প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও সামাজিক দায়বদ্ধতা

মাওলানা মুনীরুল ইসলাম


মানব জাতি মহান রাব্বুল আলামীনের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। অতি আদর, অনিন্দ্য সুন্দর, অনুপম সৃজনে সৃষ্টি করেছেন তিনি। মহাপবিত্র আল কুরআনে ঘোষণা করেন,

لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ.

অর্থ : অবশ্যই আমি মানুষকে সর্বাধিক সুন্দর অবয়বে সৃষ্টি করেছি। (‘সূরা তীন’- ৪)

আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে জ্ঞান, ক্ষমতা শক্তি, বাক শক্তি, শ্রবণ শক্তি, দৃষ্টি শক্তি, কৌশল ক্ষমতা এবং প্রতিভা শক্তিসহ নানা বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন। এগুলো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা‘আলার গুণাবলী। আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় গুণাবলী থেকে অতি সামান্য পরিমাণ গুণ মানুষকে দান করেছেন। মহামহিমের সামান্য গুণের সংস্পর্শ পেয়ে মানুষ লাভ করেছে সর্ব শ্রেষ্ঠত্বের চাবিকাঠি। সর্বশ্রেষ্ঠ এ মানব সৃষ্টির মাঝে কেউ পুরুষ, কেউ নারী, কেউ সাদা, কেউ কালো, কেউ দুর্বল, কেউ সবল। আবার কারো সর্বাঙ্গ সুস্থ, সবল, কার্যকর; কারো আবার কোন অঙ্গ অসুস্থ, দুর্বল, অকার্যকর। আল্লাহ তা‘আলা কাউকে এ সমস্যা জন্মগতভাবে দিয়েছেন, আবার কেউ দুর্ঘটনার কারণে এ সমস্যায় নিপতিত হয়েছে। এ সবই আল্লাহ তা‘আলার শক্তি-ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। মানুষ হিসেবে আল্লাহর নিকট নারী-পুরুষ, দুর্বল-সবল প্রতিবন্ধী-সুস্থ সবাই সমান। একে অপরের উপর নেই কোন শ্রেষ্ঠত্ব। কেবল তাকওয়াকেই আল্লাহ তা‘আলা শ্রেষ্ঠত্বের মানদ- নির্ধারণ করেছেন। পবিত্র কুরআনে তিনি ঘোষণা করেছেন,

إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ.

অর্থ : নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট সেই সর্বাধিক সম্মানিত যে সর্বাধিক পরহেজগার এবং খোদাভীরু। (‘সূরা হুজুরাত’- ১৩)

ইসলামের দৃষ্টিতে একজন মুমিন, মুত্তাকী, পরহেজগার প্রতিবন্ধী সহস্র কাফের-ফাসেক ও মুত্তাকী নয় এমন সুস্থ-সবল মানুষ হতে উত্তম।

আমরা মানব সমাজের সদস্য। প্রতিবন্ধীরা আমাদের সমাজেরই একটি অংশ। তারা আমাদেরই কারো প্রিয় সন্তান, কারো ভাই, কারো বোন, কারো বন্ধু বা কারো আপনজন। সুদূর প্রাচীন কাল হতে প্রতিবন্ধীরা সমাজের অংশ হয়ে বসবাস করলেও তারা সমাজ বা রাষ্ট্রের অন্য সাধারণ মানুষের মত সুবিধাপ্রাপ্ত নয়; বরং তারা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। প্রাচীন সমাজে প্রতিবন্ধীরা নানাভাবে লাঞ্ছিত, অপমানিত হতো। এমনকি কোনো কোনো সমাজে তারা মানুষ হিসেবেও গণ্য হতো না। সভ্যতার দাবিদার প্রাচীন গ্রীক সমাজে প্রতিবন্ধীরা ছিলো বড়োই অসহায়। গ্রীক দার্শনিক এরিস্টেটল বলেন, ‘প্রতিবন্ধীদেরকে শিক্ষা দেয়া অসম্ভব’। দার্শনিক প্লেটো প্রতিবন্ধীদেরকে তার শহর থেকে বের করে দেয়ার মত প্রকাশ করেছিলেন। সম্প্রতিকালে সমাজ ব্যবস্থা প্রতিবন্ধীদের উপর বড়োই অবিচার করেছে। তাদের মতে আদর্শ রাষ্ট্র গঠনে প্রতিবন্ধীরা প্রতিবন্ধক।

যখন প্রতিবন্ধীরা সমাজে এমন দুর্ভোগ, অসহায়, অধিকার বঞ্চিত হয়ে পড়েছিলো, তখনই মানবতার মুক্তির পয়গাম ইসলাম এসে প্রতিবন্ধীদেরকে নির্যাতন নিপীড়ন থেকে রক্ষা করে। তাদের অধিকার রক্ষায় যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করে। তাদেরকে দেয় অনন্য এবং বিরল সম্মাননা। ফলে প্রতিবন্ধীরাও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রতিযোগিতায় যোগ্যতার সাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়। ইসলামী ইতিহাসে যার অগণিত উপমা বিদ্যমান।

বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রীয়ভাবে আইন করা হচ্ছে। হচ্ছে বিভিন্ন সংগঠন, মিছিল-মিটিং, বক্তৃতা-সেমিনার এবং প্রতিবন্ধী দিবস পালন। তারপরও দেখা যাচ্ছে প্রতিবন্ধীরা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের অধিকার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হলে নববী আদর্শের বিকল্প নেই। ইসলাম যে নিয়মে তাদেরকে প্রকৃত সম্মান ও ন্যায্য অধিকার প্রদান করেছে, একমাত্র সে নিয়মেই প্রতিবন্ধীদের প্রকৃত অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। বক্ষমান প্রবন্ধটিতে সে বিষয়গুলো ফুটিয়ে তোলা হবে ইনশাআল্লাহ।

প্রতিবন্ধীর সংজ্ঞা

প্রতিবন্ধী শব্দের আভিধানিক অর্থ বাধাযুক্ত, বাধাজনক, বিকলাঙ্গ, বিকল, অক্ষম, ক্ষমার্হ, দৈহিক শক্তির একান্ত অভাব বা অঙ্গহানী হেতু যাহারা আশৈশব বাধাপ্রাপ্ত, মূক, বধির, অন্ধ, খঞ্জ। (বাংলা সংসদ; পৃষ্ঠা ৩৮২, বাংলা একাডেমি, ব্যবহারিক বাংলা অভিধান; পৃষ্ঠা ৭৮০)

আরবী ভাষায় প্রতিবন্ধী অর্থে الأعرج، الزمن، المعذور، المقعد، المصاب بداء القعاد প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়। (আলমু’জামুল ওয়াসিত; পৃষ্ঠা ৭৭৬)

ইংরেজিতে প্রতিবন্ধী অর্থে Impeded, Hindered, Obitructing, Handcapped, Autism ইত্যাদি শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়।

পরিভাষায় প্রতিবন্ধী বলা হয়, দেহের কোনো অংশ বা তন্ত্র আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ক্ষণস্থায়ী বা চিরস্থায়ীভাবে তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলা। (উইকিপিডিয়া; বাংলা)

বিখ্যাত আরবী অভিধান আলমুগরিব-এ প্রতিবন্ধীর সংজ্ঞা করা হয়েছে এভাবে,

المُقْعَد الذي لا حَراك به من داءٍ في جسدِهِ كأنَّ الداء اقْعده وعند الأطباء هو الزَّمِنُ وبعضهم فرَق فقال المُقْعد المُتشنّج.

(আলমুগরিব ফী তারতীবিল মু’রিব ২/১৮৮)

তাজুল আরূস নামক অভিধানে উল্লেখ করা হয়েছে,

المقعد الذي لا يقدر على القيام لزمانة به كأنه قد ألزم القعود.

(তাজুল আরূস ৯/১৫৪)

প্রতিবন্ধীদের একটি অংশ অটিজম বা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। Autism Enplaning the Enigma নাম গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে,

Autism বা Autistic শব্দটি গ্রীক শব্দ Autos থেকে এসেছে। Autos শব্দের অর্থ হলো আত্ম বা নিজ সম্পর্কিত। (Autism Enplaning the Enigma; পৃষ্ঠা ৫)

অটিজম শিশুর মানসিক পীড়া বিশেষ। এই পীড়ায় আক্রান্ত শিশুরা অস্বাভাবিকভাবে নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকে। আত্মসংবৃত্তি। (বাংলা একাডেমি, ইংলিশ বাংলা ডিকশনারি; পৃষ্ঠা ৫০)

বস্তুত অটিজম শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ জনিত সমস্যাই হলো অটিজম। মাতৃগর্ভ থেকে শিশুর জন্ম পর্যন্ত কোনো পর্যায়ে শিশুর মস্তিষ্ক ঠিকমতো বিকশিত না হলে অটিজম দেখা দেয়। শিশু নিজের কাজ নিজে করতে পারে না। ঠিক সময়ে কথা বলতে পারে না। আচার-আরচণে অপরিপক্ক হয়। আলোর সংস্পর্শ পেলে পালাতে চেষ্টা করে। ডাকলে সাড়া দেয় না। কারো চোখে চোখ রাখে না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এগুলো অটিজমের লক্ষণ।

প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণ

শারীরিক, শ্রবণ, বাক, বুদ্ধি ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের দেহের একটি অংশ জন্মগতভাবে অকেজো হয়ে থাকে। অনেক শিশু প্রতিবন্ধী হয়েই জন্মগ্রহণ করে। জন্মের পর পরই তাদের প্রতিবন্ধিতা প্রকাশমান থাকে। জন্মের পর পরই কোনো কোনো শিশুর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধিতা প্রকাশ পায় না; বেশ কয়েক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রকাশ পায়। বিশেষ করে অটিজম বা বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের প্রতিবন্ধীতা ক্রমাগত প্রকাশ পেতে থাকে।

দুর্ঘটনা জনিত বিকলাঙ্গরাও প্রতিবন্ধীদের অন্তর্ভুক্ত। পৃথিবীর সব দেশেই দুর্ঘটনা জনিত প্রতিবন্ধী রয়েছে। বিশেষ করে যুদ্ধাক্রান্ত দেশগুলোতে এদের সংখ্যা প্রচুর।

গর্ভাবস্থায় মায়ের দৈহিক কোনো ঘাটতি, পুষ্টি বা অসুস্থতা, জন্মের পর বেড়ে উঠার সময় অপুষ্টি, রোগাক্রান্ত হওয়া, সড়ক দুর্ঘটনা প্রভৃতি কারণসহ পিতা-মাতার অমনোযোগ ও অযতেœর কারণেও শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হতে পারে। এগুলোও শিশুর প্রতিবন্ধী হয়ে বেড়ে উঠার অন্যতম কারণ হিসেবে পরিগণিত। আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেন,

هُوَ الَّذِي يُصَوِّرُكُمْ فِي الْأَرْحَامِ كَيْفَ يَشَاءُ.

অর্থ : তিনিই মাতৃগর্ভে যেভাবে ইচ্ছা তোমাদের আকৃতি গঠন করেন। (‘সূরা আলে ইমরান’- ৬)

প্রতিবন্ধী জন্মের রহস্য

অস্বাভাবিক মানব বা প্রতিবন্ধী সৃষ্টির প্রকৃত রহস্য সম্বন্ধে আল্লাহ তা‘আলাই ভালো জানেন। যেহেতু তিনিই এর সৃষ্টিকর্তা। তবে সমাজে প্রতিবন্ধী জন্ম সম্পর্কে বিভিন্ন কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। অজ্ঞতাবশত মানুষ কখনো এর জন্য স্রষ্টাকে দায়ী করে থাকে। অথচ আল্লাহ তা‘আলা মহাগ্রন্থ কুরআনে কারীমে ইরশাদ করেন,

سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُونَ.

অর্থ : আপনার প্রতিপালক যিনি ক্ষমতার মালিক, তারা যা বলে তিনি তা হতে পবিত্র। (‘সূরা সাফ্ফাত’- ১৮০)

তবে কুরআন ও হাদীসের আলোকে বুঝা যায়, প্রতিবন্ধী সৃষ্টিতে আল্লাহ তা‘আলার মহান রহস্য নিহিত রয়েছে। (ক) মানুষ যেন মহান আল্লাহর একচ্ছত্র ক্ষমতা সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারে। তিনি যেমন স্বাভাবিক করতে সৃষ্টি পারেন, তেমনি অস্বাভাবিকও সৃষ্টি করতে পারেন। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে,

يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ.

অর্থ : তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। (‘সূরা শূরা’- ৪৯)

পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَيَجْعَلُ مَنْ يَشَاءُ عَقِيمًا.

অর্থ : তিনি (আল্লাহ) যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। (‘সূরা শূরা’- ৫০)

(খ) অপ্রতিবন্ধীরা যেন স্বীয় স্বাভাবিক জন্মের জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করে এবং এ বিষয়টি অনুভব করে যে, আল্লাহ চাইলে তাকেও প্রতিবন্ধী বানাতে পারতেন। অথবা আল্লাহ যাকে এই আপদ হতে নিরাপদ রেখেছেন সে যেন নিজের প্রতি আল্লাহর দয়া ও অনুকম্পা স্মরণ করে। কারণ আল্লাহ চাইলে তার ক্ষেত্রেও এমনটি করতে পারতেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَاشْكُرُوا لِي وَلَا تَكْفُرُونِ.

অর্থ : এবং তোমরা আমার কৃতজ্ঞতা আদায় কর, অকৃতজ্ঞ হয়ো না। (‘সূরা বাকারা’- ১৫২)

(গ) প্রতিবন্ধীকে আল্লাহ তা‘আলা এই বিপদের বিনিময়ে তাঁর দয়া, সন্তুষ্টি, ক্ষমা এবং জান্নাত দিতে চান। হযরত আবু হুরাইরা রাযি. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

يقول الله عز وجل من أذهبت حبيبتيه فصبر واحتسب لم أرض له ثوابا دون الجنة.

অর্থ : আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, আমি যার দুই প্রিয়কে (চক্ষুদ্বয়) নিয়ে নিই অতঃপর সে ধৈর্য ধারণ করে এবং সওয়াবের আশা করে। তাহলে আমি তার জন্য এর বিনিময়ে জান্নাত ব্যতীত অন্য কিছুতে সন্তুষ্ট হই না। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ২৪০১)

তাই ইসলামের শিক্ষা হলো, প্রতিবন্ধী যেন নিজের অক্ষমতার উপর ধৈর্য ধারণ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করে পরকালে জান্নাত অর্জন করে নেয়।

প্রতিবন্ধীদের প্ররিসংখ্যান

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা WHO -এর হিসেব মতে সমগ্র পৃথিবীতে মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০% মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার। যুদ্ধাক্রান্ত দেশগুলোতে এ সংখ্যা আরো বেশি। WHO -এর হিসেব মতে শুধু বাংলাদেশেই প্রায় ৩০ লক্ষ প্রতিবন্ধী বাস করে। প্রতিবন্ধীদের বিভিন্ন সংগঠনের হিসেব অনুযায়ী এদেশে প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা আরো বেশি। কেননা আমাদের সমাজে বুদ্ধি, বাক, শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধীর বসবাস রয়েছে।

এছাড়া এক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, শিশুদের অটিজমে আক্রান্তের হার উদ্বেগজনক ভাবে বেড়ে চলেছে। বিশ্ব জুড়ে বাড়ছে এ সমস্যার ব্যাপ্তি। আন্তর্জাতিক তথ্য উপাত্তে বলা হচ্ছে, মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে অটিজম আক্রান্ত শিশুর হার ৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে। ছেলে শিশুদের মাঝে অটিজমে আক্রমণ সাড়ে চার গুণ বেশি।। জন স্বাস্থ্যের সংকট নিয়ে গবেষণায় নিয়োজিত বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সংস্থা ‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল’ (CDC) বলছে, শিশু স্বাস্থ্যের এ সমস্যা রুখতে হবে। স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, বাংলাদেশে অটিজম পরিস্থিতি খুব বেশি ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়। বিস্তৃত পরিসরে অনুসন্ধান চালালে এদেশে অটিজমের শিকার অনেক শিশু সনাক্ত হবে।

লিঙ্গ প্রতিবন্ধীদের পরিসংখ্যান

সমাজে লিঙ্গ প্রতিবন্ধীদের সংখ্যাও অনেক। এদের সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের কাছেও নেই। তবে হিজড়া আইন-২০১৩ পাশ করার সময় তাদের সংখ্যা দশ হাজার উল্লেখ করা হয়। হিজড়াদের সংগঠন ‘বন্ধু সোস্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি, সূত্রে জানা যায়, দেশে ১০ বা ১৫ হাজার হিজড়া আছে। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার দাবী, সারা দেশে ৫০ হাজার হিজড়া আছে। শুধু ঢাকা শহরেই ২৫ হাজার হিজড়ার বসবাস।

সমাজ এবং রাষ্ট্রে প্রতিবন্ধীদের অবস্থান

আমাদের সামাজিক অবকাঠামো এবং রাষ্ট্রীয় আইন প্রয়োগিক ক্ষেত্রে দুর্বলতার দরুণ প্রতিবন্ধীরা সমাজে বড়োই অবহেলিত। পথে-ঘাটে বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত প্রতিবন্ধীরা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়। অনেক সময় দেখা যায় প্রতিবন্ধী শিশুটিকে অন্যরা উত্যক্ত করে, নানাভাবে কষ্ট দেয়। প্রায়ই দেখা যায়, প্রতিবন্ধী শিশুর অভিভাবক তার শিশুকে অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুর সাথে মিশতে দিতে চায় না। সে আশঙ্কা করে, তার প্রতিবন্ধী সন্তানকে নিয়ে অন্য শিশুরা দুষ্টুমি করবে। অথবা প্রতিবন্ধী শিশুটি কারো কোনো ক্ষতি করে ফেলবে। অথবা সে নিজেই কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পড়বে।

প্রতিবন্ধী তৈরির নোংরা খেলা

কিছুদিন পূর্বে একটি দৈনিক পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। তাতে উল্লেখ করা হয়, রাজধানী ঢাকায় একটি চক্র দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছোটো বাচ্চাদেরকে ধরে এনে অন্যায়ভাবে নির্যাতন-নিপীড়ন করে। তাদের অঙ্গহানি করে। শিকলে বেঁধে রাখে দিনের পর দিন। ভালো শিশুদের কৃত্রিমভাবে প্রতিবন্ধী বানিয়ে দেয়। পরে ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য করে। এ অন্যায় কর্মে এক শ্রেণীর সামাজিক নেতারাও জড়িত।

রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবন্ধী রক্ষা আইন থাকলেও প্রয়োগিক ক্ষেত্রে তেমন কোনো সাড়া নেই। যে কারণে প্রতিবন্ধীরা বিভিন্ন ধরনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়। যারা অন্যায়ভাবে কিডন্যাপ করে ভালো শিশুদের প্রতিবন্ধী বানিয়ে দেয় তারাও আইনী দুর্বলতার দরুণ আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেরিয়ে যায়। এ কারণে তাদের এ অপকর্ম দিন দিন বেড়েই চলছে।

লিঙ্গ প্রতিবন্ধী তথা হিজড়াদেরও সমাজে ভালো অবস্থান নেই। তারা সামাজিকভাবে অবহেলিত। সামাজিক সাধারণ কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে অস্বাচ্ছন্দবোধ করে। পথে-ঘাটে, বাসা-বাড়িতে, যানবাহনে তারা দলবদ্ধভাবে চাঁদাবাজি করে। এছাড়াও তারা বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছে।

সামাজিকভাবে তাদের যতœ নেয় হলে তাদের নায্য অধিকারগুলো আদায় করা হলে তারাও সুষ্ঠু সমাজ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। প্রয়োজন শুধু তাদের অধিকার বাস্তবায়ন করা এবং আমাদের উচিৎ তাদের প্রতি যতœশীল হওয়া।

ইসলামে প্রতিবন্ধীর গুরুত্ব ও মর্যাদা

ড. আব্দুল্লাহ নাসেহ উলওয়ান তাকাফুল ইজতিমা ফিল ইসলাম নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, প্রতিবন্ধীর প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি পাশ্চাত্য চিন্তাধারা হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এসব শারীরিক অক্ষম ও প্রতিবন্ধীরা রাষ্ট্র, সমাজ ও ধনীদের থেকে সাহায্য-সহযোগিতা, ভালোবাসা ও দয়া অনুগ্রহ লাভ করবে। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে,

عن عبد الله بن عمرو قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم الراحمون يرحمهم الرحمن ارحموا من في الارض يرحمكم من في السماء الرحم شجنة من الرحمن فمن وصلها وصله الله ومن قطعها قطعه الله.

অর্থ : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ দয়ালুদের উপর দয়া ও অনুগ্রহ করেন। যারা পৃথিবীতে বসবাস করে তাদের উপর তোমরা দয়া কর, তাহলে যিনি ঊর্ধ্বাকাশে আছেন তিনি তোমাদের উপর দয়া করবেন। ‘রহীম’ শব্দটি রহমান হতে উদগত। যে ব্যক্তি দয়ার সম্পর্ক বজায় রাখে, আল্লাহ তার সাথে নিজ সম্পর্ক বজার রাখেন। যে ব্যক্তি দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করে, আল্লাহও তার সাথে দয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করেন। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ১৯২৪)

হযরত নু’মান ইবনে বশীর রাযি. হতে বর্ণিত,

قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ترى المؤمنين في تراحمهم وتوادهم وتعاطفهم كمثل الجسد إذا اشتكى عضوا تداعى له سائر جسده بالسهر والحمى.

অর্থ : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তুমি মুমিনদেরকে পারস্পরিক দয়া, ভালোবাসা ও সহানুভূতি প্রদর্শনে একটি দেহের ন্যায় দেখতে পাবে। যখন দেহের একটি অঙ্গ রোগাক্রান্ত হয় তখন শরীরের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রাত্রি জাগরণ এবং তাপ-উত্তাপে তার সমব্যথী হয়। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৬০১১)

আমরা এ কথা নির্দ্বিধায় দাবী করতে পারি যে, ইসলামের ছায়াতলে প্রতিবন্ধীরা সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। তাদের মাঝে অনেকেই বিখ্যাত আলেম ও মুহাদ্দিস ছিলেন। যেমন আমর ইবনে আখতার আলআ’রাজ, আব্দুর রহমান আলআসাম ও আ’মাশ রহ. সহ প্রমুখ পৃথিবীখ্যাত মনীষীবর্গ।

প্রতিবন্ধীদের প্রতি সম্মান ও সহমর্মিতা প্রদর্শন

عن انس ان امرأة كان في عقلها شئ فقالت يارسول الله ان لي اليك حاجة فقال يا ام فلان انظري أي السكك شئت حتى اقضي لك حاجتك فخلا معها في بعض الطرق حتى فرغت من حاجتها.

অর্থ : হযরত আনাস রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক মহিলার জ্ঞান-বুদ্ধিতে কিছু ত্রুটি ছিল। সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার কাছে আমার কিছু প্রয়োজন রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে অমুকের মা! তুমি কোনো গলি দেখে নাও, আমি তোমার প্রয়োজন পূর্ণ করে দিবো। তারপর তিনি কোনো পথের মাঝে তার সাথে দেখা করলে সে তার প্রয়োজন পূরণ করে নেয়। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ২৩২৬)

অপর এক হাদীসে এসেছে, হযরত আয়েশা রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول إن الله عز وجل أوحى إلي أنه من سلك مسلكا في طلب العلم سهلت له طريق الجنة ومن سلبت كريمتيه أثبته عليهما الجنة.

অর্থ : আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি। তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা আমার নিকট ওহী পাঠিয়েছেন, যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণের পথে চলবে আল্লাহ তার জান্নাতের পথ সহজ করে দিবেন। আর আমি (আল্লাহ) যার দুই প্রিয় জিনিস (চক্ষুদ্বয়) নিয়ে নিই, তার বিনিময়ে আমি তাকে জান্নাত দান করবো। (ইমাম বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান; হা.নং ৫৩৬৭)

ইসলাম তাদের জন্য অনেক কঠিন কাজ সহজ করে দিয়েছে। তাদের কষ্ট লাঘব করে দিয়েছে। হাদীসে এসেছে,

أن زيد بن ثابت أخبره أن رسول الله صلى الله عليه وسلم أملى عليه (لا يستوي القاعدون من المؤمنين والمجاهدون في سبيل الله) قال فجاءه ابن أم مكتوم وهو يملها علي فقال يا رسول الله لو أستطيع الجهاد لجاهدت وكان رجلا أعمى فأنزل الله تبارك وتعالى على رسوله صلى الله عليه وسلم وفخذه على فخذي فثقلت علي حتى خفت أن ترض فخذي ثم سري عنه فأنزل الله عز وجل (غير أولي الضرر).

অর্থ : হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উপর অবতীর্ণ আয়াত (মুসলমানদের মধ্যে যারা ঘরে বসে থাকে এবং যারা আল্লাহর পথে জিহাদ করে, তারা পরস্পরে সমান নয়। ‘সূরা নিসা’- ৯৫) যখন তাকে দিয়ে লিখিয়ে ছিলেন, ঠিক সেই সময় অন্ধ (সাহাবী) ইবনে উম্মে মাকতুম রাযি. সেখানে উপস্থিত হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি জিহাদে যেতে সক্ষম হতাম তাহলে অবশ্যই অংশগ্রহণ করতাম। সেই সময় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলের উপর ওহী অবতীর্ণ করলেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উরু আমার উরুর উপর রাখা ছিল এবং তা আমার কাছে এতো ভারী মনে হচ্ছিল যে, আমি আমার উরু ভেঙ্গে যাওয়ার আশঙ্কা করছিলাম। এ সময় আল্লাহ তা‘আলা (غير أولي الضرر) আয়াতাংশটি অবতীর্ণ করেন। (সহীহ বুখারী; হা.নং ২৮৩২, সহীহ মুসলিম; হা.নং ১৮৯৮)

হযরত আয়েশা রাযি. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

رفع القلم عن ثلاثة عن النائم حتى يستيقظ وعن الصبى حتى يشب عن المعتوه حتى يعقل.

অর্থ : তিন ব্যক্তি হতে কলম উঠিয়ে রাখা হয়েছে, ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না সে জাগ্রত হয়, নাবালেগ যতক্ষণ না সে বালেগ হয়, পাগল যতক্ষণ না সে জ্ঞান ফিরে পায় বা সুস্থ হয়। (সুনানে আবু দাউদ; হা.নং ৪৪০৩, সুনানে ইবনে মাজাহ; হা.নং ২০৪১, জামে তিরমিযী; হা.নং ১৪২৩)

অন্ধলোককে পথ না দেখিয়ে বিপথগামী করা, তাদেরকে অনর্থক কষ্ট দেয়া ও উপহাস করা থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন,

ملعون من كمه أعمى عن طريق.

অর্থ : সে ব্যক্তি অভিশপ্ত যে অন্ধকে পথ ভুলিয়ে দেয়। (¬মুসনাদে আহমাদ; হা.নং ১৮৭৫)

প্রতিবন্ধীদের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দয়া আরো স্পষ্ট হয়, যখন তিনি তাদের কষ্ট লাঘবের সান্ত¡না ও বিপদে ধৈর্য ধারণের জন্য দু‘আর প্রচলন করেছেন। এতে তাদের মনের শক্তি ও চেতনা বৃদ্ধি পায়। হযরত উসমান ইবনে হুনাইফ রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

أن رجلا ضرير البصر أتى النبي صلى الله عليه و سلم فقال ادع الله أن يعافيني فقال إن شئت أخرت لك وهو خير وإن شئت دعوت فقال ادعه فأمره أن يتوضأ فيحسن وضوءه ويصلي ركعتين ويدعو بهذا الدعاء اللهم إني أسألك وأتوجه إليك بمحمد نبي الرحمة يا محمد إني قد توجهت بك إلى ربي في حاجتي هذه لتقضى اللهم فشفعه في.

অর্থ : এক অন্ধ লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বললো, আপনি আল্লাহর নিকট আমার জন্য দু‘আ করুন, তিনি যেন আমাকে রোগমুক্তি দান করেন। তিনি বললেন, তুমি চাইলে আমি তোমার জন্য দু‘আ করতে বিলম্ব করবো, আর তা হবে কল্যাণকর। আর তুমি চাইলে আমি এখনই দু‘আ করবো। সে বললো, আপনি এখনই তাঁর নিকট দু‘আ করুন। তিনি তাকে উত্তমরূপে উযূ করার পর দু’ রাকাআত নামায আদায় করে এ দু‘আ করতে বলেন, হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করছি, রহমতের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে আমি তোমার প্রতি নিবিষ্ট হলাম। হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! আমার চাহিদা পূরণের জন্য আমি আপনার মাধ্যমে আমার রবের প্রতি মনোযোগী হলাম, যাতে আমার প্রয়োজন মিটে। হে আল্লাহ! আমার জন্য তাঁর সুপারিশ কবুল করুন। (সুনানে ইবনে মাজাহ; হা.নং ১৫১২)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমর ইবনে জামূহ রাযি. কে সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে বলেছিলেন,

سيدكم الأبيض الجعد عمرو بن الجموح وكان أعرج.

অর্থ : তোমাদের সরদার হলো ফর্সা ও কোকড়া চুলের অধিকারী আমর ইবনে জামূহ। আর সে ছিলো বিকলাঙ্গ। (মা’রিফাতুস সাহাবা ১৪/১৫৫)

হযরত আবু কাতাদা রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

عن أبي قتادة أنه حضر ذلك قال أتى عمرو بن الجموح إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال يا رسول الله أرأيت إن قاتلت في سبيل الله حتى أقتل أمشي برجلي هذه صحيحة في الجنة وكانت رجله عرجاء قال رسول الله صلى الله عليه وسلم نعم فقتلوا يوم أحد هو وابن أخيه ومولى لهم فمر عليه رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال كأني أنظر إليك تمشي برجلك هذه صحيحة في الجنة فأمر رسول الله صلى الله عليه وسلم بهما وبمولاهما فجعلوا في قبر واحد.

অর্থ : একবার আমর ইবনে জামূহ রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি যদি আল্লাহর পথে জিহাদ করে শহীদ হই, তাহলে কি আমি জান্নাতে সুস্থ স্বাভাবিক পায়ে হাঁটতে পারবো? তার পা পঙ্গু ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ। উহুদের যুদ্ধে তিনি, তার ভাতিজা ও তাদের একজন আযাদকৃত গোলাম শহীদ হন। তার পাশ দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাওয়ার সময় তাকে লক্ষ্য করে বললেন, আমি যেন তোমাকে জান্নাতে সুস্থ স্বাভাবিক পায়ে হাঁটতে দেখছি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের দু’জনকে ও গোলামকে একই কবরে দাফন করতে আদেশ দিলেন। সাহাবায়ে কেরাম তাদেরকে এক কবরে সমাহিত করেন। (মুসনাদে আহমদ; হা.নং ২২৫৫৩)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্ধ প্রতিবন্ধী সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রাযি. কে মদীনায় অস্থায়ী শাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। হযরত আনাস রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

أن رسول الله صلى الله عليه وسلم استخلف ابن أم مكتوم على المدينة مرتين يصلي بهم وهو أعمى.

অর্থ : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবনে উম্মে মাকতুম রাযি. কে মদীনায় দুইবার তাঁর স্থলাভিসিক্ত করে যান। তিনি অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও নামাযের উমামতি করতেন। (মুসনাদে আহমাদ; হা.নং ১৩০০০)

ইসলামের খলীফাগণও প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পথ অনুসরণ করেছেন। তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিবন্ধীদের শারীরিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক সব ধরনের প্রয়োজন পূরণ করেছেন। উমরে সানী হিসেবে খ্যাত আমীরুল মুমিনীন উমর ইবনে আব্দুল আযীয রহ. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান উদার নীতি অনুসরণ করে সব প্রদেশে ফরমান জারী করেন যে, সকল অন্ধ, অক্ষম, প্লেগরোগী এবং বিকলাঙ্গসহ প্রতিবন্ধীর সকল পরিসংখ্যান বের করতে হবে। তারা এ সকল লোকের তালিকা খলীফার নিকট পেশ করলে তিনি তাদের দেখা শোনা ও সেবার জন্য প্রত্যেক অন্ধের ক্ষেত্রে একজন সাহায্যকারী নিয়োগ করেন। আর প্রতি দু’জন প্রতিবন্ধীর জন্য একজন সেবক নিয়োগ করেন। এমনিভাবে তিনি সব প্রতিবন্ধীর পরিসংখ্যান বের করেন এবং সবার জন্য সেবক ও সাহায্যকারী নিযুক্ত করেন, যাতে তারা নামাযে উপস্থিত হতে পারে।

একই কাজ উমাইয়া খলীফা ওয়ালিদ ইবনে আব্দুল মালিকও করেছেন। তিনি সর্বপ্রথম প্রতিবন্ধীদের দেখা শোনার জন্য বিশেষ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সেবাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। এতে তিনি ডাক্তার ও সেবক নিয়োগ করেন। তাদের জন্য বেতনের ব্যবস্থা করেন। প্রতিবন্ধীদের নিয়মিত ভাতা প্রদান করেন। তিনি তাদেরকে বলতেন, তোমরা মানুষের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করবে না। এভাবে তিনি তাদেরকে মানুষের নিকটে হাত পাতার লাঞ্ছনা থেকে মুক্ত করেন। সব অক্ষম, পঙ্গু ও অন্ধদের জন্য সেবক নিযুক্ত করেন।

মামালিকদের যুগে সুলতান ক্বালাউন প্রতিবন্ধীদের জন্য হাসপাতাল নির্মাণ করেন। এতে প্রতিবন্ধী রোগীরা বিশেষ চিকিৎসা সেবা পেত। রোগীর চিকিৎসা শেষে বিশেষ ভাতা দেয়া হতো, যাতে তারা সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভের পূর্ব পর্যন্ত নিজেদের ব্যয় নির্বাহ করতে পারে।

শরয়ী বিধান পালনে প্রতিবন্ধীদেরকে শিথিলতা প্রদান

মহান স্রষ্টা আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টির প্রতি অত্যন্ত দয়াশীল। এজন্য তিনি কাউকে তাঁর সাধ্যাতীত শরয়ী বিধান পালন করতে আদেশ করেননি। তিনি পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন,

لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا.

অর্থ : আল্লাহ তা‘আলা কাউকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না। (‘সূরা বাকারা’- ২৮৬)

এই আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ঐ সকল বান্দাদের ব্যাপারে ছাড় দিয়েছেন, যারা শরয়ী বিধান পালনে অক্ষম। অপর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা স্পষ্ট ঘোষণা করেন,

لَيْسَ عَلَى الْأَعْمَى حَرَجٌ وَلَا عَلَى الْأَعْرَجِ حَرَجٌ وَلَا عَلَى الْمَرِيضِ حَرَجٌ.

অর্থ : অন্ধের জন্য দোষ নেই, খঞ্জের জন্য দোষ নেই, রুগ্নের জন্য দোষ নেই। (‘সূরা নূর’- ৬১)

উক্ত আয়াদের ব্যাখ্যায় তাফসীরে ইবনে কাসীর গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে,

প্রাক ইসলামী যুগে অন্ধ, খঞ্জ, কুষ্ঠ (প্রতিবন্ধী) রোগীরা সুস্থ মানুষদের সাথে একত্রে খেতে অস্বস্তিবোধ করতো। এমনকি সুস্থ লোকেরাও প্রতিবন্ধীদের সাথে একত্রে খেতে অস্বস্তিবোধ করতো। আল্লাহ তা‘আলা এই বৈষম্য দূর করার জন্য উক্ত আয়াত নাযিল করেন এবং আদেশ করেন প্রতিবন্ধীদের সাথে একত্রে খেতে কোন সমস্যা নেই। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ৬/৯৭)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

لَيْسَ عَلَى الضُّعَفَاءِ وَلَا عَلَى الْمَرْضَى وَلَا عَلَى الَّذِينَ لَا يَجِدُونَ مَا يُنْفِقُونَ حَرَجٌ.

অর্থ : দুর্বল, রুগ্ন, ব্যয়ভার বহনে অসমর্থ লোকদের জন্য কোনো অপরাধ নেই। (‘সূরা তাওবা’- ৯১)

আল্লামা কুরতুবী রহ. তার বিখ্যাত গ্রন্থ আলজামে লি আহকামিল কুরআন-এ উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখেন,

(لَيْسَ عَلَى الضُّعَفَاءِ) الآية. أصل في سقوط التكليف عن العاجز فكل من عجز عن شيء سقط عنه.

অর্থ : لَيْسَ عَلَى الضُّعَفَاءِ আয়াতটি (শরয়ী বিধান) পালনে অক্ষম ব্যক্তি থেকে (বিধান) রহিত করার মূলনীতি। সুতরাং যে ব্যক্তি যে বিধান পালনে অক্ষম হয়ে যাবে, সে বিধান তার থেকে রহিত হয়ে যাবে। (তাফসীরে কুরতুবী ৪/৫৪৮)

উক্ত আয়াত ইরশাদ করে আল্লাহ তা‘আলা প্রতিবন্ধীদেরকে শরয়ী বিধান পালনের ব্যাপারে ছাড় দিয়েছেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

رفع القلم عن ثلاثة عن النائم حتى يستيقظ وعن الصبى حتى يشب وعن المعتوه حتى يعقل.

অর্থ : তিন ব্যক্তি থেকে কলম উঠিয়ে রাখা হয়েছে। ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না সে জাগ্রত হয়, শিশু যতক্ষণ না সে প্রাপ্ত বয়স্ক হয়, পাগল যতক্ষণ না সে সুস্থ জ্ঞানসম্পন্ন হয়। (সুনানে আবু দাউদ; হা.নং ৪৪০৩, সুনানে তিরমিযী; হা.নং ১৪২৩)

ইসলামের মৌলিক বিধান পাঁচটি : (১) কালেমায়ে শাহাদাত (ঈমান), (২) নামায আদায়, (৩) রোযা পালন, (৪) হজ পালন ও (৫) যাকাত আদায়। ইসলাম প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে মৌলিক পাঁচটি বিধান পালন করার ক্ষেত্রে তার সক্ষমতা অনুযায়ী নির্দেশ প্রদান করেছে। প্রতিবন্ধী যতটুকু বিধান পালন করতে সক্ষম ততটুকু বিধান পালন করা তার উপর ফরয। প্রতিবন্ধীর জন্য শরয়ী বিধান পালনের পদ্ধতি কি হবে, ইসলাম তাও বলে দিয়েছে। নিম্নে প্রধান পাঁচটি বিধানের ব্যাপারে প্রতিবন্ধীদের করণীয় উল্লেখ করা হল-

(১) কালেমায়ে শাহাদাত : মৌখিকভাবে ঈমানের স্বীকারোক্তি। কালেমায়ে শাহাদাত মুখে উচ্চারণ করা এবং অন্তরে বিশ্বাস করার নাম হলো ঈমান। এ ছাড়া কোন ব্যক্তি মুসলিম হতে পারে না। মূক-বোবার ক্ষেত্রে ঈমানের বাক্য ‘কালেমায়ে শাহাদাত’ উচ্চারণ করা সম্ভব নয়। ইসলামের বিধান হলো, বোবা ব্যক্তি ইশারা-ইঙ্গিতের মাধ্যমে এ কথার সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ এক, তিনি ছাড়া কোন প্রভু নেই, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা এবং রাসূল। (আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুওয়াইতিয়্যাহ ১৯/৯২)

ঈমানে ক্ষেত্রে পাগলের বিধান শিশুর মতো। তার পিতা-মাতা মুসলিম হলে সে মুসলিম হিসেবে গণ্য হবে। আর তার পিতা-মাতা অমুসলিম হলে সে অমুসলিম হিসেবে গণ্য হবে। এমনকি পাগলের স্ত্রী ইসলাম গ্রহণ করলে পাগলের পিতার নিকট ইসলাম পেশ করা হবে। যদি সে ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে পাগল মুসলিম হিসেবে গণ্য হবে এবং তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক পূর্বের ন্যায় বহাল থাকবে। আর পাগলের পিতা ইসলাম গ্রহণ না করলে তাদের মাঝে বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। কেননা হাদীসে এসেছে, رفع القلم عن ثلاثة عن النائم حتى يستيقظ وعن الصبى حتى يشب عن المعتوه حتى يعقل. (অর্থ) তিন ব্যক্তি থেকে কলম উঠিয়ে রাখা হয়েছে। ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না সে জাগ্রত হয়, শিশু যতক্ষণ না সে প্রাপ্ত বয়স্ক হয়, পাগল যতক্ষণ না সে সুস্থ জ্ঞানসম্পন্ন হয়। সুনানে আবু দাউদ; হা.নং ৪৪০৩, সুনানে তিরমিযী; হা.নং ১৪২৩। (তাইসীরুত তাহরীর ২/৩৬০)

(২) নামায : প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে ইসলাম নামায আদায়ের ক্ষেত্রে তার সক্ষমতার উপর ছেড়ে দিয়েছে। তার নামায আদায়ের পদ্ধতি বলে দিয়েছে। যেমন, মূক ব্যক্তি নামাযে তাকবীরে তাহরীমা এবং কিরাআত মুখে বলতে সক্ষম নয়। তার ক্ষেত্রে বিধান হলো, সে কিয়াম, রুকু, সিজদাসহ নামাযের যাবতীয় আহকাম আদায় করবে। তার অন্তরের নিয়ত তাকবীরে তাহরীমার স্থলাভিসিক্ত হবে। তার উপর নামাযে কিরাআত পড়া ফরয নয়। (মারাকিল ফালাহ; পৃষ্ঠা ১১৯, আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আল কুওয়াইতিয়্যাহ ১৯/৯২)

যদি কোনো ব্যক্তি পূর্ণ একদিন একরাত মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত থাকে তাহলে তার জন্য ঐ দিনের নামায আদায় করা ফরয নয় এবং কাযা আদায় করাও ওয়াজিব নয়। চাই তার মানসিক ব্যাধি অল্প হোক বা বেশি। (সুনানে আবু দাউদ; হা.নং ৪৪০৩, আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আল কুওয়াইতিয়্যাহ ১৬/১০৩)

বুদ্ধি প্রতিবন্ধীর জন্য নামায আদায় করা সতর্কতামূলক ফরয করা হয়েছে। তবে যদি তার প্রতিবন্ধিতা উন্মাদনার পর্যায়ে পড়ে যায় তবে তার উপর থেকে ফরয বিধান রহিত হয়ে যাবে। (আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুওয়াইতিয়্যাহ ১৬/৯৯)

(৩) রোযা : রোযা আল্লাহ তা‘আলার এমন এক বিধান যা অন্ধ, বধির, খঞ্জ ও অন্যান্য প্রতিবন্ধীরাও পালন করতে সক্ষম। অন্য কোনো ওযর না থাকলে তাদের উপরও রোযা রাখা ফরয হবে। তবে মানসিক প্রতিবন্ধী বা পাগল অবস্থায় পূর্ণ একদিন অতিক্রান্ত হলে পাগলের উপর সেদিনের রোযা রাখা ফরয নয়। রোযা রাখা অবস্থায় পাগল হয়ে গেলে সে রোযার বিধান রহিত হয়ে যাবে। (কামূসুল ফিকহ ৩/১৫৭)

(৪) হজ : ইসলামের মৌলিক পালনীয় ফরয বিধানের মধ্য হতে হজও একটি। যে ব্যক্তির মাঝে হজ ফরয হওয়ার শর্তাবলী পাওয়া যাবে তার উপর হজ ফরয। অন্ধ, খঞ্জ, মূক, বধিরসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের মাঝে হজ ফরযের শর্তাবলী পাওয়া গেলে তাদের উপরও হজ ফরয হবে। এক্ষেত্রে বোবা ব্যক্তি মনে মনে তালবিয়া পাঠ করবে এবং ঠোঁট নাড়াবে। (আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আল কুওয়াইতিয়্যাহ ১৯/৯২)

পাগলের উপর হজ ফরয নয়। তবে সুস্থ অবস্থায় হজ ফরয হওয়ার পর পাগল হলে অভিভাবক তার পক্ষ থেকে ইহরাম বাঁধবে এবং হজ আদায় করবে। (আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আল কুওয়াইতিয়্যাহ ১৬/১০৪)

(৫) যাকাত : যাকাত ইসলামের মৌলিক বিধান। নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে অন্ধ, খঞ্জ, বধির, মূক প্রভৃতি প্রতিবন্ধীর উপর যাকাত আদায় ফরয হবে। তবে পাগলের উপর যাকাত আদায় করা ফরয নয়। (সুনানে আবু দাউদ; হা.নং ৪৪০৩, সুনানে তিরমিযী; হা.নং ১৪২৩)

এছাড়া অন্যান্য শরয়ী বিধান পালনের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধীকে ছাড় দেয়া হয়েছে। যেমন, প্রতিবন্ধীদের জন্য জিহাদে যাওয়া ফরয নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

لَيْسَ عَلَى الضُّعَفَاءِ وَلَا عَلَى الْمَرْضَى وَلَا عَلَى الَّذِينَ لَا يَجِدُونَ مَا يُنْفِقُونَ حَرَجٌ.

অর্থ : দুর্বল, রুগ্ন, ব্যয়ভার বহনে অসমর্থ লোকদের জন্য কোনো অপরাধ নেই। (‘সূরা তাওবা’- ৯১)

এমনিভাবে যুদ্ধের ময়দানে প্রতিবন্ধীকে হত্যা করতে ইসলাম নিষেধ করেছে।

প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও ইসলাম

সমাজ ও পরিবারের অন্য সদস্যদের মত প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও ন্যায্য পাওনা সম্পর্কে ইসলাম গুরুত্ব প্রদান করেছে। তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ, স্বাভাবিক ও সম্মানজনক জীবন যাপনের অধিকার রয়েছে। ইসলাম প্রতিবন্ধীদের অধিকার বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ইসলাম প্রতিবন্ধীদের মানবিক মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে মানুষকে কর্তব্য সচেতন হওয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব প্রদান করেছে। কারণ প্রতিবন্ধীরা শারীরিক, মানসিক কিংবা আর্থসামাজিক অক্ষমতা বা অসুবিধার কারণে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে সক্ষম হয় না।

প্রতিবন্ধীর প্রতি দয়া-মায়া, সেবা-যতœ, সুযোগ-সুবিধা ও সাহায্য-সহযোগিতার হাত সম্প্রসারণ করা মুসলমানদের উপর একান্ত কর্তব্য। মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার ন্যূনতম মৌলিক অধিকারগুলো তাদেরও ন্যায্য প্রাপ্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ.

অর্থ : তাদের (বিত্তবানদের) সম্পদে বঞ্চিত ও অভাবীদের অধিকার রয়েছে। (‘সূরা জারিয়াহ’- ১৯)

তাফসীরে তবারীতে বলা হয়েছে, এক যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয়ী হয় এবং গনীমতের সম্পদ লাভ করে। তখন উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গনীমতের সম্পদের একটি অংশ অসহায়, দরিদ্র, প্রতিবন্ধীদের নামে বিলিয়ে দিতে বলেন। (তাফসীরে তবারী ২৬/১৫৮)

হযরত আবু মূসা আশআরী রাযি. হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

أطعموا الجائع وعودوا المريض وفكوا العاني.

অর্থ : তোমরা ক্ষুধার্থকে খাদ্য দাও, অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজ-খবর নাও এবং বন্দি মুক্ত করে দাও। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৫০৫৮, ৫৩২৫)

প্রতিবন্ধী যেমনই হোক সে আল্লাহর সৃষ্টি, আল্লাহর বান্দা। ইসলামের দিক নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের সঙ্গে সাদাচরণ করা, সাহায্য-সহযোগিতা এবং তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়া অবশ্য কর্তব্য। বিপদাপদে প্রতিবন্ধীর পাশে দাঁড়ানো মানবতার দাবী এবং ঈমানী দায়িত্ব। ইসলামের দৃষ্টিতে প্রতিবন্ধী, অসহায়দের সাথে অসদাচরণ বা তাদের সাথে উপহাস, ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ বা ঠাট্টা-মশকারা করা হারাম। এতে আল্লাহর সৃষ্টিকে অপমান করা হয়। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

وَيْلٌ لِكُلِّ هُمَزَةٍ لُمَزَةٍ.

অর্থ : পশ্চাতে এবং সম্মুখে নিন্দাকারীর জন্য দুর্ভোগ। (‘সূরা হুমাযাহ’- ১)

আল্লাহ তা‘আলা আরো ইরশাদ করেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِنْ قَوْمٍ عَسَى أَنْ يَكُونُوا خَيْرًا مِنْهُمْ.

অর্থ : হে মুমিন সকল! কেউ যেন অন্য কাউকে উপহাস না করে। কেননা সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। (‘সূরা হুজুরাত’- ১১)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাউকে উপহাস, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে নিষেধ করেছেন। হযরত আবু হুরাইরা রাযি. হতে বর্ণিত,

بحسب امرئ من الشر أن يحقر أخاه المسلم.

অর্থ : কোন ব্যক্তির নিকট নিকৃষ্ট হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলিম ভাইকে তুচ্ছ দৃষ্টিতে দেখবে। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ২৫৬৪)

প্রতিবন্ধীদের সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশা উপলব্ধি করতে পারে সেই সকল ধর্মপ্রাণ মানুষ, যারা অপরের দুঃখ-বেদনা সহমর্মিতার হাত বাড়ায়।

আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তা‘আলা ভর্ৎসনা করেছেন শুধু অন্ধ সাহাবীর প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করার কারণে। হযরত ইবনে আব্বাস ও হযরত আয়েশা রাযি. হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উতবা ইবনে রবীআহ, আবু জাহল, নবীজীর চাচা আব্বাস রাযি.সহ প্রমুখ কুরাইশ নেতাদের সাথে আলোচনারত ছিলেন এবং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আশা ছিলো তারা ইসলাম গ্রহণ করবে। এমন সময় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রাযি. (অন্ধ সাহাবী) এসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দীন শিক্ষা দেয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এর প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা‘আলা আয়াত অবতীর্ণ করলেন,عَبَسَ وَتَوَلَّى. أَنْ جَاءَهُ الْأَعْمَى. وَمَا يُدْرِيكَ لَعَلَّهُ يَزَّكَّى. (অর্থ) তিনি ভ্রুকুঞ্চিত করলেন এবং মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কারণ তার কাছে এক অন্ধ আগমন করেছে। আপনি কি জানেন? সে হয়তো পরিশুদ্ধ হতো। -‘সূরা আবাসা’- ১-৩। (সহীহ ইবনে হিব্বান; হা.নং ৫৩৫, সুনানে তিরমিযী; হা.নং ৩৩৮৬, তাফসীরে ইবনে কাসীর ৮/৩১৯, তাফসীরে তবারী ২৪/২১৭)

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিবন্ধীদের সর্বদাই অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রাযি. কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপার ¯েœহে ধন্য করেছেন। যখনই তাকে দেখতেন, বলতেন, স্বাগতম জানাই তাকে যার সম্পর্কে আমার প্রতিপালক আমাকে ভর্ৎসনা করেছেন। হযরত আনাস রাযি. হতে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাহাবীকে দু’বার মদীনার অস্থায়ী শাসক নিযুক্ত করেন। (মুসনাদে আহমাদ; হা.নং ১৩০০০) যা পৃথিবীর ইতিহাসে এক দুর্লভ ঘটনা। এজন্য প্রতিবন্ধীকে ভালোবাসা, তাদের সাথে সদাচরণ করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুপম সুন্নাত বটে।

ঘটনাক্রমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার না দেয়ার কারণে সতর্কীকরণের মুখে পড়তে পারেন তাহলে অবশ্যই মুমিনগণের জন্য প্রতিবন্ধীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া আবশ্যক। এ সহানুভূতির ফলে সে সওয়াবের অধিকারীও হবে।

প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রনীতি ও ইসলামী

আন্তর্জাতিক পরিসরে শতাব্দীর উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনের জন্য প্রতিবন্ধীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার উপর জোর দিয়েছে বিশ্ব। বাংলাদেশ এ লক্ষমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছে। প্রতিবন্ধীরা যেন সমাজে তাদের সুযোগ-সুবিধা পূর্ণাঙ্গভাবে ভোগ করতে পারে, তাদের প্রাপ্য অধিকার হতে তারা যেন বঞ্চিত না হয় সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন করে।

আইনানুযায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত, ইন্দ্রিয়গত, ক্ষতিগ্রস্থতা এবং প্রতিকূলতার ভিন্নতা বিবেচনায় প্রতিবন্ধিতারধরন নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব বিবেচনায় প্রতিবন্ধীদের সাধারণভাবে অটিজম বা অটিজমস্পেকট্রামডিজঅর্ডারস, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, মানসিক অসুস্থতা জনিত প্রতিবন্ধিতা,দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা, বাকপ্রতিবন্ধিতা, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা, শ্রবণপ্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা, সেরিব্রাল, পালসি,ডাউনসিনড্রোম, বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধিতা শ্রেণীভূক্ত করা হয়েছে।

এ আইনের ১৬ ধারায় প্রতিবন্ধীদের অধিকার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। একজন প্রতিবন্ধীর যেসব অধিকার রয়েছে-

১) প্রত্যেক প্রতিবন্ধীর পূর্ণমাত্রায় বেঁচে থাকা ও বিকশিত হওয়ার।

২) সর্বক্ষেত্রে সমান আইনী স্বীকৃতি এবং বিচার গম্যতার।

৩) উত্তরাধিকার প্রাপ্তি।

৪) স্বাধীন অভিব্যক্তি, মতপ্রকাশ এবং তথ্য প্রাপ্তি।

৫) মাতা-পিতা বৈধ বা আইনগত অভিভাবক, সন্তান বা পরিবারের সাথে সমাজে বসবাস, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন ও পরিবার গঠন।

৬) প্রবেশ গম্যতা।

৭) সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী পূর্ণ ও কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ।

৮) শিক্ষার সকল স্তরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি সাপেক্ষে একীভূত বা সমন্বিত শিক্ষায় অংশগ্রহণ।

৯) সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মে নিযুক্তি।

১০) কর্মজীবনে প্রতিবন্ধিতার শিকার ব্যক্তি কর্মে নিয়োজিত থাকা। অন্যথায় যথাযথ পূনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি।

১১) নিপীড়ন থেকে সুরক্ষা এবং নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশের সুবিধা প্রাপ্তি।

১২) প্রাপ্যতা সাপেক্ষে সর্বাধিক মানের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি।

১৩) শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রসহ প্রযোজ্য সকল ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় স্বাচ্ছ্বন্দের জন্য উপযোগী পরিবেশ ও ন্যায্য সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তি।

১৪) শারীরিক, মানসিক ও কারিগরী সক্ষমতা অর্জন করে সমাজ জীবনের সকল ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে একীভূত হওয়ার লক্ষ্যে সহায়ক সেবা ও পুনর্বাসন সুবিধা প্রাপ্তি।

১৫) মাতা-পিতা বা পরিবারের উপর নির্ভরশীল প্রতিবন্ধী ব্যক্তি মাতা-পিতা বা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হলে বা তার আবাসন ও ভরণপোষণের যথাযথ সংস্থান না হলে যথাসম্ভব নিরাপদ আবাসন ও পুনর্বাসন।

১৬) সংস্কৃতি, বিনোদন, পর্যটন, অবকাশ ও ক্রীড়া কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ। শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও বাকপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির নিজ ইচ্ছানুযায়ী যথাসম্ভব বাংলা ইশারা ভাষাকে প্রথম ভাষা হিসেবে গ্রহণ।

১৭) ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা।

১৮) স্ব-সহায়ক সংগঠন ও কল্যাণমূলক সংঘ বা সমিতির গঠন ও পরিচালনা।

১৯) জাতীয় পরিচয় প্রাপ্তি। ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি, ভোট প্রদান এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ।

২০) সরকার কর্তৃক সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপণ দ্বারা নির্ধারিত অন্য যে কোন অধিকার রয়েছে।

ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিবন্ধীর অধিকার ও সুরক্ষা আইন

১) ইসলাম প্রতিবন্ধীকে এ অধিকার দিয়েছে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা জন্মগতভাবেই প্রত্যেক মানুষকে পূর্ণমাত্রায় বেঁচে থাকা এবং বিকশিত হওয়ার অধিকার দিয়েছেন। (আলফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহ ৬/৮২৭)

২) ইসলাম সর্বক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীকে সমান আইনী স্বীকৃতি এবং ক্ষেত্রবিশেষে অগ্রাধিকার দিয়েছে। প্রতিবন্ধীকে বিচার গম্যতার ক্ষেত্রে সমান অধিকার দিয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ لِلَّهِ شُهَدَاءَ بِالْقِسْطِ وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلَّا تَعْدِلُوا.

অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ দানের ব্যাপারে অবিচল থাকবে এবং কোন সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে কখনো ন্যায় বিচার পরিত্যাগ করবে না। সুবিচার কর। (‘সূরা মায়িদা’- ৮)

৩) ইসলাম প্রতিবন্ধীর উত্তরাধিকার প্রাপ্তি নিশ্চিত করেছে এবং অপ্রতিবন্ধীর মতোই সমান উত্তরাধিকার দিয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ‘সূরা নিসা’র ১১ ও ১২ নং আয়াতে এ অধিকার নিশ্চিত করেছেন।

৪) ইসলাম প্রত্যেককেই স্বাধীন অভিমত ব্যক্ত করা বা মত প্রকাশের সুযোগ দিয়েছে। তবে এক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করতে বারণ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ.

অর্থ : তোমরা সৎকাজে আদেশ কর, অসৎকাজে বাধা প্রদান কর। (‘সূরা আলে ইমরান’- ১১০)

৫) ইসলাম প্রতিবন্ধীকে তার অভিভাবক ও সমাজের সাথে বসবাসের অধিকার নিশ্চিত করেছে। বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন ও পরিবার গঠনের অধিকার দিয়েছে। (আলফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহ ৬/৮২৮, ৮২৯)

৬) ইসলাম প্রতিবন্ধীকে অন্যদের মতো প্রবেশগম্যতার অধিকার দিয়েছে।

৭) ইসলাম প্রতিবন্ধীর এ অধিকার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রেখেছে। এ সকল কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছে।

৮) ইসলাম প্রতিবন্ধীকে জ্ঞান অর্জনের সর্বোচ্চ অধিকার ও সুযোগ দিয়েছে এবং এক্ষেত্রে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। (আলফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহ ৬/৮২৯)

৯) ইসলাম প্রতিবন্ধীর এ অধিকার বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে এবং এ অধিকার বাস্তবায়ন করে বিশ্বে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্ধ সাহাবী ইবনে উম্মে মাকতুম রাযি. কে মদীনার অস্থায়ী শাসক নিযুক্ত করেছিলেন। (মুসনাদে আহমাদ; হা.নং ১৩০০০)

১০) কর্মজীবনে প্রতিবন্ধীতার শিকার হলে, যদি সে কাজ করতে সক্ষম হয় তাহলে ইসলাম তাকে কর্মে নিয়োজিত থাকবার অধিকার দিয়েছে। অন্যথায় রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে।

১১) ইসলাম প্রত্যেক নাগরিকের জন্য নিপীড়ন হতে সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্যসম্মত উপযোগী পরিবেশ পাওয়ার অধিকার দিয়েছে। (আলফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহ ৬/৮৩১)

১২) ইসলাম প্রতিবন্ধীর স্বাস্থ্যসেবার অধিকার নিশ্চিত করেছে।

১৩) ইসলাম সকল ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধীর জন্য উপযোগী পরিবেশ এবং ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি নিশ্চিত করেছে।

১৪) ইসলাম প্রতিবন্ধীর এ অধিকার নিশ্চিত করেছে।

১৫) ইসলাম প্রতিবন্ধীর এ অধিকারও নিশ্চিত করেছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

وَفِي أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ.

অর্থ : এবং তাদের ধন-স¤পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতের হক ছিল। (‘সুরা যারিয়াত’- ১৯)

১৬) ইসলাম প্রতিবন্ধীকে সংস্কৃতি, বিনোদন, পর্যটন, অবকাশ ও ক্রীড়া কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের অধিকার দিয়েছে। তবে অবশ্যই তা শরীয়ত সম্মত হতে হবে।

১৭) ব্যক্তিগত তথ্য গোপনীয়তার অধিকার ইসলাম প্রত্যেককে দিয়েছে। তবে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করতে বারণ করেছে।

১৮) সমাজ, রাষ্ট্র ও ধর্মের কল্যাণে এ ধরনের সংগঠন করা ও পরিচালনার অধিকার ইসলাম দিয়েছে।

১৯) ইসলাম প্রতিবন্ধীর এ অধিকার সমর্থন করে।

ইসলাম শুধু প্রতিবন্ধীকে অধিকার দিয়ে ক্ষান্ত হয়নি; বরং তা বাস্তবায়ন করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিবন্ধীর অধিকার বাস্তবায়নে যতটুকু সাফল্য অর্জন করেছে, অন্য কোন রাষ্ট্রব্যবস্থা তা করতে সক্ষম হয়নি। তাই রাষ্ট্রের উচিৎ প্রতিবন্ধীর অধিকার বাস্তবায়নে সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখা।

প্রতিবন্ধীর করণীয়

১. সে ধৈর্যধারণ করবে এবং নিজের উপর সন্তুষ্ট থাকবে। কারণ এটি তাকদীরের লিখন যা ঈমানের অংশ বিশেষ। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي أَنْفُسِكُمْ إِلَّا فِي كِتَابٍ مِنْ قَبْلِ أَنْ نَبْرَأَهَا إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ. لِكَيْلَا تَأْسَوْا عَلَى مَا فَاتَكُمْ وَلَا تَفْرَحُوا بِمَا آتَاكُمْ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ.

অর্থ : পৃথিবীতে এবং তোমাদের উপর কোন বিপদ আসে না; কিন্তু তা জগত সৃষ্টির পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। নিশ্চয়ই এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ। এটা এজন্যে বলা হয়, যাতে তোমরা যা হারাও তজ্জন্যে দুঃখিত না হও এবং তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তজ্জন্যে উল্লসিত না হও। আল্লাহ কোন উদ্ধত অহংকারীকে পছন্দ করেন না। (‘সূরা হাদীদ’- ২২, ২৩)

২. সে বিশ্বাস রাখবে যে, আল্লাহ তা‘আলা যখন কোন মুমিন বান্দাকে পরীক্ষায় ফেলেন তখন তিনি তাকে ভালোবাসেন এবং অন্যান্যদের তুলনায় তাকে অনেক বেশি অগ্রাধিকার দেন। এ কারণেই আল্লাহ তা‘আলা নবীগণ আ. কে সবচাইতে বেশি বিপদাপদের মাধ্যমে পরীক্ষা করেছিলেন। হযরত সা’দ রাযি. বলেন,

قلت يارسول الله أي الناس أشد بلاء؟ قال الانبياء ثم الامثل فالامثل يبتلى الرجل على حسب دينه فإن كان في دينه صلبااشتد بلاؤه وإن كان في دينه رقة ابتلى على قدر دينه فما يبرح البلاء بالعبد حتى يتركه يمشى على الارض وما عليه خطيئة.

অর্থ : আমি বললাম, আল্লাহর রাসূল! কোন শ্রেণীর মানুষ সবচেয়ে বিপদে নিপতিত? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নবীগণ সবচেয়ে বেশি পরীক্ষিত হন বিপদাপদের মাধ্যমে। অতঃপর তাদের থেকে যারা তুলনামূলক নি¤œস্তরের তারা। মানুষকে তার দীন অনুযায়ী পরীক্ষা নেয়া হয়। যদি তার দীনী অবস্থা প্রবল হয় তাহলে তার বিপদও কঠিন হয়। আর যদি তার দীন দুর্বল হয় তাহলে তার পরীক্ষা সে অনুপাতে হয়। বিপদ বান্দার পিছু ছাড়ে না। পরিশেষে তার অবস্থা এমন হয় যে, সে গুনাহমুক্ত হয়ে যমীনে চলা ফেরা করে। (সুনানে তিরমিযী; হা.নং ২৫০৯)

৩. প্রতিবন্ধী ব্যক্তি মনে রাখবে যে, দয়াময় আল্লাহ তা‘আলা মুমিনকে তার প্রত্যেক বিপদের বিনিময় প্রদান করেন। যদিও সে বিপদ ছোটো হয়। এমনকি কাঁটা বিধলেও। হযরত আয়েশা রাযি. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

ما من مصيبة تصيب المسلم إلا كفر الله بها عنه حتى الشوكة يشاكها.

অর্থ : মুসলমান কোন কষ্টের সম্মুখীন হলে, এমনকি কাঁটা বিধলেও তার মাধ্যমে তার গুনাহের প্রায়শ্চিত্য করে দেয়া হয়। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৫৩১৭, সহীহ মুসলিম; হা.নং ২৫৭২)

৪. মুমিন প্রতিবন্ধী যেন তার নির্দিষ্ট প্রতিবন্ধিতাকে ভুলে গিয়ে শরীরের বাকী অঙ্গগুলোকে কাজে লাগায়। কারণ কোন এক অঙ্গের অচলতাই জীবনের শেষ নয়। তাছাড়া দেখা গেছে যার পঞ্চেন্দ্রীয়ের কোন একটি অচল, তার বাকী অঙ্গগুলো বেশি কিংবা দ্বিগুণ সচল হয়।

আমাদের করণীয়

১. নিজের সুস্থতা ও আরোগ্যতার জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং প্রতিবন্ধী ভাইদের জন্য দু‘আ করা। ইসলাম প্রতিবন্ধীদের যেসব অধিকার দিয়েছে তা যথাযথ আদায় করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

المسلم أخو المسلم لا يخونه ولا يكذبه ، ولا يخذله.

অর্থ : একজন মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। সে অন্যের বিশ্বাস ভঙ্গ করবে না। অন্যকে মিথ্যা সাব্যস্ত করবে না এবং লাঞ্ছিতও করবে না। (জামে তিরমিযী; হা.নং ১৯২৭)

২. যথাসম্ভব প্রতিবন্ধীদের সাহায্য-সহযোগিতা করা। সেটা অন্ধ ব্যক্তির পথ চলায়, জীবন যাপন কিংবা শিক্ষাদানে সহযোগিতা করেও হতে পারে। সুস্থদের সামান্য সাহায্যে তাদের জীবন যাপন বদলে যেতে পারে। তাদের মুখে ফুটতে পারে সুখের হাসি। তারাও সমাজের সবার সাথে দাঁড়াতে পারে। হযরত জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

لا يرحم الله من لا يرحم الناس.

অর্থ : যে ব্যক্তি মানুষের উপর দয়া করে না, আল্লাহও তার উপর দয়া করেন না। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৭৩৭৬, সহীহ মুসলিম; হা.নং ২৩১৯)

৩. বিশেষ করে প্রতিবন্ধী নারী, শিশু ও বয়ঃবৃদ্ধদের দুঃখ, কষ্ট ও বৈষম্যের সীমা থাকে না। ইসলাম এমন অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে বা তাদের সাহায্য করতে নির্দেশ দিয়েছে। হযরত আবু হুরাইরা রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

والله في عون العبد ما كان العبد في عون أخيه.

অর্থ : বান্দা (মানুষ) যতক্ষণ তার ভাইকে সাহায্য করতে থাকে, আল্লাহ ততক্ষণ বান্দাকে সাহায্য করতে থাকেন। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ৭০২৪)

৪. আমাদের মনে রাখা দরকার, প্রতিবন্ধীর দেখাশোনা করা ঐ ব্যক্তির উপর আবশ্যক, যে তার অভিভাবক। আর সমষ্টিগতভাবে সকল মুসলিমের জন্য ফরযে কিফায়া। সমাজের কিছু লোক তাদের দেখাশোনা করলে বাকিরা গুনাহ থেকে মুক্ত থাকবে। কেননা আল্লাহ তা‘আল ইরশাদ করেন,

وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ.

অর্থ : সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে একে অন্যের সাহায্য করো। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না। (‘সূরা মায়িদা’- ২)

৫. তাদের জন্য এমন কিছু শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়া জরুরী, যা তাদের প্রয়োজনীয় কাজে সাহায্য করবে এবং নিজে সাবলম্বী হতে পারবে। তাদের প্রশিক্ষণের স্বার্থে বর্তমান যুগে বিভিন্ন ধরনের উপকরণ আবিষ্কার হয়েছে। যেমন, সাংকেতিক ভাষা, হুইল চেয়ার, চলন্ত চেয়ার, কম্পিউটার ইত্যাদি।

আমাদের সামান্য সাহায্য যদি তাদের জীবন চলার পাথেয় হয়, তাহলে অবশ্যই আমরা আল্লাহর কাছে এর বিনিময় পাবো।

প্রতিবন্ধী হয়েও যারা অনন্য

ইসলামী ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে এমন অনেক মনীষী রয়েছেন যারা তাদের প্রতিবন্ধতার অভিধায়ই ইতিহাসের একজন অনন্য নক্ষত্র হয়ে আছেন। নিম্নে তাদের কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হলো।

১. আলআ’রাজ (খঞ্জ)

এ নামে অনেক মনীষী ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন,

(১) আব্দুর রহমান ইবনে হরমুয রহ. (মৃত্যু ১১৯হি.)। উপনাম আবু দাউদ আলহাশেমী। তিনি বিখ্যাত তাবেয়ী। তিনি হযরত আবু হুরাইরা রাযি. থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন।

(২) আব্দুর রহমান ইবনে সা’দ। উপনাম আবু হুমাইদ। তিনি একজন বিখ্যাত তাবেয়ী। হযরত আবু হুরাইরা রাযি. থেকে হাদীস শ্রবণ করেছেন। তিনি আলমুকআদ (প্রতিবন্ধী) নামেও প্রসিদ্ধ।

(৩) আবু হাযেম আলমাদানী আলহাকীম। তিনি একজন তাবেয়ী। মদীনার অধিবাসী ছিলেন। সহীহ মুসলিম-এর একজন রাবী (বর্ণনাকারী)।

(৪) হুমাইদ ইবনে কায়েস আবু সুফিয়ান। তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাযি. এর আযাদকৃত গোলাম এবং বহু হাদীস বর্ণনাকারী ছিলেন।

(৫) সাবেত ইবনে ইয়ায রহ.। তাকে আলআহনাফও বলা হয়। তিনি হযরত আবু হুরাইরা রাযি. হতে হাদীস শ্রবণকারী এবং সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম-এর রাবী (বর্ণনাকারী)।

(৬) হযরত মিসদা’, উপনাম আবু ইয়াহইয়া। তিনি হযরত মু‘আয ইবনে আফরা’ রাযি. এর আযাদকৃত গোলাম। তিনি সহীহ মুসলিম-এর রাবী (বর্ণনাকারী)।

(৭) আলফযল ইবনে সাহল ইবনে ইবরাহীম। তিনি ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের উস্তাদ ছিলেন। (সূত্র: আলকাবুস সাহাবা ওয়াত্তাবেয়ীন)

২. আলআহওয়াল (ট্যারা চক্ষুবিশিষ্ট)

এ নামে কয়েকজন প্রসিদ্ধ মনীষী রয়েছেন।

(১) আমর ইবনে আব্দুল ওয়াহেদ। সহীহ মুসলিম-এর একজন রাবী (বর্ণনাকারী)।

(২) সুলাইমান ইবনে আবী মুসলিম। তিনি জুরাইজ, ইবনে উয়াইনা ও উসমান ইবনে আযওয়া থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন।

(৩) আসেম ইবনে সুলাইমান আলবসরী (মৃত্যু ১৪২হি.)। তিনি হাদীসের একজন ইমাম ছিলেন।

(৪) মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল হিকাম। তিনি ইমাম বুখারী রহ. এর উস্তাদ ছিলেন। (সূত্র: আলকাবুস সাহাবা ওয়াত্তাবেয়ীন)

৩. আলআ’মাশ (ক্ষীণ দৃষ্টিসম্পন্ন)

এ নামে সুলাইমান ইবনে মেহরান নামক একজন তাবেয়ী ছিলেন। তিনি ১৪৮ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

৪. আলআখফাশ (দিনকানা বা দিবান্ধ)

ইসলামী ইতিহাসে এ নামে চারজনের পরিচিতি পাওয়া যায়।

(১) আখফাশে আকবার। তিনি হলেন আব্দুল হামীদ আব্দুল মজীদ (মৃত্যু ১৭৭হি.)।

(২) আখফাশে আওসাত। তিনি হলেন সাঈদ ইবনে মাসআদাহ আলজামাশা’য়ী (মৃত্যু ২১৫হি.)।

(৩) আখফাশে আসগার। তিনি হলেন আলী ইবনে সুলাইমান ইবনে ফযল (মৃত্যু ৩১৫হি.)। তিনি আরবী ব্যাকরণ শাস্ত্রের ইমাম ছিলেন।

(৪) আখফাশ আদদিমাশকী। তিনি হলেন, হারুন ইবনে মূসা ইবনে শারীক আসসা’লাবী (মৃত্যু ২৯২হি.)। তিনি দামেস্কের ক্বারীদের শাইখ ছিলেন।

৫. আলআ’সাম (সাদা পা বিশিষ্ট)

ইসলামী ইতিহাসে এ নামে দু’জন মনীষী প্রসিদ্ধ।

(১) হাতীম ইবনে উলওয়ান (মৃত্যু ২৩৭হি.)। তাকে এ উম্মতের লুকমান হাকীম বলা হয়।

(২) মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াকুব ইবনে ইউসুফ আলউমাবী (মৃত্যু ৩৪৬হি.)। তিনি একজন বিখ্যাত মুহাদ্দিস। সিকাহ এবং আমীন ছিলেন।

৬. আলআ’মা (অন্ধ)

মুয়াবিয়া ইবনে সুফিয়ান (মৃত্যু ২২০হি.) এ নামে প্রসিদ্ধ। তিনি ইমাম কাসায়ীর শিষ্য ও বাগদাদের কবি ছিলেন।

৭. আলআফতাস (চেপ্টা নাক বিশিষ্ট)

আলী ইবনে হাসান আলহুযালী (মৃত্যু ২৫৩হি.) এ নামে প্রসিদ্ধ। তিনি হাফেযে হাদীস ছিলেন এবং তার নিজের মুসনাদ (এক প্রকার হাদীস গ্রন্থ) রয়েছে। (সূত্র: আলমাজাল্লাতুল হিকমাহ এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচাত ভাই আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি.। জন্ম হিজরতের ৩ বছর পূর্বে এবং মৃত্যু ৬৮হি.। শেষ বয়সে তিনি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় মুফাসসির ছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে হিবরুল উম্মাহ (জাতির পণ্ডিত) উপাধী দিয়েছিলেন।

হযরত আতা রহ. (মৃত্যু ১১৪হি.) একজন বিখ্যাত তাবেয়ী। তিনি কালো, একচোখ কানা, খাঁদা নাক, খঞ্জ এবং কোঁকড়া চুল বিশিষ্ট ছিলেন। তার এ প্রতিবন্ধিতা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে প্রতিবন্ধক হয়নি। তিনি তার সময়কালে মক্কার প্রধান মুফতী ছিলেন এবং হাফেযে হাদীস ছিলেন। অসংখ্য সাহাবী থেকে হাদীস শুনেছেন। সহস্র শিক্ষার্থী তার থেকে ইলমে হাদীস এবং ইলমে ফিকহ অর্জন করেছেন। একবার হজের সময় উমাইয়া শাসক আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ান মক্কায় ঘোষণা করতে নির্দেশ দিলেন, আতা ব্যতীত মক্কায় কেউ ফাতওয়া দিবে না। (আলহাযারাতুল ইসলামিয়া ১/৩০৭)

শেষকথা

প্রতিবন্ধীদের মর্যাদা দানে এবং তাদের অধিকার রক্ষায় ইসলামের ভূমিকা অনন্য। ইসলামী ইতিহাস যার উজ্জ্বল সাক্ষী। সুতরাং প্রতিবন্ধীদের অধিকার বাস্তবায়নে নববী আদর্শের বিকল্প নেই। প্রতিবন্ধীরা আমাদের সমাজের বোঝা নয়। তারা আমাদের জন্য নেকী অর্জনের মাধ্যম। তাদের সেবা-শুশ্রুষা করা আমাদের নৈতিক, মানবিক ও ঈমানী দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে আমরা সচেষ্ট হলে মহান স্রষ্টা আল্লাহ তা‘আলার দরবারে আমরা দায়মুক্তি পাবো এবং পুরষ্কৃত হবো ইনশাআল্লাহ। তাদেরকে শারীরিক, মানসিক কষ্ট দেয়া বা তাদের সাথে অন্যায় আচরণ করা মারাত্মক নিন্দনীয় কাজ, যা আমাদের নেক আমল বিনষ্ট হওয়ার কারণ হতে পারে। আমাদের ইহকাল ও পরকাল ধ্বংস হওয়ার কারণ হতে পারে। সুতরাং তাদেরকে সর্বপ্রকার কষ্ট দেয়া হতে বিরত থাকা আবশ্যক। এ ব্যাপারে আমরা সচেতন হবো এবং অন্যদেরকে সচেতন করবো। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।

তথ্যসূত্র :

১. কুরআনুল কারীম, ২. সহীহ বুখারী, ৩. সহীহ মুসলিম, ৪. ইমাম বাইহাকীরহ., শু‘আবুল ঈমান, ৫. মুসনাদে আহমাদ, ৬. সুনানে ইবনে মাজাহ, ৭. সুনানে তিরমিযী. ৮. সুনানে আবু দাউদ, ৯. তাসফসীরে তবারী, ১০. সহীহ ইবনে হিব্বান, ১১. মা’রিফাতুস সাহাবা, ১২. তাফসীরে ইবনেকাসীর, ১৩. তাফসীরে কুরতুবী, ১৪. আলফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহ, ১৫. আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহআলকুওয়াইতিয়্যাহ, ১৬. তাইসীরুত তাহরীর, ১৭. মারাকিল ফালাহ, ১৮. কামূসুল ফিকহ, ১৯. বাংলা সংসদ, ২০. বাংলা একাডেমি, ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, ২১. আলমু’জামুল ওয়াসিত, ২২. উইকিপিডিয়া(বাংলা), ২৩. আলমুগরিব ফী তারতীবিল মু’রিব, ২৪. তাজুল আরূস, ২৫. Autism Enplaning the Enigma, ২৬. বাংলা একাডেমি, ইংলিশ বাংলা ডিকশনারি, ২৭. প্রথম আলো।

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য আছে “প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও সামাজিক দায়বদ্ধতা”

  1. অনেক দিন পরে দারুন কিছু তথ্য সম্বলিত এই পোস্টটি পড়লাম। খুব ভালো লগলো। আপনাকে ধন্যবাদ।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *