ইস্ মে ভী খায়ের হ্যায়…


রাজা হিন্দু ধর্মালম্বী। তার বিশেষ উপদেষ্টা মুসলমান। দরবারে এবং সফরে সবসময়ই সে রাজার সাথে থাকতো। রাজাও এ সহকারীর প্রতি ছিলেন খুবই অনুরক্ত। এক মুহূর্তের জন্যেও তাকে হাতছাড়া করতে চাইতেন না।

রাজার এ উপদেষ্টার একটা বিশেষ অভ্যাস ছিলো- ভালো মন্দ যাই ঘটতো, সে শুধু বলতো, ‘ইস্ মে ভী খায়ের হ্যায়। এর মধ্যেও কল্যাণ আছে।’ যা হয়েছে ভালোর জন্যেই হয়েছে।

একবার রাজা গেছেন শিকারে। সাথে মুসলমান সহকারী। দিনের শুরুতে আবহাওয়া ভালোই ছিলো। হঠাৎ বৃষ্টি এলো। মুষলধারে বৃষ্টি। উপদেষ্টা সমেত রাজা বিপদে পড়ে গেলেন। কোনরকম একটা বড় গাছের নিচে আশ্রয় নিলেন। ভালো আবহাওয়া দেখে বের হয়েছিলেন। এমন হবে বুঝতে পারলে রাজা বেরই হতেন না।

অনেক্ষণ পরে বৃষ্টি কমলো। রাজার শিকারের ইচ্ছে শেষ হয়ে গেছে। রাজপ্রাসাদে ফেরার জন্যে রওয়ানা হলেন। বৃষ্টি কমলে কী হবে। পথঘাট হয়ে গেছে পিচ্ছিল ও বিপদশঙ্কুল। অনভ্যস্ত পায়ে রাজা হাঁটা শুরু করলেন।

কিন্তু যা আশঙ্কা করা হচ্ছিলো তাই হলো। কর্দমাক্ত পথে রাজার পা পিছলে গেলো। কাদায় মাখামাখি হয়ে সহকারীর কাঁধে ভর করে রাজপ্রাসাদে ফিরে বুঝতে পারলেন, অবস্থা ধারণার চাইতেও খারাপ। ডান পা’টা একেবারে ভেঙ্গে গেছে। রাজচিকিৎসক বলেছে পা’টা সারতে দীর্ঘদিন সময় লাগবে। এসময়টা রাজাকে পরিপূর্ণ শয্যাশায়ী থাকতে হবে।

এমন আশঙ্কাজনক অবস্থাতেও রাজার সে সহকারী বললো, ‘ইস্ মে ভী খায়ের হ্যায়। এর মধ্যেও কল্যাণ আছে’। তার এ কথা শুনে রাজা ভয়ঙ্করভাবে রেগে গেলেন। এমনকি তাকে নিজের সহকারীর পদ থেকে বরখাস্ত করে দরবার থেকে বিদায় করে দিলেন।

নিজের বরখাস্তের সংবাদ পেয়েও সেই ঈমানদার উজীর বললো, ‘ইস মে ভী খায়ের হ্যায়। আমার চাকরি হারানোর মধ্যেও কল্যাণ আছে’।

***

বেশ কিছুদিন পর। রাজার ভাঙ্গা পা’ সেরে উঠেছে। তবে পা’টা মারাত্মকভাবে ভাঙ্গার কারণে কিছুটা খোড়া হয়ে গেছেন। হাটতে গেলে একদিকে কাত হয়ে হাটেন। এমন অবস্থাতেই তার শিকারে বের হতে ইচ্ছে করলো। আগে এ ধরনের সফরে রাজার সঙ্গ দিতো মুসলমান উপদেষ্টা। এখন সে চাকরিচ্যুত। সে কারণে রাজা একাই বের হলেন।

প্রহরী বিহীন রাজা একটা শিকারের পিছু নিয়ে অনেকদূর এগিয়ে গেলেন। গভীর জঙ্গল থেকে ফেরার পথে এক ডাকাত দলের কবলে পরলেন তিনি। রাজার সাথে কোন অর্থকড়ি ছিলো না। তারপরও তার হাত পা’ বেঁধে ডাকাত দল তাদের সর্দারের কাছে নিয়ে গেলো।

সেখানে নিয়ে যাওয়ার পর রাজা বুঝতে পারলেন অর্থকড়ি না পেয়েও তাকে ধরে আনার কারণ হলো- প্রতি বছর এই ডাকাত দল নিজেদের দেবতার উদ্দেশ্যে একজন সুস্থ-সবল মানুষকে বলি দেয়। রাজার নাদুস নুদুস শরীর তাদের খুবই পছন্দ হয়েছে। সে কারণেই তাকে বলি দিতে সর্দারের কাছে নিয়ে এসেছে।

ডাকাত সর্দার রাজাকে দেখলেন। বলি দেয়ার জন্যে আপাতদৃষ্টিতে খুবই উপযুক্ত মনে হচ্ছে। এমন নাদুস নুদুস নিখুঁত মানুষকেই বলি দেয়ার জন্যে খোঁজা হচ্ছিলো। ‘নিখুঁত’ শব্দটা মনে আসতেই তার মনে হলো- আরে, ধরে আনা লোকটার তো হাত পা’ বাঁধা। একটু হাটিয়ে দেখলে কেমন হয়। নিখুঁত হওয়ার জন্যে তো শারীরিক গঠনের পাশাপাশি চলন-বলনও সুন্দর হতে হয়।

রাজার হাত পায়ের বাঁধন খুলে হাটানো হলো। সামান্য চলার পরই চোখ কপালে উঠলো ডাকাত সর্দারের। আরে, এতো দেখছি খোড়া। না, না, একে দিয়ে বলির কাজ হবে না। এই খোড়াকে বলি দিলে দেবতা তুষ্ট না হয়ে আরো রুষ্ট হবেন। জলদি একে ছেড়ে দাও।

***

রাজদরবারে ফিরেই রাজা মন্ত্রীকে পাঠিয়ে তার সে মুসলমান সহকারীকে সসম্মানে তলব করলেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন, আগের সফরে তার পা’টা ভেঙ্গে যাওয়ায় আজ তার জীবনটাই বেঁচে গেছে। সুতরাং তার পা’ ভাঙ্গার পর মুসলমান উপদেষ্টা যে বলেছে- ইস্ মে ভী খায়ের হ্যায়, তা যথার্থই বলেছে।

তারপরও একটা প্রশ্ন রাজার মনে ঘুরপাক খেতে থাকে। তিনি উপদেষ্টাকে বলেন, ‘আমার পা’ ভাঙ্গার মধ্যে যে কল্যাণ ছিলো তাতো বুঝতে পাললাম। কিন্তু তোমার চাকরি হারানোর মধ্যে কী কল্যাণ ছিলো? চাকরি হারিয়েও তো তুমি বলেছ, ইস্ মে ভী খায়ের হ্যায়!

ঈমানদার উপদেষ্টা উত্তর দিলো, ‘রাজা মশায়, এখনো বোঝেন নি কী কল্যাণ ছিলো!

আমি যদি চাকরিতে বহাল থাকতাম তাহলে তো স্বাভাবিকভাবেই আপনার সাথে শিকারের সফরে থাকতাম। কারণ, এধরনের সফরে আমি ছাড়া কেউ আপনার সাথে থাকার কথা না।

আপনার সাথে সফরে থাকলে আমরা দুজনই ডাকাতদলের হতে বন্দী হতাম। ডাকাত দল বলি দেয়ার জন্যে আপনাকে পছন্দ করলেও আমাকে সাথে নিয়ে যেতো। যেনো আমি তাদের আস্তানার খবর কাউকে না বলতে পারি।

এরপর যখন আপনার খুঁত প্রকাশ পেতো তখন আপনার কাছ থেকে নিরাশ হয়ে আমাকেই বলি দিতো। কারণ, আপনার শরীরে খুঁতযুক্ত হয়ে গেলেও আমার শরীর তো এখনো নিখুঁত।

এবার বুঝতে পেরেছেন চাকরি হারানোর মধ্যেও আমার জন্যে কী বিরাট কল্যাণ ছিলো? আপনাকে বাঁচানোর সাথে সাথে আল্লাহ আমার প্রাণও রক্ষা করেছেন।

রাজা সেই মুসলিম উজীরকে আগের পদে বহাল করলেন। ঈমানদার উজীরের মুখ থেকে খুব স্বাভাবিকভাবে উচ্চারিত হলো, ইস্ মে ভী খায়ের হ্যায়…। 

গল্পের তোহফা:

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটি বিষয় আমাদের ভালোর জন্যেই হয়। কিছু হয়তো আমরা বুঝতে পারি, কিছু বুঝতে পারি না। সেজন্যে আল্লাহর ইচ্ছের কাছে নিজেকে সঁপে দেয়ার মধ্যেই রয়েছে অন্তরের প্রশান্তি।

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *