মদীনার কড়চা-দুই

মুফতি হাফিজুর রহমান

রিয়াযুল জান্নাহ ও রওযা শরীফ কি এক ও অভিন্ন?
রিয়াযুল জান্নাহ অর্থ জান্নাতের বাগানগুলো। যদিও শাব্দিক অর্থে জান্নাত অর্থও বাগান। তবে এখানে পারিভাষিক অর্থ গৃহীত। রওযা শরীফ অর্থ মহিমাময় বাগিচা। রিয়াযুল জান্নাহ ও রওযা শব্দু দুটি হাদীসে এসেছে। রওযা শরীফ শব্দটি এভাবে যুক্ত হয়ে হাদীসে আসে নি। এটা মানব সংযুক্ত শব্দ। যেমন জান্নাতুল বাকী শব্দটি হাদীসে আসে নি। হাদীসে এসেছে বাকিউল গারকাদ। রওযা ও রিয়াযুল জান্নাহ যথাক্রমে একক ও যুগল শব্দ দুটি একই হাদীসের দুটি শব্দ। হাদীসটির আরবী পাঠ নিম্নরূপ :
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ زَيْدٍ الْمَازِنِيِّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَا بَيْنَ بَيْتِي وَمِنْبَرِي رَوْضَةٌ مِنْ رِيَاضِ الْجَنَّةِ
অর্থ : আব্দুল্লাহ ইবনে যায়দ মাযিনী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার গৃহ এবং আমার মেম্বারের মধ্যবর্তী অংশটি জান্নাতের বাগিচাগুলোর মধ্য হতে একটি বাগিচা। সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৯৫
হাদীসটিতে দেখা যাচ্ছে রিয়াযুল জান্নাহ নামে কোন জায়গা নেই। আছে রওযা বা রওযাতুল জান্নাহ। আজ মানুষ যে জায়গাটিকে রিয়াযুল জান্নাহ নামে চিনে সেটা মূলত রিয়াযুল জান্নাহ নয়; বরং রাওযা বা রওযাতুল জান্নাহ। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওই জায়গাটিকে জান্নাতের একটি মাত্র বাগান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন; অনেকগুলো বাগান হিসেবে নয়। অথচ রিয়াযুল জান্নাহ অর্থ জান্নাতের অনেকগুলো বাগান। তো চলিত পরিভাষায় নাম ও জায়গার সাথে সুযুজ্য নেই। সারকথা, যেটাকে আমরা রিয়াযুল জান্নাহ নামে চিনি সেটাই মূলত রওযা বা রওযা শরীফ।

আমরা রওযা শরীফ বলতে রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র সমাধিকে বুঝে থাকি। কিন্তু রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ মাকবারাকে রওযা বলে অভিহিত করেন নি। তবে কেউ কেউ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সমাহিত স্থানকেও রওযার অন্তর্গত হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। এ বিষয়ে আরবী ব্যকরণিক একটি রীতি সবিশেষ উল্লেখ্য। রীতিটিতে বলা আছে, যদি প্রান্তসীমা ও সীমিত বিষয় একজাতীয় হয় তবে বিধানগত দিক থেকে প্রান্তসীমা সীমিত বিষয়ের অন্তর্গত হয়। এর ব্যতিক্রম হলে অন্তর্গত হয় না। এ রীতিটি এখানে প্রয়োগ হলে দেখা যাচ্ছে, প্রান্তসীমা তথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র সমাহিত স্থানটি ছিলো একটি কুঠরি। অন্য দিকে সীমিত তথা মেম্বার ও কুঠরির মধ্যবর্তী জায়গাটি হলো মসজিদ। মসজিদ আর কুঠরি একজাতীয় নয়। সুতরাং আরবী ব্যকরণিক এ রীতি মতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র মাকবারা রওযার অন্তর্গত হয় না। বস্তুত এ বিষয়টি সম্বন্ধে আল্লাহই ভালো জানেন। আমরা শুধু কিছু উপলক্ষ জড়ো করে নিছক এক দুটি সম্ভাবনাই তুলে ধরতে পারি।

রিয়াযুল জান্নাহ বা রওযা শরীফে নামাজ আদায়ের স্বতন্ত্র কোনো মাহাত্ম্য আছে কি না আমার জানা নেই। তবে যেহেতু এটি জান্নাতের বাগান তাই এখানে নামাজ আদায়ের একটা বৈশিষ্ট ও মাহাত্ম্য থাকতে পারে। দুর্বল সূত্রে বর্ণিত একটি হাদীস থেকেও এমন ধারণা পাওয়া যায়।
মসজিদে নববীস্থ এ রওযা আরেক হজরে আস ওয়াদ। প্রচণ্ড ভীড়ের সাত আটটি ধাপ পেরিয়ে রওযায় প্রবেশ করতে হয়। তবে এখানকার ডিসিপ্লিন-ব্যাবস্থা আমার ভালো লেগেছে। একটু সময় ব্যয় হলেও বেশ কিছু ব্যারিকেড অতিক্রম করে সবাই কাঙ্ক্ষিত জায়গায় গিয়ে নামাজ আদায় করতে পারে। এখানে ভীড় আছে ঠিক। তবে হাজরে আসওয়াদের মতো অতটা ভয়ঙ্কর নয়। এসব জায়গায় মানুষ যে পরিমাণ চেষ্টা সাধনা করে, হায় যদি ফরজ ওয়াজিবের জন্য এর অর্ধেক পরিমাণও চেষ্টা সাধনা করতো তবে কতোই না ভালো হতো!

মসজিদে নববী ঘেষেই মাকবারাতুল বাকী এর অবস্থান। সম্ভবত মদীনার দ্বিতীয় দিন। কাকডাকা মিস্ট ভোরে বাকিতে প্রবেশ করি। এক অব্যক্ত ভালো লাগায় মোহিত হই। তখন সত্যিই এ পবিত্র মাকবারাটিকে জান্নাতের বাগিচা বলে মনে হচ্ছিলো। এক আরবকে দেখি, নতুন একটি কবরে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, শায়খ! এটা কার কবর? বেদনার ছাপ পূর্ব থেকেই তার চোখে মুখে ভেসে উঠছিলো। আমার প্রশ্নে বেদনার রংটা আরো গাঢ় আরো নীল হলো। একটু সময় নিয়ে এক রাশ বেদনার স্বর মিশিয়ে বললেন, লি উম্মি- আমার মায়ের কবর। বাকির পরিধি প্রশস্ততাও কম নয়। জিজ্ঞেস করলাম, সাহাবায়ে কেরামের কবরগুলো কোন দিকে হবে। তিনি বেশ মমতা মিশিয়ে আমাদের একটা দিক দেখিয়ে বললেন, এ দিকটাই সাহাবায়ে কেরামের কবর বিদ্যমান। সাহাবায়ে কেরামের কবরগুলো চিহ্নিত নেই। তবে কিছু কিছু কবর প্রস্তর যোগে ঘিরে রাখা আছে। ধারণা হলো, এগুলো প্রথম শ্রেণীর সাহাবায়ে কেরামের পবিত্র সমাধি। মসজিদে নববীস্থ লাইব্রেরির এ্যালবাম দেখে সে ধারণাই প্রবল হলো। অনেক দূর পর্যন্ত হেঁটে গেলাম। পবিত্র এ মাটিতে হাঁটার মাঝে অমৃত এক রকমের স্বাদ অনুভব করছিলাম। ওখান থেকে বেরুতে ইচ্ছা করছিলো না। মনে মনে ভাবছিলাম, আহ! যদি এখানে আজীবন পড়ে থাকা যেতো।

একাধিকবার মসজিদে কুবায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। মা’রাজুল কুরআনিল কারীমে (কুরআনিক সংগ্রশালা) যাওয়া হয়েছে। কুরআন বিষয়ক অনেক কিছুই দেখা হয়েছে, জানা হয়েছে। মসজিদে নববী থেকে খানিকটা দূরত্বে তুর্কি মিউজিয়াম। পাশে ছোট্ট তুর্কি মসজিদ। মিউজিয়ামটি তুর্কি স্থাপনার এক জীবন্ত স্মৃতি। মিউজিয়ামটি ঘুরে দেখলাম। সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস রা. এর ব্যবহৃত তরবারিটি দেখে বেশ মুগ্ধ হলাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগের স্বর্ণ মুদ্রা দেখারও সৌভাগ্য হলো। আশরাফ ভাইকে এ মিউজিয়ামের তথ্য দিলাম। বেশ আগ্রহী হলেন। আশরাফ ভাই ও উসামা ভাই মিলে গিয়ে একদিন দেখে এলেন। দুজনই বেশ উচ্ছ্বাসিত হলেন। এজেন্সির গাড়িতে করে ওহুদ প্রান্তরেও যাওয়া হলো। ওহুদ পাহাড় ঘেষেই ওহুদ যুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী সাহাবাদের মাকবারাহ। চৌদিকে সুউচ্চ লৌহ জালির বেষ্টনি দিয়ে ঘেরা। বাহির থেকে ভিতরের সবকিছুই স্পষ্ট দেখা যায়। অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে মাকবারা যিয়ারত করা হলো। খন্দক যুদ্ধের স্মৃতিস্থলও দেখা হলো। সে পরিখার কিছুই এখন অবশিষ্ট নেই। নগর স্থাপনায় সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

একদিন ভোরে মদীনা ভার্সিটিতে গিয়ে উপস্থিত হলাম। সাথে ছিলেন রাসেল ভাই। দর্শনীয় জায়গাগুলোতে সুন্দর মনের এ মানুষটি আমায় সঙ্গ দিয়েছেন। মদীনা ভার্সিটির বিস্তৃত ক্যাম্পাস। হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ক্লান্তি চলে এসেছে। মসজিদে আব্দুল্লাহ বিন বাজে এক শিক্ষার্থীর সাক্ষাত পেলাম। বেশ মনোযোগের সাথে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ধ্যানমগ্নতা ভঙ্গ করে সমাচার ও পরিচয় পর্ব শেষে জিজ্ঞেস করলাম, এখানকার ছাত্র কিনা। বললো, হ্যা। প্রয়োজনীয় কথা বার্তা শেষে ছাত্র ভাইটি এতোটাই উচ্ছ্বাসিত হলেন যে, আমাকে জড়িয়ে ধরার মতো অবস্থা। তার বিস্ময়ের ব্যাপার ছিলো, বাংলাদেশের মানুষ আরবী ভাষায় কথা বলে কি করে? সে বললো, তোমরা আরবী ভাষায় কথা বলতে পারছো, এটা তোমাদের জন্য পরম সৌভাগ্য। পুরোটা ক্যাম্পাস ঘুরে দেখবার সাধ ছিলো। কিন্তু সময় স্বল্পতায় তা আর হয়ে উঠে নি। মসজিদ লাইব্রেরিতে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে কিছু বই পুস্তক ঘাটাঘাটি করে চলে আসি।

জিন উপত্যকা। অনেক শুনেছি এ নাম। বিস্ময় জেগেছে অনেক। দেখবার প্রচণ্ড বাসনা সৃষ্টি হবারই কথা। একদিন এজেন্সির গাড়ি প্রস্তুত হলো। আমরা বাসে চড়ে বসলাম। সোজা জিন উপত্যকায় গিয়ে উপস্থিত। সাথে পানির বোতল ছিলো। এবার নিরীক্ষার পালা। দু চোখে দেখছি, পীচ-ঢালা পাকা সড়কটি ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠে গেছে। পানির বোতল রাস্তার মাঝে রেখে দিচ্ছি। রাস্তার সাথে সাথে বোতলটিও উপরের দিকে ছুটে চলছে। কেমন অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড! রাস্তার মাঝে পানি ঢেলে দিচ্ছি। পানির ধারা ছুটে চলছে উপরের দিকে। সাথীরা নিজেদের মত করে নানা উপায়ে নিরীক্ষণ পর্ব সম্পন্ন করছে। রিজাল্ট একই। সব কিছুই ঊর্ধমুখী। পরীক্ষা শেষ। বাসে চড়ে কিছুটা সমুখে যাওয়া হলো। পথ শেষ। তাবুক অবধি রাস্তা হবার কথা ছিলো। জিনদের উৎপাতে নাকি এ পর্যন্ত এসেই পথ অফ করে দিতে হয়েছে। যে জায়গাটাতে এসে পীচঢালা পথটি থেমে গেছে তার পাশেই খানিকটা জায়গা জুড়ে বিনোদন স্পটের মত করা হয়েছে। ওখানে দুজন উট চালক উট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের মত অনারবীরা উটে চড়বার স্বাদ আস্বাদন করছে। আমাদেরও ইচ্ছে হলো। ব্যক্তিগতভাবে আমার ইচ্ছের পেছনে কারণ ছিলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উটে চড়েছেন। নববী অনুভূতিটাকে নিজের ভিতরে তৈরি করবার জন্যই বস্তুত এ ইচ্ছে প্রবণতা। সাথীদে প্রায় সবাই উটে চড়লেন।

জীবন্ত খেজুর বাগান দেখার সাধ ছিলো। এজেন্সির গাড়িতে করে খেজুর বাগানে যাওয়া হলো। কত সুন্দর কতো মনোরম! এই তো সেই খেজুর বাগান যেখানে সাহাবায়ে কেরাম কাজ করতেন। গাছে গাছে থোকায় থোকায় খেজুর ঝুলছে। প্রাণ জুড়িয়ে যাবার মত দৃশ্য। দীর্ঘ সময় জুড়ে বাগানটি খুটে খুটে দেখবার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু সময় হয়ে উঠে নি। হাতের নাগালেই খেজুর কাঁদি। আলতো করে ধরে ধরে পবিত্র খেজুরের স্পর্শ নিয়েছি। দু এক সাথি দু এক পিস ছিড়ে মুখে পুরে দিয়েছে। নিতান্তই গর্হিত হয়েছে। এভাবে মুখে তুলে দেবার অনুমোদন ছিলো না। রুচি মত মসজিদে নববীর গ্রন্থাগারটি খুঁজে বের করে নিয়েছি। এ যেন এক গ্রন্থগিরি। সুবিশাল গ্রন্থালয়। আমার দেখা জীবনের সব চেয়ে বৃহৎ গ্রন্থাগার। তাকে তাকে থরে থরে সাজানো অগণিত গ্রন্থের অফুরন্ত সমাহার। এক জীবন এখানেই কাটিয়ে দেয়া সম্ভব। যদি সুযোগ হতো তবে জীবনের বাকিটা এখানেই কাটিয়ে দেবার সাধনায় মনোযোগী হতাম। নির্ঝঞ্ঝাট নিরবচ্ছিন্ন অধ্যয়নের মাঝে রয়েছে এক অমৃত সুধা, অপার অনন্দের পরম ভালোলাগা। তেমন ব্যস্ততা নেই। হাতে সময়ের সমাহার। অনেক অনেক সময় এখানে দেবার সৌভাগ্য হচ্ছে, হয়েছে। কিছু কিছু নোটও চলছে। স্বতন্ত্র অধ্যয়নের জন্যও মদীনা ট্যুর হতে পারে।

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *