মাওলানা মুহাম্মদ মনযূর নোমানী
মালফূয (৩৫) : মুবাল্লিগ হওয়ার সাথে সাথে তালেবে ইলম ও আল্লাহর স্মরণকারী বান্দাও হতে হবে।
একদিন ফজরের নামায বাদ নিযামুদ্দীনে (তাবলীগের মারকায) জামাআতে অংশগ্রহণকারী মুবাল্লিগদের এক বড় সমাবেশ ছিল। হযরতের তবীয়ত তখন এতটাই দুর্বল ছিল যে, তিনি বিছানায় শুয়েও আওয়াজ সহকারে দু-চার বাক্য বলতে পারছিলেন না। তখন তিনি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তার বিশেষ একজন খাদেমকে তলব করে তার মাধ্যমে উপস্থিত জামাআতকে এভাবে নসীহত করলেন।
আপনাদের এই সফর ও মেহনত-মুজাহাদা বেকার যাবে যদি না আপনারা ইলমে দীন ও যিকরুল্লাহর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব না দেন। ইলমে দীন ও যিকির হল দু’টি ডানা স্বরূপ। তা ছাড়া তাবলীগের আকাশে ওড়া সম্ভব নয়। যদি এদু’টি বিষয়ের ব্যাপারে গাফলত করা হয় তাহলে এ মেহনত-মুজাহাদার দ্বারা ফিতনা-ফাসাদ ও গোমরাহীর এক নতুন দরজা খুলে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। যদি ইলমই না থাকে তাহলে ইসলাম ও ঈমান শুধুমাত্র রুসূম ও নামসর্বস্ব হয়ে যাবে। আর আল্লাহ তা‘আলার যিকির ছাড়া যদি ইলম হয় তাও সরাসরি যুলমাত ও অন্ধকার। এমনিভাবে যদি ইলমে দীন ছাড়া যিকিরের আধিক্য হয় তাও বড় বিপদসঙ্কুল বিষয়।
মোটকথা, ইলমের মধ্যে নূর আসে যিকরুল্লাহ দ্বারা। ইলমে দীন ছাড়া যিকিরের আসল বরকত ও ফলাফল হাসিল হয় না। বরং কখনো কখনো শয়তান এ ধরনের জাহেল সুফীদেরকে নিজের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। অথচ এ কাজে ইলম ও যিকিরের গুরুত্বকে কোন অবস্থাতেই ভুলে যাওয়া চলবে না। সর্বদা তার জন্য বিশেষ ইহতিমাম করবে। এমনিভাবে দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতেও ইলম ও যিকিরের গুরুত্ব কখনোই ভুলবে না। তাহলে আপনাদের এই তাবলীগী আন্দোলন একটা ভবঘুরে আন্দোলনের ন্যায় হয়ে উঠবে। আল্লাহ না করুন, তখন আপনারা অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বেন।
এই আলোচনার দ্বারা হযরতের উদ্দেশ্য হচ্ছে, দাওয়াত ও তাবলীগের কর্মীগণ যে মেহনত, মুজাহাদা, সফর, হিজরত, ইসার ও কুরবানী করে, একেই যেন তারা আসল কাজ মনে না করে। দীন শিক্ষা দেয়া ও শিক্ষা গ্রহণ করা উভয়ই যিকরুল্লাহর মাধ্যমে করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিবে যিকিরের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করাকে নিজের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব মনে করে। অন্য ভাষায় বলতে গেলে, তাবলীগের কর্মীদের শুধু সিপাহী এবং মুবাল্লিগ হলে চলবে না, বরং তাদেরকে তালেবে ইলম এবং আল্লাহ তা‘আলাকে স্মরণকারী বান্দাও হতে হবে।
মালফূয (৩৮) : কাজ হওয়া আর বরকত আসা দু’টি ভিন্ন বিষয়
হযরত বলেন, লোকেরা আমার তাবলীগের বিভিন্ন বরকত দেখে মনে করে খুব কাজ হচ্ছে। অথচ কাজ এক বিষয় আর বরকত অন্য বিষয়। দেখো! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের পর থেকেই অসংখ্য বরকত প্রকাশ হচ্ছিল। কিন্তু কাজ শুরু হয়েছে আরো অনেক পরে। এ ক্ষেত্রেও তদ্রূপ মনে করো। আমি সত্য বলছি এখনো আসল কাজ শুরু হয়নি। কাজ শুরু হবে সেদিন, যেদিন মানুষ সাতশত বছর পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাবে। যদি এই কাজ বর্তমান অবস্থায়ই থেকে যায়, আর মানুষ এ কাজকে অন্যান্য আন্দোলনের মত একটি আন্দোলন মনে করে ও তাবলীগের কর্মীগণ ভ্রান্ত পথেই চলতে থাকে, তাহলে শত শত বছর পরে যে ফিতনা আসত, কয়েক মাসের মধ্যেই সে ফিতনা এসে যাবে। কাজেই এ কাজকে বুঝার প্রয়োজন রয়েছে।
মালফূয (৪১) : একমাত্র আহলে ইলম ও আহলে যিকির এ কাজকে হাতে নিলেই তাবলীগের কাজ পূর্ণ হবে
একদা হযরত ইরশাদ করেন, মাওলানা! দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে ইলম ও যিকিরের অত্যন্ত গুরুত্ব রয়েছে। ইলম ছাড়া না আমল হতে পারে, না আমলের জ্ঞান বা পরিচয় হতে পারে। যিকির ব্যতীত ইলম অন্ধকারই অন্ধকার। তার মধ্যে নূর আসতেই পারে না। কিন্তু আমাদের কর্মীদের মধ্যে তার বড় অভাব রয়েছে। আমি আরয করলাম, দাওয়াত ও তাবলীগই তো স্বয়ং একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরীযা। তার কারণে যিকিরের মাঝে কমতি হওয়ার ব্যাপারটি তো নিম্নোক্ত ঘটনার ন্যায় হল।
হযরত সাইয়িদ আহমাদ বেরলবী রহ. নিজের খাদেমদিগকে জিহাদের প্রস্তুতির জন্য যিকির-আযকারের পরিবর্তে নিশানাবাজী এবং ঘোড়সওয়ারের কাজে মশগুল করে দিলেন। তখন কেউ কেউ অভিযোগ করে বলেছিলেন যে, এখন তো পূর্বের ন্যায় অন্তরে নূর নেই। তার উত্তরে হযরত সাইয়িদ আহমাদ বেরলবী রহ. বলেন, হ্যাঁ, এখন পূর্বের ন্যায় যিকিরের নূর নেই বটে; তবে জিহাদের নূর আছে। আর বর্তমানে জিহাদই বেশি প্রয়োজন।
একথা শুনে হযরত বললেন, ইলম ও যিকিরের শিথিলতা আমাকে এজন্য অস্থির করেছে যে, আজ পর্যন্ত এ কাজে আহলে ইলম ও আহলে যিকিরগণ অংশগ্রহণ করেনি। যদি ঐ সকল বুযুর্গগণ এই কাজকে নিজের যিম্মায় নিয়ে নেয়, তাহলে এ কাজটি পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। কিন্তু উলামায়ে কেরাম ও আহলে যিকিরদের থেকে খুব অল্প সংখকই এ কাজে অংশগ্রহণ করেছে।
সূত্র : মাওলানা মুহাম্মদ ফরীদুদ্দীন অনূদিত, মাকতাবাতুয যাকারিয়া কর্তৃকপ্রকাশিত হযরতজী মাওলানা ইলিয়াস (র)-এর মালফূযাত; পৃষ্ঠা ৩৮, ৪১,৪৩।