হাদীসের আলোকে রোযা ভাঙ্গার পরিণাম : প্রকৃত রোযা, ইফতার ও সাহরী

হাফিজুর রহমান

রোযা হলো জাহান্নাম থেকে রক্ষাকবচ ঢাল স্বরূপ, গুনাহ করে ঢাল ভেঙ্গে ফেলো না

১। আবূ  হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, রোযা হলো ঢাল সদৃশ। যদি তোমাদের কেউ রোযা থাকে সে যেন অন্যায় অশ্লীল কাজ না করে এবং মূর্খতাসুলভ আচরণ না করে। কেউ যদি তার সাথে বিবাদে লিপ্ত হয় বা বকা দেয় তাহলে সে যেন বলে, আমি রোযাদার। -সহীহ বুখারী; হাদীস ১৮৫৬।

২। আবূ  উবাইদা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, রোযা হলো ঢাল স্বরূপ; যতক্ষণ না একে রোযাদার (গুনাহ করে) ভেঙ্গে ফেলে। -সুনানে নাসাঈ; হাদীস ২২৩২, মুসনাদে আহমাদ; হাদীস ১৬৯০।

মিথ্যাচার রোযা কবুলের অন্তরায়

হযরত আবূ  হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা, মিথ্যাকর্ম ও অজ্ঞতাসুলভ আচরণ পরিত্যাগ করলো না তার পানাহার ত্যাগে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। -সহীহ বুখারী; হাদীস ১৮৬৫, সুনানে আবূ দাউদ; হাদীস ২৩৬২।

রোযা যেন নিছক অনাহারই না হয়

আবূ  হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, অনেক রোযাদার এমন রয়েছে যাদের রোযার মাধ্যমে অনাহারে থাকা ও তৃষ্ণার্ত থাকা ছাড়া তাদের কিছুই লাভ হয় না। -সহীহ ইবনে হিব্বান; হাদীস ৩৪৭২, মুসতাদরাকে হাকেম; হাদীস ১৫৭১।

রোযা রেখে বিনা কারণে ভেঙ্গে ফেলার মর্মন্তুদ শাস্তি

হযরত আবূ  উমামা রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। স্বপ্নে দেখলাম আমার নিকট দুই ব্যক্তি আগমন করল। তারা আমার বাহুদ্বয় ধরে আমাকে এক দুর্গম পাহাড়ে নিয়ে এলো। তারপর আমাকে বলল, আপনি পাহাড়ের উপর উঠুন। আমি বললাম, আমি তো উঠতে পারব না। তারা বলল, আমরা আপনাকে সহজ করে দিব। আমি উপরে উঠলাম। যখন পাহাড়ের সমতলে পৌঁছালাম, হঠাৎ ভয়ঙ্কর আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি বললাম, এসব কিসের আওয়াজ? তারা বলল, এটা জাহান্নামীদের আর্তনাদ। তারপর তারা আমাকে নিয়ে এগিয়ে চলল। হঠাৎ কিছু লোক দেখতে পেলাম, যাদেরকে তাদের পায়ের মাংসপেশী দ্বারা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এবং তাদের মুখের দুই প্রান্ত ছিড়ে ফেলা হয়েছে এবং তা থেকে রক্ত ঝরছে। আমি বললাম, এরা কারা? তারা বলল, যারা ইফতারের সময় হওয়ার আগেই রোযা ভেঙ্গে ফেলে। -সহীহ ইবনে খুযাইমা; হাদীস ১৯৮৬, সহীহ ইবনে হিববান; হাদীস ৭৪৪৮, সুনানে নাসায়ী কুবরা; হাদীস ৩২৮৬, মুসতাদরাকে হাকিম; হাদীস ১৬০৯, তবারানী; হাদীস ৭৬৬৬।

রোযা রেখে বিনা কারণে ভেঙ্গে ফেললে আজীবন রোযা রাখার দ্বারাও তার ক্ষতি পূরণ হবে না

১। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. বলেন, যে ব্যক্তি অসুস্থতা ও সফর ব্যতীত ইচ্ছাকৃতভাবে রমাযানের একটি রোযাও ভঙ্গ করে, সে আজীবন রোযা রাখলেও ঐ রোযার হক আদায় হবে না। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা; হাদীস ৯৮৯৩, মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক; হাদীস ৭৪৭৬, সহীহ বুখারী ৪/১৬০।

২। হযরত আলী রাযি. বলেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে রমাযান মাসের একটি রোযা ভঙ্গ করবে, সে আজীবন সেই রোযার (ক্ষতিপূরণ) আদায় করতে পারবে না। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা; হাদীস ৯৮৭৮।

রোযাদারকে ইফতার করানোর প্রতিদান

যায়েদ ইবনে খালেদ জুহানী রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে ইফতার করাবে সে রোযাদরের মতো প্রতিদান লাভ করবে। তবে রোযাদারের প্রতিদান হতে সামান্য পরিমাণও হ্রাস করা হবে না। -সুনানে তিরমিযী; হাদীস ৮০৭, মুসনাদে আহমাদ; হাদীস ১৭০৩৩।

খেজুর দ্বারা ইফতার করবে, তা না হলে পানি দ্বারা ইফতার করবে

সালমান বিন আমের রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ যখন ইফতার করবে সে যেন খেজুর দ্বারা ইফতার করে। কারণ খেজুর বরকতময় খাদ্য। যদি সে খেজুর না পায় তবে পানি দ্বারা ইফতার করবে। কারণ পানি হলো পবিত্র পানীয়। -সুনানে আবূ  দাউদ; হাদীস ২৩৫৫, সুনানে তিরমিযী; হাদীস ৬৯5।

সময় হওয়ার সাথে সাথে ইফতার করুন

১। সাহল বিন সা’দ রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মানুষ যতদিন সময় হওয়ার সাথে সাথে দ্রুত ইফতার করবে ততদিন তারা কল্যাণের মাঝে থাকবে। -সহীহ বুখারী; হাদীস ১৯৫৭, সহীহ মুসলিম; হাদীস ১০৯৮, সুনানে তিরমিযী; হাদীস ৬৯৯।

২। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, সকল নবীকে সময় হওয়ার পরপরই ইফতার তাড়াতাড়ি করতে এবং সাহরী শেষ সময়ে খেতে আদেশ করা হয়েছে। -আলমুজামুল আওসাত লিততাবারানী; হাদীস ১৮৮৪, মাজমাউয যাওয়াইদ; হাদীস ২৬০৯।

ইফতার করে দু পড়বে

১। মু‘আয ইবনে যুহরা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইফতার করে নিম্নোক্ত দু‘আটি পাঠ করতেন-

اللهم لك صمت وعلى رزقك افطرت

অর্থ : হে আল্লাহ! আমি তোমার জন্যই রোযা রেখেছিলাম এবং তোমার দেয়া আহার্য দ্বারাই ইফতার করলাম। -সুনানে আবূ দাউদ; হাদীস ২৩৫৮।

২। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, ইফতারের পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দু‘আটি পড়তেন-

ذَهَبَ الظَّمَأُ وَابْتَلَّتِ الْعُرُوْقُ وَثَبَتَ الْأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللهُ

অর্থ : পিপাসা দূর হলো, শিরা-উপশিরা সতেজ হলো। আর আল্লাহ তা‘আলা যদি চান তাহলে রোযার সওয়াব লিপিবদ্ধ হল। -সুনানে আবূ দাউদ; হাদীস ২৩৫৭, মুসতাদরাকে হাকেম; হাদীস ১৫৭৬।

সাহরী বরকতময় খাদ্য

হযরত আনাস রাযি. হতে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা সাহরী খাও। কারণ সাহরীতে বরকত রয়েছে। -সহীহ মুসলিম; হাদীস ১০৯৫, সহীহ বুখারী; হাদীস ১৮৮৮।

বিলম্বে সাহরী খাওয়া সুন্নাত

১। সাহল ইবনে সা’দ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আমার পরিবারের সাথে সাহরী খেতাম। এরপর দ্রুত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে নামাযে শরীক হতাম। -সহীহ বুখারী; হাদীস ১৯২০।

২। যায়েদ ইবন সাবেত রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাহরী খেতাম। এরপর তিনি নামাযে দাঁড়াতেন। আনাস রাযি. বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, ফজরের আযান ও সাহরীর মাঝে কী পরিমাণ সময়ের ব্যবধান হতো? তিনি বললেন, পঞ্চাশ আয়াত পাঠ পরিমাণ সময়ের ব্যবধান হতো। -সহীহ বুখারী; হাদীস ১৯২১।

এক ঢোক পানি দিয়ে হলেও সাহরী করো

আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সাহরী খাওয়া বরকতপূর্ণ কাজ। সুতরাং তোমরা তা পরিত্যাগ করো না। এক ঢোক পানি দিয়ে হলেও সাহরী করো। কারণ যারা সাহরী খায় আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতারা তাদের জন্য রহমতের দু‘আ করেন। -মুসনাদে আহমদ ৩/১২, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা; হাদীস ৯০১০, সহীহ ইবনে হিব্বান; হাদীস ৩৪৭৬।

সাহরী খাওয়া ইহুদী-খ্রিস্টানদের রোযা ও মুসলিমদের রোযার মাঝে ব্যবধান তৈরি করে

আমর ইবনুল আস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমাদের রোযা ও আহলে কিতাবদের রোযার মাঝে পার্থক্য হলো সাহরী খাওয়া (আমরা সাহরী খাই; তারা খায় না)। -সহীহ মুসলিম; হাদীস ১০৯৬।

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *