মুতীউর রহমান
পূর্বকথা
পিকনিক, বনভোজন, আনন্দ ভ্রমণ, তীর্থযাত্রা, শিক্ষাসফর ইত্যাদি শব্দ আমরা সচরাচর শুনে থাকি; কিন্তু আমরা একটি নতুন শব্দ পেয়েছি ‘ইলইী সফর’। এ শব্দটি যেমন ব্যতিক্রম ও অর্থবহ আমাদের সফরটিও ছিল তেমন ব্যতিক্রম ও অর্থবহ। সাধারণত: পার্থিব শিক্ষার বিদ্যাপীঠগুলো ছাত্রদের শিক্ষা সফরের আয়োজন করে থাকে। কোনো দীনী প্রতিষ্ঠান থেকে এ ধরনের আয়োজ তেমন একটা চোখে পড়ে না। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের মা‘হাদ কর্তৃপক্ষকে জাযায়ে খাইর দান করুন। তারা আমাদের জন্য ইলমী সফরের ব্যবস্থা করেছেন।
মা‘হাদ পরিচিতি পত্রে (প্রসপেক্টাসে) ‘বার্ষিক শিক্ষা সফরের ব্যবস্থা থাকবে’ একথা লেখা ছিল বিধায় বছরের শুরু থেকেই সফরের প্রতীক্ষায় ছিলাম। দ্বিতয় সাময়িক পরীক্ষার কয়েকদিন পূর্বে আমাদের মুদীর ছাহেব হুযুর বললেন, ‘ইনশা-আল্লাহ আগামী বন্ধে তোমাদের ‘ইলমী সফর’ হবে। সফরের গন্তব্য সিলেট। ’
সিলেট। শাহজালালরহ.এর পরশধন্য সিলেট। আউলিয়ায়ে কেরামের বরকত-পরশিত সিলেট। পাহাড়-নদী, ঝর্ণাধরার সিলেট। দিল-জুড়ানো চা বাগানের সিলেট। হৃদয়াকাশে খুশির পায়রাগুলো পেখম মেলে উড়তে লাগলো । আর মাত্র হাতে কয়েকটি দিন বাকি। দিনগুলো শেষ হলেই আমি সিলেট যাচ্ছি, আহা কত আনন্দ! আল হাম্দুলিল্লাহ।
এর দু-একদিন পর মুদীর ছাহেব হুযুর আমাদেরকে জানালেন, ‘আমাদের পুরো সফর হবে মাইক্রোযোগে। ’ একথা শুনে আমার মনেএক অজানা শঙ্কা দেখা দিল। আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠলো ‘সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বহু মানুষেররক্তাক্ত মুখ’। কানে ভেসে এলো ‘স্বজন হারানো মানুষের করুণ আহাজারি’। যদি… তাহলেতো একটি মুহূর্তে নিভে যাবে বারটি জীবন-প্রদীপ। সূচনা বছরেইথেমে যাবে একটি প্রতিষ্ঠানের গতিময় অভিযাত্রা।
আমরা বিষয়টি নিয়েপরস্পরে আলোচনা করলাম। দেখলাম ‘সবাই শঙ্কিত’। ধীরে ধীরে আমাদের সফরপ্রীতি সফরভীতিতে পরিণত হল। মশওয়ারায় বসলাম। ফায়সালা হল ‘বিষয়টি মুদীর ছাহেব হুযুরকে জানাব’। যদি একান্ত সফরে যেতেই হয়, তাহলে ট্রেনে যাব; মাইক্রোতে নয়। সিন্ধান্ত মত আমাদের একজন মুদীর ছাহেব হুযুরকে বিষয়টি জানালো। হুযুর মুচঁকি হেসে বললেন, সবাইকে আসতে বল। সবাই ঝটপট হুযুরের সামনে জড়ো হয়ে বসে গেলাম। হুযুর হাসি হাসি মুখে অল্প কয়েকটি কথা বললেন। জানিনা হুযুরের কথাগুলোতে জাদু ছিল কিনা?হুযুরের এ অল্প কয়েকটি সাদা-মাঠা কথায় আমাদের সবার অন্তর থেকে শঙ্কা একদম দূর হয়ে গেল। হৃদয়ে জন্মালো সফরের প্রতি এক অনাবিল আগ্রহ।
সিলেট অভিমুখে
২৪ মার্চ দিবাগত রাতের শেষ প্রহর। চারদিক নীরব নিথর। আমীনুত্ তা‘লীম ছাহেব হুযুরের হালকা ডাকে আমরা ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। গোসল সেরে আমাদের অনেকে তাহাজ্জুদ পড়ে নিলো। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফযরের পূর্বেই সকালের নাস্তাপর্ব সেরে নিলাম। ফযরের পূর্বে গাড়ি চলে আসার কথা; কিন্তু এলো না। সময়মত না এসে ভালই হল। ফযরের পর আমাদের মুদীর সাহেব হুযুর সবাইকে সামনে বসালেন, সফরের কতিপয় সুন্নত আলোচনা করলেন এবং সফরের কয়েকটি দু‘আ শিখালেন।
সফর শুরু না হতেই সফরের অর্জন শুরু হয়ে গেল। তখনসকাল সাতটা। আমরাগাড়িতে চড়ে দু‘আ পড়লাম। মুহতারাম মুদীর ছাহেব হুযুর , আমীনুত্ তা‘লীম ছাহেব হুযুর , আমরা অট জন ছাত্র এবং বাবুর্চি ছাহেব সহ মোট ১১জন যাত্রী সহ গাড়িটি রওয়ানা হল। শিশির স্নিগ্ধ, কোলাহলমুক্ত, যানজটহীন সকালের ঢাকা পেরুতে বেশি সময় লাগলো না। ডেমরা সেতু পেরিয়ে শাহরাহে শা শা গতিতে গাড়ি ছুটে চললা। পথে চালক তার নিজ প্রয়োজনে অল্প সময়ের জন্য গাড়ী থামালো। আমীনুত্ তা‘লীম ছাহেব হুযুর আমাদের জন্য চকলেট কিনে আনলেন। মুদীর ছাহেব হুযুর সেগুলো আমাদের মাঝে বণ্টন করে দিলেন। চকলেট হাতে পেয়ে শৈশবের স্মৃতিতে হারিয়ে গেলাম‘বাবা অনেক সময় আদর করে চকলেট কিনে দিতেন, মনটা খুশিতে ভরে যেত….’
প্রথম মনযিল শহীদবাড়িয়া
আবার গাড়িটি ছুটে চললো। এন.গঞ্জের যান্ত্রিক শিল্পাঞ্চল পেরিয়ে আমাদের গাড়ি সবুজ গাছ-গাছলিও ফসলের মাঠের মাঝ দিয়ে চলতে লাগলো। আমাদের প্রথম মনযিলশহিদ বাড়িয়া (বি.বাড়িয়া) জামিআ ইউনুসিয়া মাদরাসা। ভৈরব ব্রিজ অতিক্রমকরার পর অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা তিতাস বিধৌত, শহিদ বাড়িয়া (বি.বাড়িয়া)শহরের উপকণ্ঠে এসে পড়লাম। কল্পনার বাতয়ন পথে আমি পৌঁছে গেলাম অতীতের বেলা ভূমিতে। এই সেই শহর যে শহরের পিচঢালা পথ ছয় শহীদের তপ্ত খুনে স্নাত হয়েছে। ফাতাওয়া নিষিদ্ধ করার প্রদিবাদে আন্দোলন করায় মুসলিম দেশের জালিমশাসক কর্তৃক লেলিয়ে দেয়া বাহিনীর হাতে ঝরে পড়েছে ছয় ছয়টি শহীদের তাজাপ্রাণ। এর প্রতিবাদ ক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছিল সেদিনের তাওহীদী জনতা। একপর্যায়ে চরম ভরাডুবির গ্লানি নিয়ে গদি ছাড়তে হয়েছিল তৎকালীনশাসকদলকে।
তখন থেকে উলামায়ে কেরাম এই শহরের নাম করণ করেন ‘শহিদ বাড়িয়া’।
আমাদের গাড়ি শহরের জ্যাম ঠেলে ঠেলে একটু একটু করে আগে বাড়ছিল। আল্লাহ চাহে তো একটু পরেই আমরা পৌঁছে যাব ঐতিহ্যবাহী জামি‘আ ইউনুসিয়ার পবিত্র আঙ্গিনায়। ফখরে বাঙ্গাল তাজুল ইসলাম রহ. এর স্মৃতিধন্য জামি‘আ ইউনুসিয়া। মুজাহিদে আ’যম শামসুল হক ফরীদপুরী ও হাফেজ্জী হুযূর রহ. এর প্রথম কর্মস্থল জামিআ ইউনুসিয়া। একটু পরেই আমাদের গাড়িটি লালরঙ্গের বিশাল এক মসজিদের ফটকের সামনে এসে দাঁড়ালো। মসজিদের সাথেই সংযুক্ত মাদরাসা। আমরা মাদরাসা দফতরে প্রবেশ করলাম। জামি‘আ ইউনুসিয়ার মুহতামিম হযরত মুবারাকুল্লাহ ছাহেব সহ বেশ কয়েকজন প্রবীণ আলেমে দীনের সাথে সাক্ষাৎ হলো। সালাম-মুসাফাহার পর আমাদের মুদীর সাহেব সংক্ষেপে আমাদের পরিচয় দিলেন এবং সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত করলেন। এতে তাঁরা খুব খুশি হলেন। আমাদেরকে খুব সমাদর করলেন। দ্রুত চা-নাস্তার ইন্তিাজাম করতে খাদেমকে নির্দেশ দিলেন। আমরা কিছু নসীহত কামনা করলাম। হযরত দু-টি বিষয়ে নসীহত করলেন:১. নিজেকে যোগ্য হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। ২. কর্মক্ষেত্রে মানুষের আস্থাভাজন হতে হবে। তাহলে মানুষ আপনাদের কথা মেনে চলবে।
নসীহত শেষে হযরত মা‘হাদের জন্য কয়েকটি বই হাদিয়া দিলেন। আমরা হযরত থেকে দু‘আ নিয়ে মাদরাসা থেকে বের হলাম। উযু করে ফখরে বাঙ্গাল রহ. এর কবর যিয়ারত করলাম। এর পর আমরা গাড়ীতেচড়ে বসলাম। সবাই দু‘আ পড়লাম। গাড়ি ছুটে চললো আমাদের দ্বিতীয় মনযিল জামি‘আতুস সুন্নাহ বিজয়েশ্বর মাদরাসা পানে।
জামি‘আতুস সুন্নাহ
আমারা শহিদ বাড়িয়া হতে পশ্চিম দিকের সড়ক বেয়ে ভাদুঘর পর্যন্ত এলাম। এরপর রাস্তা মোড় নিয়েছে অন্য দিকে। ভদুঘরে শায়িত আছেন নিকট অতীতের সর্বাধিক প্রবীণ আলেমে দীন আল্লামা সিরাজুল ইসলাম (মুফাসসির ছাহেব হুযূর) রহ.। তিনি জামি‘আ ইউনুসিয়ায় দীর্ঘকাল যাবৎ মুহতামিম ছিলেন। সাথে সাথে এই ভাদুঘরেও একটি দাওরায়ে হাদীস মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। দীনি খেদমতে উৎসর্গিত এ মহামনবের ১৩০ বছরের বর্ণাঢ্য জীবন আমাদের জন্য এক মহা অনুপ্রেরণা।
ভাদুঘর থেকে পশ্চিম দিকে একটি পিচঢালা সরু রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ী এগিয়ে চললো। পশ্চিম শব্দটি কলমের ডগায় আসতেই হৃদয়ের গভীরটা উথলে উঠলো, ‘হায়! আল্লাহর কত প্রিয় বান্দা পশ্চিমমুখী বাহনে চড়ে বাইতল্লাহর মুসাফির হয়! আমার জীবনে কবে আসবে সে শুভসময়?। আল্লাহ তুমি আমাকে এবং সকল পাঠকবৃন্দকে তোমার ঘরের মুসাফির হওয়ার তাওফীক দান কর।
দূর থেকে জামি‘আতুস সুন্নাহ মাদরাসার সীমান-প্রচীর এবং মাদরাসার সুরম্য ইমারতগুলো দেখা যাচ্ছিল। দেখতে দেখতে আমরা মাদরাসার প্রধান ফটকের কাছে চলে এলাম। দারোয়ান মহোদয় বিশাল লোহার গেটের একটি পাট ঠেলে সরিয়ে দিয়ে আমাদের প্রবেশ করার সুযোগ করে দিল। ফটক দিয়ে প্রবেশ করতেই হাতের বায়ে সুন্দর একটি মসজিদ। আমাদের গাড়ী মাদরাসার বিশাল মাঠের মাঝ বরাবর দক্ষিণ পার্শে¦ অবস্থিত প্রশাসনিক ভবনের সামনে এসে থামলো। আমরা হুড়মুড় করে নেমে পড়লাম। বাহ্! কি চমৎকার চোখ জুড়ানো দৃশ্য। কোন মাদরাসা যে এত সুন্দর হতে পারে স্বচক্ষে না দেখলে তা অবিশ্বাস্যই মনে হত। দুটি শিক্ষা ভবন। একটি উত্তর পাশে, অপরটি দাক্ষিণ পাশে। মধ্যিখানে পকুর। পুকুরের দু-পাশে শান বাঁধানো ঘাট। ঘাটের উপরিভাগে পোড়ামাটির ছাউনী। ছাউনীর ছায়ায় বসার সুন্দর ব্যবস্থা। পুকুরের অপর প্রান্তে শিক্ষক নিবাসের সুউচ্চ ইমারতগুলো মাথা উঁচু করে দাাঁড়িয়ে আছে। ’। পশ্চিম পার্শে সুরম্য মসজিদ। পূর্ব দিকে মাদরাসা প্রাচীরের শেষ সীমানা ঘেষে শাক সবজির সুন্দর বাগান। দূর থেকে চোখের তারায় ভেসে উঠছে সবুজের সমারোহ। দারুন মনোমুগ্ধকর রুচিসম্মত উন্নত পরিবেশ। শিল্পপতি মোনেম খান সাহেব চেয়েছিলেন কলেজ তৈরি করবেন। আল্লাহ তা‘আলা এ জমীনকে নববী বাগান রূপে কবূল করলেন। মজলিসে দা’ওয়াতুল হকের আমীরুল উমারা আল্লামা মাহমূদুল হাসার দা.বা. এর পরামর্শ ও প্রচেষ্টায় এ জমীন ইলমে নববীর বিতরণ ফোয়ারায় পরিণত হল। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের আকাবিরগণের ছায়াকে এজাতির উপর দীর্ঘায়িত করুন। আমীন!
আমাদের আগমন সংবাদ শুনে মাদরাসার শিক্ষা সচিব মাওলানা ইসমাঈলছাহেব দফতরে এলেন। আমাদের অনুরোধের প্রেক্ষিত তিনি বিনয়-বিগলিত কন্ঠেবললেন, হাজী ইমদাদুল্লাহমুহাজেরে মক্কী রহ. কখনো পা মেলে শুইতেন না। তাঁকে কারণ সম্পর্কেজিজ্ঞাসা করা হলে বলতেন,মালিকের সামনে গোলাম কি পা মেলে শুইতে পারে?। দাসের জন্য কি মুনীবেরসামনে পা প্রসারিত করা শোভা পায়?অনেক বুযুর্গ বলতেন ‘আখেরাতে উচ্চ মর্যাদালাভের আকাঙ্ক্ষা আমার নেই,কোন ভাবে জাহান্নাম থেকে একটু মুক্তি পেলেই হয়’। আমাদের আকাবিরগণ কত বিনয়ী ছিলেন। তাঁরাই আমাদের আদর্শ, তাঁরাই আমাদের অনুসরণীয়। সুতরাং আমাদের মাঝেও থাকতে হবে এমন বিনয় ও খোদাভীতি। তাহলে আল্লাহ তা‘আলা হয়তো আমাদের দ্বারাও কিছু দীনী খিদমত নেবেন ইনশা-আল্লাহ।
দুপুরের খাবারের দাওয়াত গ্রহণের জোর আবদার হল। কিন্তু সময়ের অভাবে আমরা সে দাওয়াত কবুল করতে পারলাম না। চা-নাস্তার দাওয়াত গ্রহণেও প্রথমে আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। কিন্তু তাঁদের দিল আহত হবে ভেবে এ আবদার প্রত্যাখ্যান করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হল না। তাঁদের নিখাদ আন্তরিকতা আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে গেল। আপ্যায়ন শেষে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম। জামি‘আতুস সুন্নাহকে আল বিদা‘ জানালাম; কিন্তু হৃদয়ে নিয়ে এলাম একরাশ ভালোবাসা।
চায়ের রাজধানীর পথে…
রাস্তার করুণ দশা এবং জ্যামের কারণে ঢাকা টু সিলেট মহাসড়কে পৌঁছতে বেশ সময় লেগে গেলো। মহাসড়কে পৌঁছে আমাদের গাড়ী দুরন্ত বেগে ছুটে চললো চায়ের রাজধানীর পথে। সুন্দর পীচঢালা পথ। দুপাশে সবুজের অবারিত গালিচা বিছানো ফসলের মাঠ। কিছুদূর পরপর জনবসতি বাড়ী-ঘর। কোথাও কোথাও ছোট বড় হাট-বাজার। গাড়ি এগিয়ে চলছিল আর আমি আল্লাহ পাকের নিপুণ সৃষ্টির বৈচিত্র্যময় সোন্দর্যশোভায় আপ্লুত হচ্ছিলাম। হবিগঞ্জে দু-জায়গায় যাত্রা-বিরতি হল। যোহর নামায এবং মধ্যানহ ভোজপর্ব সেরে নিলাম। আবার গাড়ির চাকা সচল হল। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর আঁকা বাঁকা পাহাড়ী পথ শুরু হল। একটু পরেই পাহাড়ী উপত্যকায় চায়ের স্মৃতিবিজড়িত একটি ফলক নজরে পড়লো। তাতে লেখা রয়েছে ‘চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গলে আপনাকে স্বাগতম’। মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। চা-বাগান! আমি স্বচক্ষে চাবাগন দেখতে পাব। আর দেরিসইঁছে না। দেখতে না দেখতেই চা বাগনে চলে এলাম। সুবহানাল্লাহ! চা বাগান এত সুন্দর, এত মনোহর। ছোট বড় পাহাড়গুলোর আপাদমস্তক সবুজের চাদরে আবৃত। সমান করে কর্তিত চা-বৃক্ষগুলো পাহাড়ের উচুঁ নিচুতায় যেন সবুজের ঢেউ খেলানো সমারোহ। আল্লাহ তা‘আলার সুনিপুণ সৃষ্টিকুশলাতার কারুকাজ দেখে হৃদয় চিরে উৎসারিত হল, فَتَبَارَكَ اللَّهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِينَ
ছোটবেলা বইয়ের পাতায় এবং স্নেহময়ী মায়ের কথায় চা বাগান সম্পর্কে জেনেছি। আজ মা‘হাদ কর্তৃপক্ষের উসিলায় স্বচক্ষে চা বাগান দেখার তাওফীক হল। আল্লাহ তা‘আলা তাঁদেরকে জাযায়ে খাইর দান করুন। আমীন।
ইচ্ছে করছিল‘মুক্ত মনে একা একা চা-বাগনে ঘুরে বেড়াই। চায়ের পাতায় পরম মমতায় আলতো করে হাত বুলাই’। কিন্তু সময়ের স্বল্পতায় এ ইচ্ছে আর পূরণ হল না। মনকে বুঝালাম, দুনিয়াতে মানুষের সকল ইচ্ছে পূরণ হয় না। সকল ইচ্ছে পূরণের জায়গা তো হল জান্নাত। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, لَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِي أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُونَ
মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত
চা বাগানের মাঝ দিয়ে উচঁ নিচু পাহাড় বেয়ে বেয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়েচলছে। থানা শহর হলেও বেশ উন্নত শ্রীমঙ্গল শহর। শহরে তেমন জ্যাম না থাকায় শহর পেরুতে আমাদের বেশী সময় লাগলোনা। আমরা সোজা মৌলভী বাজারের উপকন্ঠে চলে এলাম। আমাদের মুদীর ছাহেব হুযুরের জুমার মুসল্লী, দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মুহতারামসৈয়দ এনায়েতুল্লাহ সাহেবের বাড়ী মৌলভীবাজার শহরে। মৌলভীবাজারে তাদের একটি দাওরায়ে হাদীস মাদরাসা আছে। সে মাদরাসায় যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সময়ের স্বল্পতা হেতু মুদীর ছাহেব হুযুর সৈয়দ সাহেবকেফোন করে অপারগতা প্রকাশ করলেন। ঘড়ির কাঁটা তখন চারটাছুঁই ছুঁই। মাধমকুন্ড এখনো প্রায় ষাট কিলোমিটার দূরে। সুতরাং মৌলভী বাজার শহর পার হয়ে আমাদের গাড়ি উল্কা বেগে ছুটেচললো। প্রায় ঘন্টা খানেক সময় চলার পর দূরদিগন্তে আকাশ ছোঁয়াসারি সারি পর্বত মালা দেখা যেতে লাগলো। মনে হল পর্বতশৃঙ্গেযেন সফেদ মেঘমালা আটকে যাচ্ছে। আমরা মূল সড়ক থেকেডানে সরু রাস্তা ধরে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর আমাদের উপলব্ধি হল পাহাড়গুলোকে যত কাছে ভেবেছিলামআসলে তত কাছে নয়। একপর্যায়ে আমরা স্বপ্নের মাধবকুন্ডে এসে পা রাখলাম।
মুদীর ছাহেব হুযুর দ্রুত টিকিট কাটলেন। আমরা হুড়মুড় করে মাধবকুন্ড ইকো পার্কে প্রবেশ করলাম। ফটক দিয়ে প্রবেশ করতেই দেখলাম, টাইলস্ বিছানো সুন্দর এক সরুপথ। পথের ডানে গভীর খাদ। খাদের তলদেশ বেয়ে তির তির করে পানি বইছে। আর বাম পাশ ঘেষে উচুঁ পাহাড়। দেখেই বুঝা যাচ্ছিলো, পাহাড় কেটে কেটে এ সুন্দর পথটি তৈরি করা হয়েছে। এ পথেরই শেষ মাথায় মাধবকুন্ড জলপ্রপাত। দ্রুতপদে সামনে অগ্রসর হলাম। কিন্তু পথ যেন আর ফুরায় না। দুঃখের রাত যেমন দীর্ঘ হয় সুখের পথও কী তেমন দীর্ঘ হয়?। অনেকক্ষণ চলার পরআমরা কাঙ্খিত জলপ্রপাতে এসে পৌছুলাম।
চারদিকে আকাশ ছোঁয়াউচুঁ উচুঁ খাড়া পাহাড়। মাথা উচুঁ করে তাকালাম। ২০০ ফুট উপর থেকে ছলছল রবে অবিরত পানি ঝরছে। বর্ষা মৌসুমে প্রতি সেকেন্ডে ৫০০ কিউসেক পানি নির্ঝরিত হয়। এ জলপ্রপাতটি ভারতের পাথারিয়া পাহাড় থেকে উৎসারিত। আল্লাহ পাকের অসীম কুদরতের এ অপার নিদর্শন মুগ্ধ নয়নে দেখছিলাম। মুদীর ছাহেব হুযুর বললেন, এসো আগে আমরা আসর নামায পড়ি নিই। নামাযের উদ্দেশে স্বচ্ছ সুন্দর সুশীতল ঝর্নার পানিতে ওযা করেনিলাম। পাহাড়ের গা বেয়ে একটু উপরে সুুউচ্চএকটি টাওয়ার রয়েছে। সুউচ্চ পাহাড়ের উপরস্থ ঝর্নর গতি ধারা এবং মনকাড়া সৌন্দর্য উপভোগেরজন্য ভিতরে ছোট ছোট সিড়ি তৈরি করে টাওয়ারটি নির্মাণ করা হয়েছে। টাওয়ারটির ফটক তালাবদ্ধ থাকায় আগ্রহ থাকলেও তার চূড়ায় উঠা সম্ভবহল না।
টাওয়ারটির দক্ষিণ পাশে ছোট্ট একটু খোলা জায়গা। জায়গাটি নামাযের জন্য নির্ধরিত। মুদীর ছাহেব হুযুরের পিছনে আমরা আসর নামায পড়ে নিলাম। নামাযান্তে হুযুর আমাদের দিকে ফিরে বললেন, ‘এইযে এত উপর থেকে অবিরত পানি ঝরছে, এর রহস্য কি? আমি যখন হিফয খানায় পড়ি তখন আমার হুযুরের সাথে পটিয়া মাদরাসাগিয়েছিলাম। সেখান থেকে প্রাইভেট গাড়িতে করে কক্সবাজার যাচ্ছিলাম। আমাদের গাড়িতে পটিয়া মাদরাসার সাবেক মুহাদ্দিস মাওলানা সিদ্দীকুল্লাহছাহেব রহ.ও ছিলেন। পথের দু ধারে অনেক ধানক্ষেত দেখতে পাচ্ছিলাম কিন্তুকোন পানি উঠানোর মেশিন দেখতে পাচ্ছিলাম না।
আমার কঁচি মনে প্রশ্নজাগলো এ ধানগুলোতে পানি দেয় কিভাবে? প্রশ্নটি আমি সিদ্দীকুল্লাহ ছাহেব হুযূরকে করলাম। তিনি বললেন যে, পাহাড় থেকে পানি প্রবাহিত হয় সে পানিতেই এ ধানগুলো বড় হয়। আবার প্রশ্ন হলো ‘হুযুর! পাহাড় থেকে পানি প্রবাহিত হয় কেন? তখন হুযুর উত্তর দিলেন ‘পাহাড়গুলো আল্লাহর ভয়ে কাঁদে’ এরপর আয়াত পড়লেন (তরজমা) অত:পর তোমাদের অন্তর কঠিন হয়ে গেছে। তা পাথরের মত অথবা তদপেক্ষাও কঠিন। কিছু পাথর এমন আছে; যা থেকে ঝরণা প্রবাহিত হয়, কিছু এমনও আছে, যা বিদীর্ণ হয়, অতঃপর তা থেকে পানি নির্গত হয় এবং কিছু পাথর এমনওআছে, যা আল্লাহর ভয়ে খসেপড়তে থাকে! আল্লাহ্ তোমাদের কাজকর্ম স¤পর্কে বে-খবর নন। -সূরা বাকারা ৭৪,
বিশাল পাহাড়গুলো আল্লাহ তা‘আলার ভয়ে কাঁদে অথচ আমরা কাঁদি না। এখানে এসে পাহাড়ের কান্না দেখে দেখে আমরা আনন্দ-উল্লাস করি, বিশাল পাহাড়ের কান্না দেখে এ ক্ষুদ্র আমরা একটু কাঁদতে শিখি না। মানুষ এখানে এসে আল্লাহর কুদরত দেখে দেখে তাঁর প্রতি অকুন্ঠ সমর্পিত হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু না করে পর্দাহীনতা, অশ্লীলত এবং ছবি তোলা সহ নানা পাপাচারে লিপ্ত হয়। মানুষ কত অনুভবহীন। ’
মুদীর ছাহেব হুযুর কুরআনের আয়াত পড়ে পড়ে আমাদেরকে আরো বললেন, তোমরা কুরআনে পড়েছ ‘এই পাহাড়গুলো আল্লাহ পাক যমীনের জন্য পেরেক স্বরূপ বানিয়েছেন। এর দ্বারা পৃথিবীর ভারসাম্যতা রক্ষা করছেন।
আজ এ পাহাড়গুলো আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে দন্ডয়মান; কিন্তু এমন একদিন আসবে যেদিন এই বিশাল বিশাল পাহাড়গুলো ধুণিত তুলার ন্যায় উড়তে থাকবে। সুতরাং এখানে এসে শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য অবলোকন নয়; এসকল আয়াতের মর্মও হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে’।
নসীহত শেষে আমরা আবারো জলপ্রপাতটি দেখতে থাকলাম। আর ভাবতে লাগলাম, ‘যেখানেএসে মানুষ পাবে স্রষ্ট্রার সন্ধান, যেখানে এসে সমর্পিত হবে স্রষ্টার কাছে, সেখানে এসে মানুষ মেতে উঠে স্রষ্টার অবধ্যতায়। আল্লাহর কুদরত দর্শনের স্থানগুলোকেনিছক আনন্দ -বিনোদনের স্থান তারা বানিয়ে ফেলেছে।
আমি তন্ময় হয়ে মনভরে আল্লাহর কুদরত দেখছিলাম। কিন্তু সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় আমরা ফিরতি পথে পা বাড়ালাম। আমাদের গাড়ী যখন মাধবকুন্ড থেকে রওয়ানা হল তখনও মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিলাম‘হালকা আলো-আধাঁরির মাঝে নীরব দন্ডয়মান পাহাড়গুলোর দিকে’। একসময় আধাঁর নেমে এলো। আমরাও পাহাড়গুলো থেকে অনেক দূরে চলে এলাম। কিন্তু সাথে নিয়ে এলাম কিছু অমলিন স্মৃতি এবং অনেক অমূল্য শিক্ষা।
গওহরপুর মাদরাসা
মসজিদগুলোতে মাগরিব নামাজ হয়ে গিয়েছিল। একটি মসজিদ দেখে গাড়ি থামানো হল। আমরা নিজেরাই জামা‘আত করে নামায পড়লাম। এরপর আমাদের জন্য ঠান্ডা পানি ও নাস্তার ইন্তিজাম করা হল। আমি মা‘হাদ কর্তৃপক্ষের উদারতায় মুগ্ধ। আসাতিযায়ে কেরামের স্নেহে আপ্লুত। আমাদের এ সফর ছিল অনেক ব্যয় বহুল। তথাপি উস্তাদগণের চেহারায় চিন্তার রেখা ফুটে উঠতে দেখি নি। গোটা সফরে আমরা আবদার করার আগেই উস্তাদগণ আমাদের জন্য পানাহার ইত্যাদির ইন্তিজাম করেছেন। এরপর রাতের আধাঁর ভেদ করে আমাদের গাড়ি ছুটে চললো গওহরপুর অভিমুখে। গাড়িটির সাহজিক দুরন্ত ছুটে চলায় চালকের দক্ষতা ফুটে উঠছিল পদে পদে। হায়! আজ যদি উম্মাহর চালকগণ জাতিকে সঠিক রাহে সঞ্চালনে এত দক্ষ হতেন তাহলে মুসলিম জাতি এ করুণ দশার স্বীকার হত না।
বেশকয়েকটি উপজেলা পেরিয়ে সিলেট শহর ঘেষা দক্ষিণ সুরমা হয়ে রাত প্রায় সাড়ে ন টা নাগাদ আমরা গওহরপুর মাদরাসায় পৌঁছাই।
জামি‘আ হুসাইনিয়া গওহরপুর মাদরাসাটি সিলেটের সর্ববৃহৎ মাদরাসাগুলোরএকটি। এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন দেশ বরেণ্য বুযুর্গ, বেফাকুল মাদাসিরিল আরাবিয়াবাংলাদেশের সাবেক সভাপতি,মাদানী রহ.এর অন্যতম খলিফা আল্লামা নূরুদ্দীন গওহরপুরী রহ.। মাদরাসাটির বর্তমান মুহতামিম হলেন ‘গওহরপুরী রহ. এর সুযোগ্য পুত্রমাওলানা মুসলেহুদ্দী রাজু ছাহেব। তিনি আমাদের উস্তাদগণেরসহপাঠি ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমরা যখন গওহরপুর মাদরাসায় পৌঁছলাম তখন মুহতামিম ছাহেবজরুরী কাজে শহরে থাকায় অন্যান্য উস্তাদগণ আমাদেরকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। মাদরাসার পুকুরের তরতাজা মাছ এবং মুরগীর গোস্ত দিয়ে আমাদের রাতেরআপ্যায়ন করলেন। মাদরাসায় পৌঁছেই আমরা ঈশার নামায পড়েছিলাম। ব্যাস,আহারান্তে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। চোখে নেমে এলো রাজ্যেরঘুম। আল্লাহ তা‘আলা ফযরের পূর্বেই আমাদেরকে ঘুম থেকে উঠার তাওফীকদান করলেন।
ফযর নামায পড়ে আমরা গওহরপুরী রহ. এর কবর যিয়ারত করতেযাচ্ছিলাম। গওহরপুরী রহ. যেহেতু জামি‘আ রাহমানিয়ার মুরুব্বী ছিলেনসেই সুবাধে আমাদের মুহতারাম উস্তাদদ্বয় হযরত রহ. কে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন। হযরত রহ. এর কবরস্থানে যাওয়ার পথে মুদীর সাহেব আমাদের উদ্দেশেগওহরপুরী রহ.এর আধ্যাত্মিক অবস্থা, তাঁর বিভিন্ন কারামাত ও খিদমাত ইত্যাদি সম্পর্কে কিছু আলোচনাকরলেন। হযরত গওহরপুরী রহ. জীবদ্দশায় বাড়ির নিকটবর্তী যে পাঞ্জগানামসজিদটিতে সাধারণত: নামায পড়তেন,যে মসজিদে নির্জনে আল্লাহর ধ্যনে মগ্ন হতেন সেই ছোট্ট মসজিদটির সামনেই হুযুর সুখনিদ্রায় শায়িত আছেন। আমরা কবর যিয়ারত করলাম। অনেকের চোখেই চিক্ চিক্ করছিল ফোঁটা ফোটা অশ্রু।
কবর যিয়ারত করে এসে আমরা গওহরপুর মাদরাসার শিক্ষাসচিব এবং শায়খমাওলানা আব্দুস সাত্তার হিমুবী দা:বা: এর কামরায় এলাম। বয়োবৃদ্ধ এ বুযুর্গ ব্যক্তি আমাদেরকে হৃদয় নিংড়ানো কিছু নসীহতকরলেন। হুযুরের ভাষা সিলেটি হলেও আমাদের বুঝতে কোন অসুবিধেহচ্ছিলনা। সাহিত্যালংকারে সজ্জিত কাব্য মালায় নয় হৃদয়ের তাপও উত্তাপেই হৃদয় উত্তপ্ত হয়। হুযুরের কথাগুলোবিশুদ্ধ বাংলায় উচ্চারিত না হলেও তার হৃদয়ের দরদ ও মহব্বত এবং ভাব ও প্রভাব ছিল একদমবিশুদ্ধ। নিষ্কলুষ দিলের বিশুদ্ধ ভাবনাই আমাদেরকে মোহাবিষ্টকরলো। আমরা তন্ময় হয়ে হুযুরের নসীহত শুনতে লাগলাম। হুযুরের নসীহতের সার কথা হল, আপনারা ইখলাস, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে দীনের খিদমত করবেন। এ ফেতনার যুগে যেভাবে সম্ভব খিদমত করতে থাকুন। দীনের কোন খিদমতকেই তুচ্ছ মনে করবেন না।
নসীহত শেষে হুযুর নিজ রুমে বসিয়েই আমাদের জন্য চা-বিস্কুটের ইন্তিজাম করলেন।
এরপর আমরা সামান্য বিশ্রাম করে ও নাস্তাপর্ব সেরে গাড়ীতে আরোহন করলাম।
বিশ্বনাথ মাদরাসা
আমাদের গাড়ী অল্পসময়েই পৌঁছে গেল সিলেটের বিশ্বনাথ থানা শহরে। এ শহরটিতে দুটি দাওরায়ে হাদীস মাদরাসা রয়েছে। একটির মুহতামিম ছিলেন দেশ বরেণ্য আলেমে দীন মাওলানা আশরাফ আলীবিশ্বনাথি রহ.। আরেকটির মুহতামিম হলেন মাওলানা সাদিকুর রহমান বিশ্বনাথিছাহেব। উভয় মাদরাসায় গেলাম। কিন্তু সেদিন ছিল ২৬ শে মার্চ। ছুটির দিন হওয়ায় মাওলানা সাদিকুর রহমান বিশ্বনাথী ছাহেব মাদরাসায়ছিলেন না বিধায় তাঁর সাক্ষাত পেলাম না। আশরাফ আলী বিশ্বনথীরহ. এর মাদরাসাটি বেশ বড় । বিস্তীর্ণ ভূমিরউপর প্রতিষ্ঠিত। চারদিকে ভবন। মাঝে বড় মাঠ। মাঠে উত্তর পাশেসুন্দর করে বাঁধানো একটি কবর। মুদীর ছাহেব হুযুরবললেন, এ কবরটি মাওলানাআশরাফ আলী বিশ্বনাথি রহ. এর। এরপর হুযুর আমাদেরকেবিশ্বনাথী রহ. এর মহান ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দিলেন।
কবর যিয়ারত শেষে আমরা মাদরাসার শিক্ষা সচিব সাহেবের সাথে সাক্ষাতকরলাম। হুযুর আমাদের অত্যাধিক সমাদর করলেন। প্রথমে নিজ রুমে বসিয়ে ছিলেন। পরিচিতি হওয়ার পর অনেকটা জোর করে আমাদেরকে অফিস রুমে নিয়ে গেলেন। চা-নাস্তার ব্যবস্থা করলেন। খুব পীড়াপীড়ির পর তিনি মুক্ত সদৃশ কিছু নসীহত করলেন। হযরতের নসীহতের সার কথা হল, আজ আমরা বড় বে-ফিকির। নিজের ও সমাজের সংশোধনের ফিকির থাকতে হবে। গাফলতের চাদর ঝেড়ে ফেলে আমাদেরকে আবার উঠে দাঁড়াতে হবে। নতুবা অধঃপতনের হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করা যাবে না।
বিশ্বনাথ মাদরাসার বর্তমান মুহতামিম আল্লামা বিশ্বনাথি রহ. এর ছেলে। তিনি মুদীর ছাহেব হুযুরকে ফোনে দুপুরের খানা খাওয়ার আবদার করলেন। আমাদের হাতে যেহেতু একদমই সময় ছিলনা তাই মুদীর ছাহেব হুযুর বিনয়ের সাথে সে অনুরোধ ফিরিয়ে দিলেন। মাদরাসা কর্তৃপক্ষ এই মাদরাসা থেকে প্রকাশিত মাসিক আল ফারুক সহ আমাদেরকে কয়েকটি বই হাদিয়া দিলেন। শিক্ষা সচিব ছাহেব সহ মাদরাসার অন্যান্যরা আমাদেরকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে পরম আন্তরিকতার পরিচয় দিলেন। তাদেরকে আল বিদা জানিয়ে আমরা গড়িতে চড়ে বসলাম।
শাহ জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
আমাদের গাড়ি সিলেট শহরে প্রবেশ না করে বাইপাস পথধরে শাহ জালালবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে চলে এলো। মূল ফটক থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার ভিতরে ঢুকে ছাত্রাবাসের সামনেএসে আমাদের গাড়ি থামলো। ঐ ভার্সিটিরই ছাত্র ভাই যুবায়ের আহমাদ সহ আরো কয়েকজনআমাদেরকে অভ্যর্থনা জানালেন। আমাদের মুদীর ছাহেবহুযুরের জুম‘আ মসজিদের মুসল্লী, ঢাকা কলেজের অধ্যাপক জনাব আলাউদ্দীন ছাহেবের ছেলে হলেন যুবায়ের ভাই। তারা দু-ভাই এ ভার্সিটিতেপড়ে। আরেকজন হলেন ভাই আম্মার। মা-শা-আল্লাহ দুজনেই সুন্নতি লেবাসধারী এবং খুব দাওয়াতের ফিকির কারনেওয়ালা। আমাদেরকে তারা হলের ভিতর নিয়ে গেল। নিজ হাতে পাকানো সেমাই দ্বারা আপ্যায়ন করলেন। ভার্সিটিতে বর্তমানে দাওয়াতী কাজ কেমন চলছে, কোন সমস্যা হয় কিনা? আমাদের এরূপ প্রশ্নের উত্তরেরসংক্ষিপ্ত কারগুযারী শুনালেন এবং বললেন, কিছু দিন আগে ছাত্রলীগ আর ছাত্র শিবিরের মাঝে খুব দাঙ্গা হাঙ্গামাহয়েছে। ছাত্রলীগ শিবির কর্মীদেরকে হলগুলো থেকে বের করে দিয়েছেঠিক; কিন্তু ভয়ে তারাওহলে থাকে না। ফলে হলে এখন শুধু আমরা আর সাধারণ ছাত্ররা আছি। আল্ হামদুলিল্লাহ আমাদের কোন সমস্যা হচ্ছে না।
তাদের মুখে ছাত্রদের মারমারির কথা শুনে কবি মুহিব খানের একটি কবিতা মনে পড়ে গেল। ‘কেন ভার্সিটি আর কলেজগুলোতে অস্ত্র গুদাম রেখে, সরকার কাঁপে মাদরাসা পড়া মাওলানাদের দেখে’।
গাজী কালুর মোকাম
যুবায়ের ভাই শুনালেন এ ভার্সিটিরই এক পাহাড়টিলায় গাজী কালুর মোকাম আছে। আমরা সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। যুবায়ের এবং আম্মার ভাইও আমাদের সঙ্গী হলেন। ভার্সিটির পিছনে এক পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে আমাদের গাড়ি থামলো। পাহাড়টি বেশ উচুঁ এবং সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত। আমরা যে যেদিক দিয়ে পারলাম প্রতিযোগিতা করে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে পড়লাম। পাহাড়ের উপরে একটি মাজার। মাজারটির ফলকে লেখা আছে ‘এটা গাজী কালুর মাজার’।
মাজারটিতে আগরবাতি জ্বলছে। ভিতরে ঘোমটা দিয়ে একটি মহিলা বসে আছে। বাহিরে চল্লিশোর্ধ একলোক এবং ছোট্ট একটি ছেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদেরকে দেখছে। লোকটিকে দেখেই মনে হল তিনি স্থানীয়। মাজারটির হাকীকত সম্পর্কে তারঁ কাছে জানতে চাইলাম। তিনি হয়ত এমন একটি প্রশ্নেরই অপেক্ষায় ছিলেন। বললেন, এটা গাজীর মোকাম। গাজী কালু দীন প্রচারের জন্য বাঘের পিঠে চড়ে এদিক দিয়ে গিয়েছিলেন। যাওয়ার সময় অল্প সময়ের জন্য এখানে বসেছিলেন। তাই এখানে মাজার তৈরি হয়েছে। শুধু এখানে নয় যেখানে যেখানে তিনি বসেছিলেন সব জায়গাতেই এক একটি মাজার তৈরি হয়েছে’। সে আরো জানালো এ পাহাড়ে বার্ষিক উরস হয়। অনেক মানুষ আসে…। পাশেই ছোট্ট আরেকটি মাজার রয়েছে। হয়ত বলা হবে যে এমাজারে শায়িত কল্পিত লোকটিও গাজী কালুর সঙ্গী ছিল। অত:পর সেখানেও নজর মান্নত নেয়া হবে।
পাহাড়টির দক্ষিণে ভার্সিটি, পূর্ব ও উত্তরে জন বসতি, পশ্চিমে অনেক দূর পর্যন্ত সমতল ভুমি, এরপর সবুজ গ্রাম। পাহাড়ের উচ্চতায় দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখতে খুব ভালো লাগছিল।
কাজির বাজার মাদরাসা
আমরা পাহাড় থেকে নেমে গাড়ীতে করে সোজা কাজীর বাজার মাদরাসায় চলে এলাম। সিলেট শহরের সবচেয়ে বড় মাদরাসা হল কাজির বাজার মাদরাসা। দীর্ঘকায় বিশাল ভবন। আমরা দফতরে প্রবেশ করলাম। সালাম মুসাফাহার পর আমাদের পরিচয় দিলাম এবং আগমনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলাম। মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান ছাহেব মাদরাসায় ছিলেন না। তাই আমাদের আগমন সংবাদ পেয়ে প্রধান মুফতী হযরত মাওলানা সিদ্দীক আহমাদ ছাহেব ছুটে এলেন। আমাদেরকে ইফতা বিভাগে নিয়ে গেলেন। কাজির বাজার মাদরাসার ইফতা বিভাগের উপস্থিত ছাত্র ভায়েরা আমাদের সাথে দেখা করলেন। অনুরোধের প্রেক্ষিতে হুযুর সবাইকে বেশ দীর্ঘ নিয়ে সময় ইফতা বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ নসীহত করলেন। যার সারমর্ম হল, ১.বেশির চে বেশি মুতালায়া করতে হবে। মুতালায়াকে নেসাবের গন্ডিতে সীমিত করলে চলবে না। ২. প্রতিটি ফতওয়াতে বেশীর চে বেশী হাওয়ালা দিতে হবে। দু-এক কিতাবের উপর নির্ভর করলে চলবে না। ৩. আমলের প্রতি যতœবান হতে হবে। নসীহত শেষে হুযুর দু‘আ করলেন। এরপর আমরা বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
হযরত শাহজালাল রহ. এর মাযার
হযরত শাহজালাল রহ. এর মাযারের মসজিদ ও মাদরাসার মধ্যবর্তি ফটকেএসে গাড়ি থামলো। আমরা ফটক দিয়ে প্রবেশ করলাম। টাইলস্বিছানো চত্তর। পূর্ব-দক্ষিণ পাশেদাওরায়ে হাদীস মাদরাসা। দক্ষিণ পাশে সুন্দর মসজিদ। এ মসজিদে মুফতী শফী রহ. বেশ কয়েক রমজানে ই‘তিকাফ করেছেন। আম্মার ভাই বললেন ‘আলহাম্দুলিল্লাহ! মসজিদ এবং মাদরাসা কমিটি হকপন্থী; মাযার পন্থী নয়। হযরত শাহজালাল রহ. মাযারটি সমতল ভূমি থেকে বেশ উচুঁ টিলার উপরঅবস্থিত। জুতো খুলে প্রবেশ করতে হয়। জুতো হাতে নিয়ে প্রবেশ ও নিষিদ্ধ। আল্লাহর ঘর মসজিদে জুতো হাতে নিয়ে প্রবেশ করা গেলেও মাযারে জুতোহাতে প্রবেশ নিষিদ্ধ,তাহলে কি মাযার আল্লাহর ঘরের চাইতেও…? আমাদের জুতোগুলো মসজিদের বাক্সে রেখে আমরা মাযারে প্রবেশ করলাম। প্রবেশ পথে মোটা সোটা বেশ কয়েকজনকে দেখলাম দান বাক্স ইত্যাদিনিয়ে বসে আছে। চেহারা সুরত দেখলেই বুঝা যায ‘মাজার ব্যবসায় এরা খুব মোজেআছে। বিনা পুজিঁতে প্রচুর ইনকাম।’
ভিতরে প্রবেশ করলাম। বেশ কয়েকটি টাইল্সমোড়ানো কবর। একটি কবর বেশ বড়। উপরে শামিয়ানা টানানো। কবরের উপর রঙিন কাপড় বিছানো। বুঝতে কষ্ট হল না যে, এটাই শাহজালাল রহ. এর মাজার। সুন্নত মুতাবিক যিয়ারত করলাম। কবরে ফুল দেয়া আছে। অনেক মানুষ চারদিকেররেলিং-এর উপর মাথা ঠেকিয়ে দু‘আ করছে। কেউ মাজারে আগরবাতিমোমবাতি কোন কিছু দিতে চাইলে দাড়িবিহীন খাদেম নামধারী লোকগুলো বলছে, এগুলো আমাদের হাতে দিন সময়মত আমরাই জ্বালাবো। একলোক প্রায় আড়াই থেকে তিনফুট লম্বা এক বিশাল মোমবাতি নিয়ে এসেছে। মাজারে জ্বালাতে চাচ্ছে। খাদেম নামধারী এক ব্যক্তির লোলুপদৃষ্টি মোমটির উপর পড়ল। সে বললো, আমার কাছে দিন আমি সন্ধ্যায় জালিয়ে দেব। লোকটি বললো, আমি চট্টগ্রাম থেকে এসেছি মোমটি এই মাযারে জ্বালানোর জন্যই। বিশেষ উদ্দেশ্যে আমাকে নিজ হাতে মোমটি জ্বালাতে বলা হয়েছে। কিন্তু খাদেম লোকটি বললো, তাহলে সন্ধ্যায় আসেন…।
এ কথপোকথন উপভোগ করার সময় আমাদের হাতে ছিল না। বিধায় আমরা বেরিয়ে এলাম। মাযার চত্তরের উত্তর -পূর্ব কোণে একটি ঘরের ভিতর কয়েকটি অদ্ভুতডেক দেখতে পেলাম। রাত্রি বেলা এ ডেগগুলোর চার পাশে মোমবাতি জ্বালানোহয়। ডেগগুলোর পরিচয় জানতে চাইলে একজন বললো ‘এ ডেগগুলোতে হযরত শাহজালালরহ. এবং তাঁর সঙ্গীগণের খাবার পাক হত।
উত্তর পাশে একটি পুকুর। পুকুরে অনেক গজার মাছ দেখতে পেলাম। মানুষ মাকছুদ হাসিলের জন্য গজার মাছগুলোকে খাবার দিচ্ছে। ব্যথাতুর মনটা আরো ব্যথিত হল, হিন্দুরা যেমন জীব-জন্তু, জড়পদার্থের পুঁজা করে মাযারকেন্দ্রিক আজ সে পুঁজাই আজ মুসলমানরা করছে। খানজাহান আলীর মাজারেকুমির পুঁজা, বায়েজিদ বোস্তামীরমাজারে কাছিম পুঁজা আর এখানে হচ্ছে গজার পুঁজা। মুদীর সাহেব হুযুর আমাদেরকে মাযারের পশ্চিম পার্শে নিয়ে গেলেন। সেখানে টাইল্স বাঁধানো কাঁচে ঢাকা একটি কূপ দেখতে পেলাম। যা যমযম কূপ হিসাবে খ্যাত। কূপের কাছেও জুতো নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ। তাই জুতো খুলে কাছে গেলাম।
ঢোকার পথে একজন খাদেমকে মুদীর ছাহেব হুযুর জিজ্ঞাসা করলেন ভাইএটি কিসের কূপ? আমাদের বেশ ভূষাদেখেই আমাদের পরিচয় বুঝে ফেললো,তাই মনের কথাকে লুকিয়ে বললো ‘হযরত শাহ জালাল রহ.একূপ থেকে পানি পান করতেন। হুযুর আবার জিজ্ঞাসাকরলেন ‘এ কূপের সাথে মক্কারযমযম কূপের সংযোগ আছে কিনা?উত্তর দিল ‘ মানুষ তো তাই বলে’। আমরা কূপে কোন পানিনা দেখলেও দেখতে পেলাম ‘কূপকমপ্লেক্সের একটিছোট্ট কামরার সামনে বহু মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁদেরকে খাদেম সাহেবরা পানি পান করাচ্ছে। ঐ পানিগুলো নাকি এই কূপেরই। দেখলাম নোংরা পানিগুলো বরকত মনে করে মানুষ কি পরম আগ্রহে পানকরছে। আমাদের মুদীর ছাহেব হুযুর শুনালেন, তিনি কয়েক বছর পূর্বে এখানেএসেছিলেন। তখন এত উন্নত ছিল না। প্লাস্টিকের বোতলে ভরে ভরে তখন যমযম কূপের পানি বলে বলে বিক্রিকরতো।
কূপ থেকে বেরিয়ে আমরা সোজা গাড়িতে চলে এলাম। যুবায়ের ভাই ভার্সিটিতেই থেকে গিয়েছিলেন। এবার আম্মার ভাইও বিদায় নিলেন। পাশের এক মসজিদে জামা‘আতের সাথে যোহর নামায আদায় করলাম। এরপর ভালো একটি হোটেল দেখে গাড়ি থামানো হল। আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। এরপর আবার গাড়িতে উঠলাম। মুদীর ছাহেব হুযুর বললেন আমরা সোজ জাফলং চলে যাবে। ফেরার পথে শাহ্ পরান রহ. এর মাযারে যাব ইনশা-আল্লাহ।
সুন্দর, মনোরম পথে আমাদের গাড়ি ছুটে চললো। কল্পনার বাতায়ন পথে আমি আবার ফিরে গেলাম শাহজালাল রাহ. এর মাযারে। ভাবলাম, পৌত্তলিকতার ঘোর অমানিশায় ইয়ামান থেকে সঙ্গী সহ হযরত শাহ জালাল রহ. এলেন। প্রতিমা পুঁজার বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন। রাজা গৌরগোবিন্দ সহ সকল হিন্দু রাজাদের দম্ভ-অহংকার চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিলেন। শিরক-বিদআত থেকে মানুষদেরকে পুতঃপবিত্র করণের লক্ষ্যে গোটা জীবন প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলেন। আজ তার কবরে শিরক-বিদআতের সয়লাব। যে মাজারে এসে নেয়ার কথা ছিল কুফর বিরোধিতার দীক্ষা , সেখান থেকেই শুরু হয় কুফুরীতন্ত্রে নির্বাচনী যাত্রা। এধরনের এলো মেলো চিন্তা আমাকে ব্যথিত করে তুলছিল। মনে পড়লো কাজী নজরুলের একটি কবিতার কয়েকটি পঙিক্তি,
তাওহীদের হায় এ চির সেবক, ভুলিয়া গিয়াছে সে তাকবীর।
দুর্গা নামের কাছা কাছী প্রায়, দরগায় গিয়ে লুটায় শীর।
ওদের যেমন রাম-রামায়ণ, এদের তেমন মানিক পীর।
ওদের চাল ও কলের সঙ্গে, মিশিয়া গিয়াছে এদের ক্ষীর।
তমাবিল
আমাদের গাড়ী বিশাল বিশাল বিলের মাঝ দিয়ে ছুটে চলছিল। এক পর্যায়ে আমারা দেশের সর্ববৃহৎ বিল তামাবিলের মাঝ দিয়ে চলতে লাগলাম। আদীগন্ত বিস্তৃত সবুজের সমারোহ। দৃষ্টির শেষ সীমায়ও কোন বাড়ী ঘর নজরে পড়ছেনা। সবাই দারুন পুলকিত হচ্ছিল। একজন বললো ‘চলন বিল’ বড় না ‘তামাবিল’ বড়। যারা চলনবিল দেখেছেন তারা বললেন ‘তামাবিলকে চলন বিল থেকে অনেক বড় মনে হচ্ছে। তবে বই পুস্তকে চলন বিলকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল সিসেবে গণ্য করা হয়।
জাফলং
তামাবিল পেরিয়ে এলাম। বাড়ি ঘরের মাথার উপর দিয়ে ঐদূর সীমানায় বিশাল বিশাল পাহাড় দেখা যাচ্ছে। হালকা কুয়াশার ন্যায় আবছা আবছা। ধীরে ধীরে পাহাড়ের কাছে চলে এলাম। খুব কাছে। ইচ্ছে করছিল পাহাড়গুলো একটু ছুঁয়ে দেখি। কিন্তু তা সম্ভব নয়। ঐ পাহাড়গুলো যে ভারতের। পাহাড়ের কাছে যাওয়ার আগেই হয়তো বি, এস, এফ এর নির্মমতার শিকার হতে হবে। তাই চলন্ত গাড়িতে বসেই পাহাড়গুলোর দিকে অপলকনেত্রে তাকিয়ে থাকলাম। কোন কোনপাহাড়ের গা বেয়ে সরু ঝর্ণাও প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টির দিনে সেগুলোতে অনেক ঝর্ণা সৃষ্টি হয়। তা দেখে পর্যটক মাত্রই বিমুগ্ধ হবে। এটাই স্বাভাবিক।
উচুঁ নিচু পাহাড়ী রাস্তা চলতে চলতে এক সময় আমরা জাফলং নদীর তীরেচলে এলাম। বহু পর্যটক নদীর পাড়জুড়ে হাঁটাহাঁটি করছে। নদীতে অনেক সরু দীর্ঘ এক ধরনের নৌকা দেখতে পেলাম। স্থানীয় লোকজন নৌকাগুলোতে পাথর তুলছে। কোনোটি থেকে আবার পাথর নামানো হচ্ছে। দূর থেকে নদীর ওপারে সারি সারি সবুজ বিথীকা চোখে পড়ছে। ডান দিকে রেখে আসা পাহাড়ের সারি দেখা যাচ্ছে। বিশাল বিশাল সবুজ পাহাড় গুলো আমাদেরকে কাছে টানছিল। আমরা নদীর তীরধরে পাহাড়গুলোর দিকে এগুতে লাগলাম। নদীটি ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে উৎসারিত। ঐ পাহাড়গুলোর মাঝ দিয়েই প্রবাহিত হয়ে তা বাংলাদেশের সীমানায়ঢুকে পড়েছে। পাহাড়গুলোতে হতে স্রোতের সাথে পাথর ভেসে আসে। আর সে পাথর কুড়িয়ে আমাদের দেশের অনেকের জীবিকার ব্যবস্থা হয়। আমরা হাঁটতে হাঁটতে একদম পাহাড়গুলোর নিকটে চলে এলাম। নজরে পড়লো বি.জে.বি ও বি.এস.এফ এর ক্যম্প।
আমরা বি.জে.বির শীর্ণ ক্যাম্প অতিক্রম করে বি.এস.এফের ক্যম্পবরা বর এসে পড়লাম। শুধু আমরা নই, আমাদের মত আরো অনেক ভ্রমণপিয়াসীরাও রয়েছে সেখানে। কয়েকজন বি.এস.এফ সদস্য লাঠি হাতে সীমানা টহল দিচ্ছে। আমরা যেখানে দাঁড়ানো তার ঠিক সামনের দিক থেকেই পাহাড়গুলো মাঝদিয়ে নদীটি প্রবাহিত হয়ে এসেছে। দুপাশের পাহাড়গুলোতেযাতায়াতের জন্য একটি ঝুলন্ত ব্রিজ নির্মিত হয়েছে। পাহাড়গুলোর বাঁকে বাঁকে জনবসতি। গাড়ী চলার রাস্তা। নিচ থেকে চলমান গাড়ীগুলোকেমনে হল খেলনা গাড়ি। ভারতের সীমানার ভিতর অনেক ভারতীয় নাগরিক কাজ করছে। আমাদের আমীনুত্ তা‘লীম ছাহেব হুযুর একজন বি.এস.এফ সদস্যের কাছে সীমানাসম্পর্কে জানতে চাইলেন। সে আমাদের পার্শস্থ একটি বড় পাথর দেখিয়ে বললো ‘এটি সীমানা’। আমরা কয়েকজন ভারতেরসীমানার ভিতর চলে গেলাম। বি.এস.এফের এক সদস্য বাঁশি বাজিয়ে আমাদেরকে বেরিয়েযাওয়ার সঙ্কেত দিল। মুদীর ছাহেব হুযুর আমাদেরকে ভারতের সীমানায় না ঢুকতেনিষেধ করলেন।
দু-একজন ছাড়া সবাই নদীতে গোসল করলাম। আহ্! কি স্বচ্ছ পানি। নদীর তলদেশের ছোটছোট পাথরগুলো পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। পানি ছিল শান্তিময়শীতল, আরামদায়ক। পানির শীতলতা আমার হৃদয়কে স্পর্শ করলো। জীবনে কখনো কোন গোসলে এত তৃপ্তি পাইনি। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, আমি ভূপৃষ্ঠে প্রবাহিত করি নির্ঝরিণী। (সুরা ইয়াসীন:৩৪)
গোসল শেষে আমি মায়াভরা নজরে পাহাড়গুলোর দিকে তাকালাম। মনে পড়লো আল্লমা ইকবালের কবিতা ‘মুসলিম হ্যাঁয় হাম ওতন হায় সারা জাহাঁ হামারা। রুয়ে যমীন ছে লে-কার তা আসমাঁ হামারা’
এ পাহাড়গুলোতো আমাদেরই। মুসলমানরাই এ পহাড়গুলোর অধিকারী ছিল। আবার ইনশা-আল্লাহ মুসলমানরা একদিন এগুলোর মালিক হবে।
দেখতে দেখতে কখন যে আসরের সময় হয়ে গেল তা টেরও পেলাম না। আমরা ফিরতি পথে রওয়ানা হলাম। আমার আসতে মন চাচ্ছিল না। পাহাড়গুলোকে বিদায় জানাতে কষ্ট হচ্ছিল। ফিরে ফিরে দেখছিলাম। আল্লাহ পাকের কুদরতের এ নিপুণ সৌন্দর্যে দেখে আবারও আমার দিল থেকে উৎসারিত হল, فَتَبَارَكَ اللَّهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِين
শাহপরাণ রহ. এর মাযার
পথে উচুঁ টিলার উপর অবস্থিত এক মসজিদে আসর নামায পড়লাম। নামাযান্তে আমাদের গাড়ি আবারও ছুটে চললো। পথে একস্থানে লেখা দেখলাম মুরীদ নগর। আরেকটু সামনে অগ্রসর হয়ে দেখলাম ‘পীরের বাজার। সিলেটের বিভিন্ন স্থানে আমরা অদ্ভুত নামের অসংখ্য মাজার দেখতে পেয়েছি। পীর-মুরীদির ব্যবসা ভালই চলছে। পুঁজিহীন ব্যবসা। তবে ধরা পড়বে আখিরাতে ।
আমরা মাগরিবের পূর্বেই শাহ্পরাণ রহ. এর মাযারে এসে উপস্থিত হলাম। শাহজালাল রহ. এর মাযারের মত এ মাযারটিও উচুঁ টিলায় অবস্থিত। দেখলাম, কিছু মানুষ মাযার থেকে উল্টো ভাবে নামছে। মাযারমুখী মুখ রেখে পিছন দিকে হাঁটছে। এখানেও নজর নেয়াজ গ্রহণ করার জন্য কিছু লোক বসে আছে। আমরা মাযার যিয়ারত করে মাগরিবের নামায আদায় করলাম এবং ঢাকার পথে রওয়ানা হলাম।
মাওলানা মুসলিহুদ্দীন রাজু সাহেব এর সাক্ষাত
আমরা গওহরপুর মাদরাসায় রাত্রি যাপন করলেও মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা মুসলিহুদ্দীন রাজু সাহেবের সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হয়নি। তাই তিনি আমাদের মুদীর ছাহেব হুযুরকে ফোন করে বললেন ‘আমি সিলেট শহরে আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছি, আমি আপনাদের সাথেদেখা করব’। সিলেট শহরের গোল্ডেনহোটেলের সামনে আমাদের গাড়ি দাঁড়ালো। মুদীর ছাহেব হুযুরতাঁর সাথে ফোনে কথা বললেন। অল্প সময়ের মধ্যেআগামী দিনে সিলেটের ইসলামী জাগরণের সম্ভাবনায় অগ্রপথিক মাওলানা মুসলিহুদ্দীন রাজু ছাহেবএকটি প্রাইভেট কার যোগে এসে হাজির হলেন। সবার সাথে সাক্ষাৎ শেষে তিনি আমাদেরকে উন্নত একটি হোটেলে নিয়ে গেলেন। আপ্যায়ন করলেন। মুদীর ছাহেব হুযুরেরঅনুরোধে তিনি কিছু নসীহত করলেন। এ সংক্ষিপ্ত নসীহতইতাঁর শাণিত চিন্তার প্রমাণ বহন করছিল। আপ্যায়ন শেষে আমরাঢাকার উদ্দেশ্য রওয়ানা হলাম। রাত দুটোর দিকে যখনআমরা বছিলা ব্রিজ পার হচ্ছিলাম তখন আমাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল-
ائبون تائبون عابدون لربنا حامدون
লেখক
ছাত্র, মা’হাদুল বুহুসিল ইসলামিয়া