মুফতী হাফিজুর রহমান
আমাদের সমাজে যৌথভাবে কুরবানীর গোস্ত বণ্টনের নামে একটি সমাজ প্রথা চালু রয়েছে। গোস্ত বণ্টনের এ পদ্ধতিটিতে সামাজিক ভ্রাতৃত্ব বন্ধন মূল উপলক্ষ হলওে তাতে বিবেক ও বিধানগত দিক থেকে সৃষ্টি হয় নানা মাত্রিক অসঙ্গতি। বস্তুত এ ধরনের পদক্ষেপ সদিচ্ছায় অসৎ পদক্ষেপ। আর শুধু ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য ভাল হলেই কাজ ভাল হয় না। ভাল কাজ সেটাই যার পদ্ধটিও সঠিক। কোনো ঐচ্ছিক বিষয়কে অপরিহার্য বানানো, ব্যক্তিগতভাবে সম্পাদনযোগ্য বিষয়কে সম্মিলিত রূপ দেওয়া এবং তাতে সকলের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা, সে মৌখিক ঘোষণার মাধ্যমে হোক বা বাধ্য-বাধকতার পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে, অনেকগুলো কারণে ভুল। যথা :
১। এ ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে শরীয়তের লক্ষ্য- উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। কেননা, শরীয়ত তো বিশেষ উদ্দেশ্যেই এ বিষয়গুলো ব্যক্তিগত পর্যায়ে রেখেছে।
২। এর মাধ্যমে শরীয়ত-নির্দেশিত পন্থা পরিবর্তন করা হয়।
৩। শরীয়ত-নির্দেশিত পন্থা পরিবর্তনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিরূপে অনেক জটিলতা ও শরীয়তের দৃষ্টিতে নিন্দিত অনেক বিষয়ের অবতারণা ঘটে। এসব জটিলতা এড়ানোর একমাত্র পদ্ধতি হচ্ছে, শরীয়ত যে বিষকে ব্যক্তিপর্যায়ে রেখেছে তাকে সম্মিলিত রূপ না দেওয়া এবং যে কাজ ঐচ্ছিক রেখেছে তাকে অপরিহার্য জ্ঞান না করা।
কুরবানী একটি ব্যক্তিগতভাবে আদায়যোগ্য ইবাদাত। ঈদের দিন সম্মিলিতভাবে জামাতে নামায আদায় করতে বলা হয়েছে, কিন্তু কোরবানীর পশু কোথায় জবাই করবে, গোশত কীভাবে বণ্টন করবে এ বিষয়গুলো সম্পূর্ণরূপে কুরবানীদাতার ইচ্ছা-স্বাধীনতার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর গোশতের ব্যাপারে বলেছেন, নিজে আহার করো, অন্যকে আহার করাও, দান কর এবং ইচ্ছা হলে কিছু সংরক্ষণ করে রাখো। তিনি সাহাবায়ে কেরামকে বলেন নি, তোমরা গোশতের একটি অংশ আমার কাছে নিয়ে আস; আমি তা বণ্টন করে দিব কিংবা এই আদেশও দেননি, তোমরা নিজেদের এলাকা ও মহল্লার কুরবানীর গোশতের একটি অংশ একস্থানে একত্রিত করবে এবং এলাকার নেতৃস্থানীয় লোকেরা তা বণ্টন করে দিবে। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি হাদীস লক্ষ করুন।
১। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন, একবার ঈদুল আযহার সময় গ্রাম থেকে কিছু নিম্নবিত্তের মানুষ শহরে এসেছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা কুরবানীর গোশত তিনদিন পর্যন্ত রাখতে পারবে। এরপর যা উদ্বৃত্ত থাকবে তা সদকা করে দিবে। পরের বছর কুরবানীর সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি সেবার গরীব মানুষের উপস্থিতির কারণে তিন দিন পর কুরবানীর গোশত সংরক্ষণ করে রাখতে তোমাদেরকে নিষেধ করেছিলাম। এখন তোমরা নিজেরা খেতে পার, সংরক্ষণ করতে পার এবং দান করতে পার। সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭১/২৮
অন্য বর্ণনা মতে, তোমরা নিজেরা আহার করো, সফরকালীন আহারের জন্য প্রস্তুত করে রাখ এবং আগামীর জন্য সংরক্ষণ করে রাখো। সহীহ বুখারী হাদীস ১৭১৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭২
২। অন্য বর্ণনায় আরো স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার বলেছিলেন, হে মদীনাবাসী, তোমরা তিনদিনের অধিক কুরবানীর গোশত আহার করবে না। (অর্থাৎ তিনদিন পর যা থাকবে তা দান করে দিবে)। (পরের বছর) সাহাবায়ে কেরাম নিবেদন করলেন, অনেক পরিবারে সদস্য সংখ্যা বেশি। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা আহার কর, অন্যকে আহার করাও এবং নিজেরা সংরক্ষণ করে রাখ। আমি সে সময় ঐ কথা এ জন্য বলেছিলাম যে, মানুষের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র বেশি ছিল। এজন্য দরিদ্র মানুষের সাহায্যের প্রয়োজন বেশি ছিল। সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭৩-১৯৭৪, সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৫৬৯
উপরোক্ত হাদীসগুলো থেকে সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়, কুরবানীদাতা তার কুরবানীর গোশত কি পরিমাণ নিজে রাখবে, কি পরিমাণ অন্যকে খাওয়াবে, কি পরিমাণ সদকা করবে এবং কি পরিমাণ আগামীর জন্য সংরক্ষণ করে রাখবে এগুলো তার ইচ্ছার ব্যাপার। যে কুরবানীদাতার পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি তিনি যদি তার কুরবানীর সব গোশত নিজ পরিবারের জন্য রেখে দেন তবে এরও সুযোগ রয়েছে। তবে ক্ষুধা ও দারিদ্রের সময় অনাথ দরিদ্র ও পাড়া প্রতিবেশীর প্রতি লক্ষ রাখা একদিকে যেমন মানবতার দাবি, অন্যদিকে তা একটি ঈমানী কর্তব্যও বটে। আর যার সামর্থ্য আছে তিনি যদি অল্প কিছু গোশত নিজেদের জন্য রেখে বাকি সব গোশত সদকা করে দেন তবে এটাও ভাল কাজ। মোটকথা, এ বিষয়টি শরীয়ত কুরবানীদাতার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিয়েছে। এখানে অন্য কারো অনুপ্রবেশ অনুমোদিত নয়। তদ্রূপ কুরবানী চামড়ার বিষয়টির বিষয়টিও শরীয়ত কুরবানীদাতার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিয়েছে। কুরবানীদাতা শরীয়াতের বিধান মতে যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে। এখানে অন্য কারো বাধ্যবাধকতা আরোপের কোনো অধিকার নেই।
ইসলামী বিধান জানা না থাকার কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গোশত বণ্টনের এ অবিধানিক পদ্ধটি প্রচলিত হয়ে আসছে। এতে দেখা যাচ্ছে, একটি ব্যক্তিগত ও ঐচ্ছিক বিষয়ে অঘোষিতভাবে একধরনের বাধ্যবাধকতা আরোপের কারণে নানা ধরনের অশোভনীয় ও আপত্তিকর বিষয়ের অবতারণা হচ্ছে। যথা :
১। অনেক মানুষ নিজেদেরে বিবেচনামতো কুরবানীর গোশত নানাজনকে হাদিয়া কিংবা সদকা করতে চান। তদ্রূপ চামড়াও নিজের বিবেচনামতো সদকা করতে চান। কিন্তু এ সামাজিক বাধ্যবাধকতার কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সামাজিক রীতি অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য হন, নিজের স্বাধীন বিবেচনামতো করতে পারেন না। অথচ কোনো মুসলিমের সম্পদ তার সন্তুষ্টি ব্যতীত অন্যের জন্য হালাল নয়। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, কোনো মুসলিমের সম্পদ তার মনের সন্তুষ্টি ব্যতীত হালাল নয়।-সুনানে দারাকুতনী, হাদীস ২৯২৩
এখানে একথা বলার সুযোগ নেই, ‘সবাই তো স্বেচ্ছায় গোশত জমা করে, কাউকে তো বাধ্য করা হয় না।’ কারণ সমাজের কিছু মানুষ হয়তো স্বেচ্ছায় জমা করে কিন্তু সমাজে এমন কিছু মানুষ রয়েছে যারা স্বেচ্ছায় গোশত জমা করে না। সামাজিক কারণে জমা করে। যদি সে গোশত জমা না করে তাহলে সমাজে তাকে নিয়ে কথা উঠবে। কোথাও হয়তো তাকে সমাজের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। সুতরাং সে মান সম্মানের ভয়ে ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও তার কুরবানী গোশতের একটা অংশ জমা করতে বাধ্য হচ্ছে।
২। অনেকে আছেন যারা প্রত্যেকের হাদিয়া বা সদকা গ্রহণ করতে চান না। আর শরীয়াতও কাউকে সকলের হাদিয়া বা সদকা গ্রহণ করতে বাধ্য করে নি। কিন্তু সামাজিক বাধ্যবাধকতার কারণে প্রত্যেকেই অন্য সকলের হাদিয়া বা সদকা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। বলাবাহুল্য, এ ধরনের বাধ্যবাধকতাহীন বিষয়াদিতে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা মোটেও বিধিত নয়।
৩। সমাজের লোকজনের মধ্যে একটি গুঞ্জন সৃষ্টি হয় যে, অমুকের সম্পদ সন্দেহজনক, অমুকের আয়-উপার্জন হারাম, কিন্তু তার কুরবানীর গোশতও সবাইকে খেতে হচ্ছে ! এখন এ জাতীয় কথাবার্তা শুধু অনুমাননির্ভর হোক বা বাস্তবভিত্তিক হোক উভয় ক্ষেত্রেই এ ধরনের আলোচনা সমালোচনা দ্বারা সমাজের মধ্যে অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় এবং ঝগড়া বিবাদের সূত্রপাত ঘটে। এর দ্বারা একদিকে যেমন সামাজিক শান্তি শৃঙ্খলা ক্ষতিগ্রস্ত হয় অন্যদিকে কুধারণা, অভিযোগ সমালোচনা এবং হিংসা বিদ্বেষের গুনাহে লিপ্ত হতে হয়। তাছাড়া বাস্তবিকই যদি সমাজের কিছু মানুষ এমন থাকে যাদের আয় উপার্জন হারাম পন্থায় হয় সেক্ষেত্রে জেনে বুঝে তাদের কুরবানীর গোশত সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া যে একটি গুনাহের কাজ তা তো বলাই বাহুল্য।
একথা সর্বজনবিদিত, সমাজে কিছু নীতিহীন মানুষ থাকে যারা হারাম পন্থায় অর্থ উপার্জন করে। আবার সে হারাম টাকা দ্বারা কুরবানীও করে। হারাম অর্থ দ্বারা কুরবানীর মত অতীব গুরুত্বপূর্ণ পবিত্র একটি ইবাদাতে অংশগ্রহণ করাও একটি স্বতন্ত্র গুনাহের কাজ। আর হারাম অর্থ দ্বারা যে পশু কুরবানী কুরবানী করা হবে তার গোশতও হারাম হবে। গোশত বণ্টনের এ সামাজিক প্রথার কারণে তার হারাম গোশত সবার ঘরে চলে যাচ্ছে। সে নিজে হারাম খেল এবং অন্যকেও হারাম খাওয়াল। ধর্মীয় এবং নৈতিক দিক থেকে এ বিষয়টা কতটা নিন্দনীয় ও কদর্য তা সহজেই অনুমেয়।
৪। প্রত্যেকের এলাকায় সমাজের গোশত বণ্টনের জন্য উপযুক্ত জায়গা থাকে না। তখন স্বাভাবিকভাবেই কারো বাড়ির আঙ্গিনা বা বাংলা ঘর ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে প্রতিবছর বাড়ির মালিক তার বাড়িতে এসব কাজকর্ম করার জন্য খুশি মনে অনুমতি দিবেন এমনটি নাও হতে পারে। অনেক সময় তো এ নিয়ে ঝগড়া বিবাদও হতে দেখা যায়। কোনো কোনো স্থানে তো এমন কা-ও করা হয় যে, কোনো উপযুক্ত জায়গা না থাকায় মসজিদের মধ্যে এ কাজ আরম্ভ করে দেয়অ হয়-আল্লাহর আশ্রয় কামনা করি এ জাতীয় কর্মকা- থেকে। এর দ্বারা মসজিদের সম্মান ও পবিত্রতা কি পরিমাণ বিনষ্ট হয় তা কি আর বলার প্রয়োজন আছে ?
৫। যদি এ প্রথায় ভিন্ন কোনো সমস্যা নাও থাকে তবুও এ সমস্যা তো অবশ্যই আছে যে, শরীয়াতের দৃষ্টিতে যে বিষয়টি ব্যক্তিগত পর্যায়ের কাজ ছিল এবং কুরবানীদাতার ইচ্ছা-স্বাধীনতার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছিল তাতে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। মৌলিক এ বিষয়টিই গোশত বণ্টনের সমাজ প্রথা আপত্তিকর ও বর্জনীয় হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
(মাসিক আলকাউসার, ডিসেম্বর ২০০৭ ইং পৃ. ৩৩, শায়েখ মাওলানা আব্দুল মালেক হাফিজাহুল্লাহু তাআলা ও রাআহু কৃত ‘কুরবানীতে সমাজ প্রথা বিষয়ক একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর’ শিরোনামের লেখা অবলম্বনে।)