মুফতী হাফিজুর রহমান
ঈদে মীলাদুন্নবী অর্থ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্ম উৎসব বা জন্ম বার্ষিকী। বস্তুত কারো জন্ম বা
মৃত্যু দিবস পালন করার বিষয়টি ছিল আরবের মানুষের কাছে একেবারেই অজ্ঞাত। এসব দিবস পালন মূলত অনারবীয় সংস্কৃতির অংশ।
পারস্যের
অগ্নিপূজক ও বাইযান্টাইন খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ
ছিল জন্ম দিবস, মৃত্যু দিবসসহ
দিবসকেন্দ্রিক নানা উৎসব পালন করা। প্রথম যুগের মুসলিমগণ এসব দিবস পালনের বিষয়ে অবগত ছিলেন না। প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে পারস্য, সিরিয়া, মিসর ও এশিয়া মাইনরের যে
সকল মানুষ ইসলামের
ছায়াতলে আশ্রয়
গ্রহণ করে তারা জীবনের সকল ক্ষেত্রে সাহাবীদের অনুসরণ অনুকরণ করতেন এবং তাদের
জীবনাচারে আরবীয় রীতিনীতিরই প্রাধান্য ছিল। হিজরী তৃতীয় শতাব্দী থেকে মুসলিম
সম্রাজ্যে অনারব পার্সিয়ান এবং তুর্কী মুসলিমদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
এরপর থেকে মুসলিম সম্রাজ্যে নানা ধরনের সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতির প্রচলন
ঘটতে থাকে। তন্মধ্য হতে ঈদে মীলাদুন্নবী অন্যতম। মূলত চতুর্থ হিজরী
শতাব্দির মাঝামাঝি থেকে শিয়া সম্প্রদায়ের উদ্যোগেই দুই ঈদের বাইরে কোনো দিবসকে ঈদের মত করে
সামাজিকভাবে উদযাপনের ধারা শুরু হয় । সর্বপ্রথম ৩৫২ হিজরীতে (৯৬৩
খ্রিষ্টাব্দ) বাগদাদের আব্বাসী খলীফার প্রধান প্রশাসক ও রাষ্ট্রের প্রধান
নিয়ন্ত্রক শিয়া শাসক মুইজ্জুদ্দৌলা ১০ই মুহাররম আশুরাকে শোক দিবস ও জিলহজ্জ মাসের ৮ তারিখকে গাদীরে
খুম দিবস তথা উৎসব দিবস হিসেবে পালন করার নির্দেশ দেন। তার নির্দেশে এ দুটি দিবস সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়
মর্যাদার সাথে পালন করা হয়।
অন্যদিকে উবাইদ
বংশের রাফেযী ইসমাঈলী শিয়াগণ ফাতেমী বংশের নামে আফ্রিকার উত্তরাংশে
রাজত্ব স্থাপন করেন। ৩৫৮ হিজরীতে (৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দ) তারা মিশর দখল করে তাকে
ফাতেমী রাষ্ট্রের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলেন। এবং পরবর্তী দুই শতাব্দীরও
অধিককাল মিশরে তাদের শাসন ও কর্তৃত্ব বজায় থাকে। এ সময়েই ফাতেমী খলীফা
আলমুয়িজ্জু লিদীনিল্লাহ সর্বপ্রথম ঈদে মীলাদুন্নবীসহ অন্যান্য জন্মদিবস পালনের
উৎসব সূচনা করেন। দুই শতাব্দীর ফাতেমী শাসনকালে মিশরের ইসমাঈলী শিয়া
শাসকগণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দুই ঈদ ছাড়াও এ দিবসগুলোকে ঈদের মত করে পালন করতেন।
তারা অত্যন্ত আনন্দ, উৎসব ও উদ্দীপনার মধ্য
দিয়ে পাঁচটি জন্মদিবস পালন
করতেন।
১। রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মদিবস।
২। আলী রা. এর জন্ম
দিবস।
৩। ফাতেমা রা. এর
জন্মদিবস।
৪। হাসান রা. এর
জন্মদিবস।
৫। হুসাইন রা. এর
জন্মদিবস।
এছাড়াও তারা
জীবিত খলীফাদেরও জন্মদিবস পালন করতেন। এবং মীলাদ নামে ঈসা আ. এর জন্মদিন তথা বড় দিন
বা ক্রিসমাস ডেও পালন করতেন। তবে বর্তমান সিরিয়ার ইরবিলের তৎকালীন শাসক আবু
সাঈদ কূকুবুরীর মাধ্যমেই মূলত ঈদে মীলাদুন্নবীর এ কালচার সুন্নী জগতে এবং
সমগ্র মুসলিম বিশ্বে জনপ্রিয় উৎসবে পরিণত হয়। সপ্তম হিজরী শতকের শুরুর
দিকে তিনিই প্রথম এ উৎসবকে বৃহৎ আকারে পালন করতে শুরু করেন এবং সাধারণের মধ্যে এ উৎসবের প্রচলন
ঘটান।আবুল খাত্তাব
ইবনে দিহইয়া নামক
জনৈক বিদ্বান ব্যক্তি বাদশাহ আবু সাঈদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশে মীলদের উপর সর্বপ্রথম
আত-তানবীর ফী মাওলিদিল বাশীর আন-নাযীর নামক গ্রন্থ রচনা করে মুসলিম বিশ্বে এর প্রাদুর্ভাব ঘটানোর
কৃতিত্ব অর্জন করেন। এ কৃতিত্ব অর্জনে বাদশার পক্ষ থেকে প্রচুর পরিমাণ উপঢৌকনও লাভ করেছিলেন তিনি। তবে তিনি
মুহাদ্দিসীনে কেরামের দৃষ্টিতে নানা দিক থেকে চরম বিতর্কিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী
ছিলেন। এবং হাদীস শাস্ত্রবিদদের মতে তার উক্ত মীলাদ গ্রন্থসহ অন্যান্য গ্রন্থসমূহ প্রচুর পরিমাণ
জাল বর্ণনায় পরিপূর্ণ। কিন্তু মীলাদুন্নবী সমর্থক ভাইয়েরা তার সে গ্রন্থকে মাথায় তুলে রাখেন। সুতরাং
ইতিহাস বলে, জন্ম-মৃত্যু কেন্দ্রিক
দিবস বা বার্ষিকী পালন মূলত মুসলিম ঐতিহ্য ও সভ্যতা-সংস্কৃতির কোনো
অংশ নয়। এগুলো মূলত অনারব অমুসলিম কালচার। হাল জমানায়ও আমরা লক্ষ করি, হিন্দুরা জন্মাষ্টমী পালন
করে, বৌদ্ধরা বুদ্ধ পূর্ণিমা পালন করে এবং
খ্রিষ্টানরা ক্রিসমাস ডে পালন করে। এগুলো মূলত বিধর্মীদেরই ঘরোয়া
সংস্কৃতি। ইসলামী শরীয়ত জন্ম, মৃত্যু কেন্দ্রিক এসব বার্ষিকি, কিংবা দিবস পালনকে আদৌ সমর্থন করে না। কুরআন-সুন্নাহে যেসব ইবাদত পালনের ব্যাপারে
আমাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবিয়ীন, তাবে তাবিয়ীনসহ আইম্মায়ে সালাফ ব্যবহারিক জীবনে
কুরআন সুন্নাহর যেসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে গেছেন একমাত্র সেসব ইবাদত
পালনেই আমরা বাধ্য এবং অঙ্গীকারাবদ্ধ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
এবং সাহাবায়ে কেরামের তিরোধানের পর নতুন কোনো ইবাদত উদ্ভাবনের অধিকার আমাদের নেই। নতুন কোনো কিছুকে
ইবাদত হিসেবে গ্রহণ করার অর্থই হলো, আল্লাহ তাআলা রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর দীনকে পরিপূর্ণ করে দেন নি। নাউযু বিল্লাহ। রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার
দীর্ঘ তেষাট্টি বছরের জীবনে একদিনও তার জন্ম বার্ষিকী পালন করেন নি।
সাহাবায়ে কেরামও এ বার্ষিকী পালন করেন নি। তাবিয়ীন এবং তাবি তাবিয়ীনের কেউও
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্ম বার্ষিকী পালন করেন নি।
অর্থাৎ ইসলামের শ্রেষ্ঠ তিন প্রজন্মের কেউ এ উৎসব পালন করেন নি। তবে কি
তাদের চেয়ে আমাদের ইবাদত পালনের আগ্রহ বেশি? তাদের চেয়ে কি আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বেশি
ভালবাসি? তাদের চেয়ে কি দীনী বিষয়গুলো
আমরা বেশি বুঝি? তাছাড়া রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্ম বার্ষিকি পালন হলে মৃত্যু বার্ষিকী কেন পালন হয় না? রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শুভ জন্ম যেমন আনন্দের তেমনি তার তিরোধানও বেদনা বিধুর। সে
হিসেবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুদিবস কেন ঘটা করে
পালন করা হয় না? জন্ম দিবস পালন করতে হলে
কেন একটি বৎসর অতিক্রম করতে হয়? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম যে রবিউল আউয়াল মাসে জন্ম গ্রহণ করেছেন সে মাসটি যেমন বছরে এক বার
ঘুরে আসে ঠিক তেমনিভাবে যে সোমবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্ম গ্রহণ করেছেন সে
সোমবারটিও তো প্রতি সপ্তাহে একবার আগমন করে। তবে কেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাপ্তাহিক জন্ম দিবস পালন করা হয় না? রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিনের যে সময়টিতে জন্ম গ্রহণ করেছেন সে সময়টি প্রতিদিনই একবার আসে।
তাহলে আমরা কেন প্রতিদিন রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্ম সময়, জন্ম লগ্ন বা জন্ম মুহূর্ত পালন করি না?
এসবই যথার্থ এবং
সঙ্গত প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের গঠনমূলক এবং বিশুদ্ধ ও শরীয়তসিদ্ধ উত্তর কি আমরা
দিতে পারবো? সারকথা সাহাবী, তাবিয়ীগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম এর প্রতি প্রচণ্ডতম ভালবাসা সত্ত্বেও কখনো তাদের আনন্দ এভাবে উৎসব
বা উদযাপনের মাধ্যমে প্রকাশ করেন নি। সুতরাং পরবর্তী যুগের মুসলিম
উম্মাহর জন্য তা শরীয়তসম্মত হতে পারে না।
বরং তাদের জন্য করণীয় হলো,
সালাফে সালেহদের ন্যায় সার্বক্ষণিক
সুন্নাহ পালন, সীরাত চর্চা, সালাত ও সালাম পাঠ এবং আন্তরিক ভালবাসার মাধ্যমে
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ
সৃষ্টি করা।
শিয়া-অমুসলিমদের
অনুকরণে জন্মদিন পালনের মাধ্যমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর
প্রকৃত ভালবাসা প্রকাশ পায় না। বরং এসকল অনুষ্ঠানের প্রচার-প্রসার বস্তুত
সাহাবী-তাবিয়ীদের নবী প্রেম ও ভক্তি-ভালবাসার পদ্ধতিকে হেয় প্রতিপন্ন
করারই নামান্তর। কারণ এতে
প্রতীয়মান হয় যে, সাহাবী-তাবিয়ীদের নীরব, অনানুষ্ঠানিক এবং
সার্বক্ষণিক ভালবাসা ও ভক্তি প্রকাশ পদ্ধতির তুলনায় নব উদ্ভাবিত এ পদ্ধতিই
উত্তম। যা নিঃসন্দেহে ভ্রষ্টতা। অতএব ইসলামী শরীয়তে ইবাদতের উদ্দেশে জন্ম
বর্ষিকি পালন কিংবা মৃত্যু দিবস পালন নব উদ্ভাবিত বিষয়। এগুলো উদযাপন করা
জায়েয নেই।
সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৭১৮, সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮৬৭, ফাতাওয়া উলামায়ি বালাদিল হারাম ৩৫৭, ৩৬৫, ফাতাওয়া মাহমূদিয়া ৫/৩৯৬, ফাতাওয়া উসমানী ১/১২৮,সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ
ফী সীরাতি খাইরিল ইবাদ, ১/৩৬৬, আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া ৭/৬৪২, ৬৫৩, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ১৫/১৬৪, ওয়াফাইয়াতুল আ‘ইয়ান ৫/২২৪,৩/৪৪৯, মীযানুল ইতিদাল ৩/১৮৮, লিসানুল মীযান ৮/২৯৫, ড. খন্দকার আ.ন.ম আব্দুল্লাহ
জাহাঙ্গীর লিখিত ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী প্রবর্তন ও প্রবর্তক : একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনা