নবী চরিত্রের কিছু দিক

হযরত আয়িশা রা. কে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্র মাধুরী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো। তিনি বললেন, তাঁর চরিত্র ছিলো সম্পূর্ণ কুরআন (-এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ) কুরআন রাগান্বিত হলে তিনিও রাগান্বিত হতেন, কুরআন সন্তুষ্ট হলে তিনিও সন্তুষ্ট হতেন।

ব্যক্তিগত কারণে বদলা নিতেন না, রাগও করতেন না। তবে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য হলে ভিন্নকথা। তখন আল্লাহর জন্য রাগ করতেন।

নবীজী রাগ করলে… তাঁর রাগের সামনে কেউ দাঁড়াতোনা।

তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ সাহসী। চূড়ান্ত পর্যায়ের বদান্য ও দানশীল। তার কাছে কিছু চাওয়া হলে কখনই ‘না’ করতেন না।

একরাতের জন্যও তিনি ঘরে কোনো দিনার-দিরহাম জমা রাখতেন না। এমনও দেখা যেতো- কিছু জিনিস বেঁচে গেছে। বেঁচে যাওয়া বস্তু নেয়ার মতো কাউকে এখনো পাওয়া যায়নি। এদিকে রাত হয়ে এসেছে; কিন্তু নবীজী কোনো মুখাপেক্ষীকে সেটি দান করে দায়িত্বমুক্ত না হয়ে ঘরে ফিরছেন না।

আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদ থেকে তিনি নিজ পরিবারের জন্য এক বছর পরিমাণ খেজুর, যব ইত্যাদি খাদ্যসামগ্রী গ্রহণ করতেন।  এরপর আবার সেই সামগ্রী থেকেও অন্যদের জন্য ব্যয় করতেন। ফলে দেখা যেতো, বছর শেষ হওয়ার আগেই তাঁর পরিবার খাদ্য সংকটে পড়ে গেছে।

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানব জাতির মধ্যে সর্বোচ্চ সত্যভাষী। পরিপূর্ণভাবে দায়িত্ব আদায়কারী। স্বভাবে সবচেয়ে কোমল। আচরণে সবচেয়ে মহান।

সবচেয়ে সহনশীল ও লাজুক মানুষ। । তার লজ্জা ছিলো পর্দার আড়ালের কুমারী কন্যা থেকেও বেশি।

আনত নয়ন। আকাশের তুলনায় জমিনের দিকেই দৃষ্টি থাকতো বেশি। দৃষ্টিপাতের জন্য অধিকাংশ সময় চোখের পলক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকাতেন। 

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানবজাতির মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের বিনয়ী। ধনী-গরীব, স্বাধীন-গোলাম যেই তাঁকে ডাকতো, তিনি সাড়া দিতেন।

তিনি ছিলেন অত্যাধিক দয়াবান; বিড়াল পান করে পরিতৃপ্ত হওয়া পর্যন্ত তিনি তার সামনে পানির পাত্র ঝুঁকিয়ে রাখতেন। বিড়ালের মতো প্রাণীর প্রতি এমনই ছিলো তাঁর দয়া।

নবীজী ছিলেন অত্যন্ত ক্ষমাশীল। সাহাবায়ে কিরামের প্রতি অনেক বেশি মর্যাদা প্রদর্শন করতেন। তাঁদের সামনে পা ছড়িয়ে বসতেন না। স্থানসংকীর্ণ থাকলে নবীজী সাহাবায়ে কিরামের জন্য জায়গা করে দিতেন। নবীজীর হাঁটু সঙ্গীদের হাঁটু থেকে সামনে বেড়ে থাকতো না। নবীজীকে হঠাৎ কেউ দেখলে সে প্রভাবান্বিত হয়ে পড়তো। তাঁর সাথে মেলামেশা করলে আন্তরিকতা তৈরি হয়ে যেতো। তাঁর কিছু সঙ্গী ছিলো যারা তাকে বেষ্টন করে রাখতেন। তিনি কিছু বললে কান লাগিয়ে শুনতেন, তিনি কোনো আদেশ করলে তা পালনে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তেন। যার সাথেই দেখা হতো, নবীজী আগে সালাম দিতেন।

নবীজী তাঁর সাহাবাদের প্রতি সংযমী আচরণ করতেন। তাঁদের খোঁজ-খবর রাখতেন। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দেখতে যেতেন। কেউ অনুপস্থিত থাকলে তাকে ডাকাতেন। কেউ মৃত্যুবরণ করলে ইন্নালিল্লাহ পড়তেন এবং তার জন্য দু‘আ করতেন।

যদি কারো ব্যাপারে আশঙ্কা হতো যে তার মনে কোনো কষ্ট আছে, নবীজী তার কাছে চলে যেতেন এমনকি তার বাড়িতে উপস্থিত হতেন।

তিনি সাথী-সঙ্গীদের বাগানে যেতেন। তাদের দাওয়াত কবুল করতেন। সজ্জন ব্যক্তিদের হৃদ্যতার সাথে গ্রহণ করতেন। সম্মানীকে সম্মান করতেন। সবার সাথে উৎফুল্ল থাকতেন। কারো সাথে মুখ মলিন করে থাকতেন না। তাঁর কাছে কেউ ওজর পেশ করলে তা কবুল করতেন। হকপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সবল ও দূর্বল তাঁর কাছে সমান ছিলো।

নবীজী কাউকে নিজের পেছনে রেখে চলতেন না। বলতেন, আমার পেছনটাকে ফেরেশতাদের জন্য ছেড়ে দাও। নিজে সওয়ারী হয়ে কাউকে সাথে হাঁটতে দিতেন না। বরং তাকেও উঠিয়ে নিতেন। সে উঠতে না চাইলে বলতেন, তুমি আমার আগে বেড়ে যেখানে যেতে চাইছ চলে যাও।

নবীজী নিজের খাদেমদেরও সেবা করতেন। তাঁর কয়েকজন খাদেম ছিলো। তিনি তাদের তুলনায় উত্তম খানাপিনা করতেন না। তাদের তুলনায় উত্তম পোষাক পরতেন না।

আনাস রা. বলেন, আমি দশ বছর নবীজীর খেদমত করেছি। আল্লাহর শপথ! আমি সফরে বা লোকালয়ে যখনই খেদমত করার জন্যে তাঁর সাথে থেকেছি.. আমি তাঁর খেদমত যতটুকু করতে করতে পেরেছি, সে তুলনায় তিনিই আমার খেদমত করেছেন বেশি। কখনই তিনি আমাকে উফ শব্দটিও বলেন নি। আমার কোনো কাজের কারণে বলেন নি ‘এটা কেন করেছ? আমি কোনো কাজ না করে থাকলে বলেন নি ‘এটা কেন করলে না?’

নবীজী একবার এক সফরে ছিলেন। সেখানে একটি বকরীকে খাবার উপযোগী করতে আদেশ করলেন। একজন বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি এটাকে জবাই করবো। অন্যজন বললো, আমি এর চামড়া ছিলবো। আরেকজন বললো, আমি রান্না করবো। নবীজী বললেন, আমি লাকড়ি যোগাড় করবো। সাহবায়ে কেরাম বললেন ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরাই তো যথেষ্ট। আপনার কাজ করার দরকার নেই।

নবীজী বললেন, ‘আমি জানি যে তোমরাই যথেষ্ট। কিন্তু আমি তোমাদের মধ্যে নিজেকে আলাদা করে রাখতে পছন্দ করি না। কারণ, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে কাউকে তার সাথীদের মধ্যে আলাদা দেখতে অপছন্দ করেন। এই বলে নবীজী দাঁড়ালেন এবং লাকড়ি জমা করলেন।

আরেকবার নবীজী এক সফরে ছিলেন। সেখানে নামাযের জন্য নেমে আবার ফিরে চললেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ, কোথায় যাচ্ছেন? তিনি বললেন, আমার উটনীকে বাঁধব। তারা বললেন, আপনার দরকার নেই, আমরাই সেটাকে বেঁধে দিচ্ছি। নবীজী বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যেন (একান্ত প্রয়োজন ছাড়া) মিসওয়াক তুলে দেওয়ার (মতো সামান্য) কাজেও মানুষের সাহায্য গ্রহণ না করে।’

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক উঠাবসায় আল্লাহর যিকর করতেন। যখন কোনো মজলিসে যেতেন মজলিসের শেষপ্রান্তে বসে যেতেন এবং অন্যদেরও এমনটা করতেই আদেশ করতেন।

মজলিসের প্রত্যেককে নবীজী প্রাপ্য সম্মান দান করতেন। তাঁর মজলিসের প্রত্যেকেই অনুভব করতো যে, সেই নবীজীর কাছে বেশি সম্মানিত।

নবীজীর কাছে যখন কেউ বসতো, সে দাঁড়ানোর আগ পর্যন্ত নবীজী দাঁড়াতেন না। তবে যদি কোনো বিষয়ে তাড়াহুড়া থাকতো তাহলে ভিন্ন কথা। সেক্ষেত্রে তার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নিতেন।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কারো সাথে মন্দ আচরণ করতেন না। এবং তিনি মন্দ আচরণের বিপরীতে মন্দ আচরণ করতেন না। বরং ক্ষমা প্রদর্শন করতেন।

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যেতেন। নিঃস্বদের মহব্বত করতেন। তাদের সাথে বসতেন। তাদের জানাযায় শরীক হতেন। কোনো দরিদ্রকে তার দারিদ্রের জন্য তুচ্ছ জ্ঞান করতেন না। আবার কোনো প্রতাপশালীকে তার প্রতাপের কারণে ভয়ও করতেন না।

নেয়ামত সামান্য হলেও বড় মনে করতেন। কোনোটার নিন্দা করতেন না। যদি কখনো কোনো খাবার খারাপ মনে হতো, মন চাইলে খেতেন অন্যথায় রেখে দিতেন।

নবীজী তার প্রতিবেশীদের অধিকারের হেফাজত করতেন। মেহমানকে সম্মান করতেন। মুচকি হাসির ক্ষেত্রে ছিলেন অদ্বিতীয়। প্রফুল্লতার ক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ।

এক মুহূর্ত সময়ও তিনি ইবাদত বা অতি প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া ব্যয় করতেন না। কখনো তাকে দু’টি বিষয়ের মধ্যে যেকোনো একটিকে গ্রহণ করতে বলা হলে তিনি সহজটিকেই গ্রহণ করতেন।

তবে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নের মতো বিষয় হলে তা থেকে তিনি সর্বোচ্চ দূরে থাকতেন।

নিজেই জুতা সেলাই করতেন। নিজের পোষাকে তালি লাগাতেন।  ঘোড়া, খচ্চর এবং গাধায় আরোহণ করতেন। নিজের পেছনে নিজের গোলাম বা অন্য কাউকে বসাতেন।

নিজের ঘোড়ার মুখ জামার হাতা বা চাদরের প্রান্ত দ্বারা মুছে দিতেন।

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুভ লক্ষণ পছন্দ করতেন। কুলক্ষণ পছন্দ করতেন না।

নিজের পছন্দনীয় কিছু সামনে এলে বলতেন-

الحمد لله رب العلمين

সকল প্রশংসা আল্লাহর। অপছন্দীয় কিছু এলে বলতেন-

الحمد لله على كل حال

সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রশংসা। যখন তার সম্মুখ থেকে খাবার তুলে নেওয়া হতো, তিনি পড়তেন-

الحمد لله الذي أطعمنا، وسقانا، وآوانا، وجعلنا من المسلمين

সকল প্রশংসা সেই সত্ত্বার যিনি আমাদের খানা খাইয়েছেন, পান করিয়েছেন, আমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছেন এবং আমাদেরকে মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

নবীজী বেশির ভাগ সময় কেবলামুখী হয়ে বসতেন। অধিকহারে যিকর করতেন। দীর্ঘ সময় নামায পড়তেন। বক্তব্য সংক্ষেপ করতেন।

একেক মজলিসে শত বার আল্লাহর ইস্তেগফার করতেন।

নবীজী যখন নামাযে থাকতেন তখন তার বুক থেকে ক্রন্দনের কারণে ডেগচির ভেতরকার আওয়াজের মতো টগবগ আওয়াজ বেরুত।

নবীজী সপ্তাহের সোমবার এবং বৃহস্পতিবার এবং প্রতিমাসের তিনদিন ও আশুরার রোজা রাখতেন।  বেশিরভাগ শুক্রবারেও রোজা রাখতেন।  শা’বান মাসে তার রোজার সংখ্যা হতো প্রচুর।

নবীজীর চোখ ঘুমাতো কিন্তু তার অন্তর ওহীর অপেক্ষায় জেগে থাকতো।

যখন ঘুমাতেন শ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজ হতো কিন্তু নাক ডাকতেন না।

ঘুমের মধ্যে কোনো অপছন্দনীয় বিষয় দেখলে পড়তেন,

هو الله لا شريك له

তিনিই আল্লাহ যিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই।

বিছানায় শুয়ে পড়তেন,

رب قني عذابك يوم تبعث عبادك

হে আমার রব, আমাকে হাশরের দিনের আযাব থেকে রক্ষা করো।

ঘুম থেকে উঠে পড়তেন,

الحمد لله الذي أحيانا بعد ما أماتنا وإليه النشور

সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি আমাদেরকে মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত করেছেন আর আমাদেরকে তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তন করতে হবে।

-নূরুল উয়ূন, ইবনু সায়্যিদিন নাস, পৃষ্ঠা: ৪৮-৫৯

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *