অস্তোদয়ের দেশে

মাওলানা রাকিবুলইসলাম

মহান রাব্বুল আলামীনের বাণী
হে নবী! আপনি বলুন, তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করো এবং অনুধাবন করো কিভাবে তিনি সৃষ্টির সূচনা করেছেন। (সূরা আনকাবূত- ২০)
মূলত এই আয়াতের মর্মবাণীকে সামনে রেখেই আমাদের মা’হাদ থেকে প্রতি বছর ইলমী সফরের আয়োজন করা হয়। সফর নিছক ভ্রমণই নয়; বরং এতেও রয়েছে শিক্ষার অফুরন্ত উপাদান। এর বাস্তব নিদর্শন হল, আমাদের মা’হাদের ইলমী সফর। আমি এই সফরে অংশগ্রহণ করতে পেরে মহান আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।
প্রতিদিন বাদ ইশা আমাদের মা’হাদে বিশেষ দু‘আর মজলিস অনুষ্ঠিত হয়। মা’হাদের মুদীর সাহেবই সাধারণত এই দু‘আ মজলিসে উপস্থিত থাকেন এবং নীতি নির্ধারণী মূলক অনবদ্য গ্রন্থ আল-ইলমু ওয়াল-উলামা থেকে তা’লীম করে দু‘আ করে দেন। প্রয়োজনীয় কোন কথা থাকলে তাও এই মজলিসে আমাদের বলে দেন। একদিন মজলিস শেষে মুদীর সাহেব হুযূর বললেন, আগামী ৭ নভেম্বর ২০১৬ মা’হাদের এ বছরের ইলমী সফর অনুষ্ঠিত হবে। সফর হবে নৌপথে সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা অভিমুখে। হুযূরের এই ঘোষণা শুনে আমাদের সবার মনে আনন্দের হিল্লোল বয়ে গেল। আমি কুয়াকাটা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়া খুলে বসলাম। সেখানে কুয়াকাটা সংক্রান্ত তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছ-
কুয়াকাটা নৈসর্গিক শোভামণ্ডিত পর্যটন কেন্দ্র। বঙ্গোপসাগরের তটে অবস্থিত কুয়াকাটা থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকন করা যায়। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া থানার লতাচাপলি ইউনিয়নে কুয়াকাটার অবস্থান। পূর্বে গজমতির সংরক্ষিত বনাঞ্চল, পশ্চিমে কুয়াকাটার বনভূমি, উত্তরে কলাপাড়া জনপদ ও দক্ষিণে বিশাল বঙ্গোপসাগর। কুয়াকাটার স্থানিয় নাম সাগর কন্যা।
কুয়াকাটা বিভিন্নপথে বিভিন্ন মাধ্যমে যাওয়া যায়। রাজধানী ঢাকা থেকে বিমানে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা যাওয়া যায়। বিলাসবহুল লঞ্চ বা স্টিমার যোগেও কুয়াকাটা যাওয়া যায়। আবার বাস যোগে সরাসরি কুয়াকাটা যাওয়া যায়। সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবের কারণে দীর্ঘপথ ভ্রমণ বেশ কষ্টসাধ্য। তবুও দীর্ঘ পথ ভ্রমণের ক্লান্তি ও অবসাদ নিয়ে যখন আপনি কুয়াকাটা পৌঁছবেন, দেখবেন অনাবিষ্কৃত এক বাংলাদেশ। কুয়াকাটার অপরূপ সৌন্দর্য মুছে দেবে দেহ মনের সব ক্লান্তি আর অবসাদ। এমন মুগ্ধ-আকর্ষণ করার ক্ষমতা আছে কুয়াকাটার।
কুয়াকাটার নামকরণ সম্পর্কে জানা যায়, ১৭৮৪ সালে বর্মিরাজা রাখাইনদের মাতৃভূমি আরাকান দখল করলে হাজার হাজার রাখাইন তাদের মাতৃভূমি আরাকান ত্যাগ করে। তারা বড় বড় নৌকায় অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। বঙ্গোপসাগরের তীরের রাঙাবালি দ্বীপে এসে তারা অবতরণ করে। গড়ে তোলে বসতি। সাগরের লোনাপানি ব্যবহার এবং খাওয়ার অনুপযোগী বলে বালুর মধ্যে তারা কূপ বা কুয়া খনন করে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করত। কুয়া খনন করে এখানে সুপেয় পানি পাওয়ায় তারা এর নাম দিয়েছিল কুয়াকাটা।…
ভোরে সূর্যোদয় ভালোভাবে দেখতে হলে যেতে হবে কুয়াকাটা থেকে পূর্ব প্রান্তে। গঙ্গামতির চরের দিকে এগিয়ে গেলে খুব স্পষ্ট সূর্যোদয় দেখা সম্ভব। প্রথমে চারদিকে লাল আলো ছড়াবে উদীয়মান সূর্য। তারপর সমুদ্রবক্ষ থেকে সূর্য উঠে আসবে ওপরের দিকে আভা ছড়িয়ে সবখানে। (বাংলাপিডিয়া ৩/১১৮-১১৯)
এই বিবরণ পড়ে মনটা আরো উতালা হয়ে উঠলো। কল্পনার বাতায়ন পথে পৌঁছে গেলাম কুয়াকাটা সাগর সৈকতে। হৃদয়ে ভেসে উঠলো সাগরের উত্তাল উর্মীমালায় লাল আভা ছড়িয়ে অস্তগামী সূর্যের রক্তিম ছবি। এক অপূর্ব পুলক শিহরণে প্রতিক্ষার প্রহর গুণতে গুণতে এসে গেলো কাঙ্ক্ষিত ৭ নভেম্বর।
সকালের সূর্যটি আজ যেন খুশির রং ছড়িয়ে উদিত হলো। মূল কাফেলা আসর নামায আদায়ান্তে যাত্রা শুরু করবে। কাফেলার রাহবার চরওয়াশপুর মাদরাসার প্রবীণ উস্তাদ মুফতী শহীদুল ইসলাম (ঝালকাঠীর হুযূর) এর পরামর্শে দুপুরেই অগ্রবর্তী কাফেলা সদরঘাটে পাঠিয়ে দেয়া হল। অগ্রবর্তী কাফেলার আমীর হলেন মা’হাদের উস্তাদ মুফতী মাহমূদ বিন ইলিয়াস। তারা গিয়ে লঞ্চে জায়গা রাখবেন। আমাদের এই ইলমী সফরের মূল আকর্ষণ হলো আল্লাহওয়ালাগণের সান্নিধ্য লাভ। মা’হাদের মুরুব্বীগণের মধ্য হতে অন্তত তিনজন মহান বুযুর্গের সোহবত আমরা এই সফরে লাভ করেছি। আরেফ বিল্লাহ শাহ হাকীম মুহাম্মাদ আখতার (করাচীর হযরত) রহ.এর বিশিষ্ট খলীফা মা’হাদের প্রধাম মুফতী হযরত মুফতী ইবরাহীম হাসান সাহেব, জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়ার নায়েবে মুহতামিম হযরত মুফতী ইবরাহীম হিলাল সাহেব এবং পাহাড়পুরী হুযূরের বিশিষ্ট খলীফা জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়ার প্রবীণ উস্তাদ হযরত মুফতী আহমাদুল্লাহ সাহেব এই ইলমী সফরে মুবারক সান্নিধ্য দ্বারা আমাদেরকে ধন্য করেছেন। আর মা’হাদের মুদীর হযরত মুফতী মাহমূদুল আমীন সাহেব, আমীনুত তা’লীম হযরত মুফতী হাফিজুর রহমান সাহেব, মা’হাদের উস্তাদ মাওলানা মাহমূদুল হাসান সাহেব ও হযরত মাওলানা মাহমূদ বিন ইলিয়াস সাহেবও সহযাত্রী হয়ে এই সফরকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। আর কাফেলার রাহবার হিসেবে থেকে আমাদের মনোবলকে অটুট রেখেছিলেন চরওয়াশপুর মাদরাসার প্রবীণ উস্তাদ হযরত মুফতী শহীদুল ইসলাম সাহেব। এতজন বরেণ্য উলামায়ে কেরামের নেক সান্নিধ্যে আমাদের সফর হয়ে উঠেছিল বরকত পরশিত পূণ্যময়।
আসর নামায আদায়ান্তে بسم الله توكلت على الله বলে মা’হাদ থেকে আমাদের শুভ্র মিছিলটি বের হল। বসিলা বড় মসজিদ ঘাটে সদরঘাট যাওয়ার জন্য ভাড়া করা ট্রলারটি আগে থেকেই নোঙ্গর করা ছিল। আমরা গিয়ে ট্রলারটাতে চড়ে বসলাম। একটু পরে জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়ার নায়েবে মুহতামিম হযরত মুফতী ইবরাহীম হিলাল সাহেব ও জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়ার প্রবীণ উস্তাদ মুফতী আহমাদুল্লাহ সাহেবও উপস্থিত হলেন। বসিলা বড় মসজিদের সম্মানিত ইমাম ও খতীব মুফতী আবূ সাইম সাহেব শ্রদ্ধেয় দুই উস্তাদকে অতি যত্নের সাথে বসিয়ে আপ্যায়ন করালেন। আপ্যায়ন পর্ব শেষে হযরতদ্বয়ও ট্রলারে উঠে বসলেন। মুফতী আবূ সাইম সাহেব বিদায়ের দু‘আ পড়লেন- استودع الله دينكموامانتكم وخواتيم عملكم (তোমাদের ঈমান, তোমাদের নিরাপত্তা ও তোমাদের শেষ পরিণতিকে আল্লাহর হাতে সঁপে দিলাম।) এর উত্তরে আমাদের মুদীর সাহেব হুযূর পড়লেন- استودعك الله الذى لا تضيع ودائعه (আমি তোমাকে ঐ আল্লাহর হাতে আমানত রাখলাম, যার কাছে রক্ষিত আমানত কখনো বিনষ্ট হয় না)। আল্লাহু আকবার! কত চমৎকার দু‘আ বিনিময়। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত সুন্দর দু‘আ আমাদেরকে শিখিয়েছেন।
এখান থেকেই আমার ইলমী সফরের ইলম অন্বেষণ শুরু হয়ে গেল। বিদায় জানানোর দু‘আ জানতাম আগে থেকেই। তবে তার প্রতিউত্তরে যে আরেকটা দু‘আ বলতে হয় তা জানা ছিল না। এখন জানা হয়ে গেল। (আল্লাহর রহমতে এরপর এর উপর আমলও হয়েছে।)
সশব্দে একরাশ দৃশ্যমান বাষ্প উদগিরণ করে ট্রলারটি চলা শুরু করল। মুফতী আবূ সাইম সাহেব তীরে দাঁড়িয়ে আমাদের গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মা’হাদের পরম হিতাকাঙ্ক্ষী এই মহান মানুষটির চাহনিই বলে দিচ্ছিল, তিনি আমাদের জন্য কত শুভ কামনা করছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাকে জাযায়ে খাইর দান করুন। আমীন।
বুদ্ধিজীবী সেতুর নিচেই দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের মা’হাদের প্রধান মুফতী আল্লামা মুফতী ইবরাহীম হাসান দা.বা.। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে, উস্তাদে মুহতারাম ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। হুযূরকে নেয়ার জন্য ট্রলার সেখানে ভিড়ল। তিনি উঠলেন। ব্যাস, আবার পথ চলা শুরু হল। এখন গন্তব্য সোজা সদরঘাট। জল ছুই ছুই আনন্দে আমাদের সকলের চোখেমুখে মুগ্ধতার আভা ফুটে উঠলো। আমরা নদীর দুপাশের দৃশ্যে চোখ বুলাতে লাগলাম আর পরস্পর মতবিনিময় করতে লাগলাম। সদরঘাট পৌঁছতে বেশ সময় লেগে গেল। ‘সুন্দরবন-৯’ এ আমাদের অগ্রগামী কাফেলা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আমরা যখন ‘সুন্দরবন-৯’ এ চড়লাম তখন চারপাশে অন্ধকার নেমে এসেছে। ‘সুন্দরবন-৯’ ঢাকা থেকে সরাসরি পটুয়াখালী যাবে। আনন্দঘন নৈশ নৌবিহার এই লঞ্চেই হবে। মুরুব্বীগণের জন্য কেবিন ভাড়া করা হয়েছিল। আর বাকী সাথীদের জায়গা হলো লঞ্চের পিছনের দিকের ডেকে। লঞ্চ ছাড়ার পর আমরা প্রথমেই জামাআতে মাগরিব নামায আদায় করি। সুন্নাত-নফল শেষে মুফতী ইবরাহীম হাসান সাহেব দা.বা. সফরের আচরণ বিধি ও আদব-উদ্দেশ্য বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করলেন। হুযূর প্রথমেই قُلْ سِيْرُوْافِى الْاَرْضِ  আয়াতাংশ তিলাওয়াত করলেন। তারপর বললেন,
সফরের ব্যাপারে সর্বপ্রথম নিয়ত শুদ্ধ করে নিতে হবে। আমরা পিকনিকে যাচ্ছি না। আমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নির্দেশ পালনার্থে বের হয়েছি। আমরা ইলমী পরিবেশে ছিলাম। এখন সফরের পরিবেশে বেরিয়েছি। যেখানে যাব সেখানকার পরিবেশ আমাদের অনুকূলে না-ও হতে পারে। তাই পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে যাতে আমাদের আচার-আচরণ প্রকাশ পায় সে ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে।
সফরে আমীরের আনুগত্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমীরের অগোচরে কোথাও যাব না; অন্তত কোন সাথীকে জানিয়ে যাব। সফরের আদবের ব্যাপারে সবিশেষ যত্নবান হব। পরস্পরের সাথে সৌহার্দপূর্ণ আচরণ করব। পরিবেশের সাথে একেবারে মিশে না গিয়ে নিজেদের আমলে মগ্ন থাকব। ভ্রমণ সমাগ্রীর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখব।
মোটকথা আমাদের সফরটা যাতে এ বার্তা দিতে সক্ষম হয় যে, বর্তমানেও ইলমী পরিবেশে ইলমী সফর করা সম্ভব।
এই ছিল হুযূরের আলোচনার সারসংক্ষেপ। এরপর আমাদের অনুমতি দেয়া হল, কেউ চাইলে লঞ্চ ঘুরে দেখতে পারে। আমরা খানিক পর লঞ্চটিকে একটু গভীরভাবে দেখতে উপরের দিকে উঠে গেলাম। বিরাট লঞ্চ। মনে হল তিনতলা বিশিষ্ট একটি বিল্ডিং পানির উপর দিয়ে ভেসে চলেছে।
এই সফরে লঞ্চের একটা নতুন বিষয়ের অভিজ্ঞতা হল। রাডার আর জি.পি.এস। আগে জানতাম উড়োজাহাজ তার দিক ঠিক রাখার জন্য রাডার ব্যবহার করে। এবার দেখলাম নদীর জাহাজও রাডার ব্যবহার করে। আমি গত বছরও চরমোনাই মাহফিল উপলক্ষে বরিশাল গিয়েছিলাম কোন এক ‘সুন্দরবন’ এ চড়ে। তাতে রাডার বা জি.পি.এস জাতীয় কিছু চোখে পড়েনি। তবে শুনেছিলাম নৌযানেও রাডারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যাইহোক এবার দেখা হয়ে গেল। আমি মূলত উপরে উঠেছিলাম লঞ্চ থেকে রাতের নৈসর্গিক পরিবেশটা উপভোগ করার জন্য। তাই জাহাজের একেবারে সামনে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি সেখানে আমাদের উস্তাদগণ আছেন। লঞ্চের এক কর্মকর্তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হল। তিনি আমাদের প্রতি বেশ সম্মান দেখালেন এবং আগ্রহভরে লঞ্চের নতুন কিছু দেখাতে লাগলেন। তিনিই আমাদেরকে রাডার দেখালেন। দেখলাম লঞ্চের ছাদে একটা জিনিস ঘুরছে। এটাই রাডার। এর মাধ্যমে খুব সহজেই লঞ্চের দিক ঠিক করা যায়। লঞ্চ কোনদিকে আছে, কোনদিকে যেতে হবে, কত কিলোমিটার অতিক্রম করেছে, কত কিলোমিটার বাকী আছে সব ইঞ্জিন রুমে বসেই বলে দেয়া সম্ভব। রাডারের পাশে আরেকটা যন্ত্র রয়েছে- জি.পি.এস। শীতের রাতে যখন খুব কুয়াশা হয় তখন জি.পি.এসের সাহায্যে দিকনির্ণয় করা হয়। যত বেশি অন্ধকার হয় জি.পি.এস ততবেশি কর্মতৎপর হয়ে ওঠে।
নিচে নেমে এসে কিছুক্ষণ ঘুমালাম। এরপর ঘুম থেকে উঠে বসলাম। ইচ্ছে হল উপরে যাই- জি.পি.এস দিয়ে কিভাবে দিক নির্ণয় করা হয় তা দেখে আসি। দু-পা অগ্রসর হয়ে দেখি অন্ধকার। দিক ঠিক করতে পারলাম না। অনেক কষ্টে উপরে উঠলাম। জি.পি.এসের কামরায় পৌঁছলাম। কিন্তু জি.পি.এস দিয়ে কিভাবে কাজ করে তা আর দেখা হল না। কারণ জি.পি.এসের কাজই হল অন্ধকারে। আর এখন ভোর হতে চলেছে। রাডারের একটা স্ক্রিন আছে, সেটাতে সব দেখা যায়। একটা এনালগ ডিসপ্লে। এতে লঞ্চ এবং তার আশপাশের বিশাল একটা অংশের প্রতিকি চিহ্ন দেখা যায়। এর দ্বারাই বোঝা যায় সামনে কোন জলযান আছে কিনা। বসতি নিকটে হলে তা-ও দেখা যায়। জি.পি.এসের কার্যক্রম না দেখা হলেও রাডারের এসব কার্যক্রম খুব আগ্রহ ভরে দেখলাম। এরপর নিচে নেমে আসলাম। দেখলাম, আমাদের অনেক সাথীই তাহাজ্জুদ আদায় করছেন। আমিও তাহাজ্জুদ নামায পড়লাম। পরবর্তীতে মুদীর সাহেব বলেছিলেন, আমাদের তাহাজ্জুদ আদায় করতে দেখে মুফতী আহমাদুল্লাহ সাহেব খুব খুশি হয়েছেন। মুদীর সাহেব হুযূরের ভাষায়,
আমি আমার পরম মুরুব্বী মুফতী আহমাদুল্লাহ সাহেব হুযূরের খিদমতের স্বার্থে তাঁর কেবিনেই ছিলাম। রাত আনুমানিক তিনটার দিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখি হযরত আহমাদুল্লাহ সাহেব হুযূর ঘুম থেকে উঠে কেবিনের বাইরে বেরুচ্ছেন। আমিও বাইরে বের হলাম। হুযূর সামান্য সময় লঞ্চের রেলিংয়ের পাশে দাঁড়ালেন। এরপর প্রয়োজন সেরে উযূ করলেন। অতঃপর ধীরে ধীরে লঞ্চের সামনের দিকে এগুতে লাগলেন। হুযূর নিতান্তই স্বল্পভাষী মানুষ। কোন কিছু বললেন না। আমিও কিছু না বলে ধীরেধীরে হুযূরের পিছনে পিছনে চলতে লাগলাম। হুযূর লঞ্চের সামনের সিঁড়ি দিয়ে নিচ তলায় নামলেন এবং লঞ্চের পিছনের যে দিকটায় তালিবে ইলম ও অন্যান্য উস্তাদগণ রয়েছেন তার কাছাকাছি পৌঁছে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমিও হুযূরের নিকটে দাঁড়ালাম। যে দৃশ্য দেখলাম তাতে অন্তর জুড়িয়ে গেল। উস্তাদ ও ছাত্রদের অনেকেই তাহাজ্জুদ পড়ছেন। কেউ রুকূতে আছেন, কেউ আছেন সিজদায়। কেউ কুরআন তিলাওয়াত করছেন, আবার কেউ করছেন দু‘আ। আমার মনের মিনারে তখন ধ্বনিত হল এই আহ্বান- ‘ও বাংলার মানুষেরা! একটু তাকিয়ে দেখ, তোমরা যাদের অগ্রযাত্রাকে রুদ্ধ করতে চাও, যাদের শ্রম আর ঘামে সাজানো ইলমী বাগানকে ভেঙ্গে তছনছ করে দিতে চাও, যাদেরকে আখ্যায়িত করো মৌলবাদী, জঙ্গিবাদী, উগ্রবাদী ইত্যাদি অভিধায়, তারা কিভাবে তোমাদের কল্যাণ কামনায় আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করছে। সফরের ক্লান্ত-শ্রান্ত, অবসাদগ্রস্থ দেহ নিয়ে তোমাদের মঙ্গল কামনায় রত আছেন। …হায়! কবে হবে আমাদের বোধোদয়!’
তালিবে ইলমগণ এমনভাবে ইবাদতে মগ্ন ছিলেন যে আমাদের উপস্থিতি বুঝতেই পারেননি। আহমাদুল্লাহ সাহেব হুযূর সামান্য সময় পর ধীরে ধীরে দোতলায় এলেন এবং তাহাজ্জুদ ও দু‘আয় মগ্ন হলেন।
রজনী তার আঁধার গুটিয়ে বিদায় নিয়েছে। লঞ্চ পটুয়াখালী এসে নোঙ্গর করেছে। ফজর নামায আদায় করব। কিবলা ঠিক করার জন্য উস্তাদে মুহতারাম মাওলানা মাহমূদুল হাসান সাহেব কিবলা কম্পাস নামক মোবাইল অ্যাপের সহায়তা নিলেন। এই যে রাডার, জি.পি.এস অবশেষে নামায আদায় করার জন্য মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার এগুলোর অধিকাংশই অমুসলিমদের আবিষ্কার। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে যে জ্ঞান দিয়েছেন তারা সে জ্ঞান ব্যবহার করে নানারকম সেবা আমাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে এবং আরো সহজ করার প্রচেষ্টায় মগ্ন রয়েছে। মহান রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে ইসলামের মত মহামূল্যবান ঐশ্বর্য দান করেছেন। আমরা কি তাদেরনিকট ইসলামের শাশ্বত সেবাকে উপস্থাপন করছি? তাদের পরকালীন শান্তির চিন্তা করছি? জাহান্নামের ভয়াবহ আগুন থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি?
নামাযের পর আমরা সফর সামগ্রী গুছিয়ে লঞ্চ থেকে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছি। হঠাৎ একলোক এস.বি পরিচয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হল। হাতে তার প্যাড ও কলম। আমাদেরকে বিভিন্ন প্রশ্ন করা শুরু করলেন। প্রশ্নগুলো এক রকম আসামী জেরা করার মতই। পথিকৃত মুফতী শহীদুল ইসলাম সাহেব ঠাণ্ডা মাথায় সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন। শেষে এস.বি সাহেব বললেন, ‘আসলে আপনারা আমাদের এখানে এসেছেন, আপনাদের নিরাপত্তার জন্যই মূলত বিস্তারিত তথ্যাদি আমরা নিলাম। যাতে আপনারা কোন ধরনের সমস্যায় না পড়েন।’ এস.বি মহোদয়ের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে লঞ্চ থেকে নেমে পড়লাম। এরপর অটোরিক্সা যোগে বাসস্ট্যান্ডের দিকে যাত্রা করলাম। আমাদের অটোরিক্সার চালক ভাইটি ধার্মিক। মুখে সুন্দর সুন্নাতী দাড়ি। তার সাথে আমাদের বিভিন্ন কথা হল। তিনি তার ছেলেকে মাদরাসায় পড়াচ্ছেন। রিক্সা থেকে নামার পর চালক মহোদয় মামুন ভাই থেকে আমাদের মুদীর সাহেবের মোবাইল নাম্বারও রাখলেন। কুয়াকাটাগামী বাস প্রস্তুত ছিল তাই তড়িঘড়ি করে তার থেকে দু‘আ নিয়ে আমরা বাসে চড়ে বসলাম।
বাসের হেল্পার বলল, এটাই নাকি সবচেয়ে উন্নত বাস। শিকদার নামের বাসটিতে আমরা উঠে বসলাম। আমাদের মুদীর সাহেব সবার পিছনের সিটে বসলেন। ডানদিকে আমি বসেছিলাম। আমার পরে আশরাফ ভাই। কিছুক্ষণ পর মুফতী মাহমূদ বিন ইলিয়াস সাহেব কেকের একটি প্যাকেট নিয়ে সামনে থেকে পিছনের দিকে আসলেন এবং প্যাকেটটি মুদীর সাহেবের হাতে দিলেন। মুদীর সাহেব সবাইকে দেয়া হয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। মাহমূদ সাহেব বললেন, পরিমাণ অল্প তো, তাই শুধু উস্তাদগণকে দেয়া হচ্ছে। মুদীর সাহেব সামান্য কেক নিলেন। সেখান থেকে আমাকেও সাধলেন। আমি বললাম, হুযূর! আপনি খান, আমার প্রয়োজন নেই। উস্তাদে মুহতারাম বললেন, তুমি আমার প্রতিবেশী না! নাও। আমি আর না করতে পারলাম না। যতটুকু নিয়েছি সেখান থেকে পাশের আশরাফ ভাইকেও দিলাম। বসে বসে ভাবতে লাগলাম, বড়রা এমনই হয়। উস্তাদে মুহতারামের হাতের কেকটুকু যৎসামান্যই ছিল। কিন্তু প্রতিবেশী হিসেবে আমাকেও শরীক করলেন। মনে পড়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাশ্বত বাণী- ‘তোমরা ব্যঞ্জনে ঝোল বাড়িয়ে দাও’। প্রতিবেশীর অধিকারের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেক গুরুত্বারোপ করেছেন। যারা প্রকৃত ওয়ারিসে নবী তাদের মাঝেই সুন্নাতের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়।
বাস চলছে আপন গতিতে। দু’পাশে ধানক্ষেত। রাস্তার দু’ধারে সারি সারি গাছ। মনোমুগ্ধকর এক প্রাকৃতিক পরিবেশ। আমরা সবাই উপভোগ করছি আল্লাহর অপার মহিমা। কিছুদূর যাওয়ার পর বাসে একজন হিন্দু মহিলা উঠলেন। বাসের সব আসন বুক হয়ে আছে। তার আগে যারা উঠেছিলেন তারাও দাঁড়িয়ে আছেন। অগত্যা মহিলাটিকেও দাঁড়িয়ে থাকতে হল। কোলে তার নিষ্পাপ শিশু সন্তান। মহিলাটি দাঁড়িয়ে রইলেন মুরশিদ ভাইয়ের আসন বরাবর। আমাদের মুদীর সাহেব হুযূর মুরশিদ ভাইয়ের কানে কানে বললেন, ‘মহিলাটিকে একটু বসতে দাও। তোমরা একটু দাঁড়াও, সওয়াব হবে।’ মুরশিদ ভাই সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেলেন। তার সাথে বসা রাইহান ভাইও ব্যাগটি তার আসনে রেখে দাঁড়িয়ে গেলেন। যাতে মহিলা স্বস্তিতে বসতে পারেন। মুরশিদ ভাই মহিলাকে সসম্মানে বসতে অনুরোধ করলেন। মহিলাটি শিশু সন্তানকে নিয়ে সসংকোচে বসলেন। কিছুক্ষণ চলার পর আমরা দাঁড়িয়ে থাকা রাইহান ভাই ও মুরশিদ ভাইকে আমাদের আসনে বসতে বললাম। কিন্তু তারা বসলেন না। পরে মুরশিদ ভাই থেকে জানতে পারলাম, যখন মুদীর সাহেব মহিলাটিকে বসতে দেয়ার ব্যাপারে বলছিলেন ঠিক তখন তিনিও ভাবছিলেন, মহিলাকে বলবেন, ‘দিদি আপনি এখানে বসুন’। কিন্তু তার আগেই মুদীর সাহেব বলে ফেললেন। আমরা বসতে বলার পরও না বসার কারণ হিসেবে তিনি বললেন, আল্লাহ তা‘আলার এক বান্দীকে সামান্য একটু সাহায্য করার জন্য দাঁড়িয়ে থাকাটাই আমাদের নিকট ভালো লাগছে।
আমতলা বাসস্ট্যান্ড। মহিলাটি এখানেই নামবেন। তিনি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ছোট একটি কথা বললেন- ‘আপনেরা তো আমার জন্য অনেক কষ্ট করলেন’। এরপর মহিলাটি নেমে গেলেন। মুরশিদ ভাই বলেন, মহিলাটি যখন কথাটি বলেছিলেন তখন আমার মন বলছিল, ইসলাম তো আমাদের এ শিক্ষাই দিয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
তোমরা সৎকাজে একে অপরকে সাহায্য করো। (সূরা মায়িদা- ২)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
সকল সৃষ্টি আল্লাহর পরিবারভুক্ত। আল্লাহর নিকট প্রিয় সেই, যে আল্লাহর পরিবারের সাথে উত্তম আচরণ করে। (মাজমাউয যাওয়াইদ; হা.নং ১৩৭০৬)
মহিলাটি নেমে যাওয়ার পর মুদীর সাহেব হুযূর মুরশিদ ও রাইহান ভাইকে বললেন, ‘সফরের মাঝে তোমরা বাড়তি সওয়াবও কামিয়ে নিলে’। নিকট অতীতের বুযুর্গদের মাঝেও আমরা আল্লাহর সৃষ্টির সাথে উত্তম আচরণ করার দৃষ্টান্ত দেখতে পাই।
মাওলানা হিদায়াতুল্লাহ (মুহাদ্দিস ছাহেব) রহ.। তার শরীরে মশা বসলে তিনি না মেরে তাড়িয়ে দিতেন। তিনি একটি বিড়াল পুষতেন। একবার তিনি বাড়িতে খেতে বসেছেন। প্লেটে ভাজা মাছ ছিল। বাইরে বিড়ালটা ম্যাঁও ম্যাঁও করছিল। হঠাৎ লাফ দিয়ে পুরো মাছটা নিয়ে দৌড়। মুহাদ্দিস ছাহেব রহ. তখন বললেন, বেচারা আর কত ধৈর্য্য ধরবে! সৃষ্টির প্রতি মায়া-মমতার এর চেয়ে সুন্দর উদাহরণ আর কী হতে পারে!
আমাদের গাড়ি এখন আন্দরমানিক নদীর ফেরিঘাটে। ফেরি এখন ওপারে। তাই এপারে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। পাশেই এ নদীর উপর ব্রীজ তৈরি হচ্ছে। ব্রীজের কাজ প্রায় শেষ। কিছুদিন পরই হয়ত উদ্বোধন করা হবে। আসার পথে যতগুলো ফেরিঘাট পড়েছে অধিকাংশের ক্ষেত্রেই এই দৃশ্য দেখা গেছে। বরিশাল যেহেতু নদীমাতৃক এলাকা। এখানে ব্যাপকভাবে ব্রীজ করা হলে জনজীবনটাও অনেক সহজ হবে।
যতক্ষণে ফেরি এপারে আসবে ততক্ষণে মুদীর সাহেব নাস্তা করে নিতে বললেন। আমরা ‘বিসমিল্লাহ’ নামক একটি হোটেলে প্রবেশ করলাম। গাঁয়ের ছোট হোটেল। তবে এতে একটি বিশেষ আইটেম আছে- আটার রুটি। আমরা রুটি-পরোটা উভয়টাই খেলাম। খাওয়া শেষে মুফতী ইবরাহীম হাসান সাহেব আমাদের সবাইকে মিষ্টি খাওয়ালেন। বরিশালের মিষ্টি। প্রথমে রসে ভিজিয়ে রুটি খেলাম। এরপর আগ্রহভরে মিষ্টিটা মুখে নিলাম।
বাসের মধ্যে মুরশিদ ভাই ও সুহাইল ভাই সফর সামগ্রী দেখা-শোনার দায়িত্বে রয়ে গেছেন। তাদের জন্য নাস্তা নিয়ে নেয়া হল। আমরা বাসে উঠে তাদেরকে নাস্তা পেশ করলাম। মুশকিল হল হাত ধোয়া নিয়ে। হাত ধোয়া ছাড়া তো আর খাবার শুরু করা যায় না। তাদের নিকট পানি পৌঁছতে একটু বিলম্ব হচ্ছে। বিষয়টি মুফতী ইবরাহীম হাসান সাহেব বুঝতে পেরে হাতের বোতলটি এগিয়ে দিলেন এবং বললেন, হাত ধুয়ে নিন। তারা সংকোচ বোধ করলেন। হুযূর বললেন, আরে সংকোচের কি আছে, নিন। এতক্ষণে পানি পৌঁছে গেল। হুযূরের পানি নেয়ার প্রয়োজন হল না।
ফেরিতে করে আমাদের বাস নদী পার হল। শুরু হল আবার পথ চলা। তিনটি ফেরিঘাট পেরিয়ে এক পর্যায়ে আমরা পৌঁছলাম সাগরকন্যা খ্যাত স্বপ্নের কুয়াকাটায়। দীর্ঘ ক্লান্তির পর যখন কুয়াকাটা পৌঁছলাম, সবার ভিতর কেমন যেন চাঞ্চল্যতা
বয়ে গেল। যেন আমরা ক্লান্ত ছিলাম না। কুয়াকাটার সতেজতা সবার মনে-তনে সজীবতার তরঙ্গ বইয়ে দিল। মুদীর সাহেব হুযূর কয়েকজনকে নিয়ে হোটেলের ব্যবস্থা করতে চলে গেলেন। আমারেদকে বললেন, এ ফাঁকে তোমরা সমুদ্র পাড়ে গিয়ে ঘুরে আসো। যার যার সফর সামগ্রী সাথে নিয়েই আমরা চঞ্চল পায়ে সমুদ্র পাড়ে পৌঁছলাম। উস্তাদদের সামানা-পত্র আমরা ভাগাভাগি করে নিলাম। মনে যতই চাঞ্চল্য বিরাজ করুক শরীর তো ক্লান্ত। তাই সামানা-পত্র কাঁধে-পিঠে বহন করে চলতে কিছুটা কষ্ট হচ্ছে। চিন্তা করলাম সামানাগুলো কোথাও রাখা যায় কিনা। সমুদ্র পাড় জুড়ে ছত্রাসন বিছানো। তবে তাতে সামানা রাখতে পারছি না। কারণ পাছে যদি মোটা অংকের ভাড়া চেয়ে বসে।
একটি সাগর চৌকিতে মুফতী ইবরাহীম হাসান সাহেব বসলেন। পাশের একটি চৌকিতে ধীরে ধীরে সবাই সামানা রাখলাম। সামানা রেখে সমুদ্র তীরে ছড়িয়ে পড়লাম। সমুদ্র দেখা এটা আমার প্রথম নয়। এর আগে কক্সবাজার যাওয়া হয়েছে। তবে কুয়াকাটা সৈকতে সমুদ্রটা অনেক শান্তই মনে হল। কক্সবাজার সৈকতে যেমন সারাক্ষণ ঢেউ আছড়ে পড়তে থাকে। এখানে সে তুলনায় কিছুটা কমই মনে হচ্ছে। সমুদ্রের আছড়ে পড়া ঢেউ দেখতে ভালো লাগলেও তার বুকে অবস্থানরত নৌযানের জন্য এটা খুব ভীতিকর। আমরা তীরে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ দেখে আনন্দ অনুভব করি। আর নৌযানে অবস্থানকারীরা এই ঢেউয়ের উত্তালতায় মৃত্যুর প্রহর গুণতে থাকে। তাদের দৃষ্টিতে শান্ত সমুদ্রই নিরাপদ।
দূরে কয়েকটি নৌকা দেখা যাচ্ছে। এগুলো সাধারণ নৌকা নয়। আকারে অনেক বড় এবং অনেক মজবুত। নৌকাগুলো ঢেউয়ের তালে উপরে উঠছে আর নামছে। কক্সবাজারে এমনটা চোখে পড়েনি। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, এরা জেলে। আমাদের জন্য মাছ ধরতে সমুদ্রে নেমেছে। আমাদেরকে এই সেবা দেয়ার জন্য অনেকে তো জীবনের অধিকাংশ সময়টাই সমুদ্রে কাটিয়ে দেয়। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল তাদের নৌকাতে চড়তে। কিন্তু সমুদ্রের বুকে চলার মত কোন নৌযান সেখানে নেই। কক্সবাজারে অবশ্য স্পিডবোট ছিল, তবে মাছ ধরার নৌকা ছিল না। হযরত মূসা আ. তো আল্লাহর কুদরতে সাগরের বুক চিরে সদলবলে ওপারে যেতে পেরেছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে সাগরের উপর দিয়েই কোন নৌযান ছাড়াই পার হয়েছিলেন। আমাদের তো ঈমানের তেমন শক্তি নেই, নেই তাদের মত মহৎ উদ্দেশ্য।
সমুদ্রের বুকে ভাসমান নৌযানগুলো আল্লাহর বিশেষ নিদর্শন। আগেকার মানুষেরা পালতোলা নৌকা ব্যবহার করত। বাতাসের সাহায্যে এগুলো চলত। নদী, সাগর, মহাসাগর পাড়ি দিত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
তাঁর (আল্লাহ তা‘আলার) অন্যতম নিদর্শন হল, সাগরে বিচরণকারী পর্বত প্রমাণ জাহাজ। তিনি চাইলে বায়ুকে স্তব্ধ করে দিতে পারেন। ফলে সমুদ্র পৃষ্ঠে তা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে। নিশ্চয়ই এর মধ্যে প্রত্যেক এমন ব্যক্তির জন্য নিদর্শন রয়েছে যে সবরেও অভ্যস্ত, শোকরেও। কিংবা মানুষের কোন কৃতকর্মের কারণে জাহাজগুলো বিধ্বস্ত করে দিতে পারেন এবং পারেন অনেককে ক্ষমা করতে। (সূরা শূরা-০০)
বাতাস স্তব্ধ হওয়া বা উল্টো দিকে বইতে শুরু করা সাগরের বুকে অবস্থানরত পালতোলা নৌযানগুলোর জন্য কেমন বিপদজনক, পুরনো এ্যাডভাঞ্চার পড়লে অতি সহজেই তা অনুমান করা যায়। বাস্তবিক অর্থেই যাকে বলে প্রাণ হাতে সফর করা। এক হজের সফরনামা পড়েছিলাম। সফরনামাটি তিনশ বছর আগের। কল্পকাহিনীর সিন্দাবাদের সফরও যেন এর সামনে তুচ্ছ। দূর থেকে ইয়ামানের আদন বন্দর (এডেন) দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ শুরু হল প্রবল বাতাস। মুহূর্তে পরিণত হল সমুদ্র ঝড়ে। জাহাজ বিপরীত দিকে চলা শুরু করল। কিছুক্ষণ পরে অনতিদূরে দেখা গেল ভারতের সমুদ্র বন্দর। এদিকে হাজীদের অবস্থা তো লবেজান।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদের জন্য কত সহজ করে দিয়েছেন। এক-দেড়শ বছর আগে কয়লার ইঞ্জিন ছিল। এখন আর জাহাজে কয়লার বোঝা বইতে হয় না। আল্লাহ তা‘আলা সমুদ্র এবং নৌযানের প্রসঙ্গ তুলে বারবার মানবজাতিকে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন,
তিনিই আল্লাহ, যিনি (তোমাদের জন্য) সমুদ্রকে বশীভূত করে দিয়েছেন এবং তোমরা দেখতে পাও সমুদ্রের বুক চিরে জাহাজ চলতে থাকে।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
তিনিই আল্লাহ, যিনি তোমাদের জন্য নৌযানগুলোকে বশীভূত করে দিয়েছেন।
সমুদ্র তীরে দাঁড়িয়ে সম্মুখে মৎস নৌকা ব্যতীত আর কিছুই দেখতে পেলাম না। শুধু পানি আর পানি। ওপার বলতে যেন কিছু নেই। তবে যে কোন বড় নদীর একপাশে দাঁড়িয়ে সামনের তাকালেও এমনই মনে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হল নদীর আরেকটা কূল আছে। আর বঙ্গোপসাগরের ওপার নেই। আসলেই নেই। যদি কোন উপায়ে বরাবর চলতে শুরু করা হয় তাহলে বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর, এন্টার্কটিকা পেরিয়ে সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহ পৃথিবী একবার প্রদক্ষিণ করে রাশিয়ায় গিয়ে উঠতে হবে।
আমরা অনেকেই সমুদ্রের পানিতে পা ভিজালাম। সমুদ্রপাড়ে অনেক বাইক রাখা আছে। সবগুলোতে একটা করে নাম্বার রয়েছে। সাধারণ বাইক না, মটরবাইক। চালকরা আমাদেরকে বিভিন্ন প্রস্তাব দিতে লাগলÑ বাইক চালানো শিখবেন? বিশ টাকা! অমুক জায়গায় যাবেন? এত টাকা! প্রস্তাবটা ঢাকার বাস হেল্পারদের মতই। এই মুহাম্মাদপুর, আসাদগেট, ফার্মগেট…। তবে তারা বাসের হেল্পার না; মটরবাইক চালক। একজনকে দেখলাম মুফতী ইবরাহীম হাসান সাহেবের সাথে কথা বলছেন। আমিও একটু এগিয়ে গেলাম লোকটা কী বলে তা শোনার জন্য। লোকটা হুযূরকে বিভিন্ন পর্যটন স্পটের ছবি সম্বলিত একটি কাগজ ধরিয়ে দিলেন। বললেন, এটা পূর্ব দিকে, এদিকে সতেরটা স্পট রয়েছে; এখানে গেলে এত টাকা। এটা পশ্চিমে, এদিকে সুন্দরবন আছে। আপনারা যতক্ষণ থাকতে চান ভাড়া এত টাকা। লোকটি আরো বললেন, হুযূর! আমি কিন্তু আপনাদের জামাআতের লোকই। ক’দিন আগে একটা তাবলীগ জামাআতকে ঘুরাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। শেষ কথাটা শুনে প্রথমে হাসি পেল। পরে দু‘আ করলাম, আল্লাহ আমাদের সকলকে হকের দলভুক্ত হওয়ার তাওফীক দান করুন; আমীন। হুযূর লোকটিকে সংক্ষেপে জবাব দিলেনÑ আমরা মশওয়ারা করে নিই, তারপর দেখা যাক। ইতোমধ্যে মুদীর সাহেব হুযূর হোটেল ভাড়া করে আমাদেরকে নিয়ে যেতে চলে এসেছেন। সী-বিচ রোডেই একটা কাউন্টার আছে। তারা সী-বোটের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে পর্যটকদের ঘুরতে নিয়ে যায়। মুদীর সাহেব হুযূর এখানে কথা বললেন। দামদর করলেন। পরে একই জবাব দিলেন-
মশওয়ারা করে জানাব। আসলে মশওয়ারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শুধু মশওয়ারার কারণেই বদর যুদ্ধের বন্দীদের ব্যাপারে গৃহীত সিদ্ধান্তের বিপরীতে আল্লাহর শাস্তি নেমে আসেনি।
আমরা হোটেল তাজ-এ উঠলাম। ২১জন সদস্য আমরা। কামরা পেলাম মাত্র তিনটি। মুদীর সাহেব হুযূর জানালেন, হোটেল ১২টার দিকে খালি হবে, তখন বাকী কামরাগুলো পাওয়া যাবে। তাই আপাতত আমাদের এখানেই সামানা রাখতে হবে। আমাদেরকে বাইরে যেতে বারণ করা হল। কিছুক্ষণ পর সংবাদ আসল আমরা সৈকত ট্যুরিজমের মাধ্যমে সী-বোট দিয়ে ফাতরার বন ঘুরতে যাব। সবাই প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। বেরিয়ে জানলাম সী-বোট যে ক্যানেল দিয়ে যাবে সেখানে ভ্যান
যোগে যেতে হবে। ভ্যানগুলো মোটর চালিত। ভ্যান দিয়েই বেশিরভাগ মানুষ আশপাশে যাতায়াত করে।
আমরা ঘাটে পৌঁছলাম। এবার বোটে উঠার পালা। এর আগে হালকা নাস্তা হিসেবে সিঙ্গারা ও পানি কিনে নেয়া হল। সী-বোটটি লোহার পল্টুনের সাথে বাঁধা রয়েছে। এটা সাধারণ বোটের মত নয়। ফাইবার জাতীয় প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি। সাগরে চলার উপযুক্ত। শীত মৌসুমে এগুলো সাগরের তীর ঘেষে ভ্রমণ পিয়াসীদের নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। স্পিডবোটও এ ধরনের প্লাস্টিক দিয়ে বানানো হয়। বোটটা একটু আর্দ্রিত। আমাদের জন্যই কিছুক্ষণ পূর্বে ধোয়া হয়েছে। ভেতরে দুইপাশে বসার স্থান। মাঝখানেও বসা যায়। আমরা একুশজন সবাই বেশ আরামেই দু’পাশে বসতে পেরেছি। উপরে ছাদের মত স্থায়ী ছাউনি দেয়া। প্রখর রোদেও কষ্ট অনুভব হচ্ছে না। গিয়ার সিস্টেমটা একটু ব্যতিক্রম। সামনে-পিছনে দু’দিকেই চালানো যায়। গাড়ি বা
বড় লঞ্চ ইত্যাদির মত।
দুপুরের খাবার ফাতরার বনেই খেতে হবে। মুদীর সাহেব হুযূর খাবার কিনে নিতে চাচ্ছিলেন। বোটের মালিক বললেন, সেখানে রান্নার ব্যবস্থা আছে, কোন চিন্তা নেই। তিনি প্রয়োজনীয় সামগ্রী বাজার থেকে কিনে আনলেন। বোটে চালকসহ সকলকে নাস্তা দেয়া হল। তারা খুব খুশি হল। বোটের মালিক আমাদের সাথেই আছেন এবং পুরোটা সময় আমাদের সাথে থাকবেন। কথাবার্তায় আলেমদের প্রতি স্পষ্ট সমীহের ছাপ। আমাদের খুব সম্মান করছেন। তিনি তাবলীগে চল্লিশ দিন সময় দিয়েছেন।
তার বোট আমাদের দূর পাল্লার বাসের মত। নির্দিষ্ট সময়ে ছেড়ে যায়। আমরা এসেছিলাম সময়ের পর। তখন তার লাইনের বোট যাত্রী নিয়ে বিদায় হয়ে গেছে। তবে মালিক আমাদের জন্য আরেকটি বোট বের করেছেন। এর যাত্রী শুধু আমরাই।
বোট ক্যানেল ধরে চলা শুরু করল। কিছুদূর যাওয়ার পর ডান পাশের বসতি দূরে চলে গেল। গরু-ছাগল দলবেঁধে মনের সুখে আহার গ্রহণ করছে। বন্য প্রাণী বা জায়গার মালিক তাদের তাড়িয়ে দিবে এ ভয় নেই। কিছুদূর পর দেখা গেল শুঁটকি পল্লী। ক্যানেলের দু’ধারেই সারে সারে শুঁটকি শিল্পের সমারোহ। সারিবদ্ধভাবে বড় বড় মাছ কেটে শুকানোর জন্য ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর আমাদের বোটটি মোহনায় এসে পৌঁছল।
এটা তিনটি জল পথের মিলনমেলা। এখানে মাছ ডিম ছাড়ে। এমনই একটি মোহনায় মূসা আলাইহিস সালাম সেই মাছটিকে হারিয়েছিলেন। অতঃপর মাছের গমন পথ অনুসরণ করেই খাযির আলাইহিস সালামের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন। মোহনার একটু আগে বামে রয়েছে লাল কাঁকড়ার চর। বিশাল এক চর। এতে প্রচুর পরিমাণে লাল কাঁকড়া বাস করে। জোয়ারের সময় এদের আনাগোনা বেশি দেখা যায়। লাল কাঁকড়াগুলো দেখতে খুব সুন্দর। কাঁকড়াও যে একেবারে লাল রঙের হয় তা আমি এই সফরেই জানলাম। আসলে সফর করলে আল্লাহর কুদরত দেখা যায়। অনুভূত হয়, কত রূপ তাঁর সৃষ্টির।
লাল কাঁকড়ার চর ঘেষেই বিশাল নদী। বামে বঙ্গোপসাগর স্পষ্টই দেখা যায়। ডান দিক থেকে নদীটি এসে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। সামনে নদীর অপর পাড়ে দৃষ্টির শেষ সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত সবুজ বৃক্ষরাজী সুশোভিত ফাতরার বন। এই নদী পাড়ি দিয়েই ঐ বনে যেতে হবে। আমাদের বোটটি ধীরে ধীরে মূল নদীতে প্রবেশ করলো। মৌসুম ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় সাগর-নদীতে তেমন ঢেউ ছিল না। তবুও মৃদুমন্দ বাতাসের হালকা ঢেউয়ে আমাদের বোটটি অল্প অল্প দুলতে লাগলো। আমাদের দেহ-মনে এক অন্যরকম রোমাঞ্চের ছোঁয়া লাগল। আমরা অনেকে ছাদের নিচ থেকে বেরিয়ে বোটের সামনে ও পিছনে খোলা স্থানে আকাশের নিচে দাঁড়ালাম। সাগর ছুঁয়ে আসা নির্মল বাতাসে স্নিগ্ধ হলাম। মুগ্ধ হলাম আল্লাহর সৃষ্টি সৌন্দর্যের অপরূপ শোভা। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর আমরা বনের কাছাকাছি চলে এলাম। নদী পেরিয়ে আমাদের বোট সরু একটি খালে প্রবেশ করল। খালটি দু’ভাগ হয়ে দু’দিকে চলে গেছে। আমাদের বোটটি বামদিকের খালটিতে প্রবেশ করল। খালের দু’পাশে গাছ আর গাছ। গাছগুলো খালের দু’পাশকে সুন্দর ছায়া দিয়ে রেখেছে। গাছগুলোর সজীবতা ও সবুজতা হৃদয়ে ¯িœগ্ধতার পরশ বুলায়। নীল আকাশের নিচে সবুজ গাছের চেয়ে সুন্দর আর কিছু কি আছে! নিজেরা তাপ সইবে আর অন্যকে ছায়া দিবে; আশ্রয় দিবে। আমরা তো এ থেকে শিক্ষা নিতে পারি। পরোপকারী হতে পারি।
বোট বনের ভিতর দিয়ে চলছে। মালিককে জিজ্ঞাসা করলাম, এই জায়গার নাম কি? তিনি বললেন, এই সেই ফাতরার বন। আমরা এখন ফাতরার বনে চলে এসেছি। এটা এক সময় সুন্দরবনের অংশ ছিল। কুয়াকাটায় এটাকে এখনো সুন্দরবন বলা হয়। একটু পর আমাদের সী-বোট নোঙ্গর ফেলল। বোট থেকে বনে উঠার জন্য গাছের গুড়ির সিঁড়ি রয়েছে। আমরা উঠলাম। বনে প্রবেশ করতেই মাহমূদুল হাসান সাহেব হুযূর দেখালেন লম্বা পাতার গোলপাতা গাছ। এ গাছের পাতা দিয়ে অনেকে ঘরের ছাউনি দেয়। তার পাশেই ছিল হেতাল গাছ। আমরা বনের ভিতরে প্রবেশ করলাম। খাল থেকে বনে ঢুকতে প্রথম রাস্তার মোড়টা ছোট্ট বাজারের মত। তিনটি দোকান। একটিতে লেখা ছিল ‘কাঁকড়ার ফ্রাই পাওয়া যায়’। কাঁকড়ার ফ্রাই আগে
দেখিনি। তা দেখার শখ জাগল। কিন্তু দোকানটি বন্ধ। এর মালিক মেয়ের বাড়ি বেড়াতে গেছে। শুধু বাম পাশের দোকানটি খোলা। সামনে একটি টেবিলে বড় থালায় পিয়াজু রাখা ছিল। এখানেও মানুষ পিয়াজু খেতে আসে! হাত দিয়ে দেখলাম পিয়াজুগুলো ঠাণ্ডা হয়ে আছে। মুরশিদ ভাইও কাঁকড়ার ফ্রাই দেখতে খুব আগ্রহী হয়েছিলেন। দূর থেকে তিনি ও আরেকজন পিয়াজুগুলোকে কাঁকড়ার ফ্রাই মনে করে দৌড়ে এসেছেন দেখতে। সামনে এসে বুঝলেন তাদের ধারণা ভুল। পরস্পরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে লাজুক হাসি হাসতে লাগলেন। পরে অবশ্য তাদের হাসিতে আমাদেরকেও শরীক করেছেন। সামনে বর্গাকৃতির বেশ বড় একটি পুকুর। দক্ষিণ পাড়ে শান বাঁধানো ঘাট। পশ্চিমে ছোট্ট একটি বনকাঠের মসজিদ। নাম গৈয়মতলা মসজিদ। তার দক্ষিণ পাশে সরকারি স্টাফদের বাসস্থান। বন দেখাশোনার জন্য তাদেরকে রাখা হয়েছে। কেউ কেউ সপরিবারে থাকেন। পুকুরের দক্ষিণ দিক দিয়ে বনে প্রবেশের সরু রাস্তা। সী-বোটের মালিক আমাদের রাস্তা দেখিয়ে নিজে রয়ে গেলেন। তবে তিনি আমাদের গাইড হিসেবে কিশোর বয়সি একটি ছেলেকে দিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলেটি কিছুদূর গিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়। বোট মালিক রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। ইলিশ মাছ নিয়ে এসেছেন। সাথে প্রয়োজনীয় সামগ্রীও।
বনের মাঝ দিয়ে সরু একটি পথ বয়ে গেছে। আমরা সে পথ ধরে হাঁটা শুরু করলাম। পথটি পাড়া গাঁয়ের পথের মত একে বেঁকে সমুদ্র তীরে চলে গেছে। সমুদ্র তীরটি কুয়াকাটা সৈকতের বিপরীত দিকে। কিছু পথ চলার পর দেখা গেল পথের মাঝে ছোট ছোট গাছের গুড়ির মত ভয়ঙ্কর সব উদ্ভিদ। এগুলো বেশ শক্ত। অসতর্কভাবে পা পড়ে গেলে আহত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। মাওলানা মাহমূদুল হাসান সাহেব বললেন, এগুলো ‘শূল’। মূলত এগুলো গাছের শিকড় থেকেই হয়। মূল সুন্দরবনে এগুলো আরো বড় আকারে হয়ে থাকে। এর ছাল ছাড়ালে আস্ত একটা তক্তা বেরিয়ে আসে। হিংস্র প্রাণী যখন তাড়া করে কিংবা শিকার ধরে টেনে নিয়ে যায় তখন হিংস্র প্রাণী থেকেও শূলগুলো বেশি প্রাণ সংহারকের ভূমিকা পালন করে। তবে ফাতরার বনের শূলগুলোর আকার তুলনামূলক ছোট। আমরা সতর্কভাবে পা ফেলে পথ চলতে লাগলাম। আরো কিছুক্ষণ চলার পর একটি সাঁকোর দেখা মিলল। এপার থেকে ওপার ছোট কয়েকটি গাছ ফেলে পথ তৈরি করা হয়েছে। নিচ
দিয়ে পানি তির তির করে বয়ে যাচ্ছে। আমরা সতর্কতার সাথে সাঁকোটি পার হলাম। এরপরের পথ বেশ কর্দমাক্ত। পা দেবে যায়। পথ চলা বেশ দুরূহ। বিশেষত যাদের কাদা পথে চলার অভিজ্ঞতা নেই তাদের জন্য আরো কষ্টকর। কেউ কেউ এখানে থেমে যেতে চাইলেন, বললেনÑ আর যাবো না। তবে অধিকাংশের মত এ দুর্গম পথে সাগর পাড় দেখার। এতে অবশ্য এক ধরনের এ্যাডভাঞ্চার এবং ভিন্ন রকমের স্বাদ কাজ করছিল। আমাদের সফরে মজার লোক ছিলেন মুফতী ইবরাহীম হিলাল সাহেব দা.বা.। হুযূর মজা করে বললেন, যার যার সমুদ্র সৈকত দেখতে মনে চায় গাছে চড়ে দেখে নিক। আমরা জুতা হাতে কাদা মাড়িয়ে পথ চলতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ দুর্গম পথ অতিক্রম করে নদীর পাড়ে পৌঁছলাম।
দক্ষিণ দিকে সমুদ্র। বালু বিশিষ্ট কর্দমাক্ত পাড় ধরে এগিয়ে চললাম। চলার পথে আল্লাহর সৃষ্টির এক অপার মহিমা দেখতে পেলাম। বেশকিছু গাছ চোখে পড়ল। গোড়া থেকে দুই তিন হাত পরিমাণ শিকড় বেরিয়ে রয়েছে। অর্থাৎ গাছগুলো শিকড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে। সাগরের জোয়ার-ভাটায় এগুলোর গোড়া থেকে মাটি সরিয়ে নিয়েছে। তারপরও বিশাল আকৃতির গাছগুলো শিকড়ের উপর ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। আসলে সফরের মাধ্যমে আল্লাহর অনেক কুদরত সম্পর্কে জানা যায়। ঈমান সতেজ হয়। হয় শক্তিশালী। আল্লাহ তা‘আলা সূরা মুলকে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন-
তোমরা পরম করুণাময়ের সৃষ্টিতে কোন খুঁত পাবে না। তোমার দৃষ্টিকে দ্বিতীয়বার ফিরাও তা আল্লাহর সৃষ্টিতে খুঁত বের করা থেকে অপারগ হয়েই ফিরে আসবে।
এগুলো দেখে মন বলে উঠল- আল্লাহু আকবার! আল্লাহু আকবার!! আল্লাহ কত মহান। আমাদের উস্তাদগণ বলতেন, পঙ্গু হাসপাতালে যাও। বুঝতে পারবে তোমার সাড়ে তিনহাত শরীরে আল্লাহ কত নিয়ামতরাজি সাজিয়ে রেখেছেন। বিশ্বের ছবি অঙ্কনকারীদের মধ্যে তার ছবিকেই বেশি সুন্দর বলা হয়, যার অঙ্কন প্রকৃতির সাথে বেশি সাদৃশ্য রাখে। প্রকৃতি কে সৃষ্টি করেছেন? আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। সমুদ্রপাড়টা কাছেই মনে হচ্ছিল। তবে আধা ঘণ্টার মত হেঁটেও সমুদ্রে পৌঁছতে পারলাম না। লবণাক্ত সমুদ্র থেকে বয়ে আসা সুমিষ্ট বাতাস আমাদের ক্লান্তি মুছে দিচ্ছিল।
এখানের সমুদ্র সৈকত তেমন মসৃণ ও নিরাপদ নয়, তাই আর সামনে অগ্রসর না হয়ে ফিরে আসাই সমীচীন মনে হল। আমরা ফিরতি পথে যাত্রা শুরু করলাম। পথে দু-একটা লাল কাঁকড়া দেখতে পেলাম। একেবারে লাল রঙের কাঁকড়া। সাথে তাদের শৈল্পিক আল্পনাও আমাদের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি এড়াল না। হঠাৎ একটি গাছ দেখিয়ে ঝালকাঠি হুযূর বললেন, এই গাছের শিকড়ে সুন্দর মেসওয়াক হয়; নাম করমজল। তাজা শিকড়। কিছু শিকড় মাটির উপর ভেসে আছে। আমরা অনেকেই শিকড় ধরে টানাটানি করলাম। কারণ সাথে ছুরি-কাঁচি নেই। তবে সক্ষম হলাম না। রাইহান ভাই সফল হলেন। তিনি বড় বড় দু’টো শিকড় ছিড়তে সক্ষম হলেন। পরে এটা থেকে মেসওয়াক বানিয়ে প্রায় সবাইকে দিয়েছিলেন। ফেরার পথে আমরা সমুদ্র পাড়ের উন্মুক্ত প্রান্তর ছেড়ে বনের ভিতর দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। শরীরে কিছু কাঁটাও বিধল। হঠাৎ একটা বড় মাছের কঙ্কাল দেখতে পেলাম। স্মৃতি হিসেবে রাখার জন্য আমরা কয়েকজন মাছের কাঁটা নিয়ে আসলাম। যেন আমরা ‘পাহাড়-সাগর-অরণ্য-মাঠ ছাড়িয়ে শত শত’ পথ চলছি।
পথ যেন হারিয়ে না ফেলি সেজন্য আসার সময় পথের বিভিন্ন বাঁকে চিহ্ন দিয়ে এসেছিলাম। সে চিহ্ন অনুসরণ করে কর্দমাক্ত পথ মাড়িয়ে ফিরে এলাম বনের সূচনায়। পুকুরের স্বচ্ছ পানিতে সবাই হাত-পা ধুয়ে নিল। আবূ ত্বলহা ভাই মুফতী ইবরাহীম হাসান সাহেব ও মুফতী ইবরাহীম হিলাল সাহেব হুযূরের পা ধুয়ে দিচ্ছিলেন। শিক্ষকের প্রতি এমন বিনম্র শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা প্রদর্শন করা একমাত্র কওমী মাদরাসা পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের পক্ষেই সম্ভব। কওমী শিক্ষাঙ্গন ছাড়া এগুলো
কল্পনাও করা যায় না। উপমহাদেশের কওমী মাদরাসাগুলোই পরিপূর্ণ মানুষ তৈরি করে। তারপরও কিছু লোক বলে বেড়ায়, এরা জঙ্গি। চামচিকা দেখতে পারে না বলে কি সূর্য আলোহীন!
ইবরাহীম হাসান সাহেব হুযূর আমাদের হাতে কাঁটা দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী এটা? ইবরাহীম হিলাল সাহেব হুযূর বললেন, এরা সমুদ্রের মাছ পায়নি; কাঁটা নিয়ে এসেছে। ইবরাহীম হাসান সাহেব বললেন, সাহাবায়ে কেরাম সফরে আম্বর মাছ পেয়েছিল। ফেরার পথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য নিয়ে এসেছিলেন। এরা তো আম্বর মাছ পায়নি, তবে একটা বড় মাছের কাঁটা নিয়ে এসেছে।
মধ্যাহ্ন ভোজের খোঁজ নিয়ে জানা গেল অল্প সময়ের মধ্যেই খাবার প্রস্তুত হয়ে যাবে। আমরা উযূ-ইস্তিঞ্জা সেরে গৈয়মতলা মসজিদে নামায আদায় করলাম। মসজিদটা টঙ্গের মত। এত ছোট যে, আমাদের একুশজনের জামাআতে নামায আদায় করা কষ্টকর হল। এ মসজিদেই খাবারের ব্যবস্থা করা হল। বোনপ্লেট হিসেবে শুকনো বাঁশপাতা ব্যবহার করা হল। বোট মালিক খুব মজাদার খাবারই রান্না করেছিলেন। মুফতী ইবরাহীম হাসান সাহেব হুযূর বললেন, আমাদের দুপুরের ভোজনটা বনেই হল। মানে বনভোজন হয়ে গেল আর কি।
বন থেকে ফিরে আসার আগ মুহূর্তের ঘটনা। হযরত মুফতী ইবরাহীম হিলাল সাহেব হুযূর দেখলেন, একটি কুকুর তার দিকে তাকিয়ে আছে। হুযূর বললেন, ঐ কুকুরটিকে কিছু খাবার খাওয়ানো দরকার। এখানে তো লোকজন তেমন নেই; কুকুরটির হয়তো খাওয়া-দাওয়ায় অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমাদের কাছে তো খাবার ছিল না। হুযূর ছোট্ট দোকানটি থেকে চড়া দামে এক প্যাকেট বিস্কুট কিনলেন এবং নিজ হাতে কুকুরটিকে খাওয়ালেন। এই সফরেই আমরা যখন কুয়াকাটা থেকে বরিশাল ফিরছিলাম, বরিশাল পায়রা নদীর ফেরিঘাটে গাড়ির দীর্ঘ লাইন হয়ে যাওয়ায় অনেকক্ষণ সেখানে আমাদের অবস্থান করতে হয়েছিল। আমরা অনেকেই নদী তীরে দাঁড়িয়ে নদীর স্রোত ও আল্লাহর কুদরত অবলোকন করছিলাম। কিছুক্ষণ পর ইবরাহীম হিলাল সাহেব হুযূর বাস থেকে নেমে নদীর তীরে আসলেন। কিন্তু হুযূরের দৃষ্টি আমাদের দিকে নয়। তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখি একটি ছাগল ও একটি ছানা বিলবোর্ডের ছায়ায় নদীর পাড়ে শুয়ে আছে। হুযূর ধীরে ধীরে তাদের কাছে এলেন। মা ছাগল ও ছানাটির মাথায় আলতো করে পরম মমতায় হাত বুলাতে লাগলেন। একটি কুকুর ও ছাগলের প্রতি যার এত মায়া, এত মহব্বত, সৃষ্টির সেরা মানুষরে প্রতি তার মায়া-মমতা কত বেশি? তার রূহানী সন্তান এই আমাদের প্রতি হুযূরের মায়া কত অধিক? আর সকল মাখলূকের স্রষ্টা আল্লাহ তা‘আলার সাথে হুযূরের ভালোবাসা আর সম্পর্ক কত গভীর! আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকেও মমতা সমৃদ্ধ হৃদয়বান মানুষ হওয়ার তাওফীক দিন এবং হুযূরসহ আমাদের সকল মুরুব্বীকে আল্লাহ তা‘আলা সুদীর্ঘ পরমায়ু দান করুন। আমীন।
বেলা অনেক গড়িয়েছে। ওদিকে কুয়াকাটার সূর্যাস্ত দেখতে হবে। তাই মুদীর সাহেব দ্রুত রওয়ানা হওয়ার কথা বললেন। আমরা বোটে উঠলাম। মাঝি বোট স্টার্ট দিলেন। কিন্তু বোট তো মাটিতে দেবে গেছে। সকালের দিকে জোয়ার ছিল। তাই আসতে কোন সমস্যা হয়নি। বিকালে ভাটা লেগেছে। এজন্য পানি কমে বোটের সামনের অংশ মাটিতে দেবে গেছে। অনেকক্ষণ চেষ্টা কসরত করে সফলতার নাগাল পাওয়া গেল।
বোট চলতে শুরু করল। আবার সেই সাগর-নদীর মোহনা পেরিয়ে সরু নদীতে প্রবেশ করলাম। পাশেই লাল কাঁকড়ার চর। আসার পথেই পড়ে। তখন নামা হয়নি ফেরার সময় নামব বলে। কিন্তু এখন সময় কম। মুদীর সাহেব হুযূর বললেন, লাল কাঁকড়া তো আমরা দেখেছি। এখন লাল কাঁকড়ার চরে নামার তেমন প্রয়োজন নেই। কারণ সময় কম, বিলম্ব হলে হয়ত সূর্যাস্ত দেখতে পারব না। হুযূর চূড়ান্ত ফয়সালার জন্য সফরের আমীর মুফতী ইবরাহীম হাসান সাহেবের শরণাপন্ন হলেন। আমীর সাহেব হুযূর সাথীদের আগ্রহ দেখে অল্প সময়ের জন্য লাল কাঁকড়ার চরে নামার অনুমতি দিলেন। আমাদের অবস্থা হল, লাল কাঁকড়া চরে নামারও ইচ্ছা, আবার ওদিকে সূর্যাস্ত হারাবারও ভয়। যাই হোক আমীর সাহেবের ফয়সালা অনুযায়ী চরে নামলাম লাল কাঁকড়া দেখতে। কাঁকড়াগুলো খুব দুষ্টু। দশ/বারো হাত দূরে শত শত লাল কাঁকড়া ছুটোছুটি করছে, কিন্তু আমরা কাছে যেতেই সব গর্তে ঢুকে পড়ে। দশ/বারো হাত সামনে যেতেই পিছনের সব কাঁকড়া উঠে আবার ছুটোছুটি
করতে থাকে। যেই দৌড়ে এগিয়ে যাই মুহূর্তেই সব মাটির গর্তে উধাও হয়ে যায়। এভাবে কিছুক্ষণ লাল কাঁকড়াদের সাথে লুকোচুরি খেলা হল। আমাদের এক সাথী গর্ত খুড়ে কাঁকড়া বের করার চেষ্টা করলেন। বের করতে পারলেন, তবে জীবিত নয়; মৃত। মুদীর সাহেব হুযূর এটা দেখে খুব দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং বললেন, তুমি আল্লাহ তা‘আলার কাছে ইস্তিগফার করো। হযরত আহমাদুল্লাহ সাহেব হুযূর বললেন, লোকেরা এমন ব্যবহার করে বলেই কাঁকড়ারা তাদের থেকে পালিয়ে বেড়ায়।
লাল কাঁকড়া দেখা শেষে বিদায় নিয়ে আমরা তড়িঘড়ি করে বোটে চড়ে বসলাম। নৌবিহারের সান্ধ্য আয়োজন শুরু হল। ঘাটে আগে থেকেই আমাদের জন্য ভ্যান অপেক্ষা করছিল। তাড়াতাড়ি ভ্যানে করে সৈকতে চলে এলাম। মসজিদে আসর নামায আদায় করে সমুদ্র তীরে ছুটে চললাম। গিয়ে দেখি সূর্য ডুবতে এখনো বেশ সময় বাকী। তখন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। লাল কাঁকড়ার চরেও নামা হল, ধীরস্থীরভাবে সূর্যাস্তও দেখা হবে। সূর্যাস্তের সময় অনেক মানুষের সমাগম হয় সৈকতে।
আমরা সূর্যের দিকেই তাকিয়ে আছি। সূর্য ধীরে ধীরে অস্ত যাচ্ছে। অস্তগামী সূর্যের প্রতিচ্ছবি সাগর বক্ষে পতিত হয়ে গোটা জলরাশিকে রক্তিম করে তুলেছে। সৈকতের ভেজা বালুগুলোকে রাঙিয়ে তুলেছে। লাল উর্মিমালাগুলো সাগরের তীরে এসে আমাদের দিকেই আছড়ে পড়ছে। সাগর বিধৌত নির্মল বায়ু দেহ মনে হিমেল পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। সে এক চিত্তহারী পরিবেশ। মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। অনেকেই এ দৃশ্যকে ক্যামেরায় বন্ধি করতে তৎপর হয়ে উঠলো। কিন্তু আমরা মহান রাব্বুল আলামীনের এ সৃষ্টি সৌন্দর্যের অনন্য শোভা মনভরে উপলব্ধি করলাম এবং হৃদয় ক্যানভাসে এঁকে নিলাম। হৃদয় গহীনে অনুরণিত হল এই কবিতা,
তোমার সৃষ্টি যদি হয় এত সুন্দর, না জানি তাহলে তুমি কত সুন্দর!
উদ্ভাসিত হল এ আয়াত,
فَتَبَارَكَ اللَّهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِينَ.
অর্থ : সুনিপুণতম স্রষ্টা মহান আল্লাহ তা‘আলা কতইনা বরকতময়। (সূরা মুমিনূন- ১৪)
কিছুটা উপরে থাকতেই সূর্যটা আমাদের বিদায় জানাল। কেউ কেউ বললেন, মেঘের কারণে সূর্য কিছুটা উপরে থাকতেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল সূর্যটা এখানে কিছুটা উপরে থাকতেই অদৃশ্য হয় এবং অস্ত যাওয়ার পরও বেশ
কিছুক্ষণ সাগর বক্ষকে আলোকিত করে রাখে।
ইতিমধ্যে মাগরিবের পবিত্র আযানের ধ্বনি ভেসে এল। নামায আদায়ের জন্য আমরা মসজিদের দিকে রওয়ানা হলাম। তবে এবার তীরবর্তী দোকানগুলোর ভিতর দিয়েই যাত্রা করলাম। এবারই প্রথম আমাদের চোখে পড়ল কাঁকড়ার ফ্রাই। মুফতী হাফিজুর রহমান সাহেব হুযূর বললেন, মুরশিদ কোথায়? ভালো করে দেখে নাও কাঁকড়ার ফ্রাই। তোমার তো দেখার বড় শখ।
মাগরিবের পর হুযূরের অনুমতিক্রমে আমরা কয়েকজন দলছুট হয়ে কেনাকাটা করার জন্য বের হলাম। আমরা শুঁটকি দোকানগুলোতে ঢু মারলাম। দামদর করলাম, তবে কিনলাম না। সী-বোট মালিক আমাদেরকে বলেছিলেন, তিনি ভালো শুঁটকি কিনে দিবেন। আমি, মুরশিদ, আশরাফ, ক্বমার ও মাসূম এ চারজন এবার মাছের বাজারের দিকে গেলাম। মুরশিদ ভাইয়ের লবণযুক্ত কাটা ইলিশ কেনার শখ। কিন্তু তখন তা পাওয়া গেল না। আমরা আরো সামনে এগিয়ে গেলাম। মুরশিদ ভাই হঠাৎ আওয়াজ দিয়ে উঠলেন, পেয়েছি! কি পেলেন? তাকিয়ে দেখি বিশাল আকৃতির এক নৌকা! এই নৌকাটার কথাই পত্রিকায় পড়েছিলাম। নৌকাটি চার দেয়ালে ঘেরা। গেট দিয়ে ঢোকার আগে বাইরের ক্যাপসনের লেখাটুকু পড়লাম। নৌকাটি শত বছরের পুরনো। সম্প্রতি মাটি খনন করে তোলা এ নৌকাটির দৈর্ঘ্য ৭২ ফুট এবং প্রস্থ ২০ ফুট। নৌকাটির ওজন প্রায় ৯০ টন। এটি এখন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে রয়েছে। ভিতরে ঢুকে আমরা নৌকাটি ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম। রাত বিধায় জায়গাটা অন্ধকার ছিল। সাপ, পোকা-মাকড়ের ভয়ও ছিল। যা দেখলাম তাতে আশ্চর্য হতে হল। নৌকাটির একেকটা পাল্লা যেন একেকটা আস্ত গাছ। মুরশিদ ভাই তো কসরত করে নৌকার উপরেই উঠে গেলেন।
ইতিমধ্যে ইশার আযান শুরু হয়ে গেল। আমরা মসজিদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম। তবে এতদূর চলে গিয়েছিলাম যে, আমরা মসজিদে গিয়ে দেখি মুসল্লীরা নামায পড়ে বের হয়ে যাচ্ছে। তাই আমরা হোটেলের দিকে রওয়ানা হলাম। সেখানে গিয়ে জামাআতে নামায আদায় করব। পথে আচারের দোকান সামনে পড়ল। সেখান থেকে কিছু আচার কিনলাম। নামাযের পর শুঁটকি কেনার জন্য বোট মালিককে নিয়ে আসলাম। উস্তাদগণও আসলেন। বোট মালিক তার ভাইয়ের দোকানে নিয়ে গেলেন। বিভিন্ন শুঁটকির দরদাম করা হচ্ছে। এ সময় মুফতী ইবরাহীম হাসান সাহেবকে হঠাৎ উঠে গিয়ে মুদীর সাহেব হুযূরের সাথে কি যেন বলতে দেখলাম। আমি মনে করেছিলাম হুযূর হয়ত টাকা ব্যাগে রেখে এসেছেন, তাই মুদীর সাহেব থেকে টাকা নিচ্ছেন। কথা শেষ করে হুযূর নিজ জায়গায় ফিরে আসলেন। মুদীর সাহেব হুযূর আমাদের দিকে এসে কতগুলো টাকা এগিয়ে দিলেন। বললেন, হুযূর তোমাদেরকে পাঁচ’শ টাকা করে হাদিয়া দিয়েছেন। আমরা সবাই খুব বেশি খুশি হলাম। হুযূর একেবারে সময়োচিত কাজটাই করেছেন। তবে আমি টাকাটা রেখে দিলাম। পরে চিন্তা করলাম এ তো টাকা, স্থায়ী কিছু না। পরে এ টাকা দিয়ে কিতাব কিনেছি। অনেকেই শুঁটকি কিনেছেন। এবার অপরিচিত একটা শুঁটকির নাম শুনলাম- বৈরাগী মাছের শুঁটকি। দোকানী আমাদের কাছে প্রায় নয় হাজার টাকার শুঁটকি বিক্রি করল। শুঁটকিগুলো ভালোই ছিল। দামও তুলনামূলক কম রেখেছে।
রাতের খাবারও বোট মালিকই রান্না করে এনেছেন। পরে মুদীর সাহেব হুযূর তাকে কিছু হাদিয়া দিলেন; পারিশ্রমিক নয়। কারণ তিনি আমাদের যে শ্রম দিয়েছেন তার মূল্য দেয়া যাবে না। হাদিয়া পেয়ে লোকটি বললেন, হুযূর যুলুম হয়ে গেল। আসলে মুদীর সাহেব হুযূর তার খরচের চেয়ে অনেক বেশি হাদিয়া দিয়েছেন। এজন্য সে নিতে চাচ্ছিল না। হুযূর অনেকটা জোর করেই তাকে টাকা দিলেন। তার জন্য দু‘আও করলেন। সে অত্যন্ত খুশি মনে আমাদের থেকে বিদায় নিল।
এবারের সফরে মাহবূব ভাই ও আব্দুল কুদ্দূস ভাই মা’হাদে রয়ে গিয়েছিলেন। ভাবছিলাম তাদের জন্য কিছু নেয়া যায় কিনা? শোয়ার আগ মুহূর্তে মনে হলো, মাহবূব ভাইয়ের ছেলে আফীফ আব্দুল্লাহর জন্য শামুকে নাম লিখে নেয়া যায়। রাত অনেক হয়ে গেছে। প্রায় অধিকাংশ দোকানই বন্ধ হয়ে গেছে। একটা দোকানে গিয়ে বললাম, খুব দ্রুত এই নামে একটি শামুক বানিয়ে দিন। প্রায় আধ ঘণ্টা পর শামুক নিয়ে হোটেলে ফিরলাম। তাড়াহুড়োর কারণে তেমন সুন্দর হয়নি।
ঘুম থেকে উঠে ফজর নামায আদায় করলাম। নামাযের পর আমরা আবার সৈকতে গেলাম। জানতাম এখান থেকে ভালোভাবে সূর্যোদয় দেখা যায় না। তারপরও তার কিছুটা আভাস পাওয়া যায় কিনা তা দেখার জন্যই সৈকতে যাওয়া। দুপুরের
খাবার ঐতিহ্যবাহী বরিশাল মাহমূদিয়ায় খাওয়া হবে। তাই সকালেই বাসে উঠার সিদ্ধান্ত হল। আমাদের হাতে সময় অনেক কম। এরই মধ্যে রাইহান ভাই ও শরীফ ভাই সমুদ্রে গোসলও করে নিলেন।
যথা সময়ে বাস ছাড়ল। সরাসরি কুয়াকাটা থেকে বরিশাল সদর। বাসের সিট এখনও খালী। হেল্পার ভাই ডাকছেন- এ্যা বরিশাল, বরিশাল…। বাস আন্দরমানিক নদীর ফেরিঘাটে এসে থামল। নাস্তা করার জন্য সবাই হোটেলে ঢুকলাম। নাস্তা শেষ না হতেই ডাক আসল, এই! ফেরি ছেড়ে দিল। আমাদের কয়েকজনের নাস্তায় বিলম্ব হওয়ায় আমরা পরের ফেরিতে গেলাম।
বাস তার নিজস্ব গতিতে চলছে। একসময় আমরা বরিশালের সবচেয়ে বড় সেতুতে চলে আসি। সেতুটি কীর্তনখোলা নদীর উপর অবস্থিত। এর আগে রয়েছে সুবিশাল ক্যাম্পাসের বরিশাল কলেজ। শুধু এই সেতুতেই টোল পরিশোধ করতে হল। বরিশাল বাসস্ট্যান্ডে নেমে আমরা অটোযোগে বরিশাল মাহমূদিয়ায় পৌঁছলাম। আমাদের অটো চালক জ্যাম থেকে রক্ষা পেতে ভিন্ন পথে আমাদেরকে চরমোনাই ঘাটে নিয়ে গেল। পরে ফোন যোগাযোগের ফলে কিছুটা বিলম্বে হলেও আমরা মাহমূদিয়া মাদরাসায় উপস্থিত হই। মাদরাসার মাঠটি বেশ প্রশস্ত। দু’পাশে বিশাল বিশাল ভবন। পশ্চিম দিকে মিনার বিশিষ্ট একটি মসজিদ। পরিবেশটা আরো সুন্দর করে তুলেছে ভবনগুলোর সামনে থাকা তিন-চারটি সুদৃশ্য ফুল বাগান। সবকিছু মিলে পরিবেশটা ভালোই লাগছে। বড় বড় ভবন থাকলেও দেয়াল ও ছাদ সাক্ষ্য দিচ্ছিল আমরা অনেক পুরাতন একটি মাদরাসায় এসেছি। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা হয়। কোথাও কোথাও ছাদ থেকে আস্তর খসে পড়েছে। তবে মনে হচ্ছে অনেক
মজবুত। ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা নেই।
গোসল সেরে যোহর নামায আদায় করলাম। মাদরাসার অফিসে আমাদের জন্য শাহী দস্তরখানের আয়োজন করা হয়েছে। বিশাল দস্তর। সবাই উলামায়ে কেরাম। পরিবেশটাই ভিন্ন রকম। মাহমূদিয়া মাদরাসায় বরিশালের উলামায়ে কেরামের একটি পরামর্শ সভা ছিল। তাতে যোগ দিতে চরমোনাই মাদরাসার ইফতা বিভাগের মুশরিফ (দায়িত্বশীল উস্তাদ) এসেছিলেন। তিনি আমাদেরকে চরমোনাই নিয়ে যাবেন। আহার শেষে আমরা তার সঙ্গে চরমোনাইর পথে রওয়ানা হলাম। চরমোনাই যাতায়াতের পুরো খরচ রাহবার সাহেবই চরমোনাইয়ের খানকাহর পক্ষ থেকে বহন করলেন। আমাদেরকে কোন খরচ করতে দিলেন না। মাহমূদিয়া মাদরাসা থেকে পায়ে হেঁটেই নদীর ঘাটে পৌঁছলাম। এরপর ট্রলারে নদী পার হলাম। ট্রলার থেকে নেমে ইজিবাইক অথবা টমটমে চরমোনাই মাদরাসায় যেতে হবে। এগুলো লাইনের গাড়ি। একটা ছাড়লে পরেরটায় উঠা যাবে। হুযূরদের জন্য ইজিবাইক রিজার্ভ করা হল। আমরা টমটমেই উঠলাম। টমটমের সবাই চরমোনাইর যাত্রী নয়।
তারপরও আমরা যেহেতু চরমোনাইর মেহমান তাই আমাদেরকে মাদরাসার গেটের ভিতরে নামিয়ে দিল। আগে শুনতাম এলাকাবাসী চরমোনাইর পরম ভক্ত। এখন তা বাস্তবে দেখলাম।
আসর নামায আমরা চরমোনাই মাদরাসার জামে মসজিদে আদায় করলাম। সেখানে আমাদেরকে স্বাগত জানালেন তাফসীর বিভাগের মুশরিফ সাহেব। আমাদের তিনি মরহুম পীর সাহেব রহ. এর জামাতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। নামায শেষে তিনি আমাদেরকে মসজিদ সম্মুখে অবস্থিত মরহুম পীর সৈয়দ ফজলুল করীম রহ. ও তার পিতা সৈয়দ ইসহাক রহ. এর কবরের পাশে নিয়ে যান। আমরা কবর যিয়ারত করলাম। তারপর আমাদেরকে মাদরাসা দেখানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হল।
চরমোনাই এলাকায় বিখ্যাত বুযুর্গ আব্দুল জাব্বার ওরফে আহসানুল্লাহ সাহেব রহ. বাস করতেন। তিনি ওলীয়ে কামেল রশীদ আহমদ গঙ্গুহী রহ. এর বিশিষ্ট খলীফা কারী ইবরাহীম সাহেব রহ. এর ফয়েয প্রাপ্ত ছিলেন। তার নামেই এলাকার নাম হয় আহসানাবাদ। আহসানুল্লাহ রহ. এলাকার লোকদের দীন শিক্ষা দানের লক্ষ্যে বাড়ির আঙ্গিনায় একটি মকতব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সৈয়দ ইসহাক রহ. এটাকেই ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে মাদরাসায় রূপ দান করেন। রশীদ আহমাদ গঙ্গুহী রহ. এর নামে মাদরাসার নামকরণ করা হয় জামি‘আ রশীদিয়া আহসানাবাদ। এ মাদরাসার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এতে আলিয়া ও কওমী উভয় ধারার শিক্ষা কারিকুলামের সমন্বয় ঘটেছে। কামিল পর্যন্ত আলিয়া মাদরাসা চালু রয়েছে। কওমী শিক্ষা ব্যবস্থার দিক থেকে তাখাস্সুস ফিল ইফতা, আদব ও তাফসীর বিভাগও রয়েছে। আমাদেরকে ইফতা বিভাগে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে আমাদেরকে ভরপুর মেহমানদারী করানো হল। মেহমানদারী শেষে সেখান থেকে প্রকাশিত মাজাল্লাতুল কারীমের দুই কপি করে সবাইকে হাদিয়া দেয়া হল। অতঃপর জামি‘আর তাফসীর বিভাগ, আদব বিভাগ, দাওরায়ে হাদীসের দরসগাহ ও নূরানী বোর্ড দেখানো হল। সবশেষে চরমোনাই মাদরাসার আসাতিযা ও তালিবে ইলমদের একরাশ ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে সেখান থেকে বিদায় নিলাম।
চরমোনাই থেকে বিদায় নিয়ে পুনরায় মাহমূদিয়া মাদরাসায় আসলাম। এখানে মাগরিব পড়ে রাজ্জাকিয়া মাদরাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। মাহমূদিয়া থেকে বের হওয়ার সময় মুহতামিম সাহেব আমাদের সাথে মুসাফাহা করলেন। রাজ্জাকিয়া মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা রফীকুল ইসলাম সাহেব আমাদেরকে এগিয়ে নেয়ার জন্য আগেই চলে এসেছিলেন। ইজিবাইক যোগে আমরা রাজ্জাকিয়া মাদরাসায় পৌঁছলাম। মাদরাসার তৃতীয় তলায় ছাত্র-উস্তাদ সবাইকে একত্রিত করা হল। মুফতী ইবরাহীম হিলাল সাহেব প্রথমে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে কিছু উপদেশমূলক কথা রাখলেন। উপদেশ-বাণীর সারসংক্ষেপ হল,
চারটি কাজ ছাত্রদের জন্য করণীয়-
(১) উস্তাদদের সম্মান করা, (২) মাদরাসার মধ্যেই থাকার অভ্যাস করা, (৩) বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন দেখা দিলে উস্তাদগণকে বলে যাওয়া এবং (৪) মাদরাসার কমিটিদের সম্মান করা।
কিছু বর্জনীয় বিষয় হল-
(১) উস্তাদগণের সাথে খারাপ আচরণ না করা, (২) উস্তাদগণকে না বলে কোথাও না যাওয়া এবং (৩) মোবাইল ব্যবহার না করা। কারণ মোবাইল একটি ক্যান্সার, যা ছাত্রদেরকে একপর্যায়ে মাদরাসা থেকে বের করে দেয়।
এরপর মুফতী ইবরাহীম হাসান সাহেবও কিছু নসীহত করলেন। তিনি বললেন,
আমাদেরকে ইলম অর্জন করতে হবে এবং তা অন্যের নিকট পৌঁছাতে হবে। আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত। যে কেউ মাদরাসায় আসতে পারে না, ইলম অর্জন করতে পারে না। মাদরাসায় পড়ি বিধায় কী খাবো, খেতে পাবো কিনা এসব বিষয়ে চিন্তা করতে হবে না। আল্লাহ তা‘আলাই পৃথিবীর সবাইকে রিযিক পৌঁছান। আর আমরা তো আল্লাহর মনোনীত ও নির্বাচিত বান্দা। আমাদের রিযিকের ব্যবস্থা আল্লাহ তা‘আলাই করবেন। দেখুন, যারা সরকারের কাজ করে, সরকার তাদের বেতন-ভাতা দেয়। আমরা আল্লাহ তা‘আলার কাজ করছি; আল্লাহই আমাদের রিযিকের ব্যবস্থা করবেন। তাই কথাগুলো মনে রাখতে হবে। এ কথাগুলো আমাদের মুরুব্বী উস্তাদগণ আমাদেরকে বলে গিয়েছেন। আজ তারা নেই; আমরা তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। তোমরা এগুলো স্মরণ রেখো। তোমাদের পরবর্তীদের এ কথাগুলো পৌঁছে দিতে হবে।
হুযূর দু‘আর মাধ্যমে মজলিস শেষ করলেন। আমি বারান্দায় বসে বয়ান শুনছিলাম। বয়ান শেষে সবাই যখন বের হচ্ছিল, তখন একটা পরিচিত মুখ দৃষ্টিগোচর হল। আমাদের বড় ভাই মাওলানা ইমরান হুসাইন। সামনে গিয়ে সালাম-মুসাফাহা বিনিময় করলাম। অনেকদিন পর অপ্রত্যাশিতভাবে সাক্ষাত। দু’জনেই অত্যন্ত আনন্দিত। আমি মাদরাসাতুল কুরআনিল কারীমে দ্বিতীয় ফরীকে পড়াকালে তিনি মাওলানা আতীকুল্লাহ দা.বা. এর সোহবতে ছিলেন। মুরশিদ ভাই ও আমি যেহেতু মাদরাসাতুল কুরআনিল কারীমে একসঙ্গে পড়েছি, তাই তিনি মুরশিদ ভাইয়েরও পরিচিত। আমি মুরশিদ ভাইকে খবর দিয়ে নিয়ে আসলাম। টুকটাক কথাবার্তা হল। মাওলানা ইমরান ভাইয়ের সহপাঠী ছিল মাওলানা আশরাফ ভাই। তিনি অনেক আগেই ইতালীতে পাড়ি জমিয়েছেন। ইমরান ভাইকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম- আশরাফ ভাই এখন বাংলাদেশেই আছেন। পরিবারকে নেয়ার জন্য দেশে এসেছেন। তারা উভয়েই বরিশাল শহরের বাসিন্দা। ইমরান ভাই এখন রাজ্জাকিয়া মাদরাসার উস্তাদ। তিনি আশরাফ ভাইকে ফোন দিতে চাইলেন এবং বললেন, আশরাফ ভাই খবর পাওয়া মাত্রই চলে আসবেন। আমরা বললাম, আমাদের সময় খুব কম, খাওয়া-দাওয়া সেরেই আমরা চলে যাব। আশরাফ ভাইকে ফোন দেয়ার দরকার নেই। তিনি বললেন, তাহলে আমি গিয়ে তাকে নিয়ে আসি; আমার বাইক আছে। আমরা বললাম, কষ্ট করার দরকার নেই। তিনি নাছোড় বান্দা- বললেন, ঠিক আছে, তাহলে আমি আশরাফ ভাইকে নিয়ে লঞ্চঘাটে আসি। অগত্যা আমরা বললাম,
সুন্দরবন-৭ এ আমরা যাব।
হুযূরদের পক্ষ থেকে আমাদের ডাক পড়ল। আমরা ভিতরে চলে গেলাম। তিনি উধাও হয়ে গেলেন। সবাই দস্তরখানে বসা। আমরাও একপাশে বসলাম। আমাদের দিকটায় যিনি খাবার পরিবেশন করছেন তিনি মাদরাসার একজন উস্তাদ। প্রথমে বুঝতে পারিনি। তিনি আমাদের সাথে একজন ছাত্রের মতই আচরণ করছিলেন। পীড়াপীড়ির পর বললেন, তিনি এখানে খিদমতে আছেন। তিনি মাওলানা কালীম সিদ্দীকী দা.বা. এর প্রসঙ্গ তুললেন। আরো কিছু কথা হল। তিনি দাওয়াতুল ইসলাম বাংলাদেশের কথাও বললেন, যা কালীম সিদ্দীকী দা.বা. সহ বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে অমুসলিমদের মাঝে দাওয়াতের কাজ করে থাকে। তিনি এর সদস্যও।
সবশেষে রসমালাই পরিবেশন করা হল। খুব সুস্বাদু। এটা এসেছে মুদীর সাহেব হুযূরের এক মুসল্লীর মাধ্যমে। তার অধিনে কাজ করে এমন একলোক তখন বরিশাল শহরে ছিল। তাকে মুদীর সাহেব হুযূরের সেই মুসল্লী মুদীর সাহেব হুযূরের সাথে রাজ্জাকিয়া মাদরাসায় রসমালাই নিয়ে সাক্ষাত করতে বলেছিলেন।
রাতের খাবার শেষে আমরা লঞ্চঘাটের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। লঞ্চঘাটে গিয়ে দেখি ইমরান ভাই ও আশরাফ ভাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। সালাম-মুসাফাহা হল, মু‘আনাকাও হল। আশরাফ ভাই বললেন, আপনাদের কথা শুনামাত্রই রওয়ানা দিয়েছি। তার এই মহব্বতপূর্ণ কথাটি আমার অন্তরে গেঁথে গেল। মাদরাসাতুল কুরআনিল কারীমের সাথীদের সাথে আমাদের এমনই গভীর সম্পর্ক। তারা আমাদের সহপাঠী নয়; আমাদের শিক্ষাজীবনে তারা সেখানে ছিলেন। তাই তাদের সঙ্গেও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। আমাদের শ্রদ্ধেয় উস্তাদ মাওলানা আতীকুল্লাহ দা.বা. এর এমনটাই আকাঙ্ক্ষা ছিল। এই মাদরাসার তালিবুল ইলমদের যাতে এমন সম্পর্ক থাকে এজন্য তিনি ‘তালিবুল ইলম’ নামে একটি সংগঠনও তৈরি করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তার সকল আকাঙ্ক্ষা কবুল করুন। আমীন।
তাদেরকে নিয়ে আমরা লঞ্চে প্রবেশ করলাম। সেখানে কিছুক্ষণ কথা হল। তারা জানালেন, আগামীকাল তারা ঢাকা যাবেন হুযূরের সাথে সাক্ষাত করতে। আমরা বরিশালে আছি তা আগে জানলে আজই আমাদের সাথে রওয়ানা হতেন। আশরাফ ভাই ইতালীতে ইমাম হিসেবে আছেন। তার কাছে জানতে পারলাম, ইতালীতে মসজিদ তৈরি করা যায় না। কেউ যদি মসজিদ করতে চায় তাহলে তাকে প্রথমে ইসলামিক কালচারাল সেন্টার খুলতে হয়। তারপর সেখানে জামা‘আতে নামাযের ব্যবস্থা করা যায়। সেখানকার মসজিদগুলোতে লেখা থাকে দারুস সালাত বা বাইতুস সালাত। অর্থাৎ নামাযের ঘর। তাদেরকে মুদীর সাহেব হুযূরের সাথে সাক্ষাত করিয়ে দিলাম। তারপর অন্যান্য মুরুব্বীগণের সাথে সাক্ষাত করানোর জন্য কেবিনে নিয়ে গেলাম। আশরাফ ভাই আমাকে এবং মুরশিদ ভাইকে কিছু টাকা হাদিয়া দিলেন। আমরা একেবারেই অপ্রস্তুত। হাদিয়া তো, তাই অগ্রাহ্য করতে পারলাম না। মুফতী ইবরাহীম হাসান দা.বা. ও মুফতী ইবরাহীম হিলাল দা.বা. কেবিনে আছেন। উস্তাদগণের সাথে আমার সাথীদ্বয়কে পরিচয় করিয়ে দিলাম। তারা দু‘আ চাইলেন। কেবিন থেকে বের হওয়ার পর আশরাফ ভাই বললেন, উস্তাদগণকে কিছু হাদিয়া দিতে চাই। বললাম, মুসাফাহা করে দিয়ে দিন। তিনি বললেন, এটা নাকি বেয়াদবী? বললাম, দিয়ে দিন না! কিছু হবে না। তিনি আবার কেবিনে ঢুকে বললেন, হুযূর! বেয়াদবী মাফ করবেন। এই বলে তিনি উস্তাদগণকে হাদিয়া দিলেন। হুযূরের কেবিনে পানির প্রয়োজন। ইমরান ভাই দৌড়ে দুইটা দুই লিটারের পানির বোতল নিয়ে আসলেন। মুদীর সাহেব হুযূর বললেন, পানির মূল্য দিয়ে দিয়ো। আমি ইমরান ভাইকে বললাম, মুদীর সাহেব হুযূর পানির মূল্য দিয়ে দিতে বলেছেন। তিনি বললেন, হুযূরকে বলবেন, রাজ্জাকিয়া মাদরাসার উস্তাদ এটা হাদিয়া হিসেবে দিয়েছেন। এরপর তারা চলে গেলেন।
আগেই বলেছিলাম, বরিশালের লঞ্চগুলোতে ডেকে থাকতে হলে আগে ভাগেই জায়গা দখল করতে হয়। ডেকের স্পেশাল জায়গা হল দ্বিতীয় তলার সামনের দিকের জায়গাটা। নিচতলা থেকে দ্বিতীয় তলায় উঠতে সিঁড়ির পাশের জায়গাটাই। আমাদের জন্য মাহমূদিয়া মাদরাসার দু’জন তালিবুল ইলম দুপুরে এসে স্পেশাল জায়গাটাই দখলে নিয়েছিলেন। তাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দেয়ার সময় কিছু হাদিয়া দিতে গেলে তারা নিতে চাইল না। তারপর মুদীর সাহেব হুযূর তাদেরকে বুঝিয়ে শুনিয়ে হাদিয়াগুলো দিয়েই দিলেন।
দু’দিনের সফরের ক্লান্তি। উযূ-ইস্তিঞ্জা সেরে ইশার নামায আদায় করলাম। নামায শেষে শরীর এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ফজরের সময় লঞ্চ সদরঘাটে পৌঁছল। যাওয়ার সময় যে ট্রলারে গিয়েছিলাম, আগে থেকে সেটাই ঠিক করা ছিল। ফজর নামায লঞ্চে আদায় করে ট্রলারে উঠলাম। ট্রলারে বসেই লাল টুকটুকে সূর্যের উদয় দেখলাম। এ সময় হযরত মুফতী ইবরাহীম হাসান সাহেব হুযূর মুদীর সাহেব হুযূরকে জিজ্ঞাসা করলেন, কয়জন তালিবে ইলম সফরে যাননি? হুযূর বললেন, দু’জন। তখন ইবরাহীম হাসান সাহেব হুযূর পাঁচশত টাকার দু’টি নোট বের করে মুদীর সাহেবের হাতে দিলেন এবং বললেন, ঐ দু’জনকেও এ টাকাগুলো হাদিয়া স্বরূপ দিয়ে দিবেন।
আমাদেরকে বসিলা বড় মসজিদ ঘাটে নামিয়ে দেয়া হল। মুফতী আবূ সাইম সাহেব উস্তাদগণের মেহমানদারীর ব্যবস্থা করেছিলেন। আমরা মা’হাদে চলে এলাম। উলামায়ে কেরামের সাথে সফরের আনন্দটাই একটু ব্যতিক্রম। বিশ্বাস না হলে একবার সফর করেই দেখুন। কমপক্ষে আপনার পিকনিক বা সফরে গান-বাদ্য না বাজিয়ে ইসলামী বিধি-বিধানকে সামলে সফর করে দেখুন। অনাবিল বিনোদনে এমন এক তৃপ্তি পাওয়া যাবে যা গান-বাদ্য বা নাচ-গান করেও পাওয়া যাবে না। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকল কাজকে একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করার তাওফীক দান করুন। আমীন।


পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *