মাওলানা বিশারাতুল্লাহ
আল-হামদুলিল্লাহ, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে লাখ-কোটি শুকরিয়া যে মহান রব্বুলআলামীন আমাদেরকে ইসলমের মত একটি মুকাম্মাল দীনের উপর উম্মতে মুহাম্মদী করে প্রেরণ করেছেন। বিশ্ব মানবতার উৎকর্ষ সাধন, ইহকাল ও পরকালের প্রকৃত শান্তি, নিরাপত্তা এবং সফলতা অর্জন-এর একমাত্র পথ হচ্ছে ইসলাম। আল্লাহ এবং তাঁররাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি সঠিক ঈমান স্থাপন করা এবং পরিপূর্ণআনুগত্য প্রকাশের কোন বিকল্প নেই। সুতরাং এই মুহূর্তেইসলামী জীবন বিধান এবং ইসলামী হুকুম আহকামের ব্যাপক এবং নিখুঁত প্রচার প্রসারের বিশেষপ্রয়োজন। প্রয়োজন সম-সাময়িক আধুনিক যুগ জিজ্ঞাসার গবেষনামূলকসঠিক উত্তর এবং জ্ঞান চর্চার। একথা সর্বজন স্বীকৃতযে, ব্যাপক প্রচার প্রসারেরক্ষেত্রে বর্তমান প্রযুক্তির ব্যবহার একটি অপরিহার্য্য বিষয় । ইরশাদ হচ্ছে,
ادْعُ إِلَى سَبِيلِرَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ
‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের প্রতি আহ্বান কর হিকমাত ও সদুপোদেশ দ্বারা এবং তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে বির্তক কর’ -সুরা নাহল-১২৫।
বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে হাতের মুঠোয় চলে এসেছে বিশ্ব। মিডিয়ার ফলেই মূলত এটি সম্ভব হচ্ছে। আধুনিক সভ্যতা বিকাশের ক্ষেত্রে মিডিয়ার ভূমিকা অত্যধিক। মিডিয়া দুই ধরনের ক. প্রিন্ট মিডিয়া খ ইলেকট্রিনিক মিডিয়া। তবে দ্রুত তথ্যের আদান-প্রদান এবং দৃশ্যসম্বলিত হওয়ায় ইলেক্ট্রানিক মিডিয়ার প্রভাব একটু বেশি। আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সর্বাধুনিক ও সর্বাধিক ক্রিয়াশীল বিস্ময়কর আবিষ্কার হচ্ছে ইন্টারনেট। এর দ্বারা দুনিয়ার যে কোনো প্রান্তের কম্পিউটার ব্যবহারকারীর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করা যায়। প্রযুক্তির উপহার ইন্টারনেট হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কম্পিউটার নেটওর্য়াক। এক জরিপে দেখা গেছে সব মিলিয়ে ষাট হাজার নেটওয়ার্ক এবং দশ মিলিয়ন কম্পিউটার ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত আছে। ১৪০ টি দেশের প্রায় ৬০ মিলিয়ন মানুষ এর আওতাভুক্ত। ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বের সব মানুষ এ আওতায় এসে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সামরিক কারণে ইন্টারনেটের আবিষ্কার হলেও বর্তমানে শিক্ষা, চিকিৎসা, যোগাযোগ, তথ্যপ্রবাহ, গবেষণা ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে এই প্রযুক্তি। এগুলো ছাড়াও নিজস্ব চিন্তাধারা, মতবাদ, কৃষ্টি, কালচারকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যম হিসাবেও ইন্টারনেট কাজ করে যাচ্ছে। ইসলামী বিশ্বে তুলনা মূলক ভাবে কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের ব্যবহার হয় না বললেই চলে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে ইসলামের গতিশীল ব্যাখ্যা ও প্রকৃত সত্য তুলে ধরা সময়ের দাবি। বর্তমানে দাওয়াতী কাজের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির এই সফল আবিষ্কার ইন্টানেট হতে পারে বড় একটি মাধ্যম। আমাদেরকে স্থান কাল পাত্র অনুযায়ী যুগের আবস্থার উপর ভিত্তি করেই কাজ করে যেতে হবে। কলমের মোকাবিলায় যেমন কলমের ব্যাবহারই প্রযোজ্য, ঠিক তদ্রƒপ প্রযুক্তির মোকাবেলয় প্রযুক্তির ব্যবহারই যুক্তি সংজ্ঞত। কারণ সিংহের মোকাবেলায় বকরী যেমনটি অযোগ্য বা হাস্যকর, যে কিনা জয় বয়ে আনবে তো দূরে থাক নিজের অস্তিতকেই হারিয়ে ফেলবে। অনুরূপ ভাবে বর্তমান যুগ সন্ধিক্ষণে বস্তু প্রসারতার চরম উন্নতি লগ্নে ইসলামের দাওয়াতের ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো যুগচাহিদার প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় ও কার্য্যকর পদ্ধতি গ্রহণ করা। যেটা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার ও বিধান বটে, ইরশাদ হচ্ছে,
ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ
‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের প্রতিআহ্বান কর হিকমাত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে বির্তক কর’ -সুরা নাহল-১২৫।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়া সৃষ্টির লগ্ন থেকে অদ্যবধি যত নবী রাসূলকে প্রেরণ করে ছিলেন তাঁদের সকলকেই তৎকালীন সময়ের সমূহু জ্ঞান দিয়েই প্রেরণ করে ছিলেন যা কুরআনে করীমে স্পষ্টভাবে বর্ণিত রয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এখানে অর্থাৎ আলোচ্য সুরা নাহলের আয়াতে কারীমায় ইসলামের দাওয়াতকে কোনো নিদিষ্ট বিষয়ে সীমাবদ্ধ না রেখে ব্যাপক রাখা হয়েছে। এতে দাওয়াতের সব মাধ্যম ও উপকরণ অন্তর্ভুক্ত। আমরা লক্ষ করলে দেখতে পাই যে বর্তমান বিশ্বে মানুষের মধ্যে ইসলামের ব্যাপারে কৌতূহল বাড়ছে। ইসলামকে জানতে ও বুঝতে সবাই উদগ্রীব। বিশেষত দেশে দেশে অমুসলিম যুব শ্রেণী অগ্রহী হচ্ছে ইসলামের অমীয় সৌন্দর্য্যরে প্রতি। কিন্ত তাদের কাছে সত্যের পয়গাম না পৌঁছার কারণে তারা এতে সাড়া দিতে পারছে না। এসব লোকের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার সুবর্ণ সুযোগ হচ্ছে প্রযুক্তির ব্যাবহার। এর মধ্যে সবচেয়ে ক্রিয়াশীল নিভুল ভাবে দ্রুততম ও বিস্বস্ত মাধ্যম হল প্রযুক্তির উপহার ইন্টারনেট। এ প্রযুক্তি পুরো দখল এখন পশ্চিমাদের হাতে। তারা এ মিডিয়াকে ব্যবহার করে ধর্ম প্রচারের সবচেয়ে উপযুক্ত মাধ্যম হিসাবে গুরুত্ব দিচ্ছে। নিম্নে আমি একটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন তুলে ধরছি। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারী ১০ তারিখে দৈনিক ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, সেটি এখানে হুবহু তুলে ধরছি। ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট যে সব ধর্ম যাজক তাদের বাণী বিশ্ব ব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার জন্য নানা ভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তাদের জন্য নতুন নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি ধর্ম যাজকদের ওয়েব সাইটে নিজস্ব ব্লগ খোলার নির্দেশ দিয়েছেন। পোপ গত শনিবার ধর্মীয় বাণী প্রচারের জন্য এবং অন্য ধর্ম ও সংস্কৃতির লোকজনের সঙ্গে কথা বলার জন্য সম্ভব হলে সব মাল্টিডিয়া টুল ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। পোপ বেনেডিক্ট এক বার্তায় বলেন, শুধুই মেইল ব্যবহার বা ওয়েব সার্চ করাই যথেষ্ট নয়, নিজেদের প্রকাশ করা এবং নিজ নিজ সম্প্রদায়কে নের্তৃত্ব দেয়ার জন্য ধর্ম যাজকদের সব ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা উচিৎ। ভ্যাটিকান থেকে প্রকাশিত বার্তায় ৮২ বছর বয়সী পোপ আরও বলেন, তরুণ ধর্ম যাজকদের নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে বেশি করে পরিচিত হওয়া উচিৎ। তিনি বিনোদন গনমাধ্যম গুলোর যৌনতা ও সহিংসতাকে উস্কে দেওয়ার প্রবনতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তবে যোগাযোগ এর ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ভূয়সী প্রশংসা করেন পোপ। তিনি বলেন প্রযুক্তি মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় উপহার”।
খ্রিস্টান ধর্মগুরুরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে সারা বিশ্বে খ্রিস্টবাদ প্রচারে সচেষ্ট হলেও দীনে হকের ধারক-বাহক উলামা সমাজ এ ব্যপারে চরম উদাসীন। সাহাবায়ে কেরাম যুগের সমরাস্ত্র এবং তার ব্যবহার সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন না। তারা তরবারির বিরুদ্ধে তরবারি হাতেই সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতেন এবং তরবারির নিপুণ ব্যবহারে শত্রুকে ধরাশায়ী করে ফেলতেন। সুতরাং বর্তমন সাহাবায়ে কেরামের উত্তরসূরী দাবিদারদের এগিয়ে আসতে হবে। যুগের হাতিয়ার প্রযুক্তির সফলতম ব্যবহার শিখে ময়দানে অবতীর্ণ হতে হবে। রপ্ত করতে হবে প্রযুক্তি ব্যবারের কল-কৌশল। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ وَآَخَرِينَ مِنْ دُونِهِمْ لا تَعْلَمُونَهُمُ اللَّهُ يَعْلَمُهُمْ وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فِي سَبِيلِ اللَّهِ يُوَفَّ إِلَيْكُمْ وَأَنْتُمْ لا تُظْلَمُونَ
অর্থাৎ আর প্রস্তুত কর তাদের সাথে যুদ্ধের জন্য যাই কিছু সংগ্রহ করতে পার নিজের শক্তি সামর্থ্যরে মধ্যে থেকে এবং পালিত ঘোড়া থেকে, যেন প্রভাব পড়ে আল্লাহর শত্রুদের উপর এবং তোমাদের শত্রুদের উপর আর তাদেরকে ছাড়া অন্যান্যদের উপর ও যাদেরকে তোমরা জান না; আল্লাহ্ তাদেরকে চেনেন। বস্তুত যা কিছু তোমরা ব্যয় করবে আল্লাহর রাহে, তা তোমরা পরিপূর্ণভাবে ফিরে পাবে এবং তোমাদের কোন হক অপূর্ণ থাকবে না”।
সুতরাং প্রযুক্তির মোকাবেলায় প্রযুক্তিই যথাযথ। দীনে ইলাহীর মোকাবেলা করতে যারা যে ভাবেই অবির্ভাব হবে তাদেরকে সেই ভাবে প্রতি হত করাই উত্তম পন্থ। বলা হচ্ছে ‘ যাই কিছু সংগ্রহ করতে পার নিজের শক্তি সামর্থ্যরে মধ্যে’ সুতরাং যখন মানুষ ক্লিক এর মাধ্যমে সব সমাধান পেতে অভ্যস্থ। তাই এখন অতি সহজে ঘরে বসে বিশ্বের মানুষের কাছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে তুলে ধরা যায় শ্বাশত দীনের আহবান। সাথে সাথে বে-দীনদের মোকাবেলাও হয়ে যায় । সুতরাং দীন প্রচারের ক্ষেত্রে যুগের আবস্থার উপর ভিত্তি করে বৈধ সকল পন্থাই অবলম্বন করার অনুমতি আছে। এ প্রসংঙ্গে সংক্ষিপ্ত রূপে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরছি।
এক. বর্তমান যুগে ইন্টারনেট আষ্কিৃত হয়ে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়েছে এক যুগেরও বেশী সময় ধরে। তথ্য-প্রযুক্তির দ্রুত আদান প্রদানের মাধ্যম হিসেবে এর জনপ্রিয়তা এখন শীর্ষে। ইন্টারনেট মিডিয়াই একমাত্র মিডিয়া যেখানে লেখক ও পাঠকের মধ্যে সরাসরি তাৎক্ষনিক অনুভূতির আদান প্রদান সম্ভব। (যা দীন বুঝানোর ক্ষেত্রে অপরিহার্য্য একটি বিষয়)। ফলে সর্বস্তরের মানুষের কাছে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে ইন্টারনেট মিডিয়াই এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় মিডিয়া।
এখন বুঝতে হবে দীন প্রচারের ক্ষেত্রে এ প্রযুক্তির প্রয়োগটা কিভাবে হবে?
লক্ষণীয় বিষয় হল যে, মিডিয়া সবসময়ই দুই পক্ষের মাঝে মাধ্যম হিসবে কাজ করে। প্রিন্ট মিডিয়া বলেন আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া বা ওয়েব মিডিয়াই বলেন না কেন সবকটির ক্ষেত্রে একই কথা। দুই পক্ষের প্রথম পক্ষ লেখক, প্রেরক বা উপস্থাপক, আর দ্বিতীয় পক্ষ পাঠক বা প্রাপক। প্রথম পক্ষ এটাকে যেভাবে কাজে লাগাতে চায়, দ্বিতীয় পক্ষের কাছে তা সেভাবেই কাজ করে। নৈতিকতার অবক্ষয়টা এখানেই ঘটে। প্রথম পক্ষ যদি একে মানবতা ও নৈতিকতার পক্ষে কাজে লাগাতে চায় , দ্বিতীয় পক্ষের কছে সে কাজটিই তুলে ধরে মিডিয়া। আবার প্রথম পক্ষ যদি একে অশ্লীলতা ও নোংড়ামির কাজে লাগাতে চায়, দ্বিতীয় পক্ষের কাছে মিডিয়া তা-ই তুলে ধরে। কাজেই মিডিয়া একটি নিরীহ বিষয়, যে যেভাবে তাকে ব্যবহার করতে চায়, সে নিঃসংকোচে নিজেকে সেভাবেই ব্যবহৃত হতে দেয়। এ বিবেচনায় মিডিয়াকে নিরপেক্ষ বললেও বাড়াবাড়ি হবে না বলে মনে হয়। যেমন একটি কলম, খোদ্রাদোহীর হাতে উঠলে নাস্তিকতার বিষপাষ্প ছড়ায়, আবার খোদাপ্রেমিকের হাতে উঠলে তার কালীতে মানবসভ্যতার মুক্তি রচিত হয়।
দুই. ওয়েব মিডিয়ায় মুসলমানদের অবস্থান খুবই দুর্বল। বিশেষ করে নৈতিকতার চর্চা এখানে খুবই নগণ্য। পূর্বেও বলা হয়েছে যে অমুসলিম ও ইয়াহুদিদের সাইট মুসলমানদের সাইটের তুলনায় ১২০০ গুণ বেশি। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এমনটিই দেখা যায়। অশ্লীলতা ও নীল ছবির সায়লাব এত বেশি যে অল্প কিছু মুসলিম সাইটের অবস্থান সে তুলনায় অনুল্লেখযোগ্য।
আর উলামা ও দীনদার মুসলিমের সাইট তো হাতে গোণা কয়েকটি ছাড়া নেই বললেই চলে ।
আজ যে নীতি নৈতিকতার চরম অক্ষয় চলছে। তরুণ সমাজের হৃদয়ের কোমল ভূমিতে ধর্মদ্রোহিতার অঙ্কুরোদগম হচ্ছে। এর জন্য অনৈসলামিক ওয়েব সাইটগুলোর ধর্মদ্রোহী ও নগ্ন আগ্রাসণই দায়িÑএকথা বলে আলেম-উলামা ও দীনদার সম্প্রদায় দায় এড়াতে পারেন না। কেননা যদি আমাদেরকে প্রশ্ন করা হয়, এই নৈতিক অক্ষয় রোধে তুমি কি দায়িত্ব পালন করেছিলে? তখন আমাদের উত্তর কি হবে? একটু নীরবে চিন্তা করুন তো জুম‘আর মিম্বারে আমার ওয়াজের ধ্বনি কি অশ্লিল পাড়ায় পৌছায়? হাদীস- তোমাদের মধ্য হতে যে কোন নিষিদ্ধ কাজ হতে দেখে সে যেন তা হাত দ্বারা পরিবর্তন করে, যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে মুখ দ্বারা, তাও যদি সম্ভব না হয় তাহলে অন্তর দ্বারা, আর এটাই হলো ঈমানের সর্ব নি¤œ স্তর। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৮৬)। এই হাদীস দ্বারা কি সাধ্যানুযায়ী নাহী আনিল মুনকার করার অপরিহার্যতা প্রমাণিত হয় না?। লক্ষ লক্ষ এমনকি কোটি কোটি টাকা এক একটি মাদরাসায় বছরে খরচ করার সাধ্য হলেও ৫/১০ হাজার টাকা খরচ করে একটি ওয়েব সাইট চালু করার সাধ্য কি আমাদের নেই? বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম ও দীনদার সমাজের ভাবা উচিত।
তিন. ইসলাম বারবার সৎ কাজের দিকে মানুষকে আহ্বান করার প্রতি উৎসাহ দিয়ে আসছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
من دعا إلى هدى كان له من الأجر مثل أجور من تبعه لا ينقص ذلك من أجورهم شيئا ومن دعا إلى ضلالة كان عليه من الإثم مثل آثام من تبعه لا ينقص ذلك من آثامهم شيئا
“যে ব্যক্তি মানুষকে কোনো ভালো কাজের দিকে আহ্বান করে, তাকে তার অনুসারীর ভালো কাজের সমান সওয়াব দেয়া হয়, অথচ ঐ ব্যক্তির সওয়াব কোন অংশে কমে না। আর যে ব্যক্তি কোনো খারাপ কাজের দিকে মানুষকে আহ্বান করে, তার ওপর তার অনুসারীর খারাপ কাজটির সমান গুনাহ দেয়া হয় , অথচ তার অনুসারীর পাপের অংশও এতটুকু কমে না” ( সহীহ মুসলিম )
তিনি আরো বলেন,
فوالله لأن يهدى بك رجل واحد خير لك من حمر النعم
“আল্লাহর শপথ ! তোমার মাধ্যমে একটি লোকও যদি হিদায়াত লাভ করে, তবু তা লাল উটনীর চেয়েও উত্তম” (লাল উটনী তৎকালীন সময়ে মানুষের অত্যন্ত প্রিয় ছিল. এ দিয়ে যে কোন প্রিয় বস্তু বোঝানো হয়েছে) বুখারী ২৭৮৩।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন…
وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
“আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের সহায়ক। তারা ভাল কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে। নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করে। এদেরই উপর আল্লাহ্ তা’আলা দয়া করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পরাক্রমশীল, সুকৌশলী”। সুরা তাওবা-৭১
আল্লাহ পাক আরো ইরশাদ করেন….
“যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সৎকর্ম করে এবং বলে, আমি একজন মুসলিম, তার কথা অপেক্ষা উত্তম আর কার কথা হতে পারে? (৪১:৩৩)
আলোচ্য হাদীস ও আয়াতে কারীমাহ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, বস্তু জগতে মানুষকে ভালো কাজের উৎসাহ দেয়া যেমন গুরুত্বপূর্ণ , ওয়েব জগতে সেই গুরুত্ব আরো বেশি বলে মনে হয়। কারণ বর্তমান প্রজন্মের কমিউনিটি গুলো গড়ে উঠেছে ওয়েব জগতেই। তাদের ভালো কাজও খারাপ কাজগুলো ওয়েব কেন্দ্রিকই হয়ে থাকে। অন্তত ভাল খারাপ কাজের প্রেরণা তারা ওয়েব থেকেই পেয়ে থাকে। কাজেই উল্লিখিত আয়াত ও হাদীসের নির্দেশনা বা¯তবায়নের ক্ষেত্র বর্তমানে ওয়েব জগৎও। কারণ এখানকার মানুষজনের কার্যক্রম খুব এফেক্টিভ হয়ে থাকে। এ জগতের উৎসাহ-প্রেরণায় বাস্তব জগতে তারা ভালো বা খারাপ কিছু করে থাকে। কাজেই, এ জগতের বাসিন্দাদের ভালো কাজের পরামর্শ দেয়া ও খারাপ কাজ থেকে সর্তক করা বিশেষ করে ওলামায়েকরাম ও সর্বস্তরের ইসলামপ্রিয় মানুষের অপরিহার্য্য দায়িত্ব।
প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে আমরা ইসলামের দিকে মানুষকে আহ্বান করতে পারি, প্রযুক্তির আবিষ্কার ওয়েব মিডিয়ায় আমাদের কীরূপ ভূমিকা হওয়া উচিৎ, কীভাবে ওয়েব মিডিয়ায় ইসলামের দাওয়াতের কাজে অংশগ্রহণ করতে পারি, নিন্মে সে সম্পর্কিত কিছু আলোচনা করছি।
উলামায়ে কেরামের প্রতি
১. যাদের মাদরাসা আছে (মাদরাসার প্রিন্সিপাল/ কার্যকরী কমিটির সদস্য) তারা মাদরাসার ওয়েবসাইট করে সেখানে মাদরাসার সব ইনফরমেশন রাখতে পারেন, মাদ্রাসায় পড়া কেন প্রয়োজন, এতে দেশ ও মানবতার কীরূপ সেবা হয়, এ ধরনের প্রবন্ধ-নিবন্ধ তাতে থাকতে পারে।
২. মাদরাসার সকল শিক্ষককে প্রতিমাসে/দুই মাসে ন্যূনতম একটি করে ছোট গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখতে বলা হবে, সে গুলো দায়িত্বশীল বিজ্ঞ কারোর সম্পাদনার পর ইন্টারনেটে মাদরাসার ওয়েবসাইট এ দিয়ে দেয়া হবে।
৩. মাদরাসার কার্য্যক্রম, সিলেবাস, বার্ষিক মাহফিল ইত্যাদি সবকিছু ওয়েবসাইটে থাকবে। কারণ মাদরাসাগুলোর সিলেবাস সহজলভ্য না হওয়ার কারণে এর শিক্ষা পদ্ধতি মানুষের কাছে অনেকটাই অস্পষ্ট, যার কারণে অনেক ভুল বুঝাবুঝি হয়ে থাকে। যার ফলে বর্তমান প্রজন্মের অনেক সন্তানই দীন শিক্ষার অন্তরালে রয়ে যাচ্ছে।
৪. মাদরাসার ইসলাহী মজলিসে বক্তাদের বক্তব্য ও আলোচনা ওয়েবসাইটে দেয়া হবে।
৫. ওয়েব সাইটে প্রশ্ন করার অপশন থাকবে। যেন পাঠক/ভিজিটরগণ সহজেই প্রশ্ন করতে পারেন এবং যে কোন বিষয়ে ইসলমী সমাধান পেয়ে যেতে পারেন। উল্লেখ্য যে, এখন এই বিশ্বগ্রামের মানুষের কাছে মাদ্রাসায় গিয়ে স্কলারদের কাছে ইসলামী সমাধান চাওয়ার কল্পনা করা প্রায় অবস্তব। মানুষ এখন মাউসের ক্লিকে সবকিছু করতে অভ্যস্ত। কাজেই ইসলামী সমাধান পাওয়াও তাদের কাছে সহজ করে দেয়া এখন সময়ের দাবী এবং উলামায়েকরামের দায়িত্বও বটে।
৬. গ্রহণযোগ্য ও বিজ্ঞ ওলামাদের লিখিত প্রকাশিত বইগুলোর ভূমিকা, সূচী, প্রাপ্তিস্থান ইত্যাদি সাইটে দেয়া যেতে পারে। যেন ভিজিটরগণ চাইলে সহজেই বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। সম্ভব হলে আপনার সাইটের মাধ্যমে সরাসরি বই বিক্রয়ের ব্যবস্থাও করতে পারেন। সবচেয়ে ভাল হয় যদি কোন দানশীল ব্যক্তির মাধ্যমে বিনামূল্যে বই পড়া বা বিতরণের সুযোগ করে দেয়া যায়। উল্লেখ্য, লেখকদের প্রাকশিত বইগুলো দেশের মানুষের কাছেই সবখানে পৌঁছে না। আর যারা বিদেশে আছেন, তাদের কাছে পৌঁছানোও অনেক সময় সম্ভব হয় না। কিন্তু ওয়েব সাইটের কোন ভৌগলিক সীমা নেই। বাংলাদেশের এক প্রান্তে বসেও যদি একটি বই ওয়েব সাইটে তুলে দেয়া হয় তাহলে সারাবিশ্বের মানুষ বইটি পাঠ করতে সক্ষম হবে । সবচেয়ে বড় কথা, বিনামূল্যে বই পড়ার সুযোগ করে দিলে ইসলামের অনেক বড় খিদমাত হবে। যা নিঃসন্দেহে যে কোন ইসলামী লেখকের প্রথম বাসনা হওয়া উচিত।
বিশ্বমানচিত্র থেকে ইসলাম ও মুসললিমের নাম-নিশানা মুছে ফেলার লক্ষ্যে কুফুরী শক্তি সমর আগ্রাসনের সাথে সাথে মিডিয়া আগ্রাসণও চালাচ্ছে ব্যপকভাবে। সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে দেশ দখল করছে আর মিডিয়া আগ্রাসন চালিয়ে দখল করছে দিল। কেড়ে নিচ্ছে দীন ও ঈমান
হক্কানী আলেমগণের উনুপস্থিতিতে আজ ভ্রান্ত আকীদাধারী ও বিদআত পন্থীরা মিডিয়া জগতে ইসলামের প্রকৃত ধারক-বাহকরূপে উপস্থাপিত হচ্ছে। ফলে তারা আজ মিডিয়াতে ইসলামের নামে মনগড়া সব অপব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছে। যার দরুন সাধারণ মানুষ যেমন বিভ্রান্ত হচ্ছে, তেমনি অসংখ্য বিদআতের সায়লাব হচ্ছে সমাজে। যদিও বর্তমানে জুমআার খুতবা, মাদরাসা মাসজিদে ভিবিন্ন প্রোগ্রাম করে মানুষকে সহীহ্ দ্বীন বুঝানোর জন্য উলামাগণ আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন । কিন্তু এর ফল আমরা ঘরে তুলতে পারছি না। কারণ এ প্রজন্মের মানুষ যতটা না মনোযোগী সাধারণ বয়ান-খুতবায় তার চেয়ে হাজারও গুণ বেশী মনোযোগী মিডিয়ার পাতায়। তারা মাসজিদে ইমাম সাহেবের বক্তব্যকে বাসায় এসে ঘরে বসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যাচাই করার চেষ্টা করেন। সুতারং যখনি তারা দুটোকে একত্রিত করে তখন মিডিয়ায় প্রচারিত বিদআত পন্থীদের বাহ্যিক গেটাপ দেখে তারই দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে এবং হক্বকে পিছনে ফেলে বিদআত গ্রহণ করছে। শুধু তাই নয়; তাদের যুক্তির কবলে পরে আলেমগণের প্রতি বিরূপ মন্তব্য করতেও দ্বিধা করছে না। কারণ তাদের বর্ণনা, উপস্থাপনা এত সাজানো যে হক্কানী বিজ্ঞ উলামা ছাড়া সাধারণ মানুষের পক্ষে এটা বুঝা আদৌ সম্ভব নয়।
আল্লাম সাইয়েদ আবূল হাসান আলী নদভী রহ. তাঁর এক ভাষণে বলেছেন, আল্লাহর নিয়ামত মনে করে প্রযুক্তিকে দাস রূপে ব্যবাহার করতে হবে; প্রযুক্তির দাসে পরিণত হওয়া যাবে না।
মোটকথা, প্রযুক্তির মাধ্যমে ইসলাম প্রচারের এই উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করতে পারলে প্রযুক্তির মাধ্যমে ইসলাম প্রচারের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। কাজেই কোন আগ্রহী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এ কাজে এগিয়ে আসলে ইসলামের একটি বড় খিদামাত হবে। এবং তারা সদক্বায়ে জারিয়ার সওয়াব পাবে ইনশা-আল্লাহ । আল্লাহ আমাদের সকলের সহায় হোন এবং সকলের মেহনতকে কবুল করুন। আমীন
লেখক:
ইমাম কাম জে. আর. অফিসার
স্কয়ার গ্রুপ, ১০২ শহীদ আহমদ সরণী, তেজগাও আই/এ ঢাকা-১২০৮