বাইতুল্লাহর কড়চা-২

মুফতী হাফিজুর রহমান


১৯.০৭. ১৯, শুক্রবার, কাবা প্রাঙ্গন

দিনগুলো কেমন কাটছে? উত্তর হলো, বেশ ভালো। তবে এ ভালোর দৈর্ঘ প্রস্থ নেই। তা পরিমাপ করাও সম্ভব নয়। অন্যসব ভালোগুলোর সাধারণত নিয়ন্ত্রণরেখা থাকে। কিন্তু এ জাতীয় ভালোলাগার নিয়ন্ত্রণরেখা থাকে না।

শুরুর দিকে প্রদক্ষিণব্রতে বেশি সময় ব্যয়িত হতো। এখন হারামের লাইব্রেরিতেই বেশি সময় কাটে। বেশ বড় সড় একটি গ্রন্থাগার।

আরবের লোকগুলোকে জিজ্ঞেস করে করে পাঠাগারটি উদ্ধার করা হয়েছে। যে গেট দিয়ে আমাদের নিয়মিত যাতায়াত সে কিং ফাহাদ গেটের সম্ভবত পঞ্চম তলায় গ্রন্থগারটি অবস্থিত।

আরবী গ্রন্থে ঠাসা বিশাল এক গ্রন্থাগার। ২৪ ঘণ্টাই উন্মুক্ত। হাতের নাগালে খেজুর-জমজম। নামাজ বাদে পুরোটা সময়ই এখানে পড়ে থাকা যায়। বইপোকাদের জন্য এক মধুর ক্যান্টিন।

বই-পুস্তকে পড়ে থাকার একটি মুদ্রদোষ কিংবা বাতিক আমার পূর্ব থেকেই ছিলো। তাই মন ভরে এখানে বইয়ের পাতায় পড়ে থাকার সুযোগ হচ্ছে।

নীরব নিস্তব্ধ ছিমছাম পরিবেশ। সেলফ থেকে বই নামাবার কষ্ট আছে। তুলে রাখবার কষ্ট নেই। নামাজের টাইমে টেবিলে রাখা বইগুলো জায়গামত চলে যাচ্ছে। বইটি টেবিলে রেখে যাবার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে আরবী বা ইংলিশ ভাষার ছোট্ট একটি কাগুজে নোটিশ বইয়ের উপর রেখে গেলেই ওটা ওখানে পড়ে থাকবে। নামাজ শেষে বইটিকে স্বস্থানে পাওয়া যাবে। নোটিশের ভাষাটা এমন হবে, ‘নামাজ শেষে আমি আবারো ফিরে আসছি।’

দেশ, জাতি, ধর্ম এবং ইহকাল-পরকাল সর্ব বিষয়কেন্দ্রিক এ্যারাবিক গ্রন্থের এক সমৃদ্ধ সম্ভার। অন্য ভাষার কিছু কিছু বই আছে বটে; কিন্তু সংখ্যায় বেশ নগণ্য।

মক্কার দিনগুলোর প্রধানতম একটি অংশ আমার এ পাঠাগারেই কাটছে। অজানার পরিধি কতোটা প্রলম্বিত ও বিস্তৃত সে সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা লাভ হচ্ছে।

বিধর্মীদের মাঝে দাওয়াতের কাজ করেন দাওয়াতুল ইসলামীর যুবায়ের ভাইয়ের সাথে প্রায়টা সময়ই দেখা হয়। মুহতারাম এখানে বেশ সময় দেন।

মাঝে তাওয়াফও চলে। উমরা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলোর নিবিড় পরিদর্শনও চলে সমান তালে।

বাইতুল্লাহর কোল ঘেষে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের স্মৃতি বিজড়িত অসংখ্য জায়গার অবস্থান। কিছু কিছু জায়গা চিহ্নিত থাকলেও অধিকাংশ জায়গাই নিশ্চিহ্ন। যেসব জায়গাগুলো চিহ্নিত তাতেও রয়েছে সংশয়ের উপাদান। যুগক্রমে সে সংশয় প্রলম্বিত হয়।

ঐতিহাসিক বর্ণনায় এসব জায়গাগুলো নিয়ে আছে দ্বৈত বিবরণ। প্রবল ধারণাকৃত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মস্থানটিতে একটি গ্রন্থাগার দাঁড়িয়ে আছে। এখানে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রিত। জায়গাটি বাইতুল্লাহর খুব সন্নিকটে অবস্থিত।

ওখানে একজন বাংলাদেশী শিক্ষার্থীর সাক্ষাত পেলাম। অনেক কথা হলো। সে উম্মুল কুরা ভার্সিটিতে লেখা পড়া করে।

হজ্ব মৌসুমে মক্কার কলেজ ভার্সিটিগুলো বন্ধ থাকে। হাজীদের নানামাত্রিক সেবায় শিক্ষার্থীদের নিয়োজিত করা হয়।

ছাত্রটির বাড়ি কিশোরগঞ্জ। জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মস্থান? তার সংক্ষিপ্ত উত্তর হলো, ‘ধারণা করা হয়’।

পাশেই চির ঘৃণিত আবু জাহেলের বাড়ি। এ বাড়িটির চমৎকার চিহ্নিত করণ প্রক্রিয়াটির জন্য সৌদি প্রশাসনকে ধন্যবাদ দিতে হয়। আবু জাহেলের বাড়িটির উপর সুবিস্তৃত একটি টয়লেট করে দেয়া হয়েছে। হজ্বপুণ্যার্থীরা প্রকৃতির কাজ এখানেই সম্পন্ন করেন। কেউ কেউ একটু ক্ষোভ ঝাড়ার স্বার্থে হলেও এখানে এসে মলমূত্র ত্যাগ করে যান।

মাঝে তায়েফ ঘুরে এলাম। পাহাড় চূড়ায় সবুজ শ্যামল চমৎকার একটি শহর। নীলিমা যেন মাথা ঝুঁকিয়ে তায়েফের ললাটে নিরন্তর চুমু এঁকে যায়। বৃষ্টপাতও হয় প্রচুর।

তায়েফের বিস্ময়কর সজীবতা আমাদের মুগ্ধ করেছে। চারদিকে পাহাড় পাথরের ধু-ধু প্রান্তর। তার মাঝে এক টুকরো সবুজের হাতছানি।

ওখানে মসজিদে আলী, মসজিদে আব্দুল্লা ইবনে আব্বাস, মসজিদে আদ্দাস, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রস্তারাঘাতে রক্তাক্ত করার কথিত চিহ্নিত জায়গা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাঁটার পথে কাটা বিছানোর কারিগর সেই কথিত বুড়ির বাড়ির ভগ্নাংশ প্রভৃতি দেখার সুযোগ হয়েছে।

বুড়ির বাড়ির জায়গা ও তার ঘটনার বাস্তবতা নিয়ে আমি বেশ সন্দিগ্ধ। তত্ত্বানুসন্ধানে বাস্তবতা বেরিয়ে আসবে। ইচ্ছে ছিলো বেদানা বাগানের ছায়ায় বসে তাজা বেদানার স্বাদ নেবো। যথার্থ পথনির্দেশকের অভাবে তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

হজ্বের আগে এক পলক হলেও মিনা, আরাফা, মুযদালিফা, ইসমাইল আ. এর জবাই পরীক্ষার জায়গা দেখার সুযোগ হয়েছে। টাইমিং করে আরাফায় নেমে খানিকটা পরিদর্শনের অবকাশ দেয়া হয়েছিলো।

সে ফাঁকে জাবালে আরাফায় চড়ে কিছুটা দেখার সুযোগ পেয়েছি। জাবালে সাওরেও খানিকটা সময় দেয়া হয়েছিলো। আবেগে আমরা কজন বেশ খানিকটা উঠে গিয়েছিলাম।

টিম ক্যাপ্টেন রাকিব ভাইয়ের ফোনে ব্যাক করতে হয়েছিলো। জাবালে নূরে নামার সুযোগ হয়নি। গাড়িতে বসেই দেখার সাধ মেটাতে হয়েছে। এতে মনের আবেগটাই উন্মাতাল হলো। এজেন্সির জিয়ারাহ-পরিদর্শন এমন অপরিপক্বই হয়ে থাকে।

একদিন খুব ঊষা বেলা তিনজন ছুটে গেলাম হেরা গুহায়। আমি, ভাই রাসেল ও জাহাঙ্গীর ভাই। প্রায় এক ঘণ্টা সময় পাহাড় বেয়ে মূল গুহাতে পৌঁছুতে সক্ষম হই। মাঝে তিন চারটে বিরতি দিতে হলো। এছাড়া বেশ কষ্টসাধ্য।

এখানে খাদিজা রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য খাবার পৌঁছে দিতেন। এখন পাহাড় কেটে খানিকটা সিড়ির মত করে দেয়া হয়েছে। তখন এ ব্যবস্থা ছিলো না। কতো না কষ্ট হয়েছে। ভাবতে গা শিউরে উঠে।

হেরা গুহার মূল ফটকে পৌঁছুতে শীর্ষ চূড়ায় উঠে কিছুটা নেমে যেতে হয়। এ পথটুকু বেশ ভয়ঙ্কর ও দুর্গম। পাহাড়টির খাঁদে খাঁদে পাকিস্তানী ভিখারীদের উপস্থিতিটা ভালো লাগেনি।

এ চিত্রটি বিশ্বের কাছে পাকিস্তানের ব্যাপারে একটি নেতিবাচক বার্তা তুলে দিচ্ছে। যারা অক্ষম, বিকলাঙ্গ তাদের ব্যাপারটা আপাত দৃষ্টিতে মেনে নেয়া যায়। কিন্তু অধিকাংশকেই দেখা গেলো সুস্থ সবল।

হেরা গুহা নিশ্চয় একটি ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত জায়গা। কিন্তু এ জাতীয় জায়গাগুলোর সাথে সাওয়াব পুণ্যের কোনো বিষয় জড়িত নেই।

গুহার ভিতর ও আশপাশ জুড়ে দেখা গেলো অসংখ্য জায়নামাজের ছড়াছড়ি। দর্শনার্থীরা এখানে নামাজ আদায়কে বাড়তি পুণ্যের কাজ মনে করছে। শুধু এতটুকুই নয়; অনেকে এ নামাজকে আবশ্যিক জ্ঞান করছে।

এ বিদাত ছড়াতে কতিপয় পাকিস্তানী জায়নামাজ ছড়িয়ে বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে। মূলত এর পেছনে অর্থের উপার্জনটাই মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।

পাশে উঁচু একটি পাথর খণ্ডের চূড়ায় কয়েকটি বাশ খণ্ডের মাথায় একটি ভাঙ্গা গম্বুজের উপরাংশ লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। শিরক বিদাতের আখড়া এভাবেই তৈরি হয়। খুব ইচ্ছা করছিলো, ওটাকে ভেঙ্গে দেই।

জাবালে নূরের মূল চূড়ায় নামাজের জন্য একটি জায়গা করা আছে। নামাজের সময় হয়ে গেলে যেন দর্শনার্থীরা নামাজ পড়ে নিতে পারে।

বেশ সুন্দর উদ্যোগ। আমি এমনিতেই ইচ্ছা পোষণ করে রেখেছিলাম, হেরা পর্বতে চড়ে ইশরাক পড়বো। তখন ওখানকার বিদাত মিশ্রিত নামাজ সম্বন্ধে আমার ধারণা ছিলো না।

আমি মূল চূড়ায় নামাজের জায়গা পেয়ে দু রাকাত ইশরাক পড়ে নিই। খানিক পর আমাদের এক সুহৃদ নামাজে দাঁড়াতে গেলে এক পাকিস্তানী এসে রীতিমত বাধা দেয়। বলে, এটা ফরজ নামাজের জায়গা। নফল পড়ার জায়গা ওই গুহায়।

আমি পাকিস্তানীর কাছে জানতে চাইলাম, আপনি কি বলতে চাচ্ছেন? সে বললো, নফল নামাজ হেরা গুহায় পড়তে হয়। আমি বললাম, আপনাকে কে বলেছে, ওখানে নামাজ পড়তে হয়? হেরা গুহায় কোনো নামাজ নেই।

এ কথা শুনে পাকিস্তানী মুরব্বী গোছের মানুষটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। ‘মুঝে মা’লুম নেহিঁ’ বলে কেটে পড়লো।

আগামী কাল ভোরে জাবালে সাওরে চড়ার ইচ্ছে আছে। এ পাহাড়টির উচ্চতা নাকি জাবালে নূরের প্রায় দ্বিগুণ। দেখা যাক কি হয়?

সৌদী প্রশাসনের লোকদের জিজ্ঞেস করে করে মাকবারায়ে মুআল্লার সন্ধান করেছিলাম। বাইতুল্লাহ প্রাঙ্গনে কাজ করে এক বাংলাদেশীকে জিজ্ঞেস করলাম, মাকবারায়ে মুআল্লা কোন দিকে? সে ভ্রু কুঁচকে বললো, এটা আবার কি? এ নাম তো জীবনে প্রথম শুনলাম।

পাশেই সৌদি প্রশাসনের বড় এক কর্মকর্তা বসা। তাকে জিজ্ঞেস করতেই চট করে বলে দিলেন। জিজ্ঞেস করলাম দূরত্ব কতটুকু? বলল, মাত্র দশ মিনিটের পথ।

তার দেখানো পথ ধরে চলে গেলাম মাকবারায়ে মুআল্লা। রাত বেশি হওয়ায় ফটক বন্ধ পেলাম। সে রাতে আর প্রবেশের সুযোগ হয়নি।

বস্তুত আমরা উপমহাদেশের মানুষ মাকবারায়ে মুআল্লা চিনি না। আমরা চিনি জান্নাতুল মুআল্লা। অথচ আরবের লোকগুলো জান্নাতুল মুআল্লা চিনে না; চিনে মাকবারাতুল মুআল্লা । অনেক আরবকে জিজ্ঞেস করেছি, ‌লা আ’লামু বলে অক্ষমতা প্রকাশ করেছে। আরবী ঐতিহাসিক সূত্রগুলোতেও মাকবারাতুল মুআল্লার সন্ধান পাওয়া যায়; জান্নাতুল মুআল্লার সন্ধান পাওয়া যায় না।

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *