পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামোফোবিয়া ইন্ডাস্ট্রি

কাসেম শরীফ

ইসলামোফোবিয়া হলো, ইসলামভীতি বা ইসলামবিদ্বেষ কিংবা মুসলিমবিরোধী মনোভাব। Islamophobia নিন্দার্থে বা ব্যাঙ্গার্থে ব্যবহৃত একটি রাজনৈতিক শব্দ, যার অর্থ ইসলামকে ভয় করা। এর দ্বারা ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করাকেও বোঝানো হয়। ইসলামোফোবিয়ার কারণ হিসেবে অনেকে চরমপন্থী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে দায়ি করে থাকে। আবার অনেকে ইসলামের বিরুদ্ধেই এই শব্দ ও বিশ্বাস প্রয়োগ করে থাকে।

ফরাসি উপনিবেশিক শাসক Alain Quellien-কে মনে করা হয় তিনিই সর্বপ্রথম একটি লিখিত দলিলে ‘ইসলামোফোবিয়া’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। (The Muslim Policy in West Africa, 1910)।

আরেকজন উপনিবেশিক প্রশাসক Maurice Delafosse. তিনি বলেছিলেন, উপনিবেশিক প্রশাসনের ভেতর মুসলিমদের প্রতি ঘৃণাবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। এবং শাসন নীতিগতভাবেই মুসলমানদের প্রতি ঘৃণাবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন।

পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে ফিলিস্তিন বংশোদ্ভূত আমেরিকান লেখক এডওয়ার্ড সাঈদ এ শব্দটি ব্যবহার করেন। সম্ভবত তিনিই প্রথম একাডেমিক জার্নাল-এ এই শব্দ ব্যবহার করেন। জন্মগতভাবে এডওয়ার্ড সাঈদ একজন আরব খ্রিস্টান। কিন্তু সারাজীবন কাটিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তাঁর পিতা একজন আমেরিকান সৈনিক। একাধিকবার তিনি আমেরিকার হয়ে যুদ্ধ করেছেন। সাঈদ পড়াশুনা করেছেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। ব্যক্তিগত রাজনৈতিক ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে তিনি ছিলেন একজন বামপন্থী চিন্তা প্রভাবিত মানুষ।

সাম্প্রতিক সময়ে ‘ইসলামোফোবিয়া’ বলতে আমরা যা বুঝি, তার সঙ্গে আক্ষরিক অর্থের মিল কম। বরং বর্তমান সময়ের ‘ইসলামোফোবিয়া’ ধারণাটিকে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পরিচিত করে তোলে যুক্তরাজ্যভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান ‘রানিমেইড ট্রাস্ট’। রানিমেইড ট্রাস্ট যুক্তরাজ্যের প্রথম সারির একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, যারা বর্ণবাদবিরোধী গবেষণা করে থাকে এবং সরকার ও পাবলিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সাহায্য করে থাকে।

১৯৯৬ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি ১৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিশন গঠন করে, যার প্রধান ছিলেন অধ্যাপক গরডন কনওয়ে। এই ১৮ সদস্যের কমিটিতে ধর্মীয় পরিচয়ের দিক থেকে মুসলিম, খ্রিস্টান, হিন্দু, শিখ ও ইহুদী সবাই ছিলেন। এই কমিটি যে রিপোর্টগুলো প্রকাশ করে, তার শিরোনাম ছিলো- “Islamophobia a Challenge For Us All”। রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মিডিয়া ও অন্যান্য মাধ্যম এটা ব্যাপক প্রচার শুরু করে। অনেকে রিপোর্টটিকে স্বাগত জানায়। আবার কেউ কেউ এর বিরোধিতা করে।

রানিমেইড ট্রাস্ট-এর এই রিপোর্ট প্রায় ২০ বছর পর আরো ফলোআপ করে প্রকাশ করা হয় ”Islamophobia –still a challenge to us all” শিরোনামে। ফলোআপ রিপোর্টটির শিরোনামে বোঝা যায়, অন্তত রানিমেইড ট্রাস্ট মনে করছে, এই সমস্যাটি এখনো আমাদের সবার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ।

দেখা যাক, রানিমেইড ট্রাস্ট ইসলামোফোবিয়া বিষয়টিকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে এবং এর সাথে যুক্ত অর্থবহতার সমস্যাকে কিভাবে উল্লেখ করেছে। সেখানে রয়েছে-

The term Islamophobia refers to unfounded hostility towards Islam. It refers also to the practical consequences of such hostility in unfair discrimination against Muslim individuals and communities, and to the exclusion of Muslims from the mainstream political and social affairs.

অনুবাদ : ইসলামোফোবিয়া শব্দটি ইসলামের প্রতি অদৃশ্যমান শত্রুতা বা শত্রুভাবাপন্নতাকে নির্দেশ করে। এটা আরো নির্দেশ করে এ ধরনের শত্রুভাবাপন্নতার কারণে মুসলমান ব্যক্তি ও সম্প্রদায় অন্যায্য বৈষম্যের স্বীকার হয় এবং তাতে যদি মুসলমান নাগরিকদের মূলধারার রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকা- থেকে ভিন্ন করে দেয়া হয়।

ওপরে উল্লিখিত এই সংজ্ঞাটিকে আরো সম্প্রসারিত করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় রিপোর্টটিতে। যেখানে এই সংজ্ঞা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে এভাবে-

The original Islamophobia report states that the term refers to three phenomena

Unfounded hostility towards Islam;

Practical consequences of such hostility in unfair discrimination against Muslim individuals and communities;

Exclusion of Muslims from mainstream political and social affairsÓ

We mainly agree with this broad definition. In our view, the focus should be on the second and third phenomena.

আসলে ইসলামোফোবিয়া রিপোর্ট এ শব্দটি সম্পর্কে যে বিষয়টি উল্লেখ করেছে তা হলো, ইসলামের প্রতি অদৃশ্যমান বিদ্বেষ এবং এই বিদ্বেষ থেকে বাস্তবজীবনে মুসলমান ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের মানুষ অন্যায় বৈষম্যের স্বীকার হওয়া। বিষয়টি খুব পরিস্কার। ইসলাম বা মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ আচরণের ফলে যদি মুসলিম ব্যক্তি বা সম্প্রদায়কে বৈষম্যের স্বীকার হতে হয়, মূলধারার রাজনীতি ও সামাজিক সংগঠনগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়, সেটাই ইসলামোফোবিয়া।

পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামোফোবিয়া ইন্ডাস্ট্রি

কাউন্সিল অন আমেরিকান ইসলামিক রিলেশন্স ‘CAIR’ (Council on American-Islamic Relations) এবং ইউনিভার্সিটি অফ কালির্ফোনিয়া বার্কলে’এর (Center for Race and Gender at UC Berkeley) এক যৌথ গবেষণার সূত্র ধরে আলজাজিরা এক বোমা ফাটানো প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। গবেষণায় উঠে এসেছে, ইসলামকে ভীতিকর হিসাবে প্রচার করে ‘ঘৃণা’ ছড়ানো বা ‘ইসলামোফোবিয়া’ এখন একটি লাভজনক ব্যবসার নাম।

২০০৮-২০১৩ সময়কালে ২ শত মিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ আমেরিকাতে ব্যয় করা হয়েছে শুধু মুসলমাদের সম্পর্কে ঘৃণা ও ভীতি ছড়াতে। এই গবেষণায় ৭৪টি বিভিন্ন গ্রুপকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যারা অর্থের বিনিময়ে ‘ইসলামোফোবিয়া’ ছড়িয়েছে। ইসলামোফোবিক এই গ্রুপগুলোর মধ্যে রয়েছে নারীবাদী, খ্রিস্টান, জায়োনিস্ট ও প্রভাবশালী বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম।

ইসলামোফোবিয়াকে সুবিশাল এক ব্যবসা হিসেবে উল্লেখ করে ঈঅওজ-এর একজন মুখপাত্র উইলফ্রেডো রুইজ বলেন, অনেক মানুষ আছে যারা ইসলামোফোবিয়া ছড়িয়ে প্রতি বছর মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কামাই করছে। এই মানুষ গুলো প্রায়ই নিজেদের ইসলাম বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে জাহির করেন, আসলে তারা তা নন।

Confronting Fear শীর্ষক এ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সাল অবধি দেশটিতে আইন বা আইনের সংশোধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, যেখানে ৮১টি ছিল ইসলাম ধর্মাচরণকে কটাক্ষ করে প্রণীত এবং ৮০টি রিপাবলিকানদের দ্বারা প্রণীত হয়েছিল।

এই বিষয়ে আলজাজিরার অনুসন্ধানী ও বেশ তথ্যসমৃদ্ধ ডকুমেন্টারি দেখতে পারেন নিচের লিঙ্ক থেকে। https:/ww/w.aljayeera.com/programmes/aljayeeraworld/2017/05/islamophobia-usa-170501131435789.html

এবং এই লিঙ্কে দেখুন :
https:/ww/w.youtube.com/watch?v=-G9G79oImG4

এখানে ইসলামোফোবিয়া ইন্ডাস্ট্রির তত্ত্ব, সংগঠক, সংগঠন, প্রচারক ও প্রমোটারদের তুলে ধরা হয়েছে ।

আরো দেখুন : https://ing.org/islamophobia-and-its-impact/

সম্প্রতি শান্তির দেশ হিসেবে খ্যাত নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে অবস্থিত আন-নূর ও লিনঊড মসজিদদ্বয়ে গত ১৫ মার্চ জুমাবার নামাজরত মুসল্লিদের ওপর যে খ্রিস্টান জঙ্গিদের হামলা হয়েছে, তা স্মরণকালের ভয়াবহতম সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা। এ ঘটনায় হতবাক গোটা পৃথিবী। শোকে মুহ্যমান মুসলিমবিশ্ব। হামলায় ৪ বাংলাদেশিসহ ৫০ জন মুসল্লি নিহত হয়েছেন।

নিউজিল্যান্ডে বসবাসরত মুসলমানরা এমন ভয়াবহ ঘটনার সঙ্গে আগে থেকে পরিচিত নয়। ঘটনার আকস্মিকতায় তারা নির্বাক। টিভি চ্যানেল ঞঠঘত-কে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে ইসলামিক এসোসিয়েশন অব নিউজিল্যান্ড-এর সভাপতি মোস্তফা ফারুক বলেন,
We feel that we are living in the safest country in the world. We never

expected aûthing like this could happen. Muslims have been living in New Zealand (for) over 100 years and nothing has ever happened to us like this, so this is not going to change the way we feel about New Zealand.

‘আমাদের উপলব্ধি ছিল, আমরা বিশ্বের নিরাপদতম দেশে বসবাস করছি। কিন্তু এই দেশে এমন একটি ঘটনা ঘটবে, তা আমরা কখনো আশা করিনি। এক’শ বছরের অধিক সময় ধরে এ দেশে মুসলমানরা বসবাস করে আসছে। এ ধরনের ঘটনা আর কখনো ঘটেনি। তবে নিউজিল্যান্ড সম্পর্কে আমরা যে ধারণা পোষণ করি, তাতে এ ঘটনা কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে না।’

কিন্তু ইউরোপের বিগত ১০ বছরে ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। ইউরোপের প্রায় সব দেশেই মুসলমানরা আক্রান্ত হয়েছে। অন্যায়ভাবে মুসলমানদের ওপর ‘জঙ্গি’ তকমা লাগানো হয়েছে। যদিও গোটা বিশ্বের বেশির ভাগ সন্ত্রাসী কর্মকা- সংঘটিত হয়েছে অমুসলিমদের দ্বারা। এফবিআই-এর পুরনো নথি থেকে রেব করে একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে রয়েছে, ১৯৮০-২০০৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ঘটা মাত্র ৬ শতাংশ সন্ত্রাসী ঘটনায় মুসলিম সন্ত্রাসীরা জড়িত ছিল। যুদ্ধাক্রান্ত সিরিয়াকে বাদ দিলে ২০১৬-১৭ সালেও বিশ্বের মোট সন্ত্রাসী ঘটনার বেশির ভাগই ঘটেছে অমুসলিমদের দ্বারা (গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্স, ২০১৮)। কিন্তু তা সত্ত্বেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার থেমে নেই। মুসলমানদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নেই।

মূলত সমস্যা অন্যত্র। সেটা হলো ইসলামোফোবিয়া বা ইসলামভীতি। ইউরোপ ও আমেরিকার দেশসমূহে যে হারে ইসলামের প্রসার-প্রচার ঘটছে, তাতে তারা রীতিমতো আতঙ্কিত। বলা যায়, ইসলামোফোবিয়া বা ইসলামভীতি পশ্চিমা বিশ্বকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।

লেখক, সাংবাদিক ও সাব এডিটর; দৈনিক কালের কণ্ঠ

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *