মুফতি হাফিজুর রহমান
লালমাই পাহাড়ের চূড়ায় এক দিন
একসময় চোখের তারায় ভেসে উঠে এক চিলতে লালমাই পাহাড়। দূর থেকে পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা খাখা লালিমা স্পষ্ট দেখা যায়। লালমাই পাহাড়ের পুরোটাই লাল মাটি দিয়ে তৈরি। এ পাহাড়ের গায়ে লেগে আছে আমার এক টুররো মধুর স্মৃতি। ২০০৬ কি ৭ হবে। ছোট্ট বেলার খেলার সাথী আসাদের সাথে কি একটা প্রয়োজনে এসেছিলাম কুমিল্লায়। এক রাত থেকে পর দিন ফেরার পথে নেমে পড়ি লাল মাইয়ের কোলে। মনের মত করে ঘুরে বেড়াই লালমাই পাহাড়। দীর্ঘ দুই থেকে তিন ঘন্টা কেটে যায় আমাদের লালমাইয়ের টিলায়। ইচ্ছে মত করে চষে বেড়াই লালমাইয়ের উঁচু নিচু জমিন। এ পাহাড় হতে ও পাহাড় এ টিলা হতে ও টিলা করে একসময় হাঁপিয়ে উঠি আমরা দুজন। লালমাইয়ের সবচে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় চড়ে ফুরফুরে বাতাসে প্রাণ জুড়িয়েছি। জায়গাটা আমাদের ভীষণ ভাল লেগেছিল। ভূস্বর্গ বলতে পারি নির্দ্বিধায়। এ চূড়াটিতে বহু বছরের পুরনো একটি মন্দির রয়েছে। একটু খানি জায়গা। তিন পাশে খাড়া গভীর। এক পাশে উপরে উঠার জন্য একটুখানি সরু জায়গা। চার দিকে আম জাম আর পাহাড়ী গাছের সমাহার। লালমাইয়ের শেষ সীমানায় চূড়াটি দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে। নিচ থেকে তাকালে শিরাচ্ছদন পড়ে যাবার সম্ভাবনা। আশ পাশের পাহাড়গুলো হতে সবুজের আবরণ ছাপিয়ে সহজেই চোখে পড়ে লাল সাদা সুন্দর মন্দিরটি। এক দিকে সবুজ গ্রাম। মনে হয় অনেক নিচে গ্রামটি পড়ে আছে। সড়ক পথে হেঁকে চলা বাস ট্রাকগুলোকে ছোট ছোট খেলনা গাড়ি বলে মনে হয়। চার পাশ জুড়ে চিকন দেয়ালের বেষ্টনি। এক পাশে দোকানের মত করে তোলা ছোট্ট দোতলা গাথুনি। অপর পাশে ছাদ করা ছোট্ট মিলনায়তন। বেশ সুন্দর পরিপাটি। দূরদূরান্ত থেকে হিন্দু মানুষের আনাগোনা চোখে পড়ছে। পর্যটকরা আসে জায়গাটা উপভোগ করতে। তখন বসন্ত কাল। ফুরফুরে বাতাসে হৃদয় মন উন্মত্ব উতাল। দখিনা হাওয়ার প্রচণ্ডতায় গায়ের কাপড় পত পত করে উড়ছে। দক্ষিণ দিকের দেয়ালটাতে গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসি। হু হু বাতাসের তীব্র প্রবাহে স্থির বসে থাকাটা বেশ দুরূহ হয়ে পড়ে। পাতায় পাতায় ঘর্ষণ লেগে কাল বৈশাখি ঝড়ের মত প্রচণ্ড শব্দ হয়। মহামহিমের এ অপরূপ জায়গাটা কিছু ভিন বিশ্বাসী মানুষের হাতে বন্দি। সুন্দর একটি জায়গায় অসুন্দর একটি মূর্তিঘর জগদ্দল পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে হাতে গড়া ছোট্ট একটি মূর্তি। প্রাণহীন এ জিনিসটার হাতে পায়ে গলায় নাকে কানে স্বর্ণ রূপা আর মণি মুক্তার অভাব নেই। কোটি টাকার সম্পদ গায়ে জড়িয়ে নিস্প্রাণ দাঁড়িয়ে আছে। আর সামনে পড়ে আছে কাগজি টাকার স্তুপ। আর দূর থেকে ছুটে আসা মূর্তি পুজারি মানুষগুলোর ভোগ উপহারের তো অন্ত নেই। হাট বাজার আর খেত খামারের সবচে সুন্দর ফলগুলো নিস্প্রাণ দেহটার সামনে হাজির। নিজ হাতে গড়া জিনিসটার এত কদর! মুখ আছে। বলে না। কান আছে। শুনে না। পা আছে। চলে না। হাত আছে। নড়ে না। এও আবার ঈশ্বর। এও আবার স্রষ্টা। হায়রে বিবেক! হায়রে বুদ্ধি!!
নেপালের একটি মসজিদে জর্ডানের এক মুসলিম যুবকের সামনে দুজন হিন্দু যুবক যুবতী প্যান্ট শার্ট গেঞ্জি পরে বসেছিল। মুসলিম যুবকটি তাদের জিজ্ঞেস করল, তোমরা এখানে কেন এসেছো? ওরা বলল পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম; তো উপাসনালয়টি দেখে ভিতরে ঢোকার খুব ইচ্ছে হল।
মুসলিম যুবক : তোমাদের কেমন লাগছে?
হিন্দু যবক যুবতী : খুব ভাল লাগছে। কোথও কোন ছবি নেই, মূর্তি নেই। নীরব নিঝুম ছিমছাম। কেউ নামায পড়ছে। কেউ কুরান পড়ছে। অজানা এক ভাল লাগা আমাদের মোহিত করে তুলছে।
ক : তোমাদের একটা কথা বলি। মাইন্ড করো না। তোমরা মূর্তি পুজা কর। মূর্তি তোমাদের ঈশ্বর। তাই না?
খ : হ্যাঁ।
ক : কিন্তু তোমরা খেতে পারো; তাঁরা খেতে পারে না। তোমরা বলতে পারো; তাঁরা বলতে পারে না। তোমরা চলতে পারো; তাঁরা চলতে পারে না। এ কেমন ঈশ্বর হল বলো তো!
খ : নিরুত্তর হল এবং প্রশ্ন করল, আপনারা যাকে পুঁজা করেন তাঁকে তো দেখেন না। যে ঈশ্বরের পুঁজা করা যাবে অথচ দেখা যাবে না; এ কেমন ঈশ্বর?
ক : তোমাদের কি বুদ্ধি আছে?
খ : হ্যাঁ! আছে বলেই তো আপনার সাথে কথা বলছি।
ক : আমি বলি তোমাদের বুদ্ধি নেই। থাকলে দেখাও। যা দেখি না তা বিশ্বাস করি না।
খ : নির্বাক।
ক : তাদের একজনের হাতে ছোট্ট একটি চিমটি কেটে দিল।
কি ব্যথা পেলে?
খ : হ্যাঁ, পেলাম তো!
ক : তুমি মিথ্যা বলেছো। কোথায় তোমার ব্যথা দেখাও। যা দেখি না তা বিশ্বাস করি না।
খ : ফ্যাল ফ্যালে চোখে তাকিয়ে আছে।
ক : মনে রেখো। মানুষের অদেখা বুদ্ধি এবং ব্যথা সত্য হলে আমার অদেখা প্রভুও সত্য।
বস্তুত হিন্দু কোনো ধর্মের নাম নয়। হিন্দু একটি বিশেষ জনবসতির নাম। এ বসতিতে যারা বসবাস করে তাদেরকে হিন্দু বলা হয়। এ ধর্মের নাম হলো সনাতন। ইতিহাস পাঠে হিন্দুধর্মের সঠিক গোড়াপত্তন সময়টা পাওয়া যায় না। তবে ও পি ঘাই (ভারত) তার ‘মিলন’ নামক গ্রন্থে বলেন, খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ হতে ২০০০ বৎসরের মধ্যে হিন্দুধর্মের গোড়াপত্তন ঘটে। আবু রায়হান মুহাম্মদ বিন আহমদ আলবিরুনী তার ‘তাহকীকু মা লিলহিন্দ মিন মাকুলাতিন মা’কবুলাহ ফিল আকল আউ মারযুলাহ’ (ভারত তত্ত্ব) গ্রন্থে বলেন, ৪৫০০ পূর্বে এ ধর্মের গোড়াপত্তন ঘটে। আলবিরুনীর তত্ত্বপূর্ণ এ গ্রন্থটিতে হিন্দু ধর্ম সম্বন্ধে বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য রয়েছে। কৌতুহলী পাঠক বইটি পাঠ করে দেখতে পারেন।
হিন্দু ধর্ম কি সত্যিই বহুশ্বেরবাদকে স্বীকার করে ? এ সম্পর্কে অধ্যাপক ড. বেদ প্রকাশ উপাধ্যায় বলেন, ‘ঋগ্বেদে বিশ্ব-চরাচরে পরিব্যাপ্ত ঈশ্বরের বর্ণনা বহুরূপে প্রদান করা হইয়াছে। ইহার ফলে অনেকে বহু দেববাদের প্রতিবাদন করত ঋগ্বেদকে বহু বেদবাদী গ্রন্থ বলিয়াছেন। আবার অনেকে ঋগ্বেদে উল্লেখিত বিভিন্ন নাম এবং বিভিন্ন গুণাবলী দেখিয়া একাধিক দেবতার কল্পনা করিয়াছেন। ইহা ঋগ্বেদের অন্তর্নিহিত তত্ত্ব সম্পর্কে তাহাদের অজ্ঞতার ফল। প্রকৃতপক্ষে সত্বা এক; এবং তাহার বিভিন্ন গুণের বিভিন্ন বর্ণনা প্রদত্ত হইয়াছে।
ঋ, বে, ম, ১০/সু ১১৪/ম, ৫ বেদান্ত ঘোষণা করা হইয়াছে যে, ‘একং ব্রহম দ্বিতীয়ং নাস্তি, নেহ নানাস্তি কিঞ্চন’। অর্থাৎ পরমেশ্বর এক, তিনি ব্যতীত কেহ নাই। [ধর্মাচার্য অধ্যাপক ড. বেদ প্রকাশ উপাধ্যায় : কল্কি অবতার এবং মোহাম্মদ সাহেব, ইসলামী সাহিত্য প্রকাশনালয় ৪৫, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০, ২০১৪, পৃষ্ঠা ৮১]।
মূর্তিপূজা কি হিন্দু ধর্মে স্বীকৃত ?
হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ‘কল্কি পুরাণ’-এ কল্কি অবতারের বৈশিষ্ট তুলে ধরা হয়েছে এভাবে :
বেদা ধর্মঃ কৃতযুগং দেবা রোকাশ্চরাচরাঃ।
হৃষ্টাঃ পুষ্টাঃ সুসংতুষ্টা কল্কৌ রাজনী চাভবন।।
নানা দেবাদি লিঙ্গেষু ভূষণৈর্ভূষিতেষুচ।
ইন্দ্রাজালিকবদ্ বৃত্তিকল্পকাঃ পূজকা জনাঃ। ।
ন সন্তি মায়া মোহাঢ্যাঃ পাষণ্ডাঃ সাধুবহআঃ।
তিল্কাচিত সর্বাঙ্গাঃ কল্কৌ রাজনি কুত্রাচিৎ।।
অর্থ : তিনি রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হইলে বেদ, ধর্ম, কৃতযুগ, দেবগণ, স্থাবর জঙ্গমাত্মক নিখিল জীব সকলেই হৃষ্টপুষ্ট ও সুপ্রীত হইবেন।
পূর্বযুগে পূজক দ্বিজাতিরা নানাবিধ অলঙ্কার দ্বারা অলঙ্কৃত দেবমূর্তিসমূহে ইন্দ্রজালিকবৎ ব্যবহার করিয়া সকলকে মোহিত করিত, তাহা দূর হইবে।
কল্কি রাজপদে প্রতিষ্ঠিত হইলে কুত্রাপি তিলকাঙ্কিত-সর্বাঙ্গ মায়া- মোহবিষ্ট সাধু বঞ্চক পাষ- দৃষ্ট হইবে না। (কল্পিক পুরাণ, ৩য় অংশ ষোড়শ অধ্যায়)। কল্কি আগমন করিয়া নানা অলঙ্কারে অলঙ্কৃত মূর্তি পূজাকে রহিত করিবেন এবং তাঁহার যুগে সর্বাঙ্গ তিলকাঙ্কিত সাধু সন্নাসী কুত্রাপি দৃষ্ট হইবে না। করণ তিনি সন্ন্যাস ধর্মকেও রহিত করিবেন। সুতরাং মূর্তিরূপী কল্কির অন্বেষণ করা বাতুলতা মাত্র। [ধর্মাচার্য অধ্যাপক ড. বেদ প্রকাশ উপাধ্যায় : কল্কি অবতার এবং মোহাম্মদ সাহেব, ইসলামী সাহিত্য প্রকাশনালয় ৪৫, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০, ২০১৪, পৃষ্ঠা ১১৮]।
সুন্দর এ জায়গাটা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না। দীর্ঘ একটা ঘন্টা মাতামাতি আর আনন্দ উৎসব করে এখান থেকে বিদায়ের পথে পা বাড়াই। দুটো পাহাড় ডিঙ্গিয়ে যখন নিচে নেমে এলাম তখন খুব তেষ্টা পেয়েছে আমার। মনে মনে এক ফোঁটা পানি অনুসন্ধান করছিলাম। মুহূর্তেই পাহাড়ি ভূমিটা আমার জন্য কারবালার প্রান্তরে রূপ নেয়। কোথও কোনো পানির চিহ্ন নেই। দুচোখের সীমানায় কোনো পাহাড়ী জনবসতি দেখা যাচ্ছে না। আমরা উদ্ভ্রান্ত হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। আচমকা পেছনে তাকিয়ে দেখি ঘনসবুজের ফাঁক গলিয়ে মানুষের মাথার মত কাল একটা জিনিস দেখা যাচ্ছে। ধরে প্রাণ ফিরে পেলাম। এই নির্জন নিরালায় নিঝুম বনে তৃষিত দুটি হৃদয় আলোর ইশারা দেখতে পেল। ভাবলাম ও মানুষটার কাছে গেলে হয়ত এক আঁজলা পানির সন্ধান মিলবে। দুরু দুরু বুকে ওদিকটায় এগিয়ে যাই। দেখি মাঝারি বয়সের একজন মানুষ বসে বসে বাঁশ থেকে চটি খসাচ্ছে। পাশেই একটা মাটির ঘর। খেটে খাওয়া মানুষটার সাথে ছোট খাট একটা সংলাপ হল। মাটির ঘরের পাশেই একটা জলকল বসানো। দেখে প্রাণটা শীতল হয়ে এল। দুজন অপরিচিত মানুষ দেখে মাটির ঘর থেকে ছোট্ট একটি পাহাড়ি মেয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসে। আমি কাছে ডেকে বললাম, মামুনি তোমাদের ঘরে কি পানি খাবার গ্লাস আছে? একটা গ্লাস এনে দাও তো! আমরা পানি খাবো। মেয়েটা দৌঁড়ে গিয়ে একটা গ্লাস নিয়ে আসে। আমরা মন ভরে পানি পান করলাম। পাহাড়ি পানি! আহ কত শীতল!! কত মিষ্ট!!! দেহ মন নিমিষেই চাঙ্গা হয়ে উঠল। গ্লাস ধরিয়ে দেয়ার সময় খুকিটাকে বললাম একটু দাঁড়াও। লাজুক মেয়েটা দৌঁড়ে চলে গেল। ভেবেছিলাম ওর হাতে ছোট্ট একটা নোট তুলে দিয়ে ওর প্রাণটাও জুড়িয়ে দেব। তা আর হল না। এরপর আমরা উঁচু নিচু পাহাড় বেয়ে সামনের দিকে পা বাড়াই। কখনো পথ হারিয়ে গভীর বনে চলে যাই। পাহাড়ি মানুষকে জিজ্ঞেস করে করে আবার পথ খুঁজে পাই। এভাবে দুর্গম গিরিপথ মাড়িয়ে এক সময় ময়নামতি গ্যাস ফিল্ডে এসে যাত্রা বিরতি করি। গ্যাস মাঠটার উপরে দৃষ্টি বুলালাম। চার দিকে কাটা তারের হালকা বেষ্টনি। মাঠ জুড়ে সবুজ ঘাসের ছড়াছড়ি। মাঝখানটায় একটা গভীর গর্ত। পাশে মাটির স্তুপ। গর্ত থেকে হালকা ধোঁয়ার মত বেরুচ্ছে। মাঠের একদিকে ছোট্ট একটি প্রহরী চৌকি। পাশে একজন পুলিশ বসে বসে ঝিমুচ্ছে।
এখন এখানে গ্যাসের উত্তোলন হয় না। মাঠটাকে দুচোখ দেখে বিদেয় জানালাম লালমাইকে, লালমাইয়ের পাহাড়গুলোকে এবং পাহাড়গুলোর গায়ে বিছানো ঘন সবুজকে। পা বাড়ালাম সুদূর আপন ঠিকানায়।
সেকেন্ডের কাটায় এগিয়ে চলছে আমাদের গাড়ি। হৃদয়ের জানালা খুলে দু চোখ ভরে দেখছি আমার বাংলার অপরূপ শ্যামলিমা। হঠাৎ রাস্তা ঘেষা দিগন্ত জোড়া সুফলা জমিতে দেখতে পেলাম অনিন্দ্য সুন্দর সীমের আবাদ। শুকনো বাঁশের চটি কেটে ফাঁক ফাঁক করে পুতে দেয়া হয়েছে ক্ষেত্র জুড়ে। তার সাথে ঝাঁকড়া চুলের মত করে জড়িয়ে আছে সীমের লতা পাতা। ঠনঠনে শুকনো মাটি। তবু কি সজীব কি সতেজ সীম, সীমের লতা, সীমের পাতা! দূর থেকে মনে হয় ক্ষেত জুড়ে ছোট ছোট দেবদাড়ু গাছ সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে বেশ চমৎকার লাগছে। আমরা সবাই চোখ মেলে দেখছি অপরূপ সীম লতার সুন্দর সমারোহ।
আমার দেশের মাটি সোনার চেয়ে খাটি। এ মাটিতে সোনা ফলে। রূপো ফলে। এ আমার জন্মভূমি। পাখি ডাকা ছায়া ঢাকা আমার মাতৃভূমি। সবাই বলি আমার বংলাদেশ। হ্যা বংলাদেশ আমার আমাদের। কিন্তু আমরা বংলাদেশের হতে পারি নি। আমরা সুন্দর এ মানচিত্রটাকে শকুনের মত ছিড়ে ফেড়ে খাই। বাংলাদেশ আমাদের অনেক কিছু দেয়। বিনিময়ে আমরা বাংলাদেশকে দেই হায়েনার হাসি, পথের ধারে পড়ে থাকা মাথার খুলি, পাঁজড়ের হার, ছোপ ছোপ রক্ত, রক্তের দাগ আর ক ফোঁটা অশ্রুজল।
এ মাটিতে সোনা রূপা গিজ গিজ করে। তুলতে পারি না। ফলাতে পারি না। যা-ও ফলে লুটে পুটে খাই। পেশি জোরে উদর পূর্তি করি। রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হই।
প্যারিসের এক রেল ষ্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে বংলাদেশী এক দম্পতি। হাতে তাদের বহুদেশীয় রেল টিকিট। এ টিকিটে ইউরোপের যে কোনো দেশে যাওয়া যাবে। এ টিকিট খুব উঁচু লেভেলের টিকিট। ইউরোপের উপরস্থ ব্যক্তি কর্তা ছাড়া এ টিকিট কেউ কিনে না। কিনতে পারে না। যুগল বন্দীর হাতে এ টিকিট দেখে এক ফরাসী যুবক কপাল কুঁচকে চোখ দুটো ছানাবড়া করে তাকিয়ে আছে। এত দামী টিকিট এদের হাতে! এরা না বাংলাদেশী! গরীব দেশের মানুষ!! শেষে লোকটি দুঃখ করে বলল, এদেশের বিশ পার্সেন্ট মানুষ আশি পার্সেন্ট মানুষকে চুষে খায় এবং দেশ বিদেশে আমোদ ফূর্তি করে বেড়ায়। কথাটা এতটুকু মিথ্যে নয়। সবটুকুই সত্যি। তাই রবি ঠাকুর মনের দুঃখে বলেছিলেন,
সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী
রেখেছ বাঙ্গালী করে মানুষ কর নি।
স্মৃতির বাতায়ন পথে
আমরা কুমিল্লা সদর পেরিয়ে মুন্সিরহাট চৌদ্দগ্রাম চিওরা সাতবাড়িয়া এবং গুণবতি ছাপিয়ে ফেনি সীমানায় ঢুকে পড়েছি। মাইল ফলকে চোখে পড়ল ফেনি শব্দটি। দোকান সাইনবোর্ডগুলোর শেষ সীমানায় ফেনি নামের ছোট্ট শব্দটি দেখা যাচ্ছে। স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠল ২০০০ এর এক ফালি হাসির স্মৃতি। শেখসাদীর জগৎখ্যাত কাব্য গ্রন্থ বুঁস্তা পড়াতেন আমাদের প্রিয় শিক্ষক আবু বকর সাহেব। গল্পের ছলে একদিন বললেন, ফেনী কলেজের ব্যস্থাপকদের মাঝে একবার কলেজের টাকা নিয়ে গোলমাল হল। পরদিন শহরে ছাত্রদের মিছিল বের হল। মিছিলটির শ্লোগান ছিল, ‘হেনী কলেজের ট্যায়া লই ছুদুর বুদুর ছইলতো নই।’ শিক্ষক মহোদয় খুব রস দিয়ে বলেছিলেন। আমরা খুব হেসেছিলাম। আজো সে স্মৃতি মনে হলে খুব হাসি পায়।
আমাদের ক্লাশে তিনজন আতাউল্লাহ ছিল। নওগা চাঁদপুর ফেনী। এক আতাউল্লাহর জেলা মাড়িয়ে আমরা পার হচ্ছি। আরেক আতাউল্লাহ আমাদের সাথে গাড়িতে। তখনো সাথী। এখনো সাথী। ফেনী এখন বসুন্ধরায়। সুরভী বাণীজ্য নিয়ে খুব ব্যস্ত। মাঝে মধ্যে দেখা হয়। আর নওগা নিরুদ্দেশ। হয়তো অর্থসচিব হাবীব বলতে পারবে এক আধটু।
৯৯ তে আমরা হাফিজ ছিলাম চারজন। মানিকগঞ্জ বাগের হাট সাতক্ষীরা মাদারীপুর। মহামছিবত ! এক ডাকে চার দিকে সাড়া পড়ে যায়। মানিকগঞ্জ দলছুট হয়েছে দুই হাজারেই। আমরা তিনজন একি নায়ে ছিলাম সাঁঝ বেলায় তরী ঘাটে ভেরা পর্যন্ত। সাঝের নৌকা ঘাটে ভিরলে দু হাফিজ নেমে পড়ে সবার সাথে। কেউ সীমানা পেরিয়ে পাড়ি জমায় আজহারে হিন্দে। মুহাম্মদ আলী রিজাউল করিম আব্দুন্নুর ভ্রমণ সাথী মামুন মাহমুদ ছিল সে দুর্গম পথের অভিযাত্রী। মুহাম্মদ আলী আজো ফিরে নি। বাকিরা সাধ মিটিয়ে ফিরে এসেছে। আব্দুন্নুর মীরপুরে মারকাযুল বুহুসে ইসলামী আইন অনুষদের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। মামুন মা’হাদু উলূমিল কুরআনে এক বছর তাফসীর করে এখন আমাদের সাথে ইফতা প্রথম বর্ষে। মাহমুদ রাহমানিয়ার হাদীস দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আর রিজাউল করিম ভাই ফিকহ দ্বিতীয় বর্ষে আছেন। সাঁঝ বিকেলে কেউ কেউ আলাদা নৌকয় চড়ে বসেন। অনেক কাছের মাহমুদুল আমীন মনসুরুল হক শুআইব ইফতায় চলে যায়। মাহমুদুল আমীন আর মনসুরূল হক ইফতা হয়ে এখন কর্মমুখী। শুআইব আমাদের বিপরীতে ছিল। এখনো বিপরীতে। সুহৃদ হাবীব বেলাটুকু পোহাবার আগেই দলছুট হয়ে যায়। হাটহাজারী থেকে পাঠ চুকিয়ে মা’হাদু উলূমিল কুরআনে তাফসীর করে দু বছর। এখন নাখাল পাড়ায় ফিকহ পড়ছে। সফিউল্লাহ মা’হাদু উলূমিল কুরআনে এক বছর ছিল। এরপর নাখাল পাড়ায় ইফতা করে এখন কর্মমুখী।
আমরা চারটি হৃদয় থেকে যাই একি নায়। নৌকা এগিয়ে চলে রাতের আঁধারে মিটি মিটি আলো জ্বেলে। তখন থেকে এখন অনেকগুলো বছর পেরিয়ে আজো আমরা একি আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে। আতাউল্লাহ মাহবুব আব্দুল্লাহ আলমামুন হাফিজ। এ গাড়িতে এ উৎসবে আমরা তিন জন আছি পাশাপাশি। নেত্রকোনার মানুষটি চোখের আড়ালে রয়ে গেছে।
সুহৃদ মাহবুব আমাদের একি সাথে বেড়ে উঠা দীর্ঘ দিনের পাঠের সাথী। এর সাথে আরেকটি পরিচিতিও মহিমান্বিত হয়ে আছে নিবিড়ভাবে। তা হল রাহমানিয়ার কীর্তিমান অধ্যক্ষ আমাদের প্রিয় উস্তাদে হাদীস হযরত মুমিনপুরী হুযুর দা.বা. এর জ্যেষ্ঠ পুত্র। শিক্ষক তনয় হিসেবে সুহৃদ মাহবুবের ব্যাপারে আমরা আলাদা একটি মহিমা লালন করে থাকি। জিনিসটা মূলত শিক্ষক মহদয়ের প্রতি অগাধ ভালবাসা থেকেই উৎসারিত। হযরত মুমিনপুরী হুযুর প্রখর মেধার একজন ধীমান মনীষী। হযরতের স্মৃতি শক্তির প্রখরতা প্রবাদতুল্য। ছাত্র সমাজের মাঝে হুযুর চলন্ত কম্পিউটার উপাধিতে খ্যাত হয়ে আছেন। ছাত্রদের ব্যাপারে হুযুরের দরদমাখা মনোভাব কিংবদন্তি তুল্য। ছাত্রদেরকে হুযুর স্নেহ ভালবাসার মায়া জালে সদা আবদ্ধ করে রাখেন। যদিও হুযুরের গাম্ভীর্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের সামনে ছাত্ররা ভয়ে সিটিয়ে থাকে। ছাত্ররা হুযুরের সান্নিধ্যে এলে হুযুর কখনো বিরক্ত হন না। ছাত্রদের কাছে পেলে হুযুর সীমাহীন আনন্দিত হন। হুযুরের আলোঝলমল চেহারায় বিমুগ্ধতার আলোক রেখা ফুটে উঠে।
হুযুরের আব্বাজান হযরত মাওলান হিদায়াতুল্লাহ সাহেব (মুহাদ্দিস সাহেব হুযুর) এশিয়া কাঁপানো এক শক্তিমান মুহাদ্দিস ছিলেন। বর্তমান আন্তর্জাতিক বিশ্বের খ্যাতিমান ইসলামিক স্কলার জাস্টিস তাকি উসমানী সাহেব মুহাদ্দিস সাহেবকে এশিয়া মহাদেশের শ্রেষ্ঠতম হাদিস বিশারদ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
চলবে, ইনশাআল্লাহ