প্রশ্ন : কি কি বিষয়ে ঈমান আনা আবশ্যক?
উত্তর : যেসব বিষয়ে ঈমান আনতে হয় তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে তুলে ধরা হল।
(১) আল্লাহর উপর ঈমান
বস্তুত তিনটি বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার উপর ঈমান আনয়নের পূর্ণাঙ্গতা প্রকাশ পায়।
১. আল্লাহ তা‘আলার সত্তা ও তাঁর অস্তিত্বে বিশ্বাস করা।
২. আল্লাহ তা‘লার সিফাত তথা গুণবাচক বিষয়াবলিতে বিশ্বাস করা। আল্লাহ তা‘আলার গুণাবলি তাঁর গুণবাচক নামসমূহে ব্যক্ত হয়েছে।
৩. তাওহিদ তথা আল্লাহ তা‘আলার একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন করা।
(২) মালা-ইকা (ফেরেশতা) সম্বন্ধে ঈমান।
ফেরেশতা সম্বন্ধে বিশ্বাস করতে হবে, তাঁরা আল্লাহ তা‘লার নূরের এক বিশেষ সৃষ্টি। তাঁরা পুরুষ ও নয় নারী ও নয়। তাঁরা কাম, ক্রোধ, লোভ প্রভৃতি রিপু হতে মুক্ত। তাঁরা সম্পূর্ণ নিষ্পাপ। আল্লাহ তা‘লার নির্দেশের সামান্যতম ব্যত্যয় ও তাঁরা করে না। তাঁরা নানা রকম রূপ ধারণ করতে সক্ষম। আল্লাহ তা‘লা তাঁদেরকে বিপুল শক্তির অধিকারী করে সৃষ্টি করেছেন। এবং তাঁদেরকে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করে রেখেছেন।
(৩) নবী ও রাসূল সম্বন্ধে ঈমান।
আল্লাহ তা‘আলা মানব ও জিন জাতির পথ প্রদর্শনের জন্য যুগে যুগে আসমানী গ্রন্থ অবতীর্ণ করেন। সেই গ্রন্থের ধারক বাহক বানিয়ে আল্লাহ তা‘আলা নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁদেরকে জিন ও মানব জাতির কাছে প্রেরণ করেছেন। মানব জাতির এ বিশেষ শ্রেণীকে নবী বা পয়গম্বর বলা হয়। নবীদের মধ্য হতে যাঁরা বিশেষভাবে নতুন আসমানী গ্রন্থের অধিকারী হন তাঁদেরকে রাসূল বলা হয়। আর যাঁরা নতুন কিতাব প্রাপ্ত হন নি; বরং পূর্ববর্তী নবীদের প্রাপ্ত কিতাব প্রচারের দায়িত্ব পালন করেন তাঁদেরকে শুধু নবী অভিধায় অভিহিত করা হয়।
নবী রাসূলদের প্রতি ঈমান আনয়নের ক্ষেত্রে প্রধানত যেসব বিষয়াবলিতে বিশ্বাস রাখা আবশ্যক তা হল,
১. নবীগণ নিষ্পাপ। তাঁদের দ্বারা কোনো ধরনের পাপ সংঘটিত হয় না।
২. নবীগণ মানুষ। তাঁরা আল্লাহ নন, আল্লাহর পুত্র ও নন। এবং তাঁরা আল্লাহর রূপান্তরও (অবতার) নন; বরং তাঁরা আল্লাহর একনিষ্ঠ প্রতিনিধি। জিন ও মানব জাতিকে সৎ পথ প্রদর্শনের জন্যই কেবল তাঁরা পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছেন।
৩. নবীগণ আল্লাহ তা‘আলার বাণী যথাযথরূপে পৌঁছে দিয়েছেন।
৪. নবীদেরক্রমধারা আদম আ. থেকে শুরু হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত এসেপরিসমাপ্ত হয়েছে।
৫. রাসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্ব শ্রেষ্ঠ নবী এবং শেষ নবী। তাঁর পর আর কোনোনবী আসবে না। কেউ নবী হওয়ার দাবি করলে সে পিথগামী এবং কাফের বলে বিবেচিত হবে।
৬. নবীগণ নিজ নিজ কবরে জীবিত আছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও পবিত্র রওযা মুবারকে জীবিত আছেন। তাঁর রওযায় সালাম দেয়া হলে তিনি শুনতে পান এবং উত্তর প্রদান করে থাকেন।
৭. সমস্ত নবী সত্য ছিলেন। সবার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। তবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমনের পর পূর্ববর্তী নবীদের শরীআত রহিত হয়ে গেছে। এখন কেবল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শরীআত ও তাঁর আনুগত্যই গৃহীত হবে।
৮. নবীদের মাধ্যমে বিভিন্ন সময় সংঘটিত অলৌকিক ঘটনাবলী সত্য। এতে বিশ্বাস করাও ঈমানের অঙ্গীভূত।
(৪) আল্লাহ তা‘আলার কিতাব সম্বন্ধে ঈমান।
আল্লাহ তা‘লা মানব ও জিন জাতির দিক নির্দেশনার জন্য নবীদের কাছে তাঁর বাণীসমূহ প্রেরণ করে থাকেন। এ বাণী ও আদেশ নিষেধের সমষ্টিকে কিতাব বা আসমানী গ্রন্থ নামে অভিহিত করা হয়। আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের উপর ঈমান আনয়নের ক্ষেত্রে প্রধানত যেসব বিষয়াবলিতে বিশ্বাস রাখা আবশ্যক তা হল,
১. এ সকল কিতাব আল্লাহ তা‘আলার বাণী সমগ্র; মানব রচিত নয়।
২. আল্লাহ যেমন অবিনশ্বর ও চিরন্তন তাঁর বাণীও তদ্রƒপ অবিনশ্বর ও চিরন্তন।
৩. আল্লাহর কিতাবসমূহের মধ্যে সর্ব শেষ কিতাব আলকুরআন সর্বশ্রেষ্ঠ।
৪. কুরআন শরীফ সর্ব শেষ কিতাব। এর পর আর কোনো কিতাব অবতীর্ণ হবে না। কিয়ামত অবধি কুরআনেরই বিধান চলবে। সর্ব শ্রেষ্ঠ এ কুরআনের মাধ্যমে অন্যান্য কিতাবসমূহ রহিত হয়ে গেছে।
৫. কুরআনের সংরক্ষণ কল্পে আল্লাহ তা‘লা নিজেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সতুরাং কেউ এর বিন্দুমাত্র পরিবর্তন সাধন করতে পারবে না।
(৫) পরকাল সম্বন্ধে ঈমান।
পরকাল সম্বন্ধে ঈমান আনয়নের ক্ষেত্রে প্রধানত যেসব বিষয়াবলিতে বিশ্বাস রাখা আবশ্যক তা হল,
১. কবর জগতের পশ্নোত্তর সত্য।
২. কবর জগতের আজাব ও শাস্তি বিধান সত্য।
৩. পুনরুত্থান ও হাশর ময়দানে অনুষ্ঠিতব্য প্রক্রিয়াবলী সত্য।
৪. আল্লাহ তা‘আলার বিচার ও হিসাব নিকাশ সত্য।
৫. পাপ পূণ্যের পরিমাপ সত্য।
৬. আমল নামার প্রাপ্তি সত্য।
৭. হাউজে কাউসার (সুমিষ্ট জলাধার) সত্য।
৮. পুলসিরাত (জাহান্নাম পারাপার সেতু) সত্য।
৯. শাফায়াত এবং সুপারিশমালা সত্য।
১০. জান্নাত সত্য।
১১. জাহান্নাম সত্য।
১২. তাকদির বা নিয়তি সম্বন্ধে ঈমান।
তাকদির সম্বন্ধে ঈমান আনয়নের ক্ষেত্রে প্রধানত যেসব বিষয়াবলিতে বিশ্বাস রাখা আবশ্যক তা হল,
১. সবকিছু সৃষ্টি করার পূর্বেই আল্লাহ তা‘আলা সব কিছু লিখে রেখেছেন।
২. সবকিছু ঘটার পূর্বেই আল্লাহ তা‘আলা সেসব কিছু সম্বন্ধে অবহিত থাকেন এবং তাঁর জানা ও ইচ্ছা অনুসারেই সব কিছু সংঘটিত হয়।
৩. তিনি ভাল এবং মন্দ সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা।
৪. আল্লাহ তা‘আলা কলম দ্বারা লওহে মাহফুজে (সংরক্ষিত ফলকে) তাকদিরের সব কিছু লিখে রেখেছেন।
৫. তাকদিরে লেখা আছে বলে মানুষ নিজেকে দায়িত্বহীন মনে করবে না। তেমনিভাবে তাকদিরকে এড়িয়ে আল্লাহ তা‘আলার পরিকল্পনার বাইরে সে কিছু করে ফেলতে সক্ষম বলে মনে করবে না।
৬. আল্লাহ প্রদত্ত কোনো বিধানই মানুষের সাধ্যের বাইরে নয়। আল্লাহ তা‘আলার উপর কোনো কিছু আবশ্যক নয়।
– সূরা বাকারা ১৭৭, ২৮৫, ২৮৬, সূরা আম্বিয়া ২৭, ৪৭, সূরা মুদ্দাসসির ২৬, ৩১, সূরা আহযাব ৩৯,৪০, সূরা মায়িদা ৬৭, সূরা হিজর ৯, সূরা তওবা ২৯, সূরা মু‘মিন ১০০, সূরা নূহ ২৫, সূরা যুমার ৬৮, সূরা ইয়াসীন ৭৯, সূরা রূম ২৭, সূরা তাকাসুর ২, সূরা বনী ইসরাঈল ১৩, ৩৬, সূরা আ‘রাফ ৮-৯, সূরা আলহাক্কা ১৯,২৫ সূরা কাহাফ ৪৯, সূরা কাউসার ১, সূরা নিসা ১১৬, সূরা আলইমরান ১৩৩, সূরা নাজম ১৩-১৫ সূরা আলকারিয়া, সূরা হুমাযা, সূরা ফজর, সূরা ইউসুফ ৬৭, সূরা হাদীদ ২২, সূরা আনয়াম, ৫৯, সহীহ বুখারী হাদীস ৩৪, ৩৫, ৫০, ২২৭৭, ৩০৭২, ৭২৮৭, ৬২০৮, সহীহ মুসলিম হাদীস ১, ৪৬৯, ৪৭২, ১৩৪৭, ৬৩০৬, ৭৩১০, সুনানে তিরমিযী হাদীস ২৪১৭,৪৮০১, ১০৭৭, সুনানে আবু দাউদ ২০৭০, ফাতহুলবারী ৩/৫২, ২৫/৭, আলজামে লি আহকামিল কুরআন ১/১৭৮, মা‘আরিফুল কুরআন ১/১৮৬, ফাতাওয়া হাক্কানিয়া ১/১৫০, ১৫৮, আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল ১/১৩, ১৪।