প্রচলিত মুদারাবা পদ্ধতি : প্রসঙ্গ শরীয়া নীতি লঙ্ঘনের ধরন

মুফতী হাফিজুর রহমান

ভূমিকা

পবিত্র আহার গ্রহণ স্বীকৃত ইবাদাত-উপাসনার পূর্বশর্ত। পবিত্র কুরআনের একাধিক জায়গায় আল্লাহ তা‘আলা হালাল এবং পবিত্র খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে নির্দেশনা আরোপ করেছেন।হাদীসের অসংখ্য বিবরণেও নৈতিক উপায়ে অর্জিত পানাহার গ্রহণের ব্যাপারে সীমাহীন গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আবূ হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা পবিত্র। তিনি শুধু পবিত্র বস্তুই গ্রহণ করেন। আর আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদেরকে সেই নির্দেশনাই প্রদান করেছেন যা তিনি রাসূলগণকে করেছিলেন। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা বলেন, হে রসূলগণ! তোমারা পবিত্র বস্তু-সমাগ্রী আহার করো এবং সৎ কর্ম করো। নিশ্চয়ই তোমারা যা করো সে বিষয়ে আল্লাহ তাআলা সবিশেষ অবহিত। (সূরা মু’মিনুন ৫১)

আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা সেসব পবিত্র বস্তু-সামগ্রী আহার করো যেগুলো আমি তোমাদেরকে আহার্য হিসেবে দান করেছি। (সূরা বাকারাহ ১৭২) অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন যে ব্যক্তি দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধুলি-ধূসরিত ক্লান্ত-শ্রান্ত বদনে আকাশের দিকে হাত তুলে প্রার্থনা করে ডাকছে, হে আমার রব! হে আমার রব!! অথচ তার খাবার হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পরিধেয় বস্ত্র হারাম এবং হারাম আহার্য দ্বারা তার দেহ পুষ্টি অর্জন করেছে। তার প্রার্থনা কিভাবে কবুল হবে? (সহীহু মুসলিম, হাদীস ১০১৫)

আজ যুগের উন্নয়নের ক্রমধারায় আয় উপার্জনের নানা মাধ্যম সৃষ্টি হচ্ছে। আয় উপার্জনের প্রাচীন এবং সর্বস্বীকৃত মাধ্যম হলো ব্যবসা। ব্যবসা বাণিজ্যের রয়েছে দুটি ধারা। ১. নৈতিক তথা ইসলামিক ধারা। ২. নৈতিকতা বিবর্জিত ধারা। দ্বিতীয় এ ধারাটিতে নৈতিকতা কোনো উপলক্ষ বা কেন্দ্রীয় প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে বিবেচ্য হয় না। তবে প্রথম ধারাটিতে বৈধতা ও নৈতিকতা কেন্দ্রীয় চরিত্র ও উপলক্ষ হিসেবে বাণিজ্যিক কার্জক্রমকে মনিটরিং করে। মুনাফা কম হোক যদি সেখানে বৈধতা ও নৈতিকতার উপস্থিতি থাকে তাহলে ইসলাম সে ব্যবসায়িক এ্যক্টিভিটিসকে অনুমোদন দিবে। পক্ষান্তরে যদি কোথাও অফুরন্ত মুনাফার হাতছানি থাকে কিন্তু সেখানে নৈতিকতা ও বৈধতার নিয়ন্ত্রণ না থাকে তাহলে এ জাতীয় ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে অনুমোদন দিবে না ইসলাম। যুগের বিবর্তনে ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া ও প্রয়োগের মাঝেও বিবর্তন সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় ব্যবসায়িক যাবতীয় কার্যক্রমের বাগডোর পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার হাতে। ইসলাম বিরোধী শক্তিই আজ বিশ্ব বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে তারা নীতি নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়ে নিত্য নতুন ব্যবসায়িক পলিসি তৈরি করছে। তাদের মূল টার্গেট যেহেতু মুনাফা গ্রহণ তাই এক্ষেত্রে তারা এমন কোনো নীতি বা নৈতিকতাকে প্রশ্রয় দিবে না যা তাদের একচেটিয়া মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। উপরন্তু বৈশ্বিক ব্যবসায়িক চ্যানেলটি এতটাই শক্তিমত্তা অর্জন করেছে যে কেউ যদি এ স্রোতের বিপরীতে গিয়ে নীতি নৈতিকতা বজায় রেখে বড় ধরনের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করতে চায় তার জন্য বিষয়টা বিষম দুরুহ হয়ে পড়বে। ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প সংস্কৃতিসহ বৈষয়িক সকল সেক্টরে এক সময় মুসলিমদের এক চেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল। কিন্তু ইয়াহুদী খ্রীষ্টানদের কূটকৌশল , নিজেদের আদর্শগত স্খলন এবং খেলাফত ব্যবস্থার বিলুপ্তির মত চতুর্মুখী ছোবলে মুসলিম জাতি জ্ঞান বিজ্ঞান, সভ্যতা সংস্কৃতি এবং ব্যবসা বাণিজ্যের বিস্তৃত অঙ্গন থেকে ছিটকে পড়ে। এ সুযোগে বিরোধী শক্তি জাগতিক সকল সেক্টরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণকে পাকাপোক্ত করে নেয়। বিংশ শতাব্দির মধ্য ভাগে এসে মুসলিমগণ অর্থনীতিতে কোমর সোজা করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তত দিনে অর্থনীতির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে বিরোধী বলয়ের হাতে। যেহেতু বর্তমান অর্থব্যবস্থার কেন্দ্রীয় মাধ্যম হলো ব্যাংক ব্যবস্থা তাই মুসলিমগণ ইসলামী শরীয়ার নিরিখে ব্যাংক ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে অর্থনীতিতে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে চেষ্টা করে। এ দিকে মুসলিম জন-সাধারণ কম হোক বেশি হোক পূর্ব থেকেই পবিত্র ধর্মীয় অনুভূতি লালন করে আসছে। এবং সুদের ভয়বহতা ও অবৈধতা সম্বন্ধেও তাদের সাম্যক ধারণা রয়েছে। রক্ষণশীল এবং ধর্মীয় বিধান পরিপালনে আগ্রহী মুসলিম সাধারণ পূর্ব থেকেই সুদমুক্ত ব্যাংক ব্যবস্থার জন্য অধীর আগ্রহে ব্যাকুল ছিল। সুতরাং ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করলে মুসলমানদের এ শ্রেণীটি সর্বপ্রথম এ ব্যবস্থাকে স্বাগত জানায় এবং নিজেদের সকল অর্থ সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামী ব্যাংকে মজুদ করতে শুরু করে। আর সাধারণ মুসলিমরাও চিন্তা করে দেখল সুদী ব্যাংকে টাকা রেখে অযথা পাপের পরিধি বৃদ্ধি করে লাভ কি ? যে স্বার্থে সুদী ব্যাংকে টাকা জমা করছি সে স্বার্থ পরিপূর্ণরূপে ইসলামী ব্যাংকে টাকা রাখলেও রক্ষা হচ্ছে। উপরন্তু সুদের পাপাচার থেকে অবমুক্তি লাভ করছি। এ চিন্তায় তারাও ইসলামী ব্যাংকগুলোতে জড়ো হতে থাকে। ফলে উত্তরোত্তর ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইসলামী ব্যাংকের অগ্রগতি দেখে ইসলামী নাম ধারণ করে আরো কিছু ব্যাংক দাঁড়িয়ে গেল। তারাও প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল। ইসলামী ব্যাংগুলোর এ অগ্রগতি দেখে সুদী ব্যাংকগুলোও ইসলামী ব্যাংকিং শাখা/ব্রাঞ্চ খুলে বসল, যেখানে ইসলামী ব্যাংকের আদলেই অর্থ জমা ও বিনিয়োগ করার ব্যবস্থা করা হয়। যেহেতু নাম করণ হয়েছে ইসলামী ব্যাংক তাই তারা ইসলামী শরীয়ার নীতি মেনেই ব্যাংক ব্যবস্থা পরিচালনা করবে। এ উদ্দেশে তারা ইসলামী শরীয়াহকে সর্বপ্রধান শ্লোগান হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে। এবং ইসলামী শরীয়ার বাণিজ্যিক যাবতীয় পরিভাষাগুলো ব্যবহার করেই তাদের ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা আরম্ভ করে। ইসলামী শরীয়ার বাণিজ্য নীতির সর্বোত্তম ও ইনসাফপূর্ণ একটি নীতি হল মুদারাবা নীতি। ইসলামী ব্যাংগুলো জমা গ্রহণের ক্ষেত্রে সাধারণত মুদারাবা ব্যবস্থাকে প্রয়োগ করে থাকে। মুদারাবা ব্যাবস্থা কি এবং প্রচলিত ইসলামী ব্যাংকগুলো এ ব্যবস্থা প্রয়োগের ক্ষেত্রে কতটুকু ইসলামী শরীয়া পরিপালন করে বা করতে পারে সে বিষয় নিয়েই আজকের আমাদের এ নিবন্ধেরে অবতারণা। প্রথমে আমরা মুদারাবা সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনায় না গিয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে এ সম্বন্ধে সাম্যক ধারণা লাভের চেষ্টা করবো। এরপর আমরা মূল আলোচনায় চলে যাবো।

মুদারাবা নীতির আভিধানিক পরিচিতি

মুদারাবা (مضاربة) শব্দটি আরবী দারব (ضرب) শব্দমূল হতে উদ্ভূত। আরবি ভাষায় শব্দটি প্রহার করা, আঘাত করা, অন্বেষণ করা, দৃষ্টান্ত দেয়া, পরিভ্রমণ করা ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পবিত্র কুরআনে শব্দটি পরিভ্রমণ করা অর্থে বহু জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন ,وَآخَرُونَ يَضْرِبُونَ فِي الْأَرْضِ يَبْتَغُونَ مِنْ فَضْلِ اللَّه । অর্থ : অন্যরা আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে পৃথিবীতে ভ্রমণ করে। সূরা মুযযাম্মিল : ২০

আয়াতটিতে আল্লাহ তা‘আলা ঐসব সাহাবায়ে কেরামের প্রশংসা করেছেন যাঁরা ব্যবসার উদ্দেশে দেশ-বিদেশে ভ্রমণ করতেন। এসব ব্যবসায়ীর অনেকেই মুদারাবার ভিত্তিতে সংগৃহীত পুঁজি নিয়ে মুনাফার লক্ষ্যে ভ্রমণ করতেন।

দারব শব্দমূলের সাথে মুদারাবা ব্যবসার সংযোগ-সাদৃশ্য

দারব বা যারব শব্দটির মূলানুগ অর্থ হলো আঘাত করা। ভ্রমণ করতে হলে ভূমিতে পদাঘাত করে করে হেঁটে চলতে হয়। সুতরাং হাঁটা বা ভ্রমণ করার সাথে পদযুগলের মাধ্যমে ভূমিতে মৃদু আঘাত করার শক্তিশালী সংযোগ রয়েছে। কারণ ভূমিতে পদাঘাত ব্যতিরেকে হাঁটা বা ভ্রমণ করা কল্পনাও করা যায় না। যদিও এটা তৎকালীন মরু আরবের সাথে সংশ্লষ্ট। বর্তমানে হয়তো ভূমিতে পদাঘাত সংশ্লিষ্ট ভ্রমণের কল্পনা করা যায় না। তবে যুগের যত উন্নতিই হোক না কেন ভ্রমণ কর্ম থেকে ভূমিতে পদাঘাত বা পায়ে হাঁটাকে সমূলে বিদায় করা আদৌ সম্ভব নয়। সে হিসেবে ভ্রমণের সাথে পায়ে হাঁটার একটা আবশ্যিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। আর পবিত্র কুরআনে ভ্রমণ বলতে ব্যবসায়িক ভ্রমণ বুঝানো হয়েছে। আর ব্যবসা বাণিজ্যের সাথে ভ্রমণ বিষয়টা ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। ব্যবসা করতে হলে তাকে এদিক সেদিক ছুটা ছুটি করতেই হবে। নতুবা সেটা আর ব্যবসা হবে না। সুতরাং আঘাত করা বা ভ্রমণ করার সাথে ব্যবসার আবশ্যিক সংশ্লিষ্টতা থাকা একটি অনস্বীকার্য বিষয়।

মুদারাবা নীতির পারিভাষিক পরিচিতি

ইসলামী শরীয়ার পরিভাষায়, মুদারাবা এমন একটি অংশীদারি কারবার যেখানে দু’টি পক্ষ থাকে। একপক্ষ মূলধন সরবরাহ করেন এবং অপর পক্ষ মেধা ও শ্রম ব্যয় করে উক্ত মূলধন দ্বারা ব্যবসা পরিচালনা করেন। ব্যবসায়ে লাভ হলে পূর্ব চুক্তি অনুসারে উভয়পক্ষের মাঝে বণ্টিত হয়। আর লোকসান হলে মূলধন সরবরাহকারী পক্ষকে তা বহন করতে হয়। এক্ষেত্রে সবটুকু লোকসান পুঁজিদাতা বহন করলেও মুদারিব তার শ্রম ও তৎপরতার কোনো পারিশ্রমিক না পাওয়াটাই তার লোকসান হিসেবে গণ্য হয়। তবে যদি মুদারিব কর্তৃক নিয়ম লঙ্ঘন, অবহেলা বা চুক্তিভঙ্গের কারণে লোকসান হয় তাহলে মুদারিবকে লোকসানের দায় বহন করতে হবে।

উল্লেখ্য, মুদারাবা ব্যবসায় স্বাভাবিক লোকসান হয়ে পুঁজি ক্ষতিগ্রস্থ হলে প্রথমত পূর্বতন লভ্যাংশ দ্বারা পুঁজির সমন্বয় করা হবে। লভ্যাংশ দ্বারা পুঁজির সমন্বয় না হলে অবশিষ্ট ক্ষতি পুঁজিদাতাই বহন করবে। এ ক্ষেত্রে মুদারিব বা উদ্যোক্তার উপর এর কোনো দায় আরোপিত হবে না। শারহুল মাজাল্লাহ ৪/৩৬৩

মূলধন সরবরাহকারী পক্ষকে বলা হয় ছাহিবুল মাল (صاحب المال) আর ব্যবসায় পরিচালনাকারী-পক্ষকে বলা হয় মুদারিব (مضارب)। আর বিনিয়োগকৃত অর্থকে বলা হয় রা’সুল-মাল (رأس المال) বা পুঁজি।

ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক এর সংজ্ঞা মতে :

Mudaraba is a form of partnarship where one party (sahib al maal/Rabbul maal) provides the fund while the other provides expertise and managemant. The latter is reffered to as the Mudarib (Manager). Any profet accrued isshared  between the two parties on a pre-agreed basis, while capital loss is exclusively borne by the partner providing the capital (sahib al mal)

অর্থাৎ মুদারাবা এক ধরনের অংশীদারিত্ব যেখানে একপক্ষ (সাহিবুল মাল/রাব্বুল মাল) তহবিল বা পুঁজি সরবরাহ করেন এবং অন্যপক্ষ তার দক্ষতা ও ব্যবস্থাপনা নিয়োজিত করেন। তাকে বলা হয় মুদারিব বা ব্যবস্থাপক। ব্যবসায়ের লাভ দু’পক্ষের মাঝে পূর্ব নির্ধারিত অনুপাতে ভাগ হয়। পুঁজির লোকসান হলে তা মূলধন সরবরাহকারী (সাহিবুল মাল) বহন করেন।

মুদারাবার শ্রেণীবিভাগ

চুক্তির ভিত্তিতে মুদারাবা বিনিয়োগ দু’প্রকার। যথা : ১. মুদারাবা মুতলাকা বা সাধারণ মুদারাবা। যে মুদারাবা ব্যবসায় মুদারিবকে কোনোরূপ শর্ত আরোপ করা ব্যতিরেকে সাহিবুল মাল কর্তৃক ব্যবসা করার অনুমতি দেয়া হয় তাকে আলমুদারাবাতুল মুতলাকাহ বা সাধারণ মুদারাবা বলা হয়।

২. মুদারাবা মুকাইয়াদা বা বিশেষ মুদারাবা। যে মুদারাবা ব্যবসায় সাহিবুল মাল ব্যবসার ধরন, মেয়াদ ও স্থান ইত্যাদি নির্দিষ্ট করে দেয় তাকে আলমুদারাবা আলমুকাইয়াদা বা বিশেষ মুদারাবা বলা হয়।

প্রচলিত মুদারাবা ব্যবস্থার বাস্তবতা

মুদারাবা হলো একটি সর্বোত্তম আদর্শ বিনিয়োগ ব্যবস্থা, যা ইসলামী শরীয়ার স্বাতন্ত্র, সাম্য এবং ইনসাফ ও ন্যায়ের রক্ষাকবচ। ফলে ইসলামী ভাবধারার আলোকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে আগ্রহী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মুদারাবা ব্যবস্থাটিকে ব্যাপকভাবে অনুশীলন করে থাকে। মৌলিকভাবে দুটি ধারায় এ ব্যবস্থাটি অনুশীলিত হয়ে থাকে। ১। ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থা ২। ইসলামী নাম ধারণ করে গড়ে উঠা বিভিন্ন সমিতি ও সোসাইটি।

ইসলামী ব্যাংকের মুদারাবা ব্যবস্থার অনুশীলন

ইসলামী ব্যাংগুলোতে মুদারাবা ব্যবস্থাটি ব্যাপকভাবে অনুশীলিত হয়। তবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ প্রতিষ্ঠানগুলো কিছুটা সীমিত পরিসরে মুদারাবা পদ্ধতিটির অনুশীলন করে থাকে।

মুহাম্মদ শামসুল হুদা ও মুহাম্মদ শামসুদ্দোহা রচিত ‘ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ পদ্ধতি শরী‘আহর নীতিমালা’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে, ইসলামী ব্যাংকসমূহে মুদারাবা পদ্ধতিটি ব্যাপকভাবে অনুশীলিত হলেও সমাজে সততা ও নৈতিকতার অভাবসহ আরো কিছু বাস্তব সমস্যার কারণে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এর অনুশীলন এখনো সীমিত রয়েছে। পৃ. ১৩১

ইসলামী ব্যাংকের পুঁজি সংগ্রহের প্রক্রিয়াগুলো দেখলে সহজেই তাতে মুদারাবা ব্যবস্থার ব্যাপক প্রচলনের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। বস্তুত ইসলামী ব্যাংকগুলো সাধারণত ১২টি উৎস থেকে তহবিল বা পুঁজি (Diposit) সংগ্রহ করে থাকে। যথা :

১.       আল ওয়াদিয়া চলতি হিসাব

২.       সাধারণ মুদারাবা সঞ্চয়ী হিসাব

৩.      বিশেষ মুদারবা সঞ্চয়ী হিসাব

৪.       সাধারণ মুদারাবা মেয়াদী সঞ্চয়ী হিসাব

৫.       বিশেষ মুদারাবা মেয়াদী সঞ্চয়ী হিসাব

৬.       মুদারাবা শর্ট নোটিশ জমা হিসাব

৭.       অন্যান্য জমা হিসাব

৮.      শেয়ার মূলধন

৯.       ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল

১০.     কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণ

১১.     সার্ভিস চার্জ বা কমিশনের ভিত্তিতে সেবা কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ

১২.     ব্যাংকের সঞ্চিতি তহবিল

মাওলানা মোঃ ফজলুর রহমান আশরাফী কৃত ‘সুদ ও ইসলামী ব্যাংকিং কি কেন কিভাবে ?’পৃ. ১৯৪

ইসলামী ব্যাংকগুলোর পুঁজি সংগ্রহের উৎসেরউপরোক্ত বিবরণীতে দেখা যাচ্ছে, ব্যাংকের প্রায় অর্ধেক পুঁজিই সংগ্রহীত হয় মুদারাবা পদ্ধতির উৎস থেকে।

ইসলামী ব্যাংকগুলো মুদারাবা পদ্ধতির মাধ্যমে পুঁজি সংগ্রহ করে বিভিন্ন পদ্ধতিতে তা বিনিয়োগ করে থাকে। ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ পদ্ধতি মৌলিকভাবে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত। যথা :

১। ক্রয়-বিক্রয় নীতি। ক্রয়-বিক্রয় এ নীতির আওতায় চারটি পদ্ধতি অনুশীলিত হয়। যথা :

ক. বাই-মুরাবাহা (চুক্তিভিত্তিকলাভে ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতি)

খ. বাই-মুয়াজ্জাল (বাকিতে ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতি)

গ. বাই-সালাম (আগাম ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতি)

ঘ. বাই-ইসতিসনা (ওয়ার্ডারের ভিত্তিতে উৎপাদনপূর্বক ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতি)

২। অংশীদারি নীতি। এ নীতির আওতায় ইসলামী ব্যাংগুলোতে দু’টি বিনিয়োগ পদ্ধতি অনুশীলিত হয়। যথা : ক. মুদারাবা (স্বনিয়োজি উদ্যোক্তার মাধ্যমে বিনিয়োগ পদ্ধতি) খ. মুশারাকা (অংশীদারি বিনিয়োগ পদ্ধতি)

৩। ইজারা বিল বাই (বিক্রয়ের মাধ্যমে ভাড়া প্রদান পদ্ধতি)। বিনিয়োগের এ পদ্ধতিটি দু ভাগে বিভক্ত। ক. ক্রমহ্রাসমান অংশীদারি পদ্ধতি খ. ক্রয়ের চুক্তিতে ভাড়াদান পদ্ধতি

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, ইসলামী ব্যাংকগুলো বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুদারাবা পদ্ধতিকে ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করে না। ইসলামী ব্যাংকগুলো বর্তমানে বিনিয়োগ পদ্ধতি হিসেবে নিম্নলিখিত দুটি ক্ষেত্রে মুদারাবা ব্যবস্থার অনুশীলন করছে।

ক. যেসব ইসলামী ব্যাংকে আমানতের চাহিদা রয়েছে তাদেরকে মুদারাবা পদ্ধতিতে ফান্ড প্রদান করে থাকে সেসব ইসলামী ব্যাংক যাদের অতিরিক্ত পুঁজি রয়েছে। এক্ষেত্রে ফান্ডদাতা ইসলামী ব্যাংক ছাহিবুল মাল ও ফান্ডগ্রহীতা ইসলামী ব্যাংক মুদারিব হিসেবে কাজ করে। ফান্ডগ্রহীতা ব্যাংক ফান্ডদাতা ব্যাংককে চুক্তিতে উল্লিখিত অনুপাতে মুনাফা দিয়ে থাকে।

খ. বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ইস্যুকৃত ‘মুদারাবা বন্ড’ ক্রয় করে ইসলামী ব্যাংকগুলো মুদারাবা পদ্ধতিতে অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক উক্ত বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী পুনঃমুদারাবার ভিত্তিতে বিনিয়োগ করে অর্জিত মুনাফা বন্ড-ক্রেতা ইসলামী ব্যাংকগুলোকে বণ্টন করে থাকে। মুহাম্মদ শামসুল হুদা ও মুহাম্মদ শামসুদ্দোহা রচিত ‘ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ পদ্ধতি শরী‘আহর নীতিমালা’ ১৩২

উপরোক্ত মুদারাবা পদ্ধতির দুটিই আলমুদারাবা আলাল মুদারাবা তথা পুনঃমুদারাবা পদ্ধতির অন্তর্গত। আর দ্বিতীয় পদ্ধতিটিতে তো ত্রিমুদারাবার সমন্বয় ঘটেছে। কারণ প্রথমত ব্যাংক মুদারবার পদ্ধতিতে ডিপোজিটর তথা পুঁজিদাতাদের নিকট থেকে পুঁজি সংগ্রহ করে থাকে। এক্ষেত্রে পুঁজিদাতা হয় রাব্বুল মাল আর ব্যাংক হয় মুদারিব। দ্বিতীয়ত ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মুদারাবা বন্ড ক্রয় করে সে অর্থটা বিনিয়োগ করে। এক্ষেত্রে ব্যাংক হলো রাব্বুল মাল আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলো মুদারিব। তৃতীয় ধাপে এসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সে অর্থটা অন্যান্য ইসলামী ব্যাংকে মুদারাবা পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলো রাব্বুল মাল আর অন্যান্য ইসলামী ব্যাংক হলো মুদারিব। পুনঃমুদারাবার এ ধারাগুলো তখনি বৈধতার পর্যায়ে পড়ে যখন প্রথম রাব্বুল মালের পক্ষ থেকে প্রথম মুদারিবকে একচেটিয়া ও উন্মুক্ত ব্যবসা পরিচালনার অনুমোদন দেয়া থাকে।

মুদারাবা পদ্ধতি বৈধ হওয়ার জন্য অন্যতম এবং প্রধানতম শর্ত হলো মুদারিবের ব্যবসা পরিচালনা বৈধ ও শরীয়াসম্মত হওয়া। কারণ মুদারাবা পদ্ধতি বৈধ হওয়ার মূল মানদণ্ড হলো মুদারিব বা ব্যবসায়ী উদ্যোক্তার ব্যবসা পরিচালনা নীতি বৈধ ও বিধিসম্মত হওয়া। বস্তুত মুদারাবা কোনো ব্যবসার নাম নয়; বরং এটি হলো কোনো ব্যবসার প্রাক চুক্তি পদ্ধতির নাম। মূল ব্যবসা পলিসি তো মুদারিবের হাতে ন্যাস্ত। তিনি মুদারাবা চুক্তির ভিত্তিতে প্রাপ্ত অর্থ দ্বারা বাইয়ে সালাম, বাইয়ে মুকাইয়াযাহ, বাইয়ে মুরাবাহা, বাইয়ে মুসাওয়ামা, বাইয়ে মুয়াজ্জাল, বাইয়ে মুযাইয়াদা, বাইয়ে তাওলিয়া, বাইয়ে ওয়াজিয়া এমন কি বাইয়ে বাতেল বা বাইয়ে ফাসেদ এর ভিত্তিতেও ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেন। এগুলো ক্রয়-বিক্রয়ের মৌলিক শ্রেণীভাগ। সুতরাং মুদারিবের মূল ব্যবসা যদি বৈধ এবং শরীয়াহসম্মত হয় তাহলে মুদারাবা নীতি পালন সাপেক্ষে তাও বৈধ হবে। মূল ব্যবসায় শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যা সৃষ্টি হলে মুদারাবা পদ্ধতিতেও সমস্যা সৃষ্টি হবে; যদিও এক্ষেত্রে মুদারাবার যাবতীয় শর্তগুলো রক্ষা করা হয়। সারকথা মুদারাবা পদ্ধতিটির বৈধতা মুদারিবের মূল ব্যবসার বৈধতার উপর নির্ভরশীল। ইসলামী ব্যাংকগুলো ডিপোজিটর তথা রাব্বুল মাল বা পুঁজিদাতাদের কাছ থেকে মুদারাবার ভিত্তিতে অর্থ গ্রহণ করে কি কি পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করে তা আমরা পেছনে উল্লেখ করেছি। এ পর্যায়ে আমরা ইসলামী ব্যাংক কর্তৃক মুদারাবার অর্থ বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে শরয়ীয়তের কি কি নীতি লঙ্ঘিত হয় তা পর্যালোচনা করে দেখতে চেষ্টা করবো। যাতে ইসলামী ব্যাংক কর্তৃক পরিচালিত মুদারাবা পদ্ধতির রূপরেখা ও বাস্তব চিত্র ফুটে উঠে।

ইসলামী ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগ খাতে অনুশীলিত বাইয়ে মুরাবাহা পদ্ধতিতে শরীআহ লঙ্ঘনের ধরন ও বিধান

১। মালামাল ক্রয়ের পরিবর্তে বিভিন্নভাবে গ্রাহককে নগদ সুবিধা প্রদান করা :

গ্রাহককে মালামাল প্রদানের পরিবর্তে বিভিন্নভাবে নগদ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে তার কাছ থেকে অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করা হলে তা সুদ হিসেবে গণ্য হবে।

২। বিনিয়োগের অর্থ দ্বারা মাল ক্রয় না করে পুরাতন বিনিয়োগ সমন্বয় করা :

এক্ষেত্রেও প্রকৃতপক্ষে কোনো ক্রয়-বিক্রয় সংঘটিত হয় না। ফলে এক্ষেত্রে গ্রাহকের নিকট থেকে অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করা হলে তা সুদ হিসেবে গণ্য হবে।

৩। মুরাবাহা পদ্ধতিতে বিক্রীত পণ্যের উপর ব্যাংকের মালিকানা প্রতিষ্ঠা ও দখল স্বত্ব ছাড়া গ্রাহকের কাছে তা বিক্রি করা :

কবজা বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাবিহীন মালামাল ক্রয়-বিক্রয় করা বৈধ নয়। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কাছে যা নেই তা বিক্রি করো না। এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে অর্জিত আয় বৈধ হবে না।

৪। ব্যাংকের পরিবর্তে গ্রাহকের নামে ক্যাশমেমো নেয়া :

গ্রাহকের নামে ক্যাশমেমো থাকার একটি অর্থ হতে পারে, ব্যাংকের পরিবর্তে গ্রাহক নিজে মাল ক্রয় করেছে। যদি এটাই প্রমাণিত হয় যে ব্যাংক মালামাল ক্রয় করে নি, তাহলে এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয় দ্বারা গ্রাহককে নদগ সুবিধা প্রদান করা হয়েছে বলে গণ্য হবে। এ বিনিয়োগ থেকে অর্জিত আয় সুদের অন্তুর্ভুক্ত হবে। কারণ মুরাবাহা পদ্ধতিতে ব্যাংক কর্তৃক মালামাল ক্রয় ও তার উপর দখল লাভের পরই গ্রাহকের কাছে বিক্রি করতে হয়।

৫। ব্যাংকের পরিবর্তে গ্রাহক কর্তৃক সরবরাহকারী থেকে ক্যাশমেমো সংগ্রহপূর্বক তা ব্যাংকে উপস্থাপনের মাধ্যমে বিনিয়োগ গ্রহণ করা :

গ্রাহক কর্তৃক ক্যাশমেমো সংগ্রহের দ্বারা যদি প্রমাণিত হয় যে, তিনি ব্যাংকের পরিবর্তে নিজে মালামাল ক্রয় করেছেন এবং মালামাল ক্রয়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকের কোনো ভূমিকা নেই, তাহলে এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয় গ্রাহককে নগদ সুবিধা প্রদান করা হয়েছে বলে গণ্য হবে এবং তদোর্জিত আয় সুদের অন্তর্ভুক্ত হবে।

৬। মুরাবাহার চুক্তিপত্র শূন্য, অপূরণকৃত, অপূর্ণাঙ্গ ও সাক্ষীবিহীন রাখা :

ব্যাংক একটি প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে লেনদেনের সকল বিবরণ বিশেষ করে বিক্রয় মূল্য ও মূল্য পরিশোধের তারিখ লিখিত থাকা আবশ্যক। এগুলোর অুনপস্থিতিতে ক্রয়-বিক্রয় ফাসিদ বলে গণ্য হবে। এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ শরীয়া লঙ্ঘনের কারণে অপরাধী গণ্য হবেন।

৭। মুরাবাহা বিনিয়োগে গ্রাহককে ক্রয় প্রতিনিধি করা হলে সে ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্তৃক মালামাল পরিদর্শনপূর্বক গ্রাহককে বুঝিয়ে না দেয়া :

ক্রয়-প্রতিনিধি কর্তৃক মালামাল ক্রয়ের পর ব্যাংক কর্তৃক তা পরিদর্শন না করার দ্বারা প্রতীয়মান হয়, উক্ত মালের উপর ব্যাংকের দখল ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় নি। আর কবজ বা দখল করার করার পূর্বে সংশ্লিষ্ট মালামাল বিক্রি করতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন। ক্রয়-প্রতিনিধির ক্ষেত্রে গ্রাহক কর্তৃক মালামাল ব্যবহারের পূর্বেই ব্যাংক কর্তৃক তা পরিদর্শন করতে হবে।

৮। ব্যাংক কর্তৃক গ্রাহককে ক্রয় প্রতিনিধি নিয়োগ করে তার একাউন্টে বিনিয়োগের টাকা স্থানান্তর করার দীর্ঘ দিন পরও বিনিয়োগের অর্থ দিয়ে মালামাল ক্রয় না করা :

অ্যদিকে প্রথম দিনেই মালামাল ক্রয়ের ক্যাশমেমো প্রদান করা ও যথারীতি মুনাফা ধার্য করা। গ্রাহকের কাছে মালামাল স্থানান্তর ব্যতীত মুনাফা ধার্য করা বৈধ নয়।

৯। বিক্রীত পণ্য ব্যাংকের মালিকানায় আসার পূর্বেই উক্ত পণ্য বিক্রয়ের চুক্তি করা :

এ ধরনের চুক্তি বৈধ নয়। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে পণ্য তোমার কাছে নেই তা বিক্রি করো না।

১০। মালামাল ক্রয়ে ব্যাংকের ভূমিকা না থাকা। অর্থাৎ ব্যাংকের পরিবর্তে বিনিয়োগ গ্রাহক কর্তৃক সরবরাহকারীর নিকট থেকে সরাসরি মালামাল বুঝে নেয়া :

মালামাল ক্রয়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকের ভূমিকা না থাকার অর্থ হলো, গ্রাহক ব্যাংকের পরিবর্তে নিজেই মালামাল ক্রয় করেছে। এ ধরনের বিনিয়োগ দ্বারা গ্রাহককে নগদ সুবিধা প্রদান করা হয়েছে বলে গণ্য হবে এবং এ বিনিয়োগ থেকে অর্জিত আয় সুদের অন্তর্ভুক্ত হবে।

১১। গ্রাহকের নিজের জন্য ক্রয়কৃত মালের উপর বিনিয়োগ প্রদান করা :

এমতাবস্থায় ব্যাংক কর্তৃক উক্ত মালের মূল্য পরিশোধপূর্বক মুরাবাহা বিনিয়োগ সৃষ্টি করা বৈধ হবে না। কারণ গ্রাহক মালামাল ক্রয় করে বিক্রেতার কাছে ঋণী হয়েছে আর ব্যাংক তার ঋণ পরিশোধ করার জন্য তাকে ঋণ দিয়েছে বলে গণ্য হবে। এ ধরনের ক্রয় বিক্রয় থেকে অর্জিত আয় সুদের অন্তর্ভুক্ত হবে।

১২। বিনিয়োগের সম্পূর্ণ অর্থ দিয়ে মালামাল ক্রয় না করে আংশিক অর্থ দিয়ে মালামাল ক্রয় করে সম্পূর্ণ বিনিয়োগের উপর মুনাফা ধার্য করা :

যে অর্থ দ্বারা মালামাল ক্রয় করা হয় নি সে অর্থ থেকে অর্জিত আয় সুদের অন্তুভুক্ত হবে।

১৩। বাইয়ে মুরাবাহা পদ্ধতিতে আমদানি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গ্রাহক কর্তৃক ব্যাংককে মালামাল ক্রয় বা আমদানি করার ক্ষমতাপত্র না দেয়া :

এ ধরনের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ক্ষমতাপত্র ছাড়া মালের উপর ব্যাংকের মালিকানা ও দখল প্রতিষ্ঠিত হয় না। আর দখল ছাড়া ক্রয় বিক্রয় শুদ্ধ হয় না।

বাইয়ে মুরাবাহায় শরীয়া লঙ্ঘন

কেস স্টাডি-১

একজন গ্রাহক ব্যাংকে এসে বিনিয়োগ কর্মকর্তার কাছে বললেন, আমি কিভাবে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারি ? বিনিয়োগ কর্মকর্তা বললেন, ইসলামী ব্যাংক ঋণের ব্যবসা করে না। তবে আপনার কোনো ব্যবসা থাকলে ব্যাংক আপনাকে সে ব্যাবসার জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করে দিতে পারে। তিনি বললেন, আমার কাপড়ের ব্যবসা আছে। আমি ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে কিছু কাপড় ক্রয় করতে চাই। বিনিয়োগ কর্মকর্তা বললেন, আপনি যে ধরনের কাপড় ক্রয় করতে চান তার একটি দরপত্র নিয়ে আসেন। আগন্তুক কাপড় ক্রয়ের একটি দরপত্র ব্যাংকে জমা দেয়ার পর বিনিয়োগ কর্মকর্তা তার সঙ্গে একটি মুরাবাহা চুক্তিপত্র সম্পাদন করলেন। এরপর বিনিয়োগ কর্মকর্তা গ্রাহকের নামে একটি বিনিয়োগ হিসাব খুললেন, এবং তা বিকলন করে মালামালের মূল্য দ্বারা সরবরাহকারীর নামে একটি পেমেন্ট অর্ডার ইস্যু করলেন। গ্রাহক পেমেন্ট অর্ডারটি গ্রহণপূর্বক সরবরাহকারীর কাছে গেলেন এবং সমপরিমাণ অর্থ দ্বারা নিজের নামে বিভিন্ন ধরনের কাপড় ক্রয় করলেন। কাপড় ক্রয় শেষে নিজের নামের ক্যাশমেমোটি ব্যাংক কর্মকর্তার কাছে জমা দিলেন এবং এর পেছনে মালামাল বুঝে পেয়েছেন বলে স্বাক্ষর করলেন।

এ বিনিয়োগটিতে মালামাল ক্রয়-বিক্রয় হওয়া সত্ত্বেও যেভাবে শরীয়া নীতি লঙ্ঘিত হয়েছে তা নিম্নরূপ

ক. আলোচ্য ক্ষেত্রে গ্রাহকের সঙ্গে ক্রয় প্রতিশ্রুতি চুক্তির পরিবর্তে সরাসরি মুরাবাহা চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছে। অথচ মুরাবাহা লিল আমির বিশশারা (বিনিয়োগ গ্রাহককে ক্রয়-প্রতিনিধি নিয়োগের মাধ্যমে মুরাবাহা) পদ্ধতিতে মালামালের উপর ব্যাংকের মালিকানা ও দখল লাভ ছাড়া গ্রাহকের সঙ্গে মুরাবাহা চুক্তি সম্পাদন করা বৈধ নয়।

খ. ব্যাংক বিনিয়োগ গ্রাহকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরাসরি কিংবা টেলিফোন/প্রতিনিধির মাধ্যমে সরবরাহকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করে মালামাল ক্রয় করবে। কিন্তু এখানে মালামাল ক্রয় করেছেন বিনিয়োগ গ্রাহক নিজে। ফলে সরবরাহকারীর সঙ্গে ব্যাংকের ক্রয়-বিক্রয় সংঘটিত হয় নি। অথচ মুরাবাহা লিল আমির বিশশিরা পদ্ধতিতে প্রথম ক্রয় বিক্রয় শুদ্ধ হতে হবে। প্রথম ক্রয়-বিক্রয় শুদ্ধ না হলে দ্বিতীয় ক্রয়-বিক্রয় শুদ্ধ হবে না।

গ. এখানে গ্রাহক মালামাল নিজের নামে ক্রয়পূর্বক ক্যাশমেমো গ্রহণ কররেছেন। ফলে এ মালের মালিক গ্রাহক নিজে। আর গ্রাহকের মালিকানাধীন মালামাল পুনরায় তারই কাছে বিক্রি করাকে বাইয়ে ঈনা বলা হয়; যা ইসলামী শরীয়াতে বৈধ নয়।

কেস স্টাডি-২

একজন গ্রাহক কৃষকদের নিকট থেকে ১০০০০০/= (এক লক্ষ) টাকার ধান ক্রয়ের জন্য ইসলামী ব্যাংকের কাছে আবেদন করলেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিনিয়োগ কর্মকর্তা উক্ত গ্রাহকের সঙ্গে মুরাবাহা চুক্তিপত্র সম্পাদন করলেন এবং উক্ত মালামাল ব্যাংকের পক্ষে সরাসরি ক্রয় করা সম্ভব নয় বলে উক্ত গ্রাহককে ব্যাংকের পক্ষে ক্রয়-প্রতিনিধি নিয়োগ করলেন। এরপর বিনিয়োগ কর্মকর্তা গ্রাহকের নামে একটি বিনিয়োগ হিসাব খুললেন এবং তা বিকলন করে মালামালের মূল্য গ্রাহকের চলতি/সঞ্চয়ী হিসাবে স্থানান্তর করলেন। এরপর বিনিয়োগ গ্রাহক একটি চেকের মাধ্যমে ১০০০০/= টাকা তার পুরাতন মুরাবাহা হিসাবে স্থানান্তর করলেন এবং ৮০০০০/= টাকা নগদ উত্তোলনপূর্বক বিভিন্ন কৃষকের নিকট থেকে ধান ক্রয় করলেন। অবশিষ্ট ১০০০০/= টাকা তার হিসাবে উত্তোলনবিহীন অবস্থায় থেকে গেল। বিনিয়োগ প্রদানের ১০ দিন পরে বিনিয়োগ গ্রাহক ১০০০০০/= টাকার ধান ক্রয় করেছেন মর্মে ক্যাশমেমো ব্যাংকে জমা দিলেন এবং উক্ত মালামাল বুঝে পেয়েছেন মর্মে ক্যাশমেমোর পেছনে স্বাক্ষর করলেন।

এ বিনিয়োগটিতে মালামাল ক্রয়-বিক্রয় হওয়া সত্ত্বেও যেভাবে শরীয়া নীতি লঙ্ঘিত হয়েছে তা নিম্নরূপ :

ক. এখানে গ্রাহকের সঙ্গে ক্রয় প্রতিশ্রুতি চুক্তির পরিবর্তে সরাসরি মুরাবাহা চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছে। অথচ মুরাবাহা লিল আমির বিশশারা (বিনিয়োগ গ্রাহককে ক্রয়-প্রতিনিধি নিয়োগের মাধ্যমে মুরাবাহা) পদ্ধতিতে মালামালের উপর ব্যাংকের মালিকানা ও দখল লাভ ছাড়া গ্রাহকের সঙ্গে মুরাবাহা চুক্তি সম্পাদন করা বৈধ নয়।

খ. গ্রাহক ১০০০০/= টাকা তার পুরাতন মুরাবাহা হিসাবে স্থানান্তর করেছেন। অর্থাৎ গ্রাহক ১০০০০/= টাকার মালামাল ক্রয় না করে তার পুরাতন দায় পরিশোধ করেছেন। কিন্তু ব্যংক গ্রাহকের দায় পরিশোধের জন্য বিনিয়োগ দিতে পারে না। কারণ ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতিতে গ্রাহকের কাছে মালামাল বিক্রয়ের পরিবর্তে নগদ অর্থ প্রদান করে তার উপর অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করাই সুদ।

গ. এক্ষেত্রে গ্রাহক/প্রতিনিধির ক্রয়কৃত মালামাল সংশ্লিষ্ট শাখার একজন কর্মকর্তা পরিদর্শনপূর্বক দখল লাভ করবেন এবং গ্রাহককে বুঝিয়ে দেবেন। কারণ ক্রয়-বিক্রয়ের একটি শতৃ হলো, পণ্যের উপর বিক্রেতার দখল স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকা। এক্ষেত্রে পণ্যের উপর ব্যাংকের দখল প্রতিষ্ঠিত হয় নি বলে ক্রয়-বিক্রয়টি শুদ্ধ হয় নি।

ঘ. গ্রাহকের হিসাবে স্থানান্তরিত বিনিয়োগের অর্থ থেকে অবশিষ্ট ১০০০০/= টাকা উত্তোলনবিহীন অবস্থায় রয়েছে এবং ১০০০০/= টাকা দ্বারা গ্রাহক তার পুরাতন বিনিয়োগ হিসাব সমন্বয় করেছে। এ সত্ত্বেও তিনি পুরো টাকার মালামাল ক্রয়ের ক্যাশমেমো উপস্থাপন করেছেন।

কেস স্টাডি-৩

কোনো নির্দিষ্ট সরবরাহকারীর নিকট থেকে একটি ক্যাশমেমো সংগ্রহপূর্বক একজন গ্রাহক ব্যাংকের কাছে বিনিয়োগের আবেদন করলেন। ব্যাংকের বিনিয়োগ কর্মকর্তা গ্রাহকের নামে একটি বিনিয়োগ হিসাব খুললেন এবং তা বিকলনপূর্বক মালামালের মূল্য দ্বারা সরবরাহকারীর নামে একটি পেমেন্ট অর্ডার ইস্যু করলেন। গ্রাহক পেমেন্ট অর্ডারটি গ্রহণপূর্বক সরবরাহকারীর কাছে গেলেন এবং সমপরিমাণ অর্থ দ্বারা নিজের নামে বিভিন্ন ধরনের কাপড় ক্রয় করলেন। কাপড় ক্রয় শেষে নিজের নামের ক্যাশমেমোটি ব্যাংক কর্মকর্তার কাছে জমা দিলেন এবং এর পেছনে মালামাল বুঝে পেয়েছেন মর্মে স্বাক্ষর করলেন। এরপর সাপ্লায়ার সমপরিমাণ টাকার একটি চেক ইস্যু করলেন। বিনিয়োগ গ্রাহক চেকটির পেছনে স্বাক্ষরপূর্বক নগদ অর্থ গ্রহণ করলেন।

এ বিনিয়োগে যেসব শরীয়া নীতি লঙ্ঘিত হয়েছে তা নিম্নরূপ :

ক. ব্যাংক বিনিয়োগ গ্রাহকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরাসরি কিংবা টেলিফোন/প্রতিনিধির মাধ্যমে সরবরাহকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করে মালামাল ক্রয় করবে। কিন্তু এখানে মালামাল ক্রয় করেছেন বিনিয়োগ গ্রাহক নিজে। ফলে সরবরাহকারীর সঙ্গে ব্যাংকের ক্রয়-বিক্রয় সংঘটিত হয় নি। অথচ মুরাবাহা লিল আমির বিশশিরা পদ্ধতিতে প্রথম ক্রয় বিক্রয় শুদ্ধ হতে হবে। প্রথম ক্রয়-বিক্রয় শুদ্ধ না হলে দ্বিতীয় ক্রয়-বিক্রয় শুদ্ধ হবে না।

খ. বিনিয়োগ গ্রাহক সরবরাহকারীর ইস্যু করা চেকের পেছনে স্বাক্ষর করে নগদ অর্থ গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ এখানে মালামাল ক্রয়-বিক্রয় সংঘটিত হয় নি; বরং গ্রাহক ক্রয়-বিক্রয়ের নামে সরবরাহকারীর মাধ্যমে নগদ সুবিধা গ্রহণ করেছেন। এ বিনিয়োগ থেকে অর্জিত আয় সুদ বলে গণ্য হবে।

কেস স্টাডি-৪

মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মদ দা.বা. বলেন, এক আমেরিকা প্রবাসী ভদ্রলোক (আমার নিকট) এসেছিলেন। তিনি ঢাকার পূর্বাঞ্চলে নিজ বাড়িতে কাজের জন্য কিছু রড/সিমেন্ট বাকিতে ক্রয় করেছেন। সময়মতো টাকা হাতে না আসায় মূল্য পরিশোধ করতে পারেননি। ভদ্রলোক গেলেন তার এলাকার একটি ইসলামী ব্যাংকের শাখায়। তারা মুরাবাহা করতে রাজি হল। তিনি ঐ দোকান থেকেই মেমো নিয়ে দিলেন এবং তার কাক্সিক্ষত এক লক্ষ টাকা গ্রহণ করে দোকানের বকেয়া আদায় করলেন। ওয়াকিবহাল মহল জানেন যে, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নয়; বরং এ জাতীয় ঘটনাই ব্যাংকগুলোর মুরাবাহার সাধারণ চিত্র। দু-এক জন ব্যতিক্রমী আল্লাহওয়ালা শাখা ম্যানেজারের অথবা বিনিয়োগের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের স¤পর্কে ভালো কথাও অবশ্য শোনা যায়, যারা মুরাবাহার শর্তগুলো পুরো করার চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু ব্যাংকপাড়ায় তা শুধুই ব্যতিক্রম।-মাসিক আলকাউসার এপ্রিল’৯

ইসলামী ব্যাংক কর্তৃক অনুশীলিত বাইয়ে সালামে শরীয়া লঙ্ঘনের ধরন ও বিধান

১। চুক্তিপত্রে পণ্যের নাম, ধরন, পরিমাণ, গুণাগুণ, মূল্য পরিশোধের সময় ও স্থান ইত্যাদি উল্লেখ না থাকা :

এগুলোর অনুপস্থিতিতে ক্রয়-বিক্রয়টি ফাসিদ বলে গণ্য হবে।

২। চুক্তি সম্পাদনের বৈঠকে মূল্য পরিশোধ না করা :

চুক্তি সম্পাদনকালে মূল্য পরিশোধ করা না হলে সালাম চুক্তিটি বাতিল বলে গণ্য হবে। কারণ এ ধরনের চুক্তি ঋণ ক্রয়-বিক্রয়ের অন্তর্ভুক্ত।

৩। মেয়াদান্তে গ্রাহক ব্যাংককে মালামাল সরবরাহ করতে ব্যর্থ হলে তার নিকট থেকে অগ্রিম প্রদত্ত মূল্যের অতিরিক্ত কিছু ব্যাংক কর্তৃক গ্রহণ করা :

গ্রাহক মালামাল করতে ব্যর্থ হলে ব্যাংক তার নিকট থেকে মালামালের মূল্য ফেরত নিতে পারে কিংবা গ্রাহকের হাতে মালামাল আসা পর্যন্ত তাকে সময় দিতে পারে।কিন্তু ব্যাংক মূল্যের অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করতে পারবে না। অতিরিক্ত কিছু গ্রহণ করলে তা সুদ বলে গণ্য হবে।

৪। সরবরাহকালীন সহজলভ্যতা নয়- এমন পণ্যের জন্য বাইয়ে সালাম করা :

সরবরাহকালীন মালামাল সহজলভ্য হওয়া বাইয়ে সালামের একটি শর্ত। শর্ত লঙ্ঘিত হলে ক্রয়-বিক্রয় ফাসিদ হয়ে যাবে। কারণ এক্ষেত্রে চুক্তিকৃত মালামাল বাস্তবে সরবরাহ করা যাবে না। ফলে ক্রেতা ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।

৫। বাইয়ে সালাম চুক্তিতে কোনো নির্দিষ্ট গাছের ফল বা কোনো নির্দিষ্ট ক্ষেতের ফসল বিক্রির শর্ত করা :

বাইয়ে সালামে এরূপ শর্ত করা জায়েয হবে না। কারণ যে কোনো কারণে নির্দিষ্ট গাছ বা ক্ষেতের ফসল সরবরাহ করা সম্ভব নাও হতে পারে। এরূপ অনিশ্চয়তাসহ চুক্তি সম্পাদন করা বৈধ নয়।

ইসলামী ব্যাংকে অনুশীলিত ইজারা বিল বাই তাহতা শিরকাতিল মিলক (Hire Purchase Under Shirkatul Meelk) পদ্ধতিতে শরীয়া নীতি লঙ্ঘনের ধরন

১। অবকাশকালে ভাড়া আদায় করা :

এ সময়ে সম্পদটি ব্যবহারযোগ্য না হওয়ার কারণে ভাড়া গ্রহীতা তা থেকে কোনো উপকার লাভ করতে পারে না। ফলে অবকাশকালের আদায়কৃত ভাড়া সুদ হিসেবে গণ্য হবে।

২। এইচপিএসএম পদ্ধতিতে ভাড়ায় প্রদত্ত সম্পদ বা মেশিনারিজ ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে গেলে তা থেকে ভাড়া আদায় করা :

সম্পদ ব্যবহারযোগ্য না হলে তা থেকে ভাড়া আদায় করা বৈধ নয়। এক্ষেত্রে আদায়কৃত ভাড়া সুদ হিসেবে গণ্য হবে।

৩। সম্পদ ক্রয়ে উভয় পক্ষের অংশগ্রহণ, মালিকানায় অংশীদারিত্বের অনুপাত, সম্পদের বিবরণ ইত্যাদি চুক্তিপত্রে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকা :

চুক্তিপত্র অপূরণকৃত থাকলে ভবিষ্যতে সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদের আশঙ্কা দেখা দেবে। তাই চুক্তিপত্র অপূরণকৃত রাখা বৈধ নয়।

৪। সম্পদের উপর ব্যাংকের মালিকানা অর্জন ব্যতীত ভাড়া আদায় করা :

মালিকানা অর্জন ব্যতীত কোনো সম্পদের উপর ভাড়া আদায় করা হলে তা সুদের অন্তর্ভুক্ত হবে।

৫। ভাড়ার উপর ভাড়া আরোপ করা :

এরূপ আদায়কৃত ভাড়া সুদ হিসেবে গণ্য হবে। কারণ ব্যবহারযোগ্য সম্পদের উপরই কেবল ভাড়া ধার্য করা যায়, অর্থের উপর নয়।

৬। সম্পদ ক্রয়ের পূর্বে ভাড়া ও বিক্রয় চুক্তি সম্পাদন করা :

এরূপ চুক্তি সম্পাদন করা বৈধ নয়। কারণ অস্তিত্বহীন সম্পদের ক্রয়-বিক্রয় চুক্তি করা বৈধ নয়। এরূপ চুক্তি বাতিল বলে গণ্য হবে।

৭। গ্রাহক কর্তৃক বিনিয়োগের অর্থ দিয়ে নির্দিষ্ট সম্পদ তৈরি না করে তা অন্য খাতে স্থানান্তর করা :

এরূপ বিনিয়োগ থেকে অর্জিত আয় সুদ হিসেবে গণ্য হবে। কারণ অস্তিত্বহীন সম্পদের উপর ভাড়া ধার্য করা যায় না।

৮। বাইয়ে মুরাবাহা ও বাইয়ে মুআজ্জাল পদ্ধতিতে প্রদত্ত বিনিয়োগকে এইচপিএসএম পদ্ধতিতে রূপান্তর করা বৈধ নয়।

৯। ভাড়া চলা কালে মালিকানার আনুপাতিক হারে সম্পদের রিস্ক ও দায় গ্রহণ না করা :

সুতরাং আবশ্যিক বীমাসহ যাবতীয় দায়ের ক্ষেত্রে ব্যাংককে অংশগ্রহণ করতে হবে। তা না হলে দায় গ্রহণ না করে মুনাফা ভোগের নামান্তর হবে, যা স্পষ্ট সুদ।

ইসলামী ব্যাংকে অনুশীলিত এইচপিএসএম পদ্ধতিতে শরীয়া নীতি লঙ্ঘন

কেস স্টাডি

একজন গ্রাহক তার শিল্পের জন্য মেশিন ক্রয় বাবদ ৫ বছর মেয়াদী ৫০০০০/= টাকা বিনিয়োগ নেবার জন্য ব্যাংকের কাছে আবেদন করল। আবেদন পত্রের সঙ্গে তিনি ৫০০০০/- টাকার একটি কোটেশনও উপস্থাপন করলেন। ব্যাংক কর্মকর্তা উক্ত গ্রাহকের সঙ্গে এইচপিএসএম চুক্তি সম্পাদনপূর্বক ৫০০০০/- টাকা প্রদান করলেন। চুক্তি অনুপাতে গ্রাহক যথারীতি কিস্তির টাকা পরিশোধ করেন।

উপরিউক্ত চুক্তির ক্ষেত্রে নিম্নোক্তভাবে শরীয়া নীতি লঙ্ঘিত হয়েছে :

এইচপিএসএম চুক্তিতে ব্যাংক ও গ্রাহকের অংশীদারিত্বের ব্যাপারটি স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। এখানে বিনিয়োগ প্রদানের দিন থেকে ভাড়াসহ কিস্তি হিসাবভুক্ত ও পরিশোধিত হয়েছে। অথচ মেশিন ক্রয়, পরিবহন ও মেশিনটি ব্যবহারযোগ্য হওয়ার জন্য গ্রাহককে জেস্টেশন পিরিয়ড না দিয়েই ভাড়া আরোপ করা হয়েছে যা শরীআতসম্মত হয় নি। ভাড়া প্রদানের হার, কিস্তি নির্ধারণ পদ্ধতি, বিনিয়োগের মেয়াদ, জেস্টেশন পিরিয়ড প্রভৃতি চুক্তিপত্রে বিশদভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। কিন্তু এখানে তা যথাযথভাবে পরিপালিত হয় নি।

ইসলামী ব্যাংকে অনুশীলিত মুশারাকা বিনিয়োগে শরীয়া নীতি লঙ্ঘনের ধরন

১। মূলধনের পরিমাণ, মুনাফা ও ক্ষতির হার চুক্তিপত্রে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকা, চুক্তিপত্র অপূরণকৃত রাখা এবং তারিখ উল্লেখ না থাকা।

২। চুক্তিবদ্ধ খাতে মূলধন ব্যবহার না করে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে মুশারাকার মূলধন ব্যবহার করা।

৩। উভয়পক্ষের সম্মতি ব্যতিরেকে একতরফাভাবে চুক্তির কোনো শর্ত পরিবর্তন করা।

৪। উভয়পক্ষ ব্যবসায়ের ক্ষতি মূলধন অনুপাতে বহন না করা।

৫। চুক্তিতে উভয়পক্ষ ব্যবসা পরিচালনায় অংশগ্রহণ করার কথা উল্লেখ থাকলে পরবর্তীতে এককভাবে কোনো একপক্ষ ব্যবসা পরিচালনা করা আর অন্যপক্ষকে তাতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ না দেয়া।

৬। উভয়পক্ষের মধ্যে ব্যবসায়ের মুনাফা চুক্তি অনুযায়ী বণ্টিত না হয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ অনুযায়ী বণ্টিত হওয়া।

৭। কোনো অংশীদার তার অংশটিকে পণ্যে রূপান্তরিত না করে লাভসহ অন্য কোনো অংশীদারের কাছে বিক্রি করে দেয়া।

৮। কোনো অংশীদার তার অংশের শরয়ী দখলদার না হয়ে তা অন্য কারো কাছে বিক্রি করা।

৯। ব্যবসা পরিচালনায় অংশগ্রহণকারীপক্ষ মুনাফা হারের পরিবর্তে নির্দিষ্ট পরিমাণ পারিশ্রমিক ভোগ করা।

১০। মুশারাকা ব্যবসা সম্পাদনের শুরুতে উভয়পক্ষের মূলধন উপস্থিত না থাকা।

১১। মূলধন অথবা শ্রম বিনিয়োগ অথবা দায়িত্ব বহন কোনোটাই না করে মুনাফায় অংশগ্রহণ করা।

মুশারাকা বিনিয়োগে শরীয়া নীতি লঙ্ঘনের ধরন

কেস স্টাডি

একজন গ্রাহক ব্যাংকে এসে বিনিয়োগ কর্মকর্তার কাছে বললেন, আমি একটি কাগজ উৎপাদনকারী প্রকল্প তৈরির জন্য আপনাদের ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে চাই। বিনিয়োগ কর্মকর্তা তাকে ঋণ ও বিনিয়োগের প্রকৃতি ও নিয়ম-পদ্ধতি বিশ্লেষণপূর্বক বললেন, আমরা আপনাকে মেশিন ক্রয় বাবদ বিনিয়োগ দিতে পারি। আর আপনি জমি ও বিল্ডিং নিজে সরবরাহ করবেন। বছর শেষে কারবারের লাভ অথবা ক্ষতি ৫০ ঃ ৫০ অনুপাতে আপনার ও আমাদের মধ্যে বণ্টিত হবে। কথা মতো চুক্তি ও কাজ সম্পাদিত হলো। বছর শেষে ২০০০০০০/- টাকা লাভ হলো। কিন্তু পরবর্তী বছর শেষে ২০০০০০/- টাকা ক্ষতি হলো এবং উভয়ে লাভ-ক্ষতি ৫০ ঃ ৫০ অনুপাতে বণ্টন করে নিল।

এ বিনিয়োগে নিম্নোক্তভাবে শরীয়া নীতি লঙ্ঘিত হয়েছে :

চুক্তির প্রথমেই উভয়পক্ষের মালিকানা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। উপরের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রকল্পের মোট মূল্য এবং তাতে গ্রাহক ও ব্যাংকের মালিকানার অংশ পৃথক পৃথক ও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা করা হয় নি। কারবারের কোন সম্পত্তি কোনো পক্ষ ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার, ভোগ দখল বা অন্য কোনো উপায়ে ব্যবহার করতে পারবে না। কারবার পরিচালনা পদ্ধতি, হিসাব রক্ষণ পদ্ধতি এবং কোনো পক্ষ কারবার পরিচালনা করলে তার বেতন চুক্তিপত্রে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে তা করা হয় নি। উল্লিখিত চুক্তি অনুযায়ী লাভ-ক্ষতি সবই ৫০ ঃ ৫০ অনুপাতে বণ্টিত হয়েছে যা শরীয়াসম্মত হয় নি। ইসলামী শরীয়ার বিধান মতে লাভ চুক্তিতে নির্ধারিত অনুপাতে এবং ক্ষতি মূলধন অনুপাতে বণ্টিত হতে হবে।

ইসলামী ব্যাংকে মুদারাবা বিনিয়োগে শরীয়া নীতি লঙ্ঘনের ধরন

১। মুদারাবা চুক্তির সমস্ত বিষয় লিখিত ও স্পষ্ট না হওয়া।

২। মুদারিব কর্তৃক ছাহিবুল মালের সম্পদের সাথে নিজের সম্পদ মিশ্রণ করে ব্যবসা করা, অথচ পৃথক কোনো হিসাব সংরক্ষণ না করা।

৩। মুদারাবা চুক্তিতে কারবারের অর্থ থেকে ব্যবসা পরিচালনার খরচ বহনের কথা উল্লেখ না থাকা সত্ত্বেও মুদারিব সমস্ত খরচ কারবার থেকে গ্রহণ করা।

৪। ব্যাংক কর্তৃক পুনঃমুদারাবা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রাব্বুল মাল থেকে অনুমোদ গ্রহণ না করা।

৫। উভয় পক্ষের সম্মতি ব্যতিরেকে একতরফাভাবে চুক্তি ভঙ্গ করা।

৬। কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন ভাতা মুদারাবা ফান্ডের অবণ্টিত অর্থ থেকে প্রদান করা।

বুহুস ফি কাযাইয়া ফিকহিয়্যাহ মুআসারাহ ২/১৬৭-১৬৮

৭। সুদি কারবারে জড়িত হওয়া। বিশেষত দুটি ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকগুলো সুদী লেনদেন করে থাকে। ১। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে বাধ্যতামূলক সঞ্চিতি (SRR)  এবং Foreign Currency Clearing Account এ জমাকৃত বৈদাশিক মুদ্রার উপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদ দেয়। ২। বিদেশী ব্যাংগুলোর সাথে ইসলামী ব্যাংকগুলোর যে Nostro Account থাকে সেখান থেকে চলতি হিসাব হলেও Overnight lending এর ভিত্তিতে তারা সুদ লাভ করে থাকে।এটা তাদের আয়ের অন্যতম একটি অংশ। সুদের এ অংশকে তারা তাদের লাভের অংশ হিসেবেই গণ্য করে থাকে। অন্য একটি সূত্র মতে সুদের এ অর্থ তারা আয় হিসাবে দেখায় না; অন্য একটি তহবিলে স্থানান্তরিত করে দেয়। কিন্তু এ অর্থটা কোন খাতে ব্যায় হয় সে ব্যাপারে সুষ্পষ্ট কোনো তথ্য সেখানে প্রদত্ত হয় নি।

ইসলামী ব্যাংকগুলোর সাথে সুদের সংশ্লিষ্টতা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এর সুদীর্ঘ সময়ের (২৩ বছর) শরীআহ কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য প্রফেসর শাহ মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান বলেন, প্রচলিত ব্যাংকিং এবং ইসলামী ব্যাংকিং পুরোপুরি সূদমুক্ত করা যাবে না। এটি অনেক লম্বা সময়ের ব্যাপার। এজন্য আমাদেরকেও বদলাতে হবে। তিনি আরো বলেন, ….. এতে তাদের (ইসলামী ব্যাংকের) যা ভুল-ভ্রান্তি হচ্ছে, আমাদের উচিৎ হবে সেগুলো ধরিয়ে দেয়া। আর তাদের উচিৎ হবে সেগুলো সংশোধন করে নেয়া। তিনি আরো বলেন, দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থা ইসলামী না হলে ব্যাংক ব্যবস্থা পুরোপুরি ইসলামী করণ করা যাবে না। রাষ্ট্রীয় কাঠামো, আইন ও শাসন, বিচার ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থাসহ সকল ক্ষেত্রে ইসলামী বিধান চালু থাকতে হবে। তবেই পুরোপুরি ইসলামী ব্যাংকিং আশা করা যায়। …. সুতরাং বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থা পুরোপুরি সূদমুক্ত করা সম্ভব নয়, কিছুটা সম্ভব। তিনি আরো বলেন, কিন্তু পুরোপুরি ইসলামী করণ করতে গেলে ব্যাংক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। সেই সঙ্গে আইন ঢেলে সাজাতে হবে। তাছাড়া এটা কখনোই সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেন, আমার জানা মতে, পরিপূর্ণ সুদমুক্ত এবং ইসলামী নিয়মানুসারে পরিচালিত কোনো ব্যাংক বর্তমান বিশ্বে নেই।- মাসিক আততাহরীক, মার্চ ’১৩।

বাংলাদেশে আয়োজিত একটি কনফারেন্সের প্রশ্নোত্তর পর্বে জাস্টিস আল্লামা তাকী উসমানী (হাফিযাহুল্লাহু তাআলা) কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকগুলোর বর্তমান লেনদেন পদ্ধতি হালাল, এমন কথা আপনি বলেছেন কি ? উত্তরে তিনি বললেন, কিছুতেই না। আমি কখনও এমন মন্তব্য করি না। এ ধরনের ঢালাও বক্তব্য আমি কখনও দেই না। কোনো প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের নিয়মপদ্ধতি পর্যবেক্ষণ, চুক্তিপত্রের শর্তাবলি যাচাই বাছাই এবং তাদের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে সম্যক অবগতি ছাড়া সে সম্পর্কে মন্তব্য করা সম্ভব নয়। মাসিক আলকাউসার মার্চ ’৯।

উল্লেখ্য, আমরা বলি না যে এ দেশের সবগুলো ইসলামী ব্যাংকের সবগুলো শাখাই উপরোক্ত ক্ষেত্রগুলোতে শরীয়া নীতি লঙ্ঘন করে থাকে। তবে মাঠ পর্যায়ের জরিপ মতে ইসলামী ব্যাংকগুলোর অধিকাংশ শাখায়ই উপরোক্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রে শরীয়া নীতি লঙ্ঘন করে থাকে এ কথা বলা যায়।

সারকথা, আমাদের এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য ইসলামী ব্যবস্থার ব্যাপারে নেতিবাচক ধারনা সৃষ্টি করা নয়। আমরা আন্তরিকভাবে ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থার ব্যাপারে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করি। আমরা চাই ইসলামী ব্যাংকগুলো উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি লাভ করুক। তবে সকল ইসামী ব্যাংকগুলোকে হতে হবে শরীয়া পালনের দিক থেকে আপোষহীন এবং কোয়ালিটিসম্পন্ন। তাই ইসলামী ব্যাংকগুলোর কর্তব্য হলো তাদের শরীয়া পরিপালনের সূচক ঊধ্বগামী করার জন্য আরো যা যা করা প্রয়োজন তার জন্য এখনি সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা এবং নাম সর্বস্বতা পরিহার করে সুদ ও নাজায়েয কারবারের অভিসম্পাত থেকে মুসলিম জনসাধারণকে রক্ষা করার জন্য বাস্তবমুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করা।এর জন্য মালিকপক্ষের আন্তরিক সদিচ্ছা, কর্মীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দান, কুরআন-হাদীসকে মূল থেকে (অনুবাদ থেকে নয়) বোঝার ও বিশ্লেষণ করার যোগ্যতা রাখেন এমন যোগ্যতাসম্পন্ন আলেমদের মাধ্যমে শরীয়া কাউন্সিল গঠন করা এবং একে সুপারভাইজারি কাউন্সিলে রূপান্তর করা, শাখায় শাখায় শরীয়া বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা এবং শরীয়া বিষয়ক অভিযোগ সেল গঠন করা খুবই জরুরী। এ বিষয়গুলো যথাযথরূপে বাস্তবায়িত হলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ইসলামী হওয়ার বিষয়টি সহজতর হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।

ইসলামী নামে গড়ে উঠা সোসাইটি-সমিতিতে অনুশীলিত মুদারাবা পদ্ধতিতে শরীয়া নীতি লঙ্ঘনের ধরন

১। অলাভজনক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধিত হয়ে অর্থলগ্নিকারী ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করা। এটা সুস্পষ্ট গারার (প্রতারণা) এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের নামান্তর।

২। সদস্য সংগ্রহের নামে বীমা পলিসির মত ব্রোকারেজ নীতি গ্রহণ করে কমিশন বাণিজ্য নীতি গ্রহণ করা। মুদারাবা তহবিল থেকে মাঠকর্মীদের এভাবে কমিশন প্রদান করা আদৌ বৈধ নয়।

৩। সিকিউরিটি মানি বা ব্রোকারেজ ফি নামে কর্মীদের থেকে অর্থ সংগ্রহ করে ব্যবসায় খাটানো।শ্রমিকদের থেকে ফি গ্রহণ করা ঘুষের নামান্তর। যা কোনো ভাবেই বৈধতার পর্যায়ে পড়ে না।

৪। মূলধন ফেরত ও লাভ প্রদানে শর্তারো করা। যথা জমাকারী এক বছরের পূর্বে তার মূলধন ফেরত নিতে পারবে না এবং দুই বছর পূর্বে টাকা ফেরত নিলে কোনো লভ্যাংশ পাবে না।এতে করে জমাকারীকে (রাব্বুল মাল) পূর্ণ বা আংশিক মুনাফা থেকে বঞ্চিত করা হয়। যা সুস্পষ্ট শরীয়া নীতির লঙ্ঘন।

৫। সদস্য (রাব্বুল মাল) থেকে ভর্তি ফি, পুনঃভর্তি ফি গ্রহণ করা।রাব্বুল মাল থেকে এ ধরনের ফি গ্রহণের বৈধতা ইসলামী শরীয়াতে নেই। কারণ এগুলো হয় ঘুষ না হয় আর্থিক দ-, যার কোনোটি ইসলামী শরীয়া মতে বৈধ নয়।

৬। ব্যবসার সাথে জড়িত সকল কর্মকর্তা-কর্মচারির বেতন মুদারাবা ব্যবসার অবণ্টিত অর্থ থেকে প্রদান করা।

৭। ফরম বিক্রির নামে টাকা ধার দিয়ে সুদ গ্রহণ করা।

৮। রিসিডিউল (পুনঃবিনিয়োগ) এর নামে কিস্তি আদায়ের মধ্য মেয়াদে পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দিয়ে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ গ্রহণের রূপ-রেখা নির্মাণ করা।

সারকথা, ইসলামী নামে গড়ে উঠা এসব সোসাইটি সমিতিতে গছব, খেয়ানত, রিশওয়াত, গারার, গাশ জাতীয় শরীয়ত পরিপন্থী বিষয়ের উপস্থিতিতির কারণে এবং তাদের কর্মপদ্ধতি ইসলামী অর্থনীতির মৌলিক নীতিমালার সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে তাদের কারবার বৈধ নয়। আমাদের দেশে এ জাতীয় আরো বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলোতে উপরোক্ত শরীয়ত পরিপন্থী বিষয়গুলোর সবগুলো কিংবা কেনো কোনোটি বিদ্যমান রয়েছে। এ ধরনের সংস্থা বা সোসাইটি গঠন করা, এগুলোর সদস্য, কর্মী ও মধ্যস্তকারী হওয়া এবং মুদারাবার ভিত্তিতে মানুষের টাকা জমা করে তা নিজ ইচ্ছামত বিলিবণ্টন করা সম্পূর্ণ অবৈধ। যৌথমূলধনী কারবার করার জন্য ইসলামী শরীয়াতে মুদারাবা ও মুশারাকার বিধান রয়েছে। কেউ বৈধ পন্থায় এ ধরনের কারবার করতে আগ্রহী হলে শুরু থেকেই শরীয়তসম্মত নিয়ম নীতি প্রণয়ন করে এবং সকল প্রকার নিষিদ্ধ কার্যক্রম থেকে মুক্ত থেকে তা করার অবকাশ রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে আধুনিক ব্যবসা-বাণিজ্য সম্বন্ধে সাম্যক ধারনা লাভ করে ফিকহ ফতওয়া বিষয়ে অভিজ্ঞমুফতিয়ানে কেরাম থেকে নীতিমালা অনুমোদন করিয়ে নিয়ে তদানুযায় কর্মপন্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *