করোনার ছুটি : যেভাবে কাটাবো অবসর দিনগুলো

আজ থেকে এক নযীর বিহীন ছুটি শুরু হয়েছে। আপাতত টানা দশদিনের ছুটি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ছুটি আরো দীর্ঘ। আল্লাহর এক ক্ষুদ্রতম মাখলুক করোনার ভয়ে সবাইকে ঘরে অবস্থান করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কেউ যেন অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের হতে না পারে সেজন্য চলছে র‌্যাব, পুলিশ আর সেনাবাহিনীর টহল। প্রশাসন থেকে মাইকিং করে করে যেন সতর্ক করছে ‘ওরে তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে…’ তাই বাধ্য হয়েই আমরা সবাই গৃহাভ্যন্তরে অবসর জীবন যাপন করছি।
তবে আমাদের এই অবসরও কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার একটি বড় নিয়ামত। এই অবসর সময়গুলোকে সঠিকভাবে ব্যয় করে আমরা চিরস্থায়ী জীবনের অনাবিল সুখ সাফল্য অর্জন করতে পারি। করোনা ভয়ের ছুটিতে আমরা করুণাময়ের মহব্বত লাভে ধণ্য হতে পারি। পেতে পারি শান্তি সুখের অনাবিল স্বাদ এবং এবং অনন্তকালের জান্নাতী প্রাসাদ।
সময়ের সঠিক ব্যবহারের গুরুত্ব
মূলতঃ আমাদের সকল সময়ই আল্লাহ তা‘আলার নিয়ামত । কর্মমুখর ও অবসর উভয় সময়ই আল্লাহর বিশেষ দান। সময় হলো আমাদের জীবনের মূলধন। এজন্য সময়ের গুরুত্ব অপরিসীম। সময়ের অত্যধিক গুরুত্ব বুঝানোর জন্যই হয়তো আল্লাহ তা‘আলা যুগের শপথ করে একটি স্বতন্ত্র সূরা অবতীর্ণ করেছেন। ইরশাদ করেছেন,

  • وَالْعَصْرِ
  • إِنَّ الإِنسَانَ لَفِي خُسْرٍ
  • إِلاَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ

অর্থ : কসম যুগের, নিশ্চয় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু তারা নয়, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে তাকীদ করে সত্যের এবং তাকীদ করে সবরের। (সূরা আসর, আয়াত, ১-৩)
এই সূরার তাফসীরে আল্লাম মুফতী শফী রহ. লিখেছেন, চিন্তা করলে দেখা যায়, আয়ূস্কালে সাল, মাস, সপ্তাহ, দিবারাত্র বরং ঘণ্টা ও মিনিটই মানুষের একমাত্র পুঁজি, যার সাহয্যে সে ইহকাল ও পরকালের বিরাট এবং বিস্ময়কর মুনাফাও অর্জন করতে পারে এবং ভ্রান্ত পথে চললে এটাই তার জন্যে বিপজ্জনকও হয়ে যেতে পারে। (তাফসীরে মা‘আরিফুল কুরআন, মুহিউদ্দীন খান অনূদিত সংক্ষিপ্ত সংস্করণ, পৃষ্ঠা ১৪৭৪)
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও সময়কে গনীমত মনে করে সঠিক ব্যবহারের তাকীদ দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেন,
اغتنم خمسًا قبل خمس : شبابك قبل هرمك ، وصحتك قبل سقمك ، وغناك قبل فقرك ، وفراغك قبل شغلك ، وحياتك قبل موتك
অর্থ : তোমরা পাঁচটি জিনিসকে গনীমত মনে করো পাঁচটি জিনিস আসার পূর্বে- (১) বার্ধক্য আসার পূর্বে যৌবনকে। (২) অসুস্থ হওয়ার পূর্বে সুস্থতাকে। (৩) দারিদ্রতা আসার পূর্বে ধনাঢ্যতাকে। (৪) ব্যস্ততা আসার পূর্বে অবসরকে (৫) এবং মৃত্যু আসার পূর্বে হায়াতকে। (আস-সুনানুল কুবরা লিন-নাসায়ী, ২/২২৩ শামেলা সংস্করণ)
যৌবন, অবসর ও জীবন সবগুলোই তো গুচ্ছ গুচ্ছ সময়ের নাম। এই সবগুলোকেই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গনীমত জ্ঞান করে কদর করতে বলেছেন। এরপরও যদি আমরা হীরার চেয়ে দামি সময়গুলোকে পাপাচারে কিংবা অনর্থক কাজ-কর্মে বিনষ্ট করি তাহলে আমরাই ক্ষতিগ্রস্থ হবো। আমাদের স্বপ্নীল সাফল্যসৌধ বরবাদ হয়ে যাবে। কিয়ামত দিবসে গোটা হাশরবাসীর সামনে লা- জওয়াব হয়ে চরমভাবে লজ্জিত হতে হবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সময়ের ব্যবহার সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন। জীবন-যৌবন কোথায়, কোন কাজে ব্যয় করেছি তার হিসাব নেবেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
لا تزول قدما ابن آدم يوم القيامة من عند ربه حتى يسأل عن خمس عن عمره فيما أفناه وعن شبابه فيما أبلاه وعـن ماله من أين أكتسبه وفيـم أنفقه وما عمـل فيما علم
অর্থ : কিয়ামতের দিন বনী আদমের পদযুগল তার রবের নিকট হতে নড়াতে পারবে না যতক্ষণ তাকে পাঁচটি প্রশ্ন না করা হবে। (১) তার জীবন সম্পর্কে যে, জীবন সে কোথায় নিঃশেষ করেছে? (২) তার যৌবন সম্পর্কে যে, তা সে কোথায় নষ্ট করেছে? (৩) তার ধন-সম্পদ সম্পর্কে যে, তা সে কোন পথে আয় করেছে? (৪) এবং কোন পথে ব্যয় করেছে? (৫) সে ইলম অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছে? (সুনানে তিরমিযী, হাদীস ৪৪১৬)
সম্মানিত পাঠক! অবসর সময়গুলো যত্নবান হওয়ার প্রতি তাকীদ করে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বহু আগেই ইরশাদ করেছেন,
نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنْ النَّاسِ الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ
অর্থ : দুটি নিয়ামতের ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষ ধোঁকাগ্রস্থ- (১) সুস্থতা (২) ও অবসর। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪১২)
তাই আসুন আমরা আমাদের অবসরের এই সময়গুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগাই। স্মার্ট ফোন, টিভি ও ইন্টারনেটে ডুবে না থেকে তওবা, ইস্তিগফার ও আল্লাহর দরবারে রোনাযারীতে মশগুল হই। সম্ভব হলে পরিচিত কোন আল্লাহওয়ালা আলেমের সাথে পরামর্শ করে সময়গুলো ব্যয়ে যত্নবান হই। দৈনন্দিন আমলসমূহের একটি রুটিন বানিয়ে সে অনুযায়ী সময়গুলোকে ব্যয় করার চেষ্টা করি। ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নাতের সাথে সাথে তাহাজ্জুদ, ইশরাক ও আওয়াবিন নামাযেও যত্নবান হই। প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ কুরআন তিলাওয়াত করি। যাদের তিলাওয়াত শুদ্ধ নেই তারা অন্ততঃ নামাযের প্রয়োজনীয় সূরাগুলো শুদ্ধ করার চেষ্টা করি এবং কোন আলেম/কারী সাহেবকে ফোনে হলেও সূরাগুলো শুনিয়ে সহীহ করে নিই। প্রতিদিন কমপক্ষে ১০০ বার দুরূদ শরীফ, ১০০ বার ইস্তিগফার, ১০০ বার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও ১০০ বার আল্লাহ আল্লাহ যিকির করি। সম্ভব হলে এই যিকিরগুলো আরো অধিক পরিমাণও করতে পারি। সকল কাজ সুন্নাত তরীকায় সম্পাদনে যত্নবান হই। মাসনূন দুআগুলোও গুরুত্বের সাথে পাঠ করার চেষ্টা করি। নির্ভরযোগ্য আলেমের লেখা আকায়িদ, ইবাদত, মুয়ামালাত (লেনদেন), মুয়াশারাত (আচার-আচরণ), আখলাক ও সীরাত বিষয়ক কিতাবাদী অধ্যয়ন করতে থাকি। আর করোনা ও মহামারী থেকে বাঁচার দুআগুলোও নিয়মিত পড়তে থাকি।
তাহলে শুধু করোনাভীতির এই অবসরে নয় বরং অনাগত দিনেও এমনকি মৃত্যুর পরেও মহান রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি ও অনাবিল শান্তি লাভে ধন্য হবো ইনশা-আল্লাহ ।

  1. وَالْعَصْرِ
  2. إِنَّ الإِنسَانَ لَفِي خُسْرٍ
  3. إِلاَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ
পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *