নারিকেল জিঞ্জিরা : প্রবাল খাঁজে সৌন্দর্যের অবগাহন

উসামা যুলকিফিল


চারিদিকে ঝকঝকে সোনালী রোদ। নির্মেঘ আকাশ। স্নিগ্ধ আবহাওয়া। সব মিলিয়ে চমৎকার একটি দিন। নয় সিটের হাইএস গাড়ির একেবারে পিছনের সারিতে গুটিসুটি মেরে বসে আছি। গাড়ি ছুটছে প্রচণ্ড বেগে। পথের দু’পাশের বাড়ি-ঘর আর গাছপালা চকিতেই পিছিয়ে যাচ্ছে। আর আমি তন্ময় হয়ে ভাবছি, কীভাবে আমাদের যাত্রা শুরু হল। আর আমাদের সামনে কী রকম রোমাঞ্চই না জানি অপেক্ষা করছে।…

মা’হাদুল বুহুসিল ইসলামিয়াতে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই আমার এখানে যাওয়া-আসা ছিল। তখন থেকেই এর কিছু ব্যতিক্রম অনন্য বৈশিষ্ট্য নযরে পড়েছিল। মা’হাদে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই আমরা মা’হাদের যে বিষয়টির জন্য অধীর আগ্রহে ছিলাম, তা হল বাৎসরিক ইলমী সফর।

ঘুরে বেড়ানো সবার মত আমারও পছন্দ। কিন্তু টইটই করে ঘোরা নয়। কোথাও যেতে চাইলে আমি আগে সুযোগ-সুবিধার খবর নিই। এই আয়েশি স্বভাবের কারণে ভ্রমণের পরিমাণও কম। একবার এক বন্ধুর আমন্ত্রণে সিলেট গিয়েছিলাম। আর বড় বোন চট্টগ্রাম থাকার সুবাদে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত আর বোনের বাসার কাছের পার্কি সমুদ্র সৈকত। সেসব মনে বড় দাগ কেটে আছে।

মা’হাদের মুখপত্র ‘বাতায়ন’ হাতে পেলেই আমি সবার আগে মা’হাদের ইলমী সফরের বৃত্তান্ত পড়ি। আর অনুন্ধিৎসু মন এমন মনোমুগ্ধকর, রোমাঞ্চকর ভ্রমণের জন্য আইঢাই করে। কিন্তু কখনো ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি, আমিও একদিন মা’হাদে ভর্তি হব আর ইলমী সফরে যাওয়ার সুযোগ মিলবে। তাই মা’হাদে ভর্তি হওয়ার পর মনে মনে প্রহর গুণছিলাম ইলমী সফরের দিনক্ষণের। মা’হাদের একাডেমিক ক্যালেন্ডারে ইলমী সফরের তারিখ লেখা রয়েছে দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরের তিনদিন। ২৯, ৩০, ৩১ জানুয়ারি। প্রায়শই সহপাঠীদের সঙ্গে আলোচনায় মেতে উঠি, কোথায়ই বা যাওয়া হবে কিংবা কোন্ কোন্ বুযুর্গের সান্নিধ্যই বা আমরা পাব। সময় গড়ায়। আসন্ন সফরের অজানা শিহরণে আমরা শিহরিত হই। দ্বিতীয় বর্ষের বড় ভাইদের কাছে সফর সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাই। সফরের ধরণ বুঝতে চেষ্টা করি।

এর মধ্যে পানি গড়িয়েছে অনেক দূর। মা’হাদ নতুন স্থানে স্থানান্তরিত হয়েছে। আগের স্থান থেকে অল্প সামনে। মা’হাদের প্রধান মুফতী ও উপদেষ্টা মুফতী ইবরাহীম হাসান সাহেব দা.বা. এর নিজস্ব ভবনের নিচতলা এবং দোতলায়। নিরাপত্তা ও জোরদার নিগরানীর উদ্দেশ্যে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসানো হয়েছে। ইতোমধ্যে মা’হাদের বার্ষিক ওয়াজ ও দু‘আ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে সফলভাবে। এবার বড় কার্যক্রম বলতে সামনে কেবল ইলমী সফর।

মুদীর সাহেব হুযূর একদিন দরসে কাঙ্ক্ষিত বিষয়ে মুখ খুললেন। জানালেন, সবার এবার সুন্দরবনে যাওয়া হতে পারে। হিরণ পয়েন্টে। কিন্তু এটা সময়সাপেক্ষ এবং কিছুটা ব্যয়বহুল হওয়ায় বাদ পড়ল। আমরা বান্দরবানের প্রস্তাব দিলাম। জানা গেল,বান্দরবানে যাওয়ার যুৎসই সময় হল বর্ষাকাল। তাই বান্দরবানও বাদ। এবার প্রস্তাব উঠল নারিকেল জিঞ্জিরা যাওয়ার। আমাদের পনের জনের মধ্যে মাত্র দু’জন এর আগে নারিকেল জিঞ্জিরা গিয়েছিলেন। তাই বাকিদের সমর্থনে এই প্রস্তাবের পালে হাওয়া লাগল। মুদীর সাহেব আনুষঙ্গিক বিষয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন। কী হয়, না হয় এই রকম দোলাচলে আমরা আমাদের পড়া-লেখা চালিয়ে যাচ্ছি।

তারপর একদিন মুদীর সাহেব হুযূর ইশার পর প্রাত্যহিক তা’লীম শেষে জানালেন ইনশাআল্লাহ সফর এবার নারিকেল জিঞ্জিরাতেই হবে। তবে একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী তারিখ ঠিক থাকবে না। বরং তার কিছুদিন আগে জানুয়ারির ২৩, ২৪ ও ২৫ তারিখে হবে। যেসব মুরুব্বী আমাদের সঙ্গে যাবেন, ছুটিতে তাদের বিভিন্ন প্রোগ্রাম থাকায় এই নতুন তারিখ। হুযূর এবার জানতে চাইলেন, কে কে সাঁতার জানে না। দু’জন হাত তুলল। আমি তুললাম না। হুযূর বললেন, কী উসামা! তুমি সাঁতার পারো? আমি বললাম, চিল্লায় গিয়ে শিখে নিয়েছি। কিন্তু সে বিদ্যার দৌড় যে কদ্দূর, তা আমি বিলক্ষণ জানি। কিন্তু সেটা ফাঁস করে তো আর সফর মাটি করা যায় না। হুযূর বললেন, যারা সাঁতার জানো না, তারা মাদরাসায় থেকে যেতে পারো। কিন্তু দেখা গেল, প্রাণের মায়া এ দু’জনের অতটা নেই! সফর থেকে ফিরেই যেহেতু পরীক্ষা; তাই হুযূর সফরের উচ্ছাসে যাতে পড়াশোনার ক্ষতি না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক করলেন।

ভেতরে ভেতরে সবার জোর প্রস্তুতি চলতে লাগল। সহপাঠী হাবীবুল বাশার একটা বাইনোকুলার আনালেন সেই সুদূর যশোর থেকে দূরবর্তী জিনিসগুলোকে অনুভব করার জন্য। তা দেখে রেযওয়ানও নিয়ে এলো একটা। এ দু’টো পেয়ে আনন্দের মাত্রা যেন আরো বেড়ে গেল। ধীরে ধীরে সেই কাঙ্ক্ষিত রবিবার ঘনিয়ে এলো। এর আগের দিন আমি ছুটি নিয়ে বাসা থেকে আমার হোল্ডল নিয়ে এলাম। হযরত আবরারুল হক রহ. এর কথা অনুযায়ী সম্ভাব্য প্রয়োজনীয় সবকিছু দিয়ে হোল্ডল বোঝাই করে ফেললাম। ‘রিডিং ম্যাটেরিয়াল’ হিসেবে ক’টা বইও ঠাই পেল তাতে। আর সফরনামা লেখার জোর তাগিদের কারণে ডায়েরীও নিলাম।

বাদ ইশা মুদীর সাহেব হুযূর সফরের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য,করণীয় ও বিভিন্ন আ’মালের আলোচনা করলেন। সঙ্গে মুরুব্বী যারা যাবেন, তাদের সবিশেষ তা’যীম ও খেদমতের কথা উল্লেখ করলেন এবং সবশেষে শেষরাতে তাহাজ্জুদ পড়ার তাগিদ দিয়ে কথা শেষ করলেন।

আমরা শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। প্রস্তুতি শেষে দ্রুত শুয়ে পড়লাম। আসন্ন সফরের নানাদিক নিয়ে কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।

ভোর রাতে ঘুম ভাঙল। কয়েকজন আরো আগে উঠে গেছে দেখলাম। উযূ ইত্যাদি সেরে নামাযের জন্য তৈরি হলাম। নামায শেষে দৈনন্দিনের ওযীফা পড়তে পড়তেই দেখে নিলাম কিছু নেয়া বাকি রইল কিনা। গাড়ি ততক্ষণে মা’হাদের সামনে এসে পড়েছে। নয় সিটের দু’টি হাইএস মাইক্রোবাস। একটি ধবধবে সাদা। আরেকটি গাঢ় নীল। একটু পরেই প্রথম বর্ষের ছাত্রদের অর্থাৎ আমাদের গাড়িতে উঠতে বলা হল। আমরা সবাই নীল গাড়িটার সামনে জড়ো হলাম। গাড়ির সামনে মুদীর সাহেব ও আমীনুত তা’লীম সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। আমীনুত তা’লীম সাহেব এবার আমাদের সঙ্গে সফরে যাচ্ছেন না। আমরা তাঁর সঙ্গে বিদায়ী মুসাফাহা করে দু‘আ চেয়ে একে একে গাড়িতে উঠে পড়লাম। আমাদের সঙ্গে উঠলেন মা’হাদের উস্তাদ হযরত মাওলানা মাহমূদুল হাসান সাহেব। মুদীর সাহেবও আপাতত আমাদের সঙ্গে উঠলেন। যেসব মুরুব্বী এই গাড়িতে যাবেন তাদের স্বাগত জানিয়ে উঠিয়ে নিতে।

আমি অভ্যাসমত যানবাহনের দু‘আ, ছয় বিসমিল্লাহর সাথে পাঁচ সূরা এবং ওয়ামা কাদারুল্লাহা… এই আয়াত পড়ে নিলাম। এসব আমল আব্বু ছোট বেলাতেই শিখিয়েছিলেন। তাই সফরের সময় এসব দু‘আ অবচেতন মনেই পড়ে ফেলি। এজন্যই ছোট বেলার তরবিয়ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গাড়ি রওয়ানা হল ওয়াশপুর মাদরাসার দিকে। সেখান থেকে উঠলেন মাদরাসাটির নায়েবে মুহতামিম মাওলানা জামালুদ্দীন সাহেব ও এ মাদরাসারই প্রবীণ উস্তাদ মাওলানা শহীদুল ইসলাম সাহেব। মাওলানা জামালুদ্দীন সাহেব হুযূর দা.বা. দৃশ্যত রাশভারী হলেও বেশ হাসি-খুশি আর দিলখোলা ব্যক্তিত্ব। তার সঙ্গ আমাদের একই সাথে আনন্দিত ও উপকৃত করেছে। আর মাওলানা শহীদুল ইসলাম সাহেব গম্ভীর প্রকৃতির বুযুর্গ মানুষ। অবসর পেলেই অনুচ্চস্বরে কুরআন তিলাওয়াত যেন তার স্বভাবে পরিণত হয়েছে।

গাড়ি ছুটছে ব্যস্ত গতিতে জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়ার মুহাম্মাদপুর ক্যাম্পাসের দিকে। এখান থেকে উঠলেন জামি‘আর নায়েবে মুহতামিম হযরত মুফতী ইবরাহীম হেলাল সাহেব দা.বা.। তাকে পেয়ে আমরা খুব খুশি হলাম। এত বড় মাপের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও ছাত্রদের প্রতি তার অসাধারণ মমত্ব ও স্নেহপূর্ণ আচরণ সবার মুখে মুখে ফেরে।

আমাদের গাড়ির কোটা পূর্ণ হল। ড্রাইভারের পাশে মাওলানা জামালুদ্দীন সাহেব, পেছনের সারিতে নায়েব সাহেব, মাহমূদুল হাসান সাহেব ও শহীদুল ইসলাম সাহেব। আর পেছনের দু সারিতে চারজন করে আমরা প্রথম বর্ষের নয়জনের মধ্যে আটজন। অন্য গাড়িতে ড্রাইভারের পাশে রাহমানিয়াসহ বহু মাদরাসার মুহাদ্দিস, মুদাররিস, মুহতামিম এবং মা’হাদের প্রধান মুফতী ও উপদেষ্টা হযরত মুফতী ইবরাহীম হাসান সাহেব, পেছনের সারিতে মুদীর সাহেব, আব্দুল হাই পাহাড়পুরী রহ. এর বিশিষ্ট খলীফা রাহমানিয়ার মুদাররিস হযরত মাওলানা আহমাদুল্লাহ সাহেব ও মা’হাদের উস্তাদ মুফতী মাহমূদ বিন ইলিয়াস সাহেব। আর পেছনের দু সারিতে দ্বিতীয় বর্ষের ছয়জন, আমাদের একজন ফখরুল ইসলাম ভাই ও আমাদের রাহবার মাওলানা শাহাদাতুল্লাহসহ মোট আটজন।

মাওলানা শাহাদাতুল্লাহ বসিলা এলাকারই আদি বাসিন্দা। হাটহাজারী মাদরাসার ফারেগ বাবরী চুলের সুঠামদেহী এই তরুণ আলেম মাঝের ক’বছর ওয়াশপুর মাদরাসায় পড়ার সুবাদে মুদীর সাহেব হুযূরের ছাত্র। এখন ওয়াশপুরের এক মাদরাসায় ইফতা করছেন। বিয়ে করেছেন সুদূর টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে। টেকনাফ ও নারিকেল জিঞ্জিরাতেও তার আত্মীয়-স্বজনেরা রয়েছেন। এ সুবাদে তিনি আমাদের রাহবার হিসেবে সঙ্গে রয়েছেন। পুরো সফরে তার এবং তার আত্মীয়-স্বজনদের মেহমানদারির অসামান্য প্রদর্শনী আমাদের সফরকে যে কী পরিমাণ সহজ ও আরামদায়ক করেছে; পাঠক সামনের বর্ণনাগুলোতে তা ছত্রে ছত্রে অনুভব করবেন।

গাড়ি এবার মূল গন্তব্য অভিমুখে চলতে শুরু করল। কিন্তু ঢাকা শহরের নিত্য যানজটের কবলে পড়ে কিছুটা মন্থর গতিতে। সূর্য তখন তেতে উঠেছে। গরমে কিছুটা হাঁসফাঁস লাগছিল। গাড়ির এয়ারকন্ডিশনারটা তেমন কাজ করছিল না। যাত্রাবাড়ি উড়াল সড়ক পেরোবার পর একটু স্বস্তি পেলাম। উড়াল সড়ক পার হয়ে কিছুদূর এগিয়ে একটা ফিলিং স্টেশনের সামনে আমরা থামলাম। নাশতা এখনো করা হয়নি। ফিলিং স্টেশন লাগোয়া ছোট্ট টিনের মসজিদে আমরা নাস্তা খেতে বসলাম। দস্তরখান বিছানো হল। মুরুব্বিরা আগে বসলেন। তারপর আমরা যে যার মত বসে পড়লাম। সবাইকে ওয়ান টাইম প্লেটে তেহারী দেয়া হল। মা’হাদের বাবুর্চি ইনআম ভাইয়ের দক্ষ হাতে রান্না করা তেহারী সবাই বেশ তৃপ্তিভরে খেলাম। এই খাবার মা’হাদ থেকে রান্না করে অপর গাড়িতে করে আনা হয়েছে। ইনআম ভাই রাত জেগে কষ্ট করে খাবার তৈরি করেছেন। আল্লাহ তাকে উত্তম বিনিময় দান করুন।

নাশতা শেষে সবাই আবার গাড়িতে উঠে পড়লাম। প্রশস্ত হাইওয়েতে গাড়ি এবার সবেগে ছুটতে লাগল। আমরা ছাত্ররা পরস্পরে কথাবার্তা আর খুনসুটিতে মেতে উঠলাম। নায়েব সাহেব হুযূরসহ অন্য মুরুব্বীরাও তাতে অংশ নিচ্ছিলেন। হুযূর মাঝে-মধ্যে এমন মজার মজার কথা বলছিলেন যে, আমরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছিলাম। অথচ এই মানুষটাই প্রয়োজনে এমন গম্ভীর হয়ে ওঠেন যে, বুকে কাঁপন ধরে যায়। এরই মধ্যে মাহমূদুল হাসান সাহেব (খুলনার হুযূর) গাড়ির প্লেয়ারের সাথে উনার ফোনটাকে কানেক্ট করে হামদ-নাত চালু করে দিলেন। পাকিস্তানের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ জুনায়েদ জামশেদ রহ. এর মোহনিয় কণ্ঠ গাড়িময় ছড়িয়ে পড়তেই এক আবেশ মাখা পরিবেশ তৈরি হল। কেউ চোখ বুজে মাথা দোলাচ্ছে, কেউ তাল ঠুকছে। আবার কেউ হেড়ে গলায় সূর মেলাচ্ছে। আমিও হারিয়ে গেছি এক তন্ময়তায়।

কুমিল্লার আলেখারচরে একটা ছোট্ট বিরতী হল। চালকদ্বয় চা পান করবেন। আমরাও নেমে হাত-পায়ের একটু খিল ছাড়িয়ে নিলাম। সেখান থেকে আরেকটু এগুতেই হাতের বাঁ পাশে নযরে পড়ল সারি সারি মিষ্টির দোকান। সবাই মাশাআল্লাহ মাতৃভাণ্ডারের মিষ্টি বিক্রি করছেন। পার্থক্য কেবল আদি, আসল, সুপার, ঐতিহ্যবাহী আর নিউ-তে।

দ্বিতীয় রাজধানী চট্টগ্রামে

কুমিল্লা ও ফেনীপেরিয়ে একসময় আমরা চট্টগ্রামে ঢুকে পড়লাম। পথের দুপাশে এবার ছোট-বড় পাহাড় চোখে পড়ল।আমরা দূরবীন দুটো দিয়ে পাহাড় দেখতে লাগলাম।

ঝাঁঝাঁলো দুপুর। যোহরের নামাযের সময় হয়ে গেছে। গাড়ি সীতাকুণ্ডের একটা ফিলিং স্টেশনে থামল। গাড়ি জ্বালানী সংগ্রহের অবসরে আমরা একে একে উযূ করে নামাযের জন্য প্রস্তুত হলাম। মুরুব্বীদের মধ্যে হযরত ইবরাহীম হাসান সাহেব দা.বা. ও হযরত আহমাদুল্লাহ সাহেব দা.বা. এর উযূ সম্পন্ন হয়েছে। দেখলাম এরই মধ্যে হযরতদ্বয় সুন্নাতে দাঁড়িয়ে গেছেন। ভাবলাম, আমলের মজা পেয়ে গেলে আর রুখসত-আযীমতের তোয়াক্কা থাকে না। এজন্যই তারা এমন বড় হতে পেরেছেন। আল্লাহ আমাদেরকে বড়দের পদাঙ্কানুসরণ করার তাওফীক দান করুন। নামায ঘর ছোট হওয়ায় দুই দফা জামাআত হল। এবার ফের ছোটার পালা। এই ফাঁকে আমরা ক’জন মিলে লাগোয়া দোকান থেকে ভাজা পোড়া আর কফি পেটে চালান করলাম।

নামায হয়ে গেছে। গাড়ি আবার চলতে লাগল। এবার দুপুরের খাবার খেতে হবে। মুদীর সাহেব এবং আমীরে সফর দা.বা. অপর গাড়িতে। তারাই ফিকির করছেন। কিন্তু সমস্যা হল, ঢাকা যেমন মসজিদের শহর; তেমনি চট্টগ্রাম যেন মাযারের শহর। তাই ভালো কোন রেস্তোরা যেমন আমরা চিনি না, আবার বড় কোন রেস্তোরার সামনে থামলে দেখা যায় ‘বাবার আশির্বাদ’ পুষ্ট! এরই মধ্যে অপর গাড়িটা চাকার লিক সারাতে একটা গ্যারেজে থামল। আমরাও থামলাম। আর মুদীর সাহেব গেলেন হোটেলের খোঁজে।

অপর গাড়ি থেকে হযরত আমীরে সফর এবং হযরত আহমাদুল্লাহ সাহেব দা.বা. আমাদের গাড়িতে এসে নায়েব সাহেব হুযূরের পাশে বসলেন। তারা কথাবার্তা বলছেন। রাস্তা দিয়ে রোগাক্রান্ত বীভৎস মুখের এক লোক হেঁটে যাচ্ছিল। আমীরে সফর দা.বা. লোকটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং পড়লেন, الحَمْدُ لِلَّهِ الَّذي عافانِي مِمَّا ابْتَلاكَ بِهِ وَفَضَّلَنِي على كَثِيرٍ مِمَّنْ خَلَقَ تَفضِيلاً আমরাও দেখি আর কেবল উঁহু-আহা করি। কিন্তু দু‘আ পড়ার কথা মনে পড়ে না। সুন্নাত কতটা মজ্জাগত হলে আমল এমন অনায়াস হয়ে যায়।

মুদীর সাহেব হুযূর ফিরে এসে জানালেন, ভালো একটা রেস্তোরা পাওয়া গিয়েছিল; কিন্তু বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘ইয়া খাজা গরীবে নেওয়াজ’। বাবার ‘মূত্র মোবারক(!)’ মেশানো খাবার খাওয়া থেকে উপোস থাকা ভালো। তবে জানা গেল, মাহমূদ বিন ইলিয়াস সাহেব হুযূর তার এক স্থানীয় বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। তিনি আমাদের ভালো কোন রেস্তোরার খোঁজ পাইয়ে দিবেন। যাক বাবা, একটা হিল্লে হল। নায়েব সাহেব হুযূর মন্তব্য করলেন, খুঁজতে খুঁজতে না আবার খালি পেটেই টেকনাফে চলে যাই! আর এই রকম একটা রেস্তোরা খোঁজার ঘটনা শোনালেন। আমরা হাসতে লাগলাম।

রাহবারের দিক-নির্দেশনায় অবশেষে গাড়ি থামল ‘জামান হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’ নামক একটা রেস্তোরায়। হোটেলটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। আমরা বসলাম একেবারে ভিতরের দিকে একটি নিরিবিলি কক্ষে। পরিবেশ-পরিবেশন বেশ ভালো। বেগুন ভর্তা আর রুই মাছ দিয়ে খাওয়া সেরে আল্লাহর শোকর আদায় করলাম। প্রচণ্ড ক্ষুধার পর এমন সুস্বাদু খাবার সত্যিই আল্লাহর বড় নিয়ামত। খাবার শেষে একজন ওয়েটার সবাইকে একটি করে মিষ্টি পান দিতে লাগল। আশেপাশে পানের উচ্চ প্রশংসা শুনে জীবনে তৃতীয় বারের মত পান খাওয়ার ‘এটেম্পট্’ নিলাম! কিন্তু দুই চিবুনি দিয়েই বেসিনের দিকে ছুটলাম। মুখ ধুয়ে অবশেষে শান্তি! এই ‘বস্তু’ চাখবার সাধ আর নেই!

খাওয়া দাওয়া শেসে গাড়ি ছুটল কক্সবাজার অভিমুখে। গাড়ি এখন কর্ণফুলি ব্রিজের উপর। বাঁ দিকে নদীর ওপারে বড় বড় কারখানা। আমার বড় বোন আনোয়ারায় থাকে। এই নদী পেরিয়েই যেতে হয়। ভাবলাম, আমার বোন কেমন আছে? দুষ্টু-মিষ্টু ছোট্ট উযায়েরই বা কী করছে? ভাবতে ভাবতেই গাড়ি ব্রিজ পেরিয়ে এলো। নায়েব সাহেব হুযূরকে দেখলাম আমার মতই দোকান-পাটের নাম পড়ছেনÑ গাউছে পাক ঝাল বিতান, ইবরাহীম কাঠের দোকান, আয়েজুল গদি ঘর। বেশ আমোদ পেলাম! এরই মধ্যে আসরের সময় হয়ে এসেছে। পটিয়া মাদরাসার সামান্য আগে একটি মসজিদ দেখে গাড়ি থামল। মসজিদের উত্তর দিকে বড় একটা পুকুর। চমৎকার শান বাঁধানো ঘাট। সবাই সেখানে উযূ করছে। আমিও দু পা গোড়ালী পর্যন্ত ডুবিয়ে উযূ সারলাম। শীতল পানির ছোঁয়ায় ক্লান্তি কেটে গেল অর্ধেক। দেখলাম পশ্চিম দিকেই মেহরাবের ওপাশেই কোন এক ‘বাবা’র মাযার। ডানে একটা বড় বোর্ডে বাবার দলে যোগদানের উদাত্ত আহ্বান। বাবার নামটা ঠিক উদ্ধার করতে পারলাম না।

নামায শেষে সবাই আবার গাড়িতে চাপলাম। পটিয়া মাদরাসার পাশ দিয়ে যাচ্ছি। ফেরার পথে এখানে আসার প্লান আছে। মাগরিবের নামায পড়লাম কেরাণীর হাট জামে মসজিদে। জানানো হয়েছিল, সন্ধ্যার আগে কক্সবাজার পৌঁছতে পারলে সৈকত দর্শন হবে। কিন্তু সে আশায় যে গুড়ে বালি তা বোঝাই যাচ্ছে। নামায শেষে আবার চলা শুরু। গজল চলছে যথারীতি। এরই মধ্যে কাউসার আর ইসমাঈল ভাই বরই বরই রব তুললেন। গাড়ি একেকটা বাজার পার হয়; আর তারা ‘এই বাজারের বরইগুলো ভালো ছিল!’ মন্তব্য করে। নায়েব সাহেব অবশেষে বলেই ফেললেন, এই! এদের বরই কিনতে দাওতো! তাই আরেকটা বাজার দেখে গাড়ি থামল। আর ওরা হাসি মুখে বরই নিয়ে ফিরলেন। সবাই মিলেই খেলাম। তবে দামটা সস্তা মনে হল না।

বাইরে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাঝে মধ্যে এক-দুটো আলো দেখা যায়। আর রাস্তায় চলমান গাড়ির আলো, ব্যস! তাই দেখারও নেই কিছু। ক্লান্তিতে সবারই চোখ ঢুলু ঢুলু। আমিসহ কয়েকজনের এক প্রস্থ ঘুমও হয়ে গেছে। গাড়ি ততক্ষণে কক্সবাজারের টেকনাফে। আচমকা আমীর ভাই পাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন, ঐ যে সমুদ্র! আমরা সবাই ডানপাশে তাকালাম। সাদা ফেনা মাথায় নিয়ে ঢেউগুলো তীরে আছড়ে পড়ছে। সমুদ্রের পানিতে ফসফরাস থাকে। তাই অন্ধকারেই দেখা যায়। আমি ‘অন্ধকার সত্ত্বেও ফেনা কীভাবে দেখা যাচ্ছে?’ এই প্রশ্ন করে রেযওয়ানকে বোকা বানালাম! পাহাড় কেটে বানানো রাস্তা। চড়াই উৎরাই পেরিয়ে গাড়ি ছুটছে। মাঝে মধ্যে রাস্তার পাশের সুউচ্চ পাহাড়ের অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে। আমাদের গন্তব্য এখন টেকনাফের নাজিরহাটে।

অবশেষে টেকনাফে

দীর্ঘ সফর শেষে আমরা যখন নাজিরহাটে পৌঁছলাম, রাত তখন এগারোটা। রাহবার মাওলানা শাহাদাতুল্লাহর ভায়েরা জাকির ভাইয়ের খালাতো ভাই এখানে আমাদের আতিথ্য দিচ্ছেন। ওর বাড়ি সংলগ্ন মসজিদে আমরা প্রথমে নামলাম। মসজিদের পাশে একটি নূরানী মাদরাসাও রয়েছে। আমি আমার ছোট্ট টর্চটা জ্বেলে নাম পড়ার চেষ্টা করলাম। ‘দারুল কুরআন আশরাফুল মাদারিস (ইসলামী নূরানী একাডেমী)’। সবাই উযূ-ইস্তিঞ্জা সেরে নিচ্ছেন। বিদ্যুৎ নেই। চারপাশে জমাট বাঁধা অন্ধকার। আকাশের দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম। পরিষ্কার তারা খচিত আকাশ এত মনোহর লাগল! ঢাকাতে যেমন দেখেছি, সেই তুলনায় তারাগুলো আরো বড় ও উজ্জ্বল! রাতের আকাশের কালো যমীনে শত-সহস্র তারা মুক্তোর দানার মত ঝকমক করছে। আল্লাহ তা‘আলা যেমন কুরআনে বলেছেন,

(অর্থ) আমি নিকটবর্তী আকাশকে নক্ষত্ররাজির সুষমা দ্বারা সুশোভিত করিয়াছি। (সূরা সফ্ফাত- ৬)

আমি আক্ষরিক অর্থেই হা করে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর কয়েকজনকে ডেকে দেখালাম। তারাও আকাশের এই নতুন রূপ স্বীকার করতে বাধ্য হল। আমি সেভেন সিস্টার’স বা সাত কন্যা খোঁজার চেষ্টা করলাম। কিন্তু অনভ্যাসে বিদ্যা হ্রাস! তাই খুঁজে পেলাম না।

নামায শেষে আমরা মেযবানের বাড়িতে চলে এলাম। ঢুকতেই বিরাট বড় বসার ঘর। আমরা খাবার খেতে বসে পড়লাম। উস্তাদগণ সবাই সারিবেঁধে বসলেন। আর আমরা চার/পাঁচজন করে গোল হয়ে একসঙ্গে বসলাম। প্রথমেই এলো উড়ুক্কু মাছ। বইতে কত পড়েছি এই মাছের কথা। জেলেরা গভীর সমুদ্র থেকে এগুলো ধরে থাকে। এগুলোর দৈর্ঘ্য দশ থেকে ত্রিশ সে.মি. পর্যন্ত হয়। বাতাসের প্রবাহ বা ঢেউয়ের অবস্থার উপর নির্ভর করে উড়ুক্কু মাছ ত্রিশ সেকেন্ডের মত উড়তে পারে। সুগঠিত পাখনাওয়ালা এসব মাছের কোন কোনটা পানির উপরিভাগ থেকে দশ মিটার উচ্চতায় প্রায় চারশ মিটার পর্যন্ত যেতে পারে। তারপর এলো সবজি, শুঁটকি, উড়ুক্কু মাছের তরকারি আর মাইট্টা মাছ। এই মাছের স্বাদ অনেকটা সুরমা মাছের মত। তাজা সামুদ্রিক মাছ দিয়ে বেশ ভালো একটা ভূরিভোজ হল। রাত অনেক গড়িয়েছে। সকালে উঠেই আবার নারিকেল জিঞ্জিরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে হবে। তাই দেরি না করে আমরা শুয়ে পড়তে লাগলাম। মেযবান তার মাস্তুরাত অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়ে পুরো বাসা আমাদের জন্য ফ্রি করে দিয়েছেন। দুটো বেডরুমে উস্তাদদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর আমরা বাকিরা আরেক বেডরুম আর বৈঠকখানা দখল করলাম। পর্যাপ্ত চাদর, বালিশ আর কম্বলের ব্যবস্থা রয়েছে। সবাই যে যার মত চাদর বিছিয়ে কম্বল নিয়ে শুয়ে পড়ছে। ততক্ষণে বিদ্যুৎ এসে পড়েছে। আমি বৈঠকখানার মাদুরের ওপর মাথার নিচে একটা কোল বালিশ দিয়ে কম্বল টেনে শুয়ে পড়লাম। ক্লান্ত শরীর। সফর নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম; বুঝতে পারলাম না।

আযান শুনে ঘুম ভাঙল। মসজিদে গিয়ে জামাআতের সাথে নামায আদায় করলাম। নামায শেষে মেযবানের বাড়িতে এলাম। গাছপালা ঘেরা অল্প বসতির নিরিবিলি পরিবেশটা চমৎকার লাগছে। ঢাকায় শীত এমনিতেই প্রায় শেষ। আর শুনেছিলাম, সমুদ্র উপকূলে শীত আরো কম থাকেÑ তাই দেখলাম। সফর জুড়ে জ্যাকেট, আলোয়ান অমনিই পড়ে ছিল।

বাসায় ফিরে বৈঠকখানায় সবাই একত্র হলাম। একে একে নায়েব সাহবে, ইবরাহীম হাসান সাহেব ও মুদীর সাহেব হুযূর দিকনির্দেশনা মূলক কথা বললেন এবং গুরুত্বপূর্ণ নসীহত করলেন। বললেন,

সফরে কষ্ট হতে পারে, এজন্য সবর করতে হবে। আমার কারণে যেন অন্যের কষ্ট না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। দৃষ্টির হেফাযত করতে হবে। সবকিছু ইবরতের (শিক্ষা গ্রহণের) দৃষ্টিতে দেখতে হবে। চলাফেরায় মানুষের সঙ্গে সাক্ষাত হলে দাওয়াতও দিয়ে দেয়া, যেন এই ইলমী সফরটা দাওয়াতী সফরও হয়ে যায়।

তারপর আমাদের তৈরি হয়ে নিতে বললেন। দ্রুত গিয়ে জাহাজ ধরতে হবে। তাই আমরা তক্ষণি বেরিয়ে পড়লাম। এবার মাদরাসায় ছোট্ট শিশুদের মুখর আনাগোনা চোখে পড়ল। ওদের এখন নাশতার সময় চলছে। মাদরাসার সামনেই আরো কিছু শিশু বুট, মুড়ি, পিঠা ইত্যাদির পসরা সাজিয়ে বসে আছে। আর মকতবে আগত শিশুরা তা কিনে খাচ্ছে। যেমন ক্রেতা তেমন বিক্রেতা। এ যেন বেগুনতলার হাট।

নূরানী মাদরাসার এমন নূরানী পরিবেশ দেখে মনটা ভরে উঠল। মনে মনে দু‘আ করলাম, আল্লাহ তা‘আলা যেন সবাইকে ভালো আলেম বানান। আমাদের উস্তাদগণ মাদরাসার খোঁজ-খবর নিলেনÑ দু‘আ দিলেন। মুদীর সাহেব কয়েক কপি বাতায়ন, রাবেতা ও মা’হাদের একাডেমিক ক্যালেন্ডার শিক্ষকদের হাদিয়া হিসেবে দিলেন।

গাড়িতে সবাই উঠছে। যাকারিয়া গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়েই নায়েব সাহেব হুযূরকে বলতে লাগল, বিয়ের পর নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে এখানে আবার আসব। বড় হুযূর সিটে বসা ছিলেন। কথা শুনে ঝট্ করে দরজা খুলে ওর পায়ের দিকে তাকালেন! নায়েব সাহেব হুযূর বললেন, কী হয়েছে!? বড় হুযূর জবাব দিলেন, না, মানে কার পায়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাই দেখছিলাম!

আমরা গাড়িতে চড়ে বসলাম। এখন আমাদের গন্তব্য নাফ নদীর কেয়ারী ঘাট। সেখান থেকে জাহাজে চেপে নারিকেল জিঞ্জিরা। নাশতা এখনো করা হয়নি। টেকনাফ পৌরসভার একটা হোটেলের সামনে গাড়ি থামল। নাম ‘হোটেল ঢাকা কস্তুরী’। অদ্ভূত নামের এই হোটেলের পরিবেশ প্রীতিকর না হলেও খাবারের মান ভালো। রুটি, পরোটা, ডাল, ভাজি আর ডিম ভাজা দিয়ে যে যার পছন্দ মত নাশতা সেরে নিলাম। সবশেষে ধূমায়িত চা’র পেয়ালায় চুমুক দিয়ে শরীরটা যেন চাঙ্গা হয়ে উঠল। হোটেলের বাইরে বেরোতেই ভাগ্যাহত রোহিঙ্গাদের নযরে পড়ল। পূর্ণ পর্দাবৃত এক মহিলা রাস্তার পাশে বসে অঝোরে কাঁদছেন। কোলে ছোট্ট একটা বাচ্চা! আমরা সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু করার চেষ্টা করলাম। ইবরাহীম হাসান সাহেব হুযূর মহিলাটির হাতে পাঁচশ টাকা গুঁজে দিলেন। আরো কিছু রোহিঙ্গা নর-নারী দেখা গেল। চোখে-মুখে অনিশ্চয়তা আর অসহায়ত্বের ছাপ নিয়ে ইতি-উতি ঘুরছেন। একটি ছেলেকে দেখলাম। টুপি মাথায়। ছোট ছোট দাড়ি। খালি পা। উস্কুখুস্কু পোশাকে নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করা হল, কী করো? মাদরাসায় কাফিয়া জামাআতে পড়িÑ সে উত্তর দিল। ওর স্যান্ডেল জোড়াও চুরি হয়ে গেছে। তাকেও ইবরাহীম হাসান সাহেব হুযূর কিছু টাকা দিলেন। এমনি আরো কয়েকজনকে হুযূর সাহায্য করলেন।

গাড়িতে উঠলাম। রাতের অদেখা পাহাড়ী রাস্তা এখন দেখছি মুগ্ধ হয়ে। রাস্তাটি পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে গেছে। রাস্তার ডান পাশে বহু নিচে নাফ নদীর তীর। ডান দিকটা সরকার কর্তৃক নিরাপত্তা বেষ্টনী দেয়া। কারণ এখান থেকে কোন গাড়ি যদি নিচে পড়ে যায় তাহলে একেবারে ছত্রখান হয়ে যাবে!

গাড়ি চলছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম কেয়ারী ঘাট। মেযবানের ছোট ভাই জামাল রাহবার হিসেবে আমাদের সঙ্গে এসেছেন। তিনি টিকেট কনফার্ম করতে গেলেন। আমরা এদিক সেদিক ঘোরাফেরা করতে লাগলাম। এখানেও কিছু রোহিঙ্গাদের দেখতে পাওয়া গেল। কয়েকজন অশ্রু সজল চোখে হাত বাড়াল। হুযূর এবারো স্বভাব সূলভ দান করে যেতে লাগলেন।

জাহাজ ছাড়ার সময় এখনো হয়নি। আমরা দূরবীন দিয়ে দূর থেকে জাহাজটা দেখার চেষ্টা করলাম। অন্যান্য জাহাজের তুলনায় ছোট দু’তলা বিশিষ্ট এ জাহাজটার নাম ‘বে ক্রুজ ইন্টারন্যাশনাল’। ছাড়বে সাড়ে ন’টায়। এ সময়টা আমরা ঘুরে ফিরে সেখানকার পরিবেশ দেখছিলাম। হযরত ইবরাহীম হাসান সাহেব ও ইবরাহীম হেলাল সাহেব একটা ছোট বেঞ্চে বসে কথাবার্তা বলছেন। অন্যান্য হুযূর এবং কয়েকজন ছাত্র হুযূরদের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নায়েব সাহেব হুযূর মজা করে বললেন, ইবরাহীমানে জালিসানে। হুযূর খুবই মজার মানুষ।

সকাল নয়টা। আমরা ধীরে ধীরে জাহাজের দিকে এগুলাম। জাহাজটা আড়াইটার দিকে আবার টেকনাফ ফিরবে। কিন্তু আমরা পরদিন ফিরব। জাহাজটার আশপাশে প্রচুর গাঙচিল দেখা গেল। গাঙচিলের প্রধান খাদ্য মাছ, পোকা-মাকড়, ডিম, বিভিন্ন লতা। শুকনো শেওলা দিয়ে পাথরের খাঁজে বাসা বাঁধে এবং তাতে দুটো বা তিনটে ডিম পাড়ে। এদের বহু প্রজাতি আছে। সে সবের অধিকাংশই পরিযায়ী। আমরা জাহাজে উঠে পড়লাম। উস্তাদদের জন্য প্রথমতলার এসি চেয়ার কোচের টিকেট কাটা হয়েছে। জাহাজের উপর তলাতেও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আসন ব্যবস্থা রয়েছে। সেটার সামনে কন্ট্রোল রুম। আমরা গাট্টি-বোচকা নিচে রেখে সিঁড়ি বেয়ে জাহাজের টপ-এ উঠে এলাম। রোদ ততক্ষণে কিছুটা চড়েছে। শরীরে রোদের মৃদু আঁচ অনুভব করছি। সামনেই আরেকটা জাহাজ দেখা গেলÑ ‘কেয়ারী সিন্দাবাদ’। বইপত্রে বহু পড়েছি এই জাহাজের নাম। ফেরীর মত চওড়া চৌক মতন দোতলা জাহাজটা আমাদের পরে ছাড়বে। পেছনেও বিরাট আরেকটা জাহাজ। নাম ‘কুতুবদিয়া’। আরো কয়েকটা জাহাজ দেখতে পেলাম। কিন্তু নাম পড়তে পারলাম না। আমি তখন গাঙচিল দেখতে ব্যস্ত। ঠোঁটসহ মুখের সামনের অংশে কালো ছোপ। দু-ডানার ডগা আর পুচ্ছও তাই। দেখতে ভারি সুন্দর! ঝাঁক বেঁধে উড়ছে, আবার কখনো ডানা গুটিয়ে পানিতে ভাসছে। আল্লাহ কী চমৎকারই না বলেছেন,

(অর্থ) উহারা কি লক্ষ্য করে না উহাদের ঊর্ধ্বদেশে বিহঙ্গকুলের প্রতি, যাহারা পক্ষ বিস্তার করে ও সঙ্কুচিত করে? দয়াময় আল্লাহই উহাদিগকে স্থির রাখেন। তিনি সর্ববিষয়ে সম্যক দ্রষ্টা। (সূরা মুলক- ১৯)

জাহাজ চলতে শুরু করল। কোন লঞ্চ বা জাহাজে চড়ার এটাই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখছি মুগ্ধ হয়ে। সঙ্গের দূরবীন দু’টি সবার হাতে হাতে ফিরছে। গাঙচিলগুলো তখনো আমাদের জাহাজ ঘিরে উড়ছে। দেখলাম এক ভদ্রলোক গাঙচিলগুলোকে চিপ্স খাওয়াচ্ছেন। চিপ্স পেল কোথায়! অমনি একটি ছোকড়া থলে ভর্তি চিপস হাতে পাখির খাবার! পাখির খাবার! বলে চেঁচাতে লাগল। দশ টাকার চিপস বিশ টাকা আক্কেল সেলামী দিয়ে কিনলাম। ততক্ষণে পাখিদের খাওয়ানোর জন্য আরো অনেক লোক জুটে গেছে। একটা ক্র্যাকার ছুড়তেই ঝাঁকের একটা পাখি কপ করে ঠোঁটে চেপে ধরে পেটে চালান করে দিল। আমি তখন উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছি আর অনবরত ক্র্যাকার ছুড়ছি। গাঙচিলগুলো যেন দুর্দান্ত জিমন্যাস্টিক শো দেখিয়ে চলছে! ক্র্যাকার উপরে ছুড়লে পাখিগুলো অনায়াস দক্ষতায় সাঁই করে ওপরে উঠে ধরে ফেলছে। নিচে ছুড়লে ডাইভ দিয়ে নিচে নেমে ধরছে। আর মিস হলে ঝাঁকের পেছনের পাখিগুলো সেটার ‘ব্যবস্থা’ করছে। উত্তেজনায় হুঁশ ছিল না। তাই চিপস দ্রুতই ফুরিয়ে যেতে লাগল। আমি এবার আনন্দ জমিয়ে রাখার জন্য খাওয়ানো বন্ধ রাখলাম। আর অন্যদেরটা দেখতে লাগলাম।

দাড়ি-টুপিওয়ালা ছোট-খাটো এক ভদ্রলোক বেশ আগ্রহ নিয়ে আমাদের কীর্তিকলাপ দেখছেন। আমি খাওয়ানো বন্ধ করতেই তিনি এক প্যাকেট চিপস কিনলেন। আমি এবার তার খাওয়ানো দেখার জন্য ঘুরে দাঁড়ালাম। কিন্তু তিনি প্যাকেট থেকে এক মুঠো চিপস দিব্যি মুখে পুরে নির্বিকার ভঙ্গিতে হেঁটে চলে গেলেন! দৃশ্য উপভোগ করতে দিলেন না। যেন তিনি এতক্ষণ আমার দেয়া চিপস খেয়ে এখন আমাকে চিপস না দিয়েই চলে গেলেন। একটু পরই আমার চিপস শেষ হয়ে গেল। আরেক প্যাকেট কেনার জন্য ছোকড়াটাকে খুঁজলাম। ছোকড়া তখন সব চিপস বেচে মোটা লাভ বাগিয়ে মনের সুখে সূর ভাঁজছে! বিষয়টি আগে থেকে জানা না থাকায় আফসোস হল। না হলে কিছু চিপস নিয়েই জাহাজে চড়া যেত। হাদীসে আছে না, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

(অর্থ) সকল সৃষ্টি আল্লাহর পরিবারভুক্ত। আল্লাহর কাছে সেই প্রিয়, যে আল্লাহর পরিবারের সঙ্গে উত্তম আচরণ করে। (মাজমাউয যাওয়াইদ; হা.নং ১৩৭০৬)

তাই অল্প ক’টা টাকায় যদি আল্লাহর অন্তত কিছুটা প্রিয়পাত্র হওয়া যায়, তবে তো বেশ ভালো!

মুদীর সাহেব হুযূর জানালেন, গাঙচিলগুলোকে খাওয়াতে থাকলে এগুলো নাকি দ্বীপ পর্যন্ত সাথে সাথে উড়ে চলে। গাঙচিলগুলো খাবারের আশায় আরো কিছুক্ষণ সঙ্গে উড়ল। এরপর খাবার না পেয়ে ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেল। আল্লাহর কী কুদরত! এদের প্রধান খাদ্য মাছ, পোকা-মাকড় ইত্যাদি। অথচ আজ ওরা খেল চিপস। তাও একেবারে নিশ্চিন্তে মানুষের টাকায়! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

(অর্থ) তোমরা যদি আল্লার উপর যথাযথ তাওয়াক্কুল করতে তবে তোমরাও পাখিরা যেমন রিযিক প্রাপ্ত হয়, তেমনি রিযিক পেতে। পাখিরা সকালে খালি পেটে বের হয় আর সন্ধ্যায় ফেরে ভরা পেটে। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ২৩৪৪)

আল্লাহ আমাদের তাওয়াক্কুলের দৌলত নসীব করুন। আমীন।

আমরা তখনো নাফ নদীতে। পানি পরিষ্কার তবে টলটলে নয়। কিন্তু স্থির। দূরে মিয়ানমার সীমান্ত। সর্পিলাকারে এই নদীর দৈর্ঘ্য তেষট্টি কিলোমিটার। গড় প্রস্থ তেরোশ চৌষট্টি মিটার। আরাকান পাহাড় থেকে মিষ্টি পানি এসে মিশলেও সাগরের পানির আধিক্যের কারণে পুরো নদীটাই লবণাক্ত। ফলে মিষ্টি পানির মাছ এখানে পাওয়া যায় না।

রোদের আঁচ আরো বেড়েছে। তাই কিছুটা ক্লান্ত হয়েই নিচে নেমে এলাম। চেয়ারগুলো অধিকাংশই খালি পড়ে আছে। যেহেতু পর্যটন মৌসুম নয়, তাই বোধ হয় খালি। পেছনের একটা চেয়ার দখল করলাম। এসির ঠাণ্ডা বাতাসে শরীর জুড়িয়ে এলো। বসে বসে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছি। পেছনের একটা জাহাজ দেখি আমাদের প্রায় ধরে ফেলেছে। দূরবীন লাগিয়ে দেখি ওটা কুতুবদিয়া। আমাদের জাহাজটা নাকি দ্রুতগামী; তাই এই জাহাজের টিকেট সংগ্রহ করা হয়েছিল। অথচ বে ক্রুজের চেয়ে দ্বিগুণ বড় কুতুবদিয়া চোখের সামনে দিয়ে ড্যাং ড্যাং করে আগে চলে গেল! কিছুক্ষণ পর দেখি কেয়ারী সিন্দাবাদও আমাদেরকে পেছনে ফেলল! এই বুঝি দ্রুতগামীতার নমুনা।

আমি ভাবছি অন্য কথা। এত বড় বড় জাহাজ! কী স্বচ্ছন্দেই না পানিতে চলছে। এসব কেবলই আল্লাহর নিদর্শন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(অর্থ) তাহার অন্যতম নিদর্শন পর্বতসদৃশ সমুদ্রে চলমান নৌযানসমূহ। (সূরা শূরা- ৩২)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে তো আর এত বড় জাহাজ ছিল না। কিন্তু এখনকার জাহাজগুলো আসলেই পর্বতসদৃশ। তই বর্তমান সময়েই এই আয়াত যেন ভালো বুঝে আসে।

এদিকে এরই মধ্যে রেযওয়ান, কাউসার আর যাকারিয়াও সাথে এসে বসেছে। আমরা বসে গল্প-গুজব করতে লাগলাম। এই ফাঁকে ক্যান্টিন থেকে আমি আর রেজওয়ান দু পেয়ালা কফিও খেলাম। এবার দেখি আবূ তলহা মিষ্টি নিয়ে হাযির। টেকনাফের মেযবান রাতেই খাওয়াতে চেয়েছিলেন। তা সম্ভব না হওয়ায় সঙ্গে দিয়ে দিয়েছেন। পুরো সফর জুড়ে রাহবার শাহাদাতুল্লাহ ভাইয়ের শ্বশুর পক্ষীয় এইসব আত্মীয়দের অসামান্য আতিথেয়তা আমাদের সবার হৃদয় খুব করে ছুঁয়ে গেছে।

নাফ নদী পেরিয়ে আমরা এবার সাগরে। বাম পাশে দীগন্তের শেষ সীমা পর্যন্ত নীলচে পানির ঢেউ। জাহাজ এদিক ওদিক দুলছে। আমাদের গন্তব্য ঘনিয়ে এসেছে। মুদীর সাহেব হুযূর ট্যাব থেকে সমুদ্র বিষয়ক কুরআনের সব আয়াত বের করে কুমিল্লার হুযূরকে তিলাওয়াত করে শুনাতে বললেন। আমরা সবাই মিলে তন্ময় হয়ে শুনছি। হাজার বছর পরও আল্লাহর কালাম এতো বাস্তব! এতো জীবন্ত!! এতো মর্মস্পর্শী!!! হবে নাই বা কেন! এযে মহামহিম খোদার বাণী। মুদীর সাহেব হুযূর অনেক বছর আগে এই দ্বীপে চিল্লার সফরে এসেছিলেন। দ্বীপের লোকেরা নাকি সমুদ্র বিষয়ক এসব আয়াত শুনে বিস্ময়বোধ করত। আয়াতগুলো এমনই জীবনঘনিষ্ট যে, তাদের অবাক না হয়ে সত্যিই উপায় নেই।

স্বপ্নের নারিকেল জিজ্ঞিরা

এমন সময় যান্ত্রিক কণ্ঠে নারিকেল জিঞ্জিরায় পৌঁছে যাওয়ার ঘোষণা শোনা গেল। আমরা হুড়মুড় করে আবার টপ-এ উঠে এলাম। ঐতো নারিকেল জিঞ্জিরা! চারদিক সুনীল সাগর ঘিরে থাকা ছোট্ট, সুন্দর দ্বীপ। আমি চেয়েই রইলাম নির্নিমেষ। বহু দিনের স্বপ্ন যে এভাবে ধরা দেবে, তা ভাবিনি কখনো। দ্রুতগামী (!) বে ক্রুজ অবশেষে দু ঘণ্টা জার্নির পর সবার পরে জেটিতে নোঙর করল। দুটো জাহাজ ডিঙ্গিয়ে বহু হ্যাপা পেরিয়ে আমরা জেটিতে সবাই একত্র হলাম। তারপর দ্বীপ অভিমুখে হাঁটতে শুরু করলাম। জেটি বরাবর সোজা পশ্চিম দিকটা হচ্ছে দোকান-পাট আর রিসোর্টে সরগরম। কিন্তু আমাদের রিসোর্ট ও মেযবানের বাড়ি দক্ষিণ দিকে হওয়ায় আমাদের দক্ষিণ দিকে যেতে হবে। নারিকেল জিঞ্জিরায় আমাদের মেযবান হলেন রাহবার শাহাদাতুল্লাহ ভাইয়ের ভায়রার বোন জামাইÑ জুবায়ের ভাই। কিন্তু তিনি তাবলীগের সফরে চট্টগ্রামে থাকায় তার ভাই মাওলানা আলম এবং শাহাদাত ভাইয়ের ভায়েরা মাওলানা জাকির ভাই আমাদের স্বাগত জানালেন। জাকির আমাদের বন্দোবস্ত করার জন্য আগেই টেকনাফ থেকে এখানে চলে এসেছেন।

জেটি থেকে অবশেষে নারিকেল জিঞ্জিরার মাটি থুড়ি প্রবালে পা রাখলাম। কারণ এটি বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। আরবের কিছু নাবিক আড়াইশ বছর আগে এই দ্বীপ আবিস্কার করে। আরবী ভাষায় দ্বীপকে জাযিরা বলা হয়। আর এখানকার অধিবাসীরা সম্ভবত পানির কষ্ট করতে এবং ক্লান্তি দূরিকরণের লক্ষ্যে প্রচূর পরিমাণে নারিকেল গাছ লাগায়। এই ‘জাযিরা’ কালক্রমে বিকৃত হয়ে ‘জিঞ্জিরা’ হয়ে দুয়ে মিলে হয় ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’। এরপর ঊনিশ শতকের দিকে ব্রিটিশ ভূ-জরীপ দল জরীপে স্থানীয় নাম পাল্টে জনৈক খ্রিস্টান সাধুর নাম অনুযায়ী এর নামকরণ করে ‘সেন্টমার্টিন’। এই নাম বাইরের লোকদের কাছে পরিচিতি লাভ করলেও স্থানীয়রা এখনো ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’ নামেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করে এবং সেন্ট মার্টিন নামকে নিজেদের উপর চাপিয়ে দেযঅ হয়েছে বলে মনে করে।

দ্বীপটির আয়তন প্রায় ৮ বর্গ কিলোমিটার। উত্তর দক্ষিণে লম্বা। এ দ্বীপের তিন দিকের ভিত শিলা যা জোয়ারের সময় তলিয়ে যায় এবং ভাটার সময় জেগে ওঠে। এগুলোকে ধরলে এর আয়তন হবে প্রায় ১০-১৫ কিলোমিটার। এ দ্বীপটি উত্তর ও দক্ষিণে প্রায় ৫.৬৩ কিলোমিটার লম্বা। দ্বীপের প্রস্থ কোথাও ৭০০ মিটার আবার কোথাও ২০০ মিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের গড় উচ্চতা ৩.৬ মিটার। এর পশ্চিম এবং উত্তর-পশ্চিম দিক জুড়ে রয়েছে প্রায় ১০-১৫ কিলোমিটার প্রবাল প্রাচীর।

কিছুদূর হেঁটে আমরা ‘দি লাইট হাউজ রিসোর্ট’ এ উঠলাম। মুহতারাম উস্তাদদের জন্য একটা কটেজ ঠিক করা হয়েছে। দুই রুমের এই কটেজের নাম অপরাজিতা। প্রতি রুমে দুটো করে বিছানা। উস্তাদগণ এক রুমে ঢুকলেন। আমরা আপাতত আরেক রুমে ঢুকে গাট্টি-বোচকা রেখে বসলাম।

গাছপালা ছাওয়া বড়সড় জায়গা নিয়ে রিসোর্টটা বানানো। আমাদের মেযবানের বাড়ি এই রিসোর্ট লাগোয়া। তিনি খাবার-দাবারের ইন্তিযাম এখানেই করেছেন। আর আমরা ছাত্ররা রাতে মেযবানের বাড়িতেই থাকব। আমাদের কটেজের পাশেই একটা হ্যামক তথা দড়ি দিয়ে বানানো বিছানা দেখলাম। হ্যামকের দু’মাথা দুটো গাছের সঙ্গে বাঁধা। কটেজের সামনেও আরেকটা হ্যামক আছে। আমি পাশের হ্যামকটা খালি পেয়েই শুয়ে পড়লাম। আর দ্বিতীয় বর্ষের মাসুম কামাল ভাই এসে বিষম জোরে দোল খাওয়াতে লাগলেন। কিছুক্ষণ বেশ করে দোল খেয়ে এই হ্যামক অন্যদের জন্য ছেড়ে দিয়ে সামনের হ্যামকটায় শুলাম। হ্যামক আস্তে আস্তে দুলছে। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি। শরীরের সব কান্তি যেন দূর হয়ে যাচ্ছে। এমন সময় মুরশিদ ভাই ডেকে বললেন, উসামা ভাই! ইবরাহীম হাসান সাহেব হুযূর আমাদের সবাইকে হাদিয়া দিয়েছেন। বলেন তো কী? আমি বললাম, বলতে পারছি না। আপনি বলুন! বললেন, হুযূর আমাদের সবাইকে পাঁচশ টাকা করে হাদিয়া দিয়েছেন। ধ্যাৎ, এটা তো আমার আঁচ করতে পারার কথা। কারণ, মা’হাদের ইলমী সফরে ছাত্রদেরকে হুযূরের হাদিয়া দেয়া প্রায় ঐতিহ্যের পর্যায়ে চলে গেছে। আমি তক্ষুণি গিয়ে হাদিয়া বুঝে নিলাম।

যোহরের নামাযের সময় হয়ে গেছে। রিসোর্টের পাশের কোস্টগার্ড কার্যালয়ের মসজিদে নামায আদায় করলাম। এখন আমাদের সামনের প্ল্যান হল, খাবার খাওয়া। এরপর আড়াইটার দিকে ছেঁড়া দ্বীপ দেখতে যাওয়া। খাবার খেতে আমরা সবাই মেযবানের বাড়ি চলে এলাম। বাসার সামনের লম্বা বারান্দায় আয়োজন করা হয়েছে। শাহাদাত ভাইয়ের ভায়েরা জাকির ভাই তদারকি করছেন। উড়ুক্কু, কোরাল, বোল ইত্যাকার কয়েক পদের তাজা সামুদ্রিক মাছ দিয়ে পেট পুরে খেলাম; আলহামদুলিল্লাহ।

আড়াইটা এখনো বাজেনি। এই ফাঁকে আমরা সমুদ্র স্নানে বের হলাম। মুদীর সাহেব হুযূর বললেন, ছেড়া দ্বীপে যেতে হলে আড়াইটার মধ্যে সবার ফিরে আসতে হবে। কিন্তু বের হওয়ার সময় শুনি সহপাঠী রেজওয়ান ওর দূরবীন জাহাজে ফেলে এসেছে। সবাই চলে গেল গোসল করতে আর মুদীর সাহেব হুযূরকে বলে আমরা দূরবীন উদ্ধারে গেলাম। আড়াইটা বাজেনি। তাই জাহাজ আছে। আর দূরবীনটাও পাওয়া গেল। দূরবীন নিয়ে এবার আমরা সোজা পশ্চিম দিকে হাঁটা শুরু করলাম। একটু পর পর রিসোর্ট, হরেক রকম পণ্যের দোকান-পাট আর পর্যটকে জমজমাট চারপাশ। সমুদ্র কাছেই। তাড়াতাড়ি বাকিদের ধরতে বাহন নেয়ার কথা ভাবছি। পাশেই দেখলাম সাইকেল ভাড়া দিচ্ছে। এক ঘণ্টা ত্রিশ টাকা। হঠাৎ দেখি আবূ তলহা আর আশরাফ ভাই ভ্যানে চড়ে যাচ্ছে। এক লাফে উঠে পড়লাম। জিজ্ঞেস করলাম, ভাড়া কত করে? আশরাফ ভাই বিরস মুখে বললেন, জনপ্রতি পঞ্চাশ টাকা! শুনে আরেক লাফ দিয়ে নেমে পড়লাম। সাইকেল ভাড়া করতে গিয়ে দেখি, এই ব্যাটার সব সাইকেল ভাড়া হয়ে গেছে। এখন ওর পাশের ব্যাটা ভাড়া দিচ্ছে ঘণ্টা চল্লিশ টাকা করে। ব্যবসায়ী বটে! দু’জনে দুটো সাইকেল নিয়ে দ্রুত এগুলাম। আশরাফ ভাই আর আবূ তলহার ভ্যান পেছনে ফেলে কিছুক্ষণের মধ্যেই সৈকতে পৌঁছে গেলাম। সৈকতে প্রবেশের সাথেই দেখি মুদীর সাহেব সহ রাহমানিয়ার উস্তাদত্রয় দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের দেখে নায়েব সাহেব হুযূর মুখে সস্নেহ হাসি টেনে বললেন, ওই দেখ দুই বাঁদর! মুদীর সাহেব বললেন, যাও, গোসল সেরে দ্রুত এসো। হুযূররা সেখানেই থাকলেন। বাকি সবাই একটু দূরে।

গিয়ে দেখি প্রায় সবাই সমুদ্রে নেমে পড়েছে। ওয়াশপুরের দুই উস্তাদ হযরতকে দেখলাম তারাও নেমে পড়েছেন। খুলনার হুযূর এক তোড়া টাকা আর মোবাইল ফোন আমার হেফাযতে দিয়ে গেলেন। আর বললেন, প্রাণীর ছবি বাদ দিয়ে পারলে ছবি তোলো। তীরে রইলাম কেবল আমি, আশরাফ ভাই আর হাবীবুল্লাহ ভাই। সাঁতার যদ্দূর জানি তাতে গোসল করা যেত। কিন্তু শারীরিক সমস্যার কারণে না নেমে ভোঁতা মুখে পা ভেজাচ্ছি। দুধের স্বাদ ঘোলে যতটুকু মেটানো যায় আর কি! আশরাফ ভাই আর হাবীব ভাইও সাঁতার পারেন। আশরাফ ভাই নামেননি বাবার নিষেধের কারণে। আর হাবীব ভাই নামেননি ভয়ে! সবাই হেঁটে একটু গভীর পানিতে গিয়ে গোসল করছে। সাঁতার কাটছে। শুনেছি সমুদ্রের পানি নাকি ভীষণ লবণাক্ত হয়। তাই একটু চেখে দেখলামÑ অসম্ভব রকম নোনা। মুখে নেয়াই দায়। তীরে দেখলাম ইসমাঈল ভাই একা একা হাঁটছেন। তিনিও ভয়ে নামেননি। এবার আমিও তীরে উঠে এলাম। তারপর দু’জনে সাইকেলে করে ডাবের পানি খেয়ে এলাম।

আড়াইটা পার হতে চলেছে। কিন্তু কারো ওঠার নাম নেই। মুদীর সাহেব তাগাদা দিয়ে সবাইকে ওঠালেন। আসার পর দেখলাম কারো হাত কেটে গেছে, কারো পা কেটে গেছে। ধারালো প্রবালে এই অবস্থা। সৈকতের এই দিকটা জনশূন্য থাকার মাজেজাটা এবার বোঝা গেল। তবে গুনাহ হওয়া থেকে হাত-পা কাটা ভালো নিশ্চয়!

রিসোর্টে ফেরার সময় সৈকতের দোকানগুলোর জিনিসপত্রের দাম আমরা একটু যাচাই করে নিলাম। তারপর সবাই দ্রুত পা চালালাম রিসোর্টের দিকে। আমরা সবাই রিসোর্টের দিকে যাচ্ছি। দ্বিতীয় বর্ষের রাকিব ভাই জানালেন, সৈকত থেকে বের হওয়ার মুখে যে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা শামুকের বিভিন্ন স্যুভেনির নিয়ে বসে ছিল, ওরা আমাদের দেখে মুখের ভাষা যথাসম্ভব বোধগম্য করে সেই সঙ্গে হাতের ইশারায় যা বলল, তার মর্মার্থ হচ্ছে হুযূর! আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে দু‘আ করবেন। রাকিব ভাই অবাক যেমন হয়েছেন, ভালোও লেগেছে। আমরাও। তবে নারিকেল জিঞ্জিরায় দীনের প্রতি দ্বীপবাসীর অনুরাগ বহু আগ থেকেই আমি শুনে এসেছি। এখন পর্যন্ত স্থানীয় কোন নারীকে আমরা বেপর্দা দেখিনি। যারা সমুদ্রে গোসল করেছেন তারা রিসোর্টে এসে আবার গোসল সেরে নিলেন। এই ফাঁকে আমি হ্যামকে শুয়ে দোল খেতে লাগলাম। তারপর সবাই প্রস্তুত হয়ে বের হলাম।

ছেঁড়া দ্বীপের রোমাঞ্চ!

রিসোর্টের সামনেই ট্রলার নোঙর করা। ফিশিং ট্রলার। এফ.বি. জুনায়েদ। এটা আমাদের মেযবানের ট্রলার। সারেং মেযবানেরই আরেক ভাই। তার সঙ্গে আরো দুই সহকারী রয়েছে। আমি সবার আগে পানি ডিঙিয়ে ট্রলারে উঠে পড়লাম। আমার পিছু পিছু আরো কয়েকজন উঠল। কিন্তু গোল বাঁধল উস্তাদগণ কীভাবে উঠবেন? উঠতে গেলে তো পানি ডিঙাতে হবে। অবশেষে পাশের ট্রলারটাকে এই ট্রলারে জুড়ে দেয়া হল। মুহতারাম উস্তাদগণ প্রথমে ওটায় উঠে তারপর এটায় এলেন। সবাই আমরা যে যার মত ট্রলারের দু’পাশে, মাঝে এবং গলুইতে বসে পড়লাম। পুরো ট্রলার একেবারে বোঝাই। সারেং আমাদের পই পই করে বলে দিলেন, যত যাই হোক কেউ একটুও নড়বেন না। যে যার স্থানে বসে থাকবেন। ট্রলার ছাড়ার আগেই একবার অনুযোগ করলেনÑ ‘আপনারা বেশি নড়েন’।

ট্রলার চলতে শুরু করল। সমুদ্রের গাঢ় নীল জলরাশির বুক চিরে ট্রলার তরতর করে এগিয়ে চলেছে। সারেঙের সহকারী পানিতে বড়শি ফেলল। টোপ হল তিন ইঞ্চি লম্বা একটি প্লাস্টিকের মাছ! সবকিছুই আমরা বেশ উপভোগ করছি। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সবার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। বলা নেই কওয়া নেই ট্রলার আচমকা বাম দিকে কাত হতে শুরু করল। কাত হতে হতে পানি ছুঁই ছুঁই করে সোজা হয়ে এবার ডান দিকে কাত হতে লাগল। ডোবে ডোবে ভাব করে সোজা হয়ে আবার বাম দিকে কাত! এভাবে ডান-বাম করতে লাগল। ভয়ে আমাদের কলজে শুকিয়ে এলো। সারেঙ বারবার সতর্ক করছেন, নড়াচড়া করবেন না। কয়েকজনকে দেখলাম পাশের জনের হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আছে। বিবর্ণ-ফ্যাকাসে মুখ। শান্ত সাগরেরই এই অবস্থা। অশান্ত থাকলে না জানি কী হত! এরই মধ্যে সারেঙের সহকারী রনি ভাই ডান পাশের কিনারায় দাঁড়িয়ে বড়শি গোটাতে লাগল। ট্রলার বিপজ্জনকভাবে ডান কাত হয়ে আছে। আমরা মনে মনে বলছি, ভাই! মাছ দেখার সাধ নেই। আপনি বসেন। যাই হোক মাছ ওঠেনি। ভালোই হল। দশ-বারো কেজি ওজনের মাছ উঠলে তখন আর দেখতে হত না!

অবশ্য এদের জীবিকার উৎসই হচ্ছে সমুদ্র। তাই ভয়-ডর কম থাকাই স্বাভাবিক। তার ওপর সারেঙ আর এই রনি ভাই। এ দু’জন একবার ঝড়ে বোট ডোবার ফলে দু’দিন সমুদ্রে ভেসে ছিলেন। আর কেবল নোনাজল খেয়ে ছিলেন!

দু’চোখ যতদূর যায় শুধু অথৈ পানি। মাঝে মধ্যে কেবল দু-একটা নৌকা, ট্রলার বা স্পীড বোট দেখা যায়। দূরে একটা নৌবাহিনীর জাহাজ দেখা গেল। এ সবকিছুর কী নিখুঁত চিত্রায়ন আল্লাহর এই বাণীতে,

(অর্থ) তিনিই সমুদ্রকে অধীন করিয়াছেন, যাহাতে তোমরা উহা হইতে তাজা মৎস্য আহার করিতে পার এবং যাহাতে উহা হইতে আহরণ করিতে পার রতœাবলী যাহা তোমরা ভূষণরূপে পরিধান কর; এবং তোমরা দেখিতে পাও, উহার বুক চিরিয়া নৌযান চলাচল করে এবং উহা এই জন্য যে, তোমরা যেন তাঁহার অনুগ্রহ সন্ধান করিতে পার এবং তোমরা যেন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। (সূরা নাহল- ১৪)

ট্রলারের ডানে-বামে কাত হওয়া অব্যাহত আছে। তবে এখনো পর্যন্ত না ডোবায় আমরা প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠেছি। বুঝলাম, ট্রলারটার কাঠামোই এমন যে, দুলবে কিন্তু সহজে ডুববে না। তবে পরিবেশ এখনো থমথমে। তীর না দেখা অবধি স্বস্তি নেই। মুরুব্বীদের দেখলাম একেবারেই শান্তÑ ভয়হীন! আল্লাহর ভয় প্রাধান্য পেলে নাকি আর সবকিছুর ভয় কেটে যায়। যদিও ভীত হওয়া বুযুর্গির পরিপন্থী নয়। এ নিয়ে থানবী রহ. এর চমৎকার ঘটনা রয়েছে। আমীরে সফর দা.বা. কে দেখলাম বাকি সময়ের মতই ঠোঁট জোড়া নড়ছে অবিরাম।

ছেড়া দ্বীপের কাছাকাছি চলে এলাম। সেই সঙ্গে ঘণ্টা খানেকের রোমাঞ্চ আর উদ্বেগে ঠাসা এই সফর আপাতত শেষ হল। এমন সময় পানিতে কিছু পড়ার জোর শব্দ! কী হল! কিছু না, নোঙ্গর ফেলা হয়েছে। আমাদের দেখে দুটো নৌকা এগিয়ে এলো। এক নৌকায় কতজন করে নিতে পারবেÑ জানতে চাইলে বলল, বারো জন করে। শুনে আমাদের চোখ কপালে উঠল! আটজনের বেশি যেতে রাজি হলাম না। তাই হল অবশেষে। জামালুদ্দীন সাহেব (বড় হুযূর) আমাকে বললেন, এই আমীর সাহেবের ছেলে! ভালোভাবে ওঠো। তোমার কিছু হলে তো তোমার বাবা আমাদের ধরবে। আমি মুচকি হেসে উনার নৌকাতেই উঠে পড়লাম। আহমাদুল্লাহ সাহেব হুযূরও আমাদের নৌকায় চলে এসেছেন। হুযূর নৌকা থেকে নেমে কিনারায় দাঁড়িয়েই উযূ করে নিলেন। বিকেলের সূর্যের মরা আলোতে হুযূরের গৌর বর্ণের সুশ্রী নূরানী চেহারায় পানির ফোঁটাগুলো ঝকমক করছে। তীরে নেমে সমুদ্রের দিকে তাকালাম। কী স্বচ্ছ টলটলে পানি! একেবারে কাকচক্ষু জল! আমিও উযূ করার লোভ সামলাতে পারলাম না। কিন্তু কুলি করার জন্য মুখে পানি নিতেই মুখ বেকে-চুরে গেল! ভীষণ নোনা পানি!

সবাই এগিয়ে গেছে। আমিও পা চালালাম। আমারও পেছনে রেযওয়ান। প্রবালে পা কেটে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। চারিদিকে কেয়া গাছের ছড়াছড়ি। কিছুদূর হেঁটে সমতল একটা পাথর। এর ঠিক পশ্চিম দিকে সমুদ্র। ক্ষণে ক্ষণে ঢেউগুলো সশব্দে তীরে আছড়ে পড়ছে। জোরালো বাতাস আর সমুদ্রের শোঁ শোঁ গর্জন! চারিদিকে নয়নাভিরাম পরিবেশ। আসরের নামাযটা এখানেই এক পাথরের উপরই আদায় করা হল। নামায শেষে নায়েব সাহেব হুযূর মন্তব্য করলেন, এই স্থানে যদি একটা মাদরাসা হত! মুদীর সাহেব হুযূর বললেন, হুযূর! আমরা সবাই মিলে দু‘আ করি, যেন আল্লাহ তা‘আলা এখানে একটা দীনের মারকায বানিয়ে দেন। আমরা সবাই মিলে দু‘আ করলাম।

সূর্য ধীরে ধীরে তার জৌলুস হারাচ্ছে। আমরা এগুলাম সূর্যাস্ত দেখতে। নায়েব সাহেব হুযূর আগে একবার এসেছেন। তাই তিনি আর সামনে যেতে রাজি হলেন না। আমরা কেয়া আর নাম না জানা কিছু গাছ-গাছালির ভেতর দিয়ে হেঁটে একেবারে পশ্চিমে চলে এলাম। পুরো তীর জুড়ে ছোট-বড় নানা আকৃতির প্রবাল পাথর ছড়িয়ে আছে। এই বাহ্যত নিষ্প্রাণ পাথর সম্পর্কে কুরআনের ভাষা শুনুন,

(অর্থ) পাথরও কতক এমন যে, উহা হইতে নদী-নালা প্রবাহিত হয় এবং কতক এইরূপ যে, বিদীর্ণ হওয়ার পর উহা হইতে পানি নির্গত হয়, আবার কতক এমন যাহা আল্লাহর ভয়ে ধ্বসিয়া পড়ে…। (সূরা বাকারা- ৭৪)

উত্তর দিকে যে পানিটুকু দেখা যাচ্ছে, ভাটার সময় তা নেমে যায়। তখন নারিকেল জিঞ্জিরার সঙ্গে ছেড়া দ্বীপের সংযোগ তৈরি হয়।

সবাই তীর ঘেঁষে হাঁটছে। শামুক আর পাথর কুড়াচ্ছে। বড় হুযূর মুরশিদ ভাইকে বললেন, চলেন মাওলানা! আমরা মাছ ধরি। দু’জন মিলে একটা মাছের দু’দিকে হাত দিয়ে ঘেরাও দিয়ে ঘেরাও ছোট করতে লাগলেন। মাছ ফাঁক গলে মুরশিদ ভাইয়ের দু’পায়ের তলা দিয়ে স্যাঁত করে বেরিয়ে গেল।

আমি হাঁটাহাঁটি না করে পেল্লায় সাইজের একটা প্রবাল পাথরের উপর সূর্যের দিকে মুখ করে বসলাম। প্রবাল মূলত সামুদ্রিক এক জাতীয় প্রাণী। প্রজনন ব্যবস্থায় এরা বংশ বিস্তার করে। এরা প্রাণী হলেও জীবনের পূর্ণ বয়স্ক অবস্থায় সাগরতলের কোন দৃঢ় তলের ওপর গ্যাট মেরে বসে বাকি জীবন পার করে দেয় নিশ্চল হয়ে। প্রতিটি প্রবাল যেখানে বসে, সেখানে সে নিজের দেহের চারপাশে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট নিঃসরণের মাধ্যমে শক্ত পাথুরে খোলস তৈরি করে। একটা প্রবালের মৃত্যুর পরও খোলসটি রয়ে যায়। এ রকম শত সহস্র কোটি প্রবাল কীটের আত্মদানে তৈরি হয় আস্ত এক দ্বীপ। অতএব সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ কত মহান! (সূরা মুমিনূন- ১৪)

চারপাশে ছড়ানো ছিটানো প্রবাল পাথর। বাতাসের মৃদু প্রবাহ। সাগরের গুরু গম্ভীর গর্জন। আর দিগন্ত জোড়া আকাশে বিরাট কুসুমের মত সূর্য চারিদিকে লালিমা ছড়িয়ে ধীরে ধীরে ডুবছে। সে এক মনমুগ্ধকর, অপরূপ, চিত্তহরি, অদ্ভূত সুন্দর দৃশ্য!! একটু একটু করে সূর্য একসময় ডুবে গেল। আকাশ জুড়ে এখন লাল আভা আর নরম আলো।

মাগরিবের সময় হয়ে এসেছে। ফেরার তাগিদে আমরা আবার পূর্ব দিকে হাঁটা শুরু করলাম। তীরের কাছে এসে নামাযের জন্য তৈরি হলাম। মসজিদ যদিও আছে; কিন্তু তা দ্বীপের ভিতরের দিকে উত্তরে। আমীরে সফর দা.বা. রেযওয়ানের দূরবীনের কম্পাস দিয়ে দিক নির্ণয় করে দিলেন।

মাগরিবের পর আমরা বিলম্ব না করে নৌকায় করে ট্রলারের দিকে এগুলাম। ট্রলারের মাঝখানে তিনটে কাঁঠের দ- দেখেছিলাম। এখন দেখি ওগুলোর ডগায় মিটমিট করে রঙিন বাতি জ্বলছে। রাতের বেলা অন্যান্য নৌযান যেন এর উপস্থিতি বুঝতে পারে, তাই এই ব্যবস্থা।

ক’জনকে দেখলাম বিমর্ষ বদনে ট্রলারে উঠতে। বিকেলের দুঃসহ স্মৃতি তারা এখনো ভোলেনি। যাকারিয়ার সঙ্গে কী এক বিষয় নিয়ে হাসাহাসি করছিলাম। আমাদের এক সহপাঠী বিকেলে আসার সময় ভালো রকম ভয় পেয়েছিল। বেচারার মুখ এখনই শুকিয়ে গেছে। আমাদের হাসাহাসি দেখে ক্ষিপ্ত গলায় বলল, ‘হাসাহাসি একটু বন্ধ রাখা যায় না!’

ট্রলার চলছে আপন গতিতে। আকাশের পূর্ব কোণে গোল চাঁদ ঝুলছে। তারারা সব জেগে উঠেছে। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় তারা ভরা আকাশ অসম্ভব সুন্দর লাগছে। কিন্তু এই সৌন্দর্যও অনেকের কাছে ফিকে। কারণ ট্রলার আগের মতই বিদজ্জনকভাবে ডানে-বামে দুলছে। সবাই চুপচাপ। যে যার চিন্তায় মশগুল। আমি অতো ভাবছি না। একেতো ডুবে মরলে শহীদ; তার উপর সঙ্গে এত বড় বড় সব বুযুর্গ। পটল তুললে নির্ঘাত জান্নাত! আমার মত পাপীর জন্য শাপে বর। আমি আপন মনে গুনগুন করে গজল গাইছি।

অদূরে নারিকেল জিঞ্জিরার ছোট বাজারের লাইটগুলো মিটিমিটি জ্বলতে দেখা গেল। ট্রলারও পাগলামী থামিয়ে সোজা চলছে। আমার পাশে বসা ইসমাঈল ভাই যেন এতক্ষণে প্রাণ ফিরে পেলেন। মুখে কথার খই ফুটতে লাগল। বললেন, ‘এখন আর চিন্তা নেই। ট্রলার ডুবলেও সাঁতরে তীরে চলে যেতে পারব। ডুবে গেলে প্রথম কাজ হল ভার কমিয়ে শরীরটাকে হালকা করা। তাতে সাঁতার কাটতে সুবিধা।’ যেমনি এই কথা বলা, অমনি ট্রলার আবার একদিকে কাত হতে লাগল। ইসমাঈল ভাই আতঙ্কে ‘আল্লাগো’ বলে আমাকে জাপটে ধরলেন! স্থান কাল ভুলে আমি হো হো করে হেসে ফেললাম। তারপর কোন মতে হাসি চেপে বললাম, ইসমাঈল ভাই! আপনার শরীর ‘হালকা’ করার সময় এসে গেছে।

ট্রলার একেবারে রিসোর্টের সামনের দিকে এসে থামল। এখন তীরবর্তী বালুকাবেলা ডিঙিয়ে আমাদের রিসোর্টে যেতে হবে। কিন্তু পানি বেশি হওয়ায় নামা যাচ্ছে না। সারেঙ বলল, ভাটা শুরু হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পানি কমে যাবে। মুদীর সাহেব হুযূর এই অবসরে কুরআনে কারীমের সমুদ্র বিষয়ক আয়াতগুলো কুমিল্লার হুযূরকে তিলাওয়াত করতে বললেন। আর আমাদের মনযোগ দিয়ে শুনতে বললেন। আমরা চুপচাপ শুনতে থাকলাম।

কিছুক্ষণ পরই পানি কমে এলো। মুদীর সাহেব আমাদেরকে এক এক করে নামতে বললেন। আমি সবার আগে নামলাম। হাঁটু অব্দি পানি। বাকিরাও নামতে শুরু করল। কাউসার ভাই একটু একটু করে নামছেন আর লুঙ্গি গোটাচ্ছেন। পানি হাঁটু পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মাটিতে পা ঠেকছে না! তাই এক লাফে আবার ট্রলারে! এ নিয়ে বেশ হাস্য রসের সৃষ্টি হল। তারপর উনি ট্রলারের সামনের দিক দিয়ে নামলেন। কিন্তু মূল সমস্য হল, উস্তাদগণ কীভাবে নামবেন! আমাদের মত কাপড়-চোপড় ভিজিয়ে নামা তো আর সম্ভব না! তাদের হেলপার দু’জন তখন উস্তাদদেরকে কাঁধে করে তীরে পৌঁছে দিলেন। আল্লাহ তাদের উত্তম বিনিময় দান করুন।

আমরা কামরায় ঢুকে কাপড় পাল্টাচ্ছি। কেউ গোসল করছে। কেউবা হাত-মুখ ধুচ্ছে। কথাবার্তা চলছে। প্রধান বিষয় ট্রলারের সদ্য সমাপ্ত ‘টেরিফিক’ ভ্রমণ! এমন সময় মুদীর সাহেব আমাদের রুমে এলেন। বললেন, যারা ভয় পেয়েছ তাদের মুফতী সাহেবের (মুফতী মনসূরুল হক সাহেব দা.বা. এর) সোহবতে থাকা উচিত। হুযূর কোন অবস্থাতেই বিচলিত হন না। আর ট্রলার থেকে নামার আগে কুরআন তিলাওয়াতের সময় অনেকে অন্যমনস্ক ছিলÑ সে ব্যাপারে সতর্ক করলেন। নায়েব সাহেব হুযূর আমাদের একজনকে ডেকে বললেন, অ্যাই! তোমরা যারা ভয় পেয়েছ, আহমাদুল্লাহ সাহেব আর ইবরাহীম হাসান সাহেব হুযূরের কাছ থেকে পানি পড়া নিয়ে শরীরে ছিটাও! এ নিয়ে বেশ একচোট হাসাহাসি হল।

ফ্রেশ হয়ে আমরা জামাআত করে ইশার নামায পড়ে নিলাম। তারপর উস্তাদগণ মেযবানের বাসায় আগে খেতে গেলেন। উনাদের খাওয়া শেষ হওয়ার পর আমরা গেলাম। কয়েক পদের সামুদ্রিক মাছ দিয়ে খাওয়া শেষ করার পর এলো কফি। এটা বার্মিজ ইন্সট্যান্ট কফি। ফ্লেভার সম্পূর্ণ ভিন্ন। ঢাকায় প্রচলিত কপিকো, ম্যাক বা নেসলে কোনটার সাথেই মেলে না।

খাওয়া-দাওয়া সেরে আমরা দ্বীপ ঘুরতে বেরোলাম। দোকানে দোকানে ঢু মারলাম; কিন্তু বেশি কিছু কিনলাম না। কারণ এ চড়া মূল্যের পণ্যগুলো সবই টেকনাফে পাওয়া যায়, দামেও কম। কয়েক ধরনের আচার চেখে দেখলাম। যেটা ভালো লাগবে সেটা টেকনাফ থেকে কিনে নিব।

প্রচুর শুঁটকির দোকান। শুঁটকি আমার অপছন্দের খাবার। তবে উস্তাদগণ সবাই শুঁটকি কিনতে গেছেন শুনলাম। হোটেলসহ কিছু দোকান দেখলামÑ বিভিন্ন প্রকারের কাঁচা সামুদ্রিক মাছ সাজিয়ে রেখেছে। আপনি চাইলেই ভেজে দিবে। নতুন ধরনের রূপচাঁদা দেখলাম। সুন্দরী রূপচাঁদা। বাহারী নকশার কাঁকড়াও দেখা গেল। আড়াইশ টাকা পিস। আরো নাম না জানা কত মাছ। হাঁটতে হাঁটতে সমুদ্র পাড়ে চলে এলাম। জোয়ার শুরু হয়ে গেছে। আমরা কিছুক্ষণ বালুকাবেলায় বসে থেকে সাগরের ক্রুদ্ধ গর্জন শুনলাম। পানি একটু একটু করে উপরে উঠে আসছে। এবার আমরা মেযবানের বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম।

রাস্তা-ঘাটের আলো এক এক করে নিভছে। ১৯৯৯ সালের হ্যারিকেনের পর থেকে দ্বীপে বিদ্যুৎ নেই। বিকল্প বিদ্যুৎ হিসেবে জেনারেটর ব্যবহার করা হয়। তাই রাতের নির্দিষ্ট একটা সময়ে দ্বীপ প্রায় অন্ধকার হয়ে যায়। রিসোর্টের কাছাকাছি যখন এলাম, চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কাছেই সমুদ্র। সমুদ্রের কাছে থাকার লোভ হল। কিন্তু শরীর সায় দিল না।

মেযবানের বাড়ির খাবার ঘরে প্রায় সবাই শুয়ে পড়েছে। এখানে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় আমাদের ক’জনের ভিতরের একটা কামরায় ঠাঁই হল। ক্লান্তির কারণে গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে বেশি দেরী হল না।

শাহপরী নামা!

ভোরে উঠে সবাই মিলে নামায পড়লাম কোস্টগার্ড কার্যালয়ের মসজিদে। যদিও প্ল্যান ছিল নাস্তা সেরে দ্বীপ ত্যাগ করব; কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে এখনই রওয়ানা হওয়ার সিদ্ধান্ত হল। আমার হোল্ড অল তৈরিই আছে। পিঠে ঝুলিয়ে বের হতেই দেখি, মেযবানের ছোট ভাই মাওলানা আলম সাহেব বাড়ির সামনেই এক কাঁধি ডাব নিয়ে বসে আছেন। একটা একটা করে ডাব কেটে দিচ্ছেন আর আমরা সবাই স্ট্র দিয়ে একেবারে আকণ্ঠ পান করলাম ডাবের মিষ্টি পানি। তারপর জেটির দিকে এগুলাম।

আমাদের এবারের গন্তব্য শাহপরীর দ্বীপ। মাওলানা শাহাদাতুল্লাহ ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি। আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা ট্রলারে করে যাব। তবে এটা কার্গো ট্রলার। ছেঁড়া দ্বীপে যে ফিশিং ট্রলার দিয়ে গিয়েছিলাম সেটার চেয়ে কয়েকগুণ বড়। সারেঙের হেলপারের বাড়ি মিয়ানমার। এই ট্রলারে কাজ করে সে মাসে এক লাখ বিশ হাজার টাকা বেতন পায়। আঁতকে ওঠার কিছু নেই। এটা মিয়ানমারের কারেন্সি। এই দেশের টাকায় সে আনুমানিক সাত হাজার টাকা পায়Ñ স্বাভাবিক বেতন।

ট্রলারটির নাম এফ.বি. ভাই ভাই। ইঞ্জিনের দিকের গলুইতে চাদর বিছিয়ে উস্তাদগণ বসলেন। গলুইর উপরটা সিঁড়ির মত। ওখানে নায়েব সাহেব, আহমাদুল্লাহ সাহেব এবং আমীরে সফর দা.বা. বসলেন। আর আমরা ট্রলারের দু’পাশে পা ঝুলিয়ে বসলাম। ট্রলারের পাটাতন কাঁধ সমান নিচু। এখানেই মাল সামানা লোড করা হয়। আমরা আমাদের সামানা এখানেই রাখলাম। তাতে পাটাতন সামান্যই ভরল।

ট্রলার চলতে শুরু করল। সাগর এখন কিছুটা অশান্ত। ট্রলার ডানে-বামে বিষম দুলতে লাগল! মাঝে মধ্যে পানি ছিটকে শরীর ভেজাচ্ছে! ভয়ে কয়েকজনের মুখ আমসি হয়ে গেছে। একজন তো ট্রলার চলা শুরু করতেই নিচে পাটাতনে নেমে ব্যাগ আঁকড়ে ধরে বসে আছেন! ঠোঁট দুটো অনবরত নড়ছে। (ট্রলার থেকে নেমে জানিয়েছিলেন, এই সময়ে ভয়ে তিনি এগারো বার সূরা ইয়াসীন পড়েছেন!) আমার পাশে আশরাফ ভাই বসা। ওর পাশের জনের চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেছে। আশরাফ ভাইয়ের জামার হাতা খামচে ধরে এক দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। চেহারা ফ্যাকাসে! দু-চোখে শূন্য দৃষ্টি। আমার বরাবর সামনের জন নিজেকে সামলাতে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। একটু পর রণে ভঙ্গ দিয়ে আস্তে করে নিচে নেমে অপরজনের মত ব্যাগ আঁকড়ে বসে পড়লেন। সব দেখে হাসিও পাচ্ছে আবার খারাপও লাগছে। আমি ওদের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সাগর দেখতে লাগলাম। এই সাগর দ্বারা আল্লাহর নিজ বড়ত্ব প্রকাশের অপূর্ব ভঙ্গি দেখুন,

(অর্থ) বলো, আমার প্রতিপালকের কথা লিপিবদ্ধ করিবার জন্য সমুদ্র যদি কালি হয়, তবে আমার প্রতিপালকের কথা শেষ হইবার পূর্বেই নিঃশেষ হইয়া যাইবেÑ আমরা ইহার সাহায্যার্থে ইহার অনুরূপ আরও সমুদ্র আনিলেও। (সূরা কাহাফ- ১০৯)

বেশ কিছুক্ষণ পর সাগর কিছুটা শান্ত হয়ে এলো। দুলুনিও কমল। যিনি পাটাতনে নেমে গিয়েছিলেন সাহস কিছুটা ফিরে পেয়ে তিনি উপরে এসে বসলেন। দু আঙ্গুলের মাঝে তাসবীহ ঘুরছে। এক সময় যখন ট্রলার দোলা বন্ধ হল, তাসবীহ ঘোরাও বন্ধ হল! আর একটু পর পকেটে ঢুকে গেল! আমার আয়াত মনে পড়ে গেল,

(অর্থ) তিনিই তোমাদিগকে জলে-স্থলে ভ্রমণ করান এবং তোমরা যখন নৌকারোহী হও এবং এইগুলি আরোহী লইয়া অনুকূল বাতাসে বহিয়া যায় এবং তাহারা উহাতে আনন্দিত হয়। অতঃপর এইগুলি বাত্যাহত এবং সর্বদিক হইতে তরঙ্গাহত হয় এবং তাহারা উহা দ্বারা পরিবেষ্টিত হইয়া পড়িয়াছে মনে করে, তখন তাহারা আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হইয়া আল্লাহকে ডাকিয়া বলে, তুমি আমাদিগকে ইহা হইতে ত্রাণ করিলে আমরা অবশ্য কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হইব। অতঃপর তিনি যখনই উহাদিগকে বিপদমুক্ত করেন তখনই উহারা পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে যুলুম করিতে থাকে। (সূরা ইউনুস- ২২, ২৩)

সাগর এখন শান্ত। ট্রলারের ভেতরেও স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে এসেছে। চারপাশের আপাতঃ অন্তহীন সাগরের নীল জলে সূর্যের সোনালী রোদ ঠিকরাচ্ছে। ট্রলার নিজ গতিতে এগুচ্ছে শাহপরীর দ্বীপে। হঠাৎ সমুদ্রের মাঝখানে সাদা ফেনার মত কী যেন চোখে পড়ল। আরেকটু অগ্রসর হওয়ার পর দেখা গেল এটা সাগরের বুকে ডুবে থাকা চর সদৃশ আরেকটা দ্বীপ। অনেক বড় জায়গা জুড়ে আছে। ঢেউগুলো এটার ওপরই আছড়ে পড়ে ফেনা ছড়াচ্ছে। ভাটার সময় দ্বীপটা জেগে ওঠে।

ঘণ্টা দেড়েকের সফর শেষে তেরো কিলোমিটার পেরিয়ে আমরা শাহপরীর দ্বীপে নামলাম। জেটিতে নেমে আমীরে সফর দা.বা. ভীতদের একজনকে বললেন, কী, এখনো পানি পড়া লাগবে, নাকি এখন অন্যকে পানি পড়া দিতে পারবেন?! এখানে থেকে সি.এন.জি যোগে শাহাদাতুল্লাহ ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি যাব। আমাদের সি.এন.জিতে মুদীর সাহেব উঠলেন। সফর কেমন লাগছে জানতে চাইলে বললাম, খুব ভালো। তিনি বললেন, দেখব, সফরনামা কেমন লেখ।

শাহপরীর দ্বীপ মূলত কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। শোনা যায়, স¤্রাট শাহ সুজা তার স্ত্রী পরী বানুকে নিয়ে কোন এক সময় এ দ্বীপে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। এরপর শাহ সুজার ‘শাহ’ আর পরী বানুর ‘পরী’ মিলে এ দ্বীপের নাম হয় ‘শাহপরীর দ্বীপ’। এছাড়া ভিন্ন ব্যাখ্যাও অনেকে দিয়ে থাকে।

শাহাদাতুল্লাহ ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ি একেবারে সমুদ্র পাড় ঘেঁষা। তারা নাশতা তৈরি করে প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। আমরা যেতেই সোজা দস্তরখানে বসিয়ে দিলেন। বড় বড় চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রকার সামুদ্রিক মাছ সহযোগে সবাই পরিতৃপ্ত হয়ে খেলাম। সবশেষে বার্মিজ কফি পরিবেশিত হল। আমরা তো খেয়েই খালাস! অন্দর মহলের বাসিন্দারা না জানি কত কষ্ট করেছেন এসবের পেছনে! আল্লাহ তাদের উত্তম বিনিময় দান করুন। শাহাদাত ভাইয়ের শ্বশুর একজন আলেম। স্থানীয় এক মাদরাসায় পড়ান। তার ছেলেরাও দীনের খিদমতে ব্যপৃত আছেন। দীনের জন্য নিবেদিত প্রাণ এই পরিবারকে আল্লাহ উত্তরোত্তর সাফল্য দান করুন।

সমুদ্র এখান থেকে দু-মিনিটের পথ। আমরা সমুদ্র পাড়ে গেলাম। গৃহকর্তা জানালেন, তার ছোট বেলায় সমুদ্র এত দূরে ছিল যে, সকালে রওয়ানা হলে পৌঁছতে দুপুর হয়ে যেত! এমনকি গত বছরও এখান থেকে সমুদ্র ছিল এক কিলোমিটার দূরে। অথচ এখন সমুদ্র বাড়ির কাছে এসে পড়েছে। ছোট্ট একটা পরিসংখ্যানে বিষয়টা আরো স্পষ্ট হবে। স্বাধীনতার আগে শাহপরীর দ্বীপের দৈর্ঘ্য ছিল ১৫ কিলোমিটার আর প্রস্থ ছিল ১০ কিলোমিটার। আর বর্তমানে এর দৈর্ঘ্য ৩ কিলোমিটার আর প্রস্থ ২ কিলোমিটার। শাহাদাত ভাইয়ের ভায়রা মাওলানা শফীকুল্লাহ জানালেন, অন্ততঃ কয়েকশ ঘর-বাড়ি আর আট-দশটি মসজিদ সাগরগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে! সমুদ্রের এই সংহারী প্রবৃত্তি সত্যিই আশঙ্কাজনক!

আমরা পায়ে পায়ে সমুদ্রের পাড়ে গেলাম। এমন অশান্ত সংক্ষুব্ধ রূপ নারিকেল জিঞ্জিরায় চোখে পড়েনি। ঢেউগুলো উঁচু হয়ে হয়ে তীরে এসে একরাশ ফেনা ছড়িয়ে সশব্দে ভেঙ্গে পড়ছে। এ যেন ভয়ঙ্কর সুন্দর! আমার ফিরতে মনে চাইছিল না। যতক্ষণ সম্ভব সেখানে থাকলাম। আর কেবল সমুদ্রের দিকে চেয়েই রইলামÑ উপভোগ করলাম। তারপর ফিরে এসে মেযবানের বাড়িতে জড়ো হলাম। মেযবান তার ছেলের মাদরাসা দেখালেন। দেশের এই দূর কোণেও আল্লাহ তা‘আলা এসব মাদরাসার মাধ্যমে দীনের বাতি জ্বালিয়ে রেখেছেন। আল্লাহ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কবুল করুন। আমীন।

আমরা এখান থেকে সোজা টেকনাফ যাবো। শাহপরীর দ্বীপ থেকে টেকনাফের সরাসরি কোন রাস্তা নেই। ২০১২ সালের জুন মাসের সৃষ্ট নি¤œচাপের ফলে একমাত্র সংযোগ সড়কটি ভেঙ্গে যায়। তাই সি.এন.জি করে আমরা প্রথমে টেকনাফের সঙ্গে সংযোগ খালের পাড়ে গেলাম। সেখান থেকে ট্রলারে করে খালের ভিতর দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে টেকনাফে উঠলাম। এখানে আমাদের গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়িগুলো এ ক’দিন টেকনাফে মেযবানের বাড়িতে ছিল।

গাড়িতে করে আমরা টেকনাফ বাজার অভিমুখে চললাম। টেকনাফে জিনিসপত্র তুলনামূলক সস্তায় পাওয়া যায়। বাজারে এসে গাড়ি থামার পর মুদীর সাহেব হুযূর বললেন, ‘দ্রুত বাজার সেরে ফেলো’। আমরা নিজ নিজ পছন্দ অনুযায়ী কয়েক পদের আচার, কফি, চকোলেট, সিদ্ধ বাদাম, শুঁটকি ইত্যাদি কিনে দ্রুত ফিরলাম। (অবশ্য বাসার ফেরার পর আব্বু ছোট্ট মন্তব্য করেছিলেন, ‘শত্রুদের পণ্য নিয়ে এসেছে!’)

ইনানীর বালুকাবেলাতে

আমরা এবার মেরিন ড্রাইভ সড়ক দিয়ে ইনানী বীচ-এ যাব। ইনানী কক্সবাজার থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত প্রবাল গঠিত বীচ। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত একশ বিশ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকতের মধ্যে ইনানী অন্যতম আকর্ষণীয় সৈকত। গাড়ি তাই ইনানী বীচের দিকে জোর গতিতে এগোতে লাগল। একটু পরই রাস্তার ডানে পাহাড় আর বামে সমুদ্র দেখা যেতে লাগল।

যোহরের নামাযের সময় হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি ইনানী বীচে গিয়ে থামল। কেউ জানাল, এখানে থামলে পার্কিং ফি দিতে হবে। তাই একটু সামনে রাখা যায় কিনা! কিন্তু আমরা আর ঝামেলায় না গিয়ে পার্কিং ফি দিয়েই গাড়ি রাখলাম। বীচের লাগোয়া মসজিদে জরুরত সেরে নামায পড়ে নিলাম। সময় স্বল্পতার কারণে সমুদ্রের একেবারে কাছে যাওয়া হল না। আমাদের কয়েকজন এই ফাঁকে কিছু কেনা-কাটাও করলেন। কিছুটা অতৃপ্ত হয়েই আবার গাড়িতে উঠে বসলাম। আমাদের গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। অপরটা ছাড়বে এমন সময় এক ব্যক্তি এসে বললেন, হুযূর! আপনারা যে এখানে নামায পড়তে এসেছেন তা বুঝতে পারিনি! ভুল হয়ে গেছে! টাকাগুলো ফেরত নিন। আমাদের সাথীরা বললেন, গাড়ি তো একটা চলে গেছে! লোকটি তখন জোর করে এক গাড়ির পার্কিং ফি ফেরত দিল।

হিমছড়ির উচ্চতায়!

এবার আমরা যাবো হিমছড়ি। মেরিন ড্রাইভ সড়কের সর্পিল মসৃণ গা বেয়ে ছুটে চলেছে আমাদের গাড়ি। ডান পাশে পাহাড়ের মৌন মহান রূপ আর বাম পাশে সমুদ্রের গম্ভীর আগ্রাসী চিত্র! পাহাড় আর সাগরের যেন এক অপূর্ব মেলবন্ধন। মাঝে মধ্যে গর্জন গাছের বাগান চোখে পড়ছে। আপন সুউচ্চ স্বকীয়তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটু পর পর। সে এক দেখার মত দৃশ্য! খুলনার হুযূর বললেন, তোমরা কেউ আমার ফোনটা নিয়ে দৃশ্যগুলো ক্যামেরাবন্দি করো। ফোনটা আমি নিয়ে ক্রমাগত ছবি তুলতে লাগলাম।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা হিমছড়ি পৌঁছে গেলাম। হিমছড়ি কক্সবাজার থেকে বারো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। দেশের একমাত্র শীতল পানির ঝরণা এখানেই আছে। নামকরণ দ্বারাই বিষয়টি বোঝা যায়। হিম মানে শীতল আর ছড়ি মানে ছোট ঝরণা।

জন প্রতি ৩০টাকার টিকেট কেটে আমরা ভেতরে গেলাম। তবে যারা আগে এসেছিলেন তার নিচেই থেকে গেলেন। প্রায় দশতলা সমান উঁচু পাহাড়ে চড়তে হবে সিঁড়ি বেয়ে। সিঁড়ির ধাপগুলো বেশ চওড়া। কী জানি দেখব এই আশায় হাঁপাতে হাঁপাতে উঠছি। আশপাশের সবার একই অবস্থা। বিভিন্ন রকম মন্তব্য শোনা যাচ্ছেÑ ‘টাকা দিয়ে দেখি আযাব কিনলাম!’

চূড়ায় উঠে এদিক ওদিক দেখি। ঝরণা কই?! জানা গেল, ঝরণা দেখতে হলে পাহাড় আরো ঘুরে ভেতরের দিকে যেতে হবে! এদিকে সময়ও কম। ঝরণা চেনে এমন কেউ সঙ্গে থাকলে হয়তো একটা চান্স নেয়া যেত। আমরা তাই পাহাড়ই ঘুরে ফিরে দেখলাম। কী উঁচু পাহাড়! অথচ কাল কিয়ামতের দিন এসব পাহাড়-পর্বত সব আল্লাহর হুকুমে ধুলিস্যাত হয়ে যাবে! আল্লাহ বলেন,

(অর্থ) উহারা তোমাকে পর্বতসমূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলো, আমার প্রতিপালক উহাদিগকে সমূলে উৎপাটন করিয়া বিক্ষিপ্ত করিয়া দিবেন। অতঃপর তিনি উহাকে পরিণত করিবেন মসৃণ সমতল ময়দানে, যাহাতে তুমি বক্রতা ও উচ্চতা দেখিবে না। (সূরা ত্বা-হা- ১০৫-১০৭) এবং পর্বতসমূহ হইবে ধূনিত রঙ্গীন পশমের মত। (সূরা কারি‘আ- ৫)

‘দিল্লি কা লাড্ডু’ খেয়ে আমরা এবার নিচে নেমে এলাম। একজনকে দেখলাম বলছে, ভাই! ঝরণা এদিকে, এদিকে যান। শুনে মাথার চাঁদি গরম হয়ে উঠল! ঝরণা নিচেই থাকলে এত কষ্ট করে ওপরে গেলাম কেন!! দ্রুত ছুটলাম ওদিক। হায় কপাল! এই বুঝি ঝরণা! ভেতরের কোথা থেকে যেন পানি আসছে। আর কৃত্রিম ঝরণা বেয়ে তা গড়িয়ে পড়ছে।

বাইরের মত ভিতরের দোকানীরা পসরা সাজিয়ে বসে আছে। তবে দাম একটু বেশি। তাই আমরা বের হয়ে এলাম। হরেক রকমের আচার, স্যুভেনির আর কারুশিল্পের ছড়াছড়ি। টুকটাক কেনাকাটা করলাম। তারপর গাড়িতে উঠে পড়লাম।

এবার ফেরার পালা

গাড়ি এবার ঢাকা অভিমুখে চলতে লাগল। তবে পথে আমরা চট্টগ্রামের বড় বড় মাদরাসায় হাযিরি দিব। দুপুরে খাওয়া হয়নি। তাই ভালো কোন রেস্তোরার খোঁজ চলতে লাগল। আমরা তখন কক্সবাজার শহরে। এদিকে আসরের সময় হয়ে গেছে। তাই বাধ্য হয়েই একটা রদ্দি মার্কা রেস্তোরায় মুদীর সাহেব হুযূর অর্ডার দিয়ে এলেন। বললেন, আমরা নামায পড়ে তারপর খেতে আসব।

নামায শেষ হল। খাওয়ার উদ্দেশ্যে রেস্তোরায় ঢুকলাম। রেস্তোরাটির নাম লোহাগাড়া ভাতঘর। শ্রীহীন পরিবেশ। প্রয়োজনের সময় তাই নেয়ামত। দুপুরের খাবারের শেষ সময়। তাই গরু, মুরগী, মাছ মিলিয়ে খাওয়া হল। ভাত শেষ হয়ে যাওয়ায় আরেক জায়গা থেকে ভাত নিয়ে আসা হল। যাকারিয়া আমার সঙ্গে বসে আছে। মুরগীর পিস পছন্দ না হওয়ায় হয়েটারকে ডেকে বলল, অ্যাই, এটা পাল্টে লেগ পিস দাও। আমিও চোখ গোল গোল করে জানতে চাইলাম, লেগ পিস জিনিসটা কী? ও জানাল, হোটেলে মুরগীর রান এভাবে ইংরেজিতে চাইতে হয়! ও কোথায় নাকি শিখেছে। এনিয়ে হাসাহাসি হল বেশ!

খাওয়া দাওয়া শেষে এবার কেবল ছোটার পালা। সামনে আমরা কেবল পটিয়াতে থামব। মাঝখানে মাগরিবের নামায আমরা রাস্তার ধারের কোন এক মসজিদে পড়লাম। বড় হুযূর আশঙ্কা করলেন, ইমামের কিরাআত শুদ্ধ হবে কিনা! আল্লাহর রহমতে ইমাম সাহেবের কিরাআত শুদ্ধই ছিল।

পটিয়া মাদরাসায় হাযিরি

আধো ঘুম, আধো জাগরণে আমরা যখন পটিয়ায় পৌঁছলাম রাত তখন দশটা পেরিয়েছে। উত্তর পাশে মসজিদের সামনে আমাদের গাড়িটা থামল। নামায পড়তে হবে। জরুরত সেরে দক্ষিণ পাশের বিশাল লাইব্রেরি ভবনের পেছনের চমৎকার বড় পুকুরে উযূ করলাম। তারপর জামিয়ার মসজিদে জামাআতে নামায পড়লাম। আমাদের পাশে তাবলীগী ভাইয়েরা মুযাকারা করছিলেন। আমরা নামাযে দাঁড়াতেই একেবারে ফিসফিস করে কথা বলতে লাগলেন। মসজিদে একটা আরব জামাআতও দেখলাম।

১৩৫৭ হিজরীতে মুফতী আজিজুল হক রহ. কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জামিয়া কাসেমুল উলূম পটিয়ার বর্তমান মুহতামিম হলেন মাওলানা আব্দুল হালীম বুখারী দা.বা.। বর্তমানে এই জামিয়া দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃত এবং শিক্ষা-দীক্ষার বহুমুখী কার্যক্রমের পাশাপাশি সামাজিক, সেবামূলক, জনকল্যাণমূলক ও অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে অবদান রেখে যাচ্ছে। অভিনব বিষয় হল, এখানে কাদীম নেসাবের সঙ্গে মাদানী নেসাবও রয়েছে।

জামিয়ার একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা আমরা অনেকেই জানি না। একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র হতে স্বাধীনতা ঘোষিত হওয়ার পর তা হানাদার বাহিনীর আক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। তখন নিরাপত্তার কথা ভেবে মেজর জিয়াউর রহমান বেতারের যন্ত্রপাতি ও সৈন্যদের নিয়ে এই জামিয়ায় চলে আসেন এবং এখান থেকেই স্বাধীনতার ঘোষণা উচ্চারিত হয়। ফলে জামিয়া হানাদার বাহিনীর রোষাণলে পড়ে যায় এবং তাদের আক্রমণে সেদিন শহীদ হন জামিয়ার মুহাদ্দিস আল্লামা দানিশ রহ. এবং আহত হন কয়েকজন উস্তাদ। সাংবাদিক শাকের হোসাইন শিবলী তার ‘আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে’ বইতে এসব তথ্য উল্লেখ করেছেন।

আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। প্রত্যেক ভবন আর কার্যক্রম বর্ণনা করতে গেলে বিরাট ফিরিস্তি হয়ে যাবে। বাৎসরিক মাহফিলের প্রস্তুতি কল্পে আজ সকালেই মাদরাসায় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। তাই প্রায় নীরব পরিবেশ। লাইব্রেরী ভবন দেখে ভেতরে প্রবেশের লোভ হল। কিন্তু বন্ধ থাকায় সম্ভব হল না। পরীক্ষার হল দেখলামÑ তিন হাজার ছাত্র একসঙ্গে এখানে পরীক্ষা দেয়। রাতের অন্ধকারে এই বিশাল জামিয়ার ওপর এক নযর বুলিয়ে আমরা গাড়িতে উঠলাম। এবার যাব জিরি মাদরাসা।

জিরি মাদরাসায় এক নযর

কিছুক্ষণের মধ্যেই জিরি মাদরাসায় পৌঁছে গেলাম। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত আল-জামিয়াতুল আরাবিয়াতুল ইসলামিয়া জিরি দেশের প্রাচীনতম ইসলামী বিদ্যাপীঠ। প্রাক প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তর থেকে দাওরায়ে হাদীস, তাফসীর, ইফতা, হাদীস, কিরাআত, হিফযসহ ভাষা শিক্ষা এবং কারিগরি প্রশিক্ষণও চালু আছে এখানে। ছাত্র সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। বর্তমান মুহতামিম আল্লামা শাহ মুহাম্মাদ তৈয়ব সাহেব দা.বা.।

আমরা মাদরাসা দেখলাম। ইফতা বিভাগে ঢু মারলাম। রাত এবং সময় স্বল্পতা হেতু কোন উস্তাদের সঙ্গে মুলাকাত হল না। একজন ছাত্র এক উস্তাদকে ডেকে আনতে চাইলে আমরা বরং নিষেধ করলাম। ক্যালেন্ডার এবং বাতায়ন হাদিয়া দিয়ে আমরা নিচে নেমে এলাম। নব নির্মিত মসজিদটি আলোয় আলোয় ঝলমল করছে।

গাড়ি ছুটছে নিজ গন্তব্যে। এবার সামনে কেবল রাতের খাবার বাকি। কোথায় খাব জানতে চাইলে আমরা সবাই জামান হোটেলের কথা বললাম। আসার পথে এই হোটেলের খাবার বিশেষত পরিবেশন আমাদের এতই পছন্দ হয়েছিল যে, আমরা ভুলতে পারছি না। যদিও কোন হাইওয়ের পাশের কোন রেস্তোরায় খাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ ছিল। কারণ ওসব রেস্তোরায় সব ধরনের খাবার পাওয়া যেত।

জামান হোটেলে আমরা যখন পা রাখলাম রাত তখন সাড়ে বারোটা। আমাদের প্রায় সবাই রুটি খাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও রাত হবার কারণে স্বভাবতই পাওয়া গেল না। তাই গোশত আর মাছ দিয়ে খাবার সারা হল।

একটু সামনে শহরের মধ্যে একস্থানে গাড়ির ক্ষুধা মেটানোর জন্য পাম্পে গাড়ি থামানো হল। এই ফাকে মুদীর সাহেব হুযূর খুলনার হুযূরের কাছ থেকে ট্যাবে কিছু গজল নিয়ে নিলেন। ড্রাইভার সাহেবকে জাগিয়ে রাখার প্রয়াস। এখন কেবলই ছোটার পালা। কুমিল্লার দিকে এসে ড্রাইভার সাহেবদ্বয় চা খেতে নামলেন। সাথে আমরাও ক’জন নামলাম। ফজরের নামায পড়লাম নারায়ণগঞ্জের মদনপুরে। ওয়াক্ত বেশি বাকি নেই। তাই নায়েব সাহেব হুযূর দ্রুত করার জন্য তাড়া দিচ্ছিলেন। বললেন, সময় কম, আগে নামায পড়ো, পরে উযূ করে নিও! মসজিদে জামাআত শেষ; তাই আমরা ভিন্ন জামাআত করে নিলাম।

আটটার দিকে আমরা বসিলা গার্ডেন সিটির ভেতরে প্রবেশ করলাম। উস্তাদগণ যে যার গন্তব্যে নেমে পড়েছেন। আশপাশের পরিচিত মুখ, বাড়িঘর, গাছপালা সবই বড় আপন মনে হল। এমনকি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ইনআম ভাইয়ের ঝলমলে হাসিটাও। অবশেষে আমরা ফিরে এসেছি আপন আলোয় সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থায়। فلله الحمد اوله واخرة সুতরাং পূর্বাপরে কেবল আল্লাহরই প্রশংসা। সফর থেকে ফিরে আসার দু‘আ পড়া হল, ائبون تائبون عابدون لربنا حامدون।

শেষের কথা

তিনদিন তিন রাতের এই আনন্দপূর্ণ রোমাঞ্চকর ইলমী সফরের অভিজ্ঞতা ভুলবার নয়। ইসলাম যে নিরস, কাঠখোট্টা নয় এবং ভ্রমণও যে আনন্দের পাশাপাশি গুনাহমুক্ত বরং সওয়াবপূর্ণ হতে পারে; এই ইলমী সফরের পরতে পরতে তা সমুজ্জ্বল। আল্লাহ আমাদের পুরো জীবন ইসলামময় করে তোলার তাওফীক দিন। আমীন।

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *