মহিমান্বিত শবে বরাত : করণীয়, বর্জনীয় ও প্রামাণিকতা

মুফতী হাফিজুর রহমান

শবে বরাতের প্রামাণিকতা

শা’বান মাসের বিশেষ একটি অংশের ব্যাপারে স্বতন্ত্র তাৎপর্য এবং মাহাত্ম্যের কথা হাদীসের কিতাবগুলোতে আলোচিত হয়েছে। আর সে অংশটি হলো ১৪ শা’বান দিবাগত রজনী। হাদীসের ভাষায় মহিমান্বিত এ রজনী ‘লাইলতুন নিসফি মিন শা’বান’ আর সাধারণ মানুষের পরিভাষায় লাইলাতুল বারা‘আত এবং শবে বরাত বা মুক্তির রজনী হিসেবে পরিচিত। এ রজনীটিকে ঘিরে আমাদের কিছু ভাইয়েরা বিদআত প্রতিরোধের নামে মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ের শিথিলতার আশ্রয় নেন। অথচ যতটুকু বিদআত এবং ধর্মীয় অনাচারের পর্যায়ে পড়ে ততটুকুই রোধ করা প্রয়োজন ছিল। দেহের কোনো অঙ্গে অপারেশন পর্যায়ের ইনফেকশন হলে নির্দিষ্ট অঙ্গটিকেই অপারেশন করে কেটে ফেলতে হয়। ইনফেকশনের ধুয়া তুলে যদি পূর্ণ দেহটিকেই দু টুকরো করে দেয়া হয় তবে তো তাতে আর প্রাণের স্পন্দন থাকবে না। ফরজ নামায কিংব ফরজ রোযাকে ঘিরে অনেক জায়গায় নানা রকমের কুসংস্কার প্রচলিত আছে। তাই বলে তো সংস্কারের নামে ফরজ নামায রোযাকে ছেটে ফেলে দেয়া যাবে না। দীনের কাজ করতে হলে অনেক সূক্ষ্ম বিষয় মাথায় রাখতে হয়। সামনে রাখতে হয় নববী কর্মপন্থা। অতি আবেগ যে কোনো সময় ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। মাহাত্ম্যপূর্ণ এ রজনী সম্পর্কে কয়েকটি বর্ণনা এবং সালাফের কিছ উক্তি রয়েছে। প্রাসঙ্গিক আলোচনাসহ কয়েকটি বর্ণনা ও আসলাফের কিছু উক্তি এখানে তুলে ধরছি।

(১) মু‘আজ ইবনে জাবাল রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তা‘আলা অর্ধ শা’বানের রজনীতে সৃষ্টিজগতের দিকে মনোনিবেশ করেন এবং শেরেকে আচ্ছন্ন ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন।

(সুনানে ইবনে মাজাহ; হা.নং ১৩৯০, সহীহ ইবনে হিব্বান; হা.নং ৫৬৬৫, [শাইখ শু‘আইব আরনাউত এর মন্তব্য, হাদীসটির ইসনাদ সহীহ])

উপরোক্ত নির্ভরযোগ্য উদ্ধৃতির আলোকে হাদীসটির শাস্ত্রীয় আলোচনায় না গিয়েও এ কথা বলার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে, হাদীসটি আমলযোগ্য। আমাদের কিছু ভাইয়েরা শাইখ ইবনে বায রহ. এর একটি আলোচনার আলোকে অর্ধ শা’বানের রজনীর মাহাত্ম্যকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন। কিন্তু ইবনে বায রহ. তাঁর ফাতাওয়াসমগ্রে (মাজমূউ ফাতাওয়া ইবনে বায ১/১৮৬, ১/২৩৫ আততাহযীর মিনাল বিদা’ অধ্যায়) যে আলোচনাটি করেছেন তাতে ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এবং ইবনে রজব হাম্বলী রহ. এর উদ্ধৃতি টেনেছেন। কিন্তু তাঁদের নিজস্ব অভিমতকে তিনি গ্রহণ করেন নি। তাছাড়া ইবনে বায রহ. বহু জাল হাদীসের মুণ্ডুপাত করেছেন। কিন্তু উপরোক্ত হাদীসটি তাঁর সে আলোচনায় উল্লেখ করেননি। আর কিছু না হোক উপরোক্ত হাদীসটি সামনে থাকলে মহিমান্বিত এ রজনীকে এভাবে তার অপাঙক্তেয় ঘোষণা করার কথা নয়। জানি না, সংশ্লিষ্ট আলোচনাটি করার সময় ইবনে বায রহ. এর ‘যেহেনে’ উক্ত হাদীসটি ছিল কি না। হয়তো বা তিনি মাত্রাজ্ঞানহীন লোকদের সীমাতিরিক্ত বাড়াবাড়ির প্রতিকারকল্পে এমন কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তবে এটা তো ইলমে শরীয়তের একটি স্বীকৃত নীতি যে, প্রান্তিকতা বা বাড়াবাড়ির প্রতিকারে বিধিত বাস্তব সত্যকে অস্বীকার করে করা যাবে না; বরং বিধানিক বিষয়ের যথাযথ উপস্থাপনের মাধ্যমেই বাড়াবাড়ির প্রতিকার করতে হবে। এবার আমরা বিশেষ ঘরানার সম্মানিত ভাইদের জ্ঞাতার্থে এ বিষয়ে তাদের কয়েকজন আদর্শ পুরুষসহ কয়েকজন মহামনীষীর মন্তব্য তুলে ধরছি।

১। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, অর্ধ শা’বান রজনীর শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে একাধিক মারফু হাদীস ও আসার বর্ণিত হয়েছে। এসব বর্ণনার আলোকে প্রতীয়মান হয়, পনের শা’বানের রজনীটি একটি মহিমান্বিত রজনী। সালাফের কেউ কেউ এ রাতে নফল নামাযের ব্যাপারে যতœবান হতেন। আর শা’বানের রোযার ব্যাপারে তো অসংখ্য হাদীসই বর্ণিত হয়েছে। সালাফ এবং খালাফের মধ্য হতে কেউ কেউ এ রাতের শ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার করেন। তবে হাম্বলী এবং অহাম্বলী মাসলাকের অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম এ রাতের শ্রেষ্ঠত্বের কথা স্বীকার করেন। ইমাম আহমদ রহ. এর ভাষ্যও এ মতের প্রমাণ বহন করে। কারণ এ সম্বন্ধে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আর এগুলোর সমর্থনে সালাফের আসারও বিদ্যমান রয়েছে। এ রাতের ফযীলত সম্পর্কিত কতক বর্ণনা মুসনাদ ও সুনান শিরোনামে সংকলিত হাদীস গ্রন্থেও বর্ণিত হয়েছে। তবে শা’বানের পনের তারিখের দিনে স্বতন্ত্রভাবে রোযা রাখার ব্যাপারে যতœবান হওয়া মাকরূহ। (ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এর অভিমত এটিই। তাঁর মতে পনের তারিখের সাথে দু এক দিন মিলিয়ে রোযা রাখা উত্তম)। আর এ রাতে বিশেষ খাবারের ব্যাবস্থা করা, সাজ-সজ্জার ব্যাপারে যতœবান হওয়া বিদআত; এর কোনো ভিত্তি নেই। তেমনিভাবে এ রাতে ‘সালাতে আলফিয়া’ নামক বানোয়াট নামাযের জন্য মসজিদে সমবেত হওয়াও বিদআত। কারণ নির্দিষ্ট সময়, সংখ্যা এবং কিরাতযোগে এ জাতীয় নফল নামাযের জন্য সমবেত হওয়া শরীয়তসম্মত নয়। (ইকতিযাউস সিরাতিল মুস্তাকীম ১৭/১৭ [শামেলা সংস্করণ])

২। বর্তমান সময়ের আলোচিত ব্যক্তিত্ব শাইখ নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ. উপরোল্লিখিত হাদীসটির সমর্থনে আটটি হাদীস উপস্থাপন করে বলেন, এসব সূত্রের সামগ্রিক বিবেচনায় হাদীসটি নিঃসন্দেহে সহীহ।…সুতরাং শাইখ কাসেমী রহ. তাঁর ইসলাহুল মাসাজিদ গ্রন্থে (১৭০) জারহ তা’দীলের ইমামদের উদ্ধৃতির আলোকে ‘অর্ধ শা’বানের রাতের শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে কোনো সহীহ হাদীস নেই’ বলে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তা গ্রহণযোগ্য নয়। তবে যদি কেউ এ জাতীয় ঢালাও উক্তি করে থাকেন তবে সেটা তার দ্রুত সিদ্ধান্ত প্রদান এবং সূত্র অনুসন্ধানে কষ্ট স্বীকার করতে না পারার পরিণতি। (সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহাহ ১/১২৪)

৩। ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী রহ. এ রাতের ফযীলত সংক্রান্ত দীর্ঘ আলোচনার পর বলেন, একজন মুমিনের জন্য বাঞ্ছনীয় হলো, এ রাতে যিকির ও দুআ-প্রার্থনার জন্য সম্পূর্ণরূপে অবসর হয়ে যাওয়া। সে নিজের পাপ মার্জনা এবং বিপদ-আপদ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য দু‘আ-প্রার্থনায় রত হবে। খাঁটি মনে তাওবা করবে। কারণ যে ব্যক্তি এ রাতে তাওবা করে তার তাওবা আল্লাহ তা‘আলা কবুল করেন। তবে এক্ষেত্রে মুমিনের জন্য আবশ্যক হলো, দু‘আ কবুল হওয়া ও মাগফিরাত লাভের ক্ষেত্রে যেসব পাপাচার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে সেসব থেকে বিরত থাকা। (লাতায়িফুল মা‘আরিফ ফীমা লিমাওয়াসিমিল আমি মিনাল ওয়াযায়িফ ১৯২)

৪। সুনানে তিরমীযীর গাইরে মুকাল্লিদ ভাষ্যকার আল্লামা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী রহ. এ রাতের ফযীলত সংক্রান্ত বিভিন্ন হাদীস উল্লেখ করার পর বলেন, এসমস্ত হাদীস ঐসমস্ত ব্যক্তিদের বিপক্ষে নির্ভরযোগ্য সূত্র হিসেবে পরিগণিত যারা ধারণা করে, অর্ধ শা’বানের রাতের ফযীলতের ব্যাপারে কোনো কিছুই প্রমাণিত নয়। (তুহফাতুল আহওয়াযী ৩/৩৬৭)

৫। মিশকাতুল মাসাবীহ এর সমকালীন ব্যাখ্যাতা আবুল হাসান উবাইদুল্লাহ মুবারকপুরী বলেন, …এসমস্ত হাদীস অর্ধ শা’বান রজনীর মাহাত্ম্য, শ্রেষ্ঠত্ব এবং মহিমার ব্যাপারে স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। এ রাতটি আর পাঁচটা রাতের মত নয়। সুতরাং এ ব্যাপারে উদাসীন হওয়া উচিৎ নয়। বরং শ্রেয় হল, ইবাদত, দু‘আ এবং যিকির-ফিকিরে রত থেকে এ রাতের অফুরন্ত কল্যাণ অর্জন করা। (মির‘আতুল মাফাতীহ শরহু মিশকাতিল মাসাবীহ ৭/৫৮)

৬। শাইখ ইবনুল হাজ্জ রহ. বলেন, ‘এ রাত যদিও শবে কদরের মত নয়; কিন্তু এর অনেক ফযীলত ও বরকত রয়েছে। আমাদের পূর্বসূরী পূণ্যাত্মারা এই রাতের যথেষ্ট মর্যাদা দিতেন এবং এর যথাযথ হক আদায় করতেন। কিন্তু আজ সাধারণ লোকেরা বিষয়টিকে সম্পূর্ণ উল্টো করে ফেলেছে। তারা রসম-রেওয়াজ ও কুসংস্কারের পেছনে পড়ে (মনের অজান্তেই) এর খায়ের বরকত ও কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একে তো ওরা এ রাতে আলোকসজ্জার নিকৃষ্টতম রসম যা অগ্নিপূজকদের প্রতীক, তা করছে; অপরদিকে মসজিদসমূহে সমবেত হয়ে শোরগোল করে পবিত্র পরিবেশকে নষ্ট করছে। তাছাড়া মহিলাদের কবরস্তানে যাওয়া, তা-ও আবার বেপর্দা অবস্থায়, পাশাপাশি পুরুষদেরও কবর যিয়ারতের উদ্দেশে ওখানে ভিড় সৃষ্টি করাÑ এসব কিছুই নব আবিষ্কৃত বিদআত এবং নববী সুন্নত ও সালাফে সালেহীনের পথ ও পদ্ধতির পরিপন্থী।’ (আলমাদখাল ১/২৯৯-৩১৩, আলকাউসার, সেপ্টেম্বর ’০৬)

৭। প্রসিদ্ধ হাদীস শাস্ত্রবিদ ইমাম ইবনুস সালাহ রহ. বলেন, অর্ধ শা’বান রজনীর অসীম ফযীলত ও মহত্ত্ব রয়েছে। এ রাতে ইবাদতে রত হওয়া মুস্তাহাব। তবে সেটা ব্যক্তি পর্যায়ে; সমবেত রূপ দিয়ে নয়। (আল-আসারুল মারফূ‘আহ ফিল আখবারিল মাউযু‘আহ ১/৭১)

৮। ইন্টারনেটভিত্তিক ৫৬ হাজার ফতওয়া সম্বলিত আরবী ফতওয়াসমগ্র ‘ফাতাওয়া আশশাবাকাতিল ইসলামিয়া’তেও (২/২৫৬৩) এ রাতের মহত্ত্ব সম্বন্ধে ইতিবাচক আলোচনা করা হয়েছে।

অর্ধ শা’বান রজনীর সপক্ষে এত সূত্র ও ভিত্তি থাকার পরও কোন বিবেকে শুধু ইবনে বায রহ. এর একটি বিচ্ছিন্ন মতের আলোকে এ রাতের মহত্ত্বকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার স্পর্ধা দেখানোর সুযোগ থাকতে পারে?

(২) আলা ইবনুল হারিস রহ. সূত্রে বর্ণিত, আয়েশা রাযি. বলেন, একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে দাঁড়ালেন। কিন্তু সেজদাকে এতটা দীর্ঘায়িত করলেন, আমার ধারণা হলো তাঁর ইন্তেকাল হয়ে গেছে। এ অবস্থা দেখে আমি উঠে গিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বৃদ্ধাঙ্গুলী নাড়া দিলাম। তখন আঙ্গুল নড়ে উঠল। ফলে আমি যথাস্থানে ফিরে এলাম। যখন তিনি সেজদা থেকে মাথা উঠালেন এবং যথা নিয়মে নামায শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, আয়েশা! তুমি কি ধারণা করেছো, আল্লাহর নবী তোমার অধিকার ক্ষুণœ করবেন? তখন আমি বললাম, না, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তবে আপনার দীর্ঘ সেজদার কারণে আমি মনে করেছিলাম, আপনার ইন্তেকাল হয়ে গেছে। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটা হলো, অর্ধ শা’বানের রজনী। আল্লাহ তা‘আলা অর্ধ শা’বানের রজনীতে তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোনিবেশ করেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদেরকে তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দেন। আবু বকর বাইহাকী রহ. বলেন, এটি উত্তম পর্যায়ের মুরসাল হাদীস। সম্ভবত আলা ইবনুল হারিস মাকহুল থেকে হাদীসটি শ্রবণ করেছেন। (আলজামি’ লিশুআবিল ঈমান হাদীস ৩/৩৮২/৩৮৩৫)

পালনীয় বিষয়

হাদীসের আলোকে প্রমাণিত হয়, এ রাতে দীর্ঘ সেজদা সম্বলিত দীর্ঘ নামায আদায় করা শরীয়তের কাক্সিক্ষত বিষয়। তবে সাধারণ নিয়মে দু রাকাত, চার রাকাত করে যত রাকাত সম্ভব আদায় করবে। সাথে কুরআন তিলাওয়াত, দুআ-দুরূদ এবং যিকির ইস্তেগফারে মনোযোগী হবে। তবে সবিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে, যেন রাত জাগা ক্লান্তির কারণে ফজরের নামাযের অত্যাবশ্যক ইবাদত ছুটে না যায়। আর এসব আমল একান্ত ঘরোয়া পরিবেশেই করা শ্রেয়। তবে যদি কোনোরূপ আহ্বান-ঘোষণা ব্যতিরেকে কিছু লোক মসজিদে এসে যায় এবং ব্যক্তিগতভাবে নিজ নিজ আমলে মগ্ন থাকে তবে এতেও কোনো ক্ষতি নেই। তবে এক্ষেত্রে লক্ষণীয় হলো, আমার ইবাদতের কারণে যেন অন্যের আমলে কোনোরূপ ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়।

শবে বরাত পরবর্তী দিনের রোযা

শবে বরাত পরবর্তী দিন তথা শাবানের পনের তারিখে রোযা রাখার আমলও করা যেতে পারে। এ দিনের রোযার ব্যাপারে সুনানে ইবনে মাজাহতে (হাদীস নং ১৩৮৮) একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। হাদীসটিকে উলামায়ে মুহাদ্দিসীন সূত্রগত দিক থেকে যয়ীফ বলে অভিহিত করেছেন। তবে এ মাসে অধিক পরিমাণ রোযা রাখার বিষয়টি অসংখ্য সহীহ হাদীসে আলোচিত হয়েছে। উপরন্তু শা’বান মাসের ১৫ তারিখ হলো ‘আইয়ামে বীয’ তথা চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখের অন্তর্ভুক্ত। আর আইয়ামে বীযে রোযা রাখার ব্যাপারটি সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি মাসের আইয়ামে বীযে রোযা রাখতেন। মিলহান কাইসী রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে তের চৌদ্দ এবং পনের তারিখে বীযের রোযা রাখার নির্দেশ দিতেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৪৪৯) আবু হুরায়রা রাযি. বলেন, আমার খলীল (ঘনিষ্ঠ বন্ধু) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে প্রতি মাসে রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯৮১)

ইবনে রজব হাম্বলী রহ. বলেন, শা’বান মাসের পনের তারিখে রোযা রাখা নিষিদ্ধ নয়। কারণ পনের তারিখ তো আইয়ামে বীযের অন্তর্ভুক্ত। আর প্রতিমাসে আইয়ামে বীযে রোযা রাখা মুস্তাহাব। (লাতায়িফুল মা‘আরিফ ১৮৯)

তবে শুধু ১৫ শা’বানের কারণে এ রোযাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সুন্নত মনে করা অনেক উলামায়ে কেরাম সঠিক মনে করেন না। আর সে কারণেই অধিকাংশ ফুকাহায়ে কেরাম মুস্তাহাব রোযার তালিকায় শা’বানের ১৫ তারিখের রোযাকে স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করেন নি। সুতরাং এসকল বিষয়কে সামনে রেখে যদি কেউ এ দিন রোযা রাখে তবে ইনশাআল্লাহ সে সওয়াব লাভ করবে।

বর্জনীয় বিষয়

(১) হালুয়া রুটির পঙ্কিল সংস্কৃতি : সমাজে শবে বারা‘আত তথা মুক্তির রজনীকে কেন্দ্র করে হালুয়া-রুটির আয়োজন বেশ ঘটা করেই চলছে। এটাকে তারা ‘পরম পূজনীয়’ বিষয় বলেই জ্ঞান করে থাকে। অথচ এ ধরনের মনগড়া রসনাবিলাসী আয়োজনের কোনোই ভিত্তি নেই।

হাদীসের নামে জাল কিছু বর্ণনাকে কেন্দ্র করে সমাজে নানা রকম আচার আনুষ্ঠানিকতার প্রাদুর্ভাব ঘটে। ধর্মের নামে সেসব ধর্মাচার অপাঙ্ক্তেয় হলেও তার একটি ঠুনকো সূত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু হালুয়া-রুটির প্রাদুর্ভাব কোন সূত্রটিকে ঘিরে আবর্তিত তার প্রেক্ষাপট আমরা খুঁজে পাই নি। আশুরার দিনে ভাল খাবারের আয়োজনের ব্যাপারে একটি হাদীসের সন্ধান পাওয়া যায়। হাদীসটির কার্যকারিতা নিয়ে বিদগ্ধ উলামা মহলে বিতর্ক থাকলেও তার একটি বর্ণনানুগ সূত্র আছে। বস্তুত খাবার আয়োজন নিয়ে শরীয়তের বিশেষ কোনো বিধি নিষেধ নেই। কিন্তু বৈধ কোনো বিষয়ের স্বাভাবিক গতিধারা যদি সময়কেন্দ্রিকতার কারণে বাধাগ্রস্ত হয় কিংবা সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ে তখন তা বৈধতার আবেদন হারিয়ে ফেলে। সুতরাং আপাতদৃষ্টিতে হালুয়া-রুটির আয়োজন বিধিসম্মত হলেও তা সময়ের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে প্রথাগত রূপ নেয়ায় তা আর শরীয়তসম্মত নেই; বরং অবশ্যপরিত্যাজ্য হয়ে গেছে। (ইকতিযাউস সিরাতিল মুস্তাকীম ১৭/১৭ [শামেলা সংস্করণ])

(২) আলোক-সজ্জার ঝিলিমিলি আয়োজন : লাইলাতুল বারা‘আতকে কেন্দ্র করে একশ্রেণীর মানুষ দোকান-পাট, বাসা-বাড়ী এমনকি আল্লাহর ঘর মসজিদের দেয়ালেও ঝুলিয়ে দেয় বাহারী ঝিলিমিলি বাতি। মূলত এটি অগ্নিপুজার অন্যতম একটি অনুষঙ্গ। অমিতব্যয়ের এ আলো ঝলকানিতেও তারা নেকী-পূণ্যের সমাহার খুঁজেন। স্বাভাবিক সাজসজ্জা ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু তা যদি স্বাভাবিকতার মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখন তা আর বৈধ থাকে না; নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এ আলোকসজ্জায় যেমন আছে মাত্রাহীন অর্থ অপচয় তেমনি আছে ধর্মাচারের নামে সীমাহীন বাড়াবাড়ি। তাই এ জাতীয় সূত্রবিহীন আচার-আনুষ্ঠানিকতা ইসলাম সমর্থন করে না। এসব অনাচারের প্রাদুর্ভাব রোধে কর্মতৎপর হওয়া আবশ্যক। (ইকতিযাউস সিরাতিল মুস্তাকীম ১৭/১৭ [শামেলা সংস্করণ], আল-আসারুল মারফূ‘আহ ফিল আখবারিল মাউযু‘আহ ১/৭১)

(৩) আতশবাজির ধর্মহীন উন্মাদনা : যেসব ভাইয়েরা শবে বরাতের নব আবিষ্কৃত আচার-আনুষ্ঠানিকতার সাথে সংশ্লিষ্ট তারা কি এ রাতের আতশবাজিকেও পূণ্যের বিষয় বলে মনে করেন? জানি না, এ ব্যাপারে তাদের লালিত ধারণাটা কি। যদিও এ বিষয়টির সাথে আবেগী যুবসমাজই বেশি যুক্ত থাকে। ধর্মীয় বিষয়ে মতভিন্নতার ফিরিস্তি নাতিদীর্ঘ হলেও দীন বিষয়ে জানাশোনা এমন কোনো মানুষ পাওয়া দুষ্কর হবে যারা অনর্থক এবং মানবতা বিরোধী এ পটকাবাজিকে বিধানিক বলে মত পেশ করবেন। অথচ মহিমান্বিত একটি রাতকে কেন্দ্র করে এ পটকাবাজির চর্চা হচ্ছে। এতে ইবাদতে নিমগ্ন মানুষের মনোযোগ ব্যাহত হচ্ছে, ঘুমন্ত মানুষের ঘুমকে হারাম করে দেয়া হচ্ছে। একটি পাপাচারের সাথে হাজারো পাপাচার এসে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। আইন করেও এ জাতীয় পাপাচারের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। এই সবই মুক্তির রজনী নিয়ে সীমাতিরিক্ত বাড়াবাড়ির অশুভ পরিণতি।

(৪) মাজার-কবরে নারী পুরুষের অবাধ জমায়েত : ১৪ শা’বান দিবাগত রাতে কবর-মাজারগুলোতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আপামর জনতার ঢল নামে। সেখানে গিয়ে তারা এমন এমন আচার আনুষ্ঠানিকতায় লিপ্ত হয় যা ইসলামী শরীয়ত আদৌ সমর্থন করে না। নারীদের কবরস্তানে গমনের ব্যাপারে এমনিতেই বিধি-নিষেধ রয়েছে। সেখানে পর্দার বিধান লঙ্ঘন করে মাজার-কবরে অবাধ যাতায়াতের ব্যাপারটি কিভাবে বিধিসম্মত হতে পারে। কবর যিয়ারত একটি কাক্সিক্ষত এবং পূণ্যময় বিষয়। সহীহ হাদীসের বর্ণনায় এ সম্বন্ধে স্পষ্ট নির্দেশনা এসেছে। কিন্তু দিন তারিখ নির্দিষ্ট করে সেটাকে সম্মিলিত পোষাকী রূপ দেয়া আদৌ শরীয়তসম্মত নয়। (ইবনুল হাজ্জ, আল-মাদখাল ১/২৯৯-৩১৩,)

(৫) শবে বরাতের ‘গোসল-স্নান’ : অনেকে শবে বরাত উদযাপনের উদ্দেশে এ রাতে গোসলনীতি পালন করে থাকেন। ফুটপাথীয় কোনো পুস্তকে হয়েতো দেখেছেন, এ রাতে গোসল করলে পানির ফোঁটায় ফোঁটায় নেকির ফল্গুধারা বয়ে যাবে। কিন্তু ভাইয়েরা এসব ‘রূপকথা’র শুদ্ধাশুদ্ধি বিচার করে দেখেন না। এ রাতের গোসলের মাহাত্ম্যের ব্যাপারে একটি জাল বর্ণনা রয়েছে। বর্ণনাটিতে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি বরাতের রাতে ইবাদত পালনের উদ্দেশে গোসল করবে তার গোসলের প্রতি ফোঁটা পানির বিনিময়ে আমলনামায় ৭০০ রাকাআত নফল নামাযের পূণ্য লেখা হবে। বানোয়াট এ বর্ণনাটিকে ঘিরেই ‘হিন্দুয়ানী স্নানব্রত’ সদৃশ এ পরগাছার জন্ম হয়েছে। (যাইলুল মাকাসিদিল হাসানাহ, যাইলু তানযীহিশ শরী‘আহ, শা’বান মাস অধ্যায়। হযরত মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেব দা.বা., প্রচলিত জাল হাদীস ১০৫)

(৬) বিশেষ পদ্ধতির সালাত আদায় : বারা‘আতের এ রজনীতে নামায পড়ার বহু রকমের নিয়ম পদ্ধতি সমাজে প্রচলিত আছে। মানুষ না জেনে না বুঝে কষ্টসাধ্য এসব নামাযের পেছনে মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করে। এতে প-শ্রমের সাথে সাথে জাহান্নামে যাওয়ার পথ আরো অবারিত ও মসৃণ হয়। ইমাম ইবনুল জাওযী রহ. বলেন, আমি কিছু মানুষকে দেখেছি, তারা সারা রাত জেগে হাজার হাজার বার বিভিন্ন সূরা যোগে এ জাতীয় নামায আদায় করে। এরপর ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে ফজর নামায কাযা করে ঘুমিয়ে থাকে। সুতরাং এ রাতের এক হাজার বার সূরা ইখলাস সম্বলিত একশত রাকাত নামায, একত্রিশ বার সূরা ইখলাস সম্বলিত বার রাকাত নামায, বিশেষ পদ্ধতির চার রাকাত খাসমা’র নামায, সেজদার বিশেষ দু‘আ সম্বলিত নামায, বিশেষ কিরাত সম্বলিত চৌদ্দ রাকাত নামাযসহ আরো যত প্রকার বিশেষ প্রকৃতির নামায রয়েছে সবই বানোয়াট। এসবের কোনো ভিত্তি নেই। এসবের পেছনে শ্রম দিয়ে পাপ কামাই করার কোনো অর্থ হয় না। (আল-আসারুল মারফু‘আ ফিল আখবারিল মাউযুআহ ৭৮-১১৪, ইমাম ইবনুল জাউযী, কিতাবুল মাউযুআত ২/১৩০)

(৭) লাইলাতুল বারাআতকে লাইলাতুল কদরের সমমর্যাদায় বা ততোধিক মর্যাদায় ভূষিত করা : শবে বরাতের মহিমা শুধু হাদীসের ভাষ্যে প্রমাণিত। কিন্তু লাইলাতুল কদরের মর্যাদা স্বয়ং কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। অথচ মানুষ সেই শবে কদরের চেয়েও শবে বরাতকে শ্রেষ্ঠতর মনে করছে। কেউ কেউ ভাষ্যে কিংবা বিশ্বাসে এ কথার জানান দিচ্ছে। কেউ বা আচার আনুষ্ঠানিকতায় তার প্রমাণ দিচ্ছে। কারণ শবে কদরের সময় ইবাদত-বন্দেগী নিয়ে এত মাতামাতি আর এত পরিমাণে বর্ণাঢ্য আয়োজন লক্ষ্য করা যায় না। এতেই প্রমাণ হয়, তাদের নিকট শবে বরাত যতটা গুরুত্বপূর্ণ শবে কদর ততোটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটা নিতান্তই আপত্তিকর এবং অতীব গর্হিত ব্যাপার। এ জাতীয় ধ্যান ধারণার আশু অপনোদন জরুরী।

ইবাদাতকে সম্মিলিত এবং আনুষ্ঠানিক রূপ দান

শবে বরাতের মাহাত্ম্য সহীহ হাদীসের আলোকে প্রমাণিত। এ রাত উদযাপনের বিশেষ কোনো পন্থা উদ্ভাবন না করে এবং সম্মিলিত ও আনুষ্ঠানিক রূপ না দিয়ে সাধারণ ইবাদত বন্দেগীতে রত থাকাও নির্ভরযোগ্য বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু আজকাল বিশেষ নিয়মে সম্মিলিত ও আনুষ্ঠানিক রূপ দিয়ে যেভাবে শবে বরাত উদযাপনের প্রক্রিয়া চলছে তাতে শবে বরাতের স্বাভাবিক ধর্মাচারের গতিধারা ব্যাহত হয়। নির্দিষ্ট সময় করে ওয়াজ নসীহত এরপর দুআ-মুনাজাত এবং তাবারক বিতরণীÑ এসবই অতিরঞ্জন এবং বাড়াবাড়ি পর্যায়ের কর্মপদ্ধতি। এগুলো পরিহার করা বাঞ্ছনীয়। মসজিদ মূলত ফরজ নামাযের জন্য। নফল নামায নিজ নিজ গৃহে আদায় করা উত্তম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নফল নামায নিজ গৃহে আদায় করতেন। এ সম্বন্ধে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আমরা শবে বরাতের রাতে যে অতিরিক্ত নামায আদায় করি তা সবই নফল নামাযের পর্যায়ভুক্ত। ইবনে উমর রাযি. সূত্রে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা তোমাদের ঘরেও কিছু নামায আদায় করো। তোমাদের ঘরগুলোকে কবর-সমাধি বানিয়ে রেখো না। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৪৩২)

আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে শবে বরাতের স্বাভাবিক মর্যাদা ও গুরুত্বের প্রতি লক্ষ্য রেখে সব ধরনের প্রথাগত রীতি-নীতি পরিহার করে প্রভূত কল্যাণ অর্জনের তাওফীক দান করুন এবং সর্বপ্রকার অকল্যাণ-অনাচার থেকে নিরাপদ থেকে বিশুদ্ধ ধর্মীয় জীবন যাপন করার তাওফীক দান করুন; আমীন!

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *