উলুল আমর ও আমীরের আনুগত্য : পরিচয়, পরিধি, হুকুম

মুফতী মাহমূদুল আমীন


বিগত ১৭ মার্চ, রোজ রবিবার, বা’দ আসর, কাকরাইল সার্কিট হাউজ জামে মসজিদে সরকারি-বেসরকারি উচ্চপদস্থ ব্যাক্তিবর্গ ও মুসল্লি ভাইদের উদ্দেশ্য প্রদত্ত বয়ান। ঈষৎ সংক্ষেপন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন ও তথ্যসূত্র সংযোজনসহ উপস্থাপিত হলো।

দীনী আলোচনা ও ওয়াজ-নসীহতে সতর্কতা অবলম্বন জরুরী

দীনের কথা বলা ও ওয়াজ-নসীহত করা বেশ দায়িত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর বিষয় । যে কথা কুরআনে নেই তা কুরআনের কথা বলে চালিয়ে দিলে মিথ্যা বলা হবে। একইভাবে কুরআনের কোন আয়াতের অপব্যাখ্যা করাও গুরুতর অন্যায়। হাদীস শরীফে আছে, যে ব্যক্তি কুরআনের ইলম ছাড়া তাফসীর করে সে ব্যক্তি যেন তার ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নেয়। (সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ২৯৫০)। অনুরূপ এমন কোন বর্ণনাকে হাদীস বলে চালিয়ে দেয়া যা মূলত হাদীস নয় ভয়ানক গুনাহ। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আমার উপর মিথ্যা বলল সে যেন আপন ঠিকানা জাহান্নামে বানিয়ে নেয়। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩)।

এজন্যই তাবলীগের মুরব্বীগণ ছয় নম্বরের সীমার মধ্যে কথা বলতে বলেন। যাতে দীনের দাওয়াত দিতে গিয়ে আওয়াম সাথীরা জবানের উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে না ফেলেন। দীনের নামে বদদীনী কিছু বলে না ফেলেন। আখেরাত কামাতে গিয়ে আখেরাত নষ্ট না করে ফেলেন।  সাধারণ লোক তাত্ত্বিক কোন কথা বলবেন না। তারা শুধু ছয নম্বরের উপর কথা বলবেন। যাতে করে তার দ্বারা সীমালঙ্ঘন না হয়ে যায়। তাবলীগের মুরব্বীগণ প্রথম থেকেই খুব সতর্কতার সাথে উসূল নির্ধারণ করে দিয়েছেন যে, এ কাজের মিম্বারে কোন মাসায়েলের আলোচনা হবে না। কেননা মাসআলা মাসায়েল বলা অভিজ্ঞ মুফতিগণের যিম্মাদারী।

ইমাম মালেক রহ. কে একদিন প্রায় চল্লিশটি মাসআলা জিজ্ঞাসা করা হলো। তিনি তার মধ্যে ৫টি প্রশ্নের উত্তর দিলেন। বাকীগুলোর ক্ষেত্রে অপারগতা প্রকাশ করলেন। (উসূলুল ইফতা; পৃষ্ঠা ২৪)।

উসূলে ইফতা নামক কিতাবে একথাও আছে المفتى موقع من الله। মুফতী সাহেব আল্লাহর পক্ষ থেকে দস্তখতকারী। আল্লাহ তা‘আলা এখন নিজে তো আসছেন না। তিনি মুফতীর মাধ্যমে বলাচ্ছেন। এজন্য মুফতীকে অনেক সতর্ক হয়ে কথা বলতে হয় এবং কখনো তাঁর কোন কথা ভুল প্রমাণিত হলে তিনি তা থেকে রুজু করেন এবং তা  শুধরে নেন। যেভাবে ভুল হয়েছে সেভাবে শুধরান। হযরত থানভী রহ. মুফতী ছিলেন। তাঁর ফাতাওয়ার বেশ কয়েকটি কিতাব আছে। তিনি ফতওয়া দেয়ার ক্ষেত্রে প্রথমে যে ভুল বা অপ্রাধান্য মাসআলা বলে ফেলেছেন এবং পরবর্তীতে যেগুলো থেকে রুজু করেছেন এমন মাসা‘আলা সম্বলিত তাঁর একটি স্বতন্ত্র কিতাবই আছে।  যে কিতাবের  নাম ‘তারজীহুর রাজেহ’। এই ভুল স্বীকার করাকে তারা কোন ত্রুটি মনে করতেন না; বরং জরুরী মনে করতেন।

উলুল আমরের তাফসীর ও আমীরের আনুগত্যের বিধান

আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا 

অর্থ: হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক তাদের। তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড় তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর। যদি তোমরা আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম। (সূরা নিসা, আয়াত ৫৯)।

তাফসীরে মা‘আরিফুল কুরআনে আল্লামা মুফতী শফী রহ. এই আয়াতে উলুল আম্র সম্পর্কে লিখেছেন,

উলুল আম্র আভিধানিক অর্থে সেই সকল লোককে বলা হয়, যাদের হাতে কোন বিষয়ের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পিত থাকে। সে কারণেই হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি., মুজাহিদ ও হাসান বসরী র. প্রমুখ মাফাসসিরগণ উলামা ও ফুকাহা সম্প্রয়দায়কে ‘উলিল আম্র’ সাব্যস্ত করেছেন। তাঁরাই হচ্ছেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নায়েব বা প্রতিনিধি। তাঁদের হাতেই দীনী ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পিত।

মুফাসসিরীনে কেরামের অপর এক জামাআত (যাঁদের মধ্যে হযরত আবূ হুরাইরা রাযি.-সহ অন্যান্য সাহাবায়ে কিরামও রয়েছেন।) বলেছেন, উলিল আম্র এর মর্ম হচ্ছে সেসব লোক যাঁদের হাতে সরকার পরিচালনার দয়িত্ব ন্যাস্ত।

এছাড়া তাফসীরে ইবনে কাসীর এবং তাফসীরে মাযহারীতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ শব্দটি দ্বারা (উলামা ও শাসক) উভয় শ্রেণীকেই বুঝানো হয়। কারণ, নির্দেশ দানের বিষয়টি তাঁদের উভয়ের সাথেই সম্পৃক্ত।

এ আয়াতে বাহ্যত তিন জনের আনুগত্য ও অনুসরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

(১)     আল্লাহর আনুগত্য।

(২)     রাসূলের আনুগত্য।

(৩)     উলিল আম্র-এর আনুগত্য।

কিন্তু কুরআনের অন্যান্য আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বলে দওয়া হয়েছে যে, নির্দেশ ও আনুগত্য প্রকৃতপক্ষে শুধমাত্র এক আল্লাহরই জন্য নির্ধারিত। বলা হয়েছে إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ । অর্থ : নির্দেশ একমাত্র আল্লাহর। (সূরা ইউসুফ, আয়াত ৪০, ৬৭)। তবে তাঁর হুকুম ও তাঁর আনুগত্যের বাস্তবায়ন পদ্ধতি চার ভাগে বিভক্ত।

(১) সে সমস্ত বিষয়ের হুকুম বা নির্দেশ যা স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা সরাসরি কুরআনে বলে দিয়েছেন এবং যাতে কোন প্রকার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অবকাশ বা প্রয়োজন নেই। যেমন, শিরক ও কুফরী চরম পাপের কাজ হওয়া, একমাত্র আল্লাহ তাআলার ইবাদাত করা, আখিরাত ও কেয়ামতে বিশ্বাস করা, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সর্বশেষ সত্য নবী বলে মান্য করা এবং নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাতকে ফরয মনে করা। এ গুলো এমন বিষয়, যা সরাসরি আল্লাহর নির্দেশ এবং এগুলোর ইতাআত সরাসরি আল্লাহরই ইতাআত বা আনুগত্য।

(২) আহকাম ও বিধি-বিধানের সে অংশ যাতে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। প্রায়ই কুরআনে কারীম এসবের ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত কিংবা আংশিক নির্দেশ দিয়েছে এবং নবী সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর সেগুলোর বিশ্লেষণের দায়িত্ব অর্পন করা হয়েছে। অতঃপর তিনি যে ব্যাখ্যা হাদীসের মাধ্যমে দিয়েছেন, সেগুলোও এক প্রকার অহী-ই বটে। এসব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে কোন রকম দ্ব্যর্থতা থেকে গিয়ে থাকলে সেগুলোও অহীর মাধ্যমে সংশোধন করে দেয়া হয়েছে। এবং শেষ পর্যন্ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিশেষ বাণী ও কাজ-কর্মসমূহও আল্লাহর হুকুমসমূহের পরিপূরক হয়ে গিয়েছে।

এসকল হুকুম আহকামের আনুগত্য করা যদিও প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই আনুগত্য, কিন্তু যেহেতু বাহ্যত এসব হুকুম-আহকাম সরাসরিভাবে কুরআন নয়, মহানবীর বাণীর মাধ্যমে উম্মতের নিকট এসে পৌঁছেছে, সেহেতু সেগুলোর আনুগত্যকে বাহ্যত রসূলের আনুগত্য বলেই অভিহিত করা হয়, যা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর আনুগত্যের অঙ্গীভূত হওয়া সত্ত্বেও বাহ্যিক দৃষ্টিতে একটা পৃথক মর্যাদার অধিকারী। সে জন্যই সমগ্র কুরআনে আল্লাহর আনুগত্যের নির্দেশ দানের সাথে সাথে রসূলের আনুগত্যের কথাটিও পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

(৩) ওই সব আহ্কাম ও নির্দেশ যেগুলো পরিষ্কারভাবে না কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে না হাদীসে। এগুলোর ব্যাপারে আবার পরস্পরবিরোধী বর্ণনাও দেখা যায়। এমন সমস্ত হুকুম-আহকামের ব্যাপারে মুজতাহিদ ও গবেষক আলিমগণ কুরআন ও সুন্নাহর প্রকৃষ্ট বক্তব্য ও আলোচ্য বিষয়ের নযীর-উদাহরণের  উপর চিন্তা-ভাবনা করে তার হুকুম অনুসন্ধান করে নেন। প্রকৃতপক্ষে সরাসরি কুরআন-সুন্নাহ না হলেও যেহেতু কুরআন ও সুন্নাহই এসব আহকামের মূল উৎস, সেহেতু  এগুলোর আনুগত্য করাও আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করার নামান্তর। কিন্তু বাহ্যিক দৃষ্টিতে এগুলোকে ফিকহী ফাতাওয়া বলা হয় এবং এগুলোকে আলিম সম্প্রদায়ের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়।

তৃতীয় পর্যায়ের এসব হুকুম-আহকামের মধ্যে এমন হুকুম-আহকামও রয়েছে, যাতে কুরআন-সুন্নাহর দিক দিয়ে কোন রকম বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়নি। বরং এসবে যারা আমল করবে তাদের ইচ্ছানুযায়ী যেভাবে খুশী আমল করতে পারে। পরিভাষাগতভাবে এগুলোকে বলা হয় ‘মুবাহ’। এ ধরণের হুকুম-আহকামের সম্পাদন ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব শাসক শ্রেণী ও কর্তৃপক্ষের উপর ন্যস্ত থাকে। তারা অবস্থা ও কল্যাণ-অকল্যাণের প্রেক্ষাপটে বিচার-বিবেচনা করে সবাইকে তদানুরূপ পরিচালনা করবেন। যেমন, কোন শহরে ডাকঘরের সংখ্যা কয়টি  হবে, পুলিশ ষ্টেশন কয়টি হবে, রেলওয়ে ব্যবস্থা কিভাবে চলবে এসব বিষয়ই হল ‘মুবাহ’ বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। এগুলোর কোন দিকই ওয়াজিব অথবা হারাম নয়, বরং ঐচ্ছিক। কিন্তু যেহেতু এসব বিষয়ের স্বাধীনতা জনসাধারণকে দিয়ে দেয়া হলে তাতে শাসনকার্য চলতে পারে না, কাজেই ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব প্রশাসনের হাতেই থাকে।

উল্লিখিত আয়াতে ‘উলিল আম্রের’ আনুগত্যের মর্ম উলামা ও শাসক কর্তৃপক্ষ উভয়েরই আনুগত্য করা। অতএব, আয়াতের পরিপ্র্রেক্ষিতে ফিক্হ সংক্রান্ত গবেষণার ক্ষেত্রে ফিক্হবিদগণের আনুগত্য এবং শাসন-ব্যবস্থা সংক্রান্ত হুকুম-আহ্কামের ক্ষেত্রে শাসন কর্তৃপক্ষের আনুগত্য করাও অপরিহার্য হয়ে গেছে।

এ আনুগত্য প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর হুকুম-আহকামেরই আনুগত্য। কিন্তু বাহ্যিক দৃষ্টিতে এসব নির্দেশ বা হুকুম-আহকাম না আছে কুরআনে, আর না সুন্নাহয়। বরং এগুলোর বিশ্লেষণ হবে উলামাদের পক্ষ  থেকে কিংবা শাসনকর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে। সেজন্যই এসবের আনুগত্যের বিষয়টিকে তৃতীয় পর্যায়ে পৃথকভাবে সাব্যস্ত করে ‘উলিল আম্র’ এর আনুগত্য নামে অভিহিত করা হয়েছে। আর যেভাবে কুরআনের নস বা সরাসরি আহ্কামের ক্ষেত্রে কুরআন এবং রসূলের নির্দেশসমূহের ক্ষেত্রে রসূলের আনুগত্য ও অনুসরণ করা ওয়াজিব, তেমনিভাবে যেসব বিষয়ে কুরআন-হাদীসের সরাসরি কোন হুকুম নেই, সেগুলোতে ফিক্হবিদ উলামা এবং শাসন সংক্রান্ত বিষয়ে শাসনকর্তৃপক্ষের নির্দেশের আনুগত্য করাও ওয়াজিব। আর এটাই হল উলিল আম্র এর প্রতি আনুগত্যের মর্ম। (তাফসীরে মা‘আরিফুল কুরআন; মুফতী শফী রহ., অনুবাদ: মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, প্রকাশক: ইসলামিক ফাউন্ডেশন, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৪৩১-৪৩৩)।

উলুল আমর দ্বারা কোন সংগঠন বা জামা‘আতের আমীর কিংবা নেতা উদ্দেশ্য নয়

উপরোল্লিখিত আয়াতে কারীমায় উলিল আম্র দ্বারা খণ্ড খণ্ড বিভিন্ন সংঘঠন বা জামাতের নেতা বা আমীরকে বুঝানো হয়নি। যেমনটি আজ-কাল অনেকেই বুঝেন বা বুঝিয়ে থাকেন। শরীয়তের দৃষ্টিতে বিভিন্ন সংগঠন বা জামাতের আমীরের ইতাআতের বিষয়টি ওয়াজিব বা জরুরি পর্যায়ের নয় বরং ঐচ্ছিক। চাইলে তার আনুগত্য করতে পারে, না করলেও কোন গুনাহ নেই। হ্যা, কাজের শৃংখলা বজায়ে রাখার জন্য আমীর নিযুক্ত করা মুস্তাহাব। এবং শৃংখলা বজায় রাখার স্বার্থে বিনা প্রয়োজনে এমন আমীর বা নেতার নির্দেশ মান্য না করা বা তার ডাকে সাড়া না দেয়া অনুচিত। তবে সাড়া না দিলে গুনাহ হবে না। ঐ আমীর বা নেতার আনুগত্যই ওয়াজিব যাকে এক বা একাধিক শহরের সকলে মিলে আমীর বা কাযী বানিয়ে নিয়েছে। (ইমদাদুল মুফতীন,পৃষ্ঠা ৭৪১)।

আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাহল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যাতীত কারো শর্তহীন ইতা‘আত জায়েয নেই

আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাহল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শর্তহীন ইতাআত করতে হবে। এছাড়া আর কারো শর্তহীন ইতাআত জায়েয নেই।  চাই তিনি সাহাবী হন কিংবা তাবেয়ী হন বা অন্য কেউ। বাকী সবার  ইতাআত হবে শর্তযুক্ত। কুরআন-সুন্নাহর খেলাফ না হওয়ার শর্তে তাদের আনুগত্য করতে হবে।  স্ত্রী স্বামীর ইতাআত করবে। এটা আল্লাহর হুকুম। এই হুকুমও ঐ সময় পর্যন্ত যতক্ষণ স্বামী বৈধ কাজের হুকুম করবে। স্বামী অবৈধ কাজের হুকুম করলে স্ত্রীর জন্য সেটা মানা জায়েয নেই। এমনিভাবে ছাত্র  উস্তাদের ইতাআত করবে; যতক্ষণ উস্তাদ জায়েয বিষয়ে আদেশ করবে। না জায়েযের হুকুম দিলে ছাত্রদের জন্য উস্তাদের হুকুম মানা জায়েয নেই। কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী অবস্থান নিলে মা‘মূরের জন্য আমীরের এতাআত জায়েয নেই।

এই আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা যে শাসকবর্গ ও উলামায়ে কেরামের আনুগত্য করতে বললেন তা শর্তহীন নয়; বরং শর্তযুক্ত। যতক্ষণ পর্যন্ত উলামায়ে কেরাম আমাকে সঠিক বিষয়ের দিকে নির্দেশনা দিবে ততক্ষণ তাদের আনুগত্য করব। আর যদি আমরা বুঝতে পারি তিনি ভুল পথের আদেশ দিচ্ছেন তখন তার আনুগত্য জায়েয হবে না। একইভাবে শাসকবর্গের ক্ষেত্রেও এ বিধান প্রযোজ্য। ইসলামী খেলাফত কায়েম না থাকলেও বৈধ বিষয়ে শাসকবর্গের আদেশ পালন করা প্রজাদের জন্য আবশ্যক।  কিন্তু না জায়েয বিষয়ে তাদের আদেশ পালন বৈধ নয়। হাদীসে আছে,

لا طاعة لمخلوق في معصية الله عز و جل। অর্থ : আল্লাহকে নারাজ করে কোন সৃষ্টির আনুগত্য জায়েয নেই। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১০৯৫)।

সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমসহ হাদীসের নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহে  একটা হাদীস বর্ণিত হয়েছে, হযরত আলী রাযি. বর্ণনা করেন, একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটা কাফেলাকে জিহাদে পাঠালেন। একজন আনসারী সাহাবীকে ঐ কাফেলার আমীর নিযুক্ত করলেন এবং সবাইকে আমীরের ইতা‘আত করতে বললেন। (কাফেলা সফরে বের হলেন এক পর্যায়ে) কোন কারণে আমীর সাহেব বাকী সাথীদের উপর ভীষণ নারাজ হলেন। লাকড়ি জমা করে আগুন জ্বালাতে বললেন। অতঃপর সকলকে সে আগুনে ঝাঁপ দিতে বললেন।  সবাই আগুনে প্রবেশে তৈয়ার হলেন তখন একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিলেন। একজন বললেন আমরা তো আগুন থেকে বাচাঁর জন্য রাসূল সাল্লাল্লামের কাছে এসেছি। তাহলে কি আমরা আবারো সে আগুনে প্রবেশ করবো? ইতিমধ্যে লাকড়ির আগুনও নিভে গেল এবং আমীর সাহেবের ক্রোধানলও নির্বাপিত হলো। তারা মদীনা শরীফে ফিরে আসলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এঘটনা জানতে পেরে বললেন, তারা যদি ওই আগুনে প্রবেশ করতো তাহলে আর কোন দিন বের হতে পারতো না। إِنَّمَا الطَّاعَةُ فِي الْمَعْرُوفِ অর্থ: আনুগত্য শুধু ভালো ও বৈধ কাজে করতে হবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৭১৪৫, সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৮৭২)।

এজন্য উলামায়ে কেরাম, শাসনকর্তা বা জামাতের আমীর যার এতা‘আতই আমরা করি না কেন অবশ্যই  আমাদের খেয়াল রাখতেই হবে যে, তিনি মাসুম বা নিষ্পাপ নয়। তার ভুল হবে না এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। নেই কারো ঈমানী মৃত্যুর নিশ্চিত গ্যারান্টি।  তাই লিখিত বা মৌখিক এমন শপথ করা যে ‘আমি আমরণ অমুকেরই আনুগত্য করবো’ চরম গোমরাহী। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, যদি কেউ কাউকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে চায় তাহলে সে যেন মৃতদের মধ্য হতে কাউকে গ্রহণ করে। কেননা জীবিত মানুষ ফেতনামুক্ত নয়। (হিলয়াতুল আউলিয়া ওয়া তাবাকাতুল আসফিয়া, আবু নুয়াইম ১/৩২৭, শরহুস সুন্নাহ, বাগাবী ১/২১৪)

ভাল হোক মন্দ হোক অমুককেই মানবো এ ধরনের মানসিকতা পথভ্রষ্টতা। কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবো না যে, আমার ঈমানের সাথে মৃত্যু হবেই। তবে অবশ্যই আশা করতে পারি। হাদীসে এসেছে, অনেক মানুষ জাহান্নামীদের আমল করে। এমনকি তার ও জাহান্নামের মাঝে এক হাত ব্যবধান থাকে এমন সময় সে হেদায়েত   পেয়ে যায়, এবং জান্নাতীদের আমল করে। ফলে সে  জান্নাতে প্রবেশ করে। আবার অনেক মানুষ জান্নাতীদের আমল করে এমনকি জান্নাত ও তার মাঝে একহাত ব্যবধান থাকে। তখন সে গোমরাহ হয়ে যায় এবং জাহান্নামবাসীর আমল করে। ফলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করে। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৩৩২, সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৮৯৩)

বালআম বাউরা নামক বিখ্যাত মুস্তাজাবুত দাওয়াহ (যার দু‘আ অবশ্যই কবুল হয়) ব্যাক্তির শেষ জীবনে পথভ্রষ্ট হওয়ার কাহিনী  তো সর্বজনবিদিত।

আবেগ ভালোবাসাকে দীন ও শরীয়তের অনুগামী করা আবশ্যক

কোন ব্যাক্তির ভক্তি-মহব্বত যদি দীন-শরীয়তের উপর প্রবল হয়ে যায় তখনই শিরক বিদ‘আত হয়। দীনের নামে ব্যক্তির অন্ধ অনুকরণে লিপ্ত হয়ে আখেরাতকে বরবাদ করে ফেলে। একবার আমি নিযামুদ্দীন মারকাযে গেলাম। তখন আমার ইচ্ছে হল বিখ্যাত নিযামুদ্দীন আউলিয়ার কবরটি একটু যিয়ারত করে যাই। গিয়ে আমার প্রচ- দুঃখ হলো। ঢোল তবলা সবই বাজছে সেখানে। অনেকেই সেজদা করে করে মাজারে ঢুকছে। দেখে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। নিজামুদ্দীন আউলিয়া তো শিরকের বিরুদ্ধে দাওয়াত দিতেন। মানুষকে তাওহীদের কালিমা শেখাতেন। তাহলে তার কবরে শিরক হচ্ছে কেন? কারণ হল, এখানে যে লোকগুলো আছে তাদের অন্তরে কবরস্থ ব্যক্তির মহব্বত আল্লাহ ও রাসূলের মহব্বতের চেয়ে বেশি হয়ে গেছে। কুরআন-সুন্নাহ উপেক্ষা করে এমন অন্ধভক্তির বহু উদাহরণ আমাদের চার পাশেই বিদ্যমান আছে।

আমার এক ত্বলেবে ইলম, যে গত বছরেই আমাদের মা‘হাদুল বুহুসিল ইসলামিয়ায় দু বছরের ইফতা কোর্স শেষ করে সালে বের হয়েছে। তার বাবা ঢাকার একজন প্রসিদ্ধ এতাআতী তাবলীগী। সালে বের হওয়ার সময় তার  বাবা তাকে বলল, তুমি যদি আমার সাথে চিল্লায় যাও তবে আমার জামাতটি  পূর্ণ হয়। সে আমার কাছে মশওয়ারা চাইলো। আমি বললাম ঠিক আছে, বাবার সাথে যাও। দাওয়াতের কাজ সহীহভাবে করো। তবে বাবার ধ্যান ধারণার অনুসরণ করো না। সে সহ ১০/১২ জন সাথী নিয়ে তার বাবা কাকরাইলের রোখ ছাড়াই নওগা গিয়ে উপস্থিত। তারা সেখানে যাওয়ার পর এতা‘আতীদের একটি জোড় হল। সে জোড়ে সাভারের একজন প্রসিদ্ধ এতা‘আতী আলেম বয়ান করলেন। (যিনি গত টঙ্গি ইজতিমার এতা‘আতী পর্বে বয়ানের তরজমাও করেছেন।) তিনি বললেন, হযরতজি ইলিয়াস রহ. কেয়ামত পর্যন্ত তার খান্দানকে এবং নিযামুদ্দিনের চার দেয়ালকে কবুল করিয়ে গিয়েছেন। আমার ছাত্র যেহেতু আলেম, তাই তার অন্তরে প্রশ্ন সৃষ্টি হলো। বয়ান শেষে বাবাকে জিজ্ঞাসা করলো, আব্বু! এই যে, সে বললো, হযরতজি ইলিয়াস রহ. কেয়ামত পর্যন্ত তার খান্দানকে এবং নিযামুদ্দিনের চার দেয়ালকে কবুল করিয়ে গিয়েছেন। এটা কি ঠিক বললেন? কবুল করানোর বিষয়টি তিনি কীভাবে জানলেন? এ বিষয় তো আল্লাহ তা‘আলা জানানো ছাড়া জানা সম্ভব নয়। তাহলে কি এব্যাপারে ওহী এসেছে?  আম্বিয়ায়ে কেরামও তো তাদের সন্তানদের জন্য দুআ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা যখন ইবরাহীম আ.কে ইমামতের মর্যাদ দানের ঘোষণা করেছেন তখন তিনি এ দু‘আ করেছেন, হে প্রভু আমার বংশধরদেরকেও এ নেয়ামত দান করুন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তার সকল বংশধরের ব্যাপারে এ দু‘আ কবুল করেন নি। যেখানে আম্বিয়ায়ে কেরাম সব সন্তানকে কবূল করাতে পারেন নি সেখানে হযরতজী ইলিয়াস রহ. কিয়ামত পর্যন্ত সবাইকে কবুল করিয়ে ফেলেছেন, একথা বলা কি ঠিক বলা হলো? এ প্রশ্ন শুনে তার দীর্ঘ দিন মেহনত কারনেওয়ালা বাবা নির্দ্বিধায় বললেন, তিনি অতিভক্তির কারণে এমনটি বলেছেন।

মুলত বর্তমানে এই অতিভক্তির কারণেই তাবলীগ রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত। অতিভক্তির ব্যাধিতে আক্রান্তরাই কুরআন-সুন্নাহ ও উলামায়ে কেরামের মত ও পথ ছেড়ে আবেগের ঘোড়া দৌড়াচ্ছে। এ ঘোড়সওয়ারীরা যে মদিনার পথ হারিয়েছে একথা বুঝতেও তারা নারাজ। ভক্তির অন্ধত্বে যারা রাহযান ভেবে রাহবারের উপরই হামলা চালায় তাদের সঠিক গন্তব্যে পৌঁছা যে অনিশ্চিত, এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে আমরা চাই, সবার জীবনেরই আধাঁর কাটুক। কুয়াশার চাদর সরিয়ে সবার হৃদয়ে ভাসুক হেদায়েতের আলো ঝলমলে নভ।

মহান রব্বুল আলামীনের দরবারে অশ্রুভেজা নয়নে এই তামান্নাই করছি, কেননা তিনিই তো হিদায়াতের মালিক।

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *