

জামি‘আ রাহমানিয়া থেকে প্রকাশিত সুপ্রসিদ্ধ ফতোয়া গ্রন্থ ফাতাওয়ায়ে রাহমানিয়া এর ভূমিকায় আইন ও ফতোয়া সংক্রান্ত কয়েকটি উদ্যোগ শিরোনামে ফতোয়া ও ইসলামী আইনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নির্ভর আলোচনায় ফতোয়া ও ইসলামী আইনকে একীভূত করে দেখানো হয়েছে।- ১/১৩

সারকথা ফতোয়া এবং ইসলামী আইন ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কখনো ভিন্নতা পরিলক্ষিত হলেও দুটি মূলত একই জিনিস। বস্তুগত দিক থেকে এ দুটির মাঝে কোনো ভিন্নতা নেই। কারণ আইনের আভিধানিক অর্থ হলো, কানুন, নীতি, পদ্ধতি। ফতোয়া ও কুরআন, হাদীস, ইজমা, কিয়াস এই দলীল চতুষ্টয়ের আলোকে প্রণীত মানব নীতিমালা।

ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স গ্রন্থে মুসলিম আইন বিজ্ঞানের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্টি এবং মন প্রাণ আত্মা জীব জগৎ ও ইহ-পরকাল সম্পর্কে মুসলিম জাতির স্বকীয় সামগ্রিক ধারণা, হৃদয়ঙ্গম, উপলব্ধি, সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা এবং নিজস্ব চিন্তাধারা ও অভিমতের নামই মুসলিম আইন বিজ্ঞান।- ২৪।

ফতোয়া গ্রন্থ এবং ইসলামী আইন গ্রন্থ একই অর্থবোধক দুটি ভিন্ন শব্দ। মোহাম্মদ হাবীবুর রহমান বলেন, সপ্তদশ শতকে সম্রাট আলমগীরের পৃষ্ঠপোষকতায় ফাতাওয়ায়ে আলমগিরী এর সংকলন করা হয়েছে। এই বিখ্যাত গ্রন্থটি হানাফী মাজহাবের নীতি অনুসারে এই অঞ্চলের মুসলমানদের বিভিন্ন রীতির সাথে সংগতি রেখে সংকলিত হয়েছে। ফলে ইহা এ উপমহাদেশে ভবিষ্যৎ মুসলিম আইনের উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র সৃষ্টি করে। হেদায়া অপেক্ষা ফাতাওয়ায়ে আলমগিরীকে উপমহাদেশের বিভিন্ন বিচারালয় এবং প্রিভি কাউন্সিল মুসলিম আইনের অধিকতর গ্রহণযোগ্য উৎস বলে পরিগণিত করেছেন।- পূর্বোক্ত ২৪।

সুতরাং আমরা বলতে পারি ফতোয়া ইসলামী আইনানুগ ব্যক্তির আইনানুগ মতামত। বাধ্যগত বিষয়ের ফতোয়া হলে একজন মুসলিম সে ফতোয়া প্রতিপালনে বাধ্য। প্রতিপালনে অবহেলা হলে পরকালে দণ্ড অবধারিত।

যদি ধরে নেয়া হয়, ফতোয়া কোনো দেশীয় আইনানুগ ব্যক্তির আইনানুগ অভিমত তবে কি সে অভিমত ব্যক্ত করা যাবে না? এ অভিমত ব্যক্ত করতে কি রাষ্ট্রের অনুমতির প্রয়োজন? একজন মানুষ কি বলতে পারবে না এটা সংবিধান বিরোধী কাজ এটা করো না? এ কথাটুকু বলতে কি তার সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হবে? আইনের কথা বলা তো অপরাধ নয়। সরকারের অনুমতি ব্যতিরেকে আইন প্রয়োগ করা হলো অপরাধ। সরকার অননুমোদিত কেউ আইনানুগ বিচার করলেও সে অপরাধী। কারণ ফতোয়া কিংবা আইনানুগ বিচারের আধিকারিক একমাত্র সরকার অনুমোদিত ব্যক্তি। এছাড়া অন্য কারো এক্ষেত্রে অনধিকার চর্চার অধিকার নেই। তবে আইন ও ফতোয়ার কথা বলার জন্য প্রশাসনিক অনুমতির প্রয়োজন না হলেও আইন ও ফতোয়া সম্বন্ধে সম্যক যোগ্যতা থাকা অবশ্যই জরুরি। তবে সরকার অনুমোদিত ব্যক্তি যদি কাউকে আইনি পরামর্শ দেয় কিংবা আইনের কথা বলে তবে সে আইন মানতে সে বাধ্য নয়। পক্ষান্তরে এ আইনটা যদি বিচারকের আদালত থেকে রায় হয়ে আসে তখন সে এটাকে মানতে বাধ্য।

যদি ধরে নেয়া হয়, ফতোয়া রাষ্ট্রীয় আইনানুগ ব্যক্তির আইনানুগ মতামত। আর এর অর্থ হলো, রাষ্ট্রীয় অনুমোদন ছাড়া কেউ ফতোয়া ব্যবহার করতে পারবে না। তখন প্রশ্ন হবে সংবিধান কিংবা রাষ্ট্রীয় আইনের কোথাও কি উল্লেখ আছে ফতোয়ার কথা? ফতোয়া যে একটি বিশেষ ইসলামী পরিভাষা এটা তো স্বতঃসিদ্ধ। ফতোয়া ব্যবহারের জন্য ফিকহ ফতোয়ার শাস্ত্রীয় ব্যক্তি হওয়া আবশ্যক এটাও সর্বজনবিদিত। তো নির্বাহী বিভাগ কিংবা বিচার বিভাগে কি যোগ্যমান এমন মুফতী কর্মকর্তা আছেন? ফতোয়া সেবাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুমোদন দেওয়ার কি কোনো ব্যবস্থা আছে? ফতোয়া সেবা দেওয়ার জন্য কি আলাদা কোনো বিভাগ আছে? এসব যদি না থাকে তবে আইনানুগ ব্যক্তির আইনানুগ অভিমত বলে ফতোয়ার কার্যক্রম বন্ধ করার কি কোনো সুযোগ আছে? আগে বিষয়টার উপস্থিতি দেখাতে হবে। তারপর সংকোচন-বিয়োজন সীমিতকরণ ইত্যকার ব্যাপারাটির কথা। বাংলাদেশে প্রচলিত আইনে ফতোয়া সম্বন্ধে কোনো আলোচনাই নেই। তাহলে এটা বাংলাদেশের আইনানুগ ব্যক্তির আইনানুগ অভিমত হয় কি করে?

সুতরাং কারো জন্য আইনানুগ ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের আইনানুগ মতামত শিরোনামে ফতোয়ার সংজ্ঞা করে দেশের দারুল ইফতা কিংবা মুফতী মহোদয় কর্তৃক প্রদত্ত ফতোয়াকে বেআইনি সাব্যস্ত করার কোনোই সুযোগ নেই। কারণ মুফতী ফতোয়া প্রয়োগ করে না। তারা শুধু ফতোয়া প্রদান করেন। বাক স্বাধীনতার অন্তরালে যদি অশ্লীল অশ্রাব্য বক্তব্য ও অন্যের পবিত্র অনুভূতিকে আঘাত করা মন্তব্যকে আইনসিদ্ধ বলে চালিয়ে দেওয়া হয় তবে আমাদের এ ফতোয়া প্রদান হবে বাক স্বাধীনতার যথার্থ প্রয়োগ। এখানে কোনো অশ্লীল অশ্রাব্যতা নেই। নেই অন্যের অনুভূতিতে প্রত্যাঘাত জনিত কোনো অনুষঙ্গ।

হদ, তাযীর, কিসাস এবং ফতোয়া

অন্যায়, অপরাধ রোধকল্পে শরীয়ত বিভিন্ন শাস্তির বিধান রেখেছে। এগুলো মূলত তিন প্রকার।

১. ঐ সকল শাস্তি যার ধরন, পরিমাণ ও কার্যকর করার পদ্ধতি সব কিছুই শরীয়তে পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করেছে। যেমন ব্যভিচারের দণ্ড, মিথ্যা অপবাদের দণ্ড, চুরি ডাকাতির দণ্ড, ধর্মান্তরিত হওয়ার দণ্ড ইত্যাদি। এ প্রকারের দণ্ডবিধিকে শরীয়তের পরিভাষায় হদ বলা হয়। এর বহুবচন হুদুদ।

২. ব্যক্তির ক্ষত, অঙ্গহানী, কিংবা মৃত্যুর কারণে অপরাধীকে ও শাস্তি স্বরূপ ক্ষত সৃষ্টি, অঙ্গহানী, কিংবা হত্যা করার দণ্ডবিধি। শরীয়তের পরিভাষায় একে কিসাস বলা হয়।

৩. ঐ সকল শাস্তি যার ধরন ও পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি; বরং এটা দায়িত্বশীল বা কর্তৃপক্ষের উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন, বিনা কারণে অব্যাহতভাবে নামায না পড়ার শাস্তি, রমাযানের মর্যাদা বিনষ্ট করার শাস্তি, ঘুস খাওয়ার শাস্তি, দুর্নীতি ও পণ্যে ভেজাল দেওয়ার শাস্তি ইত্যাদি। আব্দুল কাদের আওদা, আততাশরীউল জিনায়ী ১/৬৩২-৬৩৪। তাযিরের আরেকটি প্রকার হলো তা’দীব। তা’দীব ঐ সামান্য শাস্তি যা অধীনস্তদের তরবিয়াতের জন্য পরিমিত মাত্রায় প্রয়োগ করার অনুমতি অভিভাবকদের দেওয়া হয়েছে। যেমন, পিতা সন্তানদের শাসন করেন।

তা’দীব পর্যায়ের সামান্য শাসনের অনুমতি তো অভিভাবকদের দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাযিরের প্রথমোক্ত প্রকার, হুদুদ এবং কিসাস কার্যকর করার অধিকার জনগণের নেই। এই শাস্তিগুলো কার্যকর করা সরকারের দায়িত্ব। অন্য কেউ যদি এ ধরনের শাস্তি কার্যকর করে তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হবে। মুফতী হুদুদ, তাযির, এবং কিসাসের ফতোয়া বর্ণনা করতে পারেন। কিন্তু তা কার্যকর করার অধিকার মুফতী, মুস্তাফতী কারো নেই। এটা সরকারের কাজ। এটা একটা স্বীকৃত বিধান। এ বিষয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। সুপ্রসিদ্ধ ইসলামী আইন গ্রন্থ আলহিদায়ায় পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, হদ কার্যকর করা ওলীর দায়িত্ব (ওলী অর্থ রাষ্ট্রপ্রধান বা তার নিয়োগকৃত প্রশাসনিক ব্যক্তি)। এমন কি কোনো মনীব তার কৃতদাসের উপরও রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতি ব্যতিরেকে হদ প্রয়োগ করতে পারবে না।- (২/৫১১) তাতে আরো বলা হয়েছে, হুদুদ কিসাস প্রয়োগ করার জন্য কাউকে সালিস বানানো বৈধ নয়।- (৩/১৪৬) এতে সুস্পষ্ট প্রতিয়মান হয় সালিসী দরবার হুদুদ বা কিসাস প্রয়োগ করার অধিকার রাখে না। অতএব যে ব্যক্তি মাদ্রাসার পাঠ্যভুক্ত কিতাবসমূহ পড়ার সুযোগ পেয়েছে সে আলেম হতে না পারলেও এ বিধানটি তার জানা থাকে। ফলে হুদুদ প্রয়োগকারী সালিসের সমর্থন দেওয়ার মতো ভুল তার হওয়ার কথা নয়। বিভিন্ন জায়গায় গ্রাম্য মাতব্বর কর্তৃক দোররা মারা কিংবা শাস্তি দেওয়ার যে দুঃখবহ ঘটনাগুলো আমাদের দেশে ঘটছে সে সম্পর্কে কোনো অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ ও সরকার দলীয় লোকদেরও জানা নেই সাধারণ মানুষের জন্য আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া অপরাধ। তদ্রƒপ হুদুদ কিসাস প্রয়োগ করা সালিশি দরবারের কাজ নয়; আদালতের কাজ। এ জন্য সরকারের উপর আবশ্যক হলো শিক্ষা মাধ্যম ও প্রচার মাধ্যম ব্যবহার করে সর্ব শ্রেণীর মানুষকে শরীয়তের এ বিধান সম্পর্কে অবগত করা। পাশাপাশি ব্রিটিশ ফৌজদারি আইন বিলুপ্ত করে শরীয়তের ফৌজদারি আইন প্রতিষ্ঠা করা। যাতে আল্লাহর নির্ধারিত শাস্তিসমূহ অকার্যকর না হয়ে যায়। কারণ আল্লাহর হুদুদ দণ্ডবিধি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার চেয়ে বড়ো দুর্ভাগ্য কোনো ভূখণ্ডের জন্য আর কিছুই হতে পারে না।

ফতোয়া এবং সালিশি ব্যবস্থা

সালিশ এটা বস্তুত আরবি ثالث (ছালিছ) শব্দের প্রতিরূপ। অর্থ তৃতীয় পক্ষ। সালিশি ব্যবস্থার আরবি নাম তাহকীম। ইংরেজি নাম Arbitration। তাহকীম হলো নিজেদের মধ্যকার বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে তৃতীয় কোনো পক্ষকে বিচারক নিয়োগ করা। একজন বিচারকের মাঝে যেসব শর্তের উপস্থিতি অপরিহার্য সেসব শর্তই সালিশের মাঝে থাকা আবশ্যক।- ড. আব্দুল কারীম যাইদান, নিযামুল কাযা ২৪৭-২৪৮। সালিশি দরবার কর্তৃক প্রদত্ত রায়ের সাথে ফতোয়ার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এমনকি সালিশি করার আধিকারিক কোনো ব্যক্তিকে যদি যথা নিয়মে সালিশ বানানো হয় এবং তিনি সঠিক পন্থায় সালিশি দায়িত্ব পালন করেন তবুও তার রায়কে ফতোয়া বলা যাবে না এবং এটাকে আইনতঃ বিচারও বলা যাবে না। বরং এটা হুকুম, ফয়সালার একটি প্রকার যা বিচারের মানে উত্তীর্ণ নয়। আর ইসলামী বিচার ব্যবস্থার একটি স্বতঃসিদ্ধ বিধান হলো, হুদুদ ও তাযিরের ক্ষেত্রে সালিশি দরবার চলে না। এর জন্য আদালত প্রয়োজন। কোনো সালিশ বা সালিশি দরবারের মাধ্যমে কাউকে দোররা মারা কিংবা অন্য কোনো শাস্তি প্রদানের অধিকার নেই। ইসলামী বিচার ব্যবস্থাপনা বিষয়ক গ্রন্থাদিতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, আল্লাহ প্রদত্ত দণ্ডবিধান হুদুদ, কিসাস, দিয়তের (রক্তপণ) ক্ষেত্রে সালিসী দরবার চলে না। কারণ সালিশ বা তৃতীয় পক্ষের কাজ হলো, বাদী বিবাদীর মাঝে আপোষ মীমাংসা করে দেওয়া। সুতরাং যেসব বিষয় আপোষ মীমাংসা উপযোগী শুধু সেসব বিষয়েই সালিশি দরবার চলে। আর হদ কিসাস আপোষ উপযোগী কোনো বিষয় নয়। সুতরাং এ বিষয়ে সালিশি দরবার চলবে না।- ড. আব্দুল কারীম যাইদান, নিযামুল কাযা ২৪৮। বুঝা গেল, সালিসী দরবারকে ফতোয়া বৈঠক বলা চরম অপরাধ। বস্তুত সাত্যিকারার্থে যদি ফতোয়ার উপর আমল করা হতো তাহলে কোনো সালিশি দরবারের মাধ্যমে কাউকে দোররা মারা হতো না এবং অন্য কোনো শাস্তি প্রয়োগ করা হতো না। আমাদের দেশে প্রচলিত আইনের সালিশ ব্যবস্থা সম্বন্ধে আলাদা নীতিমালা রয়েছে। Arbitration তথা সালিস ব্যবস্থা মূলতঃ Nonjudicial (বিচার বিভাগ বহির্ভূত) পদ্ধতিতে মীমাংসা কার্যক্রমের একটি প্রকার। বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির তিনটি ধাপ রয়েছে, (১) আলাপ-আলোচনা (Negotiation), (২) মধ্যস্থতা কার্যক্রম (Mediation or Conciliation), (৩) সালিশ ব্যবস্থা (Arbitration)। আর আধা বিচার ব্যবস্থা নামে একটি বিচার ব্যবস্থা রয়েছে। এর অধীনে বলা হয়েছে, আধা বিচার বিভাগীয় কার্যক্রমকে বিচার বিভাগীয় কার্যক্রমের পূর্ববর্তী ধাপে বা অধীনে রাখা হলে তা আইনের শাসনের বিরোধী নয়, কিন্তু একে বিরোধ মীমাংসার চূড়ান্ত পথ/মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করলে আইনের শাসনের বিরোধী হবে।- মো. আব্দুল হালিম, বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থা ১৬২-১৬৩। আধা বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থাকে বিরোধ মীমাংসার চূড়ান্ত মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করাকে যেখানে আইনের বিরোধী বলা হয়েছে সেখানে ননজুডিশিয়াল পদ্ধতিতে মীমাংসা কার্যক্রমকে মীমাংসার চূড়ান্ত মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা যে আইন বিরোধী তা বলাই বাহুল্য। সুতরাং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো সালিশি বা পঞ্চায়েতের শাস্তি কার্যকর করার অধিকার নেই। আজকাল সালিশি দরবারের মাধ্যমে শাস্তি কার্যকর করার শরীয়ত পরিপন্থি ও বেআইনি তৎপরতার যেসব ঘটনা ঘটছে তা মূলতঃ সালিশি বিচার ব্যবস্থার ভুল প্রয়োগ। ফতোয়ার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি একে ফতোয়ার ভুল ব্যবহার বলাও ঠিক হবে না। আজ পর্যন্ত কোনো দারুল ইফতা কিংবা কোনো মুফতীর ফতোয়ার ভিত্তিতে এমন কোনো অঘটন ঘটেনি। যা কিছু ঘটেছে সবই গ্রামের মূর্খ লোকদের মাধ্যমেই হচ্ছে। যাদের ফিকহ, ফতোয়া ও রাষ্ট্রীয় আইন সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। এসব ঘটনার সাথে ফতোয়ার মতো মর্যাদাপূর্ণ একটি পরিভাষাকে জড়ানো আদৌ উচিত নয়।

ফতোয়া এবং সংবিধান

ফতোয়া জিজ্ঞাসা এবং তা প্রদান করা একটি মানবাধিকার। কারণ ফতোয়ার মাধ্যমে ধর্মীয় নির্দেশনা জানা ও জানতে চাওয়া মানুষের একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার। ফতোয়া জিজ্ঞাসা এবং ফতোয়া প্রদানের অধিকার যে মানুষের একটি মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ অধিকার তা আমাদের সংবিধানের বিভিন্ন ধারায় স্বীকৃত। এখানে পঞ্চদশ সংশোধনী সংযুক্ত সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদ উল্লেখ করা হলো।

১. অনুচ্ছেদ-৪১ : ধর্মীয় স্বাধীনতা। -১) আইন, জন শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা সাপেক্ষে-

ক) প্রত্যেক নাগরিকের যে-কোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে;

খ) প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপসম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রহিয়াছে।

অ্যাডভোকেট এ. কে. এম. মিজানুর রহমান প্রমুখ সম্পাদিত মেট্রোপাবলিকেশন্স ঢাকা থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের সংবিধান [(পঞ্চদশ সংশোধন) আইন-২০১১সহ] পৃ: ২৯।

২. অনুচ্ছেদ-৩৯ : চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক স্বাধীনতা। -১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইলো।

২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জন শৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানী বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে-

ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার এবং

খ) সংবাদ পত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।-পূর্বোক্ত ২৮।

৩. অনুচ্ছেদ-[“২ক। রাষ্ট্রধর্ম। – প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।”]- পূর্বোক্ত ৪।

৪. অনুচ্ছেদ-৩২ : জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকার রক্ষণ। – আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হইতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।- পূর্বোক্ত ২২।

সুতরাং ফতোয়ার সাংবিধানিক আইনগত ভিত্তি হলো, (ক) মানবাধিকার, (খ) চিন্তার স্বাধীনতা, (গ) মত প্রকাশের স্বাধীনতা, (ঘ) বাক স্বাধীনতা, (ঙ) ধর্মীয় স্বাধীনতা, (চ) ধর্মচর্চার স্বাধীনতা, (ছ) সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, (জ) সংবিধানের প্রারম্ভে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম -এর সন্নিবেশন।

বাংলাদেশের সংবিধানের এমন কোনো ধারা উপধারা নেই যা ফতোয়া বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। সুতরাং ফতোয়ার উপর আইনি খড়গহস্ত সম্প্রসারণের কোনো সুযোগ নেই। এবং এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ হবে চরম সংবিধান বিরোধী কাজ যা আইনতঃ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অন্যদিকে ফতোয়া ছাড়া সাধারণ মুসলমানের ইসলামী শরীয়ত প্রতিপালনের কোনো উপায় নেই। কারণ ইসলাম ও শরীয়তের বিধিবিধান প্রচার-প্রসারের সর্বাধিক প্রয়োজনীয় এবং সর্বশ্রেণির জনগণের সহজ ও উপযুক্ত মাধ্যম হচ্ছে ফতোয়া। এ জন্য এটি মুসলমানদের সাংবিধানিক অধিকার। উপরন্তু একমাত্র ইসলামী শরীয়তই সকল আধিকারিককে তার অধিকার যথাযথভাবে প্রদান করেছে। ইসলামের মৌলিক শিক্ষাই হচ্ছে প্রত্যেক আধিকারিককে তার প্রাপ্য অধিকার প্রদান করো। এ জন্য সমাজে যদি ফতোয়ার সঠিক চর্চা ও প্রচলন হয় তাহলে নাগরিকদের মধ্যে অন্যের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি হবে। সুতরাং সরকার যদি মানবাধিকার রক্ষা এবং হকদারকে তার প্রাপ্য হক প্রদানের বিষয়ে উদ্যোগী হয় তাহলে সম্মানিত মুফতীদের ফতোয়ার ব্যপক প্রচার-প্রসারের পদক্ষেপ নেয়া উচিত। দেশের মিডিয়াগুলোকেও এ কাজে ব্যবহার করা কর্তব্য।

আদালতের কাঠগড়ায় ফতোয়া

২০০১ সনে একটি হিল্লা বিয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিচারপতি গোলাম রব্বানী সাহেবের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ সুয়োমোটো রুল জারি করেন। এবং এক পর্যায়ে এসে সব ধরনের ফতোয়াকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় প্রদান করেন। সাথে সাথে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ধর্মপ্রাণ জনগণ। মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত হয়ে উঠে বাংলার রাজপথ। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন বেশ কজন টগবগে যুবক। রব্বানী সাহেবের এ অনাকাঙ্খিত রায়ে কলঙ্কিত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিচারালয়। এক পর্যায়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন যুগসচেতন দুজন মেধাবী আলেম। দীর্ঘ এক দশক পর ২০১১ ইং এর মার্চ মাস থেকে আপিল বিভাগে মামলাটির পূর্ণাঙ্গ শুনানি শুরু হয়। এবং সে মাসের ১৯ তারিখে শুনানি শেষে সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষিত হয়। রায়ে বলা হয়, ধর্মীয় বিষয়ে ফতোয়া দেয়া যাবে। এবং শিক্ষিত লোকেরাই শুধু ফতোয়া দিতে পারবেন। এবং গ্রহণের বিষয়টি হতে হবে স্বতস্ফূর্ত। কারো উপর কোনো শাস্তি প্রয়োগ করা যাবে না।

জনাব গোলাম রব্বানী সাহেবের পক্ষ থেকে ইসলামের উপর এটিই একমাত্র আঘাত ছিল না। বরং হাইকোর্টে থাকাকালীন তিনি আরো একাধিক মামলায় কুরআন সুন্নাহ বিরোধী রায় দিয়েছিলেন। এমনি একটি মামলা ছিল তালাক পরবর্তী খোরপোষ বিষয়ে। সেটিও আপিল বিভাগে খারিজ হয়ে যায়। জনাব বিচারপতি সাহেব শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য তৎকালীন আপিল বিভাগ কর্তৃক তিরস্কৃত ও হয়েছিলেন। তখনকার বিচারপতি আফজাল সাহেব, বিচারপতি মোস্তফা কামাল সাহেব এবং তাদের সহযোগী বিচারপতি মহোদয়গণ সম্পূর্ণ ধর্মীয় ভাবগাম্ভির্য ও যথাযথ গুরুত্বের সাথে ঐ মামলার শুনানি করেছিলেন। এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শীর্ষ উলামায়ে কেরামের মতামত ও নিয়েছিলেন। সত্যাগ্রহী এসকল আইনজীবীগণ শত শ্রদ্ধা ও ভালবাসা নিয়ে অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন মুমিনের পবিত্র হৃদয়ে।

এক শ্রেণীর এন জি ও তখন রব্বানী সাহেবের কুরআন বিরোধী রায় বহাল রাখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। নিজেদের পক্ষে একাট্টা করেছিল বড়ো বড়ো উকিল ব্যারিষ্টারদের। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। প্রধান বিচারপতি এটি এম আফজাল নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ দৃঢ়তার সাথে ঐ কুরআন বিরোধী রায় খারিজ করে দেন। তখনকার সর্ব জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মরহুম ব্যারিষ্টার ইসতিয়াক আহমদ উকিল সাহেবদের পক্ষ থেকে আদালত কর্তৃক উলামায়ে কেরামের মতামত নেয়ার সমালোচনা করে বক্তব্য দিতে চাইলে তাকে কঠোর ভাষায় ধমক দিয়ে বসিয়ে দিয়েছিলেন তখনকার আপিল বিভাগ। এমন কি জনৈক ব্যারিষ্টার সাহেব কর্তৃক পবিত্র কুরআনের তরজমা পড়ে রেফারেন্স দেয়ার চেষ্টা করলে প্রধান বিচারপতি ঈমানদীপ্ত ভাষায় নির্দেশ দিয়েছিলেন, আপনাকে আল্লাহর কালাম আল্লাহর ভাষায় পড়তে হবে। এরপর তার মেয়ের সহায়তায় ইংরেজি হরফে লিখিত পবিত্র কুরআনের উচ্চারণ পড়তে গিয়ে ব্যারিস্টার সাহেব চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন।

যাহোক আপিল বিভাগে তার শরীয়ত বিরোধী সে রায় বাতিল হয়ে যাওয়ার পর ও থমকে যাননি বিচারপতি গোলাম রব্বানী সাহেব। ২০০১ এর শুরুতে এসে তিনি এক কথায় পুরো শরীয়তকেই নিষিদ্ধ করে দেন। রায় দেন সকল ফতোয়াকে অবৈধ বলে। অথচ কে না জানে ফতোয়া হচ্ছে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য একটি অপরিহার্য বিষয়। শরীয়তের ছোটো বড়ো সকল ক্ষেত্রের সাথে রয়েছে এর নিবিড় সম্পর্ক। অতএব ফতোয়া নিষিদ্ধ করা মানেই কাউকে কুরআন সুন্নাহ তথা ধর্মীয় বিধি বিধান জানানো থেকে বারণ করা এবং অনিবার্যভাবে ধর্মীয় বিষয়ে জিজ্ঞাসার পথকে রুদ্ধ করে দেয়া। তাহলে শরীয়ত থাকল কোথায়?

বস্তুত উচ্চ আদালত থেকে কোনো রায় প্রদান করা হয় যাতে নির্দেশিত ব্যক্তিবর্গ তা মেনে চলে এবং আদালতের উপর শ্রদ্ধাশীল থেকে এর বিপরীত কিছু না করে। কিন্তু ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় ঘোষণার পর থেকে তা খারিজ হওয়া পর্যন্ত দশটি বছরে ফতোয়া নিষিদ্ধের রায়ের উপর একজন ব্যক্তি ও কি আমল করেছে। একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ ও কি ঐ রায়ের ভয়ে সম্মানিত মুফতীর নিকট তার প্রয়োজনীয় ধর্মীয় বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা থেকে বিরত থেকেছে? কিংবা বিজ্ঞ মুফতী সাহেব কি রব্বানী সাহেবের রায় তোয়াক্কা করে মানুষকে ধর্মীয় জিজ্ঞাসার জবাব দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন? সম্ভবত কোনোটিই ঘটেনি। বরং কুরআন সুন্নাহ বিরোধী ঐ নির্দেশ লঙ্ঘিত হয়েছে লক্ষ লক্ষ বার। প্রকৃত অর্থে একজন ধর্মপ্রাণ মানুষের জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। কুরআন হাদীস তাকে বলে ধর্মীয় বিষয়ে জানা না থাকলে জ্ঞানীকে জিজ্ঞেস কর। আবার জ্ঞানীর প্রতি নির্দেশ হচ্ছে শরীয়তের কথা গোপন করা যাবে না। জিজ্ঞেসিত বিষয় বলে দিতে হবে। তাহলে মুফতী মহোদয় কি করবেন? তারা দেশের আদালতের কথা শুনবেন না ঐ আদালতসহ সকল আদালতের মহা বিচারক সৃষ্টি কর্তার নির্দেশ পালন করবেন।

মুসলমানদের দুর্ভাগ্য যে, বৃটিশরা তাদের রাজত্ব এখান থেকে গুটিয়ে নিলে ও তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং বিশেষ করে তাদের আইন ও বিচার ব্যবস্থা এখনো বহাল তবিয়তে এখানে বিদ্যমান রয়েছে। অন্যথায় ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় এধরনের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কোনো প্রয়োজন হয় না। বরং শরীয়তের বিচারে ধৃষ্টতাপূর্ণ এ রায় গোড়াতেই বাতিল ও অকার্যকর বলে বিবেচিত হয়। আলহিদায়াসহ ফিকহের বিশাল গ্রন্থগুলোর আদাবুলকাযী (বিচারপতিদের আচরণবিধি) অধ্যায়ে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ রয়েছে যে, কোনো বিচারক শরয়ী পরিপন্থী কোনো রায় প্রদান করলে তা আপনা আপনিই বাতিল বলে বিবেচিত হবে।

রব্বানী সাহেব তথাকথিত হিল্লা বিয়ের যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ রায় দিয়েছিলেন তা ও কোনো ফতোয়া ছিল না। সেটাকে ফতোয়ার সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না। বরং তা ছিল একটি গ্রাম্য সালিস বিচার। তার সাথে হয়তো জড়ানো হয়েছিল সামান্য পড়ুয়া পোষাকধারী কোন ব্যক্তিকে। স্পষ্ট কথা যে কোনো হাতুড়ে চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসাকে বিশেষজ্ঞের ব্যবস্থাপত্র বলে আখ্যা দিবেন না কোনো জ্ঞানী ব্যক্তি। রব্বানী সাহেব তার মনোবাসনাকে পরিপূর্ণতার রূপ দেয়ার জন্য প্রদত্ত রায়ে সংসদকে ফতোয়াদাতাদের বিরুদ্ধে শাস্তির আইন ও প্রণয়ন করতে বলেছিলেন। কিন্তু কোনো সংসদই রব্বানী সাহেবের সে কথা আমলে নেয়নি!

ফতোয়ার বৈধতা সংক্রান্ত আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত রায়ে পাঁচটি ধারা ছিল। প্রথমেই বলা হয়েছিল, আপিল আবেদনটি আংশিক গ্রহণ করার কথা। এরপর বলা হয়েছিল ধর্মীয় বিষয়ে ফতোয়া দেয়া যাবে। এবং তা প্রদান করতে পারবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আর তা গ্রহণ করা না করার বিষয়টি থাকতে হবে ঐচ্ছিক। এরপর চতুর্থ ধারায় বলা হয়েছিল, ফতোয়ার মাধ্যমে কাউকে শারীরিক বা মানষিক শাস্তি দেয়া যাবে না।

এ শর্তগুলো অবশ্য ফতোয়ার সংজ্ঞার মধ্যেই রয়েছে। ফতোয়া দাতাকে যে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যথাযথ শিক্ষিত হতে হবে সেটা তো অনিবার্য একটি শর্ত। কিন্তু বাস্তব সত্য হল, পার্থিব বিষয়গুলোতে আমরা এজাতীয় শর্ত মেনে চললেও শরীয়তের বিষয়ে অনেকেই তা বেমালুম ভুলে যাই। একজন যত বড়ো বিখ্যাত প্রকৌশলীই হোক না কেন তিনি কোনো ডাক্তারি ব্যবস্থাপত্র প্রদান করেন না। আবার একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কখনো প্রকৌশল বিষয়ে অন্যকে জ্ঞান দেয়ার চিন্তা করেন না। কিন্তু ধর্মীয় বিষয়াবলিতে আমরা অনেকেই বিশেয়জ্ঞ সেজে যাই। আমি একজন আইনজীবী, ধর্মীয় জ্ঞান আমার থাকুক বা না থাকুক এসম্পর্কে মত আমি দিবই। আমি একজন বুদ্ধিজীবী। সুতরাং ধর্মীয় বিষয়ে আমার পড়াশুনা না থাকলেও আমাকে মতামত দিতে হবে। মাদরাসায় সামান্য দু চার ক্লাস পড়েই আমি জটিল শরঈ বিষয়ে মতামত দেয়া শুরু করলাম। এধরনের মানষিকতা এসমাজের অনেকেরই রয়েছে। অথচ অন্যান্য ক্ষেত্রের মত শরীয়া বিষয়ে মতামত দেয়ার জন্য যে উচ্চাঙ্গের পড়া শোনা থকতে হয় তা আমরা স্মরণে রাখি না। একারণে দুধরনের ভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। এক দিকে ধর্মের নামে দেয়া যে কোনো ব্যক্তির বক্তব্যকে ফতোয়া আখ্যা দেয়া হয়। অন্য দিকে না জেনে ও ধর্মীয় বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়ার খেসারত গুণতে হয় দেশ ও জাতিকে।

ধর্ম প্রাণ মুসলমান আশা করেছিল, মাননীয় আদালত হয়ত ধর্মীয় নীতি ও অনুশাসন বিরোধী রায় দেয়ার ব্যাপারে একটি নিষেধাজ্ঞা প্রদান করবেন। এমনিভাবে যেখানে সেখানে ফতোয়া শব্দের অপ প্রয়োগের ব্যাপারে মিডিয়াসহ অন্যদেরকে সতর্ক করবেন। কারণ এ অপপ্রয়োগ ও অপপ্রচারের কারণেই মূলত ফতোয়ার বাস্তব সংজ্ঞা ও চিত্র অনেকের সামনে অস্পষ্ট থেকে যায়। বরং ফতোয়া নয় এমন বিষয়কে ফতোয়া আখ্যা দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়।

এছাড়া আরেকটি বিষয়ে সুপ্রম কোর্টের সংক্ষিপ্ত রায়ে কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। তা হল, হাইকোর্ট যে সুয়োমোটো বা স্বপ্রণোদিত রুল জারি করেছে তা এ পর্যায়ে আইনসিদ্ধ ছিল কি না। কারণ অনেক আইনজীবীই এমন কি কোনো কোনো এমিকাস কিউরি ও বলেছেন যে, এক্ষেত্রে সুয়োমোটর কোনো সুযোগ নেই। যদি তাই হয় তাহলে তো মামলাটি গোড়া থেকেই অবৈধ ছিল।

আপিল বিভাগ রায়ের শেষে বলেছে, হাইকোর্ট যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফতোয়াকে অবৈধ বলেছিলেন সেটি অবৈধ ফতোয়া ছিল। এব্যাপারে প্রথম কথা হল, গ্রাম্য সালিসের সে রায়টি ফতোয়াই নয়। সুতরাং সেটিকে বৈধ বা অবৈধ ফতোয়া বলার সুযোগ ইসলামী আইনে নেই। দ্বিতীয়ত অবৈধ ফতোয়া বলতে কি বুঝাতে চেয়েছে আপিল বিভাগ। যদি উদ্দেশ্য হয় ফতোয়া নামে সালিসী দরবার হতে যে মতামতটি উঠে এসেছিল, যে তিন তালাক পরবর্তী সময়ে অন্যত্র বিবাহ বন্ধন ব্যতীত পূর্বের স্বামীর সাথে ঘর করা বৈধ নয় ইসলামী আইনের এ উক্তিটিই অবৈধ তবে আমরা আপিল বিভাগের সাথে প্রচ-ভাবে দ্বিমত পোষণ করি। কারণ কোনো বিষয়ে অনধিকার চর্চা হলে সে বিষয়টি অবৈধ বা নিষিদ্ধ হয়ে যায় না। এখানে ঘটনা যেটা ঘটেছে সেটা হল, একজন নন মুফতী আলেম ফতোয়া প্রদানে অনধিকার চর্চা করেছেন (যদি তিনি আলেম হয়ে থাকেন এবং ফতোয়া দিয়ে থাকেন)। তবে এখানে স্মৃতব্য, কোনো নির্ভরযোগ্য মুফতী সূত্রে ফতোয়া বলা আর ফতোয়া প্রদান করা এক কথা নয়। মাওলানা উপাধি গ্রহণকারী আজিজুল হক নামের লোকটি মূলত কোন কাজটি করেছিলেন তা আমাদের গোচরে নেই। যদি তিনি মুফতী না হয়ে ফতোয়া প্রদান করে থাকেন তবে তিনি ফতোয়ার ভুল ব্যবহার করেছিলেন। আর যদি কারো সূত্রে নিছক মাসআলা বলে থাকেন তবে তিনি দোষের কিছুই করেননি। কারণ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিজ্ঞ ব্যক্তি সূত্রে যে কারো জন্য ফতোয়া কিংবা আইন বলা দোষের কিছু নয়। দোষ এবং অন্যায় হল, প্রয়োগের দণ্ড হাতে তুলে নেয়া। আর যদি হাইকোর্টের উদ্দেশ্য হয় ফতোয়ার প্রয়োগ এবং ব্যবহার অবৈধ তবে হাইকোর্টের সাথে সমত পোষণ করতে আমাদের কোনো দ্বিধা নেই।

অনেকে ফতোয়াকে বিচারিক রায় বলে তার উপর আইনি খড়গ চালাতে চান। মূলত ফতোয়া কোনো বিচারিক রায় নয়। এতদ সত্ত্বে যদি ধরে নেয়া হয় ফতোয়াএকটি বিচারিক রায় তবুও এর উপর আইনি খড়গ চালানোর কোনো সুযোগ নেই। কারণ বিচারের বহু প্রকার রয়েছে। আদালতে যেটা পরিচালিত হয় সেটাও বিচার। গ্রাম্য সালিসে যেটা চলে সেটাও বিচার। দুটি বিচারই স্ব স্ব স্থানে যথাযথ। প্রশাসনেরপক্ষ থেকে সালিসী বিচারব্যবস্থার উপর কোনোরকম নিষেধাজ্ঞা আরোপকরা হয়নি। সুতরাং এটা বেআইনী কোনো বিচার ব্যবস্থা নয়। বরং এটা আবহমান কাল ধরে চলে আসা গ্রাম বাংলার চিরাচরিত বিচার ব্যবস্থা। এদৃষ্টি কোণ থেকে ফতোয়াকে যদি কেউ গায়ের জোরে বিচারিক রায় বলেন তবুও ফতোয়াকে আক্রান্ত করা যাবে না। কারণ বিচারিক রায় এক কথা আর এর প্রয়োগ আরেক কথা। বিচারিক রায় হয়ে গেলে যে কেউ সে রায় প্রয়োগ করতে পারে না। প্রয়োগের জন্য আইনি ব্যক্তি হওয়া আবশ্যক। এ প্রয়োগটাই মূল প্রসঙ্গ। বিচার করা মানে সাক্ষী সবুদ সাপেক্ষে আইনী অভিমত প্রকাশ করা। এই অভিমতের ভিত্তিতে প্রশাসন দণ্ড প্রয়োগ করবে। তো বিচারিক রায় দোষের নয়; বরং অন্যায় প্রয়োগটাই দোষের।

জনৈক প্রধান বিচারপতি (যিনি ফতোয়া মামলার বেঞ্চের প্রধান ছিলেন) হাইকোর্ট প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘আমাদেরকে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শে আদর্শবান হতে হবে। কারণ রোজ হাশরে তিনি হবেন প্রধান উকিল ও ব্যারিষ্টার। তিনি আমাদের পক্ষে সকল বিচারপতির প্রধান বিচারপতি আল্লাহ তা‘আলার দরবারে ওকালতি করবেন। যদি আমরা তার তরীকার অনুসরণ না করি তাহলে তিনি কিভাবে আমাদের পক্ষে ওকালতি করবেন। ”

বিচারপতি তার পেশাগত জীবনে এই আদর্শ ধারণ করেছেন কি না সে প্রশ্নের জবাব দিবে ইতিহাস। তবে তার এ চির সত্য বক্তব্যটি যদি মাননীয় বিচারপতি ও সম্মানিত আইনজীবীগণ ধারণ করেন তাহলে আমাদের আদালত পাড়ার মর্যাদা যে অনেক উঁচু মার্গে উন্নীত হবে এবং পিছিয়ে পড়া দেশ ও জাতি এগিয়ে যেতে পারবে তাতে সন্দেহ করার কোনো সুযোগ নেই।

পরিশেষে আমরা আপিল বিভাগের মাননীয় বিচারপতিদেরকে ফতোয়া বৈধ বলে রায় দেয়ার জন্য মোবারকবাদ জানাই। যদিও মুসলমানদের কাছে ফতোয়ার গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও অপরিহার্যতা প্রমাণের জন্য কোনো রায়ের প্রয়োজন হয় না। তথাপি মাননীয় আদালত এক দশকের বেশি সময় ধরে জাতির ঘাড়ে ঝুলে থাকা একটি ভুল রায়ের বোঝা অপসারণ করেছেন।

আপিল বিভাগের এ রায় সতর্ক বার্তা হোক সকলের জন্য এবং ভবিষ্যতে কোনো ব্যক্তি ইসলাম বিরোধী কোনো রায় দেয়ার দুঃসাহস না দেখাক। এটাই পরম করুণাময় আল্লাহর দরবারে আমাদের প্রার্থনা। আল্লাহ আমাদের সকলকে সুমতি দান করুন। আমীন!

ফতোয়া প্রদান বিষয়ে সরকারের দায়িত্ব

সরকারপ্রধান একটি দেশের কোটি মানুষের প্রতিনিধি। সে হিসেবে তার দায়িত্বের শেষ নেই। এ দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালনে সে স্রষ্টা এবং সৃষ্টি উভয়ের কাছে সমানভাবে দায়বদ্ধ। এ দায়িত্ব পালনে হেরফের হলে পরকালীন কাঠগড়ায় তো দাঁড়াতেই হবে। উপরন্তু ক্ষেত্র বিশেষে জনগণের কাঠগড়া থেকেও সে মুক্তি পায় না। সরকারি দায়িত্বাবলির মধ্য হতে অন্যতম দায়িত্ব হলো, প্রতিটি মানুষকে ধর্মীয় ও নৈতিক অনুশাসনে অভ্যস্ত করে তোলা। এতে করে মানুষের মাঝে নীতি নৈতিকতা ও রক্ষণশীলতার বিকাশ ঘটবে। ফলে দেশ থেকে যাবতীয় অন্যায় অনাচার বিদূরিত হবে। দেশ পরিণত হবে সুখী সমৃদ্ধ এক আদর্শবান দেশে। এ জন্য সরকারের কর্তব্য হলো,

১. প্রচার মাধ্যম ব্যবহার করে মানুষের মাঝে ফতোয়ার গুরুত্ব ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করা এবং তাদের অন্তরে মুফতীর প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থা তৈরি করা।

২. ফতোয়া বিভাগ ও ফতোয়া অনুশীলনে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সংশ্লিষ্ট গ্রন্থাদি ও প্রয়োজনীয় উপকরণের ব্যবস্থা করা।

৩. ফতোয়া সেবার পথকে মসৃণ ও অবারিত করা এবং এ ব্যাপারে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ না করা।

৪. বিজ্ঞ মুফতীদের জন্য মুসলমানের রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করা।

৫. কোনো অযোগ্য ব্যক্তি ফতোয়া দিলে দেশের স্বীকৃত বিজ্ঞ মুফতীদের পরামর্শক্রমে তাকে এ অনধিকার চর্চা থেকে নিবৃত্ত করা।

৬. ফতোয়া বিষয়ে নেতিবাচক যাবতীয় কার্যকলাপ ও প্রপাগান্ডা বন্ধ করা।

৭. দীন ও শরীয়ত বিষয়ে নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষা গ্রহণ করা ছাড়া শুধু অনুবাদ পড়ে এবং সিডি-ভিসিডি দেখে দীনি বিষয়ে মত প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা।

৮. ফতোয়ার মতো মর্যাদাপূর্ণ পবিত্র পরিভাষা সম্পর্কে ফতোয়াবাজ, ফতোয়ার শিকার জাতীয় অবমাননাকর শব্দ ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা।

তথ্যসূত্র :

১. আল কুরআনুল কারীম

২. কুতুবে সিত্তা (হাদীস গ্রন্থ ষষ্ঠক) সহ অন্যান্য হাদীস গ্রন্থ

৩. ইবনুল কাইয়িম আল জাওযী, ই‘লামুল মুয়াক্কিয়ীন

৪. খতীবে বাগদাদী, আল ফকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ

৫. ইবনে আবিদীন, রদ্দুল মুহতার

৬. ফরিদুদ্দীন দেহলভী, ফাতাওয়া তাতারখানিয়া

৭. আলমাউসুআতুল ফিকহিয়্যা

৮. ইমাম নববী, আলমাজমু

৯. জালালুদ্দীন মাহাল্লী, শরহু মিনহাজিত ত্বালিবীন

১০. ইমাম বাইহাকী, আলমাদখাল

১১. আল্লামা আজুররী, আখলাকুল উলামা

১২. আল্লামা শাতিবী, আল মুয়াফাকাত

১৩. আল্লামা কারাফী, আল ফুরুক, আল ইহকাম

১৪. ইবনে মুফলিহ, আল আদাবুশ শরঈয়া

১৫. আবদুল কারীম যায়দান, উসলুদ দাওয়াহ

১৬. ইমাম মারগিনানী, আল হিদায়া

১৭. আব্দুল কাদির আওদা, আততাশরীউল জিনায়ী

১৮. আল্লামা তাকি উসমানী, উসূলুল ইফতা ওয়া আদাবুহু

১৯. আব্দুল কারীম যায়দান, নিযামুল কাযা

২০. ইবনে ইমাদ, আল মুহিত ফিললুগাহ

২১. ইবনে মানযুর আফরিকী, লিসানুল আরব

২২. আহমদ আল ফাইউমী, আলমিসবাহুল মুনীর

২৩. মুরতাযা যাবিদী, তাজুল আরুস

২৪. আল্লামা মুতাররিযী, আল মুগরিব

২৫. আল্লামা মুনাবি, আত্তাওফীক

২৬. মাজদুদ্দীন ফাইরুযাবাদী, আলকামুসূল মুহীত

২৭. আল্লামা কাল‘আজী, মু’জামু লুগাতিল ফুকাহা

২৮. আল মুনজিদ ফিল লুগাহ

২৯. আল মু’জামুল ওয়াসীত

৩০. এনসাইক্লোপিডিয়া অব বৃটানিকা

৩১. সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ

৩২. বাংলাপিডিয়া

৩৩. ফাতাওয়ায়ে রাহমানিয়া

৩৪. মোহাম্মদ আব্দুল হালীম, বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থা

৩৫. ইসলামী আইন ও আইনবিজ্ঞান

৩৬. মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স

৩৭. এ কে এম মিজানুর রহমান, বাংলাদেশের সংবিধান

৩৮. ইন্টারনেট

৩৯. আলমাকতাবাতুশ শামিলা

৪০. গবেষণা-পত্রিকা মাসিক আল কাউসার, মার্চ ২০১১

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *