হযরত পাহাড়পুরী হুযূর রহ. : কিছু স্মৃতি কিছু অনুভূতি

মাওলানা আহমাদুল্লাহ


এক.

১৪১৭ হিজরীর শাওয়াল মাস থেকে হযরত পাহাড়পুরী হুযূর রহ. জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়ায় বুখারী সানীর দরস দেয়া শুরু করেন। তখন অধমের রাহমানিয়ার শিক্ষকতার দ্বিতীয় বছর। লাগাতার ছয় বছর হুযূর রাহমানিয়ায় ছিলেন। এ সময় হুযূরকে নিকট থেকে দেখার, পরিচিত হওয়ার ও উপকৃত হওয়ার বিরাট সুযোগ এসে যায়। কিন্তু উদাসীনতায় চির অভ্যস্ত এ বান্দা সে নেয়ামতের যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারেনি।

সে সময় হুযূরের উপর ছাত্রদের তরবিয়তের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল। মাসিক তরবিয়াতী জলসায় বাদ যোহর হযরত রহ. বয়ান পেশ করতেন। বয়ানে আকাবিরদের তাযকিরা করতেন। তাদের বাণীসমগ্র নকল করতেন। অধিকাংশ বয়ান গুনাহ বর্জন সংক্রান্ত হত। বয়ানের আন্দায এমন ক্রিয়াশীল হত যে, শ্রোতাদের মধ্যে আমলের জযবা পয়দা হয়ে যেত। গুনাহ সম্পর্কে বলতেন যে, ‘যত প্রকার গুনাহ আছে এখনই ছাড়তে হবে; একদিন, একমুহূর্তও বিলম্ব করা যাবে না।’ এটা তো সকলেরই জানা কথা যে, গুনাহ এখনই ছাড়তে হবে। কিন্তু একথা হুযূর রহ. এর যবান থেকে উচ্চারিত হলে মনে হত যেন এই প্রথম শুনলাম; আগে কখনো শুনিনি। যার কারণে তা হৃদয়ের গভীরে রেখাপাত করত।

বয়ানের মধ্যে যেসকল আয়াত, হাদীস ও বুযুর্গদের বাণী ও আশ‘আর পেশ করতেন মনে হত তা যেন এ বয়ানের জন্যই রচিত হয়েছে। রাহমানিয়ায় একবার তৎকালীন সরকারী দল কর্তৃক উলামায়ে কেরামের উপর যুলুম-নির্যাতন চলছিল- বড় বড় আলেমকে কারাবরণ করতে হয়েছিল, ব্যাপকভাবে উলামায়ে কেরামের মাঝে অশান্তি বিরাজ করছিল। وبلغت القلوب الحناجر এর অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। তখন এক মজলিসে বয়ানের শুরুতে হুযূর রহ. এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন, قل لن يصيبنا الاما كتب الله لنا তখন মনে হল, যেন এ আয়াত এইমাত্র নাযিল হয়েছে। আমাদের মনের সকল হতাশা নিমিষেই দূর হয়ে গেল।

আরেক দিন তাহাজ্জুদ নামায সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে হুযূর বললেন, যদি কারো রাতের তাহাজ্জুদ ছুটে যায় তাহলে দিনে পড়ে নিবে। আল্লাহ রাত-দিনের মধ্য হতে একটিকে অপরটির বদল বানিয়েছেন। আয়াত পেশ করলেন, وهو الذى جعل الليل والنهار خلفة।

মোটকথা, হুযূরের প্রতিটি কথা অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে বের হত। যে কারণে শ্রোতাদের দিলের গভীরে রেখাপাত করত। হযরত রহ. বয়ানের সমর্থনে নুসূসের নির্বাচন বড় চমৎকারভাবে করতেন।

দুই.

অধীনস্তদের প্রতি তাঁর দয়া ও স্নেহ ছিল সীমাহীন এবং তরবিয়াতের আন্দায ছিল খুবই সূক্ষ্ম। এক রমাযানে ফোনের মাধ্যমে অনুমতি ও ঠিকানা নিয়ে হযরতের প্রতিষ্ঠিত আলমারকাযুল ইলমীর প্রধান কার্যালয় নূরনগর গেলাম। তখন টিনশেড মসজিদের নির্মাণ কাজ চলছিল। সকল ব্যস্ততা থেকে ফারেগ হয়ে হুযূর বান্দাকে সময় দিলেন; অথচ বান্দা এর যোগ্য ছিল না। এটা তাঁর অতি দয়ার বহিঃপ্রকাশ ছিল। ফেরার সময় পৌঁছতে যেন কোনরূপ সমস্যা না হয় সেজন্য হুযূর নিজের নৌকায় করে বান্দাকে নদী পারের ব্যবস্থা করে দিলেন। উল্লেখ্য, সেদিন ফেরার সময় হুযূর বান্দা থেকে ছোট একটি কাজ নিয়েছিলেন যেখান থেকে আমাদের শেখার অনেক কিছু রয়েছে।

হুযূর বান্দাকে বললেন, আপনি যাওয়ার সময় রাজফুলবাড়িয়া মাদরাসার মাওলানা সাঈদ সাহেবকে বলবেন, তিনি যেন আমার কাছে ফোন করেন। হুযূর এ কথাটি এভাবে বললেই পারতেন যেভাবে আমি উল্লেখ করলাম। হুযূরের নির্দেশ পালন বান্দার জন্য সৌভাগ্যের ছিল। কিন্তু হুযূর তা না করে লম্বা ভূমিকা কায়েম করে বললেন, আপনি যাওয়ার সময় রাজফুলবাড়িয়া মাদরাসার পাশ দিয়েই তো যাবেন। তখন যোহরের নামাযের সময় হয়ে যাবে। আর নামায হয়তো সেখানেই পড়তে হবে। সেখানে গেলে হয়তো পরিচিত কারো সাথে সাক্ষাতও হতে পারে। তখন মাদরাসার উস্তাদ মাওলানা সাঈদ সাহেবের সন্ধান নিয়ে উনার কাছে গিয়ে বলবেন, তিনি যেন আমার কাছে ফোন করেন।

হুযূরের এ দীর্ঘ ভূমিকার মধ্যে শেখার আছে অনেক কিছু। যার সারসংক্ষেপ এই, (১) সরাসরি কাউকে কোন কাজের হুকুম না করা। যেমন হাদীসে এসেছে, ‘যখন সাহায্য চাইবে আল্লাহর কাছেই চাইবে; কোন মাখলূকের কাছে নয়। (২) কখনো হুকুম করার প্রয়োজন হলে তা যেন আদিষ্ট ব্যক্তির জন্য বোঝা না হয়ে যায় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখা।

সেদিনের ঘটনায় হুযূরের আজীব কারামত প্রকাশ পেল। হুযূর বলেছিলেন যে, সেখানে গেলে হয়ত পরিচিত কারো সাথে সাক্ষাত হতে পারে। তো যখন আমি নামায পড়ার জন্য মসজিদে প্রবেশ করলাম, দেখি আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রামের এক লোক ছাত্রদের সাথে মসজিদে প্রবেশ করছেন। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, তিনি সে মাদরাসার মকতব বিভাগে শিক্ষকতা করছেন। এটা হুযূরের একটি কারামত মনে হল।

হুযূরের তরবিয়াতের আন্দায সম্পর্কে বান্দার সাথে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা। বান্দার একবার হজ্জের সফরের তাওফীক হয়েছিল। যাওয়ার সময় হুযূরের কাছ থেকে দু‘আ, নসীহত নিয়ে বিদায় নিয়েছি। কিন্তু বান্দার চিরাচরিত উদাসীনতা ও গাফলতীর কারণে আসার পর যথাসময় হুযূরের সাথে সাক্ষাত করা হয়নি। অনেকদিন পর যখন সাক্ষাত করতে গেলাম, হুযূর এ সম্পর্কে আমাকে সরাসরি কিছুই বললেন না। অন্য সময়ের মতই কথাবার্তা বললেন। কথা প্রসঙ্গে একপর্যায়ে বললেন, মাওলানা আব্দুর রাযযাক সাহেবের ছেলে নু’মান কি উমরা থেকে ফিরেছে? আমি বললাম, জ্বী ফিরেছে। বললেন, সে তো যাওয়ার আগে সাক্ষাত করেছে, কিন্তু আসার পর এখনো সাক্ষাত করেনি। তখন বান্দার আর বুঝতে বাকি রইল না। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো। এটা ছিল হুযূরের সূক্ষ্ম তরবিয়াত।

তিন.

বড়দের প্রতি তাঁর ভক্তি-শ্রদ্ধা ছিল সীমাহীন। তাঁর প্রতিও বড়দের স্নেহ-মমতা ছিল অতুলনীয়। উস্তাদ হিসেবে তিনি যাদেরকে পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন-

১. স্বীয় পিতা হযরত মাওলানা আখতারুযযামান ছাহেব রহ.

২. হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.

৩. হযরত মুহাদ্দিস ছাহেব হুযূর রহ.

৪. মুফতী আব্দুল মুঈয ছাহেব রহ.

৫. শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.

৬. হযরত মাওলানা আব্দুল মজীদ ঢাকুবী রহ.

৭. হযরত মাওলানা হারূন ছাহেব চাটগামী রহ.

৮. হযরত মাওলানা শরীফ কাশ্মীরী ছাহেব রহ.

৯. হযরত মাওলানা ওসি আহমাদ নোমানী ছাহেব রহ.

উস্তাদদের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে যেতেন। ‘হায়াতে মুহাদ্দিস রহ.’ সংকলন করতে গিয়ে আমরা বারবার তাঁর শরণাপন্ন হয়েছি। প্রতিবারই হুযূর আবেগ ভরা কণ্ঠে আমাদেরকে নতুন নতুন তথ্য দিয়েছেন। হুযূর বলতেন, হযরত মুহাদ্দিস ছাহেব হুযূরকে স্মরণ হলে আমি অন্য জগতে বিচরণ করি। কখনো বলতেন, তাঁর আলোচনায় আমি সুস্থতা অনুভব করছি। মুহাদ্দিস ছাহেব হুযূরের প্রতি তাঁর ভক্তি-শ্রদ্ধা এবং তাঁর প্রতি মুহাদ্দিস ছাহেব হুযূরের মমতার কথা স্বয়ং তাঁর যবান থেকে শুনুন। হুযূর বললেন,

আমি কামরাঙ্গীরচর যখন হাদীস পড়াই তখন একদিন মুহাদ্দিস ছাহেব হুযূরের সাথে সাক্ষাত করার জন্য যাত্রাবাড়ি গেলাম। হুযূরের কাছে আগ্রহ প্রকাশ করলাম যে, লালবাগ মাদরাসায় হুযূরের কাছে তিরমিযী শরীফ পড়েছি। এখন তো হাদীস পড়াই; কিন্তু আপনার কাছে পড়ার যে তীব্র পিপাসা ছিল সে পিপাসা তো মিটল না। যদি অনুমতি দেন তাহলে প্রতিদিন যাত্রাবাড়ি এসে আপনার দরসে আবার পড়ব এবং কামরাঙ্গীরচর গিয়ে ছাত্রদের পড়াব। তখন হুযূর তাওয়াযূ প্রকাশ করেই গেলেন। মোটকথা,আমাকে অনুমতি দিলেন না। তখন আমি জযবায়ে মহব্বতে বে-চাইন হয়ে বলতে শুরু করলাম, এভাবে খালী হাতেই কি ফিরে যাব? আমি আপনার খিদমত থেকে কী নিয়ে যাব?

আহ! কি শফকত! হুযূর নিজ হাতে আমার টুপি খুলে মাথায় ফুক দেয়া শুরু করলেন। মাওলানা রফীক আহমাদ ছাহেবসহ অন্যরা বলতে লাগলেন, হযরত মুহাদ্দিস ছাহেব হুযূর তো যিন্দেগীতে কারো মাথায় দম করেননি; আপনার কিসমত এত বড় যে, আপনার মাথায় দম করলেন। তখন আমি বললাম, যদিও হুযূর আমাকে তিরমিযীর দরসে বসার অনুমতি দেননি; কিন্তু পুরো তিরমিযী মুখের দমের মাধ্যমে দিয়ে দিলেন। এরপর হুযূর বললেন, আরেকটু বসেন। হুযূরের পায়ে ব্যথা থাকা সত্ত্বেও আস্তে আস্তে দাঁড়িয়ে র‌্যাকের উপর থেকে মিষ্টির ডিব্বা নামিয়ে বললেন, মিষ্টি খান। আমি সেখান থেকে ইচ্ছামত মিষ্টি খেলাম। এ কথা আমার মুখে আসল না যে, আমার তো ডায়াবেটিস, তাই মিষ্টি খাই না। ভাবলাম, হুযূর কষ্ট করে আমাকে মিষ্টি নামিয়ে দিয়েছেন। এ মিষ্টি খেলে বরং আমার ডায়াবেটিসের শেফা হবে ইনশাআল্লাহ। (সূত্র: হায়াতে মুহাদ্দিস ছাহেব রহ.; পৃষ্ঠা ৪০৯)

পাহাড়পুরী হুযূরের স্মৃতিচারণ থেকে আমরা হুযূরের নামে একটি লেখা প্রস্তুত করে হায়াতে মুহাদ্দিস গ্রন্থে ছাপালাম। সে লেখা যখন হুযূরকে পড়ে শোনানো হল, হুযূর ছোট শিশুর ন্যায় যারযার করে কাঁদতে শুরু করলেন। আমাদের জন্য মন খুলে দু‘আ করলেন।

অন্যান্য উস্তাদদের সাথেও হুযূরের এমনই সম্পর্ক ছিল। হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ. এর সাথে তো হুযূরের ইশক এবং ফানাইয়্যাতের সম্পর্ক ছিল। যে কারণে হযরত হাফেজ্জী হুযূরের ইন্তিকালের পর দ্বিতীয় কোন শাইখ গ্রহণ করেননি।

চার.

হুযূর দীনের ব্যাপারেও আর্থিক জরুরত মানুষের কাছে সরাসরি পেশ করতেন না। আল্লাহর উপর ভরসা করে কাজ শুরু করে দিতেন। আল্লাহর বান্দারা সাহায্যে এগিয়ে আসত। হুযূরের স্বভাবের মধ্যে ইসতিগনার সিফাত বিদ্যমান ছিল। হুযূর যখন মা’যূর হয়ে গেলেন এবং ফোনের যোগাযোগও বন্ধ হয়ে গেল তখন বান্দা একদিন আরয করল যে, আপনার সাথে আমার ইসলাহী সম্পর্ক ছিল। কিন্তু এখন তো যোগাযোগ কঠিন হয়ে গেছে; এখন কী করব? বান্দার উদ্দেশ্য ছিল, হুযূর এ কথা বলবেন যে, যোগাযোগ যতটুকু হচ্ছে এতটুকুই উপকৃত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। বান্দার একীনও এটাই ছিল। আর যারা এ অবস্থায় হুযূরকে ছেড়ে অন্য মুসলিহ ধরার ইচ্ছায় মশওয়ারা চাইত তাদেরকেও বান্দা এ কথাই বলত যে, হুযূরের অস্তিত্বই তোমার ইসলাহেরজন্য যথেষ্ট; অন্য চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু হুযূরের ইসতিগনার অবস্থা দেখুন। হুযূর আমাকে কাঙ্ক্ষিত উত্তর না দিয়ে উত্তর দিলেন অমুক মুরুব্বীর সাথে সম্পর্ক করতে পারেন। কিন্তু বান্দা তা করেনি।

আল্লাহ তা‘আলা হযরত রহ. এর গোটা জীবন থেকে আমাদেরকে শিক্ষা গ্রহণের তাওফীক দান করুন এবং তাঁকে জান্নাতে উচ্চ মাকাম নসীব করুন। আমীন।

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *