সৈয়দ এনায়েতুল্লাহ
অজ্ঞতা এবং ধর্মীয় জ্ঞানান্বেষণে বিমুখতা আজ মুসলমানগণকে স্বকীয়তা থেকে বহু দূরে নিয়ে গিয়েছে। এতে মুসলমানগণের গৌরব ও সম্মান বিনষ্ট হয়েছে ও হচ্ছে। নিজের অজান্তে অন্ধভাবে বিধর্মীদের কৃষ্টি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও ক্রীড়ার অনুশীলন করে মুসলমানগণ তাদের এজেন্ট হয়ে নিজেদের নীতি বিসর্জন দিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুসলমানগণ জেনে-শুনেই বিধর্মীদের সংগঠনের প্রতিনিধি(এজেন্ট) নিয়োজিত হয়ে নিজের দ্বীনের বদলে প্রচারক হচ্ছে তাদের কৃষ্টি, শিক্ষা ও সংস্কৃতির।
বিধর্মীগণের বিভিন্ন কৃষ্টি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতি সংক্রান্ত স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক সংগঠন ও সংস্থার প্রতিনিধি ও সদস্য হয়ে মুসলমানগণ তাদের নীতির ধারক, বাহক ও প্রচারক হচ্ছে। কিন্তু ইসলামের স্বর্ণযুগে মুসলমানগণের অবস্থা ছিল পূর্ণ ইসলামি রীতি-নীতিতে পরিপূর্ণ। নীতির প্রশ্নে তাঁদের কোনো ছাড় ছিল না।
হযরত ওমর রা. যিনি খলীফাতুল মুসলিমীন, যাঁর ভয়ে রোম ও পারস্য সাম্রাজ্য প্রকম্পিত, তিনি যাচ্ছেন বায়তুল মুকাদ্দাসে। প্রথমে ঘোড়ায় আরোহণ করলেন। এতে কিছুটা পার্থিব গর্ব অনুভব হচ্ছিল দেখে উট নিলেন। তাও মাত্র একটি। শরীরে জোড়াতালি লাগানো সাধারণ কাপড়ের জামা। পানির একটি মশক এবং খেজুরের একটি থলে উটের পিঠে ঝুলানো।
একদিন হযরত ওমর রা. উটে আরোহণ করবেন, খাদেম লাগাম ধরে টানবেন। পরদিন খাদেম আরোহণ করবেন এবং হযরত ওমর রা. উটের লাগাম ধরে টানবেনÑএ শর্তে পালাক্রমে উটে চড়ে একদিন মনিব আর একদিন খাদেম চলতে লাগলেন বায়তুল মুকাদ্দাসের অভিমুখে।
বায়তুল মুকাদ্দাসের অধিবাসীগণ অধীর আগ্রহে আমীরুল মুমিনীনেরআগমনের অপেক্ষায় ছিল। তাদের ধারণা মুসলমানের বাদশাহ্, আমীরুল মুমিনীনের আগমন বাদশাহীসুলভঅতি জাঁকজমকপূর্ণ হবে। তিনি শত শত প্রহরীর প্রহরাধীন মূল্যবান পোশাকে সজ্জিত হবেন ধারণা করে দূর-দূরান্ত হতে তামাশা দেখার উদ্দেশ্যে লোকজন সমবেত হয়েছিল। স্বয়ং মুসলমানগণও আকাঙ্ক্ষা করছিল যে, আমীরুল মুমিনীন ভালো পোশাকে এবং ঘোড়ায় আরোহণ করে আসুন। কিন্তুহযরত ওমর রা. তা করেননি।
যেদিন হযরত ওমর রা. বায়তুল মুকাদ্দাস পৌঁছলেন, সেদিন খাদেমের উটের পিঠে চড়ার পালা ছিল। খাদেম অনুরোধ জানিয়ে বললেন, ‘আজ আপনি উটে আরোহণ করুন, আমি লাগাম ধরে টানি। কারণ, আপনি আমীরুল মুমিনীন হিসাবে লাগাম টেনে বায়তুল মুকাদ্দাসে গমন করবেন আর আমি আপনার খাদেম হয়ে উটে আরোহী থাকব, এটা কখনও হতে পারে না।’ হযরত ওমর রা. খাদেমের অনুরোধ অগ্রাহ্য করে বললেন, ‘আজ লাগাম টানার পালা আমার বলে কী হয়েছে? এতে অসম্মানের কী আছে? যেদিন যার পালা সে হিসাবে কাজ চলবে।’ খাদেম শেষ পর্যন্ত আরজ করল, ‘আমি আমার পালা আপনাকে দান করলাম। আপনি আরোহণ করুন, আমি লাগাম টানি।’ হযরত ওমর রা. বললেন, ‘তুমি তোমার আরোহণের পালা আমাকে দান করেছ সত্য, আমি কিন্তু আমার লাগাম টানার পালা তোমাকে দিব না। কারণ, পরবর্তীকালে লোকে বলবে যে, সরদার হলে একদিন বেশি পায়। তাই তুমি তোমার পালায় থাক আর অমি আমার পালায় থাকি।’ অবশেষে খাদেম বললেন, ‘তাহলে আপনি লাগাম টেনে যান, আমি পায়ে হেটে যাব।’ হযরত ওমর রা. তাও অস্বীকার করলেন। বাধ্য হয়ে খাদেম উটের পিঠে আরোহণ করলেন এবং হযরত ওমর রা. উটের লাগাম ধরে টেনে টেনে জাবিয়া নামক স্থানে পৌঁছলেন।
বায়তুল মুকাদ্দাসবাসীগণ তখনও বুঝতে পারে নি যে, আমীরুল মুমিনীন এসেছেন। তাদের ধারণা ভিন্নরূপ ছিল। এদিকে মুসলিম সৈনিকগণ পরিস্থিতি বুঝতে পেরে হযরত ওমর রা. কে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে একটি ঘোড়া ও ভালো পোশাক পেশ করলেন। কিন্তু হযরত ওমর রা. এই বলে তাদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন যে, ‘আল্লাহ পাক আমাকে যে সম্মান দান করেছেন, তা একমাত্র ইসলামের মাধ্যমেই দান করেছেন, পোশাকের মাধ্যমে নহে। আমার জন্য আল্লাহ্র দেওয়া সম্মানই যথেষ্ট। এ সম্মানের সম্মুখে বাহ্যিক চাকচিক্য কোনো জিনিসই নহে।’ অতঃপর ফরমাইলেন, ‘তোমাদিগকে দেখে আমার দুঃখ হচ্ছে যে, তোমরা অতি শীঘ্রই ইসলামি ধারার সরল পথ ত্যাগ করে ভিন্ন জাতির তাহযীব গ্রহণ করছ।’
শেষ পর্যন্ত বায়তুল মুকাদ্দাসবাসীগণ জানতে পারল যে, যে দু’জন লোক উট সহযোগে এসেছেন, যাদেরকে ওমর রা.-এর অগ্রদূত বলে ধারণা করা হয়েছিল, প্রকৃতপক্ষে তাদেরই একজন হলেন হযরত ওমর রা. এবং অপরজন তাঁর খাদেম। তারা হযরত ওমর রা.-এর সাক্ষাৎলাভের উদ্দেশে অগ্রসর হলো। তারা মনে করেছিল যে, উটের পিঠে যিনি আরোহী তিনি স্বয়ং ওমর হবেন। তাই তারা লাগামধারীকে ছেড়ে সওয়ারের দিকে অগ্রসর হলো। কিন্তু পরে তারা জানতে পারল যে, লাগামধারীই হযরত ওমর রা. এবং সওয়ার হচ্ছেন তাঁর খাদেম।
হযরত ওমর রা.-এর সাদাসিধা, অনাড়ম্বর ও নিরহংকার চরিত্র দর্শনে বায়তুল মুকাদ্দাসবাসী অত্যন্ত অভিভূত হয়ে গেল। অনেক লোকের ভীড় হতে লাগল। মুসলমানগণ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে হযরত ওমর রা. নিষেধ করলেন। এরই মধ্যে জনৈক বৃদ্ধ পাদ্রী অত্যন্ত আদবের সাথে এসে বায়তুল মুকাদ্দাসের চাবি হযরত ওমর রা.-এর হাতে অর্পণ করল। হযরত ওমর রা. বিস্মিল্লাহ বলে চাবি গ্রহণ করলেন। {সূত্র:-আশারা মোবাশ্শারা; মাওলানা মোহাম্মদ গরীবুল্লাহ্ ইসলামাবাদী; প্রকাশক: এমদাদিয়া লাইব্রেরীর পক্ষে এটর্নি মোহাম্মদ আবদুল করিম; সংশোধিত মুদ্রণ এপ্রিল, ১৯৯৩; পৃষ্ঠা ৮৮-৯০}
ইসলামের আদর্শের কাছে তৎকালীন সমাজ এবং সহযোগীদের চাহিদা বাহ্যিক চাকচিক্য ঘোড়ায় চড়া, মূল্যবান পোশাক পরিধান করা, উটের পিঠে সওয়ার হওয়া, খাদেমকে লাগাম ধরতে দেওয়া ইত্যাদির কোনো মূল্য ওমর রা.-এর কাছে ছিল না। আল্লাহ্ পাক ইসলামের মাধ্যমে তাঁকে যে সম্মান দিয়েছেন তা নিয়েই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। এ কারণেই তাঁর শাসনামল মুসলমানগণের গৌরবোজ্জ্বল সময় ছিল।
হযরত উসমান গনী রা. হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দূত হিসেবে মক্কায় তাশরিফ নিলেন। সেখানে গিয়ে নিজের চাচাতো ভাইয়ের ঘরে অবস্থান করলেন। সকালে যখন মক্কার সর্দারদের সাথে আলোচনার জন্য ঘর থেকে বের হলেন তখন হযরত উসমান রা.-এর পায়জামা টাখনুর উপরে নিসফে-ছাক্ক ছিল। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ ছিল পায়ের গিরার নীচে পায়জামা লটকানো যাবে না। গিরার উপরে পরতে হবে। তবে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাধারণত স্বভাব ছিল তিনি নিসফে-ছাক্ক তথা হাঁটু ও পায়ের পাতার মাঝামাঝি স্থানে জামা পরতেন। এর নীচে পরতেন না। তাই উসমান গনী রা. এর চাচাতো ভাই বললেন, জনাব! আরবদের রীতি হলো যার জামা ও লুঙ্গী যত বেশি ঝুলন্ত থাকবে তাঁকে ততবেশি মর্যাদাশীল মনে করা হয়। আর সর্দার প্রকৃতির লোকজন নিজেদের জামা ও লুঙ্গী ঝুলিয়ে রাখে। অতএব আপনি যদি জামা উপরে পরিধান করে তাদের নিকট যান তাহলে আপনার কোনো মূল্যায়ন হবে না। চাচাতো ভাইয়ের কথা শুনে হযরত উসমান গনী রা. জবাবে বললেনÑ ‘না, আমি আমার জামা এর চেয়ে নীচে ঝুলাতে পারব না। আমার মুরব্বী রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামা এমনই ছিল। তারা আমাকে ভালো বা মন্দ যাই মনে করুক, আমাকে সম্মান করুক বা অপমান করুক এতে আমার কোনো পরওয়া নেই। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পায়জামা যেমন আমার পায়জামাও তেমনই থাকবে, আমি তো এতে পরিবর্তন করতে পারব না।’[সূত্র:-সীরাতুন্নবী ও আমাদের যিন্দিগী; বিচারপতি আল্লামা মুফতী তকী উসমানী, অনু: মুফতী মোবারক উল্লাহ]
ইরান বিজয়ী হযরত হুযাইফা বিন ইয়ামান রা. কে যখন কিসরা বাদশা তার উপর হামলার সময়ে আলোচনার জন্যে স্বীয় দরবারে ডেকে আনলেন। তিনি সেখানে তাশরিফ নিলেন। পৌঁছার পর প্রথমে তাঁর সামনে খানা হাজির করা হলো। তিনি খানা খাওয়া আরম্ভ করলেন। খাওয়ার সময় তাঁর হাত থেকে একটি লোকমা নীচে পড়ে গেল। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা হলো ‘যদি খাদ্যের কোনো লোকমা নীচে পড়ে যায় তাহলে এটা নষ্ট করবে না, কারণ তা আল্লাহর দেওয়া রিজিক। আর এটাও তোমার জানা নেই যে আল্লাহ তা’আলা কোন অংশে বরকত রেখেছেন, তাই পড়ে যাওয়া লোকমার বেকদরী করবে না বরং তা উঠিয়ে নিবে। যদি কিছু মাটি লেগে থাকে তবে তা পরিস্কার করে খেয়ে নাও।’ তাই যখন লোকমা নীচে পড়ে গেল হুযাইফা রা.-এর উপরোক্ত হাদীস স্মরণ হয়ে গেল। অতএব তিনি পড়ে যাওয়া লোকমা উঠিয়ে নেওয়ার জন্য নীচে হাত বাড়ালেন। তখন তাঁর সঙ্গী তাঁকে কনুই মেরে ইঙ্গিত করলেন যে, এটা তো দুনিয়ার সুপার পাওয়ার কিসরার রাজ দরবার। আপনি যদি এ দরবারে মাটিতে পড়ে যাওয়া লোকমা উঠিয়ে খান তাহলে তাদের ধারণায় আপনাদের কোনো মূল্যায়ন হবে না। আর তারা আপনাদেরকে নীচ লোক মনে করবে। তাই এই দরবারে পড়ে যাওয়া লোকমা তুলে খাওয়ার স্থান নয়, আজ নিয়ম ছেড়ে দিন।
উত্তরে হযরত হুযাইফা বিন ইয়ামান রা. কত সুন্দর কথাই না বললেনÑ ‘আমি কি এসব আহমকদের কথায় সরকারে দু’আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত ছেড়ে দিব? তারা ভালো মনে করুক বা খারাপ মনে করুক, সম্মান করুক বা অপমান করুক আমি কিছুতেই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত পরিহার করতে পারব না।’{সূত্র:-সীরাতুন্নবী ও আমাদের যিন্দিগী; বিচারপতি আল্লামা মুফতী তকী উসমানী, অনুবাদ- মুফতী মোবারক উল্লাহ}
ফলে, তাঁরা সুন্নাতের উপর আমল করে সম্মানিত হয়েছেন আর আমরা সুন্নাত ছেড়ে দিয়ে অপমানিত হচ্ছি। তারা এমন সম্মানিত হয়েছেন যে, একদিকে সুন্নাতের উপর আমল করে লোকমা উঠিয়ে খেয়েছেন, অপরদিকে ইরানের শান-শওকত ও অহংকার মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছেন।
হযরত হুযাইফা বিন ইয়ামান রা. এবং হযরত রাবী বিন আমের রা. যখন ইরানের বাদশার সাথে আলোচনার জন্যে যেতে লাগলেন এবং কিসরার প্রাসাদে প্রবেশ করতে লাগলেন, তখন তারা সাদাসিধে পোশাক পরিহিত ছিলেন। যেহেতু তারা দীর্ঘ সফর করে এসেছিলেন তাই তাদের পোশাক হয়ত কিছুটা ময়লাযুক্ত হয়ে ছিল। গেইটের দারোয়ান তাদেরকে ভিতরে প্রবেশ করতে বাধা দিয়ে বলল, তোমরা এত বড়ো মহান বাদশাহর দরবারে এমন ময়লা পোশাক নিয়ে যাচ্ছ? এই বলে সে বাদশার দেওয়া একটি জুব্বা দিয়ে বলল, আপনি এ জুব্বাটি গায়ে দিয়ে যান। হযরত রাবী বিন আমের রা. সেই দারোয়ানকে লক্ষ করে বলেন, যদি কিসরার দরবারে যাওয়ার জন্যে তাঁর দেওয়া জুব্বা পরা জরুরি হয়ে থাকে তাহলে তার দরবারে যাওয়ার আমাদের কোনো জরুরত নেই। আমরা যদি যাই তাহলে এ পোশাকেই যাবো। আর যদি এ পোশাকে সাক্ষাৎ করতে মঞ্জুর না হয় তাহলে আমাদেরও তার সাথে সাক্ষাৎ করার কোনো আগ্রহ নেই। তাই আমরা ফিরে যাচ্ছি।
যা হোক, দারোয়ান ভিতরে সংবাদ পাঠালেন, অদ্ভুত প্রকৃতির কিছু মানুষ এসেছে যারা আপনার দেওয়া পোশাক পরিধান করে না। তাদের তরবারি দেখতে ভাঙা চুরা মনে হয় কিন্তু মজবুত ঢালকেও দু’টুকরা করে দেয়। অল্প কিছুক্ষণ পরেই তাদের ভিতরে যাওয়ার ডাক আসল। কিসরার রাজ দরবারের নিয়ম ছিল তার দরবারে কেবল সে-ই চেয়ারে বসা থাকবে আর বাকি সব লোক তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। হযরত রাবী বিন আমের রা. কিসরাকে বললেন, আমরা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার অনুসারী, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমাদের একজন বসা থাকবে আর বাকি সব দাঁড়িয়ে থাকবে তা হতে পারে না। তাই আমরা এভাবে আলোচনা করতে রাজি নই। হয়ত আমাদের জন্যেও চেয়ারের ব্যবস্থা করা হবে অথবা কিসরাও আমাদের ন্যায় দঁড়িয়ে থাকবে।
কিসরা বাদশা যখন দেখল যে, তারা তো আমাকে অপমান করতে এসেছে। তাই সে ক্রোধান্বিত হয়ে হুকুমদিল একটি টুকরিতে মাটি ভরে তাদের মাথায় দিয়ে তাদেরকে দরবার থেকে বিদায় করে দাও। নির্দেশমোতাবেক কার্য সমাধা হলো। মাটি ভর্তি টুকরি নিয়ে ফিরে আসার সময় হযরত রাবী বিন আমেররা. বললেন, হে কিসরা! স্মরণ রাখবে যে, তুমি নিজেই ইরানের মাটি আমাদেরকেদিয়ে দিয়েছ। এই বলে রওয়ানা হয়ে গেলেন। ইরানিরা বড়োই সন্দেহভাজন লোক। এবার তারা ভাবতেলাগলো, সে যে বলল, ‘ইরানের মাটি আমাদেরকে দিয়েদেওয়া হয়েছে’ এটাতো আমাদের জন্য বড়ো দুঃখজনক ব্যাপার।
এবার কিসরা
এক লোককে এই বলে তাদের পিছনে দৌড়িয়ে পাঠালেন যে দ্রুত গিয়ে সেই মাটির টুকরিটি ফিরিয়ে নিয়ে আসতে। সে আর রাবী বিন আমের রা. কে কোথায় পায়? মাটি নিয়ে চলে যাওয়ার মাঝে তিনি সফল হয়েছেন। আল্লাহ তাআলা ইরানের মাটিকে এই ভাঙা তলোয়ার ওয়ালাদের জন্যে লিখে দিয়েছেন।{সূত্র:-সীরাতুন্নবী ও আমাদের যিন্দিগী; বিচারপতি আল্লামা মুফতী তকী উসমানী, অনু: মুফতী মোবারক উল্লাহ}
মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াছ রহ. দ্বীন পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয় ছাড়া অন্য কোনো কথা মুখে উচ্চারণ করা তো দূরের কথা, কানে শোনাও পছন্দ করতেন না। খাদেমদের মধ্যে কেউ তার কুশলবার্তা জিজ্ঞাসা করলে জবাব দিতেন, ভাই! সুস্থতা-অসুস্থতা তো মানুষের সঙ্গে সবসময়ই লেগে রয়েছে। এর আবার ভালো বা মন্দ কী থাকতে পারে? কুশল-মঙ্গল তো তখন হবে, যখন আল্লাহ্ পাক যে কাজের জন্য পয়দা করেছেন তা ঠিকমতো আদায় হবে এবং এর দ্বারা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র রূহ শান্তি লাভ করবে।
অসুস্থতার সময়ে কান্দালা হতে মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াছ রহ.-এর কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন তাঁকে দেখতে এলে তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেনÑ কী উদ্দেশে এসেছেন? তারা আরজ করলেন, আপনার কুশলবার্তা জানার জন্য। বললেন, ‘যে মিটিয়ে যাওয়ার জন্য সৃষ্টি হয়েছে, তার কুশলবার্তা জানার জন্য কান্দালা হতে এ পর্যন্ত চলে এসেছেন, আর রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় দ্বীন যা মিটে যাবার নয় অথচ মিটে যেতে বসেছে তোমরা সে ব্যাপারে কোনো খবর রাখ না!’
বর্তমানে মুসলমানগণের অবস্থা কী? ঈমানের কারণে আল্লাহ রব্বুল আলামীন মুসলমানগণকে যে সম্মান দিয়েছেন তা নিয়ে আজ তারা সন্তুষ্ট নন। অমুসলমানগণের কৃষ্টি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতির মধ্যে নিজেদের সার্থকতা খুঁজে আজ মুসলমানগণ অপমানিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছেন।
মুসলমানগণ যখন নামাযে দাঁড়ান তখন পড়ে থাকেন,
আমি একাগ্রতার সাথে স্বীয় মুখম-ল তাঁর দিকে ফিরাচ্ছি যিনি আসমান ও জমিনকে সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরেকদের অন্তর্ভুক্ত নই। (সূরা আনআম ৭৯)।
পার্থিব জীবনে মুশরেকগণের অন্তর্ভুক্ত হয়ে তাদের দল, সংঘ, সংস্থা ইত্যাদির সদস্য হয়ে কাজ করার পর অনন্ত পরকালে তাদের দলভুক্ত না হওয়ার আশা কীভাবে করা যেতে পারে? সুতরাং এ জীবনেই পরকালে কোন দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ইচ্ছা তার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
বিধর্মীদের দেওয়া খেতাব, পদক ইত্যাদির মধ্যেও মুসলমানদের মান মর্যাদা বা সম্মানের কিছু নেই। যাদের নিজেরই জ্ঞানের আলো অর্থাৎ ঈমানের আলো নেই তারা মূর্খ। কুরআন শরীফে আল্লাহ রব্বুল আলামীন বেঈমানগণকে বধির, বোবা, অন্ধ বলে উল্লেখ করেছেন। কুরআনের ভাষায় যারা বধির, বোবা ও অন্ধ তাদের খেতাব ও পদকের আবার কী মূল্য হতে পারে। যাদের ঈমান নেই তাদের পরকালে বিচার নেই, তারা সরাসরি জাহান্নামে প্রবেশ করবে। এদিক থেকেও জাহান্নামীদের দেওয়া খেতাব ও পদক ইত্যাদি জান্নাতী ঈমানদারগণের কী কাজে আসবে? বরং জাহান্নামীদের খেতাব জান্নাতীদের ক্ষতির কারণ হতে পারে, যদি এর প্রতি আগ্রহ ও গুরুত্ব দেখানো হয় এবং এর দ্বারা গৌরব করা হয়ে থাকে।
যে দেশে বাসস্থানের অভাবে অনেক মানুষ মুক্ত আকাশের নীচে, ফুটপাতে, রেলস্টেশনে, স্টিমার ঘাটে বসবাস করছে। অভাবের তাড়নায় ছোটোবেলায় টুকাইয়ে পরিণত হচ্ছে। শিক্ষার অভাবে বাল্যকাল থেকে অবৈধ পথে পা বাড়াচ্ছে। অভাবে ও অশিক্ষায় মানুষ অমানুষে পরিণত হচ্ছে। সে দেশে সংস্কৃতির নামে গান-বাজনা, খেলাধুলা, নাটক-অভিনয়, শিল্পকলা, সাহিত্য-সাময়িকী, সৌধ, স্তম্ভ, মূর্তি, মিনার, শিখা ইত্যাদির নামে প্রচুর অর্থ খরচের আদৌ কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রব্বুল আলামীন কুরআন শরীফে এরশাদ করেন,
তোমরা কি প্রতিটি উচ্চস্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করছ নিরর্থক? (সূরা শু‘আরা, ১২৮)
হযরত নূহ (আ.)-এর জাতি প্রত্যেক উচ্চস্থানে উঁচু উঁচু মজবুত স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করত। তাদের উদ্দেশ্য ছিল কেবল আমোদ, স্ফূর্তি ও শক্তি প্রদর্শন। বাস্তব জীবনে তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। {সূত্র: তাফসীরে ইব্ন কাছীর, অষ্টম খ-; ইফাবা কতৃক প্রকাশনা; প্রথম প্রকাশ; বৈশাখ ১৪০৯, সফর ১৪২৩, পৃষ্ঠা ৩০০}
বিধর্মীদের ধর্মীয় মিশনারীর সাথে তাদেরই প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি, সমাজ ও দেশের সেবা ও প্রশিক্ষণের নামে কৃষ্টি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংঘ, সংস্থা, ক্লাব, দল ইত্যাদি প্রকারান্তরে তাদেরই মিশনারীর কাজ সাফল্যের সাথে মুসলমানগণের মধ্যে চালিয়ে যাচ্ছে। এ সকল কাজের পরিণামে মুসলমানদের মধ্যে মাথা নত করে অভিবাদন দেওয়া, দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন, শিখা জ্বালানো, রাস্তা-ঘাটে সংস্কৃতির নামে মূর্তি স্থাপন, মুসলমানদের নামের স্থলে বিধর্মীদের নামকরণ করা ইত্যাদি গুরুত্বের সাথে চলছে। অথচ মুসলমানগণ বর্তমানে তাদের গৌরবোজ্জ্বল সময়ে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা কী আদর্শ ও রীতিনীতির প্রচার করেছেন তা বেমালুম ভুলে বসে অমুসলিমদের কৃষ্টি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, সমাজনীতি, অর্থনীতি এবং রাজনীতির প্রচারক হয়ে বসেছেন।
লেখক
সাবেক জেলা জজ ও সাবেক মহাপরিচালক, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।