গণমাধ্যমে সংবাদ পরিবেশন : একটি সাধারণ পর্যালোচনা

মাওলানা আব্দুল হাই


প্রস্তাবনা

বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ। এদেশের প্রায় নব্বই ভাগ অধিবাসী মুসলিম। মুসলিমরা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতি। তাদের রয়েছে নিজস্ব ধর্ম, চিন্তা-ভাবনা, শিক্ষা-দীক্ষা, সভ্যতা-সংস্কৃতি। এক কথায় সর্বস্তরের মুসলমানের দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় বিষয়ের নিখুঁত নির্দেশনা, যার সবই ওহীভিত্তিক সূত্রপরম্পরায় অর্জিত।

মুসলমানের জন্য তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে মনোনীত ধর্ম ইসলাম অনুযায়ী জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করা অবশ্য কর্তব্য। আর ইসলাম নামসর্বস্ব কিছু প্রথা বা মনগড়া কিছু আচার অনুষ্ঠান পালনের নাম নয়। বরং ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক, আন্তর্জাতিকসহ জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে ইসলাম দিয়েছে সুস্পষ্ট, স্বচ্ছ ও সমুজ্জল দিক নির্দেশনা। এসব দিক নির্দেশনার কতক করণীয় আর কতক বর্জনীয়। কিছু কার্যত আর কিছু বিশ্বাসগত। তবে ইসলামের এই ওহিভিত্তিক নির্দেশনা মানব জীবনে বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত হলো তার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ও সম্যক জ্ঞান লাভ করা। প্রচলিত সংবাদপত্রগুলো বস্তুগতভাবে সংবাদ মাধ্যম হলেও এগুলো হালে জ্ঞানমাধ্যম হিসেবে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে।

উপরন্তু সংবাদপত্রগুলো আলাদা বিভাগ তৈরি করে দীন বিষয়েও ফিচার, নিবন্ধ এবং সংবাদ পরিবেশন করছে। তাই বলে সংবাদপত্রগুলোকে দীনী জ্ঞান অর্জনের উপযুক্ত মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করার সুযোগ নেই। মূলত পত্রিকাগুলোর ধর্মীয় ফিচার, নিবন্ধ এবং সংবাদগুলো কতটুকু দীনী জ্ঞানমাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত হবে তা নির্ভর করে কলামিষ্ট, প্রবন্ধকার এবং সংবাদ পরিবেশনকারীর বিশ্বাস, যোগ্যতা এবং দীন বিষয়ে তার জানা শোনার মাত্রাগত দিকটির উপর। কিন্তু পাঠকশ্রেণী এসব দিকগুলো বিবেচনা না করে অনেক ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমগুলোকে অন্যতম দীনী জ্ঞানমাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। তবে সাধারণ জ্ঞানের বিকাশ এবং মানব উন্নয়নে সংবাদপত্রগুলোর ভূমিকা সর্বজন স্বীকৃত।

‘জাতীয় দৈনিকে কৃষি বিষয়: আধেয় বিশ্লেষণ’ শিরোনামের একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে,
উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় গণযোগাযোগ মাধ্যম সমূহের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কৃষির উন্নয়নে গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্র সমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। জনগণকে কৃষি বিষয়ে সচেতন, শিক্ষাদান করতে পারে সংবাদপত্র। একটি জাতির জন্য গণমাধ্যম সমূহ পাহারাদার,শিক্ষক এবং নীতি নির্ধারকের ভূমিকা পালন করে। (মিজানুর রহমান : জাতীয় দৈনিকে কৃষি বিষয়: আধেয় বিশ্লেষণ, নিরীক্ষা, গণমাধ্যম সাময়িকী, [অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১০] প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ, ঢাকা)

উক্ত উন্নয়ন যেমন ইহলৌকিক হতে পারে আবার পারলৌকিক ও হতে পারে। তাই একটি সংবাদমাধ্যম যেমন একজন মানুষের জাগতিক কল্যাণ বয়ে আনতে পারে তেমনিভাবে পরকালীন কল্যাণও বয়ে আনতে পারে।

সাধারণত মানুষের অর্জিত শিক্ষার প্রভাব তার মনোভাব ও কাজ-কর্মে প্রতিফলিত হয়ে থাকে। একটি গবেষণায় বলা হয়েছে,

বিশেষ করে কৃষি ক্ষেত্রে সম্প্রসারণ শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। মানুষের অভিজ্ঞতা ও সামর্থ লাভের ধাপকেই শিক্ষা বলে। আর শিক্ষা তার জ্ঞান, মনোভাব, কর্ম-কুশলতা, আচার-আচরণ এবং সরল চরিত্র গঠনে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আনে। (মাহাবুবুর রহমান : কৃষি উন্নয়নে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর যোগাযোগ বার্তার কার্যকারিতা : নিরীক্ষা, গনমাধ্যম সাময়িকী, অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০১০, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ)

সুতরাং এসব উদ্ধৃতি থেকে প্রতীয়মান হয়, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ যেমন মানুষের বাহ্যিক অবস্থা পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে তেমনিভাবে মানুষের চিন্তা-চেতনা ও অভ্যন্তরীণ অবস্থার পরিবর্তনেও ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে যদি সংবাদ ধর্মীয় বিষয় সংশ্লিষ্ট হয় তাহলে এসব বিষয়ের পক্ষে বা বিপক্ষে জ্ঞান অর্জন ও চিন্তা চেতনা তৈরিতে গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা থাকাটা খুবই যৌক্তিক।

সুতরাং পত্রিকা পাঠে আগ্রহী শিক্ষিত শ্রেণীর ঈমান আকীদা ও আমলের অনেকখানি নির্ভর করে বাংলাদেশের প্রতিদিনের প্রকাশিত জাতীয় এবং আঞ্চলিক শতাধিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ বা সংবাদ উপস্থাপনা ভঙ্গির উপর। বর্তমান পর্যালোচনায় এ জাতীয় সংবাদ নির্বাচন এবং ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে তার বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের চেষ্টা করা হয়েছে।

সংবাদপত্র বাছাই

‘গণমাধ্যমে সংবাদ পরিবেশন : একটি সাধারণ পর্যালোচনা’ বিষয়ক পর্যালোচনাটি সম্পাদনের জন্য ঢাকার প্রধান ৪টি সংবাদপত্র সামনে রাখা হয়েছে স্বেচ্ছাচয়িতভাবে। সেগুলো হল-

১- প্রথম আলো
২- ইত্তেফাক
৩- সমকাল
৪- আমাদের সময়

সময়কাল

সংবাদের বাস্তবতা যাচাই এবং পর্যালোচনা কর্মের জন্য প্রদত্ত সময়সীমার কথা বিবেচনা করে যে সময় কে বেছে নেয়া হয়েছে তাও স্বেচ্ছাচয়িত। ১লা এপ্রিল ২০১৪ থেকে ৩রা এপ্রিল ২০১৪ পর্যন্ত। উল্লেখিত সময়ের নির্বাচিত সংবাদপত্রগুলোর সংবাদ কাঠামো এতে পর্যলোচনা করা হয়েছে। মোট ৩০ দিনের পত্রিকা যাচাই করা হয়েছে। জরিপে দেখা যাচ্ছে,

১। দৈনিক প্রথম আলো; ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট সংবাদ সংখ্যা ৩৫টি।
২। দৈনিক ইত্তেফাক; ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট সংবাদ সংখ্যা ৩৭টি।
৩। দৈনিক সমকাল; ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট সংবাদ সংখ্যা ২৯টি।
৪। দৈনিক আমাদের সময়; ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট সংবাদ সংখ্যা ৩৭টি।

দেশের জাতীয় চারটি দৈনিক পত্রিকার (১লা এপ্রিল ২০১৪ থেকে ৩০শে এপ্রিল ২০১৪ পর্যন্ত) সংবাদ বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এই সাতদিনে সংবাদপত্রে ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট সংবাদ সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক ইত্তেফাক ও আমাদের সময়ে (সর্বমোট ৩৭টি করে) এবং সবচেয়ে কম সমকালে (সর্বমোট ২৯টি)।

উদ্দেশ্য

বর্তমান পর্যালোচনা পরিচালনার উদ্দেশ্য হল, বাংলাদেশে দৈনন্দিন প্রকাশিত সংবাদ মাধ্যমে ধর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট খবরগুলো ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করা এবং ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীত সংবাদগুলোর কারণে সমাজের উপর প্রকাশিত কু-প্রভাবগুলো খুঁজে বের করা।

সংবাদপত্রের ধর্মীয় প্রয়োজনীয়নতা

পার্থিব রীতি-নীতির দিকে তাকালে দেখা যায়, সংবাদপত্রগুলো অত্যন্ত উপকারী ও প্রয়োজনীয় প্রকাশনা। বরং বর্তমানে তা জাতীয় ও সামাজিক জীবনে অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনাদর্শে গণমাধ্যমকেন্দ্রিক প্রতিপাদ্য বিষয়ের উত্তম নমুনা রয়েছে। হযরত হাসান রাযি. হিন্দ ইবনে হালা রাযি. এর সূত্রে একটি দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাতে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অভ্যাস ও গুণাবলীর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে,

وسألته عن مخرجه كيف كان يصنع فيه فقال: كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يخزن لسانه إلا مما يعنيه ويؤلفهم ولا يفرقهم أوقال: يتفرقهم شك أبو غسان و يكرم كريم كل قوم ويوليه عليهم ويحذر الناس ويحترس منهم من غير أن يطوي على أحد بشره ولا خلقه ويتفقد أصحابه ويسأل الناس عما في الناس ويحسن الحسن ويقويه ويقبح القبيح ويوهيها.

অর্থ : হাসান রাযি. বলেন, এরপর আমি হিন্দ বিন আবি হালার কাছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাইরে অবস্থানকালীন আচার আচরণ সম্পর্কে জানতে চাইলম। তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনর্থক কথা-বার্তা থেকে নিজের বাকশক্তিকে সংযত রাখতেন। মানুষের সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়তেন। তাদের সাথে এমন আচরণ করতেন না যাতে তারা দূরে সরে যায়। প্রত্যেক গোত্রের সম্মানিত ব্যক্তিকে সম্মান করতেন এবং তাকে গোত্র প্রধান নিযুক্ত করতেন। মানুষকে আল্লাহর শাস্তি সম্বন্ধে ভীতি প্রদর্শন করতেন এবং মানুষের অনিষ্টতার ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতেন। তবে এক্ষেত্রে তিনি সহাস্যভাব ও উত্তম চরিত্র-মাধুর্য বজায় রাখতেন। নিজ সঙ্গীদের খোঁজ খবর নিতেন। জনসাধারণের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন। ভালো বিষয়ের প্রশংসা করে তার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করতেন। আর মন্দ বিষয়ের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করে তা প্রতিহত করতেন। (আলজামে’ লিশুআবিল ঈমান; হা.নং ১৪৩০)

হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত একটি বর্ণনায় রয়েছে,

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا فَقَدَ الرَّجُلَ مِنْ إِخْوَانِهِ ثَلاثَةَ أَيَّامٍ، سَأَلَ عَنْهُ ، فَإِنْ كَانَ غَائِبًا دَعَا لَهُ، وَإِنْ كَانَ شَاهِدًا زَارَهُ، وَإِنْ كَانَ مَرِيضًا عَادَهُ.

অর্থ : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে তাঁর কোন ভাইয়ের (সাহাবীর) তিন দিন পর্যন্ত সাক্ষাত না ঘটলে তিনি অন্যদের কাছে তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন, অমুক কোথায়? তিনি সফরে থাকলে তার জন্য দু’আ করতেন। নিজ বাড়িতে থাকলে তার সঙ্গে সাক্ষাত করতেন। আর অসুস্থ হলে খোঁজ খবর নিতেন। (মুসনাদে আবূ ইয়ালা; হা.নং ৩৪২৯)
উল্লিখিত হাদীস দু’টি এ কথার প্রমাণ বহন করে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকজনের খোঁজ-খবর নেয়া এবং সাহাবাদের বিভিন্ন বিষয় ও অবস্থার অবগতির উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতেন।

বর্তমানে বিশ্ব-মুসলিমের সার্বিক অবস্থা জানার একটি মাধ্যম হলো সংবাদপত্র। সুতরাং-

(১) সংবাদপত্র ‘সুন্নাতে তাফাক্কুদ’ তথা মুসলমানদের খোঁজ-খবর নেয়ার মত মহতী কাজের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।

(২) মুসলমানদের জাতীয় সংকট ও দুঃখ-দুর্দশার কথা সংবাদপত্রের মাধ্যমে সহজেই সারা বিশ্বে পৌঁছানো যায়।

(৩) সংবাদপত্রের মাধ্যমে মুসলমানদের দাবীসমূহ অনায়াসে উত্থাপন করা যায়।
এছাড়াও আরো বিভিন্ন কারণে সংবাদপত্রের প্রয়োজনীয়তা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে স্বীকৃত।

সাংবাদিকতার মৌলিক বিষয়

বস্তুত সাংবাদিকতার মূল বিষয় হলো, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণকর ও সৎকর্মগুলো আকর্ষণীয় উপস্থাপনায় লোকসমাজে তুলে ধরা যাতে মানুষ এর দিকে আগ্রহী ও অনুপ্রাণিত হয়। অন্য দিকে সমাজ ও রাষ্ট্রের অসঙ্গতিকে তুলে ধরে তার অপনোদনে সাহসী ভূমিকা পালন করা। অন্য কথায় সৎকাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধে যুগপৎ ভূমিকা পালন করাই হলো সংবাদপত্রের প্রতিপাদ্য বিষয়। ভালো কাজের প্রচার প্রসার এবং মন্দ কাজে বাধা প্রদানের মহৎ উদ্দেশে কলম যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়াই হলো ইসলামী সাংবাদিকতার মৌলিক উপাদান। কুরআনের ভাষ্যানুযায়ী সৎ ও কল্যাণকর কাজের প্রচার প্রসার এবং সমাজের অসঙ্গতির অপনোদন নবীগণের প্রেরণের প্রধানতম উদ্দেশ্যে। সারকথা, সাংবাদিকতা একটি পবিত্র কর্মক্ষেত্র। সুতরাং সত্যের প্রতি আহ্বানকারী দায়ীর জন্য যে সকল বৈশিষ্ট কুরআন-সুন্নায় চিহ্নিত করা হয়েছে তা একজন মুসলিম সাংবাদিকের মাঝেও থাকা আবশ্যক।

সাংবাদিকতার ফলপ্রসূ শর্ত

১. একজন সাংবাদিক যা লিখবেন তা যেন হয় সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ; ভ্রান্ত ও অসত্য উপস্থাপনায় যেন সংবাদটি কলুষিত না হয়।

২. উদ্দেশ্য সৎ ও সমাজ বান্ধব হওয়া চাই। মানবাধিকার ও মানব কল্যাণের সুমহান আবেগ ও সদিচ্ছা নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করতে হবে। নিজের বড়ত্ব ও বীরত্ব প্রদর্শন অথবা অসৎ উদ্দেশে কিংবা প্রবৃত্তির তাড়নায় বিনা কারণে কাউকে হেনস্থা বা কারো মানহানি করা উদ্দেশ্য হতে পারবে না। এমনিভাবে বক্তব্যের মাঝে তোশামোদী কিংবা পক্ষপাতমূলক অনুষঙ্গ থাকতে পারবে না; বরং এমন লেখা পরিবেশন করতে হবে যা হক ও ন্যায়সঙ্গত।

৩. সংবাদ পরিবেশন পদ্ধতিটিও বিধিসম্মত হতে হবে। সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে এমন কোন উপায় বা প্রক্রিয়া গ্রহণ করা যাবে না যা ইসলামী বিধিসম্মত নয়।
(ইসলামী সাংবাদিকতা; পৃষ্ঠা ৫০, মাকতাবাতুল হেরা)

আদর্শসমাজ বিনির্মাণে সংবাদপত্রের ভূমিকা

একথা সর্বজন বিদিত যে, সাংবাদিকতা একটি জাতির মেধা গঠন ও বিনাশের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। বর্তমান যুগে বংবাদপত্র ও বই পুস্তক প্রতিটি শিক্ষিত পরিবারের আবশ্যিক সংগ্রহ হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। সুতরাং এর মাধ্যমে হক কথা মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয় সম্ভব। বিশেষত এখন দৈনিক পত্রিকা যেন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। এমনকি নিরক্ষর লোকেরাও এর মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হচ্ছে।

এ অবস্থায় পত্রিকার সম্পাদক ও ব্যবস্থাপকদের উপর জাতির গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়ে পড়েছে। তারা জীবনের যে দিকটাকে গ্রহণ করেছেন তা নিছক একটি ব্যবসায়িক পেশা বা জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম নয়; বরং মেধাগত নেতৃত্ব ও নির্দেশনা দেয়ার মত গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্বও বটে। আর কারো জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা কোন জাতীয় বা সমষ্টিগত কাজের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার ব্যাপারটি আল্লাহ তা‘আলার মহা এক নেয়ামত। কারণ জাগতিক এবং পরকালীন কল্যাণ একই প্রক্রিয়ায় অর্জিত হয়ে যাচ্ছে।

তবে আক্ষেপের বিষয় হলো, এ দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের দেশের সাংবাদিকতা পর্যবেক্ষণ করলে অত্যন্ত নিরাশ হতে হয়। আজকাল পত্রিকাগুলোর বাহ্যিক আদর্শ ও চারিত্রিক দিকটি বিন্যস্ত করার সময় এ বিষয়ের প্রতি মোটেও লক্ষ রাখা হয় না যে, এর দ্বারা জাতির বিশেষ করে অপরিপক্ব মেধাসম্পন্ন নতুন প্রজন্মের উপর কি ধরনের প্রভাব পড়বে। আমাদের একথা লিখতে অপরিসীম দুঃখ অনুভব হচ্ছে যে, ব্যবসায়িক লাভ অর্জনের লক্ষ্যে আমাদের সমাজের দর্পন সাংবাদিক ভাইয়েরা পূত-পবিত্রতা ও চারিত্রিক মূল্যবোধকে পদদলিত করছেন। নগ্নতা ও বেহায়াপনা প্রসারের ক্ষেত্রে প্রত্যেক সংবাদপত্রই অন্যের আগে বাড়ার চেষ্টায় মত্ত থাকছে।… (ইসলামী সাংবাদিকতা, পৃষ্ঠা-৫৫)

এতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে সংবাদপত্রের অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। তাই আমাদের আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে আমাদের বর্তমান সংবাদপত্রের সংবাদ পরিবেশনের রুচিশীলতার উপর।

উপস্থাপনশৈলীর বিভিন্নতায় দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য

দৃষ্টিভঙ্গিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রচার মাধ্যমগুলোরও এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত কোন ভালো সংবাদও লেখকের উপস্থাপনা বা ভাষা প্রয়োগের ত্রুটির কারণে খারাপ সংবাদে পরিণত হতে পারে এবং কোন সমাজ বা জাতির ব্যাপারে বিরুপ প্রতিক্রিয়াও তৈরি করতে পারে। একটি গবেষণায় বলা হয়েছে,

অনেক সময় গণমাধ্যমে নারী বিষয়ক সংবাদ পরিবেশনে আরো বেশী ভারসাম্যহীনতা লক্ষ্য করি। ‘নারী ঘটিত কেলেঙ্কারি’, ‘চরিত্রহীনা’, সম্ভ্রমহানী ‘পরনের কাপড় খুলে অর্ধ উলঙ্গ করে’, ‘দেহ মিলন’ ইত্যাদি অসংবেদনশীল শব্দ ব্যবহার করা হয় সংবাদপত্রে, যা নারীর প্রতি এক প্রকার সহিংস আচরণ ছাড়া আর কিছু নয়।… নির্যাতিত অথবা আক্রান্ত নারীর আলোকচিত্র অনেক সময় এমনভাবে প্রস্ফুটিত করা হয় যে, তা নারীর ‘রমণীয়’ দিককে প্রতিফলিত করতে সাহায্য করে।… গণমাধ্যমের এক্ষেত্রে যা করা উচিৎ তাহলো,

১. নারী জড়িত আছে এমন সংবাদ বা ফিচারে শব্দ বাক্য ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

২. নারী হেয় প্রতিপন্ন হয় অথবা অবমূল্যায়িত হয় এমন শব্দ বাক্য পরিহার করতে হবে। (মুহাম্মাদ আবদুল হাননান, প্রথম যুগের গ্রামীণ সাংবাদিকতা, কথা প্রকাশ, ২০১৪, পৃষ্ঠা ১০, ১৩২-১৩৩)

উক্ত গবেষণা উদ্ধৃতির আলোকে এ কথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, শব্দ প্রয়োগে অসতর্কতা মানুষের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। কখনো কোন জাতি বা গোষ্ঠির ব্যাপারে জনমনে অশ্রদ্ধা, ঘৃণা এবং আতঙ্ক তৈরি করে।

সুদীর্ঘ কাল পর্যন্ত ইসলাম ধর্ম এবং মুসলিম জাতির প্রতি সকল মানুষের একটি শ্রদ্ধাবোধ ছিল। ইসলাম শান্তির ধর্ম জনমনে এ কথার বিশ্বাস ছিল। মুসলমান শান্তিপ্রিয় জাতি হিসেবে তাদের প্রতি সকলের শ্রদ্ধাবোধ ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছর যাবত কিছু কিছু পত্রিকায় অত্যন্ত সুক্ষèভাবে প্রচার প্রচারণায় জনমনের সেই পবিত্র ও স্বচ্ছ ধারণা হ্রাস পেতে শুরু করেছে। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে তা বিদ্বেষে পরিণত হয়েছে। ইসলামের নাম শোনা মাত্রই ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্প্রদায়িকতার শ্লোগান তোলা, আলেম উলামার প্রসঙ্গ আসলে মৌলবাদী, কাঠমোল্লা, ধর্মান্ধ, তেতুল হুযুর, ইত্যাদি শব্দে জর্জরিত করা আর সাধারণ মুসলমানদের জঙ্গিবাদ, সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুসহ কিছু নিচাশয় বুলির মাধ্যমে পুরো মুসলিম জাতিকে বিশ্বমঞ্চে এক অপরাধ প্রবণ জাতি হিসেবে উপস্থাপন করার মত ঘৃণিত কাজ সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের কল্যাণেই(?) সম্ভব হয়েছে।

এছাড়াও ‘ওরা চলে গেল না ফেরার দেশে’, ‘সায়েমুর রহমানের অকাল মৃত্যু’, ‘হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন’, ‘প্রেমের বলি হতে হল’, দুর্বৃত্তরা ওদের প্রাণ কেড়ে নিল’, ‘দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের এগিয়ে আসতে হবে’ এ জাতীয় সংবাদ শিরোনামের মাধ্যমে ইসলামের স্বতঃসিদ্ধ আকীদা-বিশ্বাসকে নির্মূল করা হচ্ছে। তাই সংবাদপত্রে এহেন সংবাদ ও শব্দাবলির ব্যবহারে সতর্ক হওয়া সংবাদকর্মীদের ঈমানী ও জাতীয় দায়িত্ব।

নির্ভুল সংবাদ পরিবেশন

সংবাদপত্র জাতির দর্পণ। সংবাদপত্রের মাধ্যমে জাতি এবং সমাজের চিত্র সবার সামনে ফুটে ওঠে। তাই সংবাদ হতে হয় সত্য এবং বস্তুনিষ্ঠ। আর এ জন্য সংবাদকর্মীর দায়িত্ব অনেক বেশী। কেননা যে কোন সংবাদ তার মাধ্যমেই জনসম্মুখে বেরিয়ে আসে। তাই যে কোন সংবাদ প্রকাশের আগে তার সত্যতা যাচাই করা সংবাদকর্মীর অপরিহার্য দায়িত্ব। আর এ দায়িত্বের কথা মহা পবিত্র আল কুরআনেও বর্ণিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا.

অর্থ : হে ঈমানদারগণ! যদি কোন পাপাচারী ব্যক্তি তোমদের কাছে কোন সংবাদ নিয়ে আসে তবে তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে …। (সূরা হুজুরাত- ৭)

উক্ত আয়াতে পাপাচারী ব্যক্তির সংবাদকে যাচাই বাছাই করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং আয়াতের নির্দেশ অনুযায়ী কোন সংবাদকর্মীর জন্য লোকমুখে শ্রুত কোন ঘটনা সরেজমিন পর্যবেক্ষণ বা গ্রহণযোগ্য যাচাই বাছাই ছাড়া পত্রিকার পাতায় ছেপে দেয়া যাবে না।

অন্য আয়াতে ঘোষিত হয়েছে,

وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ الخ

অর্থ : যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই তার পিছনে পড়ো না। নিশ্চয়ই কর্ণ, চক্ষু ও অন্তঃকরণ এদের প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে। (সূরা বনী ইসরাঈল- ৩৬)

এই আয়াতেও অজানা বিষয় থেকে সতর্ক থাকার সবিশেষ নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কারণ অজানা বা অনুমান নির্ভর কোন সংবাদ প্রকাশের দ্বারা মানুষের ইজ্জত-সম্মান, ধন-দৌলত ক্ষতির সম্মুখিন হয়। কখনো বা নিজের এবং পরিবারের প্রাণ নাশের অবস্থা তৈরী হয়। অথচ এ সবের নিরাপত্তার ব্যাপারে ইসলামের সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। আর কোন ক্ষেত্রে সংবাদ যদি সঠিক না হয় তাহলে তা বুহতান অর্থাৎ অপবাদের পর্যায়ভুক্ত হতে পারে। যা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

আর যদি ঘটনা সত্য হয় তাহলে তার চর্চা করা গীবত বা পরনিন্দার অন্তর্ভুক্ত হবে। যার ভয়াবহতাও বর্ণনাতীত। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَحِيمٌ.

অর্থ : তোমাদের কেউ যেন পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভ্রাতার গোশত ভক্ষণ করাকে পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণাই কর। (সূরা হুজুরাত- ১২)
আয়াতে গীবত তথা পরনিন্দাকে আপন মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণের সাথে তুলনা করা হয়েছে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হচ্ছে,

الغيبة اشد من الزنا.

অর্থ : পরনিন্দা ব্যভিচার থেকেও মারাত্মক। (আলজামে’ লিশুআবিল ঈমান; হা.নং ৬৭৪১)
সুতরাং শরীয়ত নির্ধারিত কয়েকটি স্থান ব্যতীত সর্বত্রই পরনিন্দা ত্যাগ করা অপরিহার্য। অন্যথায় ইহকাল ও পরকালের সমূহ ক্ষতি অবশ্যম্ভাবি।

পাশাপাশি সত্য, বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ সকল পাঠক ও দর্শকের প্রাণের দাবী। তাই একজন সংবাদকর্মীর সংবাদ অন্য দু’ চার জন মানুষের সংবাদের মত হতেই পারে না। একটি গবেষণায় বলা হয়েছে,

কিন্তু একজন সাধারণ পথচারীর চোখ আর একজন সাংবাদিকের চোখ এক নয়। একজন সাংবাদিক কখনোই মরার মতো পড়ে থাকলে কাউকে মৃত মনে করবেন না। তাই যাচাই ছাড়া কোন সংবাদ প্রচার করা যাবে না। (নিরীক্ষা, গণমাধ্যম সাময়িকী, নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০১৩, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা ৩১)

পত্রিকার সংবাদ পর্যালোচনা

এক.
১৯.০৪.২০১৪ খ্রি.। প্রথম আলো পত্রিকার একটি শিরোনাম ছিল ‘সঠিক চিকিৎসা হলে বাবা আজ পাশে থাকতেন’। সংবাদটিতে বলা হয়েছে ফারহানা বারডেম হাসপাতালে বারবার এ কথা বলে মূর্ছা যাচ্ছিলেন। কিন্তু উক্ত কথাটিতে চিন্তার বিষয় রয়েছে। কারণ তা একজন মুমিন মুসলমানের বিশ্বাস পরিপন্থী কথা। একজন মানুষের জীবনে সুখ-দুঃখ নিতান্তই তার ভাগ্যের বিষয়। একজন মুসলমান জীবনের শুরু থেকেই বিশ্বাস করে যে, নিয়তির ভালোমন্দ সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়। সুতরাং কোন কিছু ঘটে যাওয়ার পর তার জন্য কোন মানুষকে দায়ী করা কিংবা কোন ঘটনা বা ইস্যুকে নির্দিষ্ট করে শুধুমাত্র তাকেই দায়ী করা এটা আদৌ কোন মুসলমানের জন্য শোভা পায় না। বরং এ কথার একনিষ্ঠ বিশ্বাস থাকতে হবে যে, ঘটনা এটি ঘটবে বিধায় এই উপলক্ষের সম্মুখিন হতে হয়েছে। এটা হচ্ছে একজন মুসলমানের নিরঙ্কুশ তাওহীদের আবেদন। সুতরাং কোন ব্যক্তির মৃত্যুর জন্য এককভাবে কোন কিছুকে দায়ী করা ঈমানের পরিপন্থী। কারণ মৃত্যু নির্ধারিত সময়ের আগেও হতে পারে না পরেও হতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي ضَرًّا وَلَا نَفْعًا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ لِكُلِّ أُمَّةٍ أَجَلٌ إِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ فَلَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ.

অর্থ : বলুন, আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত আমার নিজের ভালোমন্দের উপর আমার কোন অধিকার নেই। প্রতিটি জাতির একটি নির্দিষ্ট সময় আছে; যখন তাদের সময় এসে পড়বে তখন তারা মুহূর্তকালও বিলম্ব বা ত্বরা করতে পারবে না। (সূরা ইউনুস- ৪৯)

তাই কারো মৃত্যুর পর ‘এমন হলে বা এমন না হলে এমন হতো’ বলে মন্তব্য করা আদৌ উচিৎ নয়। তবে বাস্তবিক পক্ষেই যদি ঘটনার পেছনে প্রকৃত এবং যৌক্তিক কোন কারণ থেকে থাকে তা অনুসন্ধান করা, এবং সতর্কতা অবলম্বন করাতে কোন প্রকার বাধা নেই। বরং যৌক্তিক কারণ ঘটিত দুর্ঘটনার মোটিভ অনুসন্ধান করা একটি নৈতিক এবং বিধিসম্মত দাবি। নতুবা পৃথিবী তার বসবাসের উপযোগিতা হারিয়ে ফেলবে। কথা হলো, কারো মৃত্যু হলে এ কথার শ্লোগান তোলা যে, চিকিৎসায় অবহেলা হয়েছে বলেই মৃত্যু হয়েছে; অবহেলা না হলে মৃত্যু হত না এটা সরল অর্থে ঈমান এবং আকীদার সাথে সংঘর্ষপূর্ণ উক্তি। কারণ এ কথার মাধ্যমে আল্লাহর কালাম অসত্য প্রতীয়মান হয়ে যায়। বস্তুত মৃত্যু হবে বলেই চিকিৎসায় অবহেলাসহ এ জাতীয় নানা কার্যকারণ ও উপলক্ষ তৈরী হয়। কিন্তু এ কথার অর্থ এই নয় যে, চিকিৎসায় অবহেলাকারীগণ বা খুনিরা ছাড় পেয়ে যাবেন। বরং পরীক্ষা নিরীক্ষা ও তদন্তের পর দোষী সাব্যস্ত হলে অবশ্যই তাদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।

১৭.০৪.২০১৪ ইং তারিখের ইত্তেফাক পত্রিকায় এসব উক্তির ব্যাপারে খানিকটা খেদ প্রকাশ করে রিপোর্ট করা হয়েছে। সেখানে ‘সব রোগীর মৃত্যুর জন্য যেন চিকিৎসকই দায়ী’ শিরোনামে বলা হয়েছে, ‘চিকিৎসাধীন কোন রোগীর মৃত্যু হলেই স্বজনরা অভিযোগ করেন, ভুল চিকিৎসা কিংবা চিকিৎসকের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে। স্বজনরা বলে থাকেন, এই মৃত্যুর জন্য চিকিৎসকই দায়ী। … শাস্তি হওয়া উচিৎ।’

বস্তুত ঘটমান সবকিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে পূর্ব থেকেই নির্ধারিত। এবং সে নির্ধারণ অনুযায়ী সবকিছু সংঘটিত হয়। এক্ষেত্রে মৌলিকভাবে মানুষের ইচ্ছার কোন দখল নেই। যেহেতু সব বিষয়ই আল্লাহর নির্দেশের অনুগত সেহেতু কোন বিষয়ই নিছক মানুষের কর্মশক্তিতে পরিবর্তিত হতে পারে না।

সারকথা, মানুষের ইচ্ছাকৃত অনিচ্ছাকৃত সকল ক্রিয়া কলাপই আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত এবং বাস্তবায়িত হয়। তবে এক্ষেত্রে লক্ষণীয় হলো, মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত আংশিক ইচ্ছা শক্তিকে সকল কাজে ব্যবহার করতে পারে। এই ইচ্ছাশক্তির ব্যবহার ক্ষমতা আল্লাহ মানুষকে দান করেছে। এইচ্ছা শক্তিকে সে ভালো কিংবা মন্দ কাজে ব্যবহার করতে পারে। মূল কথা, আল্লাহ তা‘আলা সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। সকল সৃষ্টি ও অস্তিত্বের তিনিই একমাত্র উৎস। আর মানুষ কেবল কাসেব তথা অর্জনকারী; সে নিজ কর্মের স্বতন্ত্র সৃষ্টি কর্তা ও সংঘটন কর্তা নয়। (আবুল ফাতহ মুহাম্মদ শাহরাস্তানী, আলমিলাল ওয়ান নিহাল ১/৮৪)

বস্তুত প্রতিটি ঘটনার পেছনেই কোন না কোন উপলক্ষ বা কারণ থাকে। কোন কারণ বা উপলক্ষ ছাড়া কোন কিছুর আবর্তন হয় না। অধুনা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা একথাটিকে খুব শক্তিশালীভাবে প্রমাণ করে থাকে। মানবিক কার্যক্রিয়ায় যেসব কার্যকারণ পঞ্চইন্দ্রীয় দ্বারা আমরা উপলব্ধি করি তা মূলত মৌলিক কোন কার্যকারণ নয়। বরং এটি মানুষের আল্লাহ প্রদত্ত আংশিক ইচ্ছাশক্তি ব্যবহারের সামান্য প্রক্রিয়ামাত্র। তাই বাহ্যিক উপলব্ধ কার্যকারণকে মৌলিক কার্যকারণ হিসেবে বিশ্বাস করলে আমাদের পরম ধন ঈমানের বড় ধরণের ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই বাক্য ব্যবহারে আমাদের বিষম সচেতন হতে হবে। ভাষা প্রয়োগে যেন আমাদের ঈমানের আলোকছটা ফুটে উঠে এদিকটায় সবিশেষ মনোযোগী হতে হবে। সবশেষে কোন নিকটজনের মৃত্যুর কারণে যেন আমাদের ঈমান আকীদার মৃত্যু না ঘটে তার প্রতি আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

দুই.
১০.০৪.২০১৪ খ্রি.। প্রথম আলো এবং ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল,

… প্রথম রাষ্ট্রপতি নন, প্রথম মোকাব্বের।

রিপোর্টে বক্তার বক্তব্য এভাবে তুলে ধরা হয়েছে,

…হয়তো কানে কম শোনেন। ২৬ তারিখের ঘোষণার পর ২৭ তারিখে চট্টগ্রামে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে মোকাব্বেরের দায়িত্ব পালন করেছেন। কারণ ইমামতি একজনই করেন। বাকি সবাই মুকাব্বির।

বক্তব্যটি নিছক রাজনৈতিক। নিরেট এবক্তব্যটি নিয়ে আমাদের ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক কোন মন্তব্য নেই। তেমনিভাবে এব্যাপারে আমাদের কোন খেদ বা আগ্রহও নেই। বক্তব্যটিতে অনাকাঙ্খীতভাবে একটি ধর্মীয় শব্দ এসে পড়েছে। একান্ত ধর্মীয় তাগিদেই শব্দটি নিয়ে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে খানিকটা আলোচনা করতে হচ্ছে। বক্তব্যটিতে মোকাব্বের শব্দটির মিসইউস হয়েছে। কারণ শাব্দিক বা পারিভাষিক কোন অর্থেই ব্যবহৃত অর্থের জন্য শব্দটির প্রয়োগ যথার্থ নয়। মোকাব্বেরের শাব্দিক অর্থ হলো, তাকবীর তথা আল্লাহু আকবার উচ্চারণকারী, মহত্ব ও বড়ত্ব ঘোষণাকারী। আর পারিভাষিক অর্থ হলো, জামাতবদ্ধ নামাজে ইমামের সহযোগী। অর্থাৎ জামাত বড় হলে কিংবা ইমামের কণ্ঠ ক্ষীণ হলে ইমামের তাকবীর বা আল্লাহু আকবার শব্দকে উঁচু আওয়াজে সমস্ত নামাযীকে শুনিয়ে দেয়ার মহৎ কাজটি যিনি সম্পাদন করেন তিনিই হলেন মুকাব্বির।

প্রথম কথা হলো, মুকাব্বির পবিত্র একটি ধর্মীয় শব্দ। একটি রাজনৈতিক বক্তব্যে ধর্মীয় পবিত্র শব্দ দ্বারা উপমা উপস্থাপন করা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সীমাহীন গর্হিত কাজ। কারণ এধরণের সাদৃশ্য বর্ণনায় ধর্মীয় শব্দের পবিত্রতা ও মর্যাদা চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়। এতে করে ধর্ম অবমাননার মত গর্হিত প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়। কারণ স্বাধিনতা ঘোষণা নিছক একটি জাগতিক বিষয়। এতে পক্ষ বিপক্ষের সত্য মিথ্যাসহ নানা কূট কৌশল নিবিড়ভাবে জড়িত থাকে। এমন একটি কার্যক্রিয়ার সাথে নামাজের মত প্রধানতম একটি ধর্মীয় বিধানের কার্যনীতিকে তুলনা করা খুবই আপত্তিকর এবং সীমাহীন গর্হিত বিষয়।

দ্বিতীয়ত বক্তব্যটির তুলনা শৈলিতে বক্তার জ্ঞানগত ঘাটতি চরমভাবে ফুটে উঠেছে। কারণ ইমামতি একজনই করেন একথা তো যথার্থ। কিন্তু বাকি সবাই মুকাব্বির একথার স্বীকৃতি কে দিবেন? একসাথে সমস্ত নামাযীর মুকাব্বির হওয়ার প্রয়োজনীয়তাটা বা কোথায়? মুকাব্বিরের প্রয়োজনীয়তা সব ক্ষেত্রে দেখা দেয় না। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে মুকাব্বিরের দ্বারস্থ হতে হয়। মুকাব্বির ইমামের তাকবীরটি উঁচু আওয়াজে ঘোষণা করেন দূরবর্তী নামাযীদের কর্ণকুহুরে তা পৌছে দেয়ার জন্য। কিন্তু সবাই যদি একাজটি করে তাহলে কে কাকে শোনাবে? আর সকলের মুকাব্বির হওয়া কি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিধিসম্মত? কোন ইসলামী আইনবেত্তা কি এ কাজের স্বীকৃতি দিবেন?

বস্তুত কুরআন হাদীসের দৃষ্টিকোণ থেকে এধরণের স্বীকৃতি প্রদানের কোনই সুযোগ রাখা হয়নি। রাষ্ট্রীয় কর্ণধারদের এধরনের অনাকাঙ্খীত এবং অগভীর বক্তব্য থেকে সাধারণ মানুষ কি বার্তা গ্রহণ করবে? কথা বললে তো জেনে শুনেই বলা উচিৎ। অজ্ঞাত বিষয়ে কথা বলে লোক হাসিয়ে কি লাভ? বিশেষত দেশ শাসনের দ- যারা ধারণ করেন তারা যদি এধরণের কার্যক্রিয়ায় রত হন তবে তো দেশের ভাবমূর্তি এবং মূল্যবোধ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ভাষা প্রয়োগে আল্লাহ আমাদের সবাইকে সজাগ ও সচেতন হওয়ার সুমতি দান করুন।

তিন.
১৩ নিয়ে ভীতি

ইত্তেফাক, ৭ এপ্রিল, ২০১৪ এর একটি শিরোনাম এটি। রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে,
১৩ সংখ্যাটি নিয়ে মানুষের ভীতি আজ যুগ যুগ ধরে। এই ভীতির একটি গালভরা নামও দেয়া হয়েছে, ১৯১০ সালে ট্রিসকাইডেকাফোবিয়া, অর্থাৎ তেরোর আতঙ্ক। কিন্তু কেন এই আতঙ্ক? যীশুখ্রিস্টের শেষ নৈশ ভোজনে বিশ্বাসঘাতক জুডাস বসেছিল ১৩ নম্বর আসনে, বাইবেলে তাই বলে। সেখান থেকেই নাকি তেরোর আতঙ্কের সূচনা। প্রথমে ধরা হতো, কোন টেবিলে তেরোজনকে বসানোটাই অমঙ্গলজনক। পরে তেরো যুক্ত সব কিছুই আতঙ্ক ও ভীতির উৎস হয়ে উঠে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ভাইকিং যোদ্ধাদের কিংবদন্তিতে অপদেবতা ‘লো’ হলেন ত্রয়োদশ দেবতা। ভাগ্য গণনার ‘ট্যারট’ তাসের পাতাতেও তেরো নম্বর তাসটি হলো মৃত্যু। কোন মাসের তেরো তারিখ শুক্রবার পড়লে ইউরোপের মানুষদের ভীতি আবার অনেক বেড়ে যায়, কেননা যীশুখ্রিস্টকে শুক্রবারে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল। (ডয়চেভেলে)

এখানে কোন মানুষের ভীতি তা নির্ণয় করা বড় শক্ত কাজ হবে। কারণ আমাদের দেশের তথাকথিত সভ্যতার মুখরোচক বুলি আওড়াতে অভ্যস্ত এমন মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ ছাড়া অন্যদের ১৩’র ভীতি সম্পর্কে কোন খবরই নেই। আর এটা কোন মুসলমানের বিশ্বাস নয়। হতেও পারে না। কারণ ইসলাম এসব অশুভ লক্ষণকে প্রশ্রয় দেয় না। হাদীসে আছে,

قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لا عدوى ولا طيرة.

অর্থ : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সংক্রমণ এবং অশুভ লক্ষণ বলতে কোন জিনিস নেই। (সহীহ বুখরী; হা.নং ৫৩৮০)

এছাড়াও সংবাদটিতে যেসব কারণ উল্লেখ করা হয়েছে তা শক্তিশালী বা গ্রহণযোগ্য কোন কারণ নয়। বরং এগুলো অশুভ লক্ষণের ভিতকেই মজবুত করে। যীশু খ্রিস্টের শেষ নৈশভোজে বিশ্বাসঘাতক জুডাসের ১৩নং আসনে বসা, স্ফ্যান্ডিনেভিয়ার ভাইকিং যোদ্ধাদের কিংবদন্তিতে অপদেবতা ‘লোকি’ ত্রোয়দশ দেবতা হওয়া, ভাগ্য গণনার ‘ট্যারট’ তাসের পাতাতে তেরো নাম্বার তাসটি মৃত্যু হওয়া সবই ইসলাম বহির্ভূত অলীক ধারনা। তাই শুধু ধারনার ভিত্তিতে কোন কিছুর শুভলক্ষণ বা অশুভলক্ষণ নির্ধারণ হতে পারে না।

আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো, এমন একটি কুলক্ষণের বিষয়কে পত্রিকার পাতায় প্রকাশ করে মানুষের মনে সন্দেহের বীজ বপন করা। কারণ এভাবেই মানব সমাজে অসভ্যতা, কুসংস্কার, অশ্লীলতা, কুচিন্তা, কুধারণার অনুপ্রবেশ ঘটে।

চার.
খেলাপি কমলে সুদ কমবে

এটি প্রথম আলো, ১৩.৪.২০১৪ এর একটি প্রতিবেদন শিরোনাম। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে,

খেলাপি ঋণ ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহারের অন্যতম কারণ। এই খেলাপি ঋণকে সহনীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারলে অন্তত ২ শতাংশ সুদহার কমবে। ঋণের উচ্চ সুদের আরেকটি বড় কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতি। এই মূল্যস্ফীতি কমাতে অর্থসরবরাহ কমানোসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হলেও খুব একটা কমেনি। ফলে কমছেনা সুদহার। এমনিতে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। বিশ্বব্যাংক গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, খেলাপি ঋণ বাড়ায় দেশের ব্যাংকিং খাত আরও চাপের মধ্যে পড়ছে, ব্যাংকের মৌল সূচকগুলো আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।… যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি জাহাঙ্গীর আলামিন গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের শিল্প খাতটি অনেক বেশি মূলধননির্ভর। তাঁদের প্রধান সমস্যার মধ্যে রয়েছে দুর্বল অবকাঠামো আর সুদের হার। তিনি বলেন, ‘ব্যাংকগুলোতে অনেক টাকা থাকতে পারে। কিন্তু সেই টাকা নিয়ে উচ্চ সুদ দিয়ে আমাদের পক্ষে ব্যবসা লাভজনক করা সম্ভব নয়।’ তিনি দাবি করে, নিদেনপক্ষে একক অঙ্কে না হলেও সুদের হার ১০ শতাংশ হওয়া দরকার। …

আজকের বিশ্বে সুদ জিনিসটা নিতান্তই সাধারণ একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা যে সবচাইতে ঘৃণিত, গর্হিত এবং হাজারো অনাচারের আকর অপরাধ তা কেউ ঘুণাক্ষরেও অনুভব করে না। অন্যদিকে সুদ বিষয়টি হালের অর্থনীতির একটি আবশ্যকীয় উপাদানে রূপ নিয়েছে। সুদ ছাড়া যেন অর্থনীতির চাকা অচল। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণকারী কচি শিশু কিশোরদের মাথায় সুদ কষার জীবন বিধ্বংসী বিষ ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে সুকৌশলে। অর্থনীতির ধারক বাহকরা সুদের প্রচার প্রসারে এতটাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে যে, দেশের অজপাড়া গা পর্যন্ত তার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে। স্বল্প আয়ের খেটে খাওয়া মানুষগুলো দেদারসে সুদি লোন নিয়ে সুদসহ কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে নিজের বাপ দাদার ভিটে মাটিটুকু হারিয়ে পথে বসছে।

উপরের প্রতিবেদনটিতে প্রচলিত অর্থব্যবস্থার একটি করুণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এর যাবতীয় দায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছে খেলাপি ঋণ এবং মূল্যস্ফীতির উপর। কিন্তু আসলে এগুলোই কি এঅবস্থার জন্য দায়ী? বরং যদি আমরা গভীরভাবে লক্ষ করি তাহলে দেখতে পাবো যে, এঋণ খেলাপি এবং মূল্যস্ফীতির পেছনে মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে যমদূত তুল্য এই সুদী ব্যবস্থা। অর্থব্যবস্থায় সুদ হলো অক্টোপাশ এবং ড্রাকুলার মত। গরীবের রক্ত চোষণ করে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে বিপন্ন করে তোলে। বস্তুত সুদনির্ভর অর্থব্যবস্থা বিত্তবানকে আরো বিত্তবান করে তুলে এবং বিত্তহীনকে ঠেলে দেয় দারিদ্রের গহীন পাগাড়ে। এতে করে আপামর জনসাধারণের সঞ্চিত অর্থ ধীরে ধীরে গুটিকয়েকজন মানুষের হাতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। অর্থ বণ্টনে সীমাহীন বৈষম্য সৃষ্টি হয়। কারণ যে ব্যক্তি ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে তার ব্যবসায় যদি লোকসান হয় তাহলে ঋণদাতা তার সুদ মওকুফ করে না; বরং চক্রবৃদ্ধি হারে সুদে মূলে মিলে তার দায় বহু গুণে বেড়ে যায়।

এতে করে ঋণগ্রহীতা বড় ধরনের ব্যবসায়ী ক্ষতির সম্মুখিন হয় আর ঋণদাতা ফুলে ফেঁপে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। অন্য দিকে যেসব বড় বড় শিল্প উদ্যোক্তারা বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে তারা ঋণনির্ভর একারবারে বহু অর্থ বিত্তের মালিক বনে যায়। তারা তাদের মুনাফার সামান্য অংশ ব্যাংকগুলোকে সুদ হিসেবে প্রদান করে। এবং ব্যাংকের হাত হয়ে সাধারণ আমাদনতদারদের হাতে তার কিয়দাংশ পৌঁছে থাকে।

উদাহরণত একজন উদ্যোক্তা নিজের পক্ষ থেকে মাত্র দশ লাখ টাকা ইনভেস্ট করল আর বাকি নব্বই লাখ টাকা ব্যাংক থেকে লোন নিল। সুদনির্ভর পূঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় সাধারণত এমনটিই হয়ে থাকে। এভাবে সে এক কোটি টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করল। পুঁজি মোটা অঙ্কের থাকায় লাভটাও বেশ মোটা অঙ্কের হবে। ধরুন ব্যবসায় শতকরা ৫০ টাকা লাভ হলো। এবং এক কোটি টাকার ব্যবসায় দেড় কোটি টাকা হয়ে গেল। তো উদ্যোক্তা তার লাভের পঞ্চাশ লাখ টাকা থেকে মাত্র ১৫ লাখ টাকা সুদ হিসেবে ব্যাংককে দিবে। ব্যাংক এ পনের লাখ টাকা থেকে নিজের পর্যাপ্ত পরিমাণ লাভ রেখে বাকি টাকা হাজার হাজার আমানতদারের মাঝে সুদ হিসেবে বণ্টন করবে যাদের সঞ্চিত অর্থ ব্যাংকের কাছে গচ্ছিত আছে।

ফলকথা হলো যেসব গ্রাহক নব্বই লাখ টাকা ব্যাংককের মাধ্যমে এই ব্যবসায় ইনভেস্ট করেছিলÑপ্রকৃত অর্থে তাদের পুঁজিই এত বড় মুনাফা লাভের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। তাদের মাঝে সর্বসাকুল্যে মাত্র ১০/১২ লাখ টাকা বণ্টিত হলো। পক্ষান্তরে যে উদ্যোক্তা মাত্র দশ লাখ টাকা পুঁজি খাটালো সে লাভ হিসেবে পেল ৩৫ লাখ টাকা। আরো আশ্চর্যের কথা হলো, উদ্যোক্তা যে ১৫ লাখ টাকা ব্যাংককে সুদ হিসেবে দিয়েছে এবং ব্যাংককের হাত হয়ে জনসাধারণের কাছে পৌঁছেছে সে এই টাকাকেও ব্যবসায়িক ব্যয় তথা উৎপাদিত পণ্যের উৎপাদন ব্যয় হিসেবে গণ্য করে থাকে।

ফলে এ টাকাটাও তার নিজের পক্ষ থেকে দেয়া হয় না বরং তা জনগণের পকেট থেকেই দেয়া হয়। কারণ সে এই কারবারে যে পণ্য উৎপাদন করেছে তার মূল্য নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে সে ব্যাংককে প্রদত্ত সুদের টাকাটাও গণ্য করে। এতে দেখা গেল তার পকেট থেকে কোন অর্থই খরচ হলো না। এগুলো হলো সুদী ব্যবস্থার ব্যবহারিক প্রভাব। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এর পরিণতি আরো মারাত্মক ও ভয়াবহ। যদি কেউ বলে, আসুন আমাদের সেবা গ্রহণ করুন। এতে করে আপনি মহান প্রভুর পক্ষ থেকে অভিশপ্ত হওয়ার বাড়তি সুবিধা লাভ করতে পারবেন। তাহলে সুবিধা প্রত্যাশী গ্রাহকের উত্তর কি হবে?

যদি কেউ বলে, আসুন আমাদের প্রতিষ্ঠানে অর্থ ইনভেস্ট করুন। এতে আপনি পরকালীন উপহার হিসেবে পাবেন রক্তনদীর মাঝে দাঁড়িয়ে থেকে প্রস্তরাঘাতে মস্তক চূর্ণ বিচূর্ণ হওয়ার অফুরন্ত সুবিধা। তাহলে সুবিধা প্রার্থীর বক্তব্য কি হবে?

যদি কেউ আরেকটু কঠিন ও অশ্লীল ভাষায় বলে, এসো আমরা আমাদের জন্মদাত্রী মায়ের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হই তাহলে আপনার আমার ভাবমূর্তি কি হবে? শরীরের রক্তপ্রবাহের গতি কি স্বাভাবিক থাকবে? এমন অশ্লীল আহ্বানকারীকে কি আস্ত রেখে দিবেন? ঐ নরাধমটাকে কি আস্ত কাঁচা গিলে ফেলবেন না?

হ্যা, রক্ত গরম করা এসব আহ্বানই আজ পৃথিবীর অলিতে গলিতে চলছে। কিন্তু আমাদের রক্তকণিকা এতটুকু উত্তপ্তও হয় না। আমরা অনবরত ঐসব আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঐসব কুকর্মে লিপ্ত হচ্ছি। তাহলে এবার দৃষ্টি বুলানো যাক সুদ সংক্রান্ত কুরআন হাদীসের কয়েকটি বাণীর উপর।

১. আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
যদি তোমরা (সুদ) পরিত্যাগ না করো তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। (সূরা বাকারা- ২৭৯)

২. অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
যারা সুদ খায় তারা ঐ ব্যক্তির ন্যয় দণ্ডায়মান হবে যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা উন্মাদ করে দিয়েছে। এটা এ কারণে যে তারা বলে, ক্রয় বিক্রয় তো সুদের মত। অথচ আল্লাহ তা‘আলা ক্রয় বিক্রয়কে হালাল করেছেন আর সুদকে হারাম করেছেন। (সূরা বাকার- ২৭৫)

৩. আবূ জুহাইফা রাযি. থেকে বর্ণিত,
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি সুদ খায় এবং যে ব্যক্তি সুদ দেয় উভয়ের উপরই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিসম্পাত করেছেন। সহীহ বুখারী; হা.নং ৫৯৬২)

৪. অন্য এক হাদীসে রয়েছে,
যে ব্যক্তি সুদ খায়, যে ব্যক্তি সুদ দেয়, যে ব্যক্তি সুদের সাক্ষী হয় এবং যে ব্যক্তি সুদের লেখক হয় সবার উপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিসম্পাত করেছেন। (সুনানে আবূ দাউদ; হা.নং ৩৩৩৩)

৫. সামুরা ইবনে জুন্দুব রাযি. বর্ণনা করেন,
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি রাতে স্বপ্ন দেখি, দু-ব্যক্তি আমার কাছে এসে আমার হাত ধরল এবং আমাকে তারা একটি পবিত্র ভূমিতে নিয়ে গেল। আমরা হাঁটছিলাম, সহসা এক রক্ত নদীর তীরে গিয়ে উপস্থিত হলাম। নদীটির মাঝে এক ব্যক্তি দণ্ডায়মান রয়েছে। তার সম্মুখে পাথর। নদীর তীরে এক ব্যক্তিকে দেখা গেল। রক্ত নদীতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি যেই নদীর তীরে উঠার জন্য সামনে অগ্রসর হয় নদীর তীরে দাঁড়ানো ব্যক্তিটি অমনি তার মুখে পাথর মেরে তাকে পূর্বের জায়গায় ফিরিয়ে দেয়। এমনিভাবে যখনি সে তীরে উঠে আসতে চায় তখনি তার মুখে পাথর মেরে পেছনে পাঠিয়ে দেয়। আমি বললাম, ব্যাপারটি কি? তখন তারা বললেন, রক্ত নদীর মাঝে যে ব্যক্তিটিকে দেখছেন সে হলো সুদখোর। (সহীহ বুখারী; হা.নং ২০৮৫)

৬. হাদীসে আরো বর্ণিত হয়েছে,
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সুদের তেহাত্তরটি স্তর রয়েছে। তার মধ্য হতে সর্বনিম্ন এবং সহজতম স্তর হলো, আপন মায়ের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া। (সুনানে ইবনে মাজাহ; হা.নং ২২৬৫)

৭. আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত,
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি প্রায়শই দীর্ঘ ভ্রমণে থাকে এবং কেশ থাকে এলোমেলো এবং আকাশ পানে হাত তুলে বলে, হে আমার রব! হে আমার রব! অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পোষাক হারাম এবং ভরণ পোষণও হারাম। এব্যক্তির দু‘আ কিভাবে কবুল হবে। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ২৯৮৯)

যুদ্ধ বিগ্রহ বেশী হোক বা অল্প, বড় কিংবা ছোট সব সময়ই তা অপছন্দনীয়, ক্ষতিকর ও পরিত্যাজ্য। সুস্থ বিবেকবান জ্ঞানী মানুষ কখনোই যুদ্ধ সংঘাতকে পছন্দ করতে পারে না। কারণ এর দ্বারা জান-মাল, ইজ্জত-সম্মান নষ্ট হয়। মানুষের জীবন সম্মুখীন হয় চরম হুমকির। আর সে যুদ্ধও যদি হয় কোন অপরাজেয়, অপ্রতিরোধ্য, চিরক্ষমতাবান ও শক্তিধর কোন মহা পরাক্রমশালীর সাথে তাহলে কোন মানুষ তা যুদ্ধ বলবে না। বরং তাকে আত্মহত্যা বলাই শ্রেয় মনে করবে। কিন্তু ইচ্ছায় অনিচ্ছায় জেনে না জেনে আজ আমরা সবাই সে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছি। মহান রাজাধিরাজ, মহাপরাক্রমশালীর সাথে এক যুদ্ধের জীবন আমাদের চলছে। আর সুদের সাথে যেকোন ধরনের সম্পৃক্ততা এই হুকুমের আওতাধীন।

সুতরাং আয়াত ও হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সুদের যে কোন ধরনের সংমিশ্রণ এই ভয়াবহ যুদ্ধের অন্তর্ভুক্ত। আর কোন জাতি যতদিন পর্যন্ত সুদের কারবারে লিপ্ত থাকবে ততদিন তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে না। কারণ পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হচ্ছে, ‘আল্লাহ তা‘আলা সুদকে হ্রাস করেন এবং সদকাকে বৃদ্ধি করেন’। (সূরা বাকারা- ২৭৬) তাই ‘খেলাপি কমলে সুদ কমবে’ এ কথা বলে সুখের ঢেকুর তোলার কোন অর্থ থাকে না। আর পত্রিকায় এ জাতীয় প্রতিবেদন দিয়ে খেলাপি কমিয়ে সুদ কমানোর ব্যবস্থা করা আর তাতে ব্যবসায় লাভবান হবে বলে মনে করার কোন সুযোগ থাকে না। কারণ আল্লাহ তা‘আলা ব্যবসায়কে হালাল আর সুদকে হারাম করেছেন। (সূরা বাকারা- ২৭৫) সুতরাং হারাম জিনিস দিয়ে হালাল জিনিসকে লাভবান করার চেষ্টা করা তরল বিষ দিয়ে শরবত বৃদ্ধি করারই নামান্তর। এ বিষ শরবত বৃদ্ধি করবে বটে, তবে পানকারীর প্রাণ নিয়ে তবেই ক্ষান্ত হবে।

পাঁচ.
‘আত্মার পরিশুদ্ধিই জীবন, সূফী-সাধকরা বাতিঘর।’ এটি আমাদের সময় ১৯.০৪.২০১৪ ইং এর একটি প্রতিবেদন শিরোনাম।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে,
সূফী দর্শনের বিকাশ ঘটিয়ে সাধক ব্যক্তিদের সান্নিধ্যের মাধ্যমে আল্লাহ ও প্রিয় নবীর (সা.) নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব। সূফী ওলী সাধকদের জীবন দর্শন অনুসরণ করলেই আত্মা ও মনের পরিশুদ্ধি অর্জনসহ দিশাহীন মানুষ মুক্তির গন্তব্যে পৌঁছতে পারে।

প্রতিবেদক এখানে শ্রুতি মধুর ও অর্থবহুল একটি শিরোনাম চয়ন করেছেন। তবে কোন ব্যক্তি যদি উক্ত শিরোনাম ও প্রতিবেদনের সঠিক মর্মার্থ সহীহভাবে বুঝতে সক্ষম না হয় তাহলে সে সুদর্শন সাপের বিষাক্ত ছোবলে নিজের সর্বস্ব খোয়াতে পারে। তাই প্রতিবেদনে উল্লিখিত কয়েকটি অংশের বিশ্লেষণ প্রয়োজন-

(ক) ‘আত্মার পরিশুদ্ধিই জীবন, সূফী সাধকরা বাতিঘর’

উল্লিখিত কথাটির মর্মার্থ হলো, মানুষ অন্যান্য জীব-জন্তু থেকে পৃথক জীবন তখনই লাভ করবে যখন আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন করবে। আর এই পরিশুদ্ধির জন্য সূফী-সাধকদের থেকে আলো গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ তাদের সহযোগিতায় আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জন করতে হবে।
আত্মার পরিশুদ্ধি আত্মশুদ্ধি একই অর্থবোধক শব্দ। আরবীতে যাকে তাযকিয়া বলা হয়। তাযকিয়ার আভিধানিক অর্থ পবিত্র করা। আর পরিভাষায় তাযকিয়া বলা হয়, অন্তরকে আল্লাহ তা‘আলা নিকট অপছন্দনীয় জিনিস থেকে পবিত্র করা এবং আল্লাহ তা‘আলার নিকট পছন্দনীয় গুণাবলী দ্বারা অন্তরকে সুসজ্জিত করা। (কিতাবুল আরবাইন, ইমাম গাযালী রহ., দারুল মিনহাজ, পৃষ্ঠা ১৩৫)

নামায, রোযা, প্রভৃতি শরীয়তের বাহ্যিক বিধানের উপর আমল করা যেমন আবশ্যক তদ্রƒপ ইখলাস, তাকওয়া, সবর, শোকর প্রভৃতি কলবের গুণাবলী অর্জন এবং লৌকিকতা, অহঙ্কার, হিংসা, লোভ প্রভৃতি অন্তরের ব্যাধি দূর করাও আবশ্যক। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে,

وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيهِمْ.

অর্থ : তিনি তাদেরকে শিক্ষা দিবেন কিতাব ও হিকমত এবং তাদের তাযকিয়া তথা আত্মশুদ্ধি করবেন। (সূরা বাকারা- ১২৯)

আরো ইরশাদ হয়েছে,

قَدْ اَفْلَحَ مَنْ زَكّهَا.

অর্থ : সফলকাম হবে যে নিজের তাযকিয়া তথা আত্মশুদ্ধি করবে। (সূরা শামস- ৯)

قَدْ اَفْلَحَ مَنْ تَزَكّى.

অর্থ : সেই সফলকাম হবে যে নিজের তাযকিয়া তথা আত্মশুদ্ধি করবে। (সূরা আ’লা- ১৪)
এই বাতিনী বিধানাবলীর উপর আমল করাকে বলা হয় তাযকিয়ায়ে নফস বা আত্মশুদ্ধি। সুতরাং ‘আত্মার পরিশুদ্ধিই জীবন’ কথাটি দ্বারা এই আত্মার পরিশুদ্ধি উদ্দেশ্য। প্রচলিত মাইজভাণ্ডারী, বেশরা ফকীর বা মারেফতবাদীদের আত্মশুদ্ধি উদ্দেশ্য নয়।

‘সূফী-সাধকগণ বাতিঘর’

সূফী শব্দটির অর্থ আধ্যাত্মিক, আধ্যাত্মবাদী। সাধক শব্দটির অর্থ সাধনাকারী, উপাসক, সুফী সাধক। (বাংলা ব্যবহারিক অভিধান, বাংলা একাডেমি, পৃষ্ঠা ১১৪২)

শব্দ দু’টির সামষ্টিক অর্থ দাঁড়ায় আধ্যাত্মিক ইবাদাতের মাধ্যমে উপাসনাকারী।

আর এ কথা বলা বাহুল্য যে, যে ব্যক্তি আধ্যাত্মিক ইবাদতের প্রতি যত্নবান হবে তার বাহ্যিক ইবাদত অবশ্যই সুন্দর হবে। আর বাতিঘর বলার উদ্দেশ্য হলো, আলোহীন ব্যক্তি আলোর কাছে গেলে যেমন আলোকিত হয় তেমনিভাবে এ সূফী-সাধক তথা আল্লাহ ওয়ালাদের কাছে গেলে তাদের সাহচর্য দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়। পবিত্র কালামুল্লাহ শরীফেও এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায়। ইরশাদ হচ্ছে,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ.

অর্থ : হে ঈমানদারগণ! তোমরা তাকওয়া (খোদাভীতি) অর্জন কর এবং সাদেকীনদের সাথে থাকো। (সূরা তাওবা- ১১৯)

অর্থাৎ তাকওয়া অর্জনের জন্য নেক লোকদের সাহচর্য গ্রহণ আবশ্যক।

হাদীস শরীফেও নেক সোহবতের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ কর হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে,

পূণ্যবান সঙ্গী এবং অসৎ সঙ্গী যথাক্রমে মেশক বহনকারী আর হাপরে ফুৎকার দানকারীর ন্যায়। মেশক বহনকারী হয়ত তোমাকে মেশক প্রদান করবে বা তার নিকট হতে তুমি ক্রয় করবে। তাও না হলে সুগন্ধি তুমি অবশ্যই পাবে। পক্ষান্তরে হাপরে ফুৎকার দানকারী হয়তো তোমার কাপড় জ্বালাবে নতুবা দুর্গন্ধ তো অবশ্যই পাবে। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৫৫৩৪)

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে আরেকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

خير جلسائكم من يذكر الله رؤيته.

অর্থ : তোমাদের সর্বোৎকৃষ্ট সঙ্গী সে যাকে দেখলে আল্লাহ তা‘আলার কথা স্মরণ হয়। যার কথায় ইলম বৃদ্ধি পায়, যার কাজ-কর্ম তোমাদেরকে পরকলের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। (আবদ ইবনে হুমাইদ, আবূ ইয়ালা, ইতহাফুল খিয়ারা ৮/১৬৩)

সুতরাং এ সকল হাদীস দ্বারা নেককার লোকদের সাহচর্য অবলম্বনের গুরুত্ব দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট।

আর আত্মশুদ্ধির জন্য তাকওয়া অর্জনের লক্ষ্যে নেককার মুত্তাকীদের সোহবত-সংশ্রব অবলম্বনের অপর নাম পীর-মুরিদী বা তাসাওউফ।

আমরা পূর্বের আলোচনা থেকে এ কথা বুঝলাম যে, সূফী-সাধকরা বাতিঘর বলতে সকল সূফী-সাধক নয়; বরং যারা নিজেরা নেককার এবং তাকওয়ার অধিকারী। আর ঐ সকল আল্লাহওয়াদের সংশ্রবে থাকতে পবিত্র কুরআনেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমনটি আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি।

পক্ষান্তরে ঐ সকল নামধারী সূফী-সাধক যারা শরীয়ত ও তরীকতকে ভিন্ন বলে প্রচার করে। যারা তরীকত, সূফীবাদ ও আধ্যাত্মিকতার নামে শরীয়তের হুকুম আহকামের ধার ধারে না। যাদের দরবারে সর্বদা মদ, জুয়া, নাচ, গান, অশ্লীলতা, বেহায়াপনায় বাজার গরম থাকে, যাদের খানকায় নারী-পুরুষের কোন ভেদাভেদ থাকে না, যারা যিকিরের নামে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার পথ সুগম করে, ওরস, ফাতেহা খানির নামে যারা বিদ‘আত, কুফর, শিরকের প্রকাশ্য আসর জমায় আর নযর ও মান্নতের নামে যারা মানুষের থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে সেই সব তথাকথিত সূফী-সাধক কখনো বাতিঘর হতে পারে না।

(খ) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পবিত্র সামা’ মাহফিলের মাধ্যমে বর্ণাঢ্যভাবে অনুষ্ঠিত নৈশভোজের আয়োজন’।

পবিত্র সামা’ মাহফিলের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। তাই সামা’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে সাধারণ একটি ধারণা থাকা উচিৎ।

সামা’র পরিচয়

সামা’ (سماع) এর আভিধানিক অর্থ শ্রবণ করা, গান, ধর্ম সঙ্গীত।

পরিভাষায় সামা’ বলা হয়,

كل ما التذبه الاذن من صوت حسن.

অর্থ : ঐ শ্রুতি মধুর আওয়াজ যদ্দ্বারা কর্ণ পুলক অনুভব করে। (কাওয়াইদুল ফিকহ)
বাওয়াদিরুন নাওয়াদির গ্রন্থে সামা’র সংজ্ঞা এভাবে দেয়া হয়েছে,

سماع آوازے را گویند کہ بے آلات (مزمیر ومعازف) باشد ۔

অর্থ : সামা’ বলা হয়, বাদ্যযন্ত্র ও বাঁশিবিহীন সুর সঙ্গীতকে। (বাওয়াদিরুন নাওয়াদির; দারুল মা‘আরিফ)

সামা’র হুকুম

ইমাম গাযালী রহ. বর্ণনা করেন, কাযী আবুত তায়্যিব রহ. সামা’র ব্যাপারে ইমাম আবূ হানীফা রহ. ইমাম মালেক রহ. ইমাম শাফেয়ী রহ. ইমাম সুফিয়ান রহ. থেকে এমন শব্দ বর্ণনা করেছেন যা থেকে বুঝা যায় এসব ইমামগণের নিকট সামা’ হারাম।

হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহ. থেকেও অনুরূপ বর্ণিত আছে,

انه سئل عن السماع فقال هو ضلال للمبتدى والمنتهى لا يحتاج اليه.

অর্থ : সুলুকের লাইনে প্রাথমিক পর্যায়ের যারা, সামা’ তাদের জন্য ভ্রষ্টতা। আর যারা এই লাইনে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে তাদের জন্য নিঃপ্রয়োজন। (তাফসীরে রূহুল মা‘আনী ১১/৭২)

ইমাম গাযালী রহ. ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন গ্রন্থে পাঁচটি শর্ত পূরণ করা ও পাঁচটি অন্তরায় থেকে বেঁচে থাকার শর্তে সামা’ অনুমোদিত বলেছেন। এখানে শুধু অন্তরায় পাঁচটি উল্লেখ করা হচ্ছে-

১. যে শোনাবে সে পরনারী না হতে হবে এবং দাড়িবিহীন বালক না হতে হবে।

২. যাবতীয় বাদ্যযন্ত্র এবং মাদক মুক্ত হতে হবে।

৩. সামা’র বিষয়বস্তু অশালীন কমোদ্দীপক ও শিরক মিশ্রিত হতে পারবে না।

৪. যৌবনের প্রাবল্য না থাকা। সুতরাং যার মাঝে যৌবনের তেজ এবং যৌন উত্তেজনার প্রাবাল্য বিদ্যমান তার জন্য সর্বাবস্থায় সামা’ হারাম।

৫. সামা’ শ্রবণকারী ব্যক্তি দীনী জ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞ সাধারণ মানুষ না হতে হবে। (মাওলানা হেমায়েতুদ্দীন, ইসলামী আকীদা ও ভ্রান্ত মতবাদ, আনোয়ার লাইব্রেরী; পৃষ্ঠা ৫৫৮-৫৫৯)

উপরোল্লিখিত আলোচনার মাধ্যমে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যো সামা’ যা বর্তমানে সূফী-সাধকদের খানকা ও দরবারে প্রচলিত তা বৈধ নয়। কারণ সেখানে উপরোক্ত শর্তসমূহের উপস্থিতি নেই। এছাড়াও ফাতাওয়ার কিতাবসমূহের রেফারেন্সও উল্লেখযোগ্য।

১. আল্লামা ইবনুস সালাহ তার ফাতওয়ার দীর্ঘ আলোচনার পর বলেন,

فان هذا السماع حرام باجماع اهل الحل والعقد من المسلمين.

অর্থ : মুসলমানদের সকল ইমামের সর্বসম্মত মতে এই সামা’ হারাম। (তাফসীরে রূহুল মা‘আনী ১১/৬৯)

২. ফাতাওয়া শামীতে সামা’র শর্তসমূহ বর্ণনা করার পর বলা হয়েছে,

والحاصل انه لا رخصة فى السماع فى زماننا لان الجنيد تاب عن السماع فى زمانه.

অর্থ : মোটকথা, আমদের যামানায় সামা’র কোন অনুমতিই নেই। যেহেতু হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রহ. তার যুগে সামা’ থেকে তওবা করেছেন। (রদ্দুল মুহতার ৫/২৩০)

উল্লিখিত শর্তাবলী ও ফাতওয়ার আলোকে আমরা নির্দ্বিধায় এ সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে, শর্ত অনুপস্থিতির কারণে বর্তমান সময়ে প্রচলিত সকল সামা’ হারাম। সুতরাং এ ধরনের হারাম কাজকে পবিত্র বলা এবং পবিত্র মনে করা কখনোই জায়েয হতে পারে না। আর যারা পবিত্র এবং জায়েয মনে করেন তারা কখনোও আধ্যাত্মিক বা সূফী-সাধক হতে পারে না। সুতরাং তাদের মাহফিল বাতিঘর নয়; বরং অন্ধকার মরণকূপ।

মোটকথা, উপরের আলোচনা দ্বারা এ বিষয়টি স্পষ্ট হলো যে, সংবাদ পত্রটির মধ্যে যে শিরোনাম দেয়া হয়েছে বাস্তবতার সাথে তার কোনই সম্পর্ক নেই। কারণ প্রতিবেদনটিতে সুফীদের যে নৈশভোজ বা মিলনমেলার কথা বলা হয়েছে সেখানে সৎপন্থী সুফীদের কোন নাম নেই; সবাই বিদআত আচ্ছন্ন মাইজভাণ্ডারী, কাদেরী ঘরানার নামধারী সুফী। সুতরাং শিরোনামটির ক্ষেত্রে বলা যায়, কথা সত্য মতলব খারাপ।

ছয়.
রাখে আল্লাহ মারে কে! (ইত্তেফাক, ১৯.০৪.২০১৪ খ্রি.)

সংবাদে উল্লিখিত শিরোনমটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। একজন খাঁটি মুমিনের প্রাণের আওয়াজ এটি। সংবাদপত্রের পাতায় এমন সংবাদ মুসলমানদের মাঝে এখনো আশার সঞ্চার করে। যতোদিন এই আওয়াজ আমরা নিজেদের মাঝে ধারণ করতে পারবো ততোদিন বোধ হয় আমদেরকে কোন অশুভ শক্তি পরাজিত করতে পারবে না।

নবজাতক হত্যার হার দিন দিন বেড়েই চলছে। এ যেন জাহেলী যুগের নির্লজ্জ পশুত্বকে হার মানায়। জীবিত সন্তানকে পুঁতে রাখা, বস্তাবন্দি করে নবজাতককে যত্রতত্র ফেলে রাখা, ডাস্টবিনে ফুটফুটে শিশুর লাশ নিয়ে কুকুরের আনন্দে মেতে ওঠা এতো আজ আমাদের সমাজের চিত্র। নারী স্বাধীনতা, বেহায়া, বেপর্দা, উলঙ্গপনা সর্বোপরি নারীর সমান অধিকার ও ক্ষমতায়নের নামে নিজ ইজ্জতের রক্ষা কবচ ঘরের আরামের পরিবেশ থেকে নারীকে বের করে বিভিন্ন উপায়ে নারী ও নারীর সৌন্দর্যকে পণ্য হিসেবে পরিবেশনের কল্যাণেই আজ সমাজের এই ভয়াবহ চিত্র হয়েছে। প্রেম-পরকীয়া, ফ্রি সেক্স উন্মাদনার ধ্বংসাত্মক অভিশাপে হাজারও মানব শিশু অঙ্কুরেই ঝরে যাচ্ছে।

তাই আমাদের নবজাতক হত্যা প্রতিরোধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। আর প্রথমেই নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা বন্ধ করতে হবে। কিন্তু বড় পরিতাপের বিষয় যে, একদিকে যখন সরকার নবজাতক হত্যা প্রতিরোধে শাস্তির আইন করছে। অপর দিকে একই সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে যৌন আবেদন, উত্তেজনা ও যৌন সুড়সুড়িমূলক বিভিন্ন সংবাদ ও প্রতিবেদন প্রচার ও প্রকাশ করা হচ্ছে। এমন কি কোন কোন এফ.এম তরঙ্গের মাধ্যমে নিজ গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে যৌনক্ষুধা মিটানো ও হস্তমৈথুনের মত জঘন্যতম পাপ কাজের কুপরামর্শ দেয়ার অডিও আমাদের সংরক্ষণে রয়েছে। তাই যৌন চাহিদা পূরণের সকল দ্বার উন্মুক্ত রেখে নবজাতক হত্যার শাস্তি বিধান করা শিকড় কেটে গাছের আগায় পানি দেয়ারই নামান্তর।

সাত.
নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার আহ্বান রুহানির। (ইত্তেফাক, ২২.০৪.২০১৪)

আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত মাখলুককে দু’ভাগে সৃষ্টি করেছেন। পুরুষ ও মহিলা। এ বিভক্তি সৃষ্টি জীবের প্রতি দয়া ও কল্যাণ কামনার্থেই করা হয়েছে। সে ধারায় মানুষও পুরুষ ও নারী দু’ভাগে বিভক্ত। আর এ ভিন্নতা শুধু সৃষ্টিগতভাবে নয়। বরং বৈশিষ্ট্য, রুচি, মানসিকতা, কর্মক্ষমতা, দায়িত্বসহ আরো বহুদিক থেকে। নারী-পুরুষের পার্থক্য ধর্ম-কর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের নিকট স্বীকৃত। নারী-পুরুষের বৈশিষ্ট্য যেমন এক রকম নয় তেমনি রুচিবোধও নয়। উভয়ের মন মানসিকতার মাঝে যেমন বৈপরিত্ব রয়েছে, কর্মক্ষমতার মাঝেও আছে যথেষ্ট পার্থক্য। পুরুষ যে সব শক্ত ও ভারী কাজ করতে সক্ষম হয় নারীরা সে সব কাজ করতে সক্ষম হয় না। আর সে কারণেই বর্তমান পৃথিবীতেও বিভিন্ন দেশে মহিলাদেরকে রণক্ষেত্রে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয় না। আর দায়িত্বের দিক থেকেও নারী-পুরুষ সমান নয়। কারণ নারীদের এ পার্থিব জীবনে এমন কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয় যা পুরুষের করার কোনও সুযোগ নেই। যেমন গর্ভধারণ, সন্তানকে দুগ্ধদান ইত্যাদি।

সুতরাং এতসব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের পার্থক্য সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃত হওয়া সত্ত্বেও কিছু সংখ্যক লোকের নারীর সমান অধিকারের শ্লোগান নারীর প্রতি বৈষম্যের প্রকাশ ছাড়া কিছু নয়। কারণ নারী অধিকারের দু’টি অর্থ হতে পারে। (১) পুরুষকে নারীর সমান অধিকার প্রদান। আর এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, এ অর্থটি এখানে উদ্দেশ্য নয়। (২) নারীকে পুরুষের সমান অধিকার প্রদান। এটিই এখানে উদ্দেশ্য। এখন উপরোক্ত কথাটির অর্থ হলো, একজন নারী একজন পুরুষের মত অধিকার লাভ করবে। অর্থাৎ নারী সকল দিক থেকে পুরুষের মত হয়ে যাবে। অথচ এ অর্থটি সঠিক নয়। কারণ নারী কখনো পুরুষের সমান হতে পারে না। কেননা সৃষ্টিগতভাবে নারীর উপর অর্পিত দায়িত্ব পুরুষের পক্ষে আদায় করা সম্ভব নয়।

আর অন্যান্য দিক থেকে নারীর এমন কিছু অধিকার প্রয়োজন যা পুরুষের কখনো প্রয়োজন হবে না। এখন যদি নারীকে পুরুষের সমান অধিকার দেয়া হয় তাহলে নারীর জন্য নির্ধারিত অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করা হবে। আর যদি নারীর জন্য পৃথক অধিকারগুলোও তাকে দেয়া হয় তাহলে সমান অধিকারের শ্লোগানের কোন প্রয়োজন হয় না। আর যদি মর্যাদার ব্যাপারে সমান অধিকারের কথা বলা হয় তাহলে ইসলাম একজন নারীকে মা, স্ত্রী, কন্যা সর্বক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে অনেক বেশী মর্যাদা নিশ্চিত করেছে। সুতরাং এক্ষেত্রেও সমান অধিকারের শ্লোগান মানে নারীর মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার শ্লোগান।

তাই নারীর সমান অধিকারের শ্লোগান এ দাবীর সাথে কোন মুসলমান এক হতে পারে না।
সুতরাং ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানীর নারীর সমান অধিকারের আহ্বান সঠিক নয়। তিনি আরো বলেন, ইসলামিক আইন অনুযায়ী কোথাও বলা হয়নি নারীর থেকে পুরুষ বেশী শক্তিশালী। তার এ কথাটিও ঠিক নয়। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اَلرِّجَالُ قَوَّامُوْنَ عَلىَ النِّسَاءِ অর্থ পুরুষেরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মা‘আরিফুল কুরআনে বল হয়েছে,

এই আয়াতের দ্বারা মূলনীতি স্বরূপ যে বিষয়টি প্রতীয়মান হয় তা হচ্ছে, পূর্ববর্তী আয়াতসমূহের বক্তব্য অনুসারে পুরুষ ও নারীদের অধিকার পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ। বরং পুরুষের তুলনায় নারীদের দূর্বলতার কারণে তাদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে তুলনামূলকভাবে বেশী গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। কারণ নারীরা বল প্রয়োগের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার আদায় করে নিতে পারে না। (কুরআনুল কারীম বাংলা অনুবাদ ও তাফসীর; পৃষ্ঠা ২৪৫)

সুতরাং উল্লেখিত আয়াত ও তার তাফসীর অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট রুহানী সাহেবের উক্ত কথাটিও সঠিক নয়। তিনি উক্ত সংবাদে আরো বলেছেন, ইরানের নারীরা সমান সুযোগ, সমান নিরাপত্তা ও সমান সামাজিক অধিকার লাভ করবে। এ কথা বলে তিনি নারীদের মর্যাদা বাড়ানোর চেষ্টা করলেও অজ্ঞাতসারে বা স্বেচ্ছায় তাদের মর্যাদাকে হরণ করেছেন। কারণ ইসলামী আইন মতে নারীদের সমান সুযোগ, নিরাপত্তা ও সামাজিক অধিকার দিলে তাদের মর্যাদা বাড়ে না। বরং এতে তাদের নিরাপত্তা বিঘিœত হয়। তাই তাদের যথাযথ সুযোগ, নিরাপত্তা ও সামাজিক অধিকার প্রয়োজন, যা একমাত্র ইসলামই নিশ্চিত করেছে।
সুতরাং সমান অধিকারের শ্লোগান ইসলাম বা কোন মুসলমানের শ্লোগান নয়, হতেও পারে না। বরং তা ইহুদী-খ্রিস্টান ও তাদের অনুগামী নামধারী মুসলমানদের পক্ষ থেকে তথ্য সন্ত্রাস।

আট.
ধর্মনিরপেক্ষদের জয় চান বলিউডের প্রভাবশালীরা। (সমকাল, ১৭.০৪.২০১৪ ইং)

বিএনপি ধর্মনিরপেক্ষ দল। (ইত্তেফাক, ২৭.০৪.২০১৪ ইং)

‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বর্তমান সময়ে বহুল আলোচিত একটি বিষয়। ধর্মনিরপেক্ষতার পরিচয় দেয়াকে কেউ কেউ গর্বের বিষয় মনে করেন। কোন কোন দল এই পরিচয় দিয়ে অন্যকে আকৃষ্ট করতে চান। আবার ধর্মনিরপেক্ষতার সার্বজনীনতা কেউ কেউ কামনা করেন। যেমন, ১৭ ও ২৭ তারিখের সমকাল ও ইত্তেফাক পত্রিকার সংবাদে দেখা যাচ্ছে। তাই ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে সামান্য আলোচনা করা হলো।

ধর্মনিরপেক্ষতা কি?

Secularism শব্দের বাংলারূপ হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। আরবীতে বলা হয়, ‘আল আলমানিয়্যাহ’। Secular (অর্থ) পার্থিব, ইহজাগতিক, জড়, জাগতিক। Secular state ‘গীর্জার সঙ্গে বৈপরিত্যক্রমে রাষ্ট্র’। এ অর্থ অনুযায়ী মুসলিম দেশে এর ব্যাখ্যা হবে মসজিদের সঙ্গে বৈপরিত্যক্রমে রাষ্ট্র।

Secularism নৈতিকতা ও শিক্ষা ধর্মকেন্দ্রিক হওয়া উচিৎ নয় এই মতবাদ, জাগতিকতা, ইহবাদ। (ইংলিশ বাংলা ডিকশনারী, বাংলা একাডেমি, ২০১২ সম্পাদনায় : জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী)

ইনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা এবং উইকিপিডিয়াতেও একই ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
অক্সফোর্ড ইংরেজি-উর্দূ ডিকশনারীতে লেখা হয়েছে, Secularism لا مذهبية لا دينية (ধর্মহীনতা)।

উইকিপিডিয়াতে সেক্যুলারিজমের ব্যাখ্যা করা হয়েছে Anti islam দিয়ে।
উপরোল্লিখিত আলোচনা থেকে এ বিষয়টি একদম স্পষ্ট যে, ধর্মনিরপেক্ষতার সাথে ইসলামের সহাবস্থান হতে পারে না। বরং ধর্মনিরপেক্ষতার মূল শব্দ Secularism এর আভিধানিক অর্থেই ধর্মহীনতা অর্থটি বিদ্যমান। কিন্তু বাংলা ভাষী মানুষকে বরং মুসলমানদেরকে ধোঁকা দেয়ার জন্য Secularism এর অর্থ করা হয় ধর্মনিরপেক্ষতা। তাই কোন মুসলমান ধর্মনিরপেক্ষতা মতবাদে বিশ্বাসী হতে পারে না। কারণ কোন ব্যক্তি এই মতবাদে বিশ্বাসী হলে সে মুসলমান থাকতে পারে না।

ইসলামে ধর্মনিরপেক্ষতা নেই

ইসলামে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে কিছু নেই। ইসলামের মূল ভিত্তি হলো, আল্লাহর কালাম কুরআন মাজীদ। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَاَنِ احْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا اَنْزَلَ اللهُ.

অর্থ : আর তাদের মাঝে আপনি ফয়সালা করুন ঐ আইন দ্বারা যা আপনার প্রতি আল্লাহ তা‘আলা অবতীর্ণ করেছেন। (সূরা মায়িদা- ৪৯)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফয়সালা করে না তারা যালিম … তারা কাফির … তারা ফাসিক। (সূরা মায়েদা- ৪৪, ৪৫, ৪৭)

অথচ সেক্যুলারিজমের বক্তব্য হচ্ছে, আইন-আদালত, বিচার কার্য এসব চলবে রাষ্ট্রীয় নীতি ও জনগণের চাহিদা অনুযায়ী। রাষ্ট্র যেভাবে আইন করে সেভাবে চলবে। ধর্মের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। এছাড়া সেক্যুলারিজম মেনে নিলে ইসলামী পরিবারনীতি, সমাজনীতি, বিচারনীতি, লেনদেন পদ্ধতি, কৃষি, সেচ ইত্যাদি বিষয়ক অসংখ্য কুরআনের আয়াত ও হাদীস রহিত হয়ে গেছে বলে ঘোষণা করতে হবে। (নাউযুবিল্লাহ)

সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষতার জয় কোন মুসলমান চাইতে পারে না। আর কোন ইসলামী বা মুসলমানের দলও নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে পরিচয় দিতে পারে না। যদি দেয় তাহলে বুঝা যাবে ইসলাম তাদের নিকট পছন্দনীয় নয়। কিংবা মুসলমান বলে পরিচয় দিতে তারা সম্মত নন। তাই সকল ব্যক্তি ও দল যারা মুসলমান হিসেবে বাঁচতে চান এবং মুসলমান হিসেবে মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে উঠতে চান তারা ধর্মনিরপেক্ষতার শ্লোগান দিতে পারেন না।

উপসংহার

বর্তমান গবেষণাটি শিরোনামকৃত বিষয়ের উপর একটি প্রাথমিক গবেষণা। উক্ত গবেষণায় বাংলাদেশে দৈনন্দিন প্রকাশিত প্রায় শতাধিক পত্রিকার ধর্মীয় সংবাদগুলোর মধ্য হতে কিছু সংবাদকে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে পরখ করার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমনটি পূর্বোল্লিখিত উদাহরণগুলোতে আমরা উপস্থাপন করতে চেষ্টা করেছি।

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ যেহেতু মুসলমান সেজন্য পত্র পত্রিকার কোন সংবাদে ঈমান-আকীদা, ইসলামী চেতনা বিরোধী, কোন সংবাদ, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ফিচার যেন প্রকাশ না পায় তার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল বর্তমান চিত্র অত্যন্ত ভয়াবহ। সংবাদ যাচাই, তথ্য উপস্থাপন, বাক্য ও শব্দচয়ন, উপস্থাপনাশৈলী সর্বক্ষেত্রেই ইসলাম থেকে উদাসিনতা ও ইসলামের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব ফুটে উঠে। কোন ক্ষেত্রেই ইসলামী নীতিমালার অনুসরণ করতে দেখা যায় না। অথচ সংবাদ উপস্থাপন, প্রকাশনা, সাংবাদিকতা সকল ক্ষেত্রেই ইসলামের সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা আছে। এসব নীতিমালা বাস্তবায়ন না করার ফলে লেখক, পাঠক সকলেই মিথ্যা, গীবত-শেকায়াত, অপবাদ, সম্মানহানী, গোপনীয়তা প্রকাশ ইত্যাদিসহ বিভিন্ন ধরনের গুনাহে অজান্তেই লিপ্ত হচ্ছে। কেননা শরীয়তে লিখিত বিষয়ের হুকুম বিবৃত বিষয়ের অনুরূপ এবং পাঠ ও শ্রবণের হুকুম অভিন্ন। সুতরাং যে কথা উচ্চারণ করা, বলা ও শোনা গুনাহ তা লেখা, ছাপানো ও পাঠ করাও গুনাহ।

আরো একটি লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, আজকাল সংবাদপত্রগুলোর দায়-দায়িত্ব এমন সব লোকের হাতে দীন ও ধর্ম সম্পর্কে যাদের মোটেও অবগতি নেই এবং এর প্রতি তাদের কোন হৃদ্যতাও দেখা যায় না। এতদসত্ত্বেও এরা যে কোন মাসআলার উপর গবেষণামূলক অভিমত পেশ করার জন্য প্রস্তুত থাকে। যার ফলে ধর্মবিরোধিতা ও সকল প্রকার ধর্মহীনতা সংবাদপত্র প্রকাশের আবশ্যকীয় অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অবশেষে আজকাল যেহেতু মানুষের স্বভাবের মাঝে পত্র পত্রিকা দেখার আগ্রহ এতটা প্রবল হয়ে গেছে যে, তা খাবারের প্রতি আগ্রহের চেয়েও বেশী পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই সকল মানুষের কল্যাণ কামনা এবং বিশেষ করে মুসলমানদের ইহকালীন ও পরকালীন সাফল্যের জন্য গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষের করণীয় হলো-

১. প্রত্যেক পত্রিকা কর্তৃপক্ষের জন্য হক্কানী উলামায়ে কেরামের সমন্বয়ে একটি ইসলামী বোর্ড গঠন করা।

২. ধর্মীয় তথ্য বা রেফারেন্সসমূহ উলামায়ে কেরামের অনুমোদনের পর প্রচার করা।

৩. ধর্মীয় সংবাদ বা ফিচারে শব্দ, বাক্য ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করা।

৪. ধর্মের যে কোন ধরনের অবমূল্যয়ন হয় কিংবা অপব্যাখ্যা হয় এমন শব্দ, বাক্য পরিহার করা।

৫. ধর্মীয় যে কোন তথ্য বা সাক্ষাতকারের জন্য ইংলিশ স্কলারদের পরিবর্তে ধর্মীয় স্কলারদের অগ্রাধিকার দেয়া।

৬. ইসলাম শুধু ধর্ম হিসেবে নয় একটি সর্বোত্তম জাতির সর্বোত্তম জীবন ব্যবস্থা হিসেবে আগামী প্রজন্মের সামনে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা।

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *