ফতওয়া শব্দের সাম্প্রদায়িক ব্যবহার

ড. মুহাম্মদ আবদুল হাননান


সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী ল্যাটিন আমেরিকার লেখক-সাংবাদিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের সাক্ষাৎকারের একটি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকা সাহিত্য-শিক্ষা সাময়িকী কালি ও কলম-এ। এতে বেশ কয়েকটি প্রশ্নের জবাবে মার্কেজ বলেছিলেন,

১. আমি বরাবরই নিজেকে বোঝাতে সমর্থ হয়েছি, আমার আসল পেশা হচ্ছে সাংবাদিকতা। সাংবাদিকতায় আমার যা পছন্দ হয় নি তা হচ্ছে চাকরির শর্তাবলি। তাছাড়া পত্রিকার স্বার্থের কথা বিবেচনা করে আমার চিন্তা ও পরিকল্পনাকে সাজাতে হতো। … যে-কোনোভাবেই হোক একটি মহত্তর সাংবাদিকতার সুযোগ পাওয়া আমি সব সময়ই উপভোগ করব।…

২. সাংবাদিকতায় একটি ঘটনা যদি মিথ্যে হয় তাহলে তা সমস্ত কাজটিকে প্রভাবিত করবে। পক্ষান্তরে উপন্যাসের একটি একক ঘটনা যদি সত্যি হয় তাহলে তা গোটা কাজটিকে বৈধতা প্রদান করবে।…

৩. আমি যখন সংবাদপত্রে কাজ করতাম, যা লিখেছি তাতে প্রতিটি শব্দ নিয়ে তেমন সচেতন ছিলাম না, কিন্তু এখন সচেতন।…

৪. সাংবাদিকতার একটি চাতুরী যা আপনি সাহিত্যেও প্রয়োগ করতে পারেন। যেমন ধরুন যদি বলেন, হাতিরা আকাশে উড়ছে, কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু যদি বলেন চারশো পঁচিশটা হাতি আকাশে উড়ছে, তাহলে মানুষ হয়তো আপনাকে বিশ্বাস করবে। [‘মার্কেজের সাক্ষাৎকার’, ভূমিকা ও অনুবাদ, আন্দালিব রাশদী, কালি ও কলম, ঢাকা, মে ২০১৪]।

মার্কেজের কথাগুলো গভীরভাবে অনুধাবনের দাবি রাখে। প্রথমত তিনি পরোক্ষভাবে গণমাধ্যমে চাকরির শর্তাবলি ও গণমাধ্যমের নিজস্ব স্বার্থের প্রশ্ন তুলেছেন, যা অনেক ক্ষেত্রেই সাংবাদিকতার সততাকে অক্ষুণœ রাখতে দেয় না, যখন একজন সাংবাদিক-লেখকের আসল পেশা হয় সাংবাদিকতা। দ্বিতীয়ত সাংবাদিকতায় যদি কোনো ঘটনা মিথ্যে হয় তাহলে তা সমস্ত কাজটিকে প্রভাবিত করে থাকে। তৃতীয়ত সাংবাদিকতায় সকল সময়ই প্রতিটি শব্দ সম্বন্ধে সচেতন থাকতে হয়। চতুর্থত সাংবাদিকতায় অনেক সময়ই চাতুরী থাকে, যা ভাষা ও বাক্যের মারপ্যাঁচে থাকে লুকায়িত।

মার্কেজের কথা ও উপলব্ধিগুলো খুব আন্তরিক। একজন সৎ লেখক-সাংবাদিকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই অনুভূতিগুলো তিনি প্রকাশ করেছেন। সাময়িকী ও সংবাদপত্রে মাঝেমাঝেই আমরা ভাষা ও শব্দ ব্যবহারে কিছু প্রবণতা লক্ষ করি, যা অনেক ক্ষেত্রেই ভুল অথবা অপপ্রয়োগ এবং সাম্প্রায়িকতা দোষে দুষ্ট। মার্কেজের ভাষায় হয়তো ‘সচেতন’ভাবেও ব্যবহার হচ্ছে না, কিন্তু এতে যদি ঘটনাটি মিথ্যে হয় তাহলে তা পুরো বিষয়টিতে একটি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। সংবাদপত্র অথবা সাংবাদিক কি মার্কেজের ভাষায় ‘চাতুরী’ করছেন অথবা সাংবাদিক কোনো পত্রিকার নিজস্ব স্বার্থের কাছে আত্মসমর্পণ করছেন।

একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ইসলামি শরিয়ার একটি শব্দ ‘ফতওয়া’। এটা বাংলা ভাষায় বর্তমানে লেখা হয় এভাবে. ‘ফতোয়া’। ‘ফতওয়া’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ধর্মীয় আইন-বিশেষজ্ঞ অথবা মুফতি কর্তৃক প্রদত্ত ও প্রকাশিত বিধান। [সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ, দ্বিতীয় খণ্ড, ১৯৮২, পৃষ্ঠা ৭৬]।

মুসলিম সম্প্রায়ে নিত্য-প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয় ফতওয়া। যেমন, নামাজ পড়া অবস্থায় পকেটে থাকা মোবাইল বেজে উঠলে মুসুল্লি কী করবেন, তিনি কি পারবেন পকেটে হাত দিয়ে মোবাইলটি বের করে বন্ধ করতে! যদি তিনি তা করেন তাতে নামাজের কি কোনো ক্ষতি হবে! এ বিষয়ে ফয়সালা দিতে পারেন একজন ‘মুফতি’ মর্যাদার ওলামা। এই ফয়সালা বা সিদ্ধান্তের নাম ‘ফতওয়া’। মুসলিম সম্প্রায়ে ‘মুফতি’ ছাড়া কেউ ফতওয়া দিতে পারেন না।

কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতের গণমাধ্যমে আমরা অহরহ দেখি সরকার, পآায়েত ও ব্যক্তি থেকে আসা বিভিন্ন বিষয়ের ফয়সালা ও সিদ্ধান্তকেও ‘ফতোয়া’ বলে শিরোনাম-উপশিরোনাম করে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কয়েকটি সাম্প্রতিক উদাহরণ উদ্ধৃত করছি

১. হিন্দি ফতোয়ায় নিশ্চুপ বাঙালি

ইউজিসি-র নয়া ফরমান নিয়ে সরব একমাত্র জয়ললিতা।

সম্প্রতি ইউজিসি-র একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশ হইচই পড়ে গিয়েছে। ইউজিসি জানিয়েছে, এবার থেকে সমস্ত কলেজে হিন্দি পড়ানো বাধ্যতামূলক করতে হবে। এই ফতোয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন একমাত্র তামিলনাড়–র মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা। কলেজের স্নাতক স্তরে হিন্দি আবশ্যিক করতে হবেÑ একথা মানতে নারাজ জয়ললিতা। তাঁর রাজ্যের দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬ সেপ্টেম্বর ইউজিসি-র চিঠি পৌঁছানোর পরই যত ঘটনার ঘনঘটা। জয়া পত্রপাঠ চিঠি লিখেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। তাঁর এই চিঠির বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন দাক্ষিণাত্যের অন্য দ্রাবিড় দলগুলোও যথা, ডিএমকে, এমডিএমকে এবং পিএমকে।

জয়ললিতা যে-ফতোয়াকে অনৈতিক, বেআইনি এবং অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়েছেন, সেই ফতোয়া সম্পর্কে অবশ্য দেশের অন্য রাজ্যগুলো আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। পশ্চিমবঙ্গের নাম এখানে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। যে-বাংলা তথা বাঙালি কথায়-কথায় প্রতিবাদে মুখরিত হয়ে ওঠে, সেই বাঙালির মনে এ ঘটনা কোনও প্রভাবই ফেলল না! মুখ খোলেন নি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ভাষা নিয়ে এমন অগণতান্ত্রিক এবং একতরফা সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে জানে একমাত্র তামিলনাড়–ই।

আর বাঙালি? প্রতিবাদের নামে মিটিং-মিছিল, অবরোধের মধ্যেই মোক্ষলাভ করে যে-বাঙালি, সেই বাঙালি হিন্দি নিয়ে এখনও আগের মতোই বান্দাগিরি করে চলবে। কে জানে, বাঙালির বিপ্লব বোধহয় দীর্ঘজীবী হওয়ার পরিবর্তে এখন মৃতপ্রায় অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছে। [ঋতুপর্ণা ল টিপ থাকবে না। কিন্তু যদি কোনও চবিতে ভুল করেও টিপ থেকে যায়? কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সে ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হবে ওই মহিলা বিবাহিত এবং সে কারণেই তার নাম ভাতার জন্য বিবেচিত হবে না। [টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবর ছেপেছে বাংলাদেশের দৈনিক আমাদের সময়, ২৭শে জুন ২০১৪]।

২. টিপ পরলে মিলবে না পেনশন!

কপালে টিপ পরলে এখন থেকে মিলবে না পেনশন। ভারতে নতুন এ আইন চালু করা হয়েছে। নিরাশ্রয় মহিলাদের জন্য ভাতা দেওয়ার দায়িত্বে থাকা দিল্লির নারী ও শিশুকল্যাণ দপ্তরের সাম্প্রতিক ফতোয়ায় মিলেছে এমনই নির্দেশ। এর পক্ষে যুক্তি হলো- কপালের টিপ দেখে বোঝা যায় মহিলা বিবাহিত। সুতরাং এই ভাতার জন্য তিনি বিবেচিত হবেন না।

জানা গেছে, তিন বছর আগে অসহায় ও নিরাশ্রয় মহিলাদের জন্য এই বিশেষ ভাতা চালু করে দিল্লি সরকার। নিয়ম অনুযায়ী, যেমন মহিলার স্বামী নিখোঁজ বা স্ত্রীর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখেন না অথবা আদালতে স্ত্রীর বিরুদ্ধে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা দায়ের করেছেন, সেসব মহিলা এই ভাতা পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। ভাতার পরিমাণ মাসিক ১৫০০ টাকা। ভাতার জন্য নির্ধারিত ফরমে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে, আবেদনপত্রে ভাতা প্রার্থীর এমন ছবি দিতে হবে যার কপালে টিপ থাকবে না। কিন্তু যদি কোনও ছবিতে ভুল করেও টিপ থেকে যায়? কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সেক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হবে ওই মহিলা বিবাহিত এবং সে কারণেই তার নাম ভাতার জন্য বিবেচিত হবে না। [টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবর ছেপেছে বাংলাদেশের দৈনিক আমাদের সময়, ২৭শে জুন ২০১৪]।

৩. তানোরে ফতোয়াবাজি কাউন্সিলর সমাজচ্যুত

রাজশাহীর তানোরে গ্রাম্য মাতব্বরের ফতোয়ার শিকার হয়েছেন মুণ্ডুমালা পৌরসভার সাদিপুর গ্রামে নারী কাউন্সিলর পরিবার। পরিবারটির জন্য স্থানীয় মসজিদে নামাজপড়া, সরকারি ট্যাপের পানি নেয়া, গ্রামের লোকজনদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা বন্ধ ঘোষণা করে ফতোয়া জারি করেছেন সাদিপুর গ্রামের মাতব্বর একরামুল হক। ওই পরিবারের কোরবানির মাংসও সমাজে নেয়া হয়নি।

ফতোয়ার শিকার মুণ্ডুমালা পৌরসভার সংরক্ষিত কাউন্সিলর মঞ্জিরা বেগমের স্বামী আব্দুর রহমান গত রবিবার সকালে তানোর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এলাকাবাসী ও অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, মুণ্ডুমালা পৌর এলাকার সাদিপুর গ্রামের মাতব্বর একরামুল হকের সঙ্গে জায়গাজমি নিয়ে বিরোধ চলে আসছিল। কোরবানি ঈদের আগের রাতে ৫ অক্টোবর এশার নামাজ শেষে মসজিদে গ্রাম্য মাতব্বর একরামুল হক সকলের উপস্থিতিতে বলেন, মহিলা কাউন্সিলর পরিবারকে ‘সমাজে আটক’ রাখা হবে। তাদের কোরবানি ঈদের মাংস সমাজে নেয়া হবে না।

উপস্থিত মুসল্লিরা কেউ মাতব্বরের উপর কথা বলতে সাহস পাননি। আটক রাখার খবরটি মহিলা কাউন্সিলরের বাড়িতে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব দেয়া হয় জনৈক সাজ্জাদ সরদারকে। তিনি ঈদের দিন সকালে কাউন্সিলরের বাড়িতে বিষয়টি জানিয়ে দেন। কি কারণে ‘সমাজে আটক’ রাখা হয়েছে সে বিষয়ে সাজ্জাদ সরদার কিছু বলতে পারেননি। ঈদের মাংস সমাজে না নেয়ায় কাউন্সিলর মঞ্জিরা বেগম নিজ হাতে গ্রামের গরীব লোকজনদের মধ্যে মাংস বিতরণ করেন। ‘আটক’ রাখার পর গ্রামের মধ্যে মাংস বিতরণ নিয়ে গত শুক্রবার জুম্মার নামাজ শেষে গ্রাম্য মাতব্বর প্রশ্ন তোলেন। তিনি উপস্থিত মুসল্লিদের জানিয়ে দেন, কাউন্সিলরের পরিবারের লোকজনদের সঙ্গে গ্রামের যে লোক কথা বলবে তার ১ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। আটক রাখা ওই পরিবারের লোকজন মসজিদে নামাজ পড়তে পারবে না, গ্রামের কোন পুকুরে নামতে পারবে না, সরকারি ট্যাপের পানি নিতে পারবে না।

কি কারণে মাতব্বর পরিবারটিকে ‘আটক’ রাখলো এ বিষয়ে গ্রামের কেউ কিছু বলতে পারছে না। ফতোয়ার শিকার কাউন্সিলর মঞ্জিরা বেগম বলেন, আমার স্বামীর আপন বড়ভাই মাতব্বর একরামুল হক। জায়গা-জমি নিযে তার সঙ্গে আমাদের দ্বন্দ্ব চলছে। ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। আইনগত দিকে পেরে না উঠায় নিজের একক সিদ্ধান্তমতে আমাদের উপর ফতোয়া জারি করে সমাজে ‘আটক’ রেখেছে। মাতব্বর একরামুল হক বলেন, সমাজের লোকজনদের গালিগালাজ করেছেন কাউন্সিলর ও তার পরিবারের লোকজন। তাই তাদের ‘সমাজে আটক’ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তানোর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনীরুজ্জামান বলেন, অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। [দৈনিক ইদেত্তফাক, ঢাকা, ১৫ই অক্টোবর ২০১৪]।

উপরিউক্ত তিনটি সংবাদ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এর একটিও ফতওয়া না। প্রথমটি ভারতের ইউজিসি নামে সরকারি প্রতিষ্ঠানের একটি সিদ্ধান্ত, যেখানে বলা হয়েছে, এখন থেকে ভারতের সকল কলেজে হিন্দি বাধ্যতামূলকভাবে পড়াতে হবে। দ্বিতীয়টি ভারতের নারী ও শিশুকল্যাণ দপ্তরের নির্দেশনা, যাতে বলা হয়েছে, অসহায় নারী যারা ভাতা-প্রার্থী, তাদের এমন ছবি দিতে হবে যে কপালে টিপ থাকবে না। তৃতীয়টি বাংলাদেশের দৈনিক ইত্তেফাক-এ প্রকাশিত তাদের রাজশাহী অফিস থেকে প্রেরিত সংবাদ, যেখানে মূল ঘটনা ছিল রাজশাহীর তানোরের গ্রাম্য এক মাতব্বর (যিনি সম্পর্কে আপন ভাসুর), তার সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধের জেরে এক নারী কাউন্সিলরকে সমাজে ‘একঘরে’ করে রাখার একটি সংবাদ। এটিও ফতওয়া নয়, কারণ গ্রামের এক ‘মাতব্বর’ ফতোয়া দিতে পারেন না। এটাকে সালিশও বলা যাবেনা, কারণ সংবাদটিতে ঐ মাতব্বর কোনো সালিশ বৈঠকও করেছেন এমন তথ্য নেই। এটি তাঁর একক সিদ্ধান্ত। গায়ের জোরে তিনি এটা চাপিয়ে দিচ্ছেন।

অনেক সময় এইসব ঘটনায় স্থানীয় মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের সংশ্লিষ্ট রাখা হয়। মসজিদের ইমাম হলেই ফতওয়া দিতে পারেন না, এমনকি কউমি মাদরাসার দাওরা পাশ করা মাওলানা সাহেবও ফতওয়া দিতে পারেন না। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, ফতওয়া দিতে পারেন একমাত্র মুফতি সাহেব, যিনি কউমি মাদরাসা থেকে ইফতা কোর্স (ইসলামি অনুশাসন ও মাসায়েল সম্পর্কে যিনি উচ্চশিক্ষা) সম্পন্ন করেছেন।

অথচ আমরা কী দেখছি! যে কোনো বেআইনী নির্দেশনা, জুলুমবাজী ঘোষণা, সালিশ-বৈঠকের সিদ্ধান্তকে ফতওয়া বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে মুসলিম সম্প্রায়ের একটি পবিত্র শব্দকে কি হেয় করা হচ্ছে না! এটা কি সচেতনভাবে করা হচ্ছে নাকি গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের বলা সেই ‘অসচেতন’ভাবে করা হচ্ছে!

বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্র জেন্ডার সংবেদী সংবাদ সম্পাদনা নামে একটি প্রশিক্ষণ মডিউল তৈরি করেছে। ২০০৯ সালে তা প্রকাশিত হয়েছিল। বিশিষ্ট সংবাদ-প্রশিক্ষক অলিউর রহমান ও সিরাজুদ দাহার খান এটি রচনা করেন। এই প্রশিক্ষণ মডিউলে সংবাদপত্রে প্রকাশিত বেশকিছু সংবাদের বিশ্লেষণ রয়েছে। তার মধ্যে নমুনা সংবাদ: ৫ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে ২০০২ সালের ২৯শে অক্টোবর ঢাকার  ভোরের কাগজ-এ প্রকাশিত একটি সংবাদ। সংবাদটি ছিল নিম্নরূপ:

গাইবান্ধা প্রতিনিধি: জেলার সাদুল্লাপুর উপজেলায় অসামাজিক কার্যকলাপে যুক্ত থাকার অভিযোগে এক সন্তানের জননীকে স্বামী কর্তৃক তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও পরে পরকীয়ার অপরাধে দোষী ব্যক্তিকে মাত্র তিন বেত্রাঘাত ও ১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

সাদুল্লাপুর বনগ্রাম ইউনিয়নের জয়েনপুর গ্রামের ইব্রাহিম মিয়ার স্ত্রী এক সন্তানের জননী আসমা বেগম (২২) একই গ্রামের প্রতিবেশী আবদুল মণ্ডলের পুত্র সাদেকুল ইসলাম (২০)-এর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তোলে। গত ২০ অক্টোবর রাতে ইব্রাহিম মিয়া ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরে দরজায় কড়া নাড়ে। দরজা খুলতে দেরি হলে ইব্রাহিমের সন্দেহ হয়। সে দরজা ভেঙ্গে ঘরে প্রবেশ করে এবং চৌকির নিচে যুবক সাদেকুলকে খুঁজে পায়। ইব্রাহিম সারারাত সাদেকুলকে আটকে রাখে।

পরদিন গ্রাম্য সালিশে বনগ্রাম ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সাদেক আলী প্রামাণিক ও ইউপি কর্তৃক আটক সাদেকুলকে তিন বেত্রাঘাত এবং ১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। অন্যদিকে ইব্রাহিমের স্ত্রীকে পরকীয়ার অভিযোগে স্বামী কর্তৃক তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। [দৈনিক ভোরের কাগজ, ঢাকা, ২৯ অক্টোবর ২০০২]।

মূল সংবাদটি এ পর্যন্তই। সংবাদদাতা শিরোনাম করেছিলেন তালাক বেত্রাঘাত। কিন্তু প্রশিক্ষণ মডিউল রচনাকারীরা এজন্য সংবাদদাতাকে সমালোচনা করেছেন। সমালোচনার বিষয়টিও দেখা যেতে পারে:

এটি একটি যৌগিক সংবাদ। অসামাজিক কাজে লিপ্ত হওয়া, হাতেনাতে ধরা পড়া এবং সালিশÑ এই তিনটি ঘটনার মিশ্র বুনন রয়েছে সংবাদটিতে। আপাতদৃষ্টে সংবাদটিকে সুলিখিত মনে হয়। কিন্তু জেন্ডার সংবেদী দৃষ্টিতে দেখলে বোঝা যায় যে, সংবাদটি মারাত্মকভাবে পুরুষতান্ত্রিকতা দোষে দুষ্ট। এই দোষের সূত্রপাত সংবাদটির প্রারাম্ভিক বাক্য থেকেই। একই অপরাধে অপরাধী হলেও সালিশের নামে এখানে ফতোয়াবাজ ইউপি প্রতিনিধিরা যেমন নারী পুরুষ দু’জনার দুরকম শাস্তি বিধান করেছেন, তেমনি প্রতিবেদক ভিকটিম দুজনকে বৈষম্যমূলকভাবে চি‎িত করেছেন এবং যথারীতি বৈষম্যের শিকার হয়েছেন নারী ভিকটিম।

ফতোয়ার ঘটনাটি ঘটেছে বিবাহ-বহির্ভূতভাবে একজন অবিবাহিত পুরুষ এবং একজন বিবাহিত নারীর মধ্যকার স্বতঃস্ফূর্ত শারীরিক সম্পর্কের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। যখন এরকম কোনো ঘটনা ঘটে, তখন এর জন্য সমভাবে দায়ী থাকেন দুজনই। আমাদের সমাজ এ ধরনের সম্পর্ককে স্বীকার করে না, কাজেই তা অসামাজিক, যেটা দু’জনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আবার শাস্ত্র এ ধরনের ঘটনাকে ‘পরকীয়া’ হিসেবে চি‎হ্নিত করে। পরকীয়া হলো পর-সম্বন্ধীয়ের সঙ্গে সম্পর্ক। এটা উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সুতরাং সহজ হিসেব এরকম যে, এই দুজন পরকীয়া সম্পর্ক স্থাপন করে অসামাজিক কার্যকলাপে যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু সংবাদের প্রারম্ভিক বাক্য জানায় যে, অসামাজিক কার্যকলাপ করেছেন কেবল নারী ভিকটিম, অন্যদিকে পুরুষ ভিকটিম করেছেন স্রেফ পরকীয়া। আবার সংবাদের উপসংহার পড়ে মনে হয়, পুরুষ ভিকটিম দুটোর কোনোটিতেই যুক্ত না থেকেও অন্যায়ভাবে শাস্তি পেয়েছেন, আর নারী ভিকটিমের বিপরীতে তালাকের সিদ্ধান্ত হয়েছে পরকীয়ার অপরাধে। অর্থাৎ দাঁড়চ্ছে, পুরুষ লোকটি যেহেতু অবিবাহিত সে মনের টানে হঠাৎ পরকীয়ার মতো একটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে, সেজন্য তাকে মাত্র তিন ঘা বেত্রাঘাত ও এক হাজার টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে নারী ভিকটিম স্বামী-সন্তান থাকতেও একজন নিষ্কলুষ যুবকের সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্ক স্থাপন করে ভয়ানকভাবে সমাজবহির্ভূত কাজ করেছেন, কাজেই তার স্বামীর সংসারে আর থাকার অধিকার নেই। প্রতিবেদনটি পরোক্ষভাবে ফতোয়াবাজদের এই বৈষম্যমূলক রায়টিকেই সমর্থন করছে।…

এ সংবাদ সম্পর্কে আমাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বলবার কথা এই যে, একটি সালিশী কখন ফতোয়াবাজির পর্যায়ে নেমে যায়, সে সম্পর্কে প্রতিবেদকের কোনো ধারণা নেই। সালিশ হলো বিবদমান দুই পক্ষের ইচ্ছানুযায়ী তাদের নিজেদের নির্বাচিত ব্যাক্তিবর্গের দ্বারা উভয়পক্ষের সম্মতিতে নিষ্পন্ন একটি গ্রহণযোগ্য সামাজিক মীমাংসা প্রক্রিয়া। এতে কারও বিরুদ্ধে কোনো রায ঘোষণা করা বা কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা চলে না। এমনকি সালিশকারীর বিচারকের মতো আচরণ করা বা কারও প্রতি কোনো ধরনের শাস্তি বিধান করা এবং তা কার্যকর করা তার/তাদের এখতিয়ারবহির্ভূত। এসবের নেপথ্যে সবসময়ই থাকে ব্যক্তি, সম্প্রায়, গোষ্ঠীগত কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার দুরভিসন্ধি, অবশ্যই যা মানুষের জন্য অকল্যাণকর। আর এ রকম হলেই সেটা আর সালিশীর পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকে না, রূপ নেয় ফতোয়াবাজিতে, যা সামাজিক শান্তি ও  সম্প্রীতি বিনষ্ট করে। আলোচ্য সংবাদে প্রতিবেদক যে ধরনের ঘটনার উল্লেখ করে তাকে সালিশী বলে চিহ্নিত করেছেন, তা নিঃসন্দেহে ছিল একটি ফতোয়াবাজির ঘটনা। [অলিউর রহমান, সিরাজুদ দাহার খান: জেন্ডার সংবেদী সংবাদ সম্পাদনা, বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্র, ঢাকা, ২০০৯]।

উপরিউক্ত বিশ্লেষণটি ছিল দীর্ঘ। জেন্ডার সংবেদন প্রশ্নে তারা যে বিশ্লেষণ করেছিলেন তা ছিল সঠিক। কিন্তু তাঁরা জেন্ডারে থেমে থাকেন নি। তারা দাবি করেছেন এটাকে ‘ফতোয়া’ বলতে হবে। এজন্য লেখকদ্বয় সংবাদদাতাকে ভৎর্সনা করেছেন। বলেছেন, ‘একটি সালিশী কখন ফতোয়াবাজির পর্যায়ে নেমে যায়, সে সম্পর্কে প্রতিবেদকের কোনো ধারণা নেই’।

আমরা বলবো, এ ব্যাপারে প্রতিবেদক নয়, বরং সংবাদ-বিশ্লেষকদ্বয়েরই ধারণাটি ভ্রান্ত। প্রতিবেদক সঠিকই ছিলেন। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সালিশ বৈঠকই করেছিলেন। গ্রামে চেয়ারম্যান-মেম্বাররা এসব ঘটনায় সালিশ-বৈঠকই করেন। ফতওয়া দেন না। ফতওয়া দেওয়ার অধিকার তো তাদের নেই। কিন্তু আমাদের গণমাধ্যমে এক শ্রেণির প্রশিক্ষক এসব শব্দ ব্যবহারের জন্য সংবাদদাতাদের পরামর্শ দিচ্ছেন। তারা কী এটা মার্কেজের উল্লিখিত ‘অসচেতন’-ভাবে করছেন, নাকি খুবই সূক্ষ্মভাবে একটি সম্প্রায়কে আঘাত দিতে চাচ্ছেন। যদি তা না হয়, তাদের কি উচিত ছিল না, ফতওয়া শব্দের মূল অর্থ কী এবং কোন ক্ষেত্রে মুসলিম সম্প্রায় তা ব্যবহার করে, কারা দিতে পারেন ফতওয়া, তা আগে থেকে জেনে নেওয়া। মার্কেজের উদ্ধৃতিটি কি আমরা আবারও একবার পড়ে দেখবো, যেখানে মার্কেজ বলেছেন, ‘সাংবাদিকতায় একটি ঘটনা যদি মিথ্যে হয় তাহলে তা সমস্ত কাজটিকে প্রভাবিত করবে’। মার্কেজ সাংবাদিকতার যে ‘চাতুরী’র কথা বলেছেন তা থেকে কি আমরা ফিরে আসব না!

পাদটীকা

সিরাজুদ দাহার খান বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত জেন্ডার সচেতন সংবাদ লিখন নামে অন্য আরেকটি একটি মডিউল তৈরি করেছেন (এর প্রকাশনার তারিখ নেই), শুধু সিডা (বেসরকারি সংস্থা)-র অর্থ সহায়তায় প্রকাশিত উল্লেখ রয়েছে। এতে একজন আদর্শ সাংবাদিকের যোগ্যতা ও গুণাবলি সম্পর্কে উল্লিখিত হয়েছে ২৩টি পয়েন্ট। এর মধ্যে কয়েকটি নিম্নরূপ: [সাংবাদিকের থাকতে হবে],

২. সংবাদ চেতনা ও সংবাদমূল্য সম্পর্কিত ধারণা

৩. পেশাদারিত্বের মনোভাব

৪. পরিস্থিতিগত পরিমিতিবোধ

৫. অসাধারণ প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা…

১৩. সুশৃঙ্খল ও বিশ্লেষক মন…

১৬. সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতা…

২১. তীক্ষ্ন পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। ইত্যাদি।

সাংবাদিকতার শিক্ষক ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায়েরও কিছু নীতিবাক্য ঐ মডিউলে উল্লিখিত হয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, সাংবাদিক হবেন একজন ‘অসাম্প্রায়িক’। পরিশেষে দাহার খান ‘সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সতর্কতা’ জারি করে লিখেছেন ১৫টি বিশেষ বাক্য। তার কয়েকটি নিম্নরূপ:

৬. নিজের বিজ্ঞতা ও অজ্ঞতা প্রকাশে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি না করার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে

১১. শব্দ চয়ন, বাক্য গঠন ও বানানে সার্বক্ষণিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে

১৫. … প্রচলিত আইন ও গণমাধ্যম নীতিমালা সম্পর্কে তার থাকতে হবে স্বচ্ছ ধারণা।

[সিরাজুদ দাহার খান:  জেন্ডার সচেতন সংবাদ লিখন, [প্রশিক্ষণ মডিউল], বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্র, (সিডা অর্থ সহায়তায় প্রকাশিত), প্রকাশনার তারিখ নেই]।

‘ফতওয়া’ শব্দটি মুসলিম সম্প্রায়ের শরিয়াহ আইনের একটি বিধি।ঘটনার কেন্দ্রে যা ফতওয়া নয়, সংবাদ লিখনে এমন শব্দ চয়ন প্রচলিত আইন ও তাদের সম্প্রায়ের প্রতিসুবিচার করা হয় না। এতে পেশাদারিত্বের মনোভাব প্রতিফলিত হয় না। সংবাদমূল্যে ব্যত্যয়ঘটে এবং বিভ্রান্তি ছড়ায়। সাংবাদিকের তীক্ষ্ন পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাকে তা ক্ষুণ্ন করে।

লেখক

ড. মুহাম্মদ আবদুলহাননান [লেখক ও গবেষক]

সাবেক পরিচালক/সহযোগী সম্পাদক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পি.আই.বি) , ঢাকা।

ই-মেইল: drhannanpp@yahoo.com

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *