মুফতী হাফিজুর রহমান
করোনা কি?
করোনা এটি মূলত গ্রিক শব্দ। সপ্তদশ শতকের দিকে এটি ল্যাটিন ভাষায় প্রবেশ করে। স্প্যানিশ ভাষায়ও করোনা শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। করোনা শব্দটির অর্থ পুষ্পমুকুট। সূর্যের চারপাশে উজ্জ্বল যে আলোর বলয় রয়েছে তা ওই মুকুটের মত দেখায় বলে জ্যোতির্বিদরা একেও করোনা বলে অভিহিত করেন। ইলেকট্রনিক অনুবীক্ষণ যন্ত্রে করোনাভাইরাসের মূল কাঠামো ঘিরে অসংখ্য কাঁটা দেখা যায়, যেন রাজমুকুটের উপর থরে থরে সাজানো দণ্ড। এ কারণে এ ভাইরাসটিকে করোনা বলে নামকরণ করা হয়েছে। ভাইরাসটির সন্ধান মেলে ১৯৩০ এর দশকে। আর মানব দেহে প্রথমবারের মত করোনাভাইরাস সংক্রমণের তথ্য পাওয়া যায় ষাটের দশকে। মূলত করোনা একটি ভাইরাস বা জীবাণু। এ জীবাণুতে আক্রান্ত হলে মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার সমূহ আশঙ্কা তৈরি হয়। বিশ্বব্যাপী আজ এর লাখো নজির বিদ্যমান।
https://www.jugantor.com/international/
কোভিড-১৯ কি?
করোনা ভাইরাস থেকে সৃষ্ট ব্যধিকে কোভিড-১৯ নামে অভিহিত করা হয়। আগে অবশ্য করোনা নামেই রোগটি চিহ্নিত হতো। পরবর্তীতে দেয়া এ নামটি নেওয়া হয়েছে ‘করোনো’, ‘ভাইরাস’, ‘ডিজিজ (রোগ)’ এবং ২০১৯ সালে ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাবের সময় ধরে ‘১৯’ (নাইনটিন) নম্বর থেকে। সুতরাং কোভিড-১৯ অর্থ, ২০১৯ সালে করোনা নামে বিষাক্ত উপাদান হতে সৃষ্টি হওয়া ব্যধি।
https://www.prothomalo.com/international/article/
জীবাণু কি?
জীবাণু অর্থ অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দৃশ্য অতিসূক্ষ্ম প্রাণী বা উদ্ভিদ; প্রাণবিশিষ্ট অতি ক্ষুদ্র কণা; microbe। বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান ৪৭৪
উইকিপিডিয়া বলছে, জীববিজ্ঞানে ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে আদি এবং ব্যাপকতর অর্থে রোগ সংক্রামক জীবাণু হচ্ছে এমন যেকোন কিছু যা রোগ উৎপন্ন করতে পারে। সাধারণত রোগ সংক্রমণ সংঘটক (এজেন্ট) যেমন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, প্রিয়ন এমনকি অন্য কিছু অণুজীবকে বোঝাতেও এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়
https://bn.wikipedia.org/wiki/%
ভাইরাস কি?
virus অর্থ সংক্রামক রোগের কারণস্বরূপ, ব্যাক্টিরিয়ার চেয়ে ক্ষুদ্রতর, বিভিন্ন বিষাক্ত উপাদানের যে কোনো একটি। এর এ্যাডজেকটিভ হলো viral (ভাইরাল)।- বাংলা একাডেমি ইংলিশ ডিকশনারী ৮৬৯
উইকিপিডিয়া বলছে, ভাইরাস (Virus) হল এক প্রকার অতিক্ষুদ্র জৈব কণা বা অণুজীব যারা জীবিত কোষের ভিতরেই মাত্র বংশবৃদ্ধি করতে পারে। এরা অতি-আণুবীক্ষণিক এবং অকোষীয়। ভাইরাসকে জীব হিসেবে বিবেচিত করা হবে কিনা, এ নিয়ে অবশ্য বিজ্ঞানীদের মধ্যে দ্বিমতও রয়েছে। মূলত ভাইরাস ল্যাটিন ভাষা হতে গৃহীত একটি শব্দ। এর অর্থ হল বিষ। আদিকালে রোগ সৃষ্টিকারী যে কোন বিষাক্ত পদার্থকে ভাইরাস বলা হত। বর্তমান কালে ভাইরাস বলতে এক প্রকার অতি ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক অকোষীয় রোগ সৃষ্টিকারী বস্তুকে বোঝায়।
সামগ্রিক আলোচনায় দেখা যাচ্ছে ভাইরাস ও জীবাণু প্রায় একই। মৌলিক ব্যবধানটা ভাষাগত। তবে ভাইরাস শব্দটি অতিক্ষুদ্র জৈবকণা ও অতিক্ষুদ্র বিষাক্ত নির্জীবকণা উভয়টির ক্ষেত্রেই ব্যবহৃহত হয়। পক্ষান্তরে জীবাণু বলতে শুধুমাত্র অতিক্ষুদ্র জৈবকণাকেই বোঝায়।
https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%B8
সংক্রমণ কি?
সংক্রমণ অর্থ গমন, বিস্তার, সঞ্চার। সংক্রমিত অর্থ এক দেহ থেকে অন্য দেহে সঞ্চারিত, প্রবেশিত, নিবেশিত। সংক্রামক অর্থ সঞ্চারিত হয় বা ছড়ায় এমন; ছোঁয়াচে, সংস্পর্শে উৎপন্ন। সংক্রামক বিষ মানে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু, ধ্বংসাত্মক বিষ। বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান ১০৯৮
ছোঁয়াচে কি?
ছোঁয়াচে মানে সংক্রামক, স্পর্শে সংক্রমিত হয় এমন। ছোঁয়াচ মানে স্পর্শ বা স্পর্শের প্রভাব, হানিকর বা ক্ষতিকর স্পর্শ।- বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান ৪৪৫
ছোঁয়াচ বা সংক্রমণ বলতে কি বোঝায়?
পূর্বেই আমরা জেনে এসেছি ছোঁয়াচ মানে স্পর্শ বা স্পর্শের প্রভাব, হানিকর বা ক্ষতিকর স্পর্শ। আর সংক্রমণ মানে বিস্তার লাভ করা, ছড়িয়ে যাওয়া, এক জায়গা থেকে অন্যত্র গমন করা। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের ভাষায় সংক্রমণ বলতে কোন পোষক জীবের দেহকোষে রোগ সৃষ্টিকারী সংঘটকের অনুপ্রবেশ, আক্রমণ, সংখ্যাবৃদ্ধি, পোষকের দেহকলার সাথে সংঘটিত বিক্রিয়া এবং এর ফলে উৎপন্ন বিষক্রিয়াকে বোঝায়। সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট রোগকে সংক্রামক রোগ বা ছোঁয়াচে রোগ বলে। সংক্রমণের ইংরেজি পরিভাষা হল ইনফেকশন।
বস্তুত রোগ বা ব্যধিটা হলো পরিণতি। এর একটি সংঘটক পূর্বকারণ থাকে। পূর্বকারণটা নানা ধরনের হয়ে থাকে। ক্যান্সার একটি মরণব্যধি। এর পূর্বকারণ হলো ধূমপান জাতীয় কার্যক্রম। তো মূল ব্যধিটা কখনো সংক্রামক বা ছোঁয়াচে হয় না। সংক্রামক বা ছোঁয়াচে হয় রোগের সে পূর্বকারণগুলো। রোগের সব পূর্বকারণই সংক্রামক বা ছোঁয়াচে হয় না। একমাত্র ভাইরাস তথা বিষাক্ত সূক্ষ্ম উপাদান বা জীবাণুজনিত রোগের পূর্বকারণগুলোই ছোঁয়াচে বা সংক্রামক হয়। সারকথা, যে ভাইরাস বা জীবাণু মানব দেহে রোগ সৃষ্টি করে সে ভাইরাস বা জীবাণুর ক্ষেত্রেই কেবল ছোঁয়াচ বা সংক্রমণ শব্দের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। কিছু রোগ আছে যেগুলো জীবাণু, ভইরাস বা ক্ষতিকর সূক্ষ্ম উপাদান জনিত। আবার কিছু রোগ আছে যেগুলো ভাইরাস বা জীবাণুজনিত নয়। যেসব ব্যধি ভাইরাস বা জীবাণুজনিত নয় সেসব রোগের ক্ষেত্রে সংক্রমণ বা ছোঁয়াচ শব্দের ব্যবহার হয় না। কারণ সেসব রোগের পূর্বকারণগুলো ছড়ানো বা অন্য দেহে গমন করার মত নয়। যেমন মাত্রাতিরিক্ত ধূমপানের ফলে ক্যান্সার হয়। এ ধূমপানটা সংক্রমিত হওয়া বা ছোঁয়াচে হওয়ার মত উল্লেখযোগ্য কোনো বিষয় নয়। যদিও সমাজে ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ বলা হয়। এখানে মূলত ঘটিত বলে ঘটক উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে বা ঘটিত এর নামে ঘটকের নামকরণ করা হয়েছে। আরবী ভাষায় এ বিষয়টিকে تسمية المعلول باسم العلة বা اطلاق العلة على المعلول শিরোনামে অভিহিত করা হয়।
ভাইরাস বা জীবাণুটা অন্যের দেহে যেতে পারে কি না?
ভাইরাস বা জীবাণু মানেই হলো ধরা ছোঁয়া বা দৃষ্টির আড়ালের অতিক্ষুদ্র বিষাক্ত উপাদান বা প্রাণী। খাবারগ্রহণ, শ্বাসগ্রহণ, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নানামাত্রিক ব্যবহার ও বায়ূপ্রবাহের নানা পরিক্রমায় ভাইরাস বা জীবাণু অন্যত্র যেতে পারে। আর জীবাণুর তো প্রাণই আছে। সে তার নিজস্ব শক্তিবলেই অন্যত্র গমন করতে পারে। এই যে একটি ভাইরাস বা জীবাণু স্পর্শ বা বায়ূ প্রবাহের কারণে অন্যের দেহে গমন করলো এটাই হলো সংক্রমণ বা ছোঁয়াচের সারকথা। সংক্রমণ বা ছোঁয়াচের এ সহজ ব্যাখ্যাকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আল্লাহ সৃষ্ট ভাইরাস বা জীবাণুর এ স্বাভাবিক গমনাগমনকে অস্বীকার করা মানে সাধের ঈমানকে ক্ষতিগ্রস্থ করা।
এখন প্রশ্ন হলো, বিষাক্ত বা ক্ষতিকর এসব ভাইরাস বা জীবাণু ক্ষতিসাধন করতে পারে কিনা? এর উত্তর হলো, আল্লাহ প্রতিটি বস্তুকে কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। ফুলের বৈশিষ্ট্য হলো, সে মানুষকে সুবাস দিবে। খাদ্যের বৈশিষ্ট্য হলো, সে মানুষের ক্ষুধা নিবারণ করবে। সর্পবিষের ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য হলো সে মানব দেহে প্রবেশ করে মানবদেহের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে চরমভাবে বাধাগ্রস্থ করবে। ফলে মানুষের মৃত্যু ঘটবে। আগুনের বৈশিষ্ট্য হলো, সে সামনে যা পাবে তাই জ্বালিয়ে দিবে। পানির বৈশিষ্ট্য হলো, সে সব কিছুকে ভিজিয়ে দেবে। বস্তুনিচয়ের খোদাপ্রদত্ত এসব বৈশিষ্ট্য ও ধর্মকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। ঠিক তদ্রূপ ক্ষতিকর বা বিষাক্ত ভাইরাস বা জীবাণুর মাঝেও মানব দেহকে ক্ষতিগ্রস্থ করে রোগ সৃষ্টি করার মতো বৈশিষ্ট্য আছে। এ বৈশিষ্ট্য দিয়েই আল্লাহ এসব সূক্ষ্ম কীট ও উপাদানকে সৃষ্টি করেছেন; যেগুলোকে আমরা ভাইরাস বা জীবাণু নামে অভিহিত করি। আমরা দেখি, গাছগাছালি নানা ধরনের জীবাণুতে আক্রান্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এ জীবাণুগুলো দু চোখে দেখা যায় না। কিন্তু গাছ বা ফসলের ক্ষতি অনুধাবন করা যায়। জীবাণু নাশক ওষুধ ব্যবহার করে জীবাণু নির্মূল করা হয়। তদ্রূপ মানব দেহেও জীবাণু প্রবেশ করে ক্ষতি সৃষ্টি করে মানুষকে রোগাক্রান্ত করে। এসব জীবাণু বা বিষাক্ত ভাইরাসের ক্ষতির মাত্রা বিবেচনায় মানুষের রোগের মাত্রা বাড়ে কমে।
একারণেই বলা হয় ‘কিছু থেকে কিছু হয় না; সবকিছু একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়। সৃষ্টি কিছু করতে পারে না আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া।’ এ জাতীয় কথাগুলো সত্য। তবে এ বাক্যগুলোর অর্থ ঢালাওভাবে গ্রহণ করা যাবে না। নিরঙ্কুশভাবে এ বাক্যগুলোর নিরেট অর্থ বিশ্বাস করা হলে ঈমানপরিপন্থী বলে গণ্য হবে। কারণ তখন সেটা জাবরিয়া তথা Fatalism বা আদৃষ্টবাদ হিসেবে বিবেচ্য হয়ে যাবে। আর এটা স্বতঃসিদ্ধ কথা, জাবরিয়া মতবাদ একটি কুফুরী মতবাদ। বস্তুত জাবরিয়া হলো, ঐসমস্ত মতাদর্শী লোক যারা বিশ্বাস করে, ঘটমান সবকিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে পূর্ব থেকেই নির্ধারিত। এবং সে নির্ধারণ অনুযায়ী সবকিছু সংঘটিত হয়। এক্ষেত্রে বস্তুর কোনো দখল নেই। আর যেহেতু সব বিষয়ই আল্লাহর নির্দেশের অনুগত সেহেতু কোনো বিষয়ই বস্তুগত কারণে পরিবর্তিত হতে পারে না। আল্লহ তা‘আলা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অবগত। তাই ভবিষ্যৎ গুণাবলি শুরু থেকেই আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী নির্ধারিত হয়ে আছে।
মোদ্দাকথা, জাবরিয়াদের মতে বস্তুর ক্রিয়াকলাপ তার নিজের বৈশিষ্ট্য বা ক্ষমতাধীন নয়। বরং এর সবই আল্লাহর ইচ্ছার সাথে যুক্ত। বস্তুগত যাবতীয় ক্রিয়াকলাপই মূলত আল্লাহর কর্ম। সুতরাং সকল সৃষ্টি ক্ষমতা ও বৈশিষ্টহীন এবং নিস্ক্রীয় কিংবা বাধ্য বাধকতার আওতাধীন। তাদের নিজে কোনো কর্ম, ইচ্ছা, ক্ষমতা বা স্বাধীনতা কিছুই নেই।-আবুল ফাতহ মুহাম্মদ শাহরাস্তানী, আলমিলাল ওয়ান নিহাল ১/৮৪
অন্য দিকে আহলে সুন্নত ওয়াল জামা‘আত যদিও একথা স্বীকার করে, বস্তুর সকল ক্ষমতা, বৈশিষ্ট ও ক্রিয়াকলাপই আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত এবং বাস্তবায়িত হয়। কিন্তু তারা সাথে সাথে একথারও প্রবক্তা, বস্তুর আল্লাহ প্রদত্ত বৈশিষ্ট্য, সক্ষমতা ও ইচ্ছা শক্তি রয়েছে। এসবের সমন্বয়ে নানামাত্রিক ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। প্রাগুক্ত
বস্তুত বস্তু নিজ কর্মের স্বতন্ত্র সৃষ্টিকর্তা ও সংঘটনকর্তা নয়। আল্লাহ তা‘আলা সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। সকল সৃষ্টি ও অস্তিত্বের তিনিই একমাত্র উৎস। আর বস্তু হলো কেবল কাসেব তথা ভায়া সংঘটক; সৃষ্টিকর্তা নয়।-প্রাগুক্ত
সুতরাং ‘ছোঁয়াচে বা সংক্রামক বলতে কিছু নেই।’ এ কথাটাও ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। এ বাক্যের ঢালাও অর্থ গ্রহণ করা হলে ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে যাবে। কারণ বিষাক্ত জীবাণু নানাভাবে একজনের দেহ থেকে অন্যের দেহে গমন করতে পারে। এবং অন্যের দেহে গমন করে আল্লাহ প্রদত্ত বৈশিষ্ট্য বলে ক্ষতি সাধন করে রোগের সৃষ্টি করতে পারে। মৌলিকভাবে জীবাণুর অন্যের দেহে গমন এবং ক্ষতি সাধন করে রোগাক্রান্তকরণ আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়-এ বিশ্বাস প্রতিটি মুমিনকেই করতে হবে। তবে আল্লাহর নির্দেশ বা ইচ্ছাক্রমে জীবাণুর অন্যের দেহে গমন ও ক্ষতিসাধন করার ক্ষেত্রে বাহ্যত মানুষের সংস্পর্শ, বায়ূ বা পানির সহযোগ এবং জীবাণুর আল্লাহপ্রদত্ত বৈশিষ্ট্যগত সক্ষমতাও বিদ্যমান রয়েছে। এ বাস্তুবতা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। এ বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হলে তা ঈমানপরিপন্থী বিশ্বাসে পরিণত হবে। সুতরাং ‘ছোঁয়াচে বা সংক্রামক বলতে কিছু নেই।’ এ কথার বলার ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্বাসটাকে এভাবে সমৃদ্ধ ও পূর্ণাঙ্গ করে নিতে হবে যে, আল্লাহর নির্দেশ বা ইচ্ছা ব্যতীত ছোঁয়াচ বা সংক্রমণ হয় না। বরং আল্লাহর ইচ্ছা ও তদপ্রদত্ত বৈশিষ্ট্যগত সক্ষমতা যোগে ছোঁয়াচ ও সংক্রমণ আছে। তবে এ কথাও মনে রাখতে হবে, কেউ যদি ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ আছে বলে এ বিশ্বাস করে যে, জীবাণু আল্লাহর ইচ্ছা ও তদপ্রদত্ত সক্ষমতা বলে নয়; বরং নিজস্ব ক্ষমতা ও সক্ষমতা বলে সে মানব দেহে গমন করে ক্ষতি সাধন করে তাহলে এটাও চরম মাত্রার কুফুরী বিশ্বাস বলে পরিগণিত হবে। সারকথা কোনো রোগের সংঘটকই নিজস্ব ক্ষমতায় ছোঁয়াচে হয় না। কারণ কোন রোগ সংঘটকেরই এমন কোনো নিজস্ব ক্ষমতা নেই, যার ফলে সেটি একজনের শরীর ছেড়ে অন্যজনের শরীরে চলে যেতে পারে। মূলত রোগ-ব্যাধি আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয় এবং সংক্রমণও তাঁর ইচ্ছাতে হয়ে থাকে। সুতরাং যেসব রোগজীবাণু চিকিৎসা শাস্ত্র দ্বারা সংক্রামক বলে স্বীকৃত, সেগুলো কেবল আল্লাহর ইচ্ছায় সংক্রামিত হয়ে থাকে, নিজ ক্ষমতা বলে নয়।
সুতরাং বর্তমানের করোনা ভাইরাস সম্বন্ধেও আমাদের এ বিশ্বাসই করতে হবে যে, করোনার অন্যের দেহে গমন করার ও ক্ষতিসাধন করার ক্ষেত্রে তার নিজস্ব কোনো শক্তি বা ক্ষমতা নেই; বরং করোনা ভাইরাস আল্লাহর ইচ্ছায় সংস্পর্শ বা অন্য কোনো উপায়ে অন্যের দেহে প্রবেশ করে আল্লাহপ্রদত্ত বৈশিষ্ট্যগত সক্ষমতা বলে চরম মাত্রার ক্ষতিসাধন করতে পারে।
‘ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ আছে’ বলা যাবে কিনা
বিশ্বাস ঠিক রেখে ‘ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ আছে’ এভাবে বলাতে কোনো সমস্যা নেই। তবে যদি এ জাতীয় বাক্যের ক্ষেত্রে আল্লাহর ইচ্ছা বিনে জীবাণু বা ভইরাসের স্বতন্ত্র ক্ষমতার বিশ্বাস করা হয় তাহলে কুফুরী হয়ে যাবে। এ বাক্যটিকে যদি ‘আমি করি সে করে’ জাতীয় বাক্যের মতো করে ব্যবহার করা হয় তাহলে তাতে কোনো সমস্য নেই। কারণ ‘আমি করি তুমি করো সে করে’ জাতীয় বাক্যের ক্ষেত্রে সাধারণত আমরা আল্লাহর ইচ্ছা ও তদকর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতা বিনে একান্ত নিজস্ব শক্তি ও সক্ষমতার বিশ্বাস করি না। সারকথা ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ আছে বা ছোঁয়াচে বা সংক্রামক বলতে কোনো রোগ নেই- এ দুটি বাক্যের কোনোটির শাব্দিক অর্থকেই একচেটিয়াভাবে গ্রহণ করার সুযোগ নেই।
ছোঁয়াচ বা সংক্রমণ বিষয়ক হাদীস ও তার ব্যাখ্যা
১।
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا عَدْوَى وَلَا طِيَرَةَ وَلَا هَامَةَ وَلَا صَفَرَ وَفِرَّ مِنْ الْمَجْذُومِ كَمَا تَفِرُّ مِنْ الْأَسَدِ
হাদীসটির শব্দানুগ অর্থ : আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্নিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, রোগের কোনো সংক্রমণ শক্তি নেই, পাখি উঁড়িয়ে কল্যাণ-অকল্যাণ নির্ধারণ করারও কোনো ভিত্তি নেই। হুতুম পেচাঁর ডাক শুনে অশুভ নির্ধারণ করার কোনো ভিত্তি নেই। সফর মাসেরও বিশেষ কোনো প্রভাব নেই। সিংহ থেকে যেভাবে পলায়ন করো ঠিক তদ্রূপ কুষ্ঠরোগী থেকে পলায়ন করো। সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৭০৭
হাদীসটির ব্যাখ্যা
১। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إذَا سمِعْتُمْ الطَّاعُونَ بِأَرْضٍ، فَلاَ تَدْخُلُوهَا، وَإذَا وقَعَ بِأَرْضٍ، وَأَنْتُمْ فِيهَا، فَلاَ تَخْرُجُوا مِنْهَا
অর্থ, যখন তোমরা শুনতে পাবে কোথাও মাহামারি হয়েছে তাহলে সেখানে তোমরা প্রবেশ করো না। আর যখন কোথাও মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটে এবং তোমরা সেখানে থাকো তাহলে সেখান থেকে বের হয়ো না। সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৭২৮
২। শারীদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সাকীফ গোত্রের প্রতিনিধি দলে একজন কুষ্ঠরোগী ছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছে লোক পাঠিয়ে বললেন, আমি তোমাকে বাইয়াত করে নিয়েছি। তুমি বাড়ি চলে যাও। সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৯৫৮
৩। ইসলামী ইতিহাসের এক বেদনাদায়ক মহামারির নাম হলো তাউনে আমওয়াস। এ মহামারিতে প্রথম শ্রেণীর একাধিক সাহাবী ও তাবিয়ী রা. এন্তেকাল করেন। হযরত মুআয ইবনে জাবাল র. এর এন্তেকালের পর হযরত আমবর ইবনুল আস রা. বাহিনীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। প্রথমে তিনি সাধারণ সভা ডেকে ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন, এ জাতীয় মহামারি যখন শুরু হয় তখন আগুনের ন্যায় বিস্তার লাভ করতে থাকে। সুতরাং তোমরা পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করো। ভাষণ শেষে আমর ইবনুল আস রা. বাহিনীকে নিয়ে পাহাড়ে চলে যান। ফলে তারা মহামারির প্রকোপ থেকে রক্ষা পান। আমর ইবনুল আস রা. এ সিদ্ধান্ত উমর রা. এর নিকট পৌঁছলে তিনি এ ব্যাপারে কোনো বিরূপ মন্তব্য করেন নি। আলবিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৭/৭৯, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬৯৭ এছাড়াও সহীহ ইবনে হিব্বান, সহীহ ইবনে খুযাইমাহ, তাহযীবুল আসার লিততাবারীতে ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে।আমর ইবনুল আস রা. মূলত বোঝাতে চেয়েছিলেন, এ মহামারির প্রকৃতিটা হলো আগুনের মতো। যখন সে জ্বালাবার মতো কিছু না পায় তখন সে এমনি এমনি নিভে যায়। তাই তিনি তার লোকদেরকে কিছু দিনের জন্য অন্যত্র চলে যেতে উপদেশ দিয়েছিলেন। ফলে দেখা যায় মহামারি ধীরে ধীরে প্রশমিত হয়ে যায়। আমর ইবনুল আস রা. জানতেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহামারিপ্রবণ এলাকা থেকে পলায়ন করতে নিষেধ করেছেন। তথাপি তিনি মহামারিপ্রবণ অঞ্চল ত্যাগ করেছিলেন। কারণ তিনি হাদীস থেকে বুঝেছিলেন যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহামারিপ্রবণ এলাকা থেকে পলায়ন করতে নিষেধ করেছেন এ কারণে যাতে যে এলাকায় যাওয়া হবে সে এলাকায় মহামারি ছড়িয়ে না পড়ে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহামারিপ্রবণ এলাকা থেকে এমন এলাকায় যেতে নিষেধ করেন নি যেখানে কোনো জনবসতি নেই।
৪। ইমাম বাইহাকী রহ. বলেন,
فَقَدْ يَجْعَلُ اللَّهُ تَعَالَى بِمَشِيئَتِهِ مُخَالَطَتَهُ إِيَّاهُ سَبَبًا لِمَرَضِهِ
অর্থ, কখনো আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় ইচ্ছায় অসুস্থের সাথে সুস্থের মেলামেশাকে তার সেই রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণ বানিয়ে দেন। আস-সুনানুল কাবীর, ১৪৬২১ নম্বর হাদীসের অধ্যায় শিরোনাম।
৫। ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন, ৮৪২ হিজরী সন। প্রথম মুহাররম, সোমবার দিন। মহামারি বৃদ্ধি পেলো। প্রতিদিন গড়ে প্রায় দুশ করে মানুষ মরতে লাগলো। মৃতদের অধিকাংশই ছিলো গোলাম ও শিশু। এরপর মহামারি আরো বৃদ্ধি পেতে লাগলো। ইত্যবসরে হাজীরা প্রবেশ করলো। এতে মহামারি আরো বেড়ে গেলো। বলা হয় প্রতিদিন গড়ে এক হাজারের উপরে মানুষ মারা যেতে লাগলো। ইম্বাউল গুমর বি আবনাইল উমর ২/২০৩
৬। শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. হাদীসটি ব্যাখ্যায় বলেন, হাদীসটির অর্থ হলো, আল্লাহর শক্তিতে অন্যের মাঝে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কায় (ভাইরাসজনিত) রোগাক্রান্ত ব্যক্তি যেন অন্যের সংস্পর্শে না যায়। আর হাদীসের মধ্যকার (لا) শব্দটি নিষেধাজ্ঞার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন {فمن فرض فيهنّ الحج فلا رفث ولا فسوق ولا جدال في الحجّ} এ আয়াতটির মাঝে (لا) শব্দটি নিষেধাজ্ঞা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ হজ্ব আদায় কালে যেন অশ্লীল ও পাপকর্ম না করে এবং বিবাদ না করে। হাদীসের অবশিষ্টাংশেও (لا) শব্দটি নিষেধাজ্ঞা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। হুতুম পেচাঁর ডাককে অশুভ মনে করো না, পাখির মাধ্যমে অশুভলক্ষণ গ্রহণ করো না এবং সফর মাসকে অশুভ মনে করো না। আরবের লোকেরা এসবের মাধ্যমের অশুভ লক্ষণ গ্রহণ করতো। ‘এবং সিংহ থেকে যেভাবে পলায়ন করো ঠিক তদ্রূপ কুষ্ঠ রোগী থেকে পলায়ন করো।’ হাদীসের এ অংশটি স্বতন্ত্র কোনো হাদীস নয়; বরং উপরোক্ত পূর্ণ হাদীসের শেষাংশ। সুতরাং পূর্ণ হাদীসের শুরু অংশ শেষাংশের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংক্রামক ব্যধিতে আক্রান্ত রোগীকে মানুষের সংস্পর্শে যেতে নিষেধ করেছেন। যাতে সে ব্যধি অন্যের মাঝে সংক্রমিত না হয় এবং আল্লাহর ইচ্ছায় সে ব্যধি অন্যেক ক্ষতিগ্রস্থ করতে না পারে। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যধির কারণ ও সংঘটক থেকে এবং সংক্রমণের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া থেকে বিরত থাকতে নির্দেশনা দিয়েছেন। যাতে মানুষ আল্লাহর ইচ্ছায় এসব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে।
এ অর্থ সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত একটি হাদীসকে পরিপূর্ণরূপে সমর্থন করে। হাদীসটি হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, রোগগ্রস্ত উট যেন কখনো সুস্থ উটের উপরে উপনীত না হয়। সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৭৭০। এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ উটকে সুস্থ উটের উপর উপনীত করতে বারণ করেছেন। এ নিষেধাজ্ঞা একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছায় সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কায়ই করেছেন। সুতরাং ইসলাম প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় পদ্ধতির সংক্রমণকে স্বীকার করে। রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ব্যক্তি তার অন্তরঙ্গ বন্ধুর ধর্মেই বিশ্বাস করে থাকে। সুতরাং তোমাদের প্রত্যেকের দেখা উচিত সে কাকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করে। তিনি আরো বলেন, তুমি একমাত্র মুমিন ব্যক্তির বন্ধু হও। একমাত্র খোদাভীরুই যেন তোমার খাবার গ্রহণ করে। তিনি আরো বলেন, প্রতিটি শিশুই সত্য দীনের উপর জন্মগ্রহণ করে। তার বাবা মা তাকে ইহুদী বানায় অথবা খ্রিস্টান বানায় কিংবা অগ্নিপূঁজক বানায়। অর্থাৎ শিশুটি তাদের সঙ্গগ্রহণের কারণে বাবা মা তাকে ইহুদী, খ্রিস্টা অথবা অগ্নপূজক বানায়।
শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবুগুদ্দাহ রহ. টিকা কৃত আলমাসনূ’ ফি মা’রিফাতিল হাদীসিল মাওযু’ পৃ.৪৭
৭। শাইখ আলবানী রহ. বলেন, আক্রান্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কার কারণে কারো জন্য মহামারিপ্রবণ এলাকায় প্রবেশ করা বৈধ নয়। তদ্রূপ যে এলাকায় মহামারি নেই সে এলাকায় মহামারি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কার কারণে মহামারীপ্রবণ এলাকার অধিবাসীর জন্য সে এলাকা থেকে বের হওয়াও বৈধ হবে না । সিলসিলাতুলহুদা ওয়ান নূর ২১২
৮। দুর্বল ঈমান এবং সবল ঈমানের ব্যাখ্যাটাও এখানে আসতে পারে। এ ব্যাখ্যাটার সাথেও পূর্বোক্ত ব্যাখ্যাটি সাংঘর্ষিক হবে না। ব্যাখ্যাটিতে বলা হয়েছে, সংক্রমণ না হওয়ার বিষয়টি সবল ঈমানদারের সাথে সম্পৃক্ত। আর পলায়নের বিষয়টি দুর্বল ঈমানদারের সাথে সম্পৃক্ত। হাদীসে কুদসীতে এসেছে, আল্লাহ বলেন, আমার ব্যাপারে বান্দা যেরূপ ধারণা করে আমি তার সাথে সেরূপ আচরণ করি। সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৪০৫। এটা স্বতঃসিদ্ধ কথা, আল্লাহর ব্যাপারে সবল ঈমানদারের ধারণা ও বিশ্বাস প্রবল হয়ে থাকে আর দুর্বল ঈমানদারের ধারণা দুর্বল হয়ে থাকে। ভাইরাসজনিত ব্যধির ক্ষেত্রে সবল ঈমানদার সবটুকু বিশ্বাসকে আল্লাহতে সমর্পন করে দেন। তিনি বিশ্বাস করেন, ভাইরাস বা জীবাণুর নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই। যা আছে সব আল্লাহপ্রদত্ত। আল্লাহ যদি ইচ্ছা করেন ক্ষতি হবে; ইচ্ছা না করলে ক্ষতি হবে না। বিশ্বাসের এ উচ্চতায় আরোহণের কারণে আল্লাহ কখনো কখনো বস্তুর কার্যক্ষমতাকে ছিনিয়ে নেন। ফলে সে বস্তুর ক্ষতি সাধন থেকে মুক্তি পেয়ে যায়। কারণ সে আল্লাহর ব্যাপারে উচ্চ ধারণা পোষণ করেছে। ফলে সে মুক্তি পেয়েছে। পক্ষান্তরে দুর্বল ঈমানদার আল্লাহর ব্যাপারে বিশ্বাস ও ধারণার এ স্তরে উত্তীর্ণ হতে পারে না। বস্তুর প্রতি তার একটা সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা থেকে যায়। আল্লাহপ্রদত্ত বস্তুর কার্যকারি ক্ষমতার প্রতি যেন তার বিশ্বাসটা পূর্ণতা না পায় এবং এর মাধ্যমে সে যেন ঈমানগত দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সে কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ভাইরাসজনিত রোগাক্রান্ত ব্যক্তি থেকে দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। এ ব্যাখ্যায় মূলত সংক্রমণকে প্রত্যাখান করা হয় নি; বরং এখানে প্রচ্ছন্নভাবে সংক্রমণকে স্বীকার করা হয়েছে। যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে বিশেষ ব্যবস্থায় সেক দিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন। আবার চিকিৎসার এ ব্যবস্থা পরিহারকারীর প্রসংশাও করেছেন। এবং তার এ ব্যবস্থা বর্জনকে আল্লাহর উপর আস্থা হিসেবে বিবেচনা করেছেন। যাদুল মা’আদ ৪/১৩৪
এ হাদীসের অর্থ এই নয় যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঈমান দুর্বল ছিলো। আর ব্যবস্থা বর্জনকারীর ঈমান সবল ছিলো। নাউযু বিল্লাহ। রোগ নিরাময়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা ইসলামী শরীয়াতের একটি কাঙ্ক্ষিত বিষয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাঙ্ক্ষিত এ বিষয়টি উম্মতকে শেখানোর জন্যই নিজে চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। জাগতিক উপায় গ্রহণ মানেই ঈমানিক দুর্বলতা নয়। বরং বিশ্বাস ঠিক রেখে জাগতিক উপায় গ্রহণের মাঝেই ঈমানিক সবলতা বিদ্যমান। ক্ষেত্রবিশেষে জাগতিক উপায় বর্জন সবল ঈমানের পরিচয়ক হলেও স্বাভাবিক ক্ষেত্রে জাগতিক উপায় গ্রহণে ঈমানিক দুর্বলতা আবশ্যক হয়ে পড়ে না। বস্তুত সব ক্ষেত্রে জাগতিক উপায় বর্জন করাও ঈমানের জন্য ক্ষতিকর।
সারকথা, মুসলমানদের বিশ্বাস করতে হবে, সর্বরকমের রোগ-ব্যধি আল্লাহর নির্দেশে আসে এবং তাঁর নির্দেশেই তা নিরাময় হয়। আল্লাহ্ তায়ালা কিছু রোগ-ব্যধির মধ্যে সংক্রমণের শক্তি দিয়েছেন। যখন আল্লাহর নির্দেশ হবে তখনই তা সংক্রমণিত হবে, অন্যথায় নয়। তবে কোনো রোগ নিজস্ব ক্ষমতাবলে সংক্রমিত হতে পারে না। এটাই হচ্ছে নবীজির হাদীস তথা لا عدوي ولا هامة ولا صفر, فمن أعدي الأول, فر من المجذوم كما تفر من الأسد এবং لا يورد ممرض علي مصح এসব বিরোধপূর্ণ হাদীসের সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যাখ্যা। করোনা ভাইরাস চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এমনই এক সংক্রমণ ব্যধি।