মুফতী হাফিজুর রহমান
শর্ত উপস্থিত হলে জুমআর নামাজ আদায় করা ওয়াজিব। তবে ওয়াজিব হলেও জুমআর নামাজ জোহর নামাজের বিকল্প হিসেবে কাজ করে। যেহেতু জুমার নামাজ আদায়ের কারণে জোহরের ফরজ নামাজ থেকে দায়মুক্তি লাভ হয় তাই এ দৃষ্টিকোণ থেকে জুমার নামাজ ফরজও বটে। ফাতাওয়ায়ে দারুল উলূম ৫/১৩৭
আর ফরজ নামাজ জামাতের সাথে আদায় করা কার্যত ওয়াজিব। তবে জামাতের সাথে ফরজ নামাজ আদায় ওয়াজিব হওয়ার জন্য মসজিদ আবশ্যকীয় শর্ত কিনা? কেউ যদি বিনা কারণে ঘরে জামাতের সাথে ফরজ নামাজ আদায় করে তাহলে সে ওয়াজিব আদায় থেকে দায়মুক্ত হবে কি না?
উত্তর হলো, ফরজ নামাজ জামাতের সাথে আদায় করা ওয়াজিব। আর মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করাটা স্বতন্ত্র ওয়াজিব। সুতরাং এখানে দুটি ওয়াজিব। ১। জামাতের সাথে ফরজ নামাজ আদায় করা। ২। মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে ফরজ নামাজ আদায় করা। অতএব জামাতের সাথে ফরজ নামাজ আদায় ওয়াজিব হওয়ার জন্য মসজিদ আবশ্যকীয় শর্ত নয়। তবে মসজিদে উপস্থিতি হওয়া ওয়াজিব হওয়ার জন্য জামাতের সাথে নামাজ আদায় শর্ত। কেউ যদি বিনা কারণে ঘরে জামাতের সাথে ফরজ নামাজ আদায় করে তাহলে সে এক ওয়াজিব আদায় থেকে দায়মুক্ত হবে বটে, কিন্তু মসজিদে উপস্থিত হওয়ার ওয়াজিব পরিত্যাগের কারণে গুনাহগার হবে। ইমদাদুল আহকাম ১/৫৩৪ (মাকতাবায়ে দারুল উলূম করাচী)
সারকথা জামাত ও মসজিদে উপস্থিতি উভয়টিই অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে এ দুটি নামাজ শুদ্ধ হওয়ার জন্য আবশ্যকীয় কোনো শর্ত নয়। সুতরাং কেউ যদি বিনা কারণে জামাত ও মসজিদ পরিত্যাগ করে ফরজ নামাজ আদায় করে তবে তার ফরজ নামায হয়ে যাবে। তবে সে ওয়াজিব পরিত্যাগ করার কারণে গুনাহগার হবে।
হাদীস ও ফিকহের আলোকে মসজিদে জামাত ও জুমা পরিত্যাগের অবকাশ
কিছু কিছু কারণে জামাত পরিত্যাগের সুযোগ রয়েছে। যথা, ১। প্রবল বেগে বৃষ্টিপাত হওয়া ২। রাস্তা ভীষণ কর্দমাক্ত হওয়া ৩। অতিরিক্ত শীতের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়া কিংবা অসুস্থতা বেড়ে যাওয়া আশঙ্কা হওয়া ৪। সম্পদ চুরি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা হওয়া ৫। অন্ধকারের কারণে পথ ঘাট দৃষ্টিগোচর না হওয়া ৬। অসুস্থের সেবা শুশ্রূষায় রত থাকা ৭। শত্রুর সাথে মিলিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হওয়া ইত্যাদি। ফতাওয়ায়ে দারুল উলূম ৩/৫৮, আদদুররুল মুখতার ১/৪৮৮
যেসব কারণে মসজিদের জামাত পরিত্যাগের সুযোগ রয়েছে সেসব কারণে জুমা নামায পরিত্যাগেরও সুযোগ রয়েছে। প্রাগুক্ত
হাদীসেও ওজরের কারণে মসজিদে জামাত পরিত্যাগের বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। যথা,
১। নাফে’ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. এক শীতবহুল রজনীতে যাজনান নামক স্থানে আযান দিলেন। এবং আযানে বললেন, তোমরা তোমাদের নিজস্ব জায়গায় নামাজ আদায় করো। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরের ক্ষেত্রে বৃষ্টিবহুল কিংবা শীতবহুল রাত্রিতে মুয়াজ্জিনকে আযান দিতে এবং আযান শেষে একথা বলতে নির্দেশ দিতেন, তোমরা নিজ নিজ অবস্থানে নামাজ আদায় করো। সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৩২
২। আবুল মালীহ রা. থেকে বর্ণিত যে, তাঁর পিতা হুদাইবিয়ার সময় জুমার দিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে ছিলেন। সেদিন বৃষ্টি হয়েছিলো। তবে সে বৃষ্টিতে জুতার তলাও ভিজে নি। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে নির্দেশ দিলেন, তারা যেন নিজ নিজ অবস্থানে নামাজ আদায় করে। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১০৬১
৩। ইবনে সিরীন রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইবনে আব্বাস রা. একদা বৃষ্টির সময় নিজের মুয়াজ্জিনকে বললেন, যখন তুমি أَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ বলবে তখন حَىَّ عَلَى الصَّلاَةِ (নামাজের দিকে আসো) বলবে না; বরং বলবে صَلُّوا فِى بُيُوتِكُمْ (তোমরা নিজ নিজ ঘরে নামাজ আদায় করো।)। তখন লোকজন মুয়াজ্জিনের এমন আযানে আপত্তি জানালো। তখন ইবনে আব্বাস রা. বললেন, যিনি আমার থেকে সর্বোত্তম তিনিই এমনটি করেছেন। জুমার নামাজ অবশ্যই আবশ্যক। তবে আমি অপছন্দ করছি যে, তোমাদেরকে ঘর থেকে বের করবো, ফলে তোমরা কাদা ও বৃষ্টিতে চলাচল করবে। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১০৬৪
বৃষ্টি ও শীতবহুল সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশে মুয়াজ্জিনের মাধ্যমে নিজ নিজ অবস্থানে নামাজ আদায়ের ঘোষণা একাধিক জায়গায় হয়েছে।
উপরোক্ত হাদীস, আসার ও ফিকহের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হচ্ছে, বিশেষ সমস্যার কারণে জুমা ও জামাত পরিত্যাগের অবকাশ ইসলামী শরীয়াতে রাখা হয়েছে।
হাদীস ও আসারের আলোকে মহামারীর সময় নিজস্ব পরিমণ্ডলে অবস্থান ও তার মাহাত্ম্য
১। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি মহামারীর সময় ধৈর্য সহকারে, সওয়াবের আশায় এবং আল্লাহ তার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন তার বাইরে কিছুই ঘটবে না- এ বিশ্বাস নিয়ে নিজ এলাকায় অবস্থান করবে সে শহীদের মর্যাদা লাভ করবে। সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৪৭৪। মুসনাদে আহমাদের ২৬১৮২ নম্বর হাদীসে ঘরে অবস্থানের কথাও বর্ণিত হয়েছে।
সহীহ বুখারীর শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকার হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রহ. এ হাদীসের ব্যাখ্যায় লেখেন, ধৈর্য সহকারে, সওয়াবের আশায় ও আল্লাহর উপর ভরসা- এই তিনটি বিষয় ধারণ করে যে ব্যক্তি মহামারীর সময় নিজস্ব পরিমণ্ডলে অবস্থান করবে তিনি শহীদের মর্যাদা পাবেন। মহামারীতে তিনি মারা যান অথবা না-ই মারা যান।
-ফতহুল বারী ১০/৩২৫।
২। হযরত ওমর ফারূক রা.-এর ঘটনাটি এখানে বেশ প্রাসাঙ্গিকতার দাবি রাখে। ঘটনাটি হলো, সাহাবায়ে কেরামের এক জামাতসহ তিনি যখন শামের নিকটে পৌঁছে সংবাদ পেলেন যে, ওখানে মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে তখন মুহাজির, আনসার ও অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামের সাথে করণীয় নির্ধারণের বিষয়ে পরামর্শ করেন। পরামর্শে আক্রান্ত অঞ্চলে প্রবেশ করা ও না-করা দুই রকমের মতই এল। ওমর রা. প্রথমে মুহাজির সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করেছিলেন। তাদের পক্ষ হতে দুই রকম মত আসে। এরপর আনসার সাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করেন। তাদের পক্ষ হতেও দুই রকম মত আসে। এরপর অন্যান্য বিচক্ষণ ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করেন। তারা একমত হয়ে আক্রান্ত অঞ্চলে না যাওয়ার পরামর্শ দেন। এরপর ওমর রা. ঘোষণা করেন যে, তিনি মদীনায় ফিরে যাচ্ছেন। এ সময় বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রা. এর সাথে তাঁর যে কথোপকথন হয়েছিল তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হযরত আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রা. উমর রা.কে বললেন, আল্লাহর তাকদীর থেকে পলায়ন করে কি আপনি মদীনায় ফিরে যাচ্ছেন? হযরত ওমর ফারুক রা. বললেন, হে আবু উবাইদা! কথাটি যদি আপনি ছাড়া অন্য কেউ বলত! জ্বী, আমরা আল্লাহর তাকদীর থেকে আল্লাহর তাকদীরের দিকেই পলায়ন করছি। দেখুন, আপনার উটের পাল যদি এমন কোনো চারণ ভূমিতে নামে যার এক পার্শ্বে রয়েছে তৃণলতাপূর্ণ সজীব ভূমি আর অন্য পার্শ্বে রয়েছে বিরাণ ভূমি, তাহলে আপনি সজীব ভূমিতে সেগুলোকে চরানোর ব্যবস্থা নিলে কি তা আল্লাহর তাকদীরের কারণেই হবে না? ……. সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৭২৯
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় জুমা ও জামাত পরিত্যাগের সুযোগ আছে কি না?
পৃথিবীর তাবৎ শাস্ত্রের স্বতঃস্বীকৃত একটি নীতি হলো, لكل فن رجال তথা প্রতিটি শাস্ত্রের স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞ রয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এ নীতির স্বীকৃত দিয়েছেন। পরাগায়ণ বিষয়ে কৃষি বিশেষজ্ঞ সাহাবায়ে কেরামকে লক্ষ্য করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, নিছক জাগতিক এ বিষয় সম্বন্ধে তোমরাই আমার থেকে ভালো জানো। পূর্ণ হাদীসটি হলো, একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেজুর চাষীদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তখন খেজুর চাষীরা পরাগায়ণ করছিলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের পরাগায়ন পদ্ধতি দেখে বললেন, যদি তোমরা এ পরাগায়ন পদ্ধতি গ্রহণ না করো তবু গাছে ফল হবে। তারা পরাগায়ন বন্ধ রাখলে দেখা গেলো সেবার গাছে চিটা খেজুর হলো। এরপর আবার সে লোকগুলোর পাশ দিয়ে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গমন করলেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের খেজুরের কি খবর? তখন তারা বললেন, এমন এমন খেজুর হয়েছে। অর্থাৎ পরাগায়ন না করার কারণে চিটা খেজুর হয়েছে। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, জাগতিক বিষয়ে তোমরাই ভালো জানো। সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬২৭৭
বর্তমানে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ আরোপিত না স্বতঃস্ফূর্ত সূক্ষ্ম ও সন্দ্বিগ্ধ এ আলোচনার সুযোগ থাকলেও এর বাস্তবতা ও পরিণতফলকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। আমরা স্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছি, করোনা ভাইরাসটি গোটা পৃথিবীতে ভয়াবহ মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যাও বিশ্বজুড়ে অচিন্তনীয়ভাবে বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশেও আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। করোনা ভাইরাসটির প্রকৃতি ও ভয়াবহতার বিষয়টিও ইতিমধ্যে আলোচনায় এসেছে। এ বিষয়টি বোঝার দুটি উপায় রয়েছে, ১. সাধারণ বিচার-বুদ্ধি এবং ২. বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত।
সাধারণ বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ একটু চিন্তা করলেই বিষয়টির ভয়াবহতা বুঝতে পারবেন। পৃথিবীর দেশে দেশে একের পর এক লকডাউন ঘোষিত হয়েছে। কয়েকটি উন্নত রাষ্ট্রেও প্রথম দিকে এই ভাইরাস স্বল্পমাত্রায় ও মন্থরগতিতে ছড়ালেও একটা পর্যায়ে এসে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে।
করোনার ভয়াবহতা বিষয়ে সাধারণ বিচার বুদ্ধির স্বীকৃতির পাশাপাশি ধর্মপ্রাণ চিকিৎসক, অণুজীব বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও ভাইরাসটির ধরন ও বিস্তারের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাদের সম্মিলিত বক্তব্য ও মতামতকে উপেক্ষা করা মানে দৃশ্যমান বাস্তবতাকে অস্বীকার করা। প্রতিটি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভারসাম্যপূর্ণ মূল্যায়ণের নীতি ও নির্দেশনা ইসলামী শরীয়তে রয়েছে। বর্তমান যুগ পরিপ্রেক্ষিতে ফিকহ ফতওয়ার নীতিমালার সাথে এ নীতিটি ওৎপ্রোতভাবে জড়িত।
সুতরাং যেসব ওজরের কারণে মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে নামাজ আদায় না করার সযোগ আছে সেসব ওজরের মধ্যে করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতার বিষয়টিও অন্তর্গত হবে। কারণ বিশেষজ্ঞদের মতে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর অন্যতম মাধ্যম হলো ভীড় ও পরস্পরের সংস্পর্শ। করোনা ভাইরাসের প্রকোপে মানুষ একের পর এক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। অতি বৃষ্টির কারণে, সম্পদ চুরি হওয়ার কারণে ও ব্যধি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কার মত স্বাভাবিক ওজরের কারণে যেখানে মসজিদের জামাত পরিত্যাগের অবকাশ রয়েছে সেখানে মৃত্যুব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় কি মসজিদে উপস্থিত না হওয়ার সুযোগ থাকবে না? সুতরাং করোনার কারণে মসজিদে না আসার বিষয়ে ইসলামী শরীয়তে কোনো বর্ণনাও নেই, এবং এর প্রতি কোনো ইঙ্গিতও নেই- এ ধরনের কথা বলার কোনো সুযোগ আছে বলে আমাদের মনে হয় না।
করোনা ভাইরাস মহামারীর নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে। যার সাথে অতীতের মহামারীর চরিত্রগত কোনো মিল নেই। এক্ষেত্রে লাশ দাফনে জড়িত আলেমদের সাথে কথা বলে, চিকিৎসার সাথে জড়িত লোকজনের মাধ্যমে মহামারীর বিস্তার ও মৃত্যুর ভয়াল রূপ সম্পর্কে জেনে এবং করোনা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের সাথে তথ্যের আদান-প্রদান ও মতবিনিময় করে দীনী বিষয়ক সিদ্ধান্ত প্রদান করাই হলো ফিকহী নীতিমালার দাবি।
করোনা পরিস্থিতির কারণে মসজিদে মুসল্লী সীমিত করে জুমআ আদায় করা হলে জুমা আদায় হবে কি না?
বস্তুতপক্ষে করোনাময় এ পরিস্থিতিতে মসজিদকে দশ পাঁচজন মুসল্লীদের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ করাকে আমরা উচিত মনে করি না। আমাদের মতে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করে সুস্থ মুসল্লীদের জন্য মসজিদকে উন্মুক্ত রাখাই যৌক্তিক ও বাঞ্ছনীয়। সুরক্ষা ব্যবস্থা পরিপালনের ক্ষেত্রে মুসল্লীদের উপর কড়াকড়ি আরোপের বিষয়টিও মাথায় রাখা যেতে পারে। কিন্তু পূর্ণ মসজদিকেই লকডাউনের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াটা আদৌ উচিত বলে মনে হয় ন। তবে বিশেষ এ পরিস্থিতিতে মসজিদকে দশ পাঁচজন মুসল্লীদের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ করাকে আমরা মসজিদ ধ্বংস বা হারাম বলেও মনে করি না। এবং এ অবস্থায় জুমা আদায় করা হলে তা সহীহ হবে না বলেও আমরা মনে করি না। এতটুকু বলতে পারি, এখানে যথাযথ ভারসাম্য রক্ষা না করে অতিরঞ্জনমূলক কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। যেহেতু বিশেষ পরিস্থিতি তাড়িত হয়ে শরীয়ত গৃহীত ওজরের কারণে এ অতিরঞ্জন করা হয়েছে তাই কোনোভাবেই এ প্রক্রিয়াকে হারাম বা মসজিদ ধ্বংসের নামান্তর বলে অভিহিত করা যায় না।
উদ্ভূত বর্তমান এ পরিস্থিতিতে জুমু‘আর নামাযের জন্য ১০জন মুসল্লীর বেশী কাউকে মসজিদে প্রবেশের ক্ষেত্রে যে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে তা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে জনস্বার্থে নেয়া সরকারী পদক্ষেপ। তাই এটা জুমু‘আ সহীহ হওয়ার জন্য প্রযোজ্য শর্ত ইজনে ‘আম এর প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচিত হবে না। কারণ, এর উদ্দেশ্য মানুষকে জুমু‘আ থেকে বাধা দেয়া নয়, বরং উদ্দেশ্য হচ্ছে– নিয়ম ভঙ্গের ফলে আরোপিত অসুবিধা থেকে রক্ষা করা।
ফিকহের কিতাবে আছে, নামাযরত অবস্থায় যদি শত্রু প্রবেশের আশঙ্কা তৈরি হয় তাহলে মসজিদের দরজা বন্ধ করা আবশ্যক হবে।-হাশিয়াতুত তাহতাভী আলাদ দুররিল মুখতার ১/ ৩৪৪
অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘ইযনে ‘আম না থাকলে জুমু‘আ সহীহ হবে না’ এটা ঐ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যখন মানুষকে জুমু‘আয় শরীক হতে বাধা দেয়া হবে। কিন্তু যদি শত্রুকে বাধাগ্রস্ত করতে অথবা পূর্ব থেকে চলে আসা নিরাপত্তা বিধি রক্ষার স্বার্থে প্রবেশাধিকারকে সীমিত করে দেয়া হয়, তবে এ প্রক্রিয়া জুমু‘আ কায়েমে প্রতিবন্ধক হবে না।-হাশিয়াতুত তাহতাবী আলাদ দুররিল মুখতার, ১/৩৪৪
অনুরূপভাবে ইমদাদুল ফাতাওয়ায় রয়েছে, ইযনে ‘আম বিদ্যমান থাকাও জুমু‘আ সহীহ হওয়ার শর্তাবলির অন্তর্ভুক্ত। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, স্বয়ং নামায আদায়কারীগণকে বাধা দেয়া সেখানে উদ্দেশ্য হবে না। তবে যদি অন্য কোন প্রয়োজনে বাধা দেয়া হয় তবে তা ইযনে আমের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে গণ্য হবে না।-ইমদাদুল ফাতাওয়া, ১/২১৪
তদ্রূপ ইমদাদুল আহকামে রয়েছে, যদি সেনা ছাউনি বা কিল্লার মধ্যে জুমু‘আ আদায় করা হয়, তাহলে তা জায়িয হবে। যদিও সেনা ছাউনি ও কিল্লায় অন্য লোকজন আসতে পারে না। কেননা, সেখানে তাদেরকে প্রবেশ করতে না দেয়াটা নামায থেকে বাধা দেয়ার জন্য নয়, বরং ব্যবস্থাজনিত কারণে সেখানে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত করা হয়েছে।-ইমদাদুল আহকাম ১/ ৭৫২
এক্ষেত্রে আরো কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে
১। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বৃষ্টিবহুল দিনে যার যার অবস্থানে নামাজ আদায় করার জন্য বিশেষ নির্দেশনা প্রদান করেছেন। সাহাবায়ে কেরামও এমন দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। একটি আদেশের মাঝে পরোক্ষভাবে নিষেধও বিদ্যমান থাকে। আদেশ হলো, তোমরা যার যার অবস্থানে নামাজ আদায় করো। এখানে পরোক্ষ নিষেধ হলো, এ সময় তোমরা মসজিদে এসো না। তো বিশেষ পরিস্থিতিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও মসজিদে না এসে ঘরে নামাজ আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রচ্ছন্নভাবে মসজিদে আসতে বারণ করেছেন। যদি বলা হয় এ আদেশ নিষেধ আবশ্যকীয় ছিলো না; বরং ঐচ্ছিক ছিলো, অর্থাৎ এ আদেশ বা নিষেধ পরিপালনের বিষয়টি ছিলো ঐচ্ছিক, তাহলে আমরা বলবো এ নির্দেশনা জারি হওয়ার পর সকল সাহাবায়ে কেরাম কর্তৃক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে একত্রিত হওয়াকে তিনি পছন্দ করতেন না। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের কষ্ট ও ক্ষতি বিবেচনা করে এমন দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। কোনো বর্ণনায় এমনটি পাওয়া যায় না যে, সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন নির্দেশনার পরও নামাজ আদায়ের জন্য তার কাছে চলে এসেছিলেন। সুতরাং খুব সহজেই বলে দেয়া যায় না যে এ নির্দেশনাটি ঐচ্ছিক পালনীয় ছিলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক ঘরে নামাজ আদায় বিষয়ক এ নির্দেশনার মূল কারণটি আমাদের সামনে আসা প্রয়োজন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মূলত সাহাবায়ে কেরামের কষ্ট ও ক্ষতির আশঙ্কা বিবেচনায় নিয়ে এমন নির্দেশনা দিয়েছিলেন। নতুবা এমন নির্দেশনা দেয়ার প্রয়োজন ছিলো না। তখন যদি এ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশঙ্কাটি মৃত্যু আশঙ্কায় রূপান্তরিত হতো তবে নিশ্চিতরূপে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এ নির্দেশনাকে ঐচ্ছিক ভাবার কোনো অবকাশ থাকতো না। যেহেতু ক্ষতিরগ্রস্থ হওয়া আশঙ্কাটা কম তাই এ নির্দেশনার ক্ষেত্রে ইখতিয়ারী বা ঐচ্ছিকতার প্রসঙ্গ তুলে আনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় আমাদের ক্ষুদ্র দৃষ্টিতে মনে হয় না এট কোনা ঐচ্ছিক নির্দেশনা ছিলো। সুতরাং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের উক্ত কার্যক্রম থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয়, মুসল্লীদের স্বার্থ বিবেচনায় মসজিদকে সীমিত করা ইসলামী শরীয়তে সিদ্ধ। অতএবং বর্তমান বিশেষ পরিস্থিতিতে মসজিদকে সীমিত করাটাও সিদ্ধ ও বিধিত হবে। উপরন্তু জনস্বার্থে নেয়া রাষ্ট্রপ্রধানের হস্তক্ষেপের বৈধতার নজির তো ফিকহের গ্রন্থাদিতে ভূরিভূরি রয়েছে। আমরা বর্তমানে দেখতে পাই, বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিশেষ পরিস্থিতিতে কারফিউ জারি করা হয়। তখন তো মসজিদে যাওয়াও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এখন কি এ সিদ্ধান্ত দেয়া যাবে যে, যেহেতু মসজিদ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাই এ কারফিউ ব্যবস্থা ইসলামী শরীয়া মতে বৈধ হবে না। এখানে হস্তক্ষেপের মূল কার্যকারণ নিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে। কার্যকারণটা যদি অতি মাত্রার মারাত্মক হয় তাহলে ইসলামী শরীয়তে জনস্বার্থ রক্ষায় উপযোগী যে কোনো রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপকে স্বীকৃতি দিবে। এখানে ‘ইসলামী শরীয়তে ওজরের কারণে মসজিদে না যাওয়ার দলীল আছে, ওজরের কারণে মুসল্লীদেরকে মসজিদে প্রবেশে বাধা দেয়ার দলীল নেই’ বলে মেরুকরণ করা আদৌ উচিত হবে না।
২। সরকারী নির্দেশনা মেনে মসজিদ তালাবদ্ধ করে দশ বারো জন মিলে জুমা আদায় করলে জুমা নামাজ হবে না বলে যে ইজনে আম লঙ্ঘনের প্রসঙ্গ আনা হয়েছে তা আমাদের কাছে যথার্থ বলে মনে হয় নি। কারণ থানভী রাহ. বলেন, ইজনে আম দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, মুসল্লীদেরকে বাধা দেয়া উদ্দেশ্য না হওয়া। তবে কোনো কারণে যদি মুসল্লীদেরকে বারণ করা হয় তাহলে সেটা ইজনে আম পরিপন্থী হবে না। ইমদাদুল ফাতাওয়া ১/৬১৪ এ ফতওয়া থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, বিশেষ কারণবশত সীমিত সংখ্যক মুসল্লী প্রবেশ করিয়ে মসজিদ তালাবদ্ধ করে দেয়া বা ব্যাপকভাবে মুসল্লীদেরকে আসতে বারণ করা ইজনে আম পরিপন্থি নয়।
৩। ইজনে আম মানেটা কি? এ প্রশ্নের উত্তরটা আমাদের বোধগম্য করা প্রয়োজন। বস্তুত ইজনে মানে হলো, উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার থাকা। পৃথিবীর যে কোনো ব্যক্তি মসজিদে এসে নামাজ আদায় করতে পারবে- এমন প্রবেশাধিকার বজায় থাকলে সেটা হবে ইজনে আমের পূ্র্ণাঙ্গ ব্যবহার। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, স্বাভাবিকভাবে পৃথিবীর যে কেউ কোনো মসজিদে এসে নামাজ আদায় করতে পারছে না। এ না পারাটা যদি ব্যক্তিগত কারণে হয় তবে সেটা ইজনে আম পরিপন্থী হবে না- এটা স্বতঃসিদ্ধ কথা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে এ অক্ষমতা অন্য কারণে হচ্ছে। যেমন বর্ডার সংলগ্ন মসজিদগুলোতে বিপরীত রাষ্ট্রের সীমান্তবর্তী মানুষগুলো এসে নামাজ আদায় করতে পারছে না। এ না পারা বা অক্ষমতা ব্যক্তিগত নয় বরং রাষ্ট্রগত। তাহলে দেখা যাচ্ছে, এখানে ইজনে আমের পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার হচ্ছে না। বলা চলে আংশিক ব্যবহার হচ্ছে। তদ্রূপ বঙ্গভবন, গণভবন, সচিবালয়, সেনানিবাস ও জেলখানার মসজিদগুলোতেও একইভাবে ইজনে আম পূর্ণমাত্রায় রক্ষিত হচ্ছে না। এসব মসজিদগুলোতে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার না থাকাটাও ব্যক্তিগত নায়; বরং রাষ্ট্রগত। তো এসব মসজিদগুলোতে জুমার নামাজ হয় না বলে ফতওয়া দেয়া হয় না। যদিও এসব মসজিদে ইজনে আম তথা প্রবেশাধিক সংরক্ষিত ও সীমাবদ্ধ। এসব মসজিদে ইজনে আম রহিত হয়- একথা বলা হয় না। তার কারণ হলো, বাহ্যত এখানে ইজনে আম রহিত দেখা গেলেও সেটা বিনা কারণে নয়; বরং বিশেষ ওজরের কারণে এখানে ইজনে আম নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। কারণ, যদি এসব মসজিদগুলোতে উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়া হয় তাহলে রাষ্ট্র বা জাতির সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। আর ইসলামী শরীয়াতে ওজরের কারণে অনেক কিছুই ছাড় দেয়া হয়। ওজরের কারণে নামাজের মধ্যকার ফরজ পর্যন্ত রহিত হয়ে যায়। কিন্তু নামাজ ঠিকই সম্পন্ন হয়ে যায়। সতুরাং ইজনে আমের বিষয়টি কি মসজিদের সাথে সংশ্লিষ্ট না এলাকার সাথে সংশ্লিষ্ট নাকি ব্যক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, সমস্যা বা ও ওজর কতোটুকু গ্রহণযোগ্য। সমস্যার মাত্রা ও ওজরের মাত্রা ভেদে ইজনে আম এলাকা ও ব্যক্তি পেরিয়ে মসজিদের গেট পর্যন্ত গিয়েও সীমাবদ্ধ হয়ে যেতে পারে। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে সীমান্ত রেখা দিয়ে মসজিদে উন্মুক্ত গমনাধিকারকে সঙ্কুচিত করা হয়েছে। দেশীয় পরিমণ্ডলে সেনানিবাস বা গণভবনের সীমানা প্রাচীর দিয়ে গমনাধিকারকে সঙ্কুচিত করা হয়েছে। সুতরাং সমস্যা ও সঙ্কটের মাত্রা ভেদে এসব সঙ্কোচনের ভেতরেও আরো সঙ্কোচন তৈরি হতে পারে। সমস্যা ভেদে গণভবন, সেনানিবাস ও জেলখানার ভিতরেও তৈরি হতে পারে আরো সীমাবদ্ধতা ও সঙ্কোচন প্রক্রিয়া। এসব প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে এসব সীমাবদ্ধতা বিধিত কি বিধিত নয় তা নির্ভর করে সমস্যা ও সঙ্কটের মাত্রাগত গ্রহণযোগ্যতার উপর। সঙ্কট যদি অতি মাত্রার হয় এবং তা শরীয়ত গৃহীত হয় তবে অতি সীমাবদ্ধতাও ইজনে আম পরিপন্থী হবে না।
উল্লেখ্য, জুমা নামাজ সহীহ হওয়ার জন্য ফিকহের কিতাবগুলোতে আরো দুটি শর্তের কথা বলা হয়েছে। ১। রাষ্ট্রপ্রধান অথবা তার প্রতিনিধির উপস্থিতি ২। দারুল ইসলাম হওয়া। শর্ত দুটির প্রথমটি বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে না। সে হিসেবে জুমা সহীহ না হওয়ারই কথা ছিলো। কিন্তু বর্তমানে এ শর্ত সঙ্কটের কারণে ফুকাহায়ে কেরাম এ শর্তকে আবশ্যকীয় হিসেবে গ্রহণ করেন না। তো দেখা যাচ্ছে, এখানে সমস্যার কারণে শর্ত বিলুপ্ত হয়েও জুমা সহীহ হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং সমস্যার কারণে কোনো শর্ত নিয়ন্ত্রিত হলে কি জুমা সহীহ হতে পারে না?
আর দ্বিতীয় শর্তটিও বর্তমানে বিলুপ্ত। কারণ বর্তমান পৃথিবীতে কোথাও দারুল ইসলাম নেই। সুতরাং সে হিসেবে বর্তমানে কোথাও জুমা সহীহ হওয়ার কথা ছিলো না। কিন্তু উলামায়ে কেরাম বলছেন, আমাদের দুর্বলতা বা সমস্যর কারণে বর্তমানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলো দারুল ইসলাম না হলেও জুমা সহীহ হয়ে যাবে। বর্তমানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলোসহ অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো দারুল হারব কিনা এটা একটি দীর্ঘ আলোচনা সাপেক্ষ বিষয়। এ বিষয়ে উলামায়ে কেরামের মাঝে খানিকটা মতভিন্নতাও রয়েছে। অতএব যাদের নিকট বর্তমানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কিংবা অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলো দারুল হারব তাদের নিকট পৃথিবীর কোথাও জুমা সহীহ হওয়ার কথা নয়।
যদি বলা হয় রাষ্ট্রপ্রধান মুসলিম নয় তাই তার নির্দেশনা মানা আবশ্যক নয়; সুতরাং সে জনস্বার্থে ইজনে আমে হস্তক্ষেপ করলে ইজনে আম অটুট থাকবে না, তাহলে প্রথমত বলবো মুসল্লী নিয়ন্ত্রণের কারণে জুমা হবে না বলে যে ফতওয়া এসেছে তা কি এ কারণে যে রাষ্ট্রপ্রধান অমুসলিম তাই তার নির্দেশনা পালন আবশ্যক নয় ?
দ্বিতীয়ত যদি ধরে নেয়া হয় রাষ্ট্রপ্রধান অমুসলিম তবে বলতে হবে রাষ্ট্রপ্রধান অমুসলিম হলেও সে এখন আমাদের আরোপিত দায়িত্বশীল। অমুসিলম পিতা যদি মুসলিম সন্তানকে এমন উপদেশ দেয় যার বিপরীত করা হলে তার জন্য মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে তাহলে সে নির্দেশনা মানা আবশ্যক হয়ে পড়ে। তদ্রূপ গুরুতর ব্যধির ক্ষেত্রে অমুসলিম বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের নির্দেশনা মানাও কিন্তু আবশ্যক। উপরন্তু যদি এমন দিকনির্দেশনা শতভাগ ইসলামী খেলাফতের পক্ষ থেকে আসতো তখন আমাদের ফতওয়া কি হতো?
বস্তুত বর্তমানে মুসল্লীদের নিরাপত্তা ও সুস্থতার স্বার্থেই তাদেরকে মসজিদে আসতে বারণ করা হয়েছে । এটা মুসল্লির স্বার্থ । এখানে কর্তৃপক্ষ বা রাষ্ট্রের স্বতন্ত্র্য কোনো স্বার্থ নেই। ইজনে আমটাও মুসল্লীদের স্বার্থে ছিলো। এখন মুসল্লীদের স্বার্থেই ইজনে আমকে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। এখানে মুসল্লীদের স্বার্থটাই প্রধান। বর্তমান পরিস্থিতিতে ইজনে আম নিয়ন্ত্রিত হলেও মুসল্লীদের স্বার্থটা বহাল আছে। সুতরাং স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এ নিয়ন্ত্রণ ইজনে আম পরিপন্থী হবে না।
উল্লেখ্য, মালেকী, শাফিয়ী ও হাম্বলী এ মাজহাবত্রয়ে জুমআ নামাজ সহীহ হওয়ার জন্য ইজনে আমের শর্ত করা হয় নি। উপরন্তু হানাফী মাজহাবের কোনো কোনো ফকীহ এর মতে ইজনে আম শর্ত নয়। যেমন আল্লামা মারগিনানী রহ. ইজনে আমের শর্তটি হিদায়ার ভিতরে উল্লেখ করেন নি। কারণ এটি যাহিরুর রিওয়ায়েতে উল্লিখিত হয় নি। বরং এটি নাওয়াদিরুর রিওয়ায়েতে উল্লিখিত হয়েছে। আলবাহরুর রায়িক ৪/৪২০
ড. ওয়াহবাহ যুহাইলী রহ. বলেন, জুমা নামাজের জন্য রাষ্ট্রপ্রধান বা তার প্রতিনিধির উপস্থিতি এবং তাদের পক্ষ থেকে ইজনে আম- হানাফিয়া ব্যতীত অন্যরা এ দুটি শর্ত আরোপ করে নি। আলফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু ২/২৫০ (দারুল ফিকর)
সারকথা, যেসব জায়গায় জুমু‘আ সহীহ হওয়ার শর্ত পাওয়া যায় সেসব জায়গায় সরকারের বেঁধে দেয়া নিয়ম অনুযায়ী অনুর্দ্ধ ১০ জন লোক মিলে যথারীতি জুমু‘আর নামায আদায় করলে জুমুআ আদায় হবে। এখানে ইজনে আম বিধি লঙ্ঘিত হবে না। মুফতী তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহুসহ ভারত উপমহাদেশের অধিকাংশ মুফতীয়ানে কেরাম উপরোক্ত অভিমত গ্রহণ করেছেন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজেদের বাসা বাড়িতে জুমুআর নামায আদায়
আবু রাফি ও আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত আছে, তাঁরা উমর রা. এর নিকট জুমার নামাজের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে চিঠি পাঠালেন। তখন উমর রা. লিখে পাঠালেন, তোমরা যেখানেই থাকো জুমার নামায আদায় করো। মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবাহ, হাদীস ৫০৬৮
যে প্রয়োজনে একই শহরে একাধিক মসজিদে জুমার নামাজের অনুমতি দেয়া হয়েছে সে প্রয়োজনটা যদি এখনো বিদ্যমান থাকে তাহলে মসজিদ ব্যতীত বড় বড় স্পেসে জুমা বৈধ হওয়ার কথা। কারণ এখন দেখা যায় জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে মসজিদগুলোতে জুমার দিনে জায়গা সংকুলান হয় না। অনেক মানুষ জায়গা সংকুলানের অভাবে জুমা আদায় করতে পারে না। তো দেখা যাচ্ছে, এখন প্রয়োজনটা বিদ্যমান। সুতরাং স্বাভাবিক অবস্থায় নিজস্ব পরিমণ্ডলে বড় স্পেসে জুমা আদায় বৈধ হওয়ার কারণ এখনো বিদ্যমান। সুতরাং বর্তমান বিশেষ এ পরিস্থিতিতে জুমার মসজিদে মুসল্লীদের সংখ্যা সীমিত করার কারণে অসংখ্য মানুষ জুমা নামাজ আদায় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সুতরাং বর্তমানে নিজস্ব পরিমণ্ডলে আশে পাশের লোকজন নিয়ে জুমার নামাজ আদায় বিধিত হবে বলেই মনে হয়। আর এ কথা ফিকহের গ্রন্থগুলোতে স্পষ্ট করেই বলা আছে, জুমা নামাযের জন্য মসজিদ জরুরী নয়।
তবে হানাফী মাসলাকে জুমার নামাজ সহীহ হওয়ার জন্য রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমোদন ও অনুমতি আবশ্যক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানে মসজিদ ব্যতীত বাসা বাড়ি বা অন্যত্র যেহেতু জুমা নামায আদায়ে সরকারী অনুমতি নেই সে হিসেবে বাসা বাড়িতে জুমা নামাজ আদায় করা সহীহ না হওয়ার কথা। মুফতী তাকী উসমানী হাফিযাহুল্লাহসহ অনেক মুফতীয়ানে কেরাম এ ফতওয়া প্রদান করেছেন। সুতরাং প্রশাসনিক অনুমোদনকে যদি জুমা সহীহ হওয়ার জন্য আবশ্যকীয় শর্ত হিসেবে গ্রহণ করা হয় তাহলে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে মসজিদ ব্যতীত অন্য যে কোনো জায়গায় জুমা সহীহ হওয়ার কথা নয়। যেসকল মুফতিয়ানে কেরাম বর্তমানে মসজিদ ব্যতীত বাসা বাড়ি বা অন্যত্র জুমা নামায আদায়কে সহীহ বলেন তারা যদি জমুআ সহীহ হওয়ার জন্য প্রশাসনিক অনুমোদনকে আবশ্যকীয় শর্ত হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন তবে তাদের নিকটও আমাদের বাংলাদেশে মসজিদ ব্যতীত অন্য কোথাও জুমা নামাজ সহীহ হওয়ার কথা নয়। কারণ বর্তমানে বাংলাদেশে মসজিদ ব্যতীত অন্য কোথাও জুমা নামাজ প্রশাসনিকভাবে অনুমোদিত নয়। ০৬.০৪.২০২০ ইংরেজি তারিখে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে পরিষ্কার বলা হয়েছে, ভয়ানক করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধকল্পে মসজিদের ক্ষেত্রে খতীব, ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমগণ ব্যতীত অন্য সকল মুসল্লীকে সরকারের পক্ষ থেকে নিজ নিজ বাসস্থানে নামাজ আদায় এবং জুমআর নামাজে অংশগ্রহণের পরিবর্তে ঘরে যোহরের নামায আদায়ের নির্দেশ দেয়া যাচ্ছে।
এখানে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, জুমআর নামাজে অংশগ্রহণের পরিবর্তে ঘরে যোহরের নামায আদায়ের নির্দেশ দেয়া যাচ্ছে। সুতরাং পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, বর্তমানে বাসা বাড়িতে জুমার নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক অনুমোদন নেই। অতএব জুমা সহীহ হওয়ার জন্য প্রশাসনিক অনুমোদন আবশ্যক হলে বর্তমানে বাসা বাড়িতে জুমা নামাজ আদায় সহীহ হওয়ার কথা নয়। তবে উপরোক্ত মুফতিয়ানে কেরাম যদি জুমা সহীহ হওয়ার জন্য প্রশাসনিক অনুমোদনকে আবশ্যক হিসেবে গ্রহণ না করেন তবে আলাদা কথা।
জুমা সহীহ হওয়ার জন্য প্রশাসনিক অনুমোদন কি আবশ্যকীয় শর্ত?
সাধারণভাবে হানাফী মাসলাকের ফিকহী কিতাবগুলোতে জুমা নামাজ সহীহ হওয়ার জন্য রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতিকে আবশ্যকীয় শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কোথাও রাষ্ট্রপ্রধা বা তার প্রতিনিধির উপস্থিতির শর্তের সাথে শর্তটি পরোক্ষভাবে উল্লিখিত হয়েছে। কোথাও আবার ‘ইজনে আম তথা উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার’ এর সাথে ‘রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষ থেকে’ কথাটি যুক্ত করে শর্তটিকে উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে। স্বতঃসিদ্ধ কথা, বর্তমানে জুমা নামাজ সহীহ হওয়ার জন্য রাষ্ট্রপ্রধান বা তার প্রতিনিধির উপস্থিতির শর্তটি প্রযোজ্য নয়। উপরন্তু ফুকাহায়ে কেরাম এটিকে ব্যবস্থাপনাগত শর্ত বলে উল্লেখ করেছেন। সম্ভাব্য গোলযোগ নিরোধকল্পে সতর্কতামূলকভাবে এ শর্তটি আরোপের কথা বলেছিলেন ফুকাহায়ে কেরাম। এটা আবশ্যকীয় শর্ত হলে বর্তমানে জুমা সহীহ হওয়ার কথা ছিলো না। কারণ বর্তমানে অনুষ্ঠিত জুমাগুলোতে রাষ্ট্রপ্রধান বা তার প্রতিনিধিদের উপস্থিতি থাকে না। সুতরাং রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমোদন বিষয়ক শর্তটি যদি রাষ্ট্রপ্রধান বা তার প্রতিনিধির উপস্থিতি বিষয়ক শর্তটির অধীন বা অনুগামী হয় তাহলে বর্তমানে জুমা নামাজ সহীহ হওয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক অনুমোদনের শর্তটিও প্রযোজ্য হবে না। কারণ মূল শর্ত রহিত হলে অধীন শর্তও আবশ্যিকভাবে রহিত হয়ে যাবে। আর যদি প্রশাসনিক অনুমোদনের শর্তটিকে ইজনে আমের সাথে সংশ্লিষ্ট করা হয় তাহলে এখানেও কথা থেকে যায়। প্রথমত অনেক ফুকাহায়ে কেরামই জুমা নামাজ সহীহ হওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় অনুমোদনকে আবশ্যকীয় শর্ত হিসেবে গ্রহণ করেন নি। তারা বলেছেন, প্রশাসনিক অনুমোদনের শর্তটি পূর্বযুগের জুমা ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট। যখন মসজিদকেন্দ্রিক যাবতীয় কার্যক্রম প্রশাসনিকভাবেই সম্পন্ন হতো। তখন বেসরকারী মসজিদের ব্যবস্থা ছিলো না। মসজিদ নির্মাণ, জুমা জামাতের ব্যাবস্থাপনা, ইমাম খতীব ও মসজিদ স্টাফ নিয়োগসহ যাবতীয় কার্যক্রম রাষ্ট্রীয়ভাবেই সম্পন্ন করা হতো। রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমোদনের ব্যপারটি তখনকার যুগের সাথে সংশ্লিষ্ট। বর্তমান যুগে যেহেতু সুন্দর সে ব্যবস্থাপনা নেই; বরং অধিকাংশ মসজিদগুলোই বেসরকারীভাবে পরিচালিত হয়। তাই ইজনে আমের শর্তটি মসজিদ কর্তৃপক্ষের সাথে সংশ্লিষ্ট হবে; রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের সাথে নয়।
কিতাবুল আসলে রয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রপ্রধান, তার প্রতিনিধি, আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য অথবা প্রশাসকের অনুমতি ব্যতীত লোকদেরকে নিয়ে জুমার নামায আদায় করে তাহলে তাদের জুমা নামায সহীহ হবে না। শামসুল আয়িম্মাহ হালওয়ানী রহ. বলেন, এ মাসআলাটি তাদের যুগের প্রচলন ও রীতি বিবেচনায় সঠিক। কারণ তাদের যুগে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যগণ ও প্রশাসকগণ জুমা নামায ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনাগত কার্যক্রমের ব্যবস্থাপক ও তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। কিন্তু আমাদের যুগে তারা এসব কাজের ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধান করেন না। আলমুহীতুল বুরহানী ফিল ফিকহিন নু’মানী ২/৬৯ (দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বইরুত, লেবানন), ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ২/৫৫৬ মাসআলা নাম্বার ৩২৮০ (মুফতী শাব্বির আহমাদ কাসেমী কর্তৃক তারতীব ও তাহকীক কৃত, মাকতাবায়ে যাকারিয়া, দেওবন্দ)
আদদুররুল মুখতার কিতাবে ইজনে আমের শর্তটি উল্লেখ করে এর সাথে ‘ইমামের পক্ষ থেকে’ কথাটি যুক্ত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনে আবিদীন শামী রহ. বলেন, ‘ইমামের পক্ষ থেকে’ এ কথাটি যুক্ত করা হয়েছে মূলত আগত উদাহরণ বিবেচনায়। নতুবা ইজন আম দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, জুমার নামাযের আয়োজক কর্তৃপক্ষের অনুমতি। কারণ ‘বুরজান্দী’তে রয়েছে, কিছু লোক যদি জামে মসজিদে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দেয় এবং তাতে নামাজ আদায় করে তবে জায়েয হবে না।–রদ্দুল মুহতার ২/১৫৩ (এইচ. এম. সাঈদ কোম্পানী)
তার মানে কিছু লোক দরজা বন্ধ না করে যদি উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়ে দেয় তবে তাদের জুমা নামাজ সহীহ হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে শাসক শ্রেণীর অনুমোদন গ্রহণ না করা হলে জুমা আদায়ে কোনো সমস্যা হবে না।
ইমদাদুল আহকামে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমতি ব্যতীত মসজিদ ছাড়া অন্যত্র জুমা সহীহ না হওয়ার বিষয়টি ওই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যেখানে ইসলামী খেলাফতের পক্ষ থেকে প্রশাসক ইত্যাদি নিয়োগ দেয়া হবে। এসব জায়গায় যদি জুমা ছুটে যায় তাহলে প্রশাসকের অনুমোদন ব্যতীত দ্বিতীয় জুমা করা যাবে না। তবে আমাদের দেশে যেহেতু ইমাম নিয়োগের ব্যাপারটি মুসলমানদের সম্মতির উপর নির্ভর করে তাই জুমা ছুটে যাওয়া লোকগুলো কাউকে ইমাম বানিয়ে জুমা আদায় করতে পারবে। যেমন খুলাসাতুল ফাতাওয়ায় রয়েছে, সাধারণ মানুষ যদি এমন কাউকে জুমা নামাযের জন্য ইমাম বানায় যাকে (ইসলামী খেলাফতের পক্ষ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত) প্রশাসকের পক্ষ থেকে অনুমোদন দেয়া হয় নি তাহলে এ নামায জায়েয হবে না। তবে যদি (ইসলামী খেলাফতের পক্ষ থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত) প্রশাসক কিংবা পরলোকগত ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতিনিধি না থাকে এবং সাধারণ মানুষ কাউকে ইমাম বানিয়ে জুমা আদায় করে তবে জরুরতের কারণে এ জুমা জায়েয হবে। আদ্দুররুল মুখতার গ্রন্থেও এমনটি বলা হয়েছে। তাতে আরো বলা হয়েছে, ইবনে জুরুবাস রহ. এর ‘আননুজআহ ফি তাআদদুদিল জুমুআহ’ কিতাবে আছে, জুমার নামায আয়োজন করার জন্য রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমোদনের শর্তটি মসজিদ নির্মাণকালের সাথে সংশ্লিষ্ট। একবার অনুমোদন হয়ে যাওয়ার পর আর এ শর্ত বাকি থাকে না। ইমদাদুল আহকাম ১/৭৮৪ (মাকতাবায়ে দারুল উলূম করাচী)
বস্তুত ইজনে আমের দুটি দিক রয়েছে। ১। দাতাপক্ষ ২। গ্রহীতাপক্ষ। ইজনে আমের গ্রহীতাপক্ষ কারা তা পরিষ্কার। নামাজে আগ্রহী মানুষজনই ইজনে আমের গ্রহীতাপক্ষ। ইজনে আমের দাতাপক্ষ কে? এ প্রশ্নের সহজ উত্তর হলো, মসজিদের যিনি দায়িত্বশীল বা কর্তৃপক্ষ তিনিই হলেন ইজনে আমের দাতাপক্ষ। যিনি মসজিদের সার্বিক দায়িত্বে থাকবেন তিনিই মুসল্লীদেরকে উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার তথা উন্মুক্ত প্রবেশের অনুমতি প্রদান করবেন। পূর্বযুগে মসজিদগুলোর কর্তৃপক্ষ হতো রাষ্ট্রপ্রধান। রাষ্ট্রীয়ভাবেই মসজিদগুলোর যাবতীয় কার্যাবলী সম্পন্ন হতো। সুতরাং কর্তৃপক্ষ হিসেবে তখন রাষ্ট্রই মসজিদে মুসল্লীদের প্রবেশের অনুমতি প্রদান করতো। কিন্তু একসময় এসে এ ধারা বন্ধ হয়ে যায়। রাষ্ট্র সকল মসজিদের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করে না। সাধারণ মানুষই ব্যক্তিগতভাবে মসজিদ নির্মাণসহ এতদ সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করা শুরু করে। যেমনটি বর্তমানে লক্ষ্য করা যায়। ফলে সাধারণ মুসল্লীদেরকে ব্যাপক অনুমোদনের বিষয়টি রাষ্ট্রের হাত থেকে মসজিদ কর্তৃপক্ষ সাধারণ মানুষের হাতে চলে আসে। সুতরাং এখন ইজনে আমের বিষয়টি আর রাষ্ট্রের সাথে সংশ্লিষ্ট হবে না; বরং সাধারণ মসজিদ কর্তৃপক্ষের সাথে সংশ্লিষ্ট হবে। তবে যেসকল মসজিদ রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত হয় সেসকল মসজিদের ইজনে আমের বিষয়টি রাষ্ট্রের সাথেই সংশ্লিষ্ট থাকবে। হ্যা, একথা ঠিক, রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তিগত কাজেও রাষ্ট্র জাতীয় স্বার্থে হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাখে। সে হিসেবে মসজিদ কর্তৃপক্ষের দেয়া ইজনে আমেও রাষ্ট্র জাতীয় স্বার্থে হস্তক্ষেপ করতে পারে। সে কারণে ইজনে আমটা রাষ্ট্রের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে যাবে না। সুতরাং ফিকহের কিতাবগুলোতে যে ইজনে আমকে রাষ্ট্রের সাথে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে সেটা করা হয়েছে কাল বিবেচনায়। অর্থাৎ তখন মসজিদগুলোর কর্তৃপক্ষ ছিলো রাষ্ট্র তাই ফুকাহায়ে কেরাম ইজনে আমকে রাষ্ট্রের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। ইজনে আমের সাথে রাষ্ট্রপ্রধানের সম্পৃক্তিটা ছিলো আরবী ব্যকরণিক ভাষায় কয়দে ইত্তেফাকী; কয়দে ইহতেরাযী নয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রপ্রধানের শর্তটা ছিলো ঘটনাক্রমিক; আবশ্যকীয় ছিলো না।
উল্লেখ্য, মালেকী, শাফিয়ী ও হাম্বলী এ মাজহাবত্রয়ে জুমআ নামাজ সহীহ হওয়ার জন্য ইজনে আমের শর্ত করা হয় নি। উপরন্তু হানাফী মাজহাবের কোনো কোনো ফকীহ এর মতে ইজনে আম শর্ত নয়। যেমন আল্লামা মারগিনানী রহ. ইজনে আমের শর্তটি হিদায়ার ভিতরে উল্লেখ করেন নি। কারণ এটি যাহিরুর রিওয়ায়েতে উল্লিখিত হয় নি। বরং এটি নাওয়াদিরুর রিওয়ায়েতে উল্লিখিত হয়েছে। আলবাহরুর রায়িক ৪/৪২০
ড. ওয়াহবাহ যুহাইলী রহ. বলেন, জুমা নামাজের জন্য রাষ্ট্রপ্রধান বা তার প্রতিনিধির উপস্থিতি এবং তাদের পক্ষ থেকে ইজনে আম- হানাফিয়া ব্যতীত অন্যরা এ দুটি শর্ত আরোপ করে নি। আলফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু ২/২৫০ (দারুল ফিকর)
সুতরাং উপরোক্ত বিবেচনা মতে বর্তমান পরিস্থিতিতে যেসব জায়গায় জুমুআর নামায জায়েয হওয়ার শর্ত পাওয়া যায় সেসব জায়গার লোকজন যদি মসজিদে জুমুআ আদায় করতে না পারে তাহলে তারা জুমা সহীহ হওয়ার অন্যান্য শর্ত পূরণ সাপেক্ষে নিজেদের বৈঠকখানা, ড্রইংরুম বা অন্য কোনো বড় স্পেসে জুমার নামায আদায় করলে জুমা সহীহ হয়ে যাবে বলে মনে হয়। মুফতী আব্দুস সালাম চাটগামী হাফিযাহুল্লাহ ও মুফতী মনসূল হক হাফিযাহুল্লাহসহ প্রমুখ মুফতিয়ানে কেরাম উপরোক্ত অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
তবে যেসকল মুফতিয়ানে কেরাম বর্তমানে বাসা বাড়িতে জুমা হবে না বলে ফতওয়া দিয়েছেন তাঁরা এ ফতওয়া দেয়ার সাথে সাথে এ কথাও বলেছেন, ‘এই মাসআলাটিতে যে কোনো বিজ্ঞ মুফতি সাহেবের দ্বিমত পোষণের অবকাশ রয়েছে। বিজ্ঞ কোনো মুফতি সাহেব যদি ঘড়বাড়িতে জুমা পড়ার ফতোয়া দেন সে ফতোয়ার ভিত্তিতে যারা জুমা ‘ আদায় করবেন তাদের জুমা’ও আদায় হয়ে যাবে।’
বর্তমান পরিস্থিতিতে ঘরে জামাত করা
জামাআতের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে আদায় করা ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শরীয়ত গৃহীত ওযর ছাড়া মসজিদের জামাআত পরিত্যাগ করা মারাত্মক গুনাহের কাজ। এখানে মূলত দুটি কর্তব্য। একটি হলো, জামাতের সাথে নামাজ আদায় করা। আরেকটি হলো মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করা। মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করা হলে দুটি কর্তব্যই পালিত হয়। পক্ষান্তরে ঘরে জামাত করা হলে একটি পালিত হয়, অন্যটি পালিত হয় না। ফুকাহায়ে কেরামের দৃষ্টিতে কার্যত উভয়টিই ওয়াজিব। সুতরাং কোনো কারণে মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে নামায আদায় করা যদি সম্ভব না হয় এবং ঘরে জামাতের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় তাহলে ঘরেই জামাতের সাথে নামাজ আদায় করা কর্তব্য।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে উলামায়ে কেরাম শরীয়তের মূলনীতি অনুসারে মানুষের সুস্থতা ও প্রাণ রক্ষার প্রয়োজনে মসজিদে জামাআত সীমিত করার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। পাশাপাশি জনস্বার্থে সরকারের নিষেধাজ্ঞাও জারি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে যারা মসজিদের জামাতে অংশগ্রহণ করতে পারছে না তাদের জন্য কর্তব্য হলো নিজ নিজ ঘরে জামাআতের সাথে নামায আদায় করা। এতে কর্তব্য পালনের পাশাপাশি একাকী নামায আদায়ের চেয়ে অনেক বেশি সওয়াব লাভ হবে বলে আশা করা যায়।
ঘরে জামাআতের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো লক্ষণীয়,
ক. মহল্লার আযান ইকামাত যদিও যথেষ্ট, তবু আযান-ইকামত উভয়টি দিয়ে নেয়া ভালো।
বাদায়িউস সানায়ে’ ১/১৫২ (দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ), আল বাহরুর রায়িক ১/২৮০
খ. মুসল্লী হিসেবে শুধু মাহরাম নারীকে নিয়েও জামাআত করা যাবে।
আলমু’জামুল কাবীর লিত্তাবারানী, হাদীস ৬৪০১, তাবয়ীনুল হাকায়িক ১/১৩৩
গ. ইমামের পিছনে পুরুষ থাকলে তিনি ইকামাত দিবেন। পুরুষ না থাকলে ইমাম নিজেই ইকামাত দিয়ে নেবেন।
ঘ. কাতার করার ক্ষেত্রে লক্ষণীয়:
১. ইমামের পিছনে যদি একজন পুরুষ বা বুঝবান বালক থাকে, তাহলে তিনি ইমামের বরাবর ডানে দাঁড়াবেন।
২. যদি একাধিক পুরুষ বা বুঝবান বালক থাকে, তাহলে ইমাম সামনে এগিয়ে দাঁড়াবেন। আর অন্যরা পিছনে দাঁড়াবেন।
৩. ইমামের সাথে পুরুষের পাশাপাশি যদি মহিলাও থাকেন, তাহলে মহিলা ভিন্ন কাতারে পুরুষের পিছনে দাঁড়াবেন।
৪. ইমামের পিছনে যদি শুধু মাহরাম মহিলা থাকেন, কোনো পুরুষ না থাকেন, তাহলে তিনি ইমামের পিছনে দাঁড়াবেন। মাহরাম মহিলার সাথে গাইরে মাহরাম মহিলা যুক্ত হলে তিনিও পিছনে পর্দা রক্ষা করে দাঁড়াবেন।
৫. পুরুষের জন্য শুধু গাইরে মাহরাম নারীর ইমামতি মাকরুহ। এক্ষেত্রে জামাআত না করে প্রত্যেকে আলাদা নামায পড়ে নেওয়া কর্তব্য। -বাদায়িউস সানায়ে’ ১/১৫৯ (দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ)
বর্তমান পরিস্থিতিতে জুমার দিনে ঘরে জোহর নামাজের জামাতের বিধান
বর্তমান পরিস্থিতিতে জুমার দিন মসজিদে জুমা আদায় করা সম্ভব না হলে সংশ্লিষ্ট শর্ত পালন সাপেক্ষে নিজস্ব পরিমণ্ডলে জুমা নামায আদায় করার চেষ্টা করবে। যদি জুমা নামায আদায় করা সম্ভব না হয় তাহলে বিশেষ এ পরিস্থিতিতে জামাতের সাথে জোহর নামায আদায়েরও সুযোগ আছে। স্বাভাবিক অবস্থায় জুমার দিনে ঘরে জামাতের সাথে জোহর নামায আদায় করাকে ফুকাহায়ে কেরাম মাকরুহ লিখেছেন। মাকরুহ হওয়ার কারণ লিখেছেন, এতে করে মসজিদের জুমার নামাজে প্রভাব পড়বে। মানুষ জুমায় না গিয়ে ঘরেই জামাতের সাথে জোহর পড়ে নিবে। এতে জুমায় লোক সমাগমে ঘাটতি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। অথচ জুমার অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হলো, ব্যাপক হারে লোকজনের সমাগম। উপরন্তু জুমার দিনে ঘরে জামাতের সাথে জোহর নামায আদায় করা হলে জুমার জামাতের সাথে দৃশ্যত একটা বৈপরীত্ব ও সাংঘর্ষিকতা দেখা দেয়। এ দুটি কারণেই মূলত ফুকাহায়ে কেরাম জুমার দিনে জামাতের সাথে জোহর নামায আদায়কে মাকরুহ বলেছেন। এ দুটি কারণ বর্তমান পরিস্থিতিতে পাওয়া যায় না। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে জুমার দিনে ঘরে জামাতের সাথে জুমা আদায় করার অবকাশ আছে বলে মনে হয়।
ফুকাহায়ে কেরামের মতে জুমার দিনে মা’জুর বা ওজরগ্রস্থদের জন্য বিধান হলো, তারা ঘরে জোহর নামাজ একাকী পড়বে; জামাতে নয়। এ মাসআলাটি প্রায় সব ফিকহ গ্রন্থেই উল্লিখিত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে ফিকহের গ্রন্থগুলোতে জুমার দিনে জামাতের সাথে জোহর নামায আদায় মাকরুহ হওয়ার তিনটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। ১। এতে জুমার নামাযে লোকসমাগম কম হবে। ২। কখনো ওজরগ্রস্থ নয় এমন ব্যক্তির ওজরগ্রস্থ ব্যক্তির এক্তেদা করার অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। ৩। ভিন্ন জামাত করা হলে জুমার নামাযের সাথে বাহ্যত দ্বান্দ্বিকতা সৃষ্টি হবে।- হাশিয়াতুত তহতবী আলা মারাকিল ফালাহ ৫২২
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে জুমার দিনে স্বতন্ত্র জামাতের সাথে ঘরে জোহর নামাজ আদায় করা হলে উপরোক্ত কারণগুলো পাওয়া যায় না। প্রথমত এক্ষেত্রে জুমার নামাজে লোক সমাগম কম হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। তালাবদ্ধ হওয়ার কারণে মসজিদে নির্ধারিত সংখ্যার অতিরিক্ত প্রবেশের কোনো সুযোগই নেই। এখানে প্রশাসনিক কারণে লোকসংখ্যা কম হওয়া আবশ্যক। অতিরিক্ত হওয়াটাই নিষিদ্ধ। সুতরাং ঘরে স্বতন্ত্র জোহর নামাজের জামাত করা হলে জুমায় লোকসংখ্যা কম হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত ওজরগ্রস্থ নয় এমন ব্যক্তির ওজরগ্রস্থ ব্যক্তির এক্তেদা করার বিষয়টি বর্তমানে পাওয়া যাবে না। কারণ যারা বাসা বাড়িতে জামাতের সাথে জোহর পড়বে তারা সবাই ওজরগ্রস্থ। তাদের জন্য মসজিদে প্রবেশের সুযোগ নেই। তৃতীয়ত বর্তমানে বাড়িতে জোহরের জামাত করার ফলে দ্বান্দ্বিকতাও তৈরি হবে না। কারণ যারা জামাত করবে তারা তো মসজিদে যেতেই পারছে না। আল্লামা শামী রহ. বলেন, কিছু শহরবাসীদের যদি জুমা ছুটে যায় তবে তাদের জন্য জামাতের সাথে জোহর নামায আদায় করা মাকরুহে তানযিহী। কারণ এখানে জুমার নামাযে জনসংখ্যা কমানো তদ্রূপ জুমা নামাযের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা পাওয়া যায় না। মুযমারাত এর উদ্ধৃতিতে কুহুস্তানীতে এর সমর্থন রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, তারা উত্তম হিসেবে একাকী নামায আদায় করবে। রদ্দুল মুহতার ২/১৫৮
উপরন্তু ফুকাহায়ে কেরাম মূলত জুমার নামাজে উপস্থিত হতে অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য বাসা বাড়িতে জামাতের সাথে জোহরের নামাজ আদায়কে মাকরুহ বলেন নি; বরং মসজিদে জামাতের সাথে জোহর নামায আদায়কে মাকরুহ বলেছেন। যেমন আলইখতিয়ার লিতা’লীলিল মুখতার এর মুসান্নিফ ইমাম আব্দুল্লাহ বিন মাহমূদ আলমাওসিলী রহ. বলেন, ওজরগ্রস্থ ব্যক্তিদের জন্য জুমার দিনে শহরে জামাতের সাথে জোহর নামাজ আদায় করা মাকরুহ। কারণ এতে জুমার নামাযে সমস্যা তৈরি হয়। উপরন্তু তাদের পেছনে এমন ব্যক্তিরা এসে এক্তেদা করে যারা ওজরগ্রস্থ নয়। সর্বযুগে সব শহরে সম্মিলিত কর্মধার মাধ্যমে এ নীতি চলে আসছে যে, জুমার নামাজের সময় অন্যান্য সকল মসজিদ বন্ধ থাকতো। অথচ সেখানে ওজরগ্রস্থ ব্যক্তিরাও ছিলো। যদি জুমার দিনে জামাতের সাথে জোহর নামাজ আদায় করা মাকরুহ না হতো তবে এসকল মসজিদ বন্ধ করা হতো না। আলইখতিয়ার লিতা’লীলিল মুখতার ১/১৪৪ (দারুল হাদীস, কায়রো, মিশর)
ফিকহী এ বিবরণ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মা হচ্ছে, জুমার দিন ওজরগ্রস্থ ব্যক্তিদের জন্য মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে জোহর নামাজ আদায় করা হলো মাকরুহ। কারণ তখন জুমা নামাজের সাথে বাহ্যত প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি হয়। সাথে সাথে যারা ওজরগ্রস্থ নয় এমন লোকও তাদের পেছনে এক্তেদা করার সম্ভাবনা তৈরি হয়। জুমার দিন মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে জোহর নামাজ আদায় করার ক্ষেত্রে মাকরুহ হওয়ার এসব কারণগুলো প্রযোজ্য হয়। ঘরের ভিতরে জামাত করা হলে সে কারণগুলো প্রযোজ্য হয় না।
তাছাড়া যদি এমন ইমামের পেছনে ওজরের কারণে জুমা পড়া হয় যে ইমামের পেছনে জুমা পড়া হলে পুনরায় তা পড়া আবশ্যক হয় তাহলে অন্যত্র জামাতের সাথে জোহর নামাজ আদায় করার বিষয়টি সাহাবায়ে কেরাম ও তাবিয়ীন থেকে প্রমাণিত। যেমন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. আবুযর রা. হাসান ইবনে উবাইদুল্লাহ, ইয়াস ইবনে মুআবিয়াহ রা. ওজরের কারণে জুমা পড়ে পরবর্তীতে জোহর নামাজ জামাতের সাথে আদায় করেছেন। আলমুগনী লিইবনে কুদামাহ ২/১৯৯
মুফতী মীযানুর রহমান সাঈদ হাফিযাহুল্লাহ এ মাসআলা প্রসঙ্গে বলেন, ‘যুহরের নামাজ তিন কারণে জামাতে নয় একাকী আদায় করবে, যেমন তাহতাবীতে উল্লেখ হয়েছে। উপরোক্ত তিনটি কারণ বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদ্যমান না থাকায় জামাতের সহিত জোহর পড়া বৈধ হবে। সাধারণ অবস্থায় এমদাদুল আহকামে আল্লামা শামীর বরাতে জামাতে যুহর পড়াকে যদিও মাকরুহে তানযীহি বলা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে উক্ত কারণগুলো বিদ্যমান না থাকায় (ইল্লত মাফকূদ হওয়ায় ) মাকরুহে তাহযীহিও আর থাকবে না। বিশ্ববরেণ্য মুফতি শাইখুল ইসলাম আল্লামা তাকী উসমানি, শাহী মুরাদাবাদের মুফতি শাব্বির আহমদ কাসেমী প্রমুখ এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আমি নিজেও এ ফতোয়ার সাথে একাত্মতা পোষণ করি।’ http://www.ourislam24.com/
শেষ কথা
বর্তমান ভয়াবহ পরিস্থিতিটা নতুন প্রকৃতির। সুতরাং ফিকহ ফতওয়া সংশ্লিষ্ট গ্রন্থের বক্তব্যগুলো নতুন এ পরিস্থিতির সাথে সবদিক দিয়ে প্রয়োগিক হবে তা জরুরি নয়। বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় মুফতিয়ানে কেরাম কুরআন সুন্নাহ, ফিকহী বক্তব্য ও নীতিমালার আলোকে মাসআলা ইস্তেম্বাত করছেন। স্বভাবগতভাবেই এ এস্তেম্বাতের ফলাফল এক ও অভিন্ন হওয়া জরুরী নয়। ইস্তেম্বাতের ফলাফল একাধিক হওয়াটাই স্বাভাবিক। সুতরাং ইস্তেম্বাতপ্রসূত ফলবৈচিত্র নিয়ে বিরূপ মন্তব্য ও সমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গি লালন করা আদৌ কাম্য নয়। এসব ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ, গ্রহণযোগ্য যে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক আহলে ইলম মুফতীর বক্তব্য গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। স্বয়ং শাইখুল ইসলাম আল্লামা তাকী উসমানি হাফিযাহুল্লাহও তার লিখিত ফতওয়ায় মতপার্থক্যের বিষয়টি খুব শ্রদ্ধার সাথে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তবে যেহেতু এটি ইজতেহাদী বিষয় তাই কোনো নির্ভরযোগ্য আলেম দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে ভিন্নমত পোষণ করলে সেটা মানারও সুযোগ আছে।’
তবে এটা স্বতঃসিদ্ধ কথা, দেশের শীর্ষস্থানীয় মুফতিয়ানে কেরাম এক হয়ে একই সাথে স্বাস্থ্যবিধি ও রাষ্ট্রবিধি বিবেচনায় নিয়ে শরীয়াসম্মত সম্মিলিত একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারলে খুবই কল্যাণকর হতো।