ইসমাঈল আ. নাকি ইসহাক আ. -কাকে কুরবানী করতে বলা হয়েছিল?

একটি প্রশ্ন, কিছু পর্যালোচনা

মুফতী হাফিজুর রহমান

সূচনা কথন

যবীহুল্লাহ অর্থ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে জবাইয়ের জন্য প্রস্তুতকৃত। বক্ষ্যমান নিবন্ধে যবীহুল্লাহ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো হযরত ইবরাহীম আ. আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে যে পুত্রসন্তানকে কুরবানী করার জন্য সর্বাত্মকভাবে প্রস্তুত হয়েছিলেন। সাধারণভাবে যবীহুল্লাহ বলতে হযরত ইবরাহীম আ. এর প্রিয় পুত্রই উদ্দেশ্য হয়ে থাকেন। কুরআনে বর্ণিত যবীহুল্লাহ কে ছিলেন? এর সরল উত্তর হলো, হযরত ইবরাহীম আ. এর প্রিয় পুত্র ছিলেন যবীহুল্লাহ। এ ব্যাপারে কোনো রকমের দ্বিমত নেই। তবে হযরত ইবরাহীম আ. এর দুই পুত্রের মাঝে কোন পুত্র যবীহুল্লাহ ছিলেন এ নিয়ে খানিকটা বিতর্ক ও মতভিন্নতা রয়েছে। এ মতভিন্নতাটা বেশ পুরনো। হযরত সাহাবায়ে কেরাম ও তাবিয়ীদের মাঝেও এ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত লক্ষ্য করা যায়। তবে এটা এমনি একটি মতভিন্নতা যার দুটো মতই সঠিক হবার অবকাশ নেই। দুটি মতের একটি নিশ্চিত সঠিক হবে, অপরটি সুনিশ্চিত ভুল হবে। দুটি পক্ষেরই সিদ্ধান্ত ও নিশ্চয়তা প্রমাণে সীমাবদ্ধতা তৈরি হতে পারে। কিন্তু মূল একটিই থেকে যাবে। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে ইবরাহীম আ. তাঁর কোন পুত্রকে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কুরবানী করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন সে বিষয়টিকে নানামাত্রিক তথ্য উপাত্তের মাধ্যমে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হবে।

কেন এ আলোচনা

আজকাল কুরবানী ঈদের সময় ঘনিয়ে এলে অনলাইন মাধ্যমগুলোতে কুরবানী বিষয়ক বিভ্রান্তকর কিছু বিষয় বেশ চাউর হয়ে উঠে। তন্মধ্যে ‘নবী ইবরাহীম তার পুত্র ইসহাককে কুরবানী করতে মনস্থ করেছিলো; ইসমাইলকে নয়’ বিষয়টি অন্যতম। একসময় পুরাতন এ জাতীয় বিতর্ককে সজীব করা মানুষগুলো স্থান-কালের ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রেখে একটু লুকিয়ে-চুরিয়ে তাদের মনের বাসনাকে প্রকাশ করতেন। প্রযুক্তির অপার সম্ভাবনা আর পরিবেশের আনুকূল্যে এখন তারা আর লুকোচুরির আশ্রয় নেন না। নেট মিডিয়াতে এ ব্যাপারে তারা তাদের বাকস্বাধীনতাকে মনের সবটুকু মাধুরী মিশিয়ে প্রয়োগ করেন। মুক্তমনের এসব মানব সন্তানেরা যবীহুল্লাহ বিতর্কে অংশগ্রহণ করে বাহ্যত নিজেদেরকে ইয়াহুদী খ্রিস্টানদের হিতাকাঙ্ক্ষী হিসেবে প্রকাশ করে। অথচ তারা তাদের বক্তব্যে কোনো ধর্মের ধার ধারে না। প্রশ্ন হলো, সত্যিকার নাস্তিক হলে তারা কেন একটি ধর্মের পক্ষ নিয়ে অন্য ধর্মের বিপক্ষে বিষোদগার করে। নাস্তিকতা মানে তো সকল ধর্মের মুণ্ডুপাত করা। স্ববিরোধী এ কর্মকাণ্ড থেকে প্রতীয়মান হয় তাদের নাস্তিকতা চর্চার মূলক্ষেত্র হলো ইসলাম। ইসলামকে নিয়েই তাদের যাবতীয় নাস্তিকীয় আয়োজন। এরা যাবিহুল্লাহকেন্দ্রিক মুসলিম ও ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানদের মধ্যকার পুরনো ও স্তিমিত বিতর্ককে গায়ে পড়ে বেশ আয়োজন করে প্রাসঙ্গিক করে তুলছে। এতে ইতিহাস ও ধর্মীয় জ্ঞানে সীমাবদ্ধ সাধারণ নেটিজন শ্রেণী বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছেন। এর মাধ্যমে নাস্তিক শ্রেণীর উদ্দেশ্য শুধু ইসহাক আ.কে যাবীহুল্লাহ প্রমাণ করাই উদ্দেশ্য নয়। এতটুকুতে সীমাবদ্ধ হলে বিষয়টি আমাদের জন্য অতোটা মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতো না। বরং তাদের উদ্দেশ্য হলো ইসলামের ব্যাপারে মানুষকে বীতশ্রদ্ধ করে ধর্মের গণ্ডি থেকে বের করে নাস্তিকতার আসনে সমাসীন করা। তাই গোড়া থেকে এ বিতর্কের একটা সমাধা হওয়া প্রয়োজন। সাধারণ মানুষকে যাবীহুল্লাহ বিষয়ক বিভ্রান্তি থেকে বাঁচাতেই মূলত এ যাবীহুল্লাহ বিষয়ক এ আয়োজন।

যবীহুল্লাহ বিতর্কের মূল সূত্র

প্রচলিত বাইবেলগুলোতে যাবীহুল্লাহ হিসেবে ইসহাক আ.কে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমত হলো যাবীহুল্লাহ ছিলেন ইসমাইল আ.। তথ্য প্রমাণের আলোকে ইসহাক আ. যাবীহুল্লাহ প্রমাণিত হলে মুসলমানদের সমস্যা বা মনোকষ্টের কিছু নেই। কারণ তারা ইসমাইল আ. এবং ইসহাক আ. উভয়কেই সমান চোখে দেখে থাকেন। পক্ষান্তরে ইসমাইল আ. যবীহুল্লাহ হওয়ার বিষয়টি ইয়াহুদী খ্রিস্টানদের জন্য মাথা ব্যথার কারণ। কেননা তাদের ভাষ্যে ইসমাইল আ. দাসীপুত্র। বরং তাদের পরিষ্কার ভাষ্য হলো, ইসমাইল আ. ইবরাহীম আ. এর অবৈধ সন্তান! আল্লাহর আশ্রয় কামনা করছি। সুতরাং অবৈধ দাসীপুত্র হয়ে সে কেন যাবীহুল্লাহর মতো এতো বড় মর্যাদার অধিকারী হবে? ইয়াহুদী খ্রিস্টানরা হলো ইসহাক আ. এর পুত্র ইয়াকুব তথা ইসরাইল আ. এর বংশধর। তাই তাদেরকে বনী ইসরাইল বলা হয়। অন্যদিকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহ আ. হলো ইসমাইল আ. এর বংশধর। সুতরাং অবৈধ দাসীপুত্র ইসমাইল আ. যাবীহুল্লাহ এর মর্যাদা লাভ করবে এবং তার বংশ থেকে প্রতিশ্রুত শেষ নবী আগমন করে বিশ্বকে শাসন করবে এটা তারা মেনে নিতে পারে নি। তাদের স্বপ্ন ছিলো, তাদের বংশ থেকে প্রতিশ্রুত শেষ নবীর আগমন হবে। তাদের এ স্বপ্ন পূরণ হয় নি। এ কারণে তারা যে কোনো মূল্যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামর নবুওয়াতকে অস্বীকার ও ইসমাইল আ. এর যাবীহুল্লাহ এর বিষয়টিকে ভণ্ডুল করে ইসহাক আ.কে যাবীহুল্লাহ প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে ও করছে। এর জন্য তারা যা যা করণী তাই করেছে।

যাবীহুল্লাহ বিতর্কের সাথে প্রচলিত কুরবানী উৎসবের বিধানগত কোনো সম্পর্ক নেই

আমরা হজ্ব কেন পালন করি? এর সাথে ইবরাহীম আ. এবং ইসমাইল আ. এর সাথে স্মৃতির সম্পর্ক আছে বলে? না, ব্যাপারটি আদৌ এরকম নয়। মূলত আমরা আল্লার নির্দেশ ও রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ হিসেবে হজ্ব পালন করি। তদ্রূপ আমরা ইসমাইল বা ইসহাক আ. যাবীহুল্লাহ হওয়ার কারণে কুরবানী পালন করি না। আমরা আল্লাহর নির্দেশ এবং রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহ অনুসরণে কুরবানী উৎসব পালন করে থাকি। রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানী ঈদ পালন, অনুমোদন ও বিধিবদ্ধ করেছেন বলেই আমরা তা পালন করি। এ ক্ষেত্রে কে যাবীহুল্লাহ আর কে যাবীহুল্লাহ নয় তা মৌলিক কোনো বিষয় নয়। সেটা নিতান্তই প্রাসঙ্গিক। সুতরাং যাবীহুল্লাহ বিতর্কে আমাদের কুরবানী পালনে কোনো প্রভাব পড়বে না। এমন কি তথ্য প্রমাণের আলোকে যদি ইসহাক আ. যাবীহুল্লাহ প্রমাণিত হয়ে যায় তবুও আমাদের কোনো দুঃখ নেই। এবং তাতে কুরবানীর বিধানে কোনো পরিবর্তন আসবে না। কারণ আমরা ইসহাক আ.কে একজন নবী হিসেবে পরম শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন করি। এটা করতে আমরা বাধ্য। নতুবা আমাদের পরম বিশ্বাস চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। সুতরাং কোনো হিন্দু মহাশয় আদালতে রিট করে ইসহাক আ.কে যাবীহুল্লাহ প্রমাণ করে ফেললেও মুসলমানদের গরু জবাই বন্ধ হবে না। কারণ মুসলমানদের উৎসবমুখর গরু জবাইয়ে বিধানগত দিক থেকে যাবীহুল্লাহ মূল কোনো প্রসঙ্গ নয়।

আলোচনার পটভূমি

ইসলামী শরীয়া মতে তাওরাত-ইঞ্জিলের আদি রূপটি আল্লাহ প্রদত্ত গ্রন্থ। কালক্রমে সুবিধা লোকেরা নিজেদের মত প্রতিষ্ঠার স্বার্থে তাতে অনেক পরিবর্তন এনেছে। এমনকি তাওরাত ইঞ্জিল নাম পরিবর্তন করে বাইবেল নামে রূপ দিয়েছে। এসব পরিবর্তনের কথা পবিত্র কুরআন হাদীসে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে। পরিবর্তন ও বিকৃতির তীর বাইবেলে বর্ণিত যাবীহুল্লাহ বিষয়ক আলোচনাতেও আঘাত হেনেছে। বাইবেলের যাবীহুল্লাহ বিষয়ক স্ববিরোধী ও সাংঘর্ষিক বক্তব্য থেকে খুব সহজেই এ বিষয়টি বেরিয়ে আসে।

বস্তুত ইবরাহীম আ. সুমেরীয় উর অঞ্জলে জন্মগ্রহণ করেন। যেটা বর্তমানের ইরাকে অবস্থিত। সেখান থেকে অত্যাচারিত হয়ে আল্লাহর নির্দেশে সপরিবারে কানান তথা বৃহত্তর ইসরাইল-ফিলিস্তনে গমন করেন। সেখান থেকে কয়েকবার মিশরে যান। একবার মিশর সম্রাট হাজেরাকে ইবরাহীম পত্নী সারার সেবাদাসী হিসেবে উপহার দেন। কোনো কোনো বাইবেল ব্যাখ্যাগ্রন্থে হাজেরাকে মিশর সম্রাট আবিমেলকের কন্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বহু বছর যাবত সারা আ. এর গর্ভে সন্তান আসছিলো না। ফলে সারা আ. স্বউদ্যোগে ইবরাহীম আ. এর সাথে হাজেরা আ. এর বিবাহের ব্যবস্থা করেন। বাইবেলের বক্তব্য এক্ষেত্রে নিম্নরূপ : and gave her to her husband to be his wife.। এদিকে ইবরাহীম আ. পুত্রসন্তান লাভের জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেন। ফলে ৮৬ বছর বয়সে ইসমাইল আ. এর জন্ম হয়। এরপর ইবরাহীম আ. শিশু সন্তানসহ হাজেরা আ.কে মরু অঞ্চলে রেখে আসেন। এ দিকে ১০০ বছর বয়সে সারা আ. গর্ভে ইবরাহীম আ. এর দ্বিতীয় পুত্র ইসহাক আ. এর জন্ম হয়। মূল এ ঘটনার ক্ষেত্রে বাইবেল ও মুসলিম গবেষকদের মাঝে কোনো দ্বৈত মত নেই। মূল বিবাদের সূচনা হয় ইবরাহীম আ. এর কোন পুত্রকে কৈশোরে কুরবানী করার জন্য নিয়েছিলেন এ বিতর্ক থেকে।

পবিত্র কুরআনের ভাষায় যাবীহুল্লাহ

পবিত্র কুরআনে ইবরাহীম আ. কর্তৃক প্রিয় পুত্রকে কুরবানী করার প্রেক্ষাপটটি বেশ উন্মুক্তভাবেই আলোচিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, তারা পরস্পর বললো, তার জন্য চতুর্দিক পাকা প্রাচীরযুক্ত অগ্নিকুণ্ড নির্মাণ করো। এরপর তাকে জ্বলন্ত অগ্নিতে নিক্ষেপ করো। তারা তার বিরুদ্ধে চক্রান্তের  সঙ্কল্প করেছিলো। কিন্তু আমি তাদেরকে অতিশয় হেয় করে দিয়েছি। সে বললো, আমি আমার প্রতিপালকের দিকে চললাম। তিনি আমাকে অবশ্যই সৎপথে পরিচালিত করবেন। হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এক সৎকর্মপরায়ণ সন্তান দান করো। এরপর আমি তাকে স্থিরবুদ্ধি পুত্রের সুসংবাদ দান করলাম। অতঃপর যখন সে তার পিতার সাথে কাজ করার মতো বয়সে উপনীত হলো তখন ইবরাহীম আ. বললো, বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, আমি তোমাকে জবাই করছি। এখন তোমার অভিমত কি বলো। সে বললো, হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করলো এবং ইবরাহীম তার পুত্রকে কাত শায়িত করলো তখন আমি তাকে আহ্বান করে বললাম, হে ইবরাহীম! তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যই পালন করলে। এভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয় এটা ছিলো এক স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে জবাইয়ের একটি শ্রেষ্ঠ পশুর বিনিময়ে মুক্ত করলাম। আমি একে পরবর্তীদের স্মরণে রেখেছি। ইবরাহীমের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। এভাবে আমি সৎকর্মপরায়ণদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি। সে ছিলো আমার মুমিন বান্দাদের অন্যতম। আর আমি তাকে সুসংবাদ দিলাম ইসহাকের। সে ছিলো নবী, সৎকর্মপরায়ণদের অন্যতম। আমি তাকে এবং ইসহাককে বরকত দান করেছিলাম। তাদের বংশরধরদের মধ্যে কতক সৎকর্মপরায়ণ এবং কতক নিজেদের প্রতি স্পষ্ট অত্যাচারী। সূরা সাফফাত ৯৭-১১৩

আয়াত নচয় থেকে যে বিষয়গুলো বেরিয়ে এলো

ক। প্রথম দিকে আল্লাহ বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এক সৎকর্মপরায়ণ সন্তান দান করো। এরপর আমি তাকে স্থিরবুদ্ধি পুত্রের সুসংবাদ দান করলাম।’ এরপর ইবরাহীম আ. কর্তৃক পুত্র কুরবানীর আলোচনা করলেন। শেষ দিকে এসে বললেন, এভাবে আমি সৎকর্মপরায়ণদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি। সে ছিলো আমার মুমিন বান্দাদের অন্যতম। আর আমি তাকে সুসংবাদ দিলাম ইসহাকের। সে ছিলো নবী, সৎকর্মপরায়ণদের অন্যতম। আমি তাকে এবং ইসহাককে বরকত দান করেছি।

নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা উপরোক্ত ঘটনার পূর্বাপর পাঠ করি তাহলে কি একথা বলার সুযোগ আছে যে এখানে এক সন্তান সম্পর্কেই আলোচনা করা হয়েছে? প্রথমে আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম আ.কে সন্তানের সুসংবাদ দিলেন এরপর কুরবানীর আলোচনা করলেন। এরপর আবার পুত্রের সুসংবাদ দিলেন এবং পুত্রের নাম উল্লেখ করলেন ইসহাক। এখানে এক সন্তানের আলোচনা কি করে হয়? জোর করে এক সন্তানের আলোচনা ধরে নেয়া হলে আয়াত নিচয়ের পূর্বাপরের আলোচনার মাঝে বড় রকমের অসঙ্গতি তৈরি হয়ে যায়। সন্তানের সুসংবাদ দিয়ে তার কুরবানীর আলোচনা শেষ করে আবার সে পুত্রের সুসংবাদ দিবেন? খুব সহজেই আয়াতগুলো থেকে সুষ্পষ্টভাবে বোধগম্য হয় যে এখানে দুজন পুত্র সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। প্রথম সন্তানের আলোচনায় নামের উল্লেখ নেই। শুধু হালীম তথা ধৈর্যশীল বিশেষণ উল্লেখ করা হয়েছে। আর দ্বিতীয়জনের আলোচনায় নাম উল্লিখিত হয়েছে। আয়াতের বর্ণনাভঙ্গি থেকে সুষ্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হয়, ইসহাক আ. এর সুসংবাদ নিজের একমাত্র পুত্র ইসমাইল আ. কে কুরবানী করার আদেশ পালনের পুরস্কার স্বরূপ প্রদান করা হয়েছে। এক পুত্রের কুরবানীর আদেশ সম্বলিত ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর অন্য পুত্রের সুসংবাদের আলোচনা এ কথারই প্রমাণ বহন করে। তাছাড়া সর্বসম্মত ইতিহাস স্বীকৃত বিষয় হলো, ইসমাইল আ. ইসহাক আ. এর তুলনায় বয়সে বেশ বড় ছিলেন। সূরা ইবরাহীমের ৩৯ নম্বর আয়াতে সন্তান লাভ সম্পর্কিত আলোচনায় ইসমাইল এবং ইসহাক আ. এর নাম পরপর উল্লিখিত হয়েছে। সেখানে প্রথমে ইসমাইল আ. দ্বিতীয় পর্যায়ে ইসহাক আ. এর নাম উল্লিখিত হয়েছে। আয়াতটি নিম্নরূপ : الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي وَهَبَ لِي عَلَى الْكِبَرِ إِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ إِنَّ رَبِّي لَسَمِيعُ الدُّعَاءِ  । অর্থ, সকল প্রশংসা আল্লাহরই যিনি আমাকে আমার বার্ধক্যে ইসমাঈল ও ইসহাককে দান করেছেন। আমার প্রতিপালক অবশ্যই প্রার্থনা শুনে থাকেন। সুরা মারইয়ামের ৫৪ নম্বর আয়াতে ইসমাইল আ. কে রাসূল এবং নবী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আয়াতটি নিম্নরূপ : وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ إِسْمَاعِيلَ إِنَّهُ كَانَ صَادِقَ الْوَعْدِ وَكَانَ رَسُولًا نَبِيًّا ।  অর্থ, স্মরণ করো এ গ্রন্থে ইসমাইলের কথা, সে ছিলো প্রতিশ্রুতি পালনে সত্যাশ্রয়ী এবং সে ছিলো রাসূল, নবী।

ইসহাক আ.-এর আলোচনা তো কুরবানীর ঘটনার পরে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাঁর সুসংবাদ তো নিজের ‘একমাত্র পুত্র’ ইসমাঈলকে কুরবানী করার আদেশ পালনের পুরস্কার হিসাবে প্রদান করা হয়েছে। আয়াতের বর্ণনাভঙ্গি থেকেই বিষয়টি সুস্পষ্ট।

খ। কুরবানীর ঘটনা যে সন্তানের সাথে ঘটেছে তাকে পবিত্র কুরআনে غلام حليم তথা ধৈর্যশীল পুত্র সন্তান বলা হয়েছে। সূরা সাফফাত, আয়াত ১০১। অন্যদিকে ইসহাক আ. কে  غلام عليم  তথা বিদ্বান সন্তান বলে আখ্যা দেয় হয়েছে। সূরা হিজর, আয়াত ৫৩, সূরা যারিয়া, আয়াত ২৮। এতে বোঝা যাচ্ছে, غلام حليم দ্বারা ইসমাইল আ.ই উদ্দেশ্য ছিলেন। অন্যদিকে সূরা আম্বিয়ার ৮৫ নম্বর আয়াতে ইসমাইল আ.কে من الصابرين তথা ধৈর্যশীল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ গুণবৈশিষ্টটি উপরোক্ত কুরবানী সংক্রান্ত আয়াতেও উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা সাফফাত ১০২। অথচ ইসহাক আ. সম্পর্কে ধৈর্য সম্পর্কিত গুণবৈশিষ্ট উল্লেখ করা হয় নি। একমাত্র ইসমাইল আ. এর সাথে এ বৈশিষ্টগুলো উল্লিখিত হয়েছে। আর এটা স্বতঃসিদ্ধ কথা, কুরবানী বিষয়ক ঘটনার সাথেই এ গুণবৈশিষ্টগুলো সবিশেষ সম্পর্কিত। কারণ কুরবানীর ঘটনায় ইবরাহীম আ. এর কিশোর পুত্র ধৈর্য ও সহনশীলতার পরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। যা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রভুভক্তির একক ও অনন্য ঘটনা হিসেবে চির অমর হয়ে থাকবে। এসব বিষয়গুলো থেকে খুব সহজেই এ সিদ্ধানে উপণীত হওয়া যায় যে হযরত ইবরাহীম আ. পুত্র ইসমাইল আ.কেই কুরবানী করার জন্য স্বপ্নাদিষ্ট হয়েছিলেন; ইসহাক আ.কে নয়।

গ। ইবরাহীম আ. এর দুই পুত্র ছিলো। ১। ইসমাইল আ. ২। ইসহাক আ.। ইসহাক আ. এর জন্ম প্রক্রিয়া সম্বন্ধে পবিত্র কুরআনে আলোচনা এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, আমার ফেরেশতাগণ সুসংবাদ নিয়ে তার কাছে এলো। তারা বললো সালাম। সেও বললো সালাম। সে অবিলম্বে কাবাবকৃত গো-বৎস নিয়ে আসলো। সে যখন দেখলো তাদের হাত খাদ্যবস্তুর দিকে প্রসারিত হচ্ছে না তখন তাদেরকে অবাঞ্ছিত মনে করলো এবং তাদের ব্যাপারে তার মনে ভীতি সঞ্চার হলো। তারা বললো, ভয় পেয়ো না। আমরা তো লূত সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরিত হয়েছি। তখন সেখানে তার স্ত্রী দণ্ডায়মান ছিলো। সে হেসে ফেললো। অতঃপর আমি তাকে ইসহাকের ও ইসহাকের পরবর্তী ইয়াকুবের সুসংবাদ দিলাম। সারা আ. বললো, কি আশ্চর্য! সন্তানের জননী হবো আমি? অথচ আমি বৃদ্ধা এবং আমার স্বামী বৃদ্ধ! নিশ্চয় এটা একটা অদ্ভূত ব্যাপার। তারা বললো, আল্লাহর কাজে তুমি বিস্ময় বোধ করছো? হে পরিবারবর্গ! তোমাদের প্রতি রয়েছে আল্লাহর অনুগ্রহ ও কল্যাণ। তিনি তো প্রশংসার্হ ও সম্মানার্হ। এরপর যখন ইবরাহীমের ভীতি দূরীভূত হলো এবং তার নিকট সুসংবাদ আসলো তখন সে লূত সম্প্রদায় সম্বন্ধে আমার সাথে বাদানুবাদ করতে লাগলো। সূরা হূদ আয়াত ৬৯-৭৪

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,  আর তাদেরকে ইবরাহীমের অতিথিদের কথা বলো। যখন তারা তার নিকট উপস্থিত হয়ে বললো, সালাম তখন সে বললো আমরা তোমাদের আগমনে আতঙ্কিত। তারা বললো, ভয় পেয়ো না। আমরা তোমাকে এক জ্ঞানী পুত্রের সুসংবাদ দিচ্ছি। সে বললো, তোমরা কি আমাকে সুসংবাদ দিচ্ছো আমি বার্ধক্যগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও। তোমরা কি বিষয়ে সুসংবাদ দিচ্ছো? তারা বললো, আমরা সত্য সংবাদ দিচ্ছি। সুতরাং তুমি হতাশ হয়ো না। সে বললো, যারা পথভ্রষ্ট তারা ব্যতীত আর কে তার প্রতিপালকের অনুগ্রহ হতে হতাশ হয়? সূরা হিজর, আয়াত ৫১-৫৬।

অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমার নিকট কি ইবরাহীমের সম্মানিত অতিথিদের বৃত্তান্ত এসেছে? যখন তারা তার নিকট উপস্থিত হয়ে বললো, সালাম তখন সে উত্তরে বললো সালাম। এরা তো অপরিচিত লোক। এরপর ইবরাহীম তার স্ত্রীর নিকট গেলো এবং একটি মাংসল গো-বৎস ভাজা নিয়ে আসলো। এবং তাদের সামনে রেখে বললো, তোমরা খাচ্ছো না কেন? তাদের সম্পর্কে তার মনে ভীতি সঞ্চার হলো। তারা বললো, ভয় পেয়ো না। অতঃপর তারা তাকে এক জ্ঞানী পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিলেন। তখন তার স্ত্রী চিৎকার করতে করতে সম্মুখে আসলো এবং গাল চাপড়িয়ে বললো  এ বৃদ্ধা বন্ধ্যার সন্তান হবে? তারা বললো, তোমার প্রতিপালক এরূপ বলেছেন। তিনি প্রজ্ঞাময় এবং সর্বজ্ঞ। সূরা যারিয়াত, আয়াত ২৪-৩০

উপর্যুক্ত তিনটি সূরা হুদ, হিজর ও যারিয়াতে ইসহাক আ. এর জন্ম বিষয়ে বেশ স্পষ্ট আলোচনা এসেছে। ইবরাহীম আ. তাঁর ইসহাক নামী এ পুত্র লাভের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন নি। বরং বিনা প্রার্থনায় ফেরেশতাদের মাধ্যমে তাঁর এ পুত্র লাভের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। এমনকি এ সুসংবাদে ইবরাহীম আ. এর সম্মুখেই সারা আ. প্রবল বিস্ময়ে কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পড়েন। এখানে কুরআনের উপস্থাপনা শৈলী লক্ষণীয়। আল্লাহ বলেন, অতঃপর আমি তাকে ইসহাকের ও ইসহাকের পরবর্তী ইয়াকুবের সুসংবাদ দিলাম। সারা আ. বললো, কি আশ্চর্য! সন্তানের জননী হবো আমি? অথচ আমি বৃদ্ধা এবং আমার স্বামী বৃদ্ধ! নিশ্চয় এটা একটা অদ্ভূত ব্যাপার। সূরা হুদ আয়াত ৬৯-৭৪।

অন্য আয়াতে সারা আ. এর বিস্ময়ের মাত্রাটা প্রবল বেগে বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন, তারা বললো, ভয় পেয়ো না। অতঃপর তারা তাকে এক জ্ঞানী পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিলেন। তখন তার স্ত্রী চিৎকার করতে করতে সম্মুখে আসলো এবং গাল চাপড়িয়ে বললো এ বৃদ্ধা বন্ধ্যার সন্তান হবে? সূরা যারিয়াত, আয়াত ২৪-৩০। ইসহাক নামী পুত্র সন্তানের জন্য প্রার্থনা করা হলে ইবরাহীম আ. এর সমুখে সারা আ. এর এমন বিস্ময়কাতর হওয়ার কথা ছিলো না। ফেরেশতা কর্তৃক পুত্র লাভের সংবাদে শুধু সারা আ.ই বিস্মিত হন নি; ইবরাহীম আ. নিজেও বিস্মিত হয়েছিলেন। কুরআনের ভাষায়, তারা বললো, ভয় পেয়ো না। আমরা তোমাকে এক জ্ঞানী পুত্রের সুসংবাদ দিচ্ছি। সে (ইবরাহীম) বললো, তোমরা কি আমাকে সুসংবাদ দিচ্ছো আমি বার্ধক্যগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও? আয়াত ৫১-৫৬। আর উপরোক্ত আয়াতত্রয়ে যে ইসহাক আ. এর জন্ম সংবাদের ব্যাপারটিই আলোচিত হয়েছে তাতে কোনো ধরনের মতভিন্নতা নেই। কারণ ফেরেশতা কর্তৃক সংবাদ দেয়া সন্তানের নাম যে ইসহাক তা পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে। যেমন, অতঃপর আমি তাকে ইসহাকের ও ইসহাকের পরবর্তী ইয়াকুবের সুসংবাদ দিলাম। সারা আ. বললো, কি আশ্চর্য! সন্তানের জননী হবো আমি? অথচ আমি বৃদ্ধা এবং আমার স্বামী বৃদ্ধ! নিশ্চয় এটা একটা অদ্ভূত ব্যাপার। সূরা হুদ আয়াত ৬৯-৭৪। সুতরাং বেশ পরিষ্কার ভাষায়ই বলা যায়, ইসহাক আ. এর জন্ম লাভের ব্যাপারটি ইবরাহীম এর দুআর ফসল ছিলো না। বরং প্রথম পুত্র ইসমাইল আ. এর কুরবানী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার ফসল ছিলো।

অন্যদিকে ইসমাইল আ. এর জন্মলাভটি ছিলো হযরত ইবরাহীম আ. এর একনিষ্ঠ মনের দুআর ফসল। পবিত্র কুরআনে বিষয়টি এভাবে বর্ণিত হয়েছে, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এক সৎকর্মপরায়ণ সন্তান দান করো। এরপর আমি তাকে স্থিরবুদ্ধি পুত্রের সুসংবাদ দান করলাম। সূরা সাফফাত ৯৭-১১৩।

ঘ। কুরআনের ভাষ্য মতে পুত্র সন্তানকে কুরবানী করার বিষয়টি পিতা পুত্র উভয়ের জন্য ছিলো এক মহা পরীক্ষা। আল্লাহ তাআল বলেন, নিশ্চয় এটা ছিলো এক স্পষ্ট পরীক্ষা। সূরা সাফফাত ৯৭-১১৩। আর এ পরীক্ষাটা দুই পুত্রের মধ্য হতে কার জন্য প্রযোজ্য তা বিশ্লেষণ করা যাক।

কুরআনের ভাষায় আগেই বলা হয়েছে, ফেরেশতাদের মাধ্যমে ইসহাক আ. এর জন্মের বিষয়টি জানানো হয়েছে। সে সাথে আরো দুটি বিষয় জানানো হয়েছে। ১। ইসহাক আ. নবী হবেন। ২। ইসহাক আ. এর ঔরসে ইয়াকুব জন্ম লাভ করবেন। বিষয় দুটি স্বতন্ত্র দুটি আয়াতে এভাবে আলোচিত হয়েছে : ১। অতঃপর আমি তাকে ইসহাকের ও ইসহাকের পরবর্তী ইয়াকুবের সুসংবাদ দিলাম। সূরা হুদ ৭১।  ২। আর আমি তাকে সুসংবাদ দিলাম ইসহাকের। সে হবে নবী ও সৎকর্মপরায়ণদের অন্যতম। সূরা সাফফাত ১১২।

কুরবানী ঘটনা যদি ইসহাক আ. এর সাথে হয়ে থাকে তাহলে আল্লাহ ইবরাহীম আ.কে ইসহাকের নবী হবার সংবাদ কেন দিলেন? উপরন্তু ইসহাকের ঔরসে ইয়াকুব জন্ম লাভ করবে একথাটাও বা কেন বললেন? এতে তো সংঘর্ষ ও স্ববিরোধিতা দেখা যাচ্ছে। পুত্রকে কুরবানী করা যদি পরীক্ষা হয় তবে পিতাকে জানা না থাকতে হবে যে পুত্র নবী হবে এবং তার গর্ভে সন্তান হবে। আর যদি সন্তানের এ দুটি বিষয় পিতা জেনেই থাকেন তবে তো কুরবানী করাটা পরীক্ষা হলো না। কারণ তখন তো পিতা জেনেই গেলেন যে তার পুত্রকে জবাই করতে হবে না। আল্লাহ কখনো অসত্য বলেন না। আল্লাহ যেহেতু বলেছেন, পুত্র নবী হবে ও তার ঔরসে সন্তান হবে তবে এ সন্তানকে শেষ মেষ জবাই করতে হবে না। তাহলে তো এ কুরবানী পরীক্ষা হবে না। এমন কি এর কোনো অর্থ ও তাৎপর্য থাকবে না। এমন অর্থ ও তাৎপর্যহীন কাজ কি আল্লাহ করতে পারেন? এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে কুরবানীর ঘটনাটি ইসমাইল আ. এর সাথে সংঘটিত হয়েছিলো। কারণ ইসমাইল আ. এর জন্ম সংবাদের সাথে এমন কোনো সংবাদ সংযুক্ত করা হয় নি যা কুরবানী পরীক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে। কুরবানী বিষয়ে পিতা পুত্রের সংলাপের মতো বাইতুল্লাহ নির্মাণের প্রেক্ষাপটে আরো একটি সংলাপের কথা বর্ণিত হয়েছে। সংলাপটি নিম্নরূপ : ইবরাহীম আ. বললেন, হে ইসমাইল! আল্লাহ আমাকের একটি ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন। ইসমাইল আ. বললেন, আপনার প্রতিপালক আপনাকে যে ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন তা পালন করুন। ইবরাহীম আ. বললেন, তুমি আমাকে সহযোগিতা করবে? ইসমাইল আ. বললেন, হ্যাঁ, সহযোগিতা করবো। ইবরাহীম আ. বললেন, আল্লাহ আমাকে এখানে একটি ঘর নির্মাণের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। এবং একথা বলে সুউচ্চ একটি টিলার দিকে ইঙ্গিত করলেন। সহীহ বুখারী, ৩৩৬৪। দুটি সংলাপের সাদৃশ্যপূর্ণ ধারাবর্ণনা থেকেও প্রমাণিত হয় ইসমাইল আ.ই যাবীহুল্লাহ ছিলেন।

ইঞ্জিলের আলোকে যাবীহুল্লাহ

বাইবেলের সবচেয়ে বিশুদ্ধতম বর্ণনা, যা ‘ইঞ্জিলে বারনাবাস’ নামে প্রসিদ্ধ, তাতে ৪৩ ও ৪৪ নং অধ্যায়ে ঈসা আ.-এর স্পষ্ট বাণী উল্লেখ রয়েছে যে, কুরবানীর ঘটনা ইসমাঈল আ.-এর, ইসহাক আ.-এর নয়। যদিও খৃস্টানগণ এই ইঞ্জিলটিকে গ্রহণযোগ্য মনে করেন না। তার কারণ হলো তাতে এ জাতীয় বিশুদ্ধ ও স্পষ্ট তথ্যসমূহ বিদ্যমান রয়েছে।-ইঞ্জিলে  বারনাবাস পৃষ্ঠা : ১৭৭-১৮১

ইয়াহুদীর বক্তব্যে যাবীহুল্লাহ

মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব কুরাযী রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি খলীফা উমর ইবনে আব্দুল আযীয রহ. কে ইসমাইল আ. এর যবীহুল্লাহ হওয়ার বিষয়টি বললাম। উমর ইবনে আব্দুল আযীয রহ. বলেন, আমি বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। তুমি যেমনটি বলছো আমি তেমনটিই মনে করি। এরপর সিরিয়ায় অবস্থানরত জনৈক ব্যক্তিকে ডেকে পাঠালেন। তিনি ইয়াহুদী থেকে মুসলমান হয়েছিলেন। তাকে ইয়াহুদী আলেমদের মধ্যে গণ্য করা হতো। উমর ইবনে আব্দুল আযীয রহ. তাকে যবীহুল্লাহ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব রহ. বলেনত, আমি তখন উমর ইবনে আব্দুল আযীয রহ. এর কাছেই উপস্থিত ছিলাম। উমর ইবনে আব্দুল আযীয রহ. তাকে বললেন, ইবরাহীম আ. এর কোন পুত্রকে জবাই করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো? লোকটি বললো, আমিরুল মুমিনীন! আল্লাহর শপথ করে বলছি, ইবরাহীম পুত্র ইসমাইল আ.কেই কুরবানীর জন্য নির্দেশ করা হয়েছিলো। ইয়াহুদীরা ব্যাপারটি সম্পর্কে জানে। কিন্তু তারা আপনাদের আরবদের ব্যাপারে বিদ্বেষ পোষণ করে এ কারণে যে আপনাদের পিতৃপুরুষ সম্বন্ধে আল্লাহর কুরবানী সম্বলিত নির্দেশনা এসেছিলো এবং তার অস্বাভাবিক ধৈর্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার ফলে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা অর্জিত হয়েছিলো। ফলে তারা বিদ্বেষ বশত এ ব্যাপারটিকে অস্বীকার করে। এবং তারা মনে করে কুরবানীর নির্দেশনা মূলত তাদের পিতৃপুরুষ ইসহাক আ. এর ব্যাপারে প্রদত্ত হয়েছিলো। তাফসীরুল কুরআনিল আযীম ৭/৩৩

ইসমাইল আ.কে যাবীহুল্লাহ প্রমাণে সমকালীন ইয়াহুদীদের বক্তব্য

যাবীহুল্লাহ বিষয়ে ড. হামীদুল্লাহ রাহ.-এর একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৯৪ খৃষ্টাব্দের কথা। ড. সাহেব যখন এ বিষয়ের উপর ইহুদীদের কিতাবসমূহ এবং ইতিহাসের তথ্যসমূহ থেকে প্রমাণ করে দিলেন যে, কুরবানীর ঘটনা ইসমাঈল আ.-এর সাথেই সম্পর্কিত তখন ইহুদী পণ্ডিতগণ তাকে নির্জনে ডেকে বলেছিল, আপনার এই গবেষণা মেনে নিলে তো আমাদের পুরো মাযহাবই বাতিল হয়ে যাবে। ড. সাহেব বলেছিলেন, সঠিক বিষয় পেশ করা আমার কাজ। দলীলের আলোকে আমি তা করেছি। এখন মানা না মানা আপনাদের কাজ।-ড. মুহাম্মাদ হাদীদুল্লাহ কী বেহতরীন তাহরীরেঁ, সংকলক সাইয়্যেদ কাসেম মাহমুদ, ভূমিকা, পৃষ্ঠা : ২৯-৩০, সাপ্তাহিক তাকবীর-এর উদ্ধৃতিতে

হিন্দু ব্রাহ্মনের বক্তব্যে যাবীহুল্লাহ

বাংলা ভাষায় কুরআন মজীদের সর্বপ্রথম অনুবাদক হিসাবে খ্যাত জনাব গিরিশ চন্দ্র সূরা সাফফাতের সংশ্লিষ্ট আয়াতের অর্থ করেছেন ‘হে আমার প্রতিপালক, তুমি আমাকে সাধুদিগের (একজন) দান কর। অবশেষে আমি তাহাকে প্রশান্ত বালকের (এস্‌মায়িল নামক পুত্রের) সুসংবাদ দান করিলাম।’- কোরআন শরীফ (হরফ প্রকাশনী, কলকাতা-৭ থেকে মুদ্রিত), পৃষ্ঠা : ৫১৩, সূরা সাফফাত : ৯৯-১০০

ইতিহাসের আলোকে যাবীহুল্লাহ

বাইতুল্লাহ পুনঃনির্মাণ করেছিলেন যৌথভাবে ইবরাহীম এবং ইসমাইল আ.। এবং তাঁরা বাইতুল্লাহকে পরিচ্ছন্ন করার ব্যাপারে আদিষ্ট হয়েছিলেন। বিষয়টি পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে। সূরা বাকারাহ, আয়াত ১২৭, 125

সাফা মারওয়ায় সায়ী করা, রমল করা, যমযমের পানি এ বিষয়গুলোর সাথে ইসমাইল আ. ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। বিষয়টি সহীহ হাদীস দ্বারা সুপ্রমাণিত। সহীহ বুখারীতে এতদ বিষয়ে বিশদ বর্ণনা এসেছে। যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাজেরা আ. কর্তৃক সাফা মারওয়া পর্বতে সাত বার প্রদক্ষিণ করার কথা বললেন তখন বললেন, এ কারণেই মানুষ এখন হজ্বের সময় সায়ী করে থাকে। সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৩৬৪

মিনাস্থ শয়তান প্রতীককে জামরাহ বলা হয়। জামরাহ অর্থ পাথর। যেহেতু ইবরাহীম আ. শয়তানকে এ তিনটি জায়গায় পাথর নিক্ষেপ করেছিলেন তাই এ জায়গাগুলোকে জামারা বলা হয়। পাথর নিক্ষেপের প্রেক্ষাপটটি এভাবে তৈরি হয়, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যখন ইবরাহীম আ. আপন পুত্রকে জবাই করবার জন্যে মিনাতে নিয়ে আসেন তখন প্রথম জামরাতে শয়তান এসে সন্তানকে জবাই না করার জন্য ইবরাহীম আ.কে প্ররোচিত করতে শুরু করে। তখন ইবরাহীম আ. শয়তানকে সাতটি পাথর নিক্ষেপ করেন। ফলে শয়তান মাটিতে দেবে যায়। ইবরাহীম আ. দ্বিতীয় জামরার জায়গাটিতে এলে শয়তান আবারো প্ররোচিত করে। ইবরাহীম আ. আবারো তাকে সাতটি পাথর নিক্ষেপ করে। ফলে এবারো শয়তান মাটিতে দেবে যায়। ইবরাহীম আ. তৃতীয় জামরার জায়গাটিতে এলে শয়তান তৃতীয় বারের মত প্ররোচিত করার চেষ্টা করে। ইবরাহীম আ. এবারো শয়তানকে সাতটি পাথর নিক্ষেপ করেন। ফলে শয়তান মাটিতে দেবে যায়। ইবনে আব্বাস রা. বলেন, তোমরা শয়তানকে পাথর মারছো এবং তোমাদের পিতা ইবরাহীম আ. এর আদর্শকে অনুসরণ করছো। মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ১৭১৩, সহীহ ইবনে খুযাইমাহ, হাদীস ২৯৬৭, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৭০৭

ইমাম আসমায়ী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আমর ইবনুল আলা রহ.কে যাবীহুল্লাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। উত্তরে তিনি বললেন, হে আসমায়ী! তোমার জ্ঞান-বুদ্ধি কোথায় গেলো? ইসহাক আ. কবে মক্কায় ছিলো? মক্কায় তো ছিলেন ইসমাইল আ.। তিনিই তো পিতার সাথে মিলে বাইতুল্লাহ নির্মাণ করেছেন। এবং কুরবানীর স্থল ও মক্কায় অবস্থিত। ইমাম কুরতুবী, আলজামি’ লিআহকামিল কুরআন ১৫/১০০

কুরবানি-কৃত দুম্বার শিংদুটি পবিত্র বাইতুল্লাহে সংরক্ষিত ছিল

ইসমাঈলের কুরবানির বিষয়টিই যে আরবদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিল তাই নয়, উপরন্তু ইসমাঈলের পরিবর্তে যে মেষ বা দুম্বা ইবরাহীম কুরবানি করেছিলেন তার শিংদুটি রাসূলুল্লাহ -এর সময় পর্যন্ত কাবাগৃহে সংরক্ষিত ছিল। ইমাম আহমদ সহীহ সনদে উদ্ধৃত করেছেন, কাবাগৃহের মুতাওয়াল্লি পরিবারের সদস্য শাইবার কন্যা সাফিয়্যাহ বলেন, আমাদের পরিবারের ধাত্রী মহিলা আমাকে বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  কাবাগৃহের মুতাওয়াল্লি উসমান ইবনু তালহাকে ডেকে পাঠান। পরে আমি জিজ্ঞাসা করি তিনি কেন তোমাকে ডাকলেন? উসমান বলেন, রাসূলুল্লাহ  আমাকে বলেন, আমি যখন বাইতুল্লাহর মধ্যে প্রবেশ করি তখন সেখানে দুম্বার শিং দুটি দেখতে পাই। শিং দুটি আবৃত করে রাখতে বলতে আমি ভুলে গিয়েছিলাম। এজন্য তোমাকে ডেকেছি যে, তুমি শিং দুটিকে আবৃত করে রাখবে। মসজিদের মধ্যে এমন কিছু থাকা উচিত নয় যা সালাত আদায়কারীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে।” হাদীসের বর্ণনাকারী সুফিয়ান ইবনু উআইনা বলেন: শিং দুটি কাবাগৃহে সংরক্ষিত ছিল। পরে আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইরের সময়ে (৬০-৭০ হি/৬৮০-৬৯০খৃ.) কাবাগৃহে আগুন লাগলে শিং দুটি পুড়ে যায়। মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬৫৯০, ইসনাদুহ সহীহ বিতাহকীকি আহমাদ শাকির ওয়া হামযাহ আহমাদ যাইন, , আখবারে মক্কাহ লিল আযরাকী পৃ. ২৩৬

উপরোক্ত বর্ণনাগুলো থেকে খুব সহজেই প্রতীয়মান হয়, পবিত্র মক্কা ভূমিতে ইসমাইল আ. এর বসবাস ছিলো। ইসহাক আ. এর বসবাস মক্কা ভূমিতে ছিলো না। বরং তিনি বসবাস করতেন শামের কেনান ভূমিতে। এবং তিনি মক্কা ভূমিতে কখনো এসেছেন বলে কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। একাধিক হাদীস ও আসারের আলোকে প্রমাণিত কুরবানীর ঘটনা মক্কার মিনা প্রান্তরে সংঘটিত হয়েছে। ইবরাহীম আ. এর কুরবানী পরীক্ষা ভণ্ডুল করার জন্য শয়তান জায়গায় অপচেষ্টা চালিয়ে ছিলো। তিনো জায়গায় ইবরাহীম আ. শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করে শয়তানের চক্রান্তের জাল ছিন্ন করে দেন। সে স্মৃতি আদর্শের ধারা আজো মহা সমারোহে বছরে বছরে মিনা প্রান্তরে পালিত হচ্ছে। সুতরাং মক্কা ভূমিতে কুরবানীর ঘটনা সংঘটিত হওয়া এবং যুগ পরম্পরায় তার প্রচলন মুসলিম বিশ্বে অব্যাহতভাবে চলতে থাকা এবং সে কুরবানী ঘটনার স্মৃতি আদর্শ আজো পালিত হওয়া শক্তিমত্তার সাথে একথাই প্রমাণ করে যে কুরবানীর ঘটনাটি ইসমাইল আ. এর সাথেই সংঘটিত হয়েছিলো; ইসহাক আ. এর সাথে নয়। উপরন্তু কুরবানীর আদর্শটি ইসমাইল আ. এর বংশের মাঝেই পালিত হচ্ছে; ইসহাক আ. এর বংশের মাঝে পালিত হচ্ছে না। এতেও প্রমাণ হয় কুরবানীর বিষয়টি ইসমাইল আ.কে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছিলো; ইসহাক আ.কে ঘিরে নয়।

মুহাদ্দসীনে কেরামের ভাষায় যাবীহুল্লাহ

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. এর ছেলে আব্দুল্লাহ রহ. বলেন, আমি আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যাবীহুল্লাহ কে ছিলো? ইসমাইল না ইসহাক? পিতা বলেছিলেন, ইসমাইল আ.। কিতাবুয যুহদ, আহমাদ ইবনে হাম্বল পৃ.৩৯১

ইবনু আবী হাতেম রহ. বলেন, আমি আমার পিতাকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, শুদ্ধ কথা হলো, যাবীহুল্লাহ ইসমাইল আ.ই ছিলেন। তাফসীরুল কুরআনিল আযীম ৭/৩৩

ইমাম ইবনে কাসীর রহ. {فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلَامٍ حَلِيمٍ (101} [الصافات : 101] এ আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, এখানে গুলাম দ্বারা উদ্দেশ্য ইসমাইল আ.। কারণ ইসমাইল আ. হলেন ইবরাহীম আ. এর প্রথম সন্তান যার ব্যাপারে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। এবং ইয়াহুদী খ্রিস্টান ও মুসলমানদের সর্বসম্মত অভিমত অনুসারে ইসমাইল আ. ইসহাক আ. এর বড় ছিলেন। বরং তাদের গ্রন্থাদিতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে ইবরাহীম আ. এর ৮৬ বছর বয়সে পুত্র ইসমাইল আ. এর জন্ম হয়। আর ইবরাহীম আ. এর ৯৯ বছর বয়সে পুত্র ইসহাক আ. এর জন্ম হয়। এবং তাদের গ্রন্থে একথাও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম আ. এর একমাত্র পুত্রকে কোনো কোনো কপিতে অগ্রজ ও প্রথমজাত পুত্রকে জবাই করার নির্দেশ দিয়েছেন। এখানে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তারা ইসহাক শব্দ সংযুক্ত করে দিয়েছে। এ সংযোজন আদৌ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ এটা তাদের গ্রন্থের ক্তব্যের সাথেই সাংঘর্ষিক। তারা ইসহাক নাম সংযুক্ত করেছে। কারণ ইসহাক আ. তাদের পূর্বপুরুষ। আর ইসমাইল আ. হলেন আরবদের পূর্বপুরুষ। ফলে তারা আরবদের সাথে হিংসায় মেতে উঠলো। ফলে তারা ইসহাক শব্দ সংযোজন করলো। এবং বিকৃত করে وحيدك শব্দের অপব্যাখ্যা দাঁড় করালো।  ব্যাখ্যায় তারা বললো, وحيدك অর্থ ওই সন্তান যে ব্যতীত তোমার কাছে কেউ নেই। কারণ ইসমাইল আ. তার  মা’সহ মক্কার দিকে চলে গিয়েছিলো। এটা চরম মাত্রার মিথ্যা অপব্যাখ্যা। আরবী ভাষায় وحيد বলা হয় ওই ব্যক্তিকে যে ব্যতীত আর কেউ নেই। উপরন্তু প্রথম সন্তানের স্বতন্ত্র একটা মর্যাদা থাকে যেটা পরবর্তী সন্তানের হয় না। সুতরাং প্রথম সন্তানের ব্যাপারে কুরবানী করার নির্দেশ দেয়াটিই বেশি যুক্তিযুক্ত। তাফসীরুল কুরআনিল আযীম ৭/২৬

ইবনে আব্বাস রা. বলেন, যাবীহুল্লাহ ইসমাইল আ. ছিলেন। ইয়াহুদীরা মনে করে যাবীহুল্লাহ ইসহাক আ. ছিলেন। ইয়াহুদীরা মিথ্যা বলেছে। তাফসীরুল কুরআনিল আযীম ৭/৩২

আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মিনায় পাথর নিক্ষেপ ইবরাহীম আ. এর সবিশেষ স্মৃতি নিদর্শন হিসেবে পরিগণিত। সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৩৮৬৮

যাবীহুল্লাহ বিষয়ে ইসরায়েলীয় বর্ণনার প্রভাব

যাবীহুল্লাহ বিষয়ে দুটি মত পাওয়া যায়। ১। ইসমাইল আ. ২। ইসহাক আ.। তবে ইসমাইল আ. এর যাবীহুল্লাহ হওয়ার বিষয়টিই নির্ভরযোগ্য তথ্য-প্রমাণের আলোক চির সত্য। কিন্তু এতদ সত্ত্বেও কতিপয় সাহাবী, তাবিয়ী ও উলামায়ে কেরাম থেকে বর্ণনা পাওয়া যায় যে তাদের মতে ইসহাক আ. হলেন যাবীহুল্লাহ। এ বিষয়ে ইমাম ইবনে কাসীর রহ. বলেন, যাবীহুল্লাহ ইসহাক আ. ছিলেন বলে যেসব সাহাবা ও তাবিয়ীদের বক্তব্য শোনা যায় তার সবই কা’ব আহবার থেকে গৃহীত। তিনি উমর রা. এর খেলাফত কালে যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন উমর রা. তাঁর গ্রন্থাদি থেকে বিভিন্ন বিষয় বর্ণনা করতেন। অনেক সময় উমর রা. কাব আহবার এর কাছে রক্ষিত কিতাবাদি থেকে বিভিন্ন বিষয়াদি শ্রবণ করতেন। ফলে মানুষ তার কাছে রক্ষিত বিভিন্ন তথ্যাবলী শ্রবণের সুযোগ পেয়ে যায়। ফলে মানুষ তার কাছে থেকে সত্য অসত্য বিভিন্ন তথ্য বর্ণনা করতে শুরু করে। কাব আহবারের নিকট রক্ষিত একটি বর্ণেরও মুসলিম উম্মাহর প্রয়োজন নেই। তাফসীরুল কুরআনিল আযীম ৭/৩২

তাওরাত ইঞ্জিলে কি ইসহাক আ.কে যাবীহুল্লাহ বলা হয়েছে?

শিরোনামকৃত প্রশ্নের উত্তরে আমাদের একটু গভীরে প্রবেশ করতে হবে। কারণ এ প্রশ্নের উত্তর তাওরাত ইঞ্জিলের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সাথে সংশ্লিষ্ট।

তাওরাত ও ইঞ্জিল কি জিনিস?

তাওরাত

তাওরাত একটি হিব্রু ভাষার শব্দ। এটি মূলত ירה (ইউরহা) শব্দ থেকে এসেছে। এর আবিধানিক অর্থ আইন, শিক্ষা, ব্যবস্থাপনা, সর্বজনগ্রাহ্য নিয়মনীতি। পরিভাষায় হযরত মুসা আ. এর উপর অবতীর্ণ আল্লাহ তাআলার পবিত্র বাণীসমূহের সমষ্টিকে তাওরাত বলা হয়।

প্রচলিত তাওরাতে দেখা গেছে মহাবিশ্বের সৃষ্টির বিবরণ দিয়ে এর সূচনা হয়েছে। তারপর আদম আ. থেকে নূহ আ. পর্যন্ত বংশ-তালিকা ও মহা প্লাবনের ঘটনাক্রম বর্ণনা করা হয়েছে। এর সাথে রয়েছে ইবরাহীম আ.এর  বংশের বিবরণ ও ইসরাইল জাতির সুচনালগ্ন ও প্রাচীন মিশর দেশে পুনর্বাসনের কাহিনী। উপরন্তু সিনাই উপত্যকায় তাওরাত অবতীর্ণ হওয়ার কাহিনীও তাতে স্থান পেয়েছে। মিশর দেশ থেকে মুক্ত হয়ে কেনান দেশে ইসরাইল জাতির ফিরে আসা এবং মুসা আ. এর মৃত্যুর ঘটনার বিবরণ দিয়ে প্রচলিত তাওরাত গ্রন্থটির উপসংহার টানা হয়েছে।

প্রচলিত তাওরাত গ্রন্থটি মৌলিকভাবে পাঁচটি পর্বে বিভক্ত। প্রতিটি পর্বের স্বতন্ত্র নামকরণ করা হয়েছে। পর্বগুলোকে একত্রে পঞ্চপুস্তক হিসেবেও অভিহিত করা হয়। ইংরেজি ভাষায় ব্যবহৃত প্রত্যেকটি নাম প্রাচীন গ্রিসের ভাষা থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়। প্রচলিত তাওরাতের মূল পাঁচটি পর্বের নাম গ্রীস বর্ণ ও অর্থসহ নিম্নরূপ:

ইঞ্জিল

ইঞ্জিল শব্দটির ইংরেজি রূপ ইভানজেল (evangel)। evangel শব্দটি মূলত প্রাচীন গ্রীক (euaggelion/euaggelos) থেকে গৃহীত। এর অর্থ সুসংবাদ। ইংরেজিতে একে গসপেল (gospel)-ও বলা হয়। প্রচলিত ইঞ্জিলে(প্রচলিত বাইবেলের দ্বিতীয় অংশ “নতুন নিয়ম” (the New Testament)) মোট ২৭টি পুস্তক বিদ্যমান রয়েছে।

বাইবেল কি? ও তাওরাত ইঞ্জিলের সাথে এর সম্পর্ক কি?

বাইবেল শব্দটি মূলত কইনি গ্রীক τὰ βιβλία, tà biblía, শব্দ থেকে উদগত হয়েছে। τὰ βιβλία, tà biblía,  অর্থ বইগুলো।  বাইবেল অর্থাৎ ধর্ম শাস্ত্র, লিপি বা পুস্তক  স্রষ্টা বাক্য। উইকিপিডিয়া

অন্য একটি সূত্র বলছে, বাইবেল শব্দটির অর্থ ‘পুস্তক’। ভূমধ্যসাগরের উপকুলে বর্তমান বৈরুতের নিকটবর্তী প্রাচীন ফনিশিয়া (Phoenicia) রাজ্যের একটি শহরের নাম ছিল ‘বিবলস’ (Byblos)। এ শহর থেকেই প্রাচীন ‘কাগজ’ প্যাপিরাস (papyrus) আমদানী করত গ্রীকগণ। এজন্য প্যাপিরাস বা কাগজকে এবং প্যাপিরাস বাণ্ডিল (papyrus scroll)- কে গ্রীক ভাষায় বিবলস (Byblos/biblos) বলা হতো। আর কাগজে লেখা ছোট পুস্তককে বলা হতো বিবলিয়ন(biblion=small book)। মাইক্রোসফট এনকার্টা বিশ্বকোষের ‘বাইবেল’ আর্টিকেলে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: “বাইবেল শব্দটি ল্যাটিন ভাষার মাধ্যমে গ্রীক ‘বিবলিয়া’ বা ‘পস্তকসমূহ’ থেকে আগত। এটি মূলত ‘বিবলস’ শব্দ থেকে গৃহীত। বিবলস অর্থ ছিল প্যাপিরাস বা কাগজ, যা প্রাচীন ফনিসিয়ান বন্দর নগরী ‘বিবলস’ থেকে আমদানী করা হতো। মধ্য যুগ পর্যন্ত এসে বাইবেলের পুস্তকগুলোকে একীভূত অস্তিত্ব হিসেবে গণ্য করা হতো।”

গ্রন্থটি মূলত হিব্রু ভাষায় রচিত ও প্রচারিত। অনেক শতাব্দী পরে গ্রন্থটিকে গ্রীক ভাষায় অনুবাদ করা হয়।

বাইবেল নাম থেকে প্রতীয়মান হয়, এতে মূল তাওরাত ও ইঞ্জিল অবিকৃত নেই। নতুবা আল্লাহ প্রদত্ত নাম পরিবর্তন করে তাকে কেন বাইবেল নামে অভিহিত করা হবে?

ইহূদী স্বীকৃত বাইবেল মূলত তিন অংশে বিভক্ত: (১) তাওরাত (The Law), (২) নাবিয়্যীম: নবীগণের পুস্তক (the Prophets) এবং (৩) কিতুবীম: লিখনিসমূহ (the Writings)। গীতসংহিতা পুস্তকটি তৃতীয় অংশের মধ্যে বিদ্যমান। তাওরাতের ‘তা’, ‘নাবিয়ীমের’ ‘না’ ও ‘কিতুবিম’ ‘ক’ নিয়ে একত্রে বাইবেলের পুরাতন নিয়মের ইহূদী সংস্করণকে ইহূদীরা ‘তানাক’ বলেন।

খৃস্টীয় বাইবেলের পুরাতন নিয়মের মূল ভিত্তি ইহূদী বাইবেলের ‘গ্রীক অনুবাদ বা গ্রীক সংস্করণের উপর। ইহূদী বাইবেলের গ্রীক সংস্করণকে সেপ্টুআজিন্ট বা সত্তরের কর্ম বলা হয়।

ইহূদীগণের ধর্মীয় ও ব্যবহারিক ভাষা হিব্র“ ভাষা। পুরাতন নিয়মের গ্রন্থগুলো হিব্র“ ভাষায় লিখিত ছিল। খৃস্টপূর্ব ৩৩২ সালে আলেকজান্ডার প্যালেস্টাইন দখল করেন এবং তা গ্রীক সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। ইহূদীগণ গ্রীক নাগরিকে পরিণত হয় এবং তাদের মধ্যে গ্রীক ভাষার কিছু প্রচলন ক্রমান্বয়ে শুরু হয়। প্রায় এক শতাব্দী পরে, খৃস্টপূর্ব ২৮৫-২৪৫ সালের দিকে বাইবেলের পুরাতন নিয়ম নামে পরিচিত ইহূদী ধর্মগ্রন্থগুলি গ্রীক ভাষায় অনুবাদ করা হয়। কথিত আছে যে, মিসরের শাসক ২য় টলেমি: টলেমি ফিলাডেলফাস (Ptolemy Philadelphus)- এর রাজত্বকালে (খৃ. পূ. ২৮৫-২৪৬) তাঁর নিদের্শে নির্দেশে ৭০/৭২ জন পণ্ডিত তা ‘আলেকজেন্ড্রীয় গ্রীক ভাষায়’ অনুবাদ করেন। এই গ্রীক অনুবাদটিই the Septuagint (LXX) বা ‘সত্তরের’ অনুবাদ বলে প্রসিদ্ধ। একে গ্রীক পুরাতন নিয়মও (Greek Old Testament) বলা হয়। যীশুখৃস্টের সময়ে এ অনুবাদটি প্রচলিত ছিল।

পঞ্চম খৃস্টীয় শতকের শেষ দিক থেকে ইহূদীগণ গ্রীক পাণ্ডুলিপি পরিত্যাগ করে হিব্রু পাণ্ডুলিপির দিকে ঝুকে পড়েন।

সারকথা প্রচলিত বাইবেল গ্রন্থটি ৬৬টি পুস্তক বা অধ্যায়ের একটি সংকলন। এ সংকলনটি দুটি প্রধান পর্বে বিভক্ত। ১। ৩৯টি পুস্তক সম্বলিত পুরাতন নিয়ম বা ওল্ড টেস্টামেন্ট । ২। ২৭টি পুস্তক সম্বলিত নতুন নিয়ম বা নিউ টেস্টামেন্ট। পুরাতন নিয়ম মূলত হিব্রু ভাষায় লিখিত। তবে দানিয়েল ও ইষ্রা পুস্তক দুটির কিছু অংশ আরামীয় ভাষায় লিখিত। নতুন নিয়ম গ্রিক ভাষায় রচিত। ওল্ড টেস্টামেন্টের কিছু অংশ গ্রিক ও ল্যাটিন অনুবাদে পাওয়া যায়।  কিন্তু মূল হিব্রু ভাষার তাওরাত নেই। ইয়াহুদীরা খ্রিস্টানদের নিউ টেস্টামেন্টকে স্বীকার করে না। তদ্রূপ তারা ঈসা আ.কেও স্বীকার করে না। তবে খ্রিস্টানরা ওল্ড টেস্টামেন্টকে স্বীকার করে। এবং মুসা আ.কেও তারা স্বীকার করে। তাই তো তারা তাদের দাবি কৃত তাওরাত ও ইঞ্জিলকে একত্রিত করে বাইবেলে রূপ দিয়েছে।

প্রচলিত বাইবেলের আলোক যাবীহুল্লাহ ও বাস্তবতা

প্রচলিত বাইবেলের আদিপুস্তকের ২২ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, “১। এই সকল ঘটনার পরে ঈশ্বর অব্রাহামের পরীক্ষা করিলেন। তিনি তাঁহাকে কহিলেন, হে অব্রাহাম; তিনি উত্তর করিলেন, দেখুন, এই আমি। ২। তখন তিনি কহিলেন, তুমি আপন পুত্রকে, তোমার অদ্বিতীয় পুত্রকে, (কোনো কোনো আরবী বাইবেলে: তোমার প্রথমজাত পুত্রকে) (thine only son) যাহাকে তুমি ভালবাস, সেই ইস্হাককে লইয়া মোরিয়া দেশে যাও, এবং … তাহার উপরে তাহাকে হোমার্থে বলিদান কর। … ১২। … যুবকের প্রতি তোমার হস্ত বিস্তার করিও না, উহার প্রতি কিছুই করিও না, কেননা এখন আমি বুঝিলাম, তুমি ঈশ্বরকে ভয় কর, আমাকে আপনার অদ্বিতীয় পুত্র দিতেও অসম্মত নও।… ১৬। তুমি এই কার্য করিলে, আমাকে আপনার অদ্বিতীয় পুত্র দিতে অসম্মত হইলে না, এই হেতু আমি আমারই দিব্য করিয়া কহিতেছি, ১৭ আমি অবশ্য তোমাকে আশীর্বাদ করিব…।”

বাইবেলের বক্তব্যে একাধিক বার বেশ গুরুত্বের সাথে ‘অদ্বিতীয় পুত্র’ কথাটি উঠে এসেছে। এবং সে অদ্বিতীয় পুত্র কে সে কথায়ও বলা হয়েছে অদ্বিতীয় পুত্র হলো ইসহাক। অথচ বাইবেল কুরআন ও ইতিহাস সাক্ষী ইসহাক আ. ইবরাহীম আ. এর অদ্বিতীয় পুত্র ছিলো না। বরং ইসহাক জন্ম থেকেই দ্বিতীয় পুত্র ছিলেন। আর ইসহাক আ. এর জন্মগ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত  ইসমাইল আ.ই ছিলেন ইবরাহীম আ. এর একমাত্র ও অদ্বিতীয় পুত্র। এবার আমরা বাইবেলের বক্তব্যের নিরিখে দেখতে চেষ্টা করবো অদ্বিতীয় পুত্র কে ছিলেন?

বাইবেলের আলোকে অদ্বিতীয় পুত্র

আদিপুস্তকের ১৬ অধ্যায়ে ইসমাঈল আ. এর জন্ম-বিবরণে বলা হয়েছে: “১। অব্রামের স্ত্রী সারী নিঃসন্তানা ছিলেন, এবং হাগার নামে তাঁহার এক মিসরীয়া দাসী ছিল। … ৩। এইরূপে কনান দেশে অব্রাম দশ বৎসর বাস করিলে পর অব্রামের স্ত্রী সারী আপন দাসী মিসরীয়া হাগারকে লইয়া আপন স্বামী অব্রামের সহিত বিবাহ দিলেন। … ১৫। পরে হাগার অব্রামের নিমিত্তে পুত্র প্রসব করিল; আর অব্রাম হাগারের গর্ভজাত আপনার সেই পুত্রের নাম ইশ্মায়েল রাখিলেন। ১৬ অব্রামের ছিয়াশি বৎসর বয়সে হাগার অব্রামের নিমিত্তে ইশ্মায়েলকে প্রসব করিল।”

অন্যদিকে আদিপুস্তকের ১৭ অধ্যায়ে ইসহাকের জন্ম বিবরণে বলা হয়েছে: “১। অব্রামের নিরানব্বই বৎসর বয়সে সদাপ্রভু তাঁহাকে দর্শন দিলেন ….  ১৫। আর ঈশ্বর অব্রাহামকে কহিলেন, তুমি তোমার স্ত্রী সারীকে আর সারী বলিয়া ডাকিও না; তাহার নাম সারা [রাণী] হইল। ১৬। আর আমি তাহাকে আশীর্বাদ করিব, এবং তাহা হইতে এক পুত্রও তোমাকে দিব;… অব্রাহাম ঈশ্বরকে কহিলেন, ইশ্মায়েলই তোমার গোচরে বাঁচিয়া থাকুক (O that Ishmael might live before thee!) ১৯ তখন ঈশ্বর কহিলেন, তোমার স্ত্রী সারা অবশ্য তোমার নিমিত্তে পুত্র প্রসব করিবে, এবং তুমি তাহার নাম ইস্হাক [হাস্য] রাখিবে।… ২০। আর ইশ্মায়েলের বিষয়েও তোমার প্রার্থনা শুনিলাম; দেখ, আমি তাহাকে আশীর্বাদ করিলাম, এবং তাহাকে ফলবান করিয়া তাহার অতিশয় বংশবৃদ্ধি করিব; তাহা হইতে দ্বাদশ রাজা উৎপন্ন হইবে, ও আমি তাহাকে বড় জাতি করিব। …..”

এরপর ২১ অধ্যায়ে বলা হয়েছে : “… ৫। অব্রাহামের এক শত বৎসর বয়সে তাঁহার পুত্র ইস্হাকের জন্ম হয়।

এরপর ২৫ অধ্যায়ে বলা হয়েছে: “৮। পরে অব্রাহাম বৃদ্ধ ও পূর্ণায়ূ হইয়া শুভ বৃদ্ধাবস্থায় প্রাণত্যাগ করিয়া আপন লোকদের নিকটে সংগৃহীত হইলেন। ৯। আর তাঁহার পুত্র ইস্হাক ও ইশ্মায়েল মম্রির সম্মুখে হেতীয় সোহরের পুত্র ইফ্রোণের ক্ষেত্রস্থিত মক্পেলা গুহাতে তাঁহার কবর দিলেন।”

বাইবেলের উপরোক্ত উদ্ধৃতি থেকে জানা যাচ্ছে, ইবরাহীম আ. প্রথম পুত্র ইসমাঈল আ. ছিলেন। ইসমাঈল আ. এর বয়স চৌদ্দ বছর হলে দ্বিতীয় পুত্র ইসহাকের জন্ম হয়। ইসমাঈল আ. ১৪ বছর পর্যন্ত ইবরাহীম আ. এর একমাত্র ও অদ্বিতীয় পুত্র ছিলেন। আর ইসহাক আ. দ্বিতীয় পুত্র হয়েই জন্মগ্রহণ করেন। ইসহাক আ. এর জন্মের পূর্বে ইসমাঈল আ. ইবরাহীম আ. এর প্রিয়তম পুত্র ছিলেন। তাঁর জন্য তিনি দুআ করতেন। ইসমাঈল আ.কে দূর মরুবাসে পাঠালেও ইবরাহীম আ. এর সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হয় নি। তার বড় প্রমাণ , পিতার মৃত্যুর সময়ে তিনি উপস্থিত ছিলেন এবং ছোট ভাই ইসহাক আ. এর সাথে একত্রে তাঁকে দাফন করেন। সুতরাং বাইবেলের আদিপুস্তকের ২২ অধ্যায়ের বক্তব্যে যে ইসহাক আ.কে অদ্বিতীয় পুত্র বলা হয়েছে তা চরম মাত্রার প্রমাদপূর্ণ ও বিকৃতি। বস্তুত ওখানের পূর্ণ বক্তব্যই যথাস্থানে সঠিক ছিলো। কিন্তু ইয়াহুদী-খ্রিস্টানরা ইসহাক এর নামটি নিজেদের পক্ষ থেকে সংযুক্ত করে দিয়েছে। এ কারণেই এত বড় একটি সংঘর্ষ তৈরি হয়েছে। কারণ ইসমাঈল আ. ছিলেন ইবরাহীম আ. এর প্রথমজাত, একমাত্র ও অদ্বিতীয় সন্তান। এ একমাত্র পুত্র ইসমাইল আ.কেই তিনি কুরবানি করতে নিয়েছিলেন। কিন্তু ইসমাঈল আরব জাতির পিতা। পক্ষান্তরে, ইসহাক ইহূদী জাতির পিতা। একারণে ইহূদীগণ এখানে ইসমাঈল আ. এর নামের পরিবর্তে ইসহাক আ. এর নাম সংযোজন করে দেয়। প্রাচীনকাল থেকেই ইহূদীগণ এবং এরপর খৃস্টানগণ নিজেদের মানসিকতার বিপরীত অনেক বিষয় বাইবেল থেকে মুছে দিয়েছে, অথবা নিজেদের মত প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক বিষয় সংযোজন করেছে। সারকথা, তারা তাদের ধর্মের স্বার্থে নানা রকম বিকৃতি সাধন করেছে। এ পর্যায়ে আমরা দেখতে চেষ্টা করবো বাইবেলে এ ধরনের বিকৃতি ও সংযোজন বিয়োজন সম্ভব কি না?

ইয়াহুদী-খ্রিস্টানদের কিতাব বিকৃতি

পবিত্র কুরআনে একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে,  আল্লাহ মূসা (আ.)এর উপর তাওরাত, দায়ূদ (আ.)এর উপর যাবূর এবং ঈসা (আ.)এর উপর ইঞ্জিল অবতীর্ণ করেন। পবিত্র এ গ্রন্থগুলোর মধ্যে ছিল হেদায়াতের নূর ও বরকতময় বিধিবিধান। কিন্তু এ সকল গ্রন্থের অনুসারীরা সেসবের মাঝে বিকৃতি সাধন করে। পবিত্র কুরআন তিন প্রকারের বিকৃতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, (১) ভুলে যাওয়া, (২) বিকৃত করা ও (৩) জাল কথা সংযোজন করা। এরূপ বিকৃতিসহ “তাওরাত”, “যাবূর” ও “ইঞ্জিল” নামে গ্রন্থগুলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে বিদ্যমান ছিল। সাথে তাতে মূল ওহীর অনেক কিছু বিদ্যমান ছিল। কিন্তু ইয়াহুদী-খ্রিস্টানরা নানাভাবে তাওরাত-ইঞ্জিলে বিকৃতি সাধন করেছে। এটি একটি স্বতঃসিদ্ধ স্বীকৃত ও প্রমাণিত বিষয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন,

১। ইয়াহুদীদের মাঝে যারা অসত্য শ্রবণে ততপর, তোমাদের নিকট আসে না এমন এক ভিন্ন দলের পক্ষে যারা কান পেতে থাকে। শব্দগুলো সুবিন্যস্ত থাকার পরও তারা সেগুলোর অর্থ বিকৃত করে। সূরা মায়িদা ৪১

২। তারা শব্দগুলোর আসল অর্থ বিকৃত করে এবং তারা যা উপদিষ্ট ছিলো তার এক অংশ ভুলে গিয়েছে। সূরা মায়িদা ১৩

৩। ইয়াহুদীদের মধ্যে কতক লোক কথাগুলো স্থানচ্যুত করে বিকৃত করে। সূরা নিসা ৪৬


হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হে মুসলিম সমাজ! কি করে তোমরা আহলে কিতাবদের নিকট জিজ্ঞাসা করো? অথচ আল্লাহ তাঁর নবীর উপর যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, তা আল্লাহ সম্পর্কিত নবতর তথ্য সম্বলিত। এটা তোমরা তিলাওয়াত করছ এবং এর মধ্যে মিথ্যার কোন সংমিশ্রণ নেই। তদুপরি আল্লাহ তোমাদের জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি যা লিখে দিয়েছেন আহলে কিতাবরা তা পরিবর্তন করে ফেলেছে এবং নিজ হাতে সেই কিতাবের বিকৃতি সাধন করে তুচ্ছ মূল্য পাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রচার করেছে যে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকেই অবতীর্ণ। তোমাদেরকে প্রদত্ত মহাজ্ঞান কি তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করার ব্যাপারে তোমাদের বাধা দিয়ে রাখতে পারে না? আল্লাহর শপথ! তাদের একজনকেও আমি কখনো তোমাদের উপর যা নাযিল হয়েছে সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে দেখিনি। সহীহ বুখারী, হাদীস ২৬৮৫

মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ আবু শাহবাহ রহ. বলেন বিশদ বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধানের পর আমাদের নিকট সুস্পষ্ট ও বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত যে যাবীহুল্লাহ ইসমাইল আ. ছিলেন। যাবীহুল্লাহ ইসহাক আ. হওয়ার ব্যাপারে যেসব মারফু হাদীস বর্ণিত হয়েছে সেগুলো হয় বানোয়াট নয়তোবা এমন যয়ীফ যদ্দ্বারা প্রমাণ পেশ করা বিশুদ্ধ নয়। আর এ বিষয় সাহাবা তাবিয়ী থেকে যেসব বর্ণনা পাওয়া যায় সেগুলোর সনদ ও সূত্রপীঠিকা যদি সহীহ হয়ে থাকে তবে সেগুলো ওই সব ইসরাইলী বর্ণনার অন্তর্গত যেগুলো ওই সকল আহলে কিতাবগণ বর্ণনা করেছেন যারা মুসলমান হয়েছিলেন। সেগুলো মূলত ইয়াহুদীদের বিকৃতি ও মিথ্যচার। তারা আল্লাহর সুস্পষ্ট বাণীকে বিকৃত করেছে আরব ও আরব জাতির প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে। ইয়াহুদীদের যাবীহুল্লাহ বিষয়ক বিকৃতি কতক বড় বড় আলেমকেও গ্রাস করেছে। যেমন ইবনে জারীর, কাযী ইয়াজ ও সুহাইলী প্রমুখ উলামায়ে কেরাম। তারা মনে করেন যাবীহুল্লাহ হলো ইসহাক আ.। তাদের কতক বিভিন্ন বর্ণনার কারণে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। ফলে তারা কে যাবীহুল্লাহ এ প্রশ্নের উত্তরে নীরবতা অবলম্বন করেছেন। যেমন ইমাম সুয়ূতী রহ.। আবার কোনো কোনো আলেম দুই বক্তব্যের মাঝে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করে বলেছেন, কুরবানী পরীক্ষা মূলত দুই বার সংঘটিত হয়েছে। সত্য সেটাই যেটা আমরা পরিষ্কার করেছি। সুতরাং সত্য অতিক্রম করো না, নীরবতা অবলম্বন করো না এবং কুরবানী পরীক্ষাকে দ্বিত্ব করো না। একমাত্র আল্লাহই সত্য পথ প্রদর্শনকারী। আলইসরাইলিয়্যাত ওয়াল মাওযুআত ফি কুতুবিততাফসীর ১/৩৩০

ইয়াহুদীদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদের তথ্য বিকৃতির অভিযোগ

বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টের লেখকগণ দাবি করেন, ওল্ড টেস্টামেন্টে ঈসা আ. এর ব্যাপারে কিছু ভবিষ্যত বাণী ছিলো। বর্তমান বাইবেলে সে বাণীগুলো নেই। ইয়াহুদীরা ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে সেগুলোকে মুছে দিয়েছে। যেমন প্রচলিত বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টের প্রথম পুস্তক মথি লিখিত সুসমাচারের ২য় অধ্যায়ের ২৩ শ্লোকে রয়েছে, “এবং নাসরৎ নামক নগরে গিয়া বসতি করিলেন; যেন ভাববাদিগণের দ্বারা কথিত এই বচন পূর্ণ হয় যে, তিনি নসরতীয় বলিয়া আখ্যাত হইবেন।‘ খ্রিস্টানদের দাবি মতে এ কথাগুলো পুরাতন নিয়মে ছিলো। কিন্তু ইয়াহুদীরা ষড়যন্ত্রমূলক এ বাণীগুলো পুরাতন নিয়ম থেকে মুছে দিয়েছে।

খ্রিস্টান কর্তৃক বাইবেলে বিয়োজন-বিকৃতি

মথি, মার্ক ও লূক লিখিত সুসমাচার মতে ঈসা আ. তার শিষ্যদের উদ্দেশে কিয়ামত সম্বন্ধে কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। মথির বর্ণনা মতে ঈসা আ. বলেন, ‘(৩৫) আকাশের ও পৃথিবীর লোপ হইবে, কিন্তু আমার বাক্যের লোপ কখনও হইবে না। (৩৬) কিন্তু সেই দিনের ও সেই দণ্ডের কথা কেহই জানে না, স্বর্গের দূতগণও জানেন না, কেবল পিতা জানেন।‘ (মথি ২৪/৩৪-৩৬)। এটা হলো মথি লিখিত সুসমাচারের অথোরাইজড ভার্শন বা কিং জেমস ভার্শনের তথ্য। আধুনিক গবেষণা বলছে, বেশ পরিকল্পনা করে এখান থেকে একটি বাক্য বাদ দেয়া হয়েছে। সে বাক্যটি হলো “পুত্রও জানেন না”। মথি লিখিত সুসমাচারের রিভাইজড স্টান্ডার্ড ভার্সন (RSV)-এ বাক্যটি যথাবস্থায় বিদ্যমান রয়েছে। মুছে দেয়া বাক্যাংশটুকু-সহ শ্লোকটির অর্থ দাঁড়ায়, “কিন্তু সেই দিনের বা সেই দণ্ডের তত্ত্ব কেহই জানে না, স্বর্গস্থ দূতগণও জানেন না, পুত্রও জানেন না, কেবল পিতা জানেন।” বাংলা কেরির বাইবেলে এরূপই আছে। এতে প্রমাণিত হয়, ঈসা আ. বা যিশু ঈশ্বর ছিলেন না। ফলে কিয়ামত কখন হবে সে বিষয়ে তিনি জানতেন না।

ঈসা আ.কে যারা ঈশ্বর বলে বিশ্বাস করে তাদের জন্য এ বক্তব্য ছিল চরম মাত্রার চপেটাঘাত। তাই অতি ধার্মিক ধূর্ত বাইবেল লেখকগণ এ বাক্যটিকে বাইবেল থেকে মুছে দিয়েছিলো।

খ্রিস্টান কর্তৃক বাইবেলে সংযোজন বিকৃতি

কিং জেমস ভার্সন বা অথোরাইজড ভার্সন অনুসারে বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টে যোহন লিখিত সুসমাচারের প্রথম পত্রের ৫ম অধ্যায়ের ৭-৮ শ্লোকে বলা হয়েছে, “(৭) কারণ স্বর্গে তিন জন রহিয়াছেন যাঁহারা সাক্ষ্য সংরক্ষণ করেন: পিতা, বাক্য ও পবিত্র আত্মা; এবং তাঁহারা তিন একই। ৮. এবং পৃথিবীতে তিন জন রহিয়াছেন যাঁহারা সাক্ষ্য প্রদান করেন: আত্মা, জল ও রক্ত, এবং সেই তিনের সাক্ষ্য একই।

গবেষণা বলছে এমনকি খৃস্টান পণ্ডিতগণও একমত যে, একথাগুলো ত্রিত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য মূল বাইবেলের মধ্যে সংযোজিত হয়েছে। এখানে মূল কথা ছিল “তিনজন সাক্ষী রয়েছেন: আত্মা, জল ও রক্ত, এবং এ তিনজনের সাক্ষ্য একই।” কিন্তু ত্রিত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য ধার্মিক বাইবেল লেখকগণ অতিরিক্ত কথাগুলো সংযোজন করে দিয়েছেন। বাইবেলের কোথাও ত্রিত্ববাদের কথা নেই। রিভাইজড স্টান্ডার্ড ভার্সনের মূল ভাষ্য নিম্নরূপ : There are three witnesses , the Spirit, the water and the blood; and these three agree.” বাংলা কেরির বাইবেলের অনুবাদ: “বস্তুত তিনে সাক্ষ্য দিতেছেন, আত্মা, ও জল, ও রক্ত, এবং সেই তিনের সাক্ষ্য একই।”  এখানে অতিরিক্ত অংশ নেই।

বাইবেলে এ জাতীয় সংযোজন বিয়োজন ও পরিবর্তন দৃষ্টান্ত অসংখ্য ও অগণিত। সুতরাং বাইবেলের বক্তব্যের উপর নির্ভর করে ইসহাক আ.কে কুরবানি দেওয়া হয়েছিল বলে দাবি করার কোনো উপায় নেই। ইসমাইল আ. ইসহাক আ. বিষয়ে তথ্যগত সাংঘর্ষিকতা সংযোজন বিকৃতির প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

সংযোজন বিকৃতির সমর্থনে খৃস্টানদের কুৎসিত অপব্যাখ্যা

পেছনে বাইবেলের বক্তব্য থেকেই দেখানো হয়েছে, ১৪ বছর পর্যন্ত ইসমাইল আ.ই ছিলেন ইবরাহীম আ. এর একমাত্র ও অদ্বিতীয় পুত্র। আর ইসহাক আ. জন্ম থেকেই ছিলেন দ্বিতীয় পুত্র। সুতরাং ইসহাক আ.কে একমাত্র, প্রথম জাত কিংবা অদ্বিতীয় চরম মাত্রার তথ্য বিকৃতি ও স্ববিরোধী বক্তব্য। স্ববিরোধী এ বক্তব্য থেকে স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয় যে ইয়াহুদীরা এখানে ইসহাক আ. এর নামটি সংযোজন করেছে। ইয়াহুদী খৃস্টানদের সামনে যখন এ বিকৃতিটি প্রমাণাকারে তুলে ধরা হয় তখন তারা এর হাস্যকর অপব্যাখ্যায় মেতে উঠে। তারা বলে, ইসমাইল মাত হাজেরা ছিলো দাসী। তাই ইসমাইল ছিলো ইবরাহীমের অবৈধ সন্তান! আল্লাহর আশ্রয় কামনা করছি। এ কারণেই তাকে বাদ দিয়ে ইসহাককে অদ্বিতীয় পুত্র বলা হয়েছে। কত বড় বুকের পাটা হলে একজন নবীকে অবৈধ সন্তান বলে আখ্যা দিতে পারে! এ জাতীয় বক্তব্য ইতিহাস ঘৃণিত ইয়াহুদী জাতির পক্ষেই সম্ভব। এতে করে পরোক্ষভাবে ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আ.কে ব্যভিচারী সাব্যস্ত করার দুঃসাহস দেখালো মহাকালের শ্রেষ্ঠ ধূর্ত ইয়াহুদী সম্প্রদায়। অথচ বাইবেলের আদিপুস্তকের ১৬ অধ্যায়ে বেশ পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে, …৩। এইরূপে কনান দেশে অব্রাম দশ বৎসর বাস করিলে পর অব্রামের স্ত্রী সারী আপন দাসী মিসরীয়া হাগারকে লইয়া আপন স্বামী অব্রামের সহিত বিবাহ দিলেন। এতে প্রকৃষ্টভাবে প্রমাণিত হয় হাজেরা আ. ইবরাহীম আ. এর শুধু দাসী ছিলেন না; বরং বৈধ স্ত্রীও ছিলেন। সুতরাং বৈধ স্ত্রীর গর্ভে কি করে অবৈধ সন্তানের জন্ম হয়। আর যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেয়া হয়, হাজেরা আ. ইবরাহীম আ. এর দাসী ছিলেন তবে প্রশ্ন হলো, নিজ মালিকানাধীন দাসীর গর্ভে কি করে অবৈধ সন্তানের জন্ম হয়? ইয়াহুদীরা শুধু ইসমাইল আ.কে অবৈধ সন্তান বলেই ক্ষান্ত হয় নি; বরং তারা নবী ও নবী পরিবারের প্রতি জঘন্য মিথ্যাচার পূর্ণ ব্যভিচারের আপবাদ আরোপ করেছে।

নবী ও নবী পরিবারের নামে ইয়াহুদী খ্রিস্টানদের ব্যভিচারের অপবাদ

বস্তুত ইয়াহুদী খ্রিস্টানগণ নবী-রাসূলদের ব্যাপারে নানা রকম কুৎসা রটাতে বেশ দক্ষ। নিজেদের মতবাদ প্রতিষ্ঠার স্বার্থে নবী-রাসূলগণকে ব্যভিচারী বলতে তাদের মোটেও দ্বিধা হয় না। নবী রাসূলকেন্দ্রিক অনেক ব্যভিচারের গল্প তাদের বাইবেল গ্রন্থে বিদ্যমান রয়েছে। নিম্নে কিছু দৃষ্টান্ত দেয়া হলো।

১। নবীর সাথে তার কন্যাগণের ব্যভিচার

বাইবেলের একটি অপবিত্র কাহিনীতে বলা হয়েছে, রাতের পর রাত লূত আ. এর দুই কন্যা তাদের পিতাকে মদ পান করিয়ে মাতাল বানিয়ে তার সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। সে ব্যভিচার থেকে তারা গর্ভবতী হয়। মাআযাল্লাহ। আদিপুস্তক: ১৯: ৩৩-৩৮

২। নবী-পত্নীর সাথে নবী-পুত্রের ব্যভিচার

বাইবেলের একটি অপবিত্র কাহিনীতে বলা হয়েছে, ইয়াকুব আ. এর বড় ছেলে রুবেন তার সৎ-মায়ের (বিলহার) সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। মাআযাল্লাহ। আদিপুস্তক: ৩৫: ২২

৩। পুত্রবধুর সাথে নবী-পুত্রের ব্যভিচার

বাইবেলের আরেকটি অবপিত্র কাহিনীতে বলা হয়েছে, নবী-পুত্র ইয়াহূদা তার আপন পুত্রবধুর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হন। সেই ব্যভিচারের ফলে উক্ত পুত্রবধু গর্ভধারণ করেন এবং পেরস ও সেরহ নামে দুটি জমজ জারজ সন্তান প্রসব করেন। মাআযাল্লাহ। আদিপুস্তক: ৩৮: ১৫-১৮, ২৭-৩০)

বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ইহূদী-খৃস্টানদের প্রাণপুরুষ ও সকল গৌরবের উৎস দাউদ, সুলাইমান ও যীশুখৃস্ট এ জারজ সন্তান (?) পেরসের বংশধর। মথি লিখিত সুসমাচার: ১: ১-৩

৪। দাউদ আ. কর্তৃক প্রতিবেশীর স্ত্রীকে ধর্ষণ

দাউদ আ.-কে কথিত তাওরাতে ব্যভিচারী ও ধর্ষক বলে চিত্রিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, উরিয়া নামে দাউদের এক প্রতিবেশী ছিলো। তিনি যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধরত ছিলেন। দাউদ আ. উরিয়ার স্ত্রীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে নিজ বাড়িতে ডেকে এনে ধর্ষণ করেন। উরিয়ার স্ত্রী এ ধর্ষণে গর্ভবতী হয়ে যায়। দাউদ আ. সেনাপতিকে চিঠি লিখে কৌশলে উরিয়াকে হত্যা করান এবং তার স্ত্রীকে বিবাহ করেন। প্রচলিত তাওরাতের ২ শমূয়েল পর্ব : ১১: ১৪: ১৭

৫। নবী-পুত্র কর্তৃক বোনকে ধর্ষণ

প্রচলিত জাল তাওরাতের আরেকটি কাহিনীতে বলা হয়েছে, দাউদ আ. এর পুত্র অম্মোন  কৌশলে তার ভগ্নি তামরকে ধর্ষণ করে। সে অসুস্থতার ভান করে শুয়ে থাকে এবং দাউদ আ. কে বলে যে, আমি আমার বোন তামরের হাতে পিঠা খেতে চাই। তামর তাকে পিঠা খাওয়াতে আসলে সে জোরপূর্বক তাকে ধর্ষণ করে। নোংরা কাহিনীটির সূত্র প্রচলিত তাওরাতের ২ শমূয়েল পর্ব, ১৩: ১১-১৪

নবী-রাসূলদের নামে এ ধরনের অশ্লীল গল্প ইয়াহুদী খ্রিস্টানদের বাইবেলে আরো অনেক রয়েছে।  যারা এসব অশ্লীলতাকে পরম সত্য বলে বিশ্বাস করে তাদের জন্য ইসমাইল আ.কে অবৈধ সন্তান বলা  এবং পরোক্ষভাবে ইবরাহীম আ.কে ব্যভিচারী সাব্যস্ত করা বিচিত্র কিছু নয়। তারা তাদের অসত্য দাবি প্রমাণে সবকিছু্ই করতে পারে।

তবে বনী ইসরাইলের প্রায় অর্ধেকই তো দাসী সন্তান!

বনী ইসরাইল সম্প্রদায়ের প্রায় অর্ধেকই হলো দাসীর সন্তান। দাসীর সন্তান হওয়ার কারণে যদি পুত্রত্বের মর্যাদা বিলুপ্ত হয় তবে বনী ইসরাইল সম্প্রদায়ের বিশাল একটা অংশ বনী ইসরাইল সম্প্রদায়ভুক্ত হবে না। কারণ বনী ইসরাইল সম্প্রদায়ের মূল পুরুষ ইয়াকুব আ.। তাকে ইসরাইলও বলা হয়। ইয়াকু আ. এর দ্বিতীয় এ নামেই বনী ইসরাইল সম্প্রদায়ের নামকরণ হয়েছে। ইয়াকুব আ. এর দুজন স্ত্রী ছিলেন। তাঁরা হলেন যথাক্রমে লেয়া (Leah) ও রাহেল (Rachel)। এ দু স্ত্রীর সিল্পা (Zilpah) ও বিলহা (Bilhah) নামে দুজন দাসী ছিলো। এ দু দাসীকে ইয়াকু আ. স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। ইয়াকুব আ. ১২ জন সন্তানের মধ্য হতে চার জন সন্তানই এ দু দাসীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছে। অথচ দাসী পুত্র হওয়ার কারণে এ চার সন্তানকে কখনো পুত্রত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় নি এবং এ কারণে তাদেরকে অবমূল্যায়ন করা হয় নি। বিস্তারিত, প্রচলিত তাওরাতের আদিপুস্তক পর্বের ২৯ ও ৩০ অধ্যায়

অন্যদিকে বাইবেলের বর্ণনা মতে ইয়াকুব আ. এর পুত্র ইয়াহুদা তার আপন পুত্রবধুর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার কারণে পেরস ও সেরহ নামে দুটি জারজ সন্তানের জন্ম হয়। আর জারজ সন্তান পেরস এরই বংশধর হলেন ইয়াহুদী খ্রিস্টানদের প্রাণপুরুষ দাউদ, সুলাইমান ও ঈসা আ.। আদিপুস্তক: ৩৮: ১৫-১৮, ২৭-৩০, মথি লিখিত সুসমাচার: ১: ১-৩

জারজ (?) সন্তানের বংশধর হওয়ায় দাউদ, সুলাইমান ও ঈসা আ. এর কিছুই হলো না। কিন্তু বৈধ ও বিবাহিত দাসী পুত্র হওয়ার কারণে ইসমাইল আ. এর পুত্রত্বই বিলুপ্ত হয়ে গেলো! কি রকম অদ্ভূতুড়ে কথা!! অথচ ইবরাহীম আ. তাকে সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাকে ভালো বেসেছেন। তার জন্য দুয়া করেছেন। পুত্রত্বের স্বীকৃতি নিয়েই ইসমাইল আ. পিতার মৃত্যু হলে পিতার দাফন কার্যে অংশগ্রহণ করেন। এসব তথ্য বাইবেলেই লক্ষ করা যায়। এমনকি বাইবেলের তথ্য থেকেই জানা যায় ইসহাকের জন্মে ইবরাহীম আ. এর তেমন আগ্রহ ছিলো না। আর বাইবেলে এ কথাও বলা হয়েছে, ১৯ তখন ঈশ্বর কহিলেন,… ২০। আর ইশ্মায়েলের বিষয়েও তোমার প্রার্থনা শুনিলাম; দেখ, আমি তাহাকে আশীর্বাদ করিলাম, এবং তাহাকে ফলবান করিয়া তাহার অতিশয় বংশবৃদ্ধি করিব; তাহা হইতে দ্বাদশ রাজা উৎপন্ন হইবে, ও আমি তাহাকে বড় জাতি করিব। …..” দ্রষ্টব্য আদিপুস্তক, অধ্যায় ১৭। পবিত্র কুরআনের ছয় জায়গায় ইসমাইল এবং ইসহাক আ. এর আলোচনা পাশাপাশি এসেছে। সে জায়গাগুলোতে প্রথমে ইসমাইল আ. এর নাম এসেছে। এরপর ইসহাক আ. এর নাম এসেছে। জায়গাগুলো নিম্নরূপ : সূরা ইবরাহীম ৩৯, সূরা বাকারা ১৩৩, সূরা বাকারা ১৩৬, সূরা বাকারা ১৪০, সূরা আলু ইমরান ৮৪, সূরা নিসা ১৬৩। এ আয়াতগুলোতে মানগত দিক থেকে যে ইসমাইল আ. উচ্চ আসনে সমাসীন সে দিকে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত রয়েছে। কথা হলো, অবৈধ সন্তানের প্রতি পিতা ও ঈশ্বরের কেন এতো আদর সোহাগ তৈরি হলো?

শিশুপুত্র ইসমাইল আ.কে মরুবাসে পাঠানোও ছিলো ইবরাহীম আ. এর জন্য এক মহা পরীক্ষা

বস্তুত আল্লাহ তাআলা একমাত্র ও অদ্বিতীয় শিশুপুত্রকে মরুবাসে পাঠিয়ে ইবরাহীম আ.কে প্রথম পরীক্ষাটি করেন। অথচ প্রচলিত তাওরাতের এক বিকৃত বর্ণনায় বলা হয়েছে, ইসহাক আ. এর জন্মের পর ইসমাইল আ.কে মরুবাসে পাঠানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে,…. তার মানে ইসমাইল আ.কে ১৪/১৫ বছর বয়সে মরুবাসে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তাওরাতের অন্য বর্ণনা এ বক্তব্যকে চরমভাবে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করছে, ইসহাক আ. এর জন্মের বহু আগে অতি শৈশবে মাতৃক্রোড়ে থাকার বয়সে ইসমাইল আ.কে মরুবাসে পাঠানো হয়েছে। তাওরাতের আদিপুস্তকের ২১তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে, “১৪। পরে অব্রাহাম প্রত্যুষে উঠিয়া রুটি ও জলপূর্ণ কুপা লইয়া হাগারের স্কন্ধে দিয়া বালকটিকে সমর্পণ করিয়া তাহাকে বিদায় করিলেন। ১৫। পরে কুপার জল শেষ হইল, তাহাতে সে এক ঝোপের নিচে বালকটিকে ফেলিয়া রাখিল; ১৬ আর আপনি তাহার সম্মুখ হইতে অনেকটা দূরে, অনুমান এক তীর দূরে গিয়া বসিল, কারণ সে কহিল, বালকটির মৃত্যু আমি দেখিব না।…”

বর্ণনাটিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মরুবাসে পাঠানোর সময় ইসমাইল আ. হাঁটা চলার বয়সে ছিলেন না। বরং তিনি এতোটাই ছোটো ছিলেন যে হাজেরা আ. তাকে রুটি ও পানির সাথে কাঁধে তুলে নিতে পেরেছিলেন। গাছের নিচে রেখে মা কিছুটা দূরত্বে গিয়ে বসেছিলেন। কিন্তু দৌড়ে কিংবা হেঁটে যাওয়ার মত বড়ও তিনি হন নি। একমাত্র শিশুপুত্রকে মরুপ্রান্তরে রেখে আসাটা নিশ্চয়ই ইবরাহীম আ. এর জন্য মহাপরীক্ষা ছিলো। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর দ্বিতীয় পর্যায়ে আসে কুরবানী পরীক্ষা। দ্বিতীয় এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে ইবরাহীম আ. এর জীবন বদলে যায়। লাভ করেন দ্বিতীয় পুত্রের জন্ম ও তাঁর বংশধরদের সুসংবাদ।

যাবীহুল্লাহ বিষয়ে প্রচলিত কিছু হাদীস ও অভিমত

যাবীহুল্লাহ কে এ বিষয়ে দুটি অভিমত লক্ষ্য করা যায়। ইসমাই আ. এবং ইসহাক আ.। দুটি মতের পক্ষেই প্রচলিত কিছু হাদীসও লক্ষ্য করা যায়। সাথে লক্ষ্য করা যায় বড় বড় কতিপয় উলামায়ে কেরামের অভিমতও। যেসব হাদীস ও মতামতে ইসহাক আ.কে যাবীহুল্লাহ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইয়াহুদী খ্রিস্টানগণ তথা ইসহাক আ. যাবীহুল্লাহ হওয়ার পক্ষের প্রবক্তাগণ সেসব হাদীসকে বেশ জোরে শোরে প্রচার প্রসার করে থাকেন। যারা নিজেদের মত প্রতিষ্ঠার স্বার্থে মিথ্যাচার, বিকৃতি, অপব্যাখ্যাসহ নানা রকম ধূর্ততা ও কূটকৌশলের আশ্রয় নিতে পারে তাদের জন্য হাদীস নামের এসব অপাংক্তেয় বর্ণনা ও অগ্রহণীয় মতামত তো সোনায় সোহাগা। ফলে এসব বর্ণনা ও মতামতের ব্যাপারে তাদের বেশ আগ্রহ ও উদ্দীপনা দেখা যায়। তবে আমরা বেশ দৃঢ়তা ও শক্তিমত্তার সাথে একথাও ঘোষণা করছি, ইসমাইল আ. যাবীহুল্লাহ হওয়ার ব্যাপারে যেসব হাদীসের সন্ধান পাওয়া যায় সেগুলোও আমাদের বিশ্লেষণ মতে অগ্রহণযোগ্য ও অপাংক্তেয়। সুতরাং আমরা আমাদের মত প্রতিষ্ঠার স্বার্থে ইসহাক আ. যাবীহুল্লাহ সংক্রান্ত হাদীসের বর্ণনাগুলোকে অগ্রহণযোগ্য বলছি না। নিরপেক্ষতা ও সততার স্বার্থে এবং বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণের আলোকেই ওসব বর্ণনাকে অগ্রহণযোগ্য বলছি। ফলে আমাদের জন্য খুব সহজেই বলা সম্ভব হচ্ছে, ইসমাইল আ. যাবীহুল্লাহ বিষয়ক বর্ণনাগুলোও অগ্রহণযোগ্য। নিম্নে ইসমাইল যাবীহুল্লাহ ও ইসহাক যাবীহুল্লাহ বিষয়ক দু ধরনের কিছু হাদীস বিশ্লেষণসহ উল্লেখ করা হলো।

ইসমাইল আ. যাবীহুল্লাহ বিষয়ক হাদীস

১। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বক্তব্য হিসেবে বহুল প্রচলিত আমি দুই যাবীহের পুত্র।

ইমাম ইরাকী রহ. এ হাদীস সম্বন্ধে বলেন,  এ ব্যাপারে আমার জানা নেই। আব্দুর রউফ মুনাবী রহ. কৃত আলফাতহুস সামাবী বিতাখরীজি আহাদীসিল কাযী আলবাইযাবী  ৩/৯৫৫

ইমাম যাইলায়ী রহ. বলেন, হাদীসটি গারীব। তাখরীজু আহাদীসিল কাশশাফ লিযযাইলায়ী ৩/১৭৭

আল্লামা কাউকজী রহ. বলেন, আমি দুই যাবীহের পুত্র- এ শব্দে এটি বর্ণিত হয় নি। আললু’লুউল মারসু’ ১/৪৯

আমি দুই যাবীহের পুত্র- এমনটি হাদীসে বর্ণিত হয় নি। যেটা বর্ণিত হয়েছে সেটা হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ্য করে জনৈক আরাবীর বক্তব্য হে দুই যাবীহের সন্তান! আননুখবাতুল বাহিয়্যাহ ফিল আহাদীসিল মাকযুবাহ আলা খাইরিল বারিয়্যাহ লিল আমীর মালিকী ১/৪  

২। মুআবিয়া বিন আবি সুফইয়ান রা. থেকে বর্ণিত, একদা আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকটে উপস্থিত ছিলাম। ইত্যবসরে এক আরাবী এসে বললো, হে আল্লাহর রাসূল! এলাকা শুকিয়ে গেছে। পানিশূন্য হয়ে গেছে। সম্পদ নষ্ট হয়ে গেছে। পরিবারবর্গ ও নিঃশেষ হয়ে গেছে। সুতরাং আল্লাহ আপনাকে যা কিছু দান করেছেন তা থেকে আমাকে কিছু দেন হে দুই যাবীহ এর পুত্র! এতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেসে দিলেন। তাকে কিছু বললেন না। মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ৪০৩৬, ইমাম যাহাবী রহ. হাদীসটির সূত্র সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলন, হাদীসট ওয়াহীন

ইমাম ইবনে কাসীর রহ. বলেন, গারীবুন জিদ্দান তাফসীরুল কুরআনিল আযীম ৪/১৮

সতর্ক বার্তা!

আল্লামা আজলুনী রহ. কাশফুল খাফা কিতাবে যুরকানী রহ. এর শরহুল মাওয়াহিব এর সূত্রে বলেন, হাদীসটি হাসান। বরং একাধিক সূত্রের মাধ্যমে শক্তিশালী হওয়ার কারণে হাকেম ও যাহাবী রহ. হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। ১/১১৮। এখানে আল্লামা আজলুনী রহ. যে কথাটি বলেছেন, তা সঠিক নয়। কারণ যুরকানী রহ. উক্ত হাদীস সম্বন্ধে কোনো মন্তব্য করেন নি। বরং হাদীসটি হাসান বলে যে মন্তব্য করেছেন তা অন্য হাদীস সম্বন্ধে, সংশ্লিষ্ট এ হাদীস সম্বন্ধে নয়। আর মুস্তাদরাকে হাকেমে হাকেম রহ. হাদীসটিকে সহীহ বলেন নি; বরং তিনি এ হাদীসের ক্ষেত্রে নীরবতা অবলম্বন করেছেন। তদ্রূপ ইমাম যাহাবী রহ.ও সহীহ বলেন নি; বরং ইমাম যাহাবী রহ. বলেছেন, এর ইসনাদ ওয়াহিন। মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ৪০৩৬, সিলসিলাতুল আহাদীসিয যাঈফা ওয়াল মাউযুআহ লিল আলবানী রহ. ৪/১৭২

আলইসরাইলিয়্যাত ওয়া মাউযুআত গ্রন্থের লেখক আবু শাহবাহ রহ. ইমাম আজলুনী রহ. এর অনুসরণে উক্ত কথাগুলোই তার গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। অথচ তথ্যটি সঠিক নয়। আলইসরাইলিয়্যাত ওয়া মাউযুআত ১/৪২০

ইসহাক আ. যাবীহুল্লাহ বিষয়ক হাদীস

১। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যাবীহ হলো ইসহাক আ.। আতরাফুল গারায়িব ওয়াল আফরাদ লিদদারাকুতনী, মুহাম্মাদ ইবনে তাহির মাকদিসী, হাদীস ৩৮৭৭, মুসনাদুল বাযযার, হাদীস ১৩০৮, ইবনে আব্বাস রা. থেকে। ইমাম বাযযার রহ. বলেন অধিকাংশই ইবনে আব্বাস রা. থেকে মাওকুফ বর্ণনা করেছেন। আলবানী রহ. হাদীসটিকে মাওযু’ বলেছেন সহীহু ও যাইফুল জামিয়িস সাগীরে। হাদীস নাম্বার ৬৪০৪।

২। ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যে পাথর খণ্ডের উপর ইবরাহীম আ. ইসহাক আ.কে জবাই করেছিলো সে পাথরটি সাবির পর্বতের পাদদেশে বিদ্যমান রয়েছে। মুস্তাদরাকে হাকেম নাইসাবুরী, হাদীস ৪০৪৮

ইমাম হাকেম নাইসাবুরী রহ. বলেন, আমাদের পূর্ববর্তী মুহাদ্দিস এবং আমি যেসকল শহরে হাদীস অর্জন করেছি সেসব শহরের মুহাদ্দিসদের দেখেছি, তারা যাবীহুল্লাহ যে ইসমাইল আ. এ ব্যাপারে কোনো দ্বিতমত করতেন না। এ ব্যাপারে তাদের মূলসূত্র ছিলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বক্তব্য আমি দুই যাবীহ এর ছেলে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসমাইল আ. এর সন্তান ছিলেন। আর দ্বিতীয় যাবীহ হলো, তাঁর জন্মদাতা পিতা আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব। এখন এসব দলীল-প্রমাণ সংকলকদের দেখছি, তারা যারা ইসহাক আ.কে যাবীহুল্লাহ বলছে তাদের বক্তব্য গ্রহণ করছে। এসব বক্তব্যের মূলসূত্র হলো ওয়াহব ইবনে মুনাব্বিহ এর বর্ণনা। মুস্তাদরাকে হাকেম, ৪০৪৮ নম্বর হাদীসের অধীনে কৃত আলোচনা।

বস্তুত ইবনে আব্বাস রা. থেকে ইসমাইল আ. যবীহুল্লাহ বিষয়কও একাধিক বর্ণনা রয়েছে। মুহাদ্দিসীনে কেরামের দৃষ্টিতে যাবীহুল্লাহ ইসমাইল বিষয়ক বর্ণনাগুলোই অধিক শুদ্ধ। ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত যাবীহুল্লাহ ইসমাইল বিষয়ক বর্ণনাগুলো নিম্নরূপ :

ক। ইবনে আব্বাস রা. বলেন, যাবীহুল্লাহ ইসমাইল আ. ছিলেন। ইয়াহুদীরা মনে করে যাবীহুল্লাহ ইসহাক আ. ছিলেন। ইয়াহুদীরা মিথ্যা বলেছে। তাফসীরুল কুরআনিল আযীম ৭/৩২

খ। ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ….অতঃপর মধ্য জামারায় এসে শয়তান ইবরাহীম আ.কে প্ররোচিত করতে লাগলো। ইবনে আব্বাস রা. বলেন, এরপর ইবরাহীম আ. তাকে কাত করে শুইয়ে দিলেন। তখন ইসমাইল আ. এর উপর সাদা জামা ছিলো।… মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৭০৭ এ বর্ণনাটির ইসনাদকে শায়েখ আহমাদ শাকের রাহ. সহীহ বলেছেন। কিন্তু ইবনে আব্বাস রা. থেকে যেহেতু ইসহাক যাবীহুল্লাহ বিষয়ক বর্ণনাও বর্ণিত হয়েছে তাই ইবনে আব্বাস রা. এর এ বর্ণনাকে গ্রহণ করতে পারছি না।

৩। আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাহল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, …..হে দাউদ! ইসহাক জবাইয়ের ক্ষেত্রে আমার জন্য নিজের জীবনেকে উৎসর্গ করেছে। আযযুআফাউল কাবীর লিল উকাইলী, আব্দুল মুমিন বিন আব্দুল্লা আবাসী, রাবী নম্বর ১০৬৭। উকাইলী রহ. বলেন, আব্দুল মুমিন বিন আব্দুল্লা আবাসী এর হাদীস মাহফুজ নয়। আবু হাতেম রাযী রহ. বলেছেন, এ ব্যক্তি মাজহুল।

ইমাম দুলাবী রহ.ও ভিন্ন একটি সূত্রে ইবনে আব্বাস রা. থেকে হাদীসটি মারফুআন বর্ণনা করেছেন। হাদীস নম্বর ৭৬৮। তবে এ সূত্রটি নিতান্তই ভিত্তিহীন। কারণ এর সূত্রে হাসান ইবনে দীনার নামে মিথ্যা দোষে দুষ্ট একজন রাবী আছেন। ইবনে হিব্বান রহ. বলেন, লোকটি মিথ্যা হাদীস বর্ণনা করতো। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল ও ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীন রহ. একে মিথ্যাবাদী বলে সাব্যস্ত করেছেন। আলবানী রহ. সিলসিলাতুল আহাদীসিয যাইফা ওয়াল মাউযুআহ এর ভিতরে এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। হাদীস নাম্বার ৫৮৯৬

৪। ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ….যখন ইবরাহীম তাঁর পুত্র ইসহাককে জবাই করার ইচ্ছা করলেন তখন পুত্র পিতাকে বললো…. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৭৯৫

আহমাদ শাকের রহ. বলেন, হাদীসটির ইসনাদ সহীহ। তবে ‘যখন ইবরাহীম তাঁর পুত্র ইসহাককে জবাই করার ইচ্ছা করলেন’ হাদীসের এ অংশটুকুকে আমরা আতা ইবনে সাইব রা. এর পক্ষ থেকে ভুল বলে মনে করি। করণ যাবীহ হলো ইসমাইল আ.। যেমন কুরআন সুন্নাহ এ ব্যাপারটি প্রমাণ করছে। হাদীসটি মাজমাউয যাওয়ায়েদেও এসেছে (৩/২৫৯-২৬০)। হাইসামী রহ. হাদীসটির ব্যাপারে বলেন, ইমাম আহমাদ রহ. হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। এর সূত্রে আতা ইবনুস সায়িব রয়েছে। তিনি শেষ বয়সে হাদীস বর্ণনায় জড়িয়ে ফেলতেন। ইমাম ইবনে কাসীর রহ.ও এ ব্যাপারটির দিকে ইঙ্গিত করেছেন (৭/১৪৯)। এবং বলেছেন, যাবীহ কে ছিলেন এ ব্যাপারে ইবনে আব্বাস রা. থেকে দুটি বর্ণনা রয়েছে। তাঁর পক্ষ থেকে বাস্তব স্পষ্ট বর্ণনা হলো যাবীহ ইসমাইল ছিলেন। আমরা বলি, এ বর্ণনাটি অকাট্যভাবে ভুল ও প্রমাদপূর্ণ। সুতরাং ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা একটিই; দুটি নয়। যেমন ২৭০৭ নম্বর হাদীসে রয়েছে। মুসনাদে আহমাদ বিতাকীকে আহমাদ শাকের, ৩/২৪২

আলবানী রহ. ইসহাক আ. যাবীহুল্লাহ বিষয়ক আরো চার পাঁচটা হাদীস উল্লেখ করে শাস্ত্রীয় আলোচনার মাধ্যমে দেখাতে চেষ্টা করেছেন এগুলো গ্রহণযোগ্য নয়। সিলসিলাতুল আহাদীসিয যাইফা ওয়াল মাউযুআহ, হাদীস নাম্বার ৩৩১-৩৩৭

সারকথা মুহাদ্দিসীনে কেরাম যাবীহুল্লাহ বিষয়ক সকল হাদীসকেই অপ্রমাণিত বলে আখ্যায়িত করেছেন। সুতরাং যাবীহুল্লাহ প্রমাণে হাদীসের আলোচনা প্রয়োজনীয় নয়।

বাইবেলীয় বক্তব্য ও অসঙ্গতি

ইয়াহুদী খ্রিস্টানগণ একমাত্র পুত্র কথাটির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, যেহেতু ইসমাইল আ. এর জন্ম দাসীর গর্ভে হয়েছে তাই ঐশ্বরিক আশির্বাদ একমাত্র ন্যায়সঙ্গত সন্তান ইসহাক আ.ই পাবেন। এভাবে একমাত্র পুত্র বলতে নাকি ইসহাক আ.কে বোঝানো হয়েছে। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট আদিপুস্তক তথা জেনেসিস ২২.২

বাইবেলে আছে, যখন ইসহাক আ. দুধ ছাড়ালেন তখন ইবরাহীম আ. এক ভোজসভার আয়োজন করলেন। সারা সে অনুষ্ঠানে ইসমাইল আ.কে ভেংচি কাটতে দেখে রাগান্বিত হন। এবং ইবরাহীম আ.কে বলেন, এ দাসী ও ছেলেক ঘর থেকে বের করে দাও। ইসমাইল কখনো ইসহাকের উত্তরাধিকারের অংশীদার হবে না। যদিও সারার সিদ্ধান্তটা ইবরাহীম আ.কে ব্যথিত করে। কারণ ইসমাইল আ.ও তার ছেলে। তথাপি আল্লাহ বলেন, ব্যথিত হবে না ইবরাহীম! সারা যাব বলে তা শোনো। কারণ ইসহাকের বংশ দিয়েই তোমার পরিচিতি হবে। আদিপুস্ত-জেনেসিস ২১.৮-১২

অসঙ্গতি ১

ইহুদীরা শাস্ত্রগত সংজ্ঞা অনুসারে,  ইয়াকুব আ. এর বারো ছেলে তথা বারো গোত্রের একজন না হলে তাকে জন্মগত ইহুদী বলেনা। তাদের বিধাণ অনুসারে, এই ১২ গোত্রের সবাই সমান। বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী বনী-ইস্রাইলের ১২ টি গোত্রের ৪ টির সুত্রপাত দাসীর ঘরে। এরা হলেন, ডান(Dan), নাফতালি(Naphtali), গাদ(Gad), আশের(Asher)। ডান ও নাফতালি দাসী ও স্ত্রী বিলহাহ এর সন্তান; আর, গাদ ও আশের অপর দাসী ও স্ত্রী জিলফা’র সন্তান (বিস্তারিত জেনেসিস ২৯-৩০)। পরিষ্কার অসামঞ্জস্যতা এখানে দৃশ্যমান। যে অজুহাতে দাসীর ছেলে বলে, ইসমাইল (আঃ) এর সন্তানের অধিকার কেড়ে নেয়া হলো; সেই একই অভিযোগ কিন্তু বনী ইস্রায়েলের ১২ গোত্রের ৪-টির উপর চাপাতে বাইবেল-বিশারদ/ইহুদী/খৃষ্টানরা নারাজ।

অসঙ্গতি ২

ইয়াহুদী খ্রিস্টানদের একমাত্র পুত্র এর ব্যাখ্যা সত্য হিসেবে গ্রহণ করে নেয়া হলে বাইবেলে ইসমাইল আ.কে সন্তান হিসেবে উল্লেখ করার কথা নয়। কিন্তু বাইবেলে ইসহাক আ. এর জন্মের পরও ইসমাইল আ.কে son বা পুত্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। জেনেসিস ২৫.৮-৯ এ ইবরাহীম আ. এর মৃত্যু ও সমাহিত করণ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, যখন ইবরাহীম (আ.) মারা যান তখন তাঁর সন্তানেরা (sons) তাঁকে মাখফেলাহে সমাহিত করেন। এখানে পরিষ্কারভাবে sons বলা হয়েছে। সুতরাং, এই বক্তব্যের আলোকে ইসমাইল(আ.) ও ইসহাক(আ.) দুজনেই ইবরাহীম(আ.) এর সন্তান/sons।

অসঙ্গতি ৩

জেনেসিস ২২.৮-১৯ এ বলা হয়েছে, ইব্রাহীম(আঃ) যখন শিশু ইসমাইল (আঃ) ও মা হাজেরাকে মক্কায় রেখে যান তখন সেখানে কোনো জনবসতি ছিলোনা। রেখে যাওয়া অল্প খাবার আর পানি শেষ হয়ে গেলে দুধের শিশু ইসমাইল (আঃ) [বর্ণনা অনুসারে তখনো ইসমাইল(আঃ) মায়ের দুধ পান করেন; তাই আশা করা যায় উনার বয়স তখন ২ বছরের মত হবে] কাঁদতে আরম্ভ করেন। বিচলিত মা হাজেরা ৭ বার সাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয়ে দৌড়াদৌড়ি করার পরে যখন শিশু ইসমাইল (আঃ) এর কাছে আসেন, তখন দেখতে পান যে, জিব্রাঈল(আঃ) তাঁর ডানা দিয়ে জমজমের কূপ খুঁড়ছেন ও একটু পরেই পানি বেরিয়ে আসে। জেনেসিস ২১.১৮ নং ভার্স অনুযায়ী আল্লাহ বলছেন পিপাসায় কাতর ইসমাইল (আ.) কে কোলে তুলে নিতে।

পূর্বে বাইবেলের বক্তব্যে বলা হয়েছে যে বাইবেল অনুসারে ইসমাইল(আ.) কে যখন ছোটো ভাই ইসহাক (আ.) এর দুধ ছাড়ার ভোজসভায় সারা ভেংচি কাটতে দেখেন; তখনই সারা আ. ক্ষিপ্ত হয়ে ইসমাইল (আ.) ও হাজেরাকে বাসা থেকে বের করে দিতে বলেন। সহজ হিসেব অনুসারে দুধ ছাড়ার সময় ইসহাক (আ.) এর বয়স ৩ আর ইসমাইল (আঃ) এর বয়স ৩+১৪ = ১৭। তো পিপাসার্ত ১৭ বছরের ইসমাইল (আঃ) কে কিভাবে ২১.১৮ অনুসারে মা হাজেরা কোলে তুলে নিলেন? উল্টো বরং ১৭ বছরের জোয়ান যুবক ইসমাইল (আ.) তাঁর মাকে কোলে তোলার ক্ষমতা রাখার কথা। মূল রহস্য হলো, কোরবানীর ভার্স থেকে ইসমাইল(আ.) এর নাম মুছতে গিয়ে সবকিছু গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। হারিয়ে গেছে ঘটনার পরম্পরা। ২ বছরের শিশু ইসমাইল (আ.) হয়ে গেলেন ১৭ বছরের কোলে ওঠা শিশু। এতে করে সৃষ্টি হয়েছে চরম মাত্রার অসংলগ্নতা ও অসামঞ্জস্যতা।

ইয়াহুদী-খ্রিস্টবাদী নাস্তিকদের আপত্তি ও পর্যালোচনা

১। নির্বাসনে দেয়ার পর থেকে বিবাহের আগ পর্যন্ত ইসমাইল আ. এর সাথে ইবরাহীম আ. এর কোনো দেখা সাক্ষাত হয় নি। সহীহ বুখারীতে এমনটিই রয়েছে।

জবাব : নির্বাসনে দেয়ার পর থেকে বিবাহের আগ পর্যন্ত ইসমাইল আ. এর সাথে ইবরাহীম আ. এর কোনো দেখা সাক্ষাত হয় নি। –সুনির্দিষ্ট এমন তথ্য সহীহ বুখারীতে উল্লিখিত হয় নি। এটা তাদের মনগড়া বক্তব্য। সহীহ বুখারীর আরবী পাঠ হলো,

فبلغ ابنها فنكح فيهم امرأة قال ثم إنه بدا لإبراهيم فقال لأهله إني مطلع تركتي । সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৩৬৫। এর অর্থ হলো, তিনি প্রাপ্ত  বয়সে উপণীত হলেন। এরপর সে গোত্রের এক নারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর ইবরাহীম আ. মনে তাদের কথা উদয় হলো। ফলে তিনি তার স্ত্রীকে বললেন, আমি আমার নির্বাসিত পরিজনের খবর নেবো। বর্ণনার ধারাভাষ্য থেকেই প্রমাণিত হচ্ছে, ইবনে আব্বাস রা. ইসমাইল এবং ইবরাহীম আ. এর পূর্ণ ঘটনা উল্লেখ করছেন না। সংক্ষিপ্ত পরিসরে ইসমাইল আ. ও মাতা হাজরা আ. এর নির্বাসন কালীন মূল ঘটনা বর্ণনা করাই উদ্দেশ্য। আর ‘অতঃপর ইবরাহীম আ. মনে তাদের কথা উদয় হলো।’ এ কথার অর্থ কখনো এ হতে পারে না যে ইবরাহীম আ. শৈশব থেকে নিয়ে বৈবাহিক বয়সে উপণীত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের সাথে সাক্ষাত করেন নি। শৈশব থেকে বৈবাহিক বয়স কম সময় নয়। আমাদের বয়স হিসেবেই তো ১৪-১৫ বছর। আর তাদের বয়স বিবেচনায় তো সময়ের পরিমাণ আরো বেশি হওয়ার কথা। একজন নবীর পক্ষে এমনটি আদৌ আশা করা যায় না। বাস্তবতা হলো ইবরাহীম আ. মাঝে মাঝে এসে নির্বাসিত স্ত্রী পুত্রকে দেখে যেতেন। বক্তব্যের মাঝে قال বা তিনি বলেন শব্দ এসেছে। তার মানে অন্য একজন বর্ণনাকারী ইবনে আব্বাস রা. এর বক্তব্য উদ্ধৃত করছেন। হয়তো তিনি ইবনে আব্বাস রা. এর পূর্ণ বক্তব্য উদ্ধৃত করেন নি নয়তো ইবনে আব্বাস রা. পূর্ণ ঘটনা বলেন নি। তাছাড়া ইবনে আব্বাস রা. এরই বক্তব্য রয়েছে যে তিনি বলেছেন, ইসমাইল আ. যাবীহুল্লাহ ছিলেন।ইবনে আব্বাস রা. বলেন, যাবীহুল্লাহ ইসমাইল আ. ছিলেন। ইয়াহুদীরা মনে করে যাবীহুল্লাহ ইসহাক আ. ছিলেন। ইয়াহুদীরা মিথ্যা বলেছে। তাফসীরুল কুরআনিল আযীম ৭/৩২

২। হাজের আ. ইবরাহীম আ. এরবিবাহিত স্ত্রী  ছিলো না

জবাব : একথা সত্য হাজেরা আ. সারা আ. এর দাসী ছিলেন। এবং সারা আ. তাঁর হাজেরা নামী এ দাসীকে ইবরাহীম এর সাথে বিবাহ পড়িয়ে দেন। সুতরাং হাজেরা আ. ইবরাহীম আ. এর কেবল দাসীই ছিলেন না; বিবাহিত স্ত্রীও ছিলেন। উপরন্তু হাজেরা আ. যে দাসী ছিলেন এ ব্যাপারে কুরআন ও সহীহ হাদীসের কোনো বর্ণনা নেই। যেসব বর্ণনা রয়েছে তার সবই ঐতিহাসিক। আর এ বিষয়ক সকল ঐতিহাসিক বর্ণনার মূল উৎস হলো বাইবেল। যাতে সত্য অসত্য, বিকৃত অবিকৃত সব রকমের বর্ণনাই বিদ্যমান রয়েছে। একারণে কোনো কোনো গবেষক মনে করেন, হাজেরা আ. ইবরাহীম আ. এর দাসী ছিলেন না; বরং তিনি তাঁর নিয়মতান্ত্রিক বৈধ স্ত্রী ছিলেন। অন্য একটি সূত্র বলছে, হাজেরা আ. মিশর সম্রাটের কন্যা ছিলেন।

৩। ইসমাইল আ. কি করে ইবরাহীম আ . এর সবচেয়ে প্রিয়পাত্র হন। সে তো বহু বছর পর্যন্ত ইবরাহী আ. এর কাছে ছিলো না। ইবরাহিম আ. এর কাছে ছিলেন শিশুপুত্র ইসহাক আ.।

পর্যালোচনা : সবচেয়ে প্রিয় হবার মানদণ্ড কি কাছে থাকা? বরং মানুষের বিবেক ও স্বভাবের দাবি হলো যে ছেলেটা দূরে থাকে তার প্রতিই মায়া মমতাটা বেশি থাকে। আর এখানে শুধুই দূরত্বই নয় বরং একেবারেই সহায় সম্বলহীন অবস্থায় শত শত মাইল দূরত্বে নির্জন প্রান্তরে রেখে আসা হয়েছে। এতে তার প্রতি মায়া মমতাটা বেশি হওয়াই যুক্তিযুক্ত। আর প্রথম সন্তানের প্রতি মায়া মমতাটা সব মা বাবারই বেশি থাকে। এটা প্রমাণের কোনো দলীল প্রমাণের প্রয়োজন নেই।  

৩। বাইবেলকে বিকৃত বলে কেন সেই বিকৃত বাইবেল থেকেই রেফারেন্স দিচ্ছেন?

পর্যালোচনা : বাহ্যত এটি আসলেই একটি যৌক্তিক প্রশ্ন। একদিকে বাইবেলকে বিকৃত বলছি। অন্যদিকে সেই বাইবেলের রেফারেন্সেই নিজেদর বক্তব্য প্রমাণ করছি। বস্তুত বাইবেল থেকে রেফারেন্স দেয়ার দুটি রূপ। ১। প্রত্যক্ষ বা দৃশ্যমান ২। পরোক্ষ বা অদৃশ্যমান। আর অনেক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান বিষয়টা অবাস্তব হয় এবং অদৃশ্যমান বিষয়টা বাস্তব হয়। দৃশ্যমান রূপ তো বাইবেল থেকে রেফারেন্স দেয়া। কিন্তু অদৃশ্য ও বাস্তবিক রূপটি হলো, বাইবেলের বক্তব্য ও তাদের বক্তব্যের তথ্যগত সাংঘর্ষিকতা ও বাইবেলের তথ্যগত বিকৃতিকে পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরে। আমরা মূলত এখানে এ দৃষ্টিকোণ থেকেই বাইবেলের রেফারেন্স ব্যবহার করে থাকি। নতুবা প্রচলিত বাইবেল আমাদের নিকট রেফারেন্সযোগ্য কোনো গ্রন্থ নয়। দ্বিতীয়ত আমরা এক দৃষ্টিকোণ থেকে বাইবেলের তথ্যকে রেফারেন্স হিসেবে গ্রহণ করি। তবে সেটা আমাদের জন্য নয়; বরং সেটা ইয়াহুদী খ্রিস্টানদের জন্য। কারণ আমাদের এ লেখার পাঠক তো শুধু আমরা মুসলিমরাই নই; আমাদের মূল কাঙ্ক্ষিত পাঠক হলো ইয়াহুদী খ্রিস্টান বা তাদের সতীর্থরা। তারা তো কুরআন হাদীস বিশ্বাস করবে না। তাদের নিকট যেহেতু বাইবেল সত্য ও রেফারেন্সযোগ্য সে দৃষ্টিকোণ থেকেও আমরা বাইবেলের বক্তব্যকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করি। তাছাড়া ইয়াহুদী খ্রিস্টানরাও কিন্তু কুরআন হাদীস থেকে ইসহাক আ.কে যাবীহুল্লাহ প্রমাণের উদ্দেশ্যে উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন। আমরা কিন্তু তখন প্রশ্ন করি না, কেন তারা কুরআন হাদীস থেকে রেফারেন্স দেয়? অথচ তারাও কিন্তু কুরআন হাদীসকে সত্য বলে বিশ্বাস করে না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো আপনারা নাস্তিক হয়ে কেন বাইবেল থেকে উদ্ধৃতি দেন? বাইবেল তো একটি ধর্মগ্রন্থ। আমরা তো বাইবেলের আদিরূপ তাওরাত ইঞ্জিলকে সত্য বলে বিশ্বাস করি। এবং এও বিশ্বাস করি, বর্তমানে বাইবেলে বহু রকমের বিকৃতি সাধিত হলেও তাতে অবিকৃত কিছুও বিদ্যমান রয়েছে। আর আপনারা তো বাইবেলকে বিশ্বাস করেন না। তবে কেন বাইবেল থেকে উদ্ধৃতি দেন? আচ্ছা ধরে নিলাম যে আপনারা যে কোনো কারণে তাদের পক্ষ নিয়েছেন। তো পক্ষ নিয়ে কেন কুরআন হাদীস দ্বারা আপনারাও দলীল পেশ করেন? নাস্তিক হিসেবে তো কুরআন হাদীসকে বিশ্বাস করেন না এবং ইয়াহুদী খ্রিস্টানদের পক্ষ হিসেবেও কুরআন হাদীসে বিশ্বাস থাকার কথা নয়। তবে কেন কুরআন হাদীস থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছেন? এ প্রশ্নের উত্তরে আপনারা যাব বলবেন তাই আপনাদের করা প্রশ্নের আমাদের উত্তর।

৪। বাইবেলকে বিকৃত বলছেন। তবে অবিকৃত বাইবেল দেখান। অবিকৃত বাইবেল ছাড়া প্রচলিত বাইবলে বিকৃত বলা যাবে না।

পর্যালোচনা : বিকৃতি প্রমাণের জন্য মূল ও বিশুদ্ধ কপি উপস্থিত বিকৃতি প্রমাণের একটি মাত্র পদ্ধতি। কিন্তু বিকৃতি প্রমাণের এটিই একমাত্র পদ্ধতি নয়। আর তারা যদি মূল কপিতেই বিকৃত করে কিংবা বিকৃত করে মূল কপিগুলোকে গায়েব করে ফেলে কিংবা নষ্ট করে ফেলে তবে মূল কপি কোথায় পাওয়া যাবে? তারা যে বর্তমানে বা রাসূল এর যুগে বিকৃত করেছে তাতো নয়। তারা তো সে শুরু যুগ থেকেই তাদের বিকৃত করার কাজ করে আসছে। বস্তুত প্রচলিত বাইবেল বিকৃত কি বিকৃত নয় এটি স্বতন্ত্র ও সুদীর্ঘ প্রবন্ধ সাপেক্ষ বিষয়। এখানে সে দিকে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ নেই। তবে সংক্ষেপে বলা যায়, এ কথা সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত এং ইয়াহুদী খ্রিস্টান গবেষকদের গবেষণার আলোকেও সুপ্রমাণিত যে, প্রচলিত বাইবেল অরিজিনাল তাওরাত ইঞ্জিল নয়। এ কথা বাইবেলের অসংখ্য উদ্ধৃতি থেকেও প্রমাণিত। আর পবিত্র কুরআন তো স্পষ্ট করেই বলেছে, তারা তাদের কিতাবকে বিকৃত করেছে। আল্লাহ বলছেন, অতএব তাদের জন্যে আফসোস! যারা নিজ হাতে গ্রন্থ লেখে এবং বলে, এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ-যাতে এর বিনিময়ে সামান্য অর্থ গ্রহণ করতে পারে। অতএব তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের হাতের লেখার জন্য এবং তাদের প্রতি আক্ষেপ, তাদের উপার্জনের জন্যে।সূরা বাকারা ২: ৭৯ । আর কুরআনের এ ভাষাকে মিথ্যা বলার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের জায়গা থেকে এ কথা আমাদের বলতে হবে। যদিও ইয়াহুদী খ্রিস্টানরা কুরআনকে মিথ্যা বলে দম্ভ করবে। সুতরাং বাইবেলের বিকৃতি প্রমাণের জন্য বিশুদ্ধ বাইবেলের কোনো প্রয়োজন নেই।

5। যাবীহুল্লাহ যে ইসমাইল আ. তার প্রমাণ তো কুরআন ও হাদীসে নেই!

পর্যালোচনা : ইয়াহুদী খ্রিস্টান এবং তাদের একালের শক্তিশালী প্রতিনিধি নাস্তিকগণ একটি প্রশ্ন করে থাকে ইসমাইল আ. যে যাবীহুল্লাহ একথা তো পবিত্র কুরআন ও হাদীসে নেই। তবে কেন তারা ইসমাইল আ.কে যাবীহুল্লাহ হিসেবে বিশ্বাস করে থাকে? আসলেই ইসমাইল আ. যে যাবীহুল্লাহ এ বিষয়টি পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসে স্পষ্ট করে বলা নেই। তবে বক্তব্য দু ধরনের হয়ে থাকে। ১। প্রত্যক্ষ ২। পরোক্ষ। একথা সত্য যে প্রত্যক্ষভাবে ইসমাইল আ. এর যাবীহুল্লাহ হওয়ার বিষয়টি কুরআন ও সহীহ হাদীসে নেই। তবে পরোক্ষভাবে বেশ শক্তিমত্তার সাথে কুরআন ও সহীহ হাদীসে ইসমাইল আ. যাবীহুল্লাহ হওয়ার বিষয়টি বিদ্যমান রয়েছে। এবং পরোক্ষ প্রমাণগুলো এতোটাই শক্তিশালী যে তা প্রত্যক্ষ বক্তব্য সম্বলিত প্রমাণসূত্রের তুলনায় শক্তি ও মানগত দিক থেকে কোনো অংশেই কম নয়। কুরআন হাদীসকে যদি যাবীহুল্লাহ প্রমাণের মূলসূত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয় তবে আমরা বলবো ইসহাক আ. যাবীহুল্লা হওয়ার বিষয়টিও পবিত্র কুরআন ও হাদীসে প্রত্যক্ষভাবে বলা হয় নি এবং পরোক্ষভাবেও বলা হয় নি। সুতরাং কুরআন হাদীসের আলোকে যদি ইসমাইল আ.কে যাবীহুল্লাহ না বলা যায় তবে তো কুরআন হাদীসের আলোকে ইসহাক আ.কেও যাবীহুল্লাহ বলার সুযোগ নেই। তবে আপনারা কুরআন হাদীসের প্রসঙ্গ কেন টানেন? আপনাদের দায়িত্ব শুধু কুরআন হাদীসের পরোক্ষ দলীল-প্রমাণ খণ্ডনে ব্রতী হওয়া। মুসলিমদের ঘরোয়া অন্য কিছু আপনাদের দায়িত্বের আওতায় পড়ে না। আর যদি আপনারা ইসহাক আ. যাবীহুল্লাহ প্রমাণে কুরআন হাদীস বাদে বাইবেলকে সামনে নিয়ে আসেন তবে আমরা বাইবেলের বক্তব্যকে বিশ্লেষণ করার কাজে ব্রতি হবো।

৬। কুরআনে তো তাওরাত ইঞ্জিলকে মানতে বলা হয়েছে?

পর্যালোচনা : পবিত্র কুরআনে তাওরাত শব্দটি ১৬বার এসেছে। আর ইঞ্জিল শব্দটি ১২বার এসেছ। এতে খুব সহজেই প্রতীয়মান হয় তাওরাত ইঞ্জিল ইসলামী শরীয়াতে অতীব গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয়। তবে পবিত্র কুরআনের কোথাও মুসলিমদেরকে তাওরাত ইঞ্জিলকে ঢালাওভাবে মানতে বলা হয় নি। বরং ইসলামী শরীয়াতে তাওরাত ইঞ্জিলের ওই সকল বিধান মান্য বলে গণ্য যেগুলো কুরআন হাদীসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ আল্লাহ যুগে যুগে অসংখ্য নবী রাসূল পাঠিয়েছেন। সকলের শরীয়ত মূলগত দিক থেকে এক ও অভিন্ন হলেও শাখাগত দিক থেকে অভিন্ন ছিলো না। সে দৃষ্টিকোণ থেকে মুসা আ. ও ঈসা আ. এর শরীয়ত ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীয়ত অভিন্ন হওয়ার কথা নয়। এসব গ্রহণ বর্জনের বিষয়টি বিশুদ্ধ ও অবিকৃত তাওরাত ও ইঞ্জিলের সাথে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু পবিত্র কুরআন হাদীস ও ইতিহাস প্রমাণ করে ইসলাম আগমন কালে তাওরাত ও ইঞ্জিল বিশুদ্ধ ও অবিকৃত ছিলো না। আর মূল তাওরাত ও ইঞ্জিল আল্লাহ প্রদত্ত গ্রন্থ হলেও সেগুলো যে চিরকাল অবিকৃত থাকবে তার কোনো গ্যারান্টিও আল্লাহ তাআলা দেন নি। সুতরাং সেগুলো বিকৃত হওয়া ও অশুদ্ধ হওয়া বিস্ময়কর ও বিচিত্র কিছু নয়। উপরন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে সেগুলোক চিরকাল অবিকৃত করে রাখার ব্যবস্থা করারও কোনো প্রয়োজন ছিলো না। কারণ মুসা আ. ও ঈসা আ. এর শরীয়ত তো চিরকালের ছিলো না। মুসা আ. ও ঈসা আ. এর শরীয়ত চিরস্থায়ী না হলে তাওরাত ইঞ্জিলকে চিরস্থায়ী করে রাখার মাঝে কোনো উপকারিতা নেই। পৃথিবীতে অসংখ্য নবী রাসূল এসেছেন। সেসব নবী রাসূলদের প্রতি অসংখ্য সহীফা বা আল্লাহপ্রদত্ত গ্রন্থও অবতীর্ণ হয়েছিলো। কিন্তু সেগুলোর অস্তিত্ব তো দূরের কথা নামেরও সন্ধান পাওয়া যায় না। সেসব কিতাব নামসহ হারিয়ে যাওয়ার মূল কারণ হলো সেসব কিতাব আশ্রিত শরীয়তগুলোর চিরস্থায়ী বন্দবস্ত না হওয়া। আর বর্তমানে তাওরাত ইঞ্জিল যে অবিকৃত নেই তা তো বলাই বাহুল্য। আর বর্তমানে যে ইয়াহুদী খ্রিস্টানরা তাদের নামসর্বস্ব ধর্মকে বিকৃত করে টিকিয়ে রেখেছে তা তাদের বিদ্বেষ ও গোয়ার্তুমির ফসল। পবিত্র কুরআন ও ইসলাম আগমনের ফলে তাওরাত ও ইঞ্জিল ও তদাশ্রিত ধর্মদুটিও বিলুপ্ত ও রহিত ঘোষিত হয়েছে।

যারা নবীদের হত্যা করতে পারে তাদের পক্ষে সবকিছু করাই সম্ভব

ইয়াহুদীরা তাওরাত ইঞ্জিল বিকৃত করেছে। নবীদের নামে ব্যভিচারের কুতসা রটিয়েছে। নবীদেরকে অবৈধ সন্তান ও ব্যভিচারী আখ্যা দিয়েছে। এসব তাদের পক্ষে সম্ভব। কারণ তারা নবীদরকে হত্যা করতে পারঙ্গম। যুগে যুগে তারা নবীদের হত্যা করেছে। আল্লাহ বলেন, তারা অভিসম্পাদিত হয়েছিলো তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে, আল্লাহর আয়াতকে প্রত্যাখান করার কারণে, নবীগণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার কারণে… এবং তারা অভিসম্পাদিত হয়েছিলো তাদের কুফুরির কারণে ও মারইয়ামের বিরুদ্ধে গুরুতর অপবাদের কারণে আর আল্লাহর রসূল মারইয়াম তনয় ঈসাহ মসীহকে হত্যা করেছি তাদের এ উক্তির কারণে। অথচ তারা তাকে হত্যা করে নি, ক্রুশবিদ্ধ ও করে নি। কিন্তু এরূপ বিভ্রম হয়েছিলো। সূরা নিসা ১৫৫-১৫৭ ইয়াহুদী কর্তৃক নবী হত্যার বিষয়টি কুরআনের অন্যান্য আয়াতেও আলোচিত হয়েছে। যেমন সূরা আলে ইমরান ১১২, ১৮১। সূরা বাকারা ৮৭,৯১

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *