মুহাম্মাদ ইরফান জিয়া
আরাকান থেকে রাখাইন
যে দেশের মাটিতে আমি চোখ মেলেছি তার এখনকার নাম মিয়ানমার। আগে ছিল বার্মা। মিয়ানমারের একটি প্রদেশের নাম রাখাইন। রাখাইনের পূর্বনাম আরাকান। আরাকানের একদিকে বঙ্গোপসাগর, অন্যদিকে পাহাড়ের সারি। পাহাড়গুলো আরাকান এবং মিয়ানমারের মাঝখানে প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটা অংশে আছে নাফ নদী। ওপারে বাংলাদেশ।
এই পাহাড়, সাগর আর নদী ঘেরা আরাকানে আমার জন্ম। এখানেই আমি বড় হয়েছি। কাটিয়েছি জীবনের সত্তরটি বছর। বার্ধক্য এখন আমাকে চেপে ধরেছে। হারিয়ে ফেলেছি শক্তি ও মনোবল।
১৯৬২ খ্রিস্টাব্দ। আমার বয়স তখন ষোল। বার্মায় সামরিক অভ্যুত্থান হল। ক্ষমতায় বসলো মাসক নেউইন। একদিন হঠাৎ দেখলাম গ্রামে আর্মিরা আক্রমণ করেছে। লোকজনকে ঘর থেকে বের করে মেরে ফেলছে। জ্বালিয়ে দিচ্ছে সবার বাড়ি-ঘর। আমার বাবা-মা তাদের পাঁচ সন্তানকে নিয়ে কোনমতে পালাতে সক্ষম হলেন। তিনদিন হেঁটে আমরা সীমান্তের কাছাকাছি চলে এলাম। বাবার ইচ্ছা ছিল সীমান্ত পার হয়ে অন্য কোন দেশে চলে যাবেন। কিন্তু আমি তার ইচ্ছা বুঝতে পেরে শক্তভাবে বেঁকে বসলাম। কিছুতেই দেশ ছেড়ে যাব না। জানি না সে বয়সে এত মনোবল কোথায় পেয়েছিলাম। তবে আমার মনে একের পর এক প্রশ্ন আঘাত হানছিল। আমরা কে? কেন আমাদের ওপর আক্রমণ করছে এদেশেরই সেনারা? আমরা কি এ দেশের নাগরিক নই? তাহলে কোন অপরাধে ওরা উজাড় করে দিচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম?
দীর্ঘদিন সীমান্তবর্তী এক এলাকায় আমরা লুকিয়ে থাকলাম। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে ফিরে এলাম আমাদের গ্রামে। আমার পরিবার আবার স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে গেল। আর আমি খুঁজতে লাগলাম আমার প্রশ্নের উত্তর। ধীরে ধীরে আমার সামনে উন্মোচিত হতে লাগল অসংখ্য অজানা বিষয়।
ফিরে দেখা ইতিহাস
৮ম শতাব্দীর কোনএক সময়। আরাকান তীরবর্তী আকিয়াব বন্দরে ভিড়ল আরব বণিকদের জাহাজ। এ এলাকার নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া আর উর্বর ভূমি বণিকদের আকৃষ্ট করল। পড়ে থাকা অনাবাদী যমীনকে আবাদ করতে তারা এখানে বসবাস শুরু করল। এর বহু বছর পর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকেও লোকেরা আরাকানে আসতে লাগল। এছাড়াও এখানে বসতি স্থাপন করল আফগানিস্তান ও অন্যান্য কয়েকটি দেশের লোকজন। এভাবে বিভিন্ন ধর্মের নানা রকম মানুষের আবাসস্থলে পরিণত হল আরাকান।
আগত মানুষদের অনেকেই ছিলেন মুসলিম। তাদের সুন্দর আচরণ আর মায়াভরা আহ্বানে অন্যরাও ইসলামে দীক্ষিত হয়। ফলে মুসলমানরা এ এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিতে পরিণত হয়। আরাকানের আদি নাম ছিল রোহাং বা রোসাং। সে থেকে এ জাতির নাম হয় রোহিঙ্গা।
এ জাতিরই একজন সদস্য আমি। আমার পূর্বপুরুষরা ছিলেন স্বাধীন। আরাকান ছিল আলাদা রাষ্ট্র। বিশেষ করে মিয়ানমারের কোনই অধিকার ছিল না আমাদের উপর। চৌদ্দ শতক থেকে আঠার শতক পর্যন্ত এ ভূখণ্ডে ‘মারুক ইউ’ রাজত্ব করেছে। এ বংশের প্রতিষ্ঠাতা নারামেইখলা মুসলমান ছিলেন। তার মুসলিম নাম ছিল সুলাইমান শাহ। রাজ দরবারের উচ্চপদস্থ সবাই ছিলেন মুসলিম। মহাকবি আলাওল এবং দৌলত কাজীর মত বিখ্যাত সাহিত্যিকগণ এ দরবারের শোভা বর্ধন করেছিলেন।
পরাধীন কড়চা
১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দ। বার্মার রাজা বোদাদাউয়া আরাকান রাজ্য আক্রমণ করে। তার বাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর চালায় নির্যাতনের স্টিমরোলার। পরাজিত রোহিঙ্গাদের চোখের সামনে ডুবে যায় স্বাধীনতার সূর্য। জীবন বাঁচাতে হাজারো রোহিঙ্গা পালিয়ে যায় চট্টগ্রামে।
১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজরা আরাকানকে ব্রিটিশ-ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে ওরা পুরো বার্মাই দখলে নিয়ে নেয়। এ সময় ব্রিটিশরা আরাকানকে বার্মার অন্তর্ভুক্ত করে ফেলে। এরপর ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে বার্মা ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তিলাভ করে। আধিপত্যবাদ থেকে মুক্তির এ সংগ্রামে রোহিঙ্গারা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল।
৪৮’র এই আশাপূর্ণ সময়ে আমার জন্ম। আমার বাবা বড় আশা করে মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার আশার কিছুটা বাস্তবায়ন হয়েছিল স্বাধীন বার্মার প্রথম শাসক অং সাং -এর সময়ে। তিনি রোহিঙ্গাদের বার্মার নাগরিক বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তিনি নিহত হওয়ার পর সামরিক শাসক উনু’র সময়েও শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল।
কিন্তু ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে যখন সামরিক শাসক ‘নেউইন’ ক্ষমতাসীন হল, পূর্বের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়ে সে গণহত্যা শুরু করল। বাঁচার আকুতিতে অনেক রোহিঙ্গা বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাতে লাগল। আমার বাবাও এটাই চেয়েছিলেন। শুধু আমার জেদের কারণে সিদ্ধান্ত পাল্টে থেকে গেলেন জন্মভূমিতে ।
সব হারিয়ে একা
সময় বয়ে যায়। আমার বাবা-মা বৃদ্ধ হয়ে যান। আমি পরিণত হই যুবকে। এক সময় দাম্পত্য বন্ধনেও আবদ্ধ হই। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন তখন ধীর লয়ে চলছে। মাঝে মাঝে বিভিন্ন স্থান থেকে নির্যাতনের খবর আসছে, তবে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ না হওয়ায় অনেকে ভয় নিয়েই থাকছেন।
১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের কোন এক সকাল। আমাকে একটা কাজে দূরের গ্রামে যেতে হয়েছিল। ঘরে বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী আর তিন সন্তান। যখন ফিরে আসি বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। গ্রামের কাছাকাছি হতেই আঁৎকে উঠলাম। পোড়া পোড়া একটা গন্ধ নাকে আসছে। আরো কাছে এসে লক্ষ্য করলাম, গ্রামের সব ঘর-বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সেনাবাহিনীর আক্রমণ থেকে যারা পালাতে পারেনি তাদেরকে পাইকারিভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমার পরিবারের সবাইকে ঘরের মধ্যে বেঁধে তারপর আগুন ধরানো হয়েছে। আমার প্রিয় বাবা-মা, স্ত্রী এমনকি চার বছরের ছোট্ট মেয়েটি, যে সবেমাত্র গ্রামের মকতব থেকে সূরা ফাতিহা পড়া শিখেছে; তাকে নিক্ষেপ করেছে জ্বলতে থাকা কয়লায়। কেউ বাঁচতে পারেনি ওদের এই নারকীয় আগুন থেকে।
জ্বলেপুড়ে ওরা অঙ্গার হয়ে পড়ে থাকল। আপনজনদের হারিয়ে বড় একা হয়ে গেলাম। কানে বাজল, বাবা যেন বলছেন, কী বাছাধন! বলেছিলাম না এদেশ এখন আর আমাদের নেই! এ মাটি ছেড়ে চলে গেলেই ভালো হবে!
বাবা তো চলেই গেছেন। কিন্তু আমার আরো জেদ চেপে গেছে। ৭৮’র এই নিধনযজ্ঞের সময় দুই লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আমি আঁকড়ে থাকি রাখাইনের মাটি। সব হারিয়ে এখন আমি একা; মৃত্যু হলেও কোন পরোয়া নেই।
১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে অহিংসার বাণীধারী বৌদ্ধরা আবার হামলে পড়ে মুসলমানদের উপর। এই হামলায় বহু লোক নিহত হয়। হাজার হাজার মানুষ ঘর-বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। নৌকায় করে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড বা বাংলাদেশে যাওয়ার চেষ্টা করে অনেকে। পথে ডুবে যায় অসংখ্য মানুষ।
এ সময়ে আমি বার্ধক্যে পৌঁছে গেলেও আমার প্রতিজ্ঞায় আমি অটল ছিলাম। যতো কিছুই হোক দেশ ছেড়ে যাব না। যাব না আমার শিকড় ছিড়ে।
বহমান এই সময়ে
২০১২ খ্রিস্টাব্দের এক নির্মূল অভিযানের পর এক লাখ পঁচিশ হাজার রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে। আশ্রয় শিবিরে রাখা হয়েছে এসব বন্দীদের। তাদের চলাফেরায় আরোপ করা হয়েছে কঠোর নিয়ন্ত্রণ। আটকে পড়া মানুষের মিছিলে আমিও আছি। শুরু হয়েছে আমাদের বন্দী জীবন। আশ্রয় শিবির থেকে বাইরে যাওয়ার কোন উপায় নেই। তাই বাইরের রোহিঙ্গাদের জীবনে কী ঘটছে তা ভালোভাবে জানতে পারছি না।
কিন্তু গত ৯ অক্টোবর ২০১৬’র পর থেকে ঘটতে শুরু করে এমন সব ঘটনা যেগুলোর ভয়াবহতা আশ্রয় শিবিরের বেষ্টনী ভেদ করে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
সীমান্তবর্তী একটি পুলিশফাঁড়ি নাকি আক্রান্ত হয়েছিল। হামলাকারী কারা তা সুস্পষ্টভাবে জানা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, মাদক পাচার চক্র বা বিচ্ছিন্ন কোন রোহিঙ্গা হতে পারে। শুধু এই ধারণার কারণে সাধারণ রোহিঙ্গাদের উপর নেমে এসেছে নারকীয় অত্যাচার। সেনাবাহিনী এবং সহিংস বৌদ্ধরা একযোগে হামলে পড়েছে নারী-পুরুষ ও অবুঝ শিশুদের উপর। ১০ নভেম্বরের মধ্যে পুড়িয়ে ফেলেছে ৮০০’র বেশি গ্রাম। ধ্বংস হয়েছে ২৫ হাজার বাড়ি, ৬০০ দোকান, ১২টি মসজিদ ও ৩০টির বেশি স্কুল। কত মানুষ যে শহীদ হয়েছে তার হিসেব নেই। বন্দী শিবিরেও মাঝে মাঝে সেনারা আসে। আমাদেরকে লাইনে দাঁড় করিয়ে চাবুক দিয়ে পিটায়। মানসিকভাবে দুর্বল করার জন্য আমাদেরকে কিছু ভিডিও দেখায়। যে ভিডিওগুলো ওরা রোহিঙ্গা পল্লীগুলো ধ্বংস করার সময় নিজেরাই উল্লাসের সাথে ধারণ করেছে। নির্যাতনের সেসব দৃশ্য দেখে আমাদের হৃদয় কেঁদে ওঠে। কী বর্বর! কত অসভ্য!
একটা মেয়েকে গাছে বেঁধে রাখা হয়েছে। হাত দুটো পিছনে। পা দুটো সামনে প্রলম্বিত। বৌদ্ধ হায়েনারা চাপাতি দিয়ে কোপাতে আরম্ভ করল। পায়ের পাতা থেকে উরু পর্যন্ত। এরপর বাঁধন খুলে দিয়ে কিছুক্ষণ ঘাড়ে কোপাল। তখনো ঘড়ঘড় শব্দ বের হচ্ছে গলা থেকে। একেবারে নিস্তব্দ করার জন্য চিৎ করে শুইয়ে কোপ দিয়ে আলাদা করে ফেলল মাথাটা।
কয়েকজন লোককে একসঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। এক বৌদ্ধ এসে তাদের শরীরে পেট্রোল ঢেলে দিল। আরেকজন আগুন ধরিয়ে দিল। চোখের পলকে ওদের চামড়া ঝলসে গেল। শরীর ছেঁকে গেল। ওদের ভয়াবহ চিৎকার শুনে বৌদ্ধরা হেসে একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ল।
আরেকটা দৃশ্য দেখলাম, একটা শিশুকে বেয়নেট দিয়ে খোচাচ্ছে। কেঁদে উঠলেই চেপে ধরছে গলা। শিশুটির কান্না যখন অস্বাভাবিক বেড়ে গেল, একজন তার শরীরটা ধরে রাখল। আরেকজন দু’হাতে মাথাটা ধরে মুচড়ে দিল। হাড় ভাঙ্গার একটা ক্ষীণ শব্দ হল। চিরতরে কান্না থেমে গেল শিশুটির।
অপরাধ আমরা মুসলিম
মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দের পূর্ব থেকে যেসব জাতি-গোষ্ঠী এদেশে বসবাস করছে সবাই এদেশের নাগরিক। অথচ রোহিঙ্গারা হাজার বছর বসবাস করেও নাগরিকত্ব পায়নি। আরাকানের মোট জনসংখ্যার অধিকাংশই মুসলিম। লক্ষ লক্ষ মানুষের এ বিশাল জনগোষ্ঠীর যদি এদেশের নাগরিক হওয়ার অধিকার না থাকে তাহলে অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী কিভাবে নাগরিক হওয়ার সুযোগ পেল?
স্বাধীন মিয়ানমারের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ‘শাওসোয়ে আইক’ ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বলেছিলেন, রোহিঙ্গারা যদি স্থানীয় আদিবাসী না হয়, তাহলে আমিও তা নই। সত্যিই তো। মিয়ানমারের বর্তমান শাসকরাই বরং বহিরাগত। ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে ওরা আরাকানে আসে। সেই বহিরাগত শাসকগোষ্ঠীই কিনা আজ হাজার বছর ধরে বসবারকারীদের নাগরিকত্ব বাতিল করেছে! মগের মুল্লুকে শুরু করেছে গণহত্যা। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ একথার প্রয়োগক্ষেত্র আজ আরাকান।
সবকিছু দেখেও দেশের নির্বাচিত নেত্রী অং সাং সু চি ছিলেন পুরোপুরি নিশ্চুপ। কেনইবা তিনি চুপ থাকবেন না। তাকে ক্ষমতায় আনার পেছনে যে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিরাট অবদান রয়েছে; আর সেসব ভিক্ষুই আজ চাইছে রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে।
২০১২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেনের দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছিল, সিত্তুইয়ের তরুণ ভিক্ষু সমিতি এবং ম্রাউক‘উ ভিক্ষু সমিতি বিবৃতির মাধ্যমে স্থানীয় বাসিন্দাদের আহ্বান জানিয়েছে, তারা যেন রোহিঙ্গাদের সহায়তা না করে। সু চি যে এসব উগ্রপন্থী ভিক্ষুদের সঙ্গে একমত তা ডিসেম্বর মাসেই প্রকাশ পেয়ে গেল। নিউইয়র্ক টাইমস সু চির বক্তব্য প্রকাশ করল- ‘রোহিঙ্গারা বার্মার নাগরিক নয়; ওরা বাঙালী…। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এটি করা সরকারের দায়িত্ব।
সু চি ঠিকই বলেছেন। মিয়ানমারের সরকার আরাকানকে রোহিঙ্গামুক্ত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে। এর আরেকটি প্রমাণ হল, মিয়ানমারে মুসলমানরা ছাড়াও আরো শতাধিক নৃগোষ্ঠী আছে। এসব নৃগোষ্ঠীকে জাতি ও রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করতে বিভিন্ন সময় সরকার তাদের সঙ্গে শান্তি-সমঝোতার আলোচনা চালিয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা বরাবরই উপেক্ষিত হয়েছে। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে সাতটি গোষ্ঠীর সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের আগস্টে ১৮টি বিদ্রোহী সংগঠনের সদস্যরা একটি শান্তি সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়েছে। পক্ষান্তরে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সরকার কখনোই আলোচনায় বসার আগ্রহ দেখায়নি। চলমান এ পরিস্থিতিতে বিশ্বনেতারা নিছক দর্শক। তারা বিভিন্ন সময়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে নিজেদের দায়িত্ব আদায় করেছেন। অন্য কোন ধর্মের সংখ্যালঘুরা কোথাও নির্যাতিত হলে যাদের বুকে আগুন জ্বলে ওঠে, তারা আজ বিবৃতি দিয়েই ক্ষান্ত থাকছেন।
কফি আনানের নেতৃত্বে গত সেপ্টেম্বরে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। কমিশন রিপোর্ট পেশ করেছে, রাখাইন প্রদেশে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটে গেছে। ব্যস! এ পর্যন্তই। কমিশনের কাজ কমিশন করেছে; রিপোর্ট দিয়েছে হায়! তাই বলে কি ব্যবস্থা গ্রহণ পাশ্চাত্যের শোভা পায়?
মুসলিম বিশ্বের অবস্থাও ভিন্ন কিছু নয়। শাসক নাগরিক সবাই নিজেদেরকে অসহায় মনে করছে। আরব বিশ্ব শোক প্রকাশ করেছে। মালয়েশিয়া ও তুরস্কের মত কেউ কেউ অবশ্য কিছুটা কঠোর বাণী উচ্চারণ করেছে। কিন্তু শুধু মৌখিক কঠোরতা এসব হিংস্র বার্মিজদের টলাতে পারবে বলে মনে হয় না।
জানি, ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে আমার জাতির লাখ লাখ মানুষ। বিশেষ করে বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরে আছে কমপক্ষে দশ লাখ রোহিঙ্গা। কিন্তু আপনারাই বলুন, কারো আশ্রিত হিসেবে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেয়া কি কোন সমাধান?
মিয়ানমার নাকি বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদেরকে ফেরত নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এজন্যে বাংলাদেশ থেকে ৫০ হাজার রোহিঙ্গার একটা তালিকা গ্রহণ করেছে। ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়ার প্রক্রিয়ায় তালিকাই যদি তৈরি হয় মাত্র ৫০ হাজারের, তাহলে এই প্রক্রিয়ার সাথে মিয়ানমার সরকারের কতটুকু সদিচ্ছা জড়িত আছে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
এদিকে সেখানকার রোহিঙ্গারা গত ২৫ শে আগস্ট ২০১৯ তারিখে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে বিশাল এক দু‘আ জমায়েত করে ঘোষণা দিয়েছে- ‘নাগরিকত্ব নিশ্চিত না হলে ওরা রাখাইনে ফিরে আসবে না।’ বিষয়টা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সাথে সেখানকার আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সুস্পষ্ট একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের বক্তব্য হল- “আমরা চাইছি বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় বার্মা সরকার এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে। বাংলাদেশকে বিপদে ফেলা বা তাকে কোনপ্রকার চাপ প্রয়োগ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমাদেরকে বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে বলেই আমরা আজ কঠোরভাবে এই দাবী করতে পারছি। এই দাবী পুরণের ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে ফিরে গেলে তো হায়েনারা আবারও আমাদের ওপর ঝাপিয়ে পড়বে। তখন তো এই সামান্য আশ্রয়টুকুও কারো থেকে পাব না।”
আসলে বাংলাদেশের সাধ্যের কথা বিবেচনা করলে তারা যতটুকু করেছে যথেষ্ট করেছে। বাংলাদেশের সাধ্যেরও তো একটা সীমা আছে। আমাদের চরম বিপদের সময়ে তারা বুক উজাড় করে জায়গা দিয়েছে ঠিকই; কিন্তু তারা তো আর চিরদিনের জন্যে আমাদেরকে আশ্রয় দেয়নি। সেজন্যেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়ায় অসংখ্য সন্দেহজনক দিক লক্ষ করেও বাংলাদেশের কিছু মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবী চাইছে; যত তাড়াড়াড়ি সম্ভব রোহিঙ্গা নামক আপদকে বিদায় করতে। অন্যদিকে দেশের হৃদয়বান অসংখ্য মানুষ তাদের মাটিতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা ভাইদেরকে কোন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে না। মুসলিম ভ্রাতৃত্ব আর মানবতার যে রূপ দেখিয়ে তারা নিজেদের হৃদয়ের সীমান্ত খুলে দিয়েছিলো; এত সহজেই সে দরোজা তারা বন্ধ করতে চাইছে না।
এদিকে আমার রোহিঙ্গা ভাইয়েরা আছে দ্বিমুখী বিপদে। তারা নিজেদের ভিটামাটি ছেড়ে কতদিন আর উদ্বাস্তু হয়ে ঘুরবে? আবার এই বিপদের দাবানলে ফিরে এসেই বা কী করবে? ফিরে এলে হয়ত আবারও শিকার হবে বৌদ্ধ হায়েনাদের নারকীয় তাণ্ডবের, নয়ত কাটাতে হবে আমার মতো বন্দীজীবন।
হবে, একটা কবরের জায়গা?
যতই দিন যাচ্ছে নিরাশা আমাকে ততই চেপে ধরছে। সহিংস বৌদ্ধদের হিংস্রতার সকল সীমা ছাড়িয়ে গেছে। যেই আমি একসময় শত যুলুমের পরও এ মাটিকে আঁকড়ে থাকতে চেয়েছি, স্বজাতির অধিকার আদায়ে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করেছি, সেই আমার কাছেই এখন রোহিঙ্গাদের মুক্তি সুদূর পরাহত মনে হচ্ছে। ভয় হচ্ছে, বৌদ্ধ ভিক্ষুরা আমাদের শেষ রক্তবিন্দু পান করে তবেই দম নেবে।
আমি যে আশ্রয় শিবিরে আছি, সেখানের সবাই তো বন্দী। এর বাইরে মিয়ানমারের অন্যান্য স্থানে অল্পবিস্তর যেসব মুসলিম আছেন তারাও কিন্তু নিরাপদ নয়। তাদের ঘাড়ের ওপরও অহর্নিশ ঝুলছে মৃত্যুর পরোয়ানা।
জীবনের এই বেলাভূমিতে এসে আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। মন চাইছে সারা জীবনের ক্লান্তি শেষে কবরের শীতল বিছানায় একটু ঘুমাই।
তবে আমি চাই না আমার কবর এদেশে হোক। যে দেশের মাটি প্রতিনিয়ত আমার মুসলিম ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে, যালিমরা যেখানে নারীর ইজ্জত-আব্রু লুণ্ঠন করে পৈশাচিক উল্লাসে মেতে ওঠে, এমন দেশে আমি থাকতে চাই না। মৃত্যুর পরও এমন দেশে কবর হওয়ার কথা আমি ভাবতে পারি না।
তবে আমি জানি, মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশে হাজার হাজার বর্গমাইল জায়গা খালি পড়ে আছে। সেসব দেশের শাসকদের সামান্য ইচ্ছাতেই সকল রোহিঙ্গা ইজ্জত-আব্রু নিয়ে বাঁচতে পারে। শুধু তাই নয়; তারা এক নববর্ষ উদযাপনের জন্য যে অর্থ ব্যয় করে তা দিয়ে রোহিঙ্গাদের সারা জীবন অনায়াসে কেটে যাবে। যেহেতু রেহিঙ্গাদেরকে নাগরিক মর্যাদা দিয়ে ফেরত নেয়ার কোন ইচ্ছাই মিয়ানমারের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না, সেহেতু এসব মুসলিম ধনী রাষ্ট্রগুলো চাইলেই রোহিঙ্গাদের ইজ্জত-আব্রু হেফাজতের স্থায়ী সমাধানের ব্যবস্থা করতে পারে।
কিন্তু সবকিছু দেখার পরও সামর্থ্যবান মুসলিম দেশগুলো এই সদিচ্ছা প্রকাশ করছে না। তাই তাদের সামনে এই অযৌক্তিক (!) দাবী পেশ করে আমি লজ্জিত হতে চাই না। আমি শুধু এখন একটা কবর পরিমাণ জায়গা চাই।
কেউ আমাকে গ্রহণ না করুক, মাটি তো আমায় ফিরিয়ে দেবে না। কারো জন্য বোঝা না হয়ে শান্ত মাটির বুকে আমি শুয়ে থাকব অনেকদিন।
আছে কেউ, দেবে একটা কবরের জায়গা?