বিজ্ঞাপন বিনির্মাণ ও প্রচার : ইসলামিক নীতিমালা

মুফতী হাফিজুর রহমান


অবতরণিকা

একটি সময় ছিল যখন বিজ্ঞাপনের সাথে পেশাগত কোনো বিষয়ের সংযোগ ছিল না। কিন্তু হালের অত্যাধুনিক আকাশ সংস্কৃতির বাতাবরণে বিজ্ঞাপন একটি বৈশ্বিক এবং একাডেমিক রূপ পরিগ্রহ করে বসেছে। এ নিয়ে বিস্তর লেখা-পড়া ও গবেষণা-চর্চা হচ্ছে। আজ বিজ্ঞাপনী গোলক ধাঁধায় মানুষ নানা রকম পণ্য সেবায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। বিজ্ঞাপনের বাকচাতুরতা ও যাদুমন্ত্রে পণ্য-বাজারের ব্যপ্তি হুহু করে বেড়ে চলছে।

বস্তুত মানুষ মাত্রই নীতিমান। নীতি নৈতিকতার প্রতি তার সদিচ্ছা ও আগ্রহের বিষয়টি আবহমান কাল থেকেই স্বীকৃত। পারলৌকিক জীবনধারা ছাপিয়ে জাগতিক বিষয়েও নীতি নৈতিকতার স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট সংবিধান হলো ইসলামী জীবন বিধান। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে তাবৎ জ্ঞান গবেষণায় আজ এ বিষয়টি অটল সত্য প্রমাণিত। তাই বিজ্ঞাপনের বিষয়টিও ইসলামী বিধি নিষেধের আওতামুক্ত কোনো বিষয় নয়। এর সাথেও জড়িয়ে আছে ইসলামী জীবন ধারার সুস্পষ্ট নীতিমালা। মূলত বিজ্ঞাপন ব্যবস্থাটি ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প সাহিত্যসহ সকল অঙ্গনে একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। বস্তুনিষ্ঠভাবে বলতে গেলে ক্রমাগ্রসরমান উন্নতির এ যুগে এর প্রয়োজনীয়তা সত্যিই অপরিসীম। ইসলামী ধর্মতত্ত্ব মতে বিজ্ঞাপনের ব্যাপারটি অবৈধ কিছু নয়। কিন্তু হালে বিজ্ঞাপনের যে গড্ডালিকা প্রবাহ দৃশ্যমান এবং তাতে নিত্যনতুন যে হারে অবৈধ সংযোজনার প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তাতে বিজ্ঞাপনের সহজাত এবং স্বাভাবিক গতিধারা আর অক্ষুণœ নেই। ধর্মতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে আর বিধানসম্মত বলার অবকাশ অবশিষ্ট নেই। নীতি-নৈতিকতার সম্প্রসারণ এবং দেশ ও জাতির ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরার সদিচ্ছা ও তাগিদেই বিজ্ঞাপন বিষয়ক এ নিবন্ধের অবতারণা। বিজ্ঞাপন শিল্পটির আদ্যোপান্ত তুলে ধরার মানসে আমরা প্রথমে এর বৈষয়িক দিকটির সুবিস্তর আলোচনার দিকে অগ্রসর হবো। যাতে বিজ্ঞাপনের একটি সার্বিক এবং প্রামাণ্য চিত্র অনুসন্ধিৎসু পাঠকের সামনে ফুটে উঠে এবং বিধি নিষেধের ব্যাপারটি সাহজিকভাবে বোধগম্য হয়। এরপর আমরা বিজ্ঞাপন বিনির্মাণ এবং তার প্রচার প্রসারের ব্যাপারে নীতি-নৈতিকতা এবং ধর্মীয় নানা দিক নিয়ে সুবিস্তর একটি আলোচনার প্রয়াস পাবো। কারণ কোনো বিষয়ের বিধি নিষেধ সম্বন্ধে অবগতি লাভের পূর্বে সে বিষয়টি সম্বন্ধে একটি বিস্তৃত ধারণা লাভ করা শাস্ত্রগতভাবেই একটি অপরিহার্য বিষয়। বিস্তৃত ধারণা লাভের পূর্বে বিধি নিষেধ বর্ণনা করতে গেলে তাতে খুঁত থেকে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক।

বিজ্ঞাপন পরিচিতি

জ্ঞাপন অর্থ জ্ঞাত করণ, সংবাদদান, নিবেদন। এ ‘জ্ঞাপন’ শব্দটির সাথে ‘বি’ উপসর্গ যুক্ত হয়ে বিজ্ঞাপন শব্দটির উদ্ভব হয়েছে।

বাংলা অভিধানগুলোতে বিজ্ঞাপনের অর্থ করা হয়েছে, বিশেষভাবে জ্ঞাপন, বিজ্ঞপ্তি, সাধারণকে জানাইবার জন্য লেখন, ইশতিহার, নোটিশ।

সংসদ বাংলা অভিধান থেকে বিজ্ঞাপনের প্রচলিত পারিভাষিক রূপটি সহজেই অনুমিত হয়। পশ্চিম বাংলার এ অভিধানটিতে বিজ্ঞাপনের অর্থ করা হয়েছে, সংবাদপত্র ইত্যাদির সাহায্যে সাধারণ লোকের নিকট প্রচার। অনলাইনে বিজ্ঞাপনটি আরেকটু সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিজ্ঞাপন হলো, চিহ্নিত উদ্যোক্তা কর্তৃক অর্থের বিনিময়ে ধারণা, পণ্য ও সেবার নৈর্ব্যক্তিক উপস্থাপনা ও প্রসার। আরেকটু গুছিয়ে বললে, পণ্য বা সেবার প্রতি ভোক্তার দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে যে কোনো মাধ্যম ব্যবহার করে তথ্য প্রেরণ বা প্রদর্শনই হলো বিজ্ঞাপন। বস্তুত বিজ্ঞাপন একটি একমুখী যোগাযোগ ব্যবস্থা। সাধারণত পণ্য ও সেবার প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়ে থাকে।

ইংরেজি ভাষায় বিজ্ঞাপনের প্রতিশব্দ হলো, advertise । সংক্ষেপে adও প্রচলিত। আর আরবী ভাষায় النشرة (আননাশরা) এবং الاعلان (আলই’লান) হলো বিজ্ঞাপনের প্রতিশব্দ।

ইংরেজি advertise শব্দটি ল্যাটিন advertre এর বিবর্তিত রূপ। advertre এর অর্থ হলো, আবর্তিত করা বা ঘুরানো। অন্য একটি সূত্র মতে প্রাচীন ফরাসী শব্দ advertir (দেখানো) থেকে মধ্যযুগীয় ইংরেজী শব্দ advertisen (জানানো) হয়ে advertising শব্দটির উদ্ভব হয়েছে।

কালপরিক্রমায় বিজ্ঞাপনের সরল প্রবাহ

বিজ্ঞাপন যোগাযোগ ব্যবস্থার একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। যোগাযোগ শব্দটি বস্তুত অন্যকে কোনো বিষয় সম্বন্ধে অবহিত করণের সবগুলো উপায়-অবলম্বনকেই নির্দেশ করে। মানব জীবনে যোগাযোগের ধারা সে আদিকাল থেকে বিরাজমান। ভাষা হলো মানব সমাজের পারস্পারিক যোগাযোগের প্রথম সূত্র। লেখা আবিষ্কারের পূর্বকালে মানুষ ভাষা ছাড়াও হাত নাড়া, চিৎকার করা, ঢাকঢোল পিটানো, আগুন বা ধোঁয়া সৃষ্টি করাÑ প্রভৃতি মাধ্যমকে যোগাযোগ ব্যবস্থারূপে গ্রহণ করতো। অবশ্য হস্ত-সংকেত কিংবা বাকধ্বনির সরব ব্যবহার আজকের মুঠোময় পৃথিবীর যুগেও যোগাযোগের ক্রিয়াশীল একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আদি যুগে মানুষ আগুনকে যোগাযোগের সাংকেতিক মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে অন্যকে কোনো বিষয়ে অবহিত করণের প্রক্রিয়াটি সাধন করতো। উঁচু গাছের ডগায় উঠে মশাল নেড়ে কিংবা আগুনে তীর ছুড়ে শিকারীদের ফিরে আসার সংকেত দিতো। যোগাযোগ বা বিজ্ঞাপনের এ সাংকেতিক ব্যবহারটি প্রযুক্তিময় এ যুগেও সমতালে চলমান রয়েছে। সবুজের বুক চিরে বয়ে চলা মেঠো পথ ধরে টুংটাং নানা রকম শব্দ করে মালাই জাতীয় শিশু খাদ্যের পসরা সাজিয়ে আজো হেঁটে চলে আবহমান গ্রাম বাংলার ফেরিওয়ালা। বিজ্ঞাপনী সেসব সাংকেতিক শব্দের যাদুমন্ত্রে গ্রামের সহজ সরল ছেলে মেয়েরা ছেড়া জুতো আর ভাঙ্গা থালা, শিশি-বোতল কিংবা লোহা-লক্কর নিয়ে ছুটে আসে। অর্থলগ্নি বিহীন এ বিজ্ঞাপনে খুব সহজেই ফেরিওয়ালার শিশুখাদ্যগুলো নিঃশেষ হয়ে যায়। ঢোল, থালা কিংবা প্রতিধ্বনি সৃষ্টিকারী ধাতব বস্তু পিটিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচারের সাংকেতিক ব্যবহারটি এই সেদিনও গ্রাম বাংলার হাটে বাজারে চলমান ছিল। লেখা আবিষ্কারের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থাটি বেশ উন্নত হয়ে উঠে। লেখা আবিষ্কারের পথ ধরেই যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রাচীন অনুষঙ্গ চিঠি চালনার উদ্ভব ঘটে। চিঠি চালনাকে কেন্দ্র করেই ডাক ব্যবস্থার প্রচলন হয়। যোগাযোগের অগ্রগতির ক্ষেত্রে লেখা আবিষ্কারোত্তার গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কার। মুদ্রণ যন্ত্রের সহযোগে বই পুস্তক ও পত্রপত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে লাখো মানুষের সাথে যোগাযোগের পথ উন্মুক্ত এবং অবারিত হয়। আধুনিক জীবন যাত্রার আবশ্যিক অনুষঙ্গ টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার প্রথম ব্যবহৃত যন্ত্র হলো টেলিগ্রাফ। বিজ্ঞানের মহা বিস্ময় বৈদ্যুতিক আবিষ্কারের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপুল পালাবদল ঘটে। ইমেইল, মোবাইল এবং নিকট অতীতের টেলিফোন, ফ্যাক্স ইত্যাদি হলো বিদ্যুত বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ অবদান। বস্তুত যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকতম উপায়টির সূচনা হয়েছিল রেডিও তথা বেতার যন্ত্র উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে। যোগাযোগ ব্যবস্থার সর্বশেষ সংযোজন হলো ইন্টারনেট। বিশ্বের কোটি কোটি কম্পিউটার সংযুক্ত হয়ে বিশ্বব্যাপী যোগাযোগের এক বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে। এ যোগাযোগ ব্যবস্থার পথ ধরেই কালে কালে বিজ্ঞাপনের গতিধারা আবর্তিত হয়েছে। এ ছিল ইতিহাসের গতিধারায় বিজ্ঞাপনের সরল প্রবাহ। বর্তমানে বিজ্ঞাপন ব্যবস্থাটি একটি শক্তিমান কর্পোরেট এবং একাডেমিক শিল্প হিসেবে প্রাদুর্ভূত হয়েছে।

আধুনিক বিজ্ঞাপনের ক্রমধারা

প্রকৃত অর্থে বিজ্ঞাপনের মর্মবস্তু হলো, নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে একাধিক ব্যক্তির দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিজ্ঞাপন মানব সভ্যতায় বেশ প্রাচীন ইতিহাসের দাবিদার। দৃষ্টি কাড়া কিংবা তথ্যসেবা দেয়ার স্তর থেকে বাণিজ্যিক তথ্যের জানান দেয়া এবং মনোযোগ আদায় করার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসেবেই বিজ্ঞাপনের প্রাথমিক ইতিহাস তৈরি হয়।

প্রচলিত বিজ্ঞাপন জগতের যাত্রা ঠিক কখন থেকে শুরু হয় তা সুনির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও ধারণা করা হয়, মানুষ যখন থেকে চাষাবাদ পেশায় আত্মনিয়োগ করে এবং ফসল কেটে ঘরে তোলে তখন থেকেই বিজ্ঞাপনের অভিযাত্রা শুরু হয়। তখন মানুষ জনসমাগম স্থলে ফসলী পণ্যের সামনে দাঁড়িয়ে সরব আওয়াজ তুলে পণ্য বিক্রির কাজটি সমাধান করতো। নিজ পণ্যের গুণাগুণ নিজেই বর্ণনা করতো। পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনের এ প্রাচীন রূপটি আজও আমরা শহরের ফুটপাতে, গ্রামের হাট-বাজারে প্রত্যক্ষ করি। ধীরে ধীরে সাক্ষরতা শুরু হলো। মানুষ লেখা পড়া শিখলো। হাট-বাজার ছাপিয়ে দোকান ঘরের সৃষ্টি হলো। মানুষের মাঝে অল্প পয়সায় মানসম্মত পণ্য ক্রয়ের প্রবণতা তৈরি হলো। দোকানদার বা সেলস্ম্যানরা দোকানের সামনে পণ্য-দ্রব্যের ছবি এঁকে ক্রেতা সাধারণকে আকৃষ্ট করার নতুন পন্থা উদ্ভাবন করলো। ফলে সৃষ্টি হলো সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডের আধুনিকতম রূপটি হলো ইয়া বড় বিলবোর্ড কিংবা ডিজিটাল ব্যানার। এরপর এক সময় দোকান মালিকরা দোকানের সামনে মানব ঘোষক রাখার পন্থা আবিষ্কার করলো। এ ঘোষকরা পণ্যের গুণাগুণ ব্যাখ্যা করে লোক জমায়েত করে পণ্য বিক্রি করতো। বিজ্ঞাপনের এ প্রাচীন ব্যবস্থাটি আজ আধুনিকতার মোড়কে ভ্রাম্যমান প্রতিনিধির রূপ পরিগ্রহ করেছে। এতে ব্যবহৃত হচ্ছেন বিনোদন জগতের মডেল তারকারা(?)। এরপর এক সময় ছাপাখানা আবিষ্কার হয়। এতে বিজ্ঞাপন জগতে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। পণ্য বিজ্ঞাপনের জন্য সৃষ্টি হয় পোস্টার ব্যবস্থা। দেয়ালে দেয়ালে পণ্যচিত্র এবং পণ্যতথ্য সম্বলিত পোস্টার সেটে পণ্য প্রচারণার ব্যবস্থাটি এক সময় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো। বিজ্ঞাপনের প্রাচীন এ ব্যবস্থাটি আজো সমতালে অক্ষুণ্ন রয়েছে। ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়াম কক্সটন নামের জনৈক ব্যক্তি সর্বপ্রথম কতগুলো ধর্মীয় গ্রন্থের অনুরূপ পোস্টার তৈরি করে। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের তথ্য মতে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সনের দিকে প্রাচীন মিসরে পোস্টার ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। পোস্টার ব্যবস্থার আধুনিক যুগের সূত্রপাত হয় ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে লিথোগ্রাফি (lithography- পাথর, দস্তা বা এ্যালুমিনিয়ামের পাত ব্যবহার করে ছাপানোর পদ্ধতি বিশেষ) আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। বস্তুত বিজ্ঞাপনের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রাচীন মিসরীয়রা পণ্যের বিক্রয়তথ্য বিজ্ঞাপনে এবং ওয়ালপোস্টার বিনির্মাণে প্যাপিরাস (papyrus- দীর্ঘ জলজ উদ্ভিদ বা নল-খাগড়া থেকে তৈরি এক ধরনের কাগজ) ব্যবহার করতো। প্রাচীন আরব এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত রোমান ছোট্ট নগরী পম্পেই-তেও বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, বেশ প্রাচীন যুগেও বিজ্ঞাপনের প্রচলন ছিল। তবে আধুনিক বিজ্ঞাপনের জনক হিসেবে থমাস জে. ব্যারাট (thomas j. barratt)-এর নাম উল্লেখ করা হয়। থিবস নগরের পুরনো পুঁথি ইতিহাস পাঠে জানা যায়, সেখানে একদা পালিয়ে যাওয়া এক ক্রীতদাসকে ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। ধারণা করা হয়, সে থেকেই বিজ্ঞাপনের প্রচলন শুরু হয়।

খ্রিস্টীয় ১৬০০ শতকে ইংল্যান্ডে তথ্য ছড়িয়ে দেয়ার সমন্বিত উদ্যোগ প্রথম পরিলক্ষিত হয়। সেকালে সেন্টপলসের নির্দিষ্ট জায়গায় প্রাচীরপত্র দেয়া হতো। পরে ক্রমান্বয়ে তার পরিধি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। তবে সে সবই ছিল ব্যক্তিগত স্তরের কেনাবেচা সংক্রান্ত। বর্তমান বিজ্ঞাপন জগতে যাকে আমরা শ্রেণীবদ্ধ বিজ্ঞাপন হিসেবে অবহিত করে থাকি। ১৬০০ শতকের শেষ দিকে সংবাদপত্রের উল্লেখযোগ্য উন্নতির ফলে বিজ্ঞাপনেরও স্থায়ী এবং মজবুত একটি জায়গা হয়ে যায় অর্থনীতির বিস্তৃত অঙ্গনে। শিল্পবিপ্লব এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি বিজ্ঞাপন জগতে বিপুল সম্ভাবনা ও পরিবর্তন এনে দেয়। সে সময় করাধিক্যের ফলে বিজ্ঞাপনের বিকাশধারা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নীত হয়ে উঠেনি। ১৮৫৩ ও ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে দু’ দফায় যাবতীয় কর প্রত্যাহার করে নেয়া হলে সংবাদপত্রের উত্তরোত্তর বৃদ্ধির সাথে সাথে বিজ্ঞাপনেরও রমরমা বাণিজ্যের সূচনা হয়। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে প্রথম বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ আইন চালু হয়। বিজ্ঞাপনের আধুনিক যুগ মূলত ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার বিকাশের সাথে সাথেই সূচিত হয়। আধুনিক ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হলো, উৎপাদন এবং উৎপাদিত পণ্য বিক্রির মাধ্যমে মুনাফা অর্জন। উৎপাদন বা সরবরাহ বজায় রাখতে হলে পণ্যের এক আকর্ষণীয় বাজার চাই। বিজ্ঞাপন সে বাজারে পণ্যকে বিক্রয়যোগ্য হিসেবে প্রচার করে। উৎপাদক ও ক্রেতার মাঝে এক সেতুবন্ধ গড়ে তোলে এ বিজ্ঞাপন। তাই উৎপাদকেরা তাদের পণ্যের বিক্রি বাড়ানোর জন্য নিরন্তর বিজ্ঞাপন প্রচার করতে থাকে। ফলে গড়ে ওঠে বিজ্ঞাপন গ্রহণকেন্দ্র ও এজেন্সি। সংবাদপত্রগুলো তাদের নিজস্ব বিজ্ঞাপন দপ্তর খুলে বসে। গড়ে উঠে বিজ্ঞাপন দাতাদের স্বার্থ রক্ষার সংগঠনও। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে সংবাদপত্রের বিক্রি সংখ্যার তথ্য পেতে অডিট ব্যুরো অফ সার্কুলেশন তৈরি হলে বিজ্ঞাপনের স্বাতন্ত্র্য ও সার্বভৌমত্বের কাল শুরু হয়। অর্থনীতির অন্যতম অঙ্গ হিসেবে বিজ্ঞাপনের উপস্থিতি ও অস্তিত্ব বজায় থাকার কাজটিও সম্পন্ন হয়। মুদ্রণ মাধ্যম ছাপিয়ে প্রথমে রেডিও পরে টেলিভিশন বিজ্ঞাপন-মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। আজ মোবাইল, ইন্টারনেটও বিজ্ঞাপনের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বিজ্ঞাপনের ব্যাপকতা আজ প্রচারমাধ্যমেরও অস্তিত্বের নিয়ন্ত্রক। উচ্চবিত্তদের জীবন প্রণালীও এখন বিজ্ঞাপনের কল্যাণে সম্পাদিত হয়। এক সকাল থেকে আরেক সকাল অবধি সমস্ত গণমাধ্যম জুড়ে থাকে বিজ্ঞাপনের শাসন। উদ্দেশ্য একটিই; ব্যক্তির মনছবিতে দখলস্বত্ব প্রতিষ্ঠা। মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতায়, সত্য-মিথ্যায়, স্বাদ-বিস্বাদে জীবন ও মূল্যবোধের উপর সাংস্কৃতিক-অপসাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তারে বিজ্ঞাপন আমাদের অস্তিত্বকে অক্টোপাশের মতো আটকে রাখে সারাক্ষণ।

বিজ্ঞাপনের ক্রমধারা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

বাংলাদেশ কেন্দ্রিক বিজ্ঞাপনের পর্যালোচনায় প্রথমেই ব্রিটিশ আমলের কথা উঠে আসে। সে সময় দু’টি বিজ্ঞাপন ছিল বেশ অভিনব এবং নতুন। তার একটি হলো চা পানের বিজ্ঞাপন আর অপরটি হলো ম্যালেরিয়া রোগের ওষুধি পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত কুইনাইনের বিজ্ঞাপন। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে সিলেটের মালনিছড়ায় বাণিজ্যিকভাবে চা বাগান প্রতিষ্ঠা করে বৃটিশ সরকার। দেশের মানুষের মধ্যে চা পানের অভ্যাস গড়ে তুলতে ব্রিটিশরা সে সময় চায়ের বিজ্ঞাপন দেয়া শুরু করে। এ দেশের মানুষ পানীয় বলতে যা বুঝতো তা হলো দেশী গরুর খাঁটি দুধ। অত্যন্ত পুষ্টিকর দুধের বিপরীতে তারা চা পান করতে খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করতো না। তাই ব্রিটিশরা বিজনেস স্ট্র্যাটেজি হিসেবে এ দেশের মানুষকে ফ্রি চা পান করানোর পন্থা উদ্ভাবন করে। এতেও তারা কাক্সিক্ষত সফলতার দারে পৌঁছুতে সক্ষম হচ্ছিল না। ব্রিটিশরা ভেবে দেখলো, দুধ হলো এ দেশের মানুষের অমীয় সুধা। তাই চায়ের কাটতি বাড়াতে তাতে দুগ্ধসুধার সংমিশ্রণ ঘটাও। ব্যস ব্রিটিশদের এ উদ্ভাবনী শক্তি তাদের চা বাণিজ্যে বিপুল সফলতা এনে দেয়। তাই দেখা যায়, ভারতবর্ষ বাদে বিশ্বের অন্য কোথাও দুধ-চায়ের প্রচলন নেই বললেই চলে। ব্রিটিশদের চা প্রচারণার কাজটি তাদের উদ্ভাবিত বিজ্ঞাপন ব্যবস্থা বেশ সহজতর করে তুলেছিল। তখন চা’কে জনপ্রিয় করে তুলতে রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট, স্টিমারঘাটসহ পাবলিক প্লেসে বিজ্ঞাপন-ফলক লিখে প্রচার করা হতো। এমন একটি বিজ্ঞাপন কালের সাক্ষী হয়ে আজো শ্রীমঙ্গল চা জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। আদমজি জুট মিলের দেয়ালের গায়েও এমন একটি বিজ্ঞাপনের দেখা মিলে।

বস্তুত আজ থেকে ৫০ বছর পূর্বে এ দেশে বিজ্ঞাপন শিল্পের অভিযাত্রা শুরু হয়। ৫০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকাকেন্দ্রিক প্রথম বিজ্ঞাপন শিল্পের চর্চা শুরু হয়। কিন্তু ঢাকা তখনো এ শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল না। ঢাকার বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন তখন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ‘নিয়ন সাইন’ করিয়ে আনা হতো। মূলত দেশ বিভাগের পরই ঢাকা বিজ্ঞাপন ব্যবসার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। আশির দশকে এ দেশে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানী গড়ে উঠে। শুরু হয় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্যের সাথে তুমুল যুদ্ধ। সে সাথে বিজ্ঞাপন শিল্পও ক্রমান্বয়ে প্রসারিত এবং বৈচিত্র্যময় হতে শুরু করে।

ঢাকা কেন্দ্রিক বিজ্ঞাপন শিল্পের ইতিহাসটা নিয়ে পর্যালোচনা করা হলে তার উপাখ্যানটা দাঁড়ায় নিম্নরূপ-

১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে গুলাম মহিউদ্দিন ‘গ্রিন ওয়েজ পাবলিসিটি’ নামের একটি বিজ্ঞাপন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটিই সর্বপ্রথম বিজ্ঞাপনী সংস্থা। ১৯৫৪ মতান্তরে ৫৫ খ্রিস্টাব্দে সালাম কবির প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইস্টল্যান্ড অ্যাডভার্টাইজিং কোম্পানি’। ১৯৫৬-৫৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে যাত্রা শুরু করে বিজ্ঞাপনী সংস্থা কোহিনূর। ১৯৬০ এর দশকের শুরুতে শরফুদ্দিন আহমেদ, শের আলী রামজি ও ইফতেখারুল আলম মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ‘স্টার অ্যাডভার্টাইজিং’। এ সময় ‘লিভার ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভার্টাইজিং সার্ভিস’ এবং ‘ডিজেকিমার’ও এ দেশে তাদের যাত্রা শুরু করে। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে শরফুদ্দিন আহমেদ চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নবংকুর অ্যাডভার্টাইজিং লিমিটেড’। এ সময় গুলাম মহিউদ্দিন বিজ্ঞাপন জগতে নতুনত্ব এবং ভিন্ন ধারা সৃষ্টিতে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করেন ‘চ্যাম্পিয়ন নিয়ন সাইন’। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের ‘এশিয়াটিক অ্যাডভার্টাইজিং লিমিটেড’ ঢাকায় ‘ইস্ট এশিয়াটিক অ্যাডভার্টাইজিং লিমিটেড’ নামে তাদের শাখা অফিস চালু করে। ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘এশিয়াটিক মার্কেটিং কমিউনিকেশনস লিমিটেড’। এরপর দু’ এক বছরের ব্যবধানে রেজা আলী প্রতিষ্ঠা করেন ‘বিটবি’। ১৯৬৯-৭০ খ্রিস্টাব্দে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী লতিফুর রহমান বিজ্ঞাপন শিল্পে অর্থ বিনিয়োগ করে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইন্টারস্পিড’। দেশ স্বাধীনের পর দেশী উদ্যোক্তারা নতুন শক্তি ও সাহসে উৎসাহিত হয়ে নব উদ্যমে বিজ্ঞাপন শিল্পে বিনিয়োগ শুরু করেন। এ সময় বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানের কিছু বিজ্ঞাপনী সংস্থাকে অধিগ্রহণ করে। এর মধ্যে ‘কোহিনূর’ নামক বিজ্ঞাপন সংস্থা উল্লেখযোগ্য।

স্বাধীনতার পর শরফুদ্দিন আহমেদ কবি ফজল শাহাবুদ্দিন এবং অভিনেতা হারুন রশিদকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নান্দনিক অ্যাডভার্টাইজিং লিমিটেড’। ‘নান্দনিক’ই সর্বপ্রথম বিজ্ঞাপন শিল্পে রঙিন দৃশ্যের ব্যবহার শুরু করে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে রশিদ আহমেদ প্রতিষ্ঠা করেন ‘কারুকৃত’। ঢাকার বিজ্ঞাপনের ইতিহাসে গ্রাফিক্স ডিজাইনের প্রচলনের কথা উঠতেই রশিদ আহমেদের নাম চলে আসে। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে গীতি আরা সাফিয়া চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত ‘অ্যাডকম’ এর যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে আনিসুল হক ‘অ্যাডবিজ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভার্টাইজিং’ প্রতিষ্ঠা করেন। একই বছর বিজ্ঞাপনের পথকে আরো মসৃণ ও প্রাণবন্ত করতে হাজি আরশাদ আলী ‘এলিট প্রিন্টিং প্যাকেজেস লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘অ্যাডবেস্ট’। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে অভিনেতা আফজাল প্রতিষ্ঠা করেন ‘মাত্রা’। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে মুনির আহমেদ খান ও জুলফিকার আহমেদ ‘ইউনিট্রেন্ড’ প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর আরো অনেক বিজ্ঞাপনী সংস্থার জন্ম হয়। নব্বইয়ের দশক থেকে বিজ্ঞাপন জগতে তুমুল পরিবর্তন সাধিত হয়। এ সময় বিজ্ঞানসম্মত বিজ্ঞাপন তৈরির ধারা শুরু হয়। সে সাথে বিজ্ঞাপন তৈরির পূর্বে মার্কেটিং রিয়েলাইজেশনের বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়। নতুন শতাব্দির শুরুতে বিজ্ঞাপন শিল্পে আমূল পরিবর্তন আসে। অনেক ব্যবসায়ী এ শিল্পে বিনিয়োগ করেন। পেশা হিসেবে বেছে নেন অনেকে। এক জরিপ মতে বর্তমানে বাংলাদেশে আনুমানিক ২৫০টিরও বেশি বিজ্ঞাপনী সংস্থা রয়েছে। এ সময় উদ্ভব হয় আধুনিক প্রযুক্তিসম্মত নিত্যনতুন বিজ্ঞাপনী মাধ্যম। সব থেকে বেশি পরিবর্তন এসেছে বড় বড় বিলবোর্ডের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে। আশপাশে তাকালেই রাস্তা ও বিশাল অট্টালিকায় ইলেক্ট্রনিক বিলবোর্ড চোখে পড়ে। তবে ইন্টারনেট মিডিয়ার বিস্তৃতিতে টিভি বিজ্ঞাপনের বাজার ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে বলে আভাস দিয়েছে বিশ্বের বেশ কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞাপনী সংস্থা। ফ্রান্সের আন্তর্জাতিক বিজ্ঞাপনী সংস্থা ‘জেনিথ অপটিমিডিয়া’ এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘পাবলিসিস’ এর পূর্বাভাস মতে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বব্যাপী মোট বিজ্ঞাপন ব্যয় ৫৩২০০ কোটি ডলারের ৪০.২ শতাংশ টিভি মিডিয়ায় খরচ করবেন বিজ্ঞাপন দাতারা। বর্তমানে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সেরা বিজ্ঞাপনী সংস্থার মর্যাদা পেয়েছে জাপানের ‘ডেন্টসু’ ও ‘হাকুহুডো’। আর বিজ্ঞাপনে সেরা দশ দেশের মধ্যে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে জায়গা করে নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া ও জাপান। তাদের অবস্থান যথাক্রমে পঞ্চম ও সপ্তম। এ ক্ষেত্রে প্রথম অবস্থ’ানে আছে যুক্তরাষ্ট্র। বিজ্ঞাপনের বিভিন্ন শাখায় সৃজনশীল কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ‘কান লায়ন পুরস্কার’ দেয়া হয়। পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলোর আনুষ্ঠানিক অবস্থান তালিকা বা অফিশিয়াল র‌্যাংকিং প্রকাশিত হয়। এ তালিকায় বর্তমানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ব্রাজিল ও যুক্তরাজ্য। শীর্ষ দশে জায়গা না পেলেও এ তালিকার ১২ নম্বরে রয়েছে ভারত। এশিয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সেরা বিজ্ঞাপনী সংস্থার তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে আছে ‘ওয়াইএন্ডআর বেইজিং’, চতুর্থ স্থানে রয়েছে ‘লিও বার্নেট সিডনি’ এবং নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডভিত্তিক ‘কলেনসো বিবিডিও’ রয়েছে পঞ্চম স্থানে। সারা বিশ্বের সেরা বিজ্ঞাপনী সংস্থা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে লন্ডনের ‘অ্যাডাম অ্যান্ড ইভ বিবিডি’। এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ‘ডেন্টসু’।

আজকাল ঢাকার পত্রপত্রিকা ও বেতার-টেলিভিশনে লক্ষ্য করা যায় জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিজ্ঞাপনেরই ছড়াছড়ি। পণ্য, চাকরি, নিলাম, জায়গা-জমি, ঘরবাড়ি, ক্রয়-বিক্রয়, বিদেশ যাত্রা, কৃতি ছাত্র-ছাত্রী, টেন্ডার নোটিশ, বিউটি পার্লার, ছাত্র পড়ানো, কোচিং সেন্টার, পাত্র-পাত্রী চাই, পত্রপত্রিকা প্রকাশনা, সিনেমা, প্রসাধনী, উকিল নোটিশ, স্বাস্থ্য, রোগ-ব্যধি, পরিবার পরিকল্পনা, শুভেচ্ছা, ভর্তি, ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনসহ আরো কত ধরনের বিজ্ঞাপন যে চোখে পড়ে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই।

(উইকিপিডিয়া, বিভিন্ন দৈনিক (অনলাইন সংস্করণ), বিজ্ঞাপন বিষয়ক বিভিন্ন ব্লগ এবং Principles of Marketing (10th Edition), Philip Kotler & Gary Armstrong, Pearson Prentice Hall, American Heritage Dictionary, Third edition, Version 3.6a)

ইসলামী বিধি নিষেধ এবং বিজ্ঞাপন

পূর্বের আলোচনায় বিজ্ঞাপনের একটি সার্বিক চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। তাতে একটি বিষয় ফুটে উঠেছে যে, বস্তুগতভাবে বিজ্ঞাপন কোনো অচ্ছুত কিংবা নিষিদ্ধ বিষয় নয়। রুচিগতভাবেই মানুষ তার কাছে রক্ষিত জিনিসটির কথা অন্যকে অবহিত করার প্রবণতা লালন করে এবং তাতে কোনো গুণাগুন থেকে থাকলে তাও অকপটে জানিয়ে দিতে আগ্রহ বোধ করে। চাই তা যেকোনো স্বার্থকে লালন করেই হোক? ইসলাম বিজ্ঞাপনের এ স্বাভাবিক প্রবাহকে গতিরোধ করতে চায় না। বর্তমানে প্রচলিত বিজ্ঞাপনগুলোর সাথে আধুনিকতার মোড়কে কিছু আনুষঙ্গিকতার প্রলেপ লেগেছে; যাতে ধর্মীয় বিধি নিষেধের ব্যাপারটি বেশ আবশ্যিক হয়ে উঠেছে। মুসলিম দেশের অধিবাসী হিসেবে আমাদের জীবনধারা অবারিত এবং বন্ধনমুক্ত নয়। ওহীভিত্তিক একটি জীবনদর্শনকে ঘিরে আমাদের জীবনাচার আবর্তিত হতে সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকেই বাধ্য। সে হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-সংস্কৃতি থেকে শুরু করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা অঙ্গনসহ তাবৎ বৈষয়িক ক্ষেত্রে আমাদের মাঝে একটি নৈতিকতা বোধ চির জাগরুক থাকা বিবেকের দাবিও বটে।

একটি বিজ্ঞাপন বিজ্ঞাপন হয়ে উঠার পেছনে মানব শ্রেণীর অনেকগুলো স্তর পার হতে হয়। প্রথমত কোনো কোম্পানী তাদের সেবা বা পণ্য প্রচারণার নিমিত্ত একটি বিজ্ঞাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এরপর তারা কোনো বিজ্ঞাপন বিনির্মাণ সংস্থার দারস্থ হয়ে আর্থিক চুক্তিভিত্তিক একটি বিজ্ঞাপন তৈরি করে নেয়। এরপর এ বিজ্ঞাপনটি প্রচারণার জন্য তাদের কোনো মিডিয়ার সন্নিধান লাভ করতে হয়। এখানে অর্থের বিনিময়ে তাদের বিজ্ঞাপন প্রচারণার কাজটি সমাধা হয়। এ বিজ্ঞাপনটি মিডিয়ায় চুক্তিভিত্তিক নিয়মে প্রচারিত হচ্ছে কি না তা মনিটরিং করার জন্য আলাদা সংস্থা প্রস্তুত রয়েছে। কখনো কোম্পানীকে তাদের বিজ্ঞাপন প্রচারণার ব্যাপারটিকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য অ্যাড মনিটরিং এজেন্সির সাথে চুক্তি বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়। সর্বশেষ বিজ্ঞাপনটি দর্শক, শ্রোতা, ভোক্তা, গ্রাহক, ক্লায়েন্ট যাই বলি-এদের সামনে পরিবেশিত হয়। তো একটি বিজ্ঞাপন যদি নীতি-নৈতিকতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ না হয়ে অনৈতিক এবং অবৈধতার স্তরে নেমে আসে তাহলে তা মানব শ্রেণীর অনেকগুলো পক্ষকে ছাপিয়ে দর্শক শ্রোতাদের বিশাল একটি জনগোষ্ঠিকে আক্রান্ত করবে। এমন কি নীতিমান, রক্ষণশীল, ধার্মিক শ্রেণী যারা তাদের জীবনটাকে একটু নিয়ন্ত্রিত করে সাজাতে আগ্রহ বোধ করে তারাও এ অনৈতিক বিজ্ঞাপনের বিষক্রিয়া থেকে পরিত্রাণ পেতে সক্ষম হন না। তো প্রচলিত বিজ্ঞাপনগুলোতে আমরা যেসব আপত্তিকর বিষয়গুলো লক্ষ্য করি তা হলো, ১. নিষিদ্ধ এবং আপত্তিকর ছবির রমরমা ব্যবহার ২. ভিনদেশী অপসংস্কৃতির উন্মাতাল আয়োজন ৩. বাকশিল্পের চতুর আয়োজনে সত্যিকার মিথ্যা প্রলাপ ৩. প্রচারণার বাতাবরণে সীমাহীন প্রতারণা ৪. যত্রতত্র বিজ্ঞাপন সাটার নামে সুস্থ জীবন ধারাকে ব্যহত করণ ৫. নাগরিক জীবনের সৌন্দর্যকে ধূলিম্লান করণ ৫. আদিরসের সুড়সুড়িতে উঠতি বয়সের তরুণ সমাজকে বিপথগামী করার পথকে সুগম করণ ৬. সড়ক দুর্ঘনাকে ত্বরান্বিত করণ ৭. নৈতিকতা বোধকে বিধ্বস্ত করে দেয়া ৮. স্বকীয় মূল্যবোধ এবং দেশপ্রেমের বিনাশ সাধন ৯. লাজহীনতার চরম অবক্ষয় ধারা সৃষ্টি করা ১০. পাপাচারের কণ্টকাকীর্ণ পথকে মসৃণ এবং অবারিত করা ১১. আত্মপ্রশংসার লাগামহীন প্রচারণা ১২. ইসলামী আকীদা বিধ্বংসী বিষাক্ত প্রচারণা। ইসলামী বিধি নিষেধের দৃষ্টিকোণ থেকে বিজ্ঞাপনের অনৈতিক এ শিরোনামগুলো নিয়ে আমরা ভিন্ন ভিন্ন আলোচনা পর্ব তৈরির চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

১. নিষিদ্ধ ছবির আপত্তিকর ব্যবহার

যুগ চাহিদার মিষ্ট শ্লোগানে যদিও ছবি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইদানিং বেশ শিথিলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে কিন্তু ছবি সম্পর্কিত ইসলামী আইনের মূল ছত্রগুলো এখনো অশিথিল, এখনো আপোসহীন। তাতে সামান্যতম চিড়ও এ যাবত দৃষ্টিগোচর হয়নি। ছবি ব্যাখ্যার দীর্ঘ সূত্রতায় খানিকটা ভিন্নমত লক্ষ্য করা গেলেও সংখ্যাগরিষ্ঠের সমন্বিত বক্তব্য হলো, ইসলামী আইন মতে প্রাণির চিত্র নিষিদ্ধ এবং অবিধানিক। তাতে কাল চাহিদার ঠুনকো যুক্তি দেখিয়ে শিথিলতা প্রদর্শনের সামান্যতম অবকাশ নেই। আর অপারগতা, অক্ষমতা ইসলামী আইনে একটি স্বীকৃত বিষয়। ওজরগ্রস্ত ব্যক্তির জন্য শুধু জীবচিত্র কেন কুরআন হাদীসের অকাট্য নিষিদ্ধ ‘মরদেহ’ ভক্ষণও বিধিসম্মত। ওজর এবং প্রয়োজনীয়তার একটি সীমানা প্রাচীর রয়েছে। যার বিস্তৃত বিবরণ ইসলামী আইনের পত্রপল্লবে বিবৃত হয়েছে। তাই প্রয়োজনীয়তার অবাঞ্ছিত রেখাকে দীর্ঘায়িত করে জীবচিত্রের বৈধতা অন্বেষণ কোনো ক্রমেই অনুমোদিত নয়। এখানে আমরা বিষয়ের আবশ্যিক প্রাসঙ্গিকতায় জীবচিত্র সম্পর্কিত দু’টি হাদীস উল্লেখ করবো।

১. আবূ তালহা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ঘরে কুকুর অথবা জীবচিত্র থাকে সে ঘরে ফেরেশতা প্রবেশ করে না। সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৪৯

হাদীসটির ভাষ্যকে সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। জীবচিত্র ব্যবহারের নিষিদ্ধতা ঘরের চৌহদ্দির মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর পরিধি ব্যাপক। সর্বত্রই এর নিষিদ্ধতা প্রযোজ্য। খ্যাতিমান হাদীস বিশারদ ইবনে আব্দুল বার রাহ. বলেন, হাদীসটির দৃশ্যত বক্তব্যের দাবি হলো, জীবচিত্র ব্যবহারের নিষিদ্ধতা স্থান কাল পাত্র নির্বিশেষে সর্বক্ষেত্রকে ব্যাপৃত করবে।Ñআত্ তামহীদ লিমা ফিল মুয়াত্তা মিনাল মা‘আনী ওয়াল আসানীদ ১/১০১। তাছাড়া হাদীসটির মধ্যকার (بَيْت) বাইত বা গৃহকে হাদীসের ভাষ্যগ্রন্থগুলোতে স্থান বা মানুষের আবাসভূমি বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সুতরাং ‘বিজ্ঞাপন যেহেতু ঘরোয়া কোনো বিষয় নয়; বাইরের বিষয় তাই তাতে জীবচিত্রের ব্যবহারে কোনো বিধি নিষেধ নেই এবং সেখানে ফেরেশতাকুলের যাতায়াতেও কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই।’ এ জাতীয় বাতিক প্রসূত বিরল চেতনা বিকাশের কোনোই সুযোগ নেই। হাদীসটিতে বেশ স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, জীবচিত্ররক্ষিত জায়গাগুলোতে দয়া ও অনুগ্রহ বিভাগের দায়িত্বশীল ফেরেশতাকুলের আগমন ঘটে না। অথচ আজ আমাদের দেশটাই বিজ্ঞাপন চিত্র ছবিময় এক রঙিন ভুবনে পরিণত হয়েছে। কোথায় নেই বিজ্ঞাপনচিত্রের উন্মাতাল ব্যবহার। নাগরিক জীবনের কথা না হয় বাদই দিলাম। নীরব নিস্তব্ধ আবহমান বাংলার গ্রামীণ পরিবেশও বিজ্ঞাপন চিত্রের ভয়াল দুষণ থেকে মুক্ত নয়। এভাবে বিজ্ঞাপন চিত্র দিয়ে যদি দয়া অনুগ্রহ আনাগোনার পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয় তাহলে এ দেশে অশান্তি বিশৃঙ্খলা, বিবাদ বিসম্বাদ, হানাহানি, খুনোখুনি ইত্যকার অনাচার কি করে রুদ্ধ হবে? যে পথ্যে এসব দুরারোগ্য ব্যাধির নিরাময় হবে সে পথ্য সেবনের যাবতীয় উপায় অবলম্বনই যদি বন্ধ করে দেই তাহলে তো এ সব ব্যাধির প্রাদুর্ভাব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে পেতে পুরো দেশটারই একদিন অপমৃত্যু ঘটবে। দেশপ্রেম আর উন্নতি অগ্রগতির যত বুলিই আওড়ানো হোক জীবচিত্রের প্রাদুর্ভাবের এ ছিদ্রপথ বন্ধ না হলে দেশপ্রেম আর উন্নয়নের স্বার্থকতা চিরকাল সোনার হরিণের মত অধরাই থেকে যাবে।

এ তো গেল নিছক জীবচিত্র সম্বলিত বিজ্ঞাপন চিত্রের ভয়াল দিকের কথা। এরপর আসে বিজ্ঞাপনে নারী চিত্রের ব্যবহার প্রসঙ্গ। হিসাব করলে দেখা যাবে বিজ্ঞাপনচিত্রগুলোর প্রায় আশি কিংবা নব্বই পার্সেন্টই নারী চিত্র সম্বলিত। নারী চিত্রের এ অবাধ এবং বাহুল্য ব্যবহার সত্যিই অনাগত এক ভয়াবহ দুর্যোগের ঘনঘটা। এখানে দু’টি নিষিদ্ধ বিষয়ের সমন্বয় ঘটেছে। এক জীবচিত্র। দুই নারীচিত্র। নারী দেহ দর্শন বাহ্যিক জগতে যেমন নিষিদ্ধ তদ্রƒপ চিত্রজগতেও নিষিদ্ধ। বরং চিত্রজগতের নিষিদ্ধতার ব্যাপারটি আরো ভীষণ আরো কঠোর। কারণ এখানে দ্বিমুখী অপরাধের সমন্বয় ঘটেছে। আর নারী দেহের সম্পূর্ণটাই হলো ‘হিজাব’ বিধানের পর্যায়ভুক্ত। এক্ষেত্রে কুরআন হাদীসের বক্তব্যগুলো বেশ স্পষ্ট। তাই এব্যাপারে শিথিলতা প্রদর্শনের কোনো সুযোগ নেই। তৃতীয় যে বিষয়টি তা হলো নারী দেহের বিবস্ত্র পরিবেশনা। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ এবং নীতি নৈতিকতার বিবেচনায় এ বিষয়টিই বিজ্ঞাপন জগতের সবচাইতে আপত্তিকর বিষয়। যৌনতা এবং আদিরসাত্মক এসব বিজ্ঞাপনের ক্ষতিকর দিকগুলো বর্ণনার জন্য ধর্মীয় বিধি-নিষেধের প্রয়োজন পড়ে না। মানুষের বিবেক আর সুস্থ রুচিবোধই এসব বিজ্ঞাপনের জাজমেন্ট করার জন্য যথেষ্ট। মুক্ত মন আর জরায়ূর স্বাধীনতা সৃষ্টির পেছনে এসব আপত্তিকর বিজ্ঞাপন প্রচারণা এন্টি ইসলাম গ্রুপের নিবিড় এবং গভীর ষড়যন্ত্রের বার্তা বহন করে। কিন্তু স্বকীয়তা বোধহীন এ দেশের মুসলিম সন্তানেরা ‘ওদের’ রসালো শ্লোগানে মুগ্ধ হয়ে যৌন স্বাধীনতার প্রাদুর্ভাব ঘটাতে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে আত্মহুতি দিচ্ছে। বিবসনা নারী দেহের চিত্র সম্বলিত বিজ্ঞাপন চিত্রটি যে কোম্পানী নির্মাণ করে দিলো সে কোম্পানীটি কি পরিমাণ পাপাচারের রসদ এবং উপাদান সমাজে সরবরাহ করল তা কি তারা কখনো ভেবে দেখেছে? এতে সেকেন্ডে সেকেন্ডে কি পরিমাণ মানুষের পাপের পাল্লা ভারি হচ্ছে তা সত্যিই পিলে চমকে যাবার মত মর্মন্তুদ ব্যাপার। আল্লাহ আমাদের এসব পাপাচারের ডামাডোল থেকে পরিত্রাণ দান করুন।

২. আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যারা এ জাতীয় জীবচিত্র তৈরি করে কিয়ামতের দিন তাদের শাস্তি প্রদান করা হবে। তাদের বলা হবে, যাদের তোমরা তৈরি করেছিলে তাদের জীবন দান করো। সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৫১। অন্য একটি বর্ণনায় ছবি প্রস্তুতকারী, চিত্রকর, ফটোগ্রাফার, আলোকচিত্রি- শাব্দিক বৈচিত্রে যে নামেই অভিহিত করা হোক- এদের শাস্তির ভয়াবহতার ব্যাপারটি বেশ স্পষ্ট করেই বিবৃত হয়েছে। সেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কিয়ামতের দিন চিত্রশিল্পীরা গুরুতর শাস্তিতে নিপতিত হবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৫০) যারা বিজ্ঞাপন শিল্পে অর্থলগ্নি করেন এবং যারা আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন তৈরি করিয়ে নিজেদের কোম্পানীর প্রডাক্টের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করতে প্রবৃত্ত হন তারা চিত্রশিল্পকে রমরমা ব্যবসায় পরিণত করে জাহান্নামগামী মানুষের মিছিলকে প্রলম্বিত করছেন। কারণ বিজ্ঞাপন উদ্যোক্তাদের কারণেই চিত্রশিল্পের প্রতি মানুষের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ চাহিদা সৃষ্টির ফলেই মানুষ চিত্রশিল্পের মত নিষিদ্ধ কর্মে আত্মনিয়োগ করছেন। তারা নিজেরা জীবচিত্র ব্যবহার করে পাপের পঙ্কিলতায় নিজেদের জীবনকে কলঙ্কিত করেছেন, সাথে সাথে বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে জীবচিত্র সৃষ্টিতে আগ্রহী করে জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তির সম্মুখীন করছেন।

২. ভিনদেশী অপসংস্কৃতির উন্মাতাল আয়োজন

সাংস্কৃতিক দিক থেকে যদি আমরা হালের বিজ্ঞাপনকে জাস্টিফাই করি তবে দেখতে পাবো তাতে বেশ ঘটা করেই ভিনদেশী সংস্কৃতির অনুশীলন হচ্ছে এবং পণ্য প্রচারের আবরণে বিজাতীয় এ সাংস্কৃতিক প্রাদুর্ভাব পরিকল্পনা করেই ঘটানো হচ্ছে। ইসলামফোবিয়া সৃষ্টিকারী বিধর্মীচক্রের যুগপরম্পরাগত লালিত স্বপ্ন হলো, মুসলিম সম্প্রদায়কে হৃৎপি-হীন শৃগালে পরিণত করা। তারা তাদের ‘ড্রিম আইডিয়া’কে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে কার্যকরী মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে। এক দিকে তারা পণ্যসেবার অন্তরালে মুসলিম সমাজের কাড়ি কাড়ি অর্থ লুটে নিচ্ছে। অন্য দিকে পণ্য প্রচারের সুমিষ্ট শ্লোগানে ইসলামী সংস্কৃতির অপমৃত্যু ঘটিয়ে ভিনদেশী কালচারকে মুসলিম জাতির দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে তাদেরকে হৃৎপি-হীন শৃগালে পরিণত করছে। আজ আমরা ব্যবহারিক জীবনে যেসব পণ্যসেবা গ্রহণ করি তার সিংহভাগই ভিনদেশী বহুজাতিক কোম্পানীর প্রোডাক্ট। তারা বিজ্ঞাপনের জাদুর কাঠিতে মুসলিম সম্প্রদায়ের বাজার ব্যবস্থাকেও নিজেদের করায়ত্ব করে নিয়েছে। ফলে তারা খুব সহজেই বিজ্ঞাপনী ডামাডোলে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে ষোলকলায় পূর্ণতা দিতে সক্ষম হচ্ছে। অন্যদিকে মুসলিম মালিকানাধীন কোম্পানীগুলো মুক্তবাজার অর্থব্যবস্থায় টিকে থাকার প্রতিযোগিতায় ভিনদেশী বিজ্ঞাপনের মডেলে নিজেরা বিজ্ঞাপন তৈরি করে পণ্য প্রচারণায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। ফলে তারা ভিনদেশী সাংস্কৃতিক প্রচারণায় বিজাতিদের সহযোগিতে পরিণত হয়েছে। ভিনদেশী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর চরিত্র হলো, তারা সিংহভাগ বিজ্ঞাপন একটি দেশের জন্য নির্মাণ করে। এরপর সেগুলোকে বিভিন্ন রাষ্ট্রে নানা ভাষায় ডাবিং করে প্রচার করে। এতে অন্য দেশের জন্য উপযোগী বিজ্ঞাপন আমাদের এ মুসলিম দেশে কি করে উপযোগী হতে পারে? এসব সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের প্রশাসনের কেউ মাথা ঘামানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না। কৃষ্টি-কালচার, পোশাক-পরিচ্ছদ, দেশজ রীতি-নীতিসহ নানা বৈসাদৃশ্যের এ দেশে এ জাতীয় বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য কি করে অনুমোদন লাভ করতে পারে? বৈষয়িক বিবেচনায়ই তো এ ধরনের ভিনজাতীয় কালচারাল বিজ্ঞাপনতো বেখাপ্পা ও ভাঁড়ামি বলে গণ্য হয়। সুস্থ রুচিবোধ ও জাত্যাভিমান এ জাতীয় বিজ্ঞাপনকে আদৌ সমর্থন করতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, রাসূল তোমাদেরকে যা কিছু দান করেছেন তাই তোমরা গ্রহণ করো। এবং যেসব ব্যাপারে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকো। (সূরা হাশর-৭) অন্য দিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য গ্রহণ করবে সে তাদের শ্রেণীভুক্ত গণ্য হবে। (সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস নং ৪০৩৩) আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে যে উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতি দান করে গেছেন তা নিয়েই আমাদের তুষ্টি লাভ করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আমরা খোদাপ্রদত্ত সে সভ্যতা-সংস্কৃতিকে শিকেয় তুলে পরসংস্কৃতির আয়োজনে উন্মাতাল হয়ে আছি। শুধু এতটুকুতেই আমরা তৃপ্ত নই; বরং এ অপসংস্কৃতিকে প্রতিটি মুসলিমের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে বিধর্মীদের পিঠচাপড়ানি লাভ করছি। আচার-আচরণ, সভ্যতা-সংস্কৃতি-সহ যাপিত জীবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডে বিজাতিদের সাদৃশ্য গ্রহণ করে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনে তাদের দলভুক্তির সার্টিফিকেট গ্রহণ করে নিচ্ছি।

৩. বাকশিল্পের চতুর আয়োজনে ‘সত্যিকার’ মিথ্যা প্রলাপ

হালের বিজ্ঞাপনগুলোতে পণ্য প্রসারের প্রতিযোগিতায় যে পরিমাণ মিথ্যার পরিবেশনা হচ্ছে তাতে মানুষের পিলে চমকে যাবার কথা। বস্তুত বিজ্ঞাপন মাধ্যমে পণ্যের গুণাগুণ প্রচার হবে এটাই স্বীকৃত বাস্তবতা। কিন্তু পণ্যের গুণ-মান প্রচারে সিংহভাগ বিজ্ঞাপনই মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। মিথ্যাই যেন তাদের ব্যবসার মূলধন। মিথ্যার করুণা না হলে যেন তাদের ব্যবসাই নিশ্চল। বহুজাতিক এমনো কোম্পানি রয়েছে যাদের বিজ্ঞাপন উন্নত দেশে মিথ্যাচারের অভিযোগে নিষিদ্ধ। কিন্তু আমাদের মুসলিমপ্রধান দেশে সে বিজ্ঞাপন এখনো প্রচারিত, এমন কি সর্বাধিক প্রচারিত। ‘হরলিক্স’ বিজ্ঞাপনে ভাষ্যকারের দাবী হল, এ পানীয় পান করলে শিশুরা Taller, Sharper and Stronger হবে। অর্থাৎ আরো লম্বা, আরো শক্তিশালী, আরো বুদ্ধিদীপ্ত হবে। পণ্যটির উৎপাদনকারী কোম্পানির এ দাবির কোনো ভিত্তি না থাকায় উন্নত দেশে বিজ্ঞাপনটি নিষিদ্ধ হয়েছিল। বরং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এটা স্বীকার করে নিয়েছিল যে, বিজ্ঞাপনটি বাংলাদেশের মত অনুন্নত দেশের জন্য তৈরি করা হয়েছে। ভুলক্রমে তা উন্নত দেশে (ব্রিটেনে) প্রচারিত হয়েছে। বিশ্বখ্যাত নেসলের ম্যাগি নুডলস-এর বিজ্ঞাপনও ব্রিটেনে একই কারণে নিষিদ্ধ হয়েছিল। বিজ্ঞাপনটির ভাষ্য ছিল, এই নুডলস খেলে হাড় ও মাংসের গড়ন বৃদ্ধি পায়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বহুজাতিক তামাশার এ হলো রকমফের। আর দেশীয় পণ্যের বিজ্ঞাপনে মিথ্যা ও প্রতারণা তো ওপেন সিক্রেট। মিথ্যাই যেন মূল পণ্য।

প্রসঙ্গত প্রশ্ন হতে পারে, বিজ্ঞাপন নিয়ে আমরা কেন কথা বলছি? বিজ্ঞাপন নিয়ে ভাববার জায়গাটা কোথায়? হ্যাঁ বিজ্ঞাপন নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ একটি বিজ্ঞাপন একটি ধারণার নেতৃত্ব দেয়। বস্তুত প্রতিটি সত্তাই একেকটি নেতৃত্বের ধারক। এ নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় ক্ষমতার বলয়, যা আকৃষ্ট করে কোটি কোটি ভোক্তাকে। একজন বিজ্ঞাপন মডেল একটি স্টাইল প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। একজন বিজ্ঞাপন নির্মাতা একটি ধারণা বিপুল জনগোষ্ঠির মনে গেঁথে দেয়ার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বিজ্ঞাপন এতটাই শক্তিশালী যে, একটি বিজ্ঞাপন দেখেই গানের প্রতিযোগিতার অডিশনে জমায়েত হয় লক্ষ মানুষ। একটি প্রজন্মের কথা বলার পুরো ভাষাই পরিবর্তন করে দিতে পারে একটি ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন। এ কারণেই বিজ্ঞাপন একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। একটি বিজ্ঞাপন একটি প্রজন্মের এবং একটি জাতির রুচিবোধের প্রতিনিধিত্ব করে। অনেক সময় রুচিবোধের জায়গাটি তৈরি করে কিংবা বদলে দিতে পারে। সুতরাং একটি জাতিকে সঠিক পথের দিশা দিতে একটি বিজ্ঞাপনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। একটি প্রজন্ম কিংবা জাতিকে বিপথগামী করতেও একটি বিজ্ঞাপনের জুড়ি নেই। এ কারণে বিজ্ঞাপনের এ জায়গাটিতে সুস্থ বিজ্ঞাপন চর্চার নিমিত্ত ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলকেই আপন আপন জায়গা থেকে কর্মনীতি গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন।

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *