মাওলানা ইসমাঈল মাহমূদ
আল্লাহ তা‘আলার অসংখ্য সৃষ্টির মাঝে মানবজাতি আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা। তিনিই সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। আল্লাহ তা‘আলার এ সৃষ্টি জগত বড় ব্যাপক ও বিস্তৃত। তার সদস্য সংখ্যা অসংখ্য অগণিত। মহান স্রষ্টা তাঁর কুদরতী হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় নানা বর্ণে ও বৈচিত্রে সাজিয়েছেন এ সৃষ্টি জগতকে। এ জগতের প্রতি তাঁর দয়া-মায়া ও করুণা-অনুগ্রহের অন্ত নেই। বিস্ময়কর তাঁর এ সকল সৃষ্টির রহস্য। কিন্তু এগুলোর মধ্যে কিছু সৃষ্টি আমাদের কাছে অনেক সময় অস্বাভাবিক মনে হয়।
অনেকে অজ্ঞতাবশত এর দোষটা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাকে দেয়; অথচ তিনি পূত পবিত্র, মহান ও সর্ব প্রকার দোষমুক্ত। আবার অনেকে সেই সৃষ্টিকেই দোষারোপ করতে থাকে। এর পিছনে আল্লাহ তা‘আলার হেকমত, উদ্দেশ্য ও রহস্য নিগূঢ়-দুর্জ্ঞেয় ও একান্ত গুপ্ত। যা একমাত্র তিনিই জানেন। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন,
لِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ
অর্থ : নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের রাজত্ব তাঁরই, তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। (‘সূরা শূরা’- ৪৯)
অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন,
هُوَ الَّذِي يُصَوِّرُكُمْ فِي الْأَرْحَامِ كَيْفَ يَشَاءُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
অর্থ : তিনিই মহান সত্তা; মাতৃগর্ভে যেভাবে ইচ্ছা তোমাদের আকৃতি গঠন করেন। তিনি প্রবল পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (‘সূরা আলে ইমরান’- ৬)
তিনি মানবজাতির কাউকে পুরুষ, কাউকে নারী, আবার তাঁর কুদরতের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ কাউকে বানিয়েছেন একটু ভিন্ন করে, যেন বান্দা তাঁর একচ্ছত্র ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারে যে তিনি সব বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তিনি যেমন স্বাভাবিক সুন্দর সৃষ্টি করতে সক্ষম, তেমনি এর ব্যতিক্রম সৃষ্টি করতেও সক্ষম। আর এমনই এক বৈচিত্রময় সৃষ্টি লিঙ্গ প্রতিবন্ধী বা হিজড়া। এরা পূর্ণাঙ্গদের ন্যায় সমান মর্যাদার অধিকারী মানব। ইসলামের দৃষ্টিতে হিজড়া, বিকলাঙ্গ বা পূর্ণাঙ্গ হওয়া মর্যাদার মাপকাঠি নয়। বরং তাকওয়াই হলো মান-মর্যাদা আর শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি। মহান আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেন,
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ
অর্থ : নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলার নিকট সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত ও মর্যাদাবান, যে সর্বাধিক আল্লাহভীরু-মুত্তাকী আর পরহেজগার। অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলা সর্বজ্ঞ সব কিছুর খবর রাখেন। (‘সূরা হুজরাত’- ১৩)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
إن الله لا ينظر إلى صوركم وأموالكم ولكن ينظر إلى قلوبكم وأعمالكم
অর্থ : আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের বাহ্যিক আকার-আকৃতি এবং সহায়-সম্পত্তির প্রতি লক্ষ্য করেন না। বরং তিনি লক্ষ্য করেন তোমাদের অন্তর এবং আমলের প্রতি। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ৬৭০৮)
অতএব ইসলামী মূল্যবোধ এবং সুমহান আদর্শের আলোকে এটাই প্রমাণিত হয়, লিঙ্গ প্রতিবন্ধীদের এ পরিমাণ সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে, যে পরিমাণ সম্মাান ও মর্যাদা রয়েছে একজন সুস্থ-সবল সাধারণ মুসলিমের। এমনকি ইসলামী শরীয়তে একজন মুমিন-মুত্তাক্বী, পরহেজগার হিজড়া; শত-সহস্র কাফের-ফাসেক ও মুত্তাকী নয় এমন নর-নারী থেকে উত্তম।
হিজড়ার পরিচয়
হিজড়া হচ্ছে বিশেষ লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন মানুষ, যার লৈঙ্গিক গঠন অনুপযোগী, বিকলাঙ্গ অথবা উভয়লিঙ্গ বা খোঁজা পুরুষ, যারা না পুরুষ না নারী। যদিও এদের চলা ফেরা, আচার-আচরণ অনেকটা নারীসুলভ। শরিয়তের পরিভাষায় হিজড়া বলা হয় যার পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ উভয়টি রয়েছে। অথবা কোনটিই নেই, শুধু প্রশ্রাবের জন্য একটিমাত্র ছিদ্রপথ রয়েছে। সংক্ষেপে একই দেহে স্ত্রী এবং পুংচিহ্ন যুক্ত অথবা উভয় চিহ্নবিযুক্ত মানুষই হলো লিঙ্গ প্রতিবন্ধী বা হিজড়া। (কামূসুল ফিকহ ৩/৩৭৭)
সমার্থবোধক শব্দ
শিখন্ডী, বৃহন্নলা, তৃতীয় লিঙ্গ, উভলিঙ্গ, নপুংশক।
পারিভাষিক শব্দ
আরবী ভাষায় খুন্সা, ইংরেজিতে Transgender (ট্রান্সজেন্ডার) Hermaphrodite (হার্মফ্রোডাইট), হিব্রু ভাষায় Eunuch (ইউনাক)।
হিজড়ার শ্রেণী বিন্যাস
(১) পুরুষ শ্রেণী (২) নারী শ্রেণী (৩) তৃতীয় শ্রেণী।
যে সকল হিজড়ার মাঝে দাড়ি গোঁফ গজানো, নারী সহবাসে সক্ষমতা এবং স্বপ্নদোষ জাতীয় নরচিহ্ন প্রকাশিত হয় তারা পুরুষ শ্রেণীভুক্ত হিজড়া।
# যে সকল হিজড়ার মাঝে স্তন, ঋতুস্রাব, সহবাসের উপযোগিতা, গর্ভ সঞ্চার হওয়া ইত্যকার নারীচিহ্ন প্রকাশিত হয় তারা নারী শ্রেণীভুক্ত হিজড়া।
# যে সকল হিজড়ার মাঝে নারী-পুরুষের কোন নিদর্শনই পরিলক্ষিত হয় না অথবা উভয় ধরণের নিদর্শনই সমানভাবে পরিলক্ষিত হয় তারা তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত হিজড়া। শরীয়তের পরিভাষায় তাদেরকে ‘খুনসায়ে মুশকিলা’ তথা জটিল হিজড়া বা প্রকৃত হিজড়া নামে অভিহিত করা হয়।
বৈজ্ঞানিক এবং মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে এদেরকে সাধারণত হার্মফ্রোডাইট বা ইন্টারসেক্স হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সোজা বাংলায় উভয়লিঙ্গ। এদের আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়। প্রকৃত উভলিঙ্গত্ব (True-Hermaphrodite) এবং অপ্রকৃত উভলিঙ্গত্ব (Pseudo-Hermaphrodite)। তবে বাস্তবে প্রকৃত হিজড়ার সংখ্যা খুবই কম। আর শারীরিকভাবে পুরুষ কিন্তু মানসিকভাবে নারী বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হিজড়াদের বলা হয় অকুয়া, অন্য হিজড়াদের বলা হয় জেনানা, এবং পুরুষের হাতে সৃষ্ট বা ক্যাস্ট্রেড পুরুষদের বলা হয় চিন্নি।
শিশু হিজড়ার শ্রেণী বিন্যাস
শিশু হিজড়া যদি পুংলিঙ্গ দিয়ে প্রস্রাব করে তাহলে সে পুরুষ শ্রেণী ভুক্ত, আর যদি স্ত্রীলিঙ্গ দিয়ে প্রস্রাব করে তাহলে সে নারী শ্রেণীভুক্ত বলে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে উভয়লিঙ্গ দিয়ে প্রস্রাব করলে যে লিঙ্গ দিয়ে প্রস্রাব আগে বের হবে সেই শ্রেণীভ্ক্তু বলে গণ্য হবে। তবে উভয় লিঙ্গ দিয়ে যদি সমানভাবে একই সময় প্রস্রাব করে, অথবা কোন লিঙ্গই না থাকে শুধুমাত্র ছিদ্রপথ থাকে, তাহলে তৃতীয় শ্রেণীর হিজড়া বলে বিবেচিত হবে। (সুনানে বাইহাকী কুবরা; হা.নং ১২২৯৪)
হিজড়া জন্মের রহস্য
কোনো পুরুষ বা নারী নিজ ইচ্ছায় নারী-পুরুষ হয়নি। তেমনি হিজড়া হওয়ার পেছনেও তাদের নিজ ইচ্ছার কোনো ভূমিকা নেই। এটা শুধুমাত্র আল্লাহ তা‘আলার কুদরতের বহিঃপ্রকাশ। তিনি নিজ ইচ্ছায় যাকে চেয়েছেন পুরুষ বানিয়েছেন যাকে চেয়েছেন নারী বানিয়েছেন, এবং যাকে ইচ্ছা বানিয়েছেন উভলিঙ্গ বা হিজড়া। পবিত্র কুরআনের আলোকে বুঝা যায় এর পিছনে আল্লাহ তা‘আলার মহান হেকমত ও নিগূঢ় রহস্য বিরাজমান। তবে বাহ্যিকভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ সার্বিক দিক পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ করে কিছু কারণ বর্ণনা করে থাকেন। বিশেষজ্ঞদের মতে শিশুটি হিজড়া হতে পারে দুই কারণে-
১. মানসিক কারণ, ২. জন্মগত ত্রুটি।
জন্ম নেয়ার পর একটি নির্দিষ্ট বয়সে পুরুষ বা নারীতে পরিণত হতে যেসব হরমোন স্বভাবিক মাত্রায় থাকা প্রয়োজন, সেসব হরমোনের তারতম্যের কারণেই নারী-পুরুষের বাইরে আরেকটি লিঙ্গের সৃষ্টি হয় বলে প্রচলিত ব্যাখ্যায় বলা হয়। বিশেষজ্ঞরা কারণ দুটিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন-
(১) মানসিক সমস্যা থেকে শিশুটি হিজড়া হতে পারে। যেমন, শিশু বয়সে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া বা কোন ট্রমা থেকেও সে নিজেকে অপর লিঙ্গের মত ভাবতে থাকে। এমনটিই বলেন ঢাবির ক্লিনিক্যাল সাইক্লোজির শিক্ষক ডা. শাহানুর হোসেন (যিনি দীর্ঘদিন ধরে হিজড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করছেন)।
(২) এ ধরণের জন্মগত ত্রুটি নিয়েই পৃথিবীতে আসে যে শিশু; তার সম্পর্কে ডা. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, হিজড়া এক ধরণের জেনেটিক সমস্যা। গর্ভাবস্থার প্রথম দিকেই একটি ভ্রূণের শরীরে এক ধরনের ডিফেক্ট জিনের আবির্ভাব ঘটে। তখন থেকেই ঐ ভ্রূণটি হিজড়া হতে শুরু করে। এই ত্রুটিযুক্ত জিন শরীরের ভেতর অস্বাভাবিক পরিমাণ এন্ড্রোজেন হরমোন তৈরী করে। এন্ড্রোজেন হরমোনের মধ্যে রয়েছে টেস্টোস্ট্রেরন হরমোন পুরুষ-বৈশিষ্ট্য এবং হিস্ট্রোজেন হরমোন মেয়ে-বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তোলে। এ সমস্ত ভ্রূণের দেহে উপরিউক্ত হরমোন দু’টির অসামঞ্জস্যতা দেখা দিলেই ভ্রূণটি ছেলে বা মেয়ে কোনও বৈশিষ্ট্য আলাদাভাবে ধরে রাখতে পারে না। বরং একজনের ভেতরেই ছেলের কিছু বৈশিষ্ট্য ও মেয়ের কিছু বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। (দৈনিক যুগান্তর ২১/১২/০১২ইং)
জীববিদ ও চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতানুসারে ক্রোমোজোম ও বারবডির ত্রুটি এবং হরমোন ও এনজাইমের ত্রুটির কারণে একজন মানুষ হিজড়া হয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে। স্বাভাবিক ক্ষেত্রে মানুষের দেহকোষের ক্রোমোজোমের সংখ্যা ৪৬ অথাৎ ২৩ জোড়া। এক জোড়া যৌন ক্রোমোজোম আর বাকি ২২ জোড়া অটোজম। অটোজম নির্ধারণ করে একটা মানুষ বেঁটে হবে না লম্বা হবে, শান্ত হবে না বদমেজাজী হবে ইত্যাদি। আর সেক্স ক্রোমোজোম নির্ধারণ করে মানুষটি পুরুষ হবে না মহিলা হবে। যৌন ক্রোমোজোম দুটিকে x ও y দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। স্ত্রী দেহকোষে দুটি x ক্রোমোজোম থাকে, একে হোমোজেনিক ক্রোমোজোম বলে। অন্যদিকে পুরুষ দেহকোষে একটি x ও y ক্রোমোজোম থাকে। একে হেটারোজেনিক ক্রোমোজোম বলে।
প্রতিটি কন্যা সন্তান পিতা-মাতার কাছ থেকে ২২ জোড়া অ-যৌন ক্রোমোজোম এর সাথে মায়ের কাছ থেকে একটি x ক্রোমোজোম এবং বাবার কাছ থেকে একটি x ক্রোমোজোম লাভ করে। কিন্তু পুত্র সন্তানটি ২২ জোড়া অ-যৌন ক্রোমোজোমের সাথে মায়ের কাছ থেকে একটি x ক্রোমোজোম এবং বাবার কাছ থেকে একটি y ক্রোমোজোম লাভ করে। এ ডিম্বানু বা শুক্রাণু (xx) প্যাটার্নে কন্যা শিশু আর (xy) প্যাটার্নে পুত্র শিশুর জন্মগ্রহণ করে। জরায়ূতে ভ্রূণের বিকাশ হওয়ার সময় মায়েদের বিভিন্ন প্রকার শারীরিক ও মানসিক সমস্যারও সৃষ্টি হয়ে থাকে। এরপর জেনেটিক পরিবর্তনের কারণে ভ্রূণটি হিজড়ায় রূপান্তরিত হয়। অনেক সময় যৌন ক্রোমোজোমের ত্রুটির ফলে সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ করা দুরূহ হয়ে পড়ে। সে এসে পড়ে তৃতীয় সেক্সের দলে; আমরা যাদের হিজড়া বলি। ভ্রূণের পূর্ণতার স্তরগুলোতে ক্রোমোজোম প্যাটার্নের প্রভাবে ছেলে শিশুর মধ্যে অ-কোষ আর মেয়ে শিশুর মধ্যে ডিম্বকোষ জন্ম নেয়। অ-কোষ থেকে নিসৃত হয় পুরুষ হরমোন এন্ড্রোজেন এবং ডিম্বকোষ থেকে নিসৃত হয় এস্ট্রোজেন। ভ্রূণের বিকাশকালে নিষিক্তকরণ ও বিভাজনের ফলে বেশ কিছু অস্বাভাবিক প্যাটার্নের সৃষ্টি হয়। যেমন- (ক) xxy (খ) xyy (গ) ক্লাইনেফেলটার সিনড্রোম, (ঘ) টার্নার সিনড্রোম, ইত্যাদি। এর ফলে বিভিন্ন গঠনের হিজড়া শিশুর জন্ম হয়। (সামাজিক বিজ্ঞান পত্রিকা; ডিসেম্বর ২০১২)
স্বীকৃতি ও পরিসংখ্যান
এ প্রসঙ্গে দৈনিক প্রথম আলোর একটি সংখ্যায় ছাপা হয়েছে,
বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ হিজড়া। হিজড়াদের দেয়া তথ্যমতে বাংলাদেশে এদের সংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষ। শুধু ঢাকাতেই বসবাস করে পনের হাজার হিজড়া। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায় হিজড়াদের নিয়ে সরকারের কোনও কার্যক্রম নেই। তবে সরকার অপরাপর জনগোষ্ঠীর তথ্য সংরক্ষণ করেন। ২০১১ সালের আদমশুমারীর রিপোর্টে দেখানো হয়েছে যে, বাংলাদেশে ২৭ টি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী রয়েছে। তাদের মোট সংখ্যা ১৫,৮৬,১৪১ (পনের লক্ষ ছিয়াশি হাজার একশত একচল্লিশ)। এবং প্রতিবন্ধী জনসংখ্যা ২০,১৬,৬১২ (বিশ লক্ষ ষোল হাজার ছয়শত বার) যা মোট জন সংখ্যার ১.৪ ভাগ। (দৈনিক প্রথম আলো; ৩১ আগস্ট ২০১৩)
দৈনিক যুগান্তরে এ বিষয়ে রিপোর্ট করা হয়েছে,
সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের নিকট হাজারের নিচে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর হিসাব যেমন আছে, তেমিন আছে প্রতিবন্ধীদেরও আলাদা আলাদা হিসাব। তবে হিজড়াদের কোনো পরিসংখ্যান সরকারের কোনো বিভাগ সংরক্ষণ করে না। ২০০৮ সনে লিঙ্গ নির্ধারণ না করেই প্রথমবারের মত হিজড়ারা ভোটাধিকার পায়। তবে ভোটার আইডি কার্ডে জেন্ডার নির্ধারণ না থাকায় সেখানেও তাদের বিড়ম্বনার অন্ত ছিল না। জাতীয় আদমশুমারি- ২০১১ এর মধ্যেও গণ্য করা হয়নি হিজড়াদের, এমন অভিযোগ করেছে এএফপিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ‘বাঁধন হিজড়া সংঘ’। বাংলাদেশে নারীর তুলনায় পুরুষের সংখ্যা বেশি হওয়ায় আদমশুমারিতে এদের অধিকাংশকেই দেখানো হয় ‘পুরুষ’ হিসেবে। ফলে এদের নিয়ে প্রায় সর্বক্ষেত্রেই পড়তে হয় বেশ বিড়ম্বনায়। কারণ এদেরকে টিক চিহ্ন দিতে হয় ‘পুরুষ’ কিংবা ‘নারী’র ঘরে। দীর্ঘ দিন ধরে বিভিন্ন সংগঠন এই স্বীকৃতির দাবিটিই জানিয়ে আসছিল।
পরিশেষে গত ১১ নভেম্বর ২০১৩ইং সন সোমবার বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী পরিষদে উত্থাপিত হিজড়াদের নারী-পুরুষের পাশাপাশি আলাদা লিঙ্গ বা তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতির বিলটি পাশ হয়েছে। স্বীকৃতি পরবর্তী নির্দেশ জারি করা হয় যে সার্টিফিকেট, ভিসা, বীমা, ব্যাংক সর্ব ক্ষেত্রে লিঙ্গ নির্ণয়ে তৃতীয় লিঙ্গের অপশন রাখতে হবে এবং তাদের পরিচয়ে হিজড়া (Hijra)-ই লিখতে হবে; অন্য শব্দ নয়। এ স্বীকৃতি হিজড়াদের জন্য সুখের। কিন্তু সুপারিশমালায় পরিসংখ্যানে জানানো হয়েছে দশ হাজার (১০,০০০)। হিজড়াদের সংগঠন ‘বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’ সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে হিজড়া সংখ্যা ১০-১৫ হাজার। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার দাবি, সারা দেশে পঞ্চাশ হাজার হিজড়া রয়েছে। ডেমোগ্রাফি সূত্র অনুযায়ী শুধু ঢাকার মধ্যে হিজড়ার সংখ্যা পঁচিশ হাজারেরও বেশি। (দৈনিক যুগান্তর ২১/১২/০১২ ইং)
হিজড়া সম্প্রদায়ের সামাজিক রীতি-নীতি
যুগ যুগ ধরে অবহেলা, অবজ্ঞা, ঘৃণা, টিটকারী আর টিপ্পনি খেয়ে এই ছোট জনগোষ্ঠীটি সমাজে বেঁচে আছে। এদের প্রতি সমাজ বা রাষ্ট্রের কোনো সুদৃষ্টি নেই। নেই কোনো অর্থ বরাদ্দ। অন্যের কাছে হাত পেতে টাকা চেয়ে কিংবা চাঁদাবাজি করে নিজেদের খাবার জোগাড় করে। পরিবার ও সমাজের হেলাফেলায় এরা দলবদ্ধভাবে বসবাস করে। এদের বেশির ভাগই কোনো না কোনো মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে। কিন্তু মুসলিম পরিবারের এ সন্তানরা যখন আপনজনদের নিকট অবহেলা ও অভিশাপের পাত্র হয়, সমাজে কোথাও এদের ঠাই মেলে না, এমনকি সমাজের ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গ; আলেম-উলামা, মসজিদের ইমাম-খতিব, মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক কেউ তাদের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয় না বা মুখ খোলে না, তখন পরিবারের এই শিশুটির আশ্রয় কেবল হিজড়াদের কোনো না কোনো দলেই হয়ে থাকে। প্রতিটি মানুষের জীবনে পিতা-মাতার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এই হিজড়াদের কিন্তু পিতা-মাতা থেকেও নেই; যে কারণে ওদের একজন গুরু-মায়ের প্রয়োজন পড়ে। হিজড়াদের গুরু ওদের পিতার মত এবং গুরুকেই নিজেদের অভিভাবক এবং ধর্মাবতার মনে করে। গুরুর বিশ্বাসই তাদের ধর্ম।
নিজেদের সমাজে এরা নিজস্ব সমাজের আইন মেনে চলে। ওদের এলাকাভিত্তিক একজন গুরু মা-ই যেন ওদের পিতা-মাতা, অভিভাবক; সবকিছু। যত রোজগার সব জমা হয় ওই গুরু মায়ের কাছে। গুরু মা তার ইচ্ছামত সবার মাঝে বণ্টন করে। উপার্জিত অর্থের অর্ধেকই যায় গুরুদের পকেটে। বিনিময়ে গুরুদের কাছ থেকে তারা স্বাস্থ্য সুবিধা, অবসরকালীন ভাতা ও পতিতাবৃত্তির অভিযোগে বা নানা কারণে পুলিশী গ্রেফতার থেকে উদ্ধার বা রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করে এই গুরুরা। হিজড়া জগতটা আধিপত্য পরম্পরার ভিত্তিতে চলে এবং গুরুদের মধ্যে কর্তৃত্ব নিয়ে লড়াইও হয়। এদের কর্মকা- ন্যায়-অন্যায়ের বাঁধাধরা নিয়ম মেনে চলে না এবং এটা একটা ‘গ্রে মার্কেট ইকোনমি’র মতো কাজ করে।
এ প্রসঙ্গে দৈনিক সমকালে ছাপা হয়েছে,
মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী এই ভাগ্যবিড়ম্বিত সন্তানের ধর্ম আর যাই হোক ইসলাম যে নয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তারা অনেক হিন্দু রীতি-নীতিতে বিশ্বাস করে। তাই; যদিও তাদের কবর দেয়া হয় তবে তা একটু ভিন্ন প্রক্রিয়ায়। প্রত্যেক হিজড়াকে কবর দেয়া হয় তারা যে বিছানায় থাকে তার নিচে। তবে বর্তমানে স্থান সংকুলানের কারণে অন্যত্রও কবর দেয়া হয়। কিন্তু কবর দেয়ার বিষয়টি খুবই বিষ্ময়কর। কবরে প্রথম লবন ঢালা হয় তারপর লাশ। তারপর দেয়া হয় ফুল এরপর লবন। পরে তারা একটা অদ্ভুত কা- করে; কবর দেয়ার পূর্বে সবাই মিলে লাশটি জুতা পেটা করে। এদের বিশ্বাস- এমন করা হলে সে আর কখনও হিজড়া হয়ে জন্ম নেবে না এবং তার সকল পাপ ধুয়ে-মুছে পরবর্তী জনমে সে পূর্ণ নারী বা পুরুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারবে। (দৈনিক সমকাল ২০/৩/০১৫ইং, wordpress.com/০৩/০৬/২০১৩)
জীবন ও জীবিকা নির্বাহ
হিজড়া সম্প্রদায় পুরুষ বা নারী কোনোটি না হলেও সাধারণত এরা মেয়েদের মত থাকতে এবং মেয়েদের পোষাক পরতে ও মেয়েদের ঢঙে বোলচাল করতে অধিক স্বাচ্ছন্দবোধ করে। এই জায়গাটায় এসে সে সমাজের সামনে উপস্থাপিত হয় ভিন্নরূপে। সমাজ তাকে দেখে অন্য চোখে। ফলে সে আর স্বাভাবিক অন্যদের সাথে মিশতে পারে না। লেখা পড়াতেও এগুতে পারে না বেশী দূর। সূত্রমতে, সর্বোচ্চ এইট পাশ পর্যন্ত পাওয়া যায়। সাধারণত ওরা প্রাইমারির গণ্ডিই অতিক্রম করতে পারে না। সমাজে এরা যেমন বিচিত্র অংশ, এদের জীবিকা নির্বাহও তেমন বিচিত্র ও বিভিন্ন। নিজেদের জন্য তারা বেছে নিয়েছে এমন এক জীবন যার সাথে দেহজ চাহিদার বাইরে চিত্তবৃত্তি ও মননশীলতার বিশেষ কোন সম্পর্ক নেই। গড়ে নিয়েছে এমন এক জগত, গ্রাসাচ্ছাদনই যার শেষকথা। ব্যস, এর জন্য বৃহত্তর সমাজ থেকে আলাদা হয়ে তারা নিজেদের জন্য তৈরি করে নিয়েছে স্বতন্ত্র নিবাস, স্বতন্ত্র বেশভূষা ও স্বতন্ত্র পেশা। এভাবে যেন এক দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর দ্বারা তারা নিজেদের ঘিরে নিয়েছে। যাতে এক অর্থ ছাড়া শিক্ষা-দীক্ষা, চিন্তা-চেতনা, সভ্যতা-সংস্কৃতি তথা সমষ্টির সাথে মিশে যাওয়ার আরও যত উপাদান-উপকরণ আছে, তার কিছুই তাদেরকে স্পর্শ করতে না পারে।
২০ শে মার্চ ২০১৫ইং সংখ্যার দৈনিক সমকালে প্রকাশিত হয়েছে যে,
তাদের মধ্যে যারা প্রথাগত জীবনযাপন করতে পছন্দ করে তারা বিভিন্ন উৎসব ও অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে অর্থ উপার্জন করে। অবশ্য এরা আবার রাস্তায় দল পাকিয়ে শোরগোল করতেও ছাড়ে না। চিৎকার-চেঁচামেচি আর হৈচৈ তো এরা করেই থাকে। কেউ দল বেঁধে ভিক্ষা করে, কেউ বিভিন্ন উপলক্ষ্যে চাঁদা তুলে বা কোন বাড়ির নবজাতককে ঘিরে নেচে-গেয়ে আবদার করে বা জোর করে টাকা আদায় করে জীবিকা নির্বাহ করে। কোনো লোক বা দোকানদার তাদের অর্থ না দিলে তাদেরকে শাপ-শাপান্ত করতে থাকে। যতক্ষণ টাকা দিয়ে বিদায় না করবে ততক্ষণ এটা চলতেই থাকে। কেউবা বাজার থেকে ‘তোলা’ তুলেও বাঁচে। অনেকে বিকৃত রুচির অন্ধতম গলি পতিতাবৃত্তির পথেও হাঁটে। নির্দিষ্ট একটা বয়সে এসে যখন প্রচলিত সমাজে নিজেকে খাপ খাইয়ে চলতে পারে না, পিতা-মাতা, ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজনদের অবহেলা ও তাচ্ছিল্যের পাত্র হয়। মানুষ গড়ার কারখানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপহাসের পাত্র হয়, তখন সে পরিবার, আপনজন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ সব জায়গায় অবহেলা আর অবজ্ঞার স্বীকার হয়। নিঃসঙ্গতা ও মানসিক যন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য তখন সে নিজ পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হিজড়াদের নিকটই আশ্রয় গ্রহণ করে। অথবা হিজড়ারা কোন হিজড়া শিশুর সংবাদ জানতে পারলে শিশুটিকে নিজেদের দলভুক্ত করে নেয়। আর একবার ঘরছাড়া হয়ে গেলে হিজড়া সমাজ ত্যাগ করে কোন দিন ঘরমুখো হওয়া সম্ভব হয় না। (দৈনিক সমকাল ২০/৩/০১৫ইং)
শিক্ষা-দীক্ষা
বর্তমান সরকারী হিসাব অনুসারে বাংলাদেশে শিক্ষার হার শতকরা ৫৬%। স্বাক্ষরতার হার আরো বেশী। জাতীয় শিক্ষার হারের সাথে তুলনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের হিজড়া সম্প্রদায় শিক্ষার ক্ষেত্রে খুবই পিছিয়ে। মাত্র ২৪% হিজড়া অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন, ১২% প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেছে, ২% মাধ্যমিক পাশ করেছে। তবে উচ্চ শিক্ষিত কোন হিজড়া পাওয়া যায়নি। (সামাজিক বিজ্ঞান পত্রিকা ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টাডিজ- পার্ট ডি’ ডিসেম্বর ২০১২ইং)
রূপান্তরকামিতা (Transsexualism) একটি বিকৃত চিত্র
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সমাজের একটি অংশ স্বেচ্ছায় কিংবা বাধ্য হয়ে হিজড়াবৃত্তির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এরা যখন দেখল হিজড়াবৃত্তিতে সহজে ভালো উপার্জন হয় তখন বেছে নিতে শুরু করল নকল হিজড়াবৃত্তির ঘৃণ্য এ পথ। এ অন্ধকার জগতের নিয়ন্ত্রক একদল কুচক্রী। যাদের চক্রান্তের ক্রীড়নক কতগুলো সুস্থ মানুষও। এরা সরল-সুস্থ শিশু-কিশোর অপহরণ করে হাসপাতাল-ক্লিনিকে নিয়ে শিক্ষিত ডিগ্রিধারী ডাক্তারের মাধ্যমে অস্ত্রোপচার করে পেনিস অপসারণ করে, ওষুধ খাইয়ে হিজড়া বানায়।
অনেকে নানা প্রলোভনে এমন করতে গিয়ে নির্মমভাবে ফেঁসে গেছে। পরিণামে জীবনের মধ্য দুপুরে পরাজিত-পর্যুদস্ত হয়ে বিতৃষ্ণার অতল সাগরে তলিয়ে যাচ্ছে। আর ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে অসামাজিক কর্মকা- হারে। এছাড়া জানা যায় ভারতে কিছু ক্লিনিক রয়েছে যেখানে পুরুষদের খোঁজা-পুরুষ বা ক্যাসট্রেড হিজড়ায় পরিণত করা হয়। তবে বর্তমান বাংলাদেশেও ভারত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার এই কাজ করছে যা ‘ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশন’-এর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। এক শ্রেণীর দরিদ্র পুরুষ এটা করে বেঁচে থাকার তাগিদে এবং বেশি আয় রোজগারের আশায়। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে এটি একটি মহা অন্যায়, নাজায়েয এবং হারাম কাজ। এমন কাজ আল্লাহ তা‘আলার নাফরমানি ও তাঁর সৃষ্টিকে বিকৃত সাধন করার শামীল। হযরত ইবনে আব্বস (রাযি.) হতে বর্ণিত,
لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمُتَشَبِّهِينَ مِنْ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ وَالْمُتَشَبِّهَاتِ مِنْ النِّسَاءِ بِالرِّجَالِ والمغيرات خلق الله.
অর্থ : রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ সকল পুরুষের উপর অভিশাপ ও লা’নত করেছেন যারা নারীদের সাদৃশ্য অবলম্বন করে এবং ঐ সকল নারীর উপরও লা’নত ও অভিশাপ করেছেন যারা পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বন করে এবং আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করে। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৩৮৮৫)
নারী-পুরুষ একে অপরের সাদৃশ্য অবলম্বনের ব্যাপারে ইসলামী শরীয়ার অবস্থান এমনই কঠোর। কাজেই অঙ্গহানি বা রূপান্তরকামীর বিষয়টি যে কতো জঘন্য এ থেকে অনুমেয়। অধিকন্তু আমাদের দেশীয় আইনেও কারো অঙ্গহানি করা পেনালকোড ৩২৬ ধারায় অপরাধ।
গত ১৭/৯/১২ ইং দৈনিক যুগান্তর-এর অনলাইন সংস্করণের একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, দেশের কোথায় কোথায় সভ্যমুখোশে সম্পন্ন হয় হিজড়া বানানোর এই অপকর্মটি। রিপোর্ট অনুযায়ী এ কাজে সরাসরি জড়িত রোম আমেরিকান হাসপাতাল, ধামরাই, রাজধানীর শ্যামলীর অনির্দিষ্ট ক্লিনিক, খুলনার ফুলতলার কয়েকটি ক্লিনিক। হরমোন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. হাফিজুর রহমান রলেন, …এর সঙ্গে যে দুষ্টচক্র জড়িত তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। রাষ্ট্রীয় কাঠামো দুর্বল হওয়ার কারণেই দুষ্টচক্রটি এ ধরণের ঘটনা ঘটাচ্ছে। রাষ্ট্রকে এর বিহিত করতে হবে। নইলে সমাজ অধঃপতনের দিকে ধাবিত হবে।
সুচিকিৎসায় লিঙ্গ প্রতিবন্ধী সুস্থ হয়
সামাজিক বিজ্ঞান পত্রিকায় এই আশা জাগানিয়া সুসংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে। আমরা সংবাদটি হুবহু তুলে ধরছি।
অনেকেরই জানা নেই যে, হিজড়া বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মানো কোন শিশুকে যদি পরিণত বয়স হওয়ার আগে চিকিৎসা করানো হয় তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাকে সুস্থ করা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ। দেশে বিদেশে এর প্রচুর দৃষ্টান্ত রয়েছে। এ প্রসঙ্গে গত ৩ মে ২০১৩ শুক্রবারে একটি জাতীয় দৈনিকে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে; ‘জন্মগত লৈঙ্গিক ত্রুটি নিয়ে জন্ম নেয়া শিশুদের সঠিক চিকিৎসা দিলে, আগামী পাঁচ বছরে দেশে ‘হিজড়া’ পরিচয়ে আর কাউকে জীবন যাপন করতে হবে না। চিকিৎসার ফলে জন্মগত ত্রুটি পুরোপুরি নিরাময় হয়ে সমাজের দশজন স্বাভাবিক মানুষের মত তারাও স্বভাবিক জীবন পাবে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকরা। লৈঙ্গিক ত্রুটি নিয়ে জন্ম নেয়া কয়েকশ’ শিশুকে গত ছয় বছর ধরে টেলিস্কোপের মধ্যমে লিঙ্গ শনাক্ত করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে সক্ষম হয়েছেন তারা। কাজেই লিঙ্গ প্রতিবন্ধীরা উপযুক্ত সময়ে যেন চিকিৎসা সহায়তা লাভ করতে পারে, সেজন্য সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্যকর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া সময়ের দাবী। Pathan, Dr Farukh (২০০৪) লিখিত গ্রন্থে দেখা যায়, যে কোনো হাসপাতালেই হিজড়াদের এন্ডোগাইনোকোলজি ও কসমিক এবং প্লাষ্টিক সার্জারির মাধ্যমে চিকিৎসা করা সম্ভব। এছাড়াও হরমোন ট্রিটমেন্টও প্রয়েগ যোগ্য। (সামাজিক বিজ্ঞান পত্রিকা ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টাডিজ- পার্ট-ডি’ ডিসেম্বর ২০১২)
বিভিন্ন ধর্মে হিজড়ার অবস্থান
ধর্ম মানুষের জন্য। ধর্ম মানে যুগে যুগে ভৌগলিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে যথাযোগ্য পরিবেশ পরিম-লে থেকে মানুষের জীবন চলার পথের কতিপয় বিধানাবলী, যা পালনে মানুষ শান্তিতে বাস করতে পারে।
ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইহকাল ও পরকালে সর্বাঙ্গীন কল্যাণ সাধনে যে বিধানের প্রভাব অনস্বীকার্য, তাই হলো ধর্ম। আর ধর্মীয় বিধানের আলোকে মানব জীবনের গতির বিকাশ ঘটে। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম লিঙ্গ প্রতিবন্ধী সম্পর্কে কি বলে দেখা যাক।
হিন্দু ধর্মে হিজড়া
দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে সাধারণত হিজড়া নামে অভিহিত করা হয়। হিন্দু দর্শনে তৃতীয় লিঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রে এই ধরনের মানুষকে আলাদাভাবে পুরুষ বা নারী হিসেবে বিবেচনা করা হতো না। তাদেরকে জন্ম সূত্রে তৃতীয় প্রকৃতি হিসেবে গণ্য করা হতো। তাদের কাছ সাধারণ নারী-পুরুষের মতো ব্যবহার প্রত্যাশা করা হতো না।
আরাবানী হিজড়ারা আরাবান দেবতার পূঁজা করে। অনেক মন্দিরে হিজড়াদের নাচের ব্যবস্থা করা হয়। অনেক হিন্দু বিশ্বাস করে হিজড়াদের আশির্বাদ করার এবং অভিশাপ দেয়ার বিশেষ ক্ষমতা আছে। (পট্টনায়েক, দেবদূত; ২০০২, Wilhelm, Amara Das; ২০০৩, Peopl of the third sex; ১১০)
খ্রিস্ট ধর্মে হিজড়া
খ্রিস্ট ধর্মের নিউ টেস্টামেন্টে স্পষ্ট করে তৃতীয় লিঙ্গ সম্পর্কে বলা হয়েছে। বিবাহ এবং বিচ্ছেদ সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দেয়ার প্রাক্কালে জেসাস বলেন, কিছু মানুষ জন্ম থেকেই Eunuchs -এ পরিণত হয় এবং কিছু মানুষ আছে যারা স্বর্গরাজ্যের জন্য নিজেদের ঊঁহঁপযং -এ রূপান্তরিত করে।
কিছু খ্রিস্টান সংঘ হিজড়াদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। ইউনিটারিয়ান একটি ধর্মমত। এটি তাদের মূল খ্রিস্টান ধর্মের সাথে যুক্ত। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে তারা সর্বপ্রথম হিজড়াদের পূর্ণ সদস্য হিসেবে গ্রহণ করে। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে ইউনিটারিয়ান ইউনিভার্সালিস্ট এসোসিয়েশন প্রথম একজন হিজড়া ব্যক্তিকে মনোনীত করে। ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে চার্চ অব খ্রিস্ট সকল হিজড়া ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করার মত পেশ করে। (Unitarin universalist association; ২১ August ২০১২, ২ May ২০১৪, Wenjuan, Angelina; ২৪ February ২০১১)
বৌদ্ধ ধর্মে হিজড়া
অধিকাংশ বৌদ্ধ লিপিতে ধর্ম প্রতিপালনে কোনো লিঙ্গ ভিত্তিক বিভাজন করা হয়নি। নির্বাণ লাভের জন্য কামনাকে এই শাস্ত্রে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
থাই বৌদ্ধ ধর্মে ‘কতি’ বলে একটি শব্দ আছে। মেয়েদের মত আচারণকারী পুরুষকে ‘কতি’ বলা হয়। এটা সেখানে পুরুষ সমকামীদের ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয়। থাইল্যান্ডে কতিদের বিবাহের অনুমতি নেই। তারা কখনো বিয়ে করতে পারবে না। থাইল্যান্ডে কতিদের নারীতে রূপান্তরিত হওয়া কিংবা পুরুষের সাথে বিবাহ দেয়া এখানো আইনত অবৈধ। কিন্তু হিজড়া নারীরা তাদের ইউরোপীয় সঙ্গীকে বিয়ে করতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে তাকে থাইল্যান্ড ত্যাগ করে তাদের সঙ্গীদের দেশে চলে যেতে হবে। (Homo sexuality in Buddhism, Matyner, Andrew; ২০০০)
ইহুদী ধর্মে হিজড়া
ইহুদী ধর্মে হিজড়াদের ‘সারিস’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হিব্রু ‘সারিস’ ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে Eunuchs অথবা Chamberlain নামে। তনখ -এ সারিস শব্দটি ৪৫বার পাওয়া যায়। সারিস বলতে একজন লিঙ্গ নিরপেক্ষ বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে বোঝায় যিনি শক্তিমানের প্রতিনিধিত্ব করেন। ঈশ্বর সারিসদের কাছে এই বলে প্রতিজ্ঞা করেছে, তারা যদি সাবাথ পালন করে এবং রোযা রাখে তাহলে তাদের জন্য স্বর্গে একটি উত্তম মনুমেন্ট তৈরি করবেন।
তোরাহ’য় ক্রস ড্রেসিং (পুরুষ কর্তৃক নারীর মতো পোশাক পরা) এবং জেনিটাল বা শুক্রাশয় ক্ষতিগ্রস্থ করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়েছে। আর সেজন্য অনেক ইহুদী হিজড়াদেরকে ধর্ম বহির্ভুত মানুষ মনে করে। কারণ তার বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পরিধান করে। (Born Eunuche librery, টেমপ্লেট, Biberef)
ইসলাম ধর্মে হিজড়া
শান্তি এবং মানবতার ধর্ম, সাম্য আর উদারতার ধর্ম ইসলাম। স্নেহ-মমতা, সহনশীলতা, সহমর্মীতা আর উত্তম চরিত্রের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ইসলাম। ব্যক্তি পরিসর থেকে শুরু করে পরিবার-পরিম-ল, সমাজ এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা তথা সর্বক্ষেত্রে মানুষের প্রকৃত অধিকার নিশ্চিত করেছে ইসলাম। মানবতার মুক্তির একমাত্র পথ ও সঠিক দিশা শাশ্বত ধর্ম ইসলাম। আসুন খুঁজে দেখি তৃতীয় লিঙ্গ (Trans gender) সম্পর্কে ইসলাম ধর্ম কি বলে।
কুরআন-হাদীসের আলোকে হিজড়া
মহাগ্রন্থ কুরআনুল কারীমে মৌলিকভাবে নারী এবং পুরুষদের আলোচনাই স্থান পেয়েছে। সেখানে হিজড়াদের সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু না বলা হলেও তাদের অস্তিত্বকে অস্বীকারও করা হয়নি।
প্রখ্যাত মুফাসসির ইমাম কুরতুবী রহ. তার জগদ্বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ আলজামে’ ফী আহকামিল কুরআন-এ ‘সূরা শূরা’র ৪৯নং আয়াতের ব্যাখ্যায় কাজী আবু বকর ইবনে আরাবী রহ. এর উদ্ধৃতি পেশ করে বলেন, একটি গোষ্ঠী হিজড়াদের অস্তিত্বকে এই বলে উড়িয়ে দিতে চায় যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টিজীবকে পুরুষ-নারী এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করে দিয়েছেন।
এ কথার প্রতিউত্তরে আমরা বলি, এটা আরবী ভাষা এবং অলংকার শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞানের স্বল্পতা আর অজ্ঞতা এবং আল্লাহ তা‘আলার অসীম কুদরতের পরিচয় সম্পর্কে সীমাবদ্ধতা কিংবা উপলব্ধি করার অক্ষমতা বৈ কিছুই নয়। তো আল্লাহ তা‘আলা প্রাচুর্যময় এবং মহাজ্ঞানী।
কুরআনুল কারীমের বাহ্যিক আয়াত হিজড়ার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে না। কেননা আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেছেন,
لِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ.
অর্থ : নভোম-ল এবং ভূম-লের রাজত্ব তারই, তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। (‘সূরা শূরা’- ৪৯)
এটি একটি ব্যাপক অর্থবোধক আয়াত। কাজেই তা বিশেষ বিষয়ের সাথে নির্দিষ্ট করে নেয়া কিছুতেই সমীচীন নয়। এটাই তাঁর কুদরতের প্রকৃত দাবী। আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
يَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ إِنَاثًا وَيَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ الذُّكُورَ.
অর্থ : তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা দান করেন পুত্র সন্তান। (‘সূরা শূরা’- ৪৯)
এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, তাঁর সৃষ্টিজীবের মাঝে যেগুলো সচরাচর পাওয়া যায় সেগুলোর সংবাদ দেয়া, আর যেগুলোর অস্তিত্ব বিরল এবং দুর্লভ-প্রায় সেগুলো আয়াতের প্রথমাংশের ব্যাপকতায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। এজন্য পৃথকভাবে এখানে আলোচনা করা হয়নি। আর বাস্তবতা এরই সাক্ষ্য দিচ্ছে এবং চাক্ষুস বিষয় অস্বীকারকারীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। (তাফসীরে কুরতুবী ৮/৩৬৮)
হাদীসে স্পষ্টভাবে তাদের আলোচনা এসেছে এবং কতিপয় বিধানও বর্ণিত হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. বর্ণনা করেন,
عن بن عباس أن رسول الله صلى الله عليه و سلم سئل عن مولود ولد له قبل وذكر من أين يورث فقال النبي صلى الله عليه و سلم يورث من حيث يبول.
অর্থ : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোনো এক গোত্রের নবজাতকের মীরাস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, যে নারী-পুরুষ কোনোটিই নয়। উত্তরে তিনি বললেন, তার প্রস্রাবের পথকে কেন্দ্র করে তার মীরাস প্রাপ্তির বিষয়টি নির্ণিত হবে। (সুনানে বাইহাকী কুবরা ৬/২৬১)
أن عليا رضي الله عنه سئل عن المولود لا يدري أرجل أم امرأة فقال علي رضي الله عنه يورث من حيث يبول.
অর্থ : হযরত আলী রাযি. কে যে নবজাতকের নারী-পুরুষ হওয়ার বিষয় স্পষ্ট নয় তার সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এমন শিশুর প্রস্রাবের অবস্থা নির্ণয় করে বিধান আরোপিত হবে। (সুনানে বাইহাকী কুবরা; হা.নং ১২২৯৪)
وروي أنه عليه السلام أتي بخنثى من الأنصار فقال ورثوه من أول ما يبول منه.
অর্থ : হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক আনসারী হিজড়ার নিকট আসলেন এবং বললেন, তাকে তোমরা মীরাস দিবে সে প্রথম যে রাস্তা দিয়ে প্রস্রাব করে সে হিসেবে। (আলমুগনী ৬/২৫৩)
এছাড়াও অসংখ্য হাদীস এবং আসারে হিজড়া সংক্রান্ত বিধি-বিধান বর্ণিত হয়েছে। আর এগুলোর আলোকেই ফুকাহায়ে কেরাম বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হিজড়াদের জন্য জন্য শরয়ী সমাধান ও মাসআলা-মাসাইল বর্ণনা করেছেন।
ইসলাম ধর্মে হিজড়ার অবস্থান
মহান আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টির সেরা এবং সর্বাধিক সম্মান ও মর্যাদার আসন দান করেছেন। তিনি বলেন,
وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَى كَثِيرٍ مِمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا.
অর্থ : আমি অবশ্যই আদম সন্তানদের মর্যাদা দান করেছি। স্থলে ও সমুদ্রে তাদের চলাচলের বাহন দিয়েছি এবং তাদের উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি। আর আমি অন্য যতকিছু সৃষ্টি করেছি তার অধিকাংশের উপরই তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। (‘সূরা বনী ইসরাঈল’- ৭০)
সুতরাং নারী-পুরুষ আর হিজড়া সকলেই আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টির সেরা জীব। কাজেই হিজড়াদেরকে ভিন্ন চোখে দেখার কোনো সুযোগ নেই। ইসলাম কোনো ব্যক্তির প্রতি কোনো প্রকার বিরূপ মনোভাব পোষণ করে না। কাউকে সমাজের অপ্রয়োজনীয় উপাদান মনে করে না। আল্লাহ তা‘আলা ছোটো-বড়ো, সক্ষম-অক্ষম, ধনী-গরীব প্রতিটি মানুষের প্রতি নির্দিষ্ট দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। যথাযথ দায়িত্ব পালনকারী আল্লাহ তা‘আলার অনুগত নেক বান্দা। তারাই আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রকৃত মর্যাদাবান। মানব মর্যাদার মানদণ্ড আর প্রকৃত মাপকাঠি কোনো বংশ, গোত্র, অঞ্চল, বর্ণ, ভাষা, সৌন্দর্য, সুস্থতা আর নারী-পুরুষের তারতম্যের ভিত্তিতে নিরুপণ হয় না। একমাত্র তাকওয়াই হচ্ছে এ মর্যাদার মাপকাঠি। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ.
অর্থ : হে মানব সম্প্রদায়! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ এবং এক নারী হতে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হও। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলার নিকট সেই সর্বাধিক মর্যাদাবান সম্ভ্রান্ত, যে সর্বাধিক পরহেজগার তথা আল্লাহভীরু। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন। (‘সূরা হুজুরাত’- ১৩)
সুতরাং যে যত বেশি মুত্তাকী আল্লাহ তা‘আলা তাকে তত বেশি ভালোবাসেন। এই মাপকাঠির মাধ্যমে তিনি মানুষের মাঝে ভেদাভেদ দূরিভূত করে দিয়েছেন এবং সকলকে বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করেছেন। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,
الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا.
অর্থ : (সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেন,) তিনি জীবন এবং মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন যাতে তিনি দেখতে পান, কে তোমাদের মাঝে কর্মে উত্তম। (‘সূরা মুলক’- ২)
তাই কারো কর্ম বেশি হওয়া আল্লাহ তা‘আলার নিকট গ্রহণযোগ্য নয়; বরং কর্মটি ভালো, নির্ভুল এবং কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী হওয়াই ধর্তব্য। তাই কোনো ব্যক্তি হিসেবে নয়, সৎ এবং ভালো আমলই হবে মান-মর্যাদার একমাত্র ভিত্তি। এ প্রসঙ্গে রাসূকে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
إن الله لا ينظر إلى صوركم وأموالكم ولكن ينظر إلى قلوبكم وأعمالكم.
অর্থ : আল্লাহ তা‘আল তোমাদের বাহ্যিক আকার-আকৃতি এবং সহায়-সম্পত্তির প্রতি লক্ষ্য করেন না; বরং তিনি লক্ষ্য করেন তোমাদের অন্তর এবং আমলের প্রতি। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ৬৭০৮)
অতএব ইসলামী মূল্যবোধ এবং আদর্শের ভিত্তিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, হিজড়াদের ততটুকু সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে, যতটুকু একজন সুস্থ মুসলিম ব্যক্তির রয়েছে। এমনকি ইসলামী শরীয়ার আলোকে একজন মুমিন, মুত্তাকী, পরহেজগার হিজড়া অসংখ্য, অগণিত ফাসেক ও মুত্তাকী নয় এমন পূর্ণাঙ্গ সুস্থ নর-নারী থেকে উত্তম এবং মর্যাদাবান।
মানবাধিকার ও হিজড়া
এ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই জন্মগত কিছু অধিকার আর চাহিদা নিয়ে জীবন যাপন করে। যার মধ্যে নিরাপদ আবাসন, খাদ্য নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা, সামাজিক মর্যাদা অন্যতম।
নিরাপদ আবাসন বলতে শিশুর সঠিক লালন-পালন, নাগরিক অধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধানকে বুঝায়। অনুরূপভাবে খাদ্য নিরাপত্তার উদ্দেশ্য হলো দেশের অন্য নাগরিকের মতো যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান ও জীবন-জীবিকার পথে ন্যায়সঙ্গত পাথেয় জোগাড়ের অধিকার অর্জন। বৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের নিশ্চিত মাধ্যম অবলম্বনের সুযোগদান। তদ্রƒপ সামাজিক মর্যাদার জন্য স্নেহ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সামাজিক বন্ধন, ব্যক্তি পরিসর, মত-পথ, কর্তৃত্ব ও অবদানের স্বীকৃতির মতো বিষয়গুলো পাওয়ার নিশ্চয়তা।
অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় কেবল নারী-পুরুষই মানব সমাজের অঙ্গ। হিজড়াগণ এ সমাজের কোনো অংশ নয়; তারা ভিন্ন কোনো প্রজাতি। তাই মানবিকতার চর্চা, মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ও মানব প্রতিভার স্ফুরণ বলতে গেলে তাদের পক্ষে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। সুতরাং দেখতে শুনতে মানুষ হলেও কার্যত তারা সেই মর্যাদার বাইরে। এক কথায় মনুষ্য অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। এমনকি তারা যে মনুষ্য মর্যাদা ও মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত সেই বোধটুকুও অধিকাংশেই লালন করে না।
অধিকার এবং আমাদের সংবিধান
বাংলাদেশ সমাজ সেবা অধিদপ্তর ২০১২ সনে প্রথমবারের মতো হিজড়া শিশুদের শিক্ষা উপবৃত্তি ও প্রশিক্ষণের উপর পাইলট প্রকল্প শুরু করেছে। কারণ এ জনগোষ্ঠির শিশুরা একটা পর্যায়ে স্কুল থেকে ঝরে যায়। অনেকেই পরিবার থেকে বের হয়ে এক অর্থে ভাসমান জনগোষ্ঠিতে পরিণত হয়। সমাজের প্রত্যেক স্তরে স্বাস্থ্যসেবা ও কর্মসংস্থানের মতো বিষয়ে তারা চরম অবহেলা আর বিড়ম্বনার শিকার। সুপারিশকৃত আইনের খসড়া যেটি সংসদে আইন বা অ্যাক্ট আকারে উত্থাপন ও পাসের অপেক্ষায় রয়েছে এর নাম ‘বৈষম্য বিলোপ আইন ২০১৪’। সেখানে ৪নং ধারার ঘ, ঙ, চ, ছ, জ উপধারায় লিঙ্গ প্রতিবন্ধীদের জন্ম, পরিবার, উত্তরাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে বৈষম্য বিলোপের কথা বলা হয়েছে।
আমাদের সংবিধানের ১৯, ২৭, ২৮, ২৯ অনুচ্ছেদেও সকল নাগরিকের সমতা, সমান সুযোগ ও সব ধরনের বৈষম্য বিলোপের বিধানাবলী লিপিবদ্ধ রয়েছে। লিঙ্গ প্রতিবন্ধীদের জন্য অন্য ধর্ম, জাত-পাত, দলিত ইত্যাদি জনগোষ্ঠির সুরক্ষার সঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে বৈষম্য বিলোপ আইন তৈরি ও কার্যকরের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সরকারের এসব উদ্যোগ কাগজে কলমে বেঁধে না রেখে সঠিকভাবে কার্যকর করতে হবে।
এদিকে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ণয়ে বলা হয়েছে মানব জাতির প্রত্যেক মানুষের সহজাত মর্যাদা এবং সমতা ও সমান অধিকার রক্ষা করা। মানবাধিকার চুক্তির ভাষ্য অনুযায়ী এ পর্যন্ত মানুষের অধিকার সুস্পষ্ট। এবার প্রশ্ন আসে, এ অধিকারের ভোক্তা কারা? উত্তরে অবশ্যই বলা হবে, প্রসূত প্রতিটি মানব শিশুই এর ভোক্তা। তাহলে অপরিহার্যভাবে সমাজের অন্যসব শ্রেণীর মানুষের মতো হিজড়াদেরকেও মানুষ বলতে হবে এবং তাদের সকল মৌলিক অধিকারও নিশ্চিত করতে হবে।
শরয়ী অধিকারে লিঙ্গ প্রতিবন্ধী
পৃথিবী সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে মানব সমাজে যে বিধান চলে আসছে ইসলাম হলো তার সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্করণ। আখেরী নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম সবার পরে এসে মানবজীবনের বিধানকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দান করেছেন।
বিদায় হজের ভাষণে ইসলামকে শান্তির ধর্ম বলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ঘোষণা দিয়েছেন ইতিহাসে তা আজো স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে। মানবাধিকার সম্পর্কে ইসলামের ধারণা সুস্পষ্ট। কারণ ইসলাম আসার পূর্বে মানব গোষ্ঠি ছিল উপেক্ষিত, অবহেলিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত আর সর্ব প্রকার অধিকার বঞ্চিত। ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একমাত্র ইসলামই মানবাধিকার ও সার্বজনীন মৌলিক স্বাধীনতা প্রদান করেছে।
ইসলাম যেভাবে পুরুষের জন্য নারীর আর নারীর জন্য পুরুষের সকল অধিকার সুষম হারে বণ্টন করেছে ঠিক তেমনিভাবে নিশ্চিত করেছে সর্বক্ষেত্রে লিঙ্গ প্রতিবন্ধীর অধিকার এবং পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়াদী। তুলে ধরেছে ইসলামের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা।
আজ সমাজে যাদেরকে আমরা লিঙ্গ প্রতিবন্ধী বা হিজড়া বলে জানি তারাও আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টি। তারা আল্লাহ তা‘আলারই বান্দা। তারাও আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব। যার ঘোষণা স্বয়ং রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে দিয়েছেন,
وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَى كَثِيرٍ مِمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلًا.
অর্থ : নিশ্চয়ই আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি, তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি। আর আমি অন্য যতো কিছু সৃষ্টি করেছি তার অধিকাংশের উপরই তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। (‘সূরা বনী ইসরাঈল’- ৭০)
অন্যত্র তিনি আরো ইরশাদ করেন,
لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ فِي أَحْسَنِ تَقْوِيمٍ.
অর্থ : আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সুন্দরতম অবয়বে। (‘সূরা তীন’- ৪)
আল্লামা ইবনুল আরাবী রহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন,
এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ তা‘আলা তাকে জ্ঞানী, শক্তিবান, বক্তা, শ্রোতা, দ্রষ্টা, কুশলী এবং প্রজ্ঞাবান করেছেন। এগুলো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা‘আলারই গুণাবলী। (তাফসীরে কুরতুবী ১০/৩৫৫)
বাস্তবতা হলো তারাও (হিজড়া) মানুষ এবং আমাদের মতোইমানুষ। তবে অনেক মানুষের যেমন শারীরিক ত্রুটি থাকে, এটিও তাদের তেমনিএকটি ত্রুটি। এ ত্রুটির কারণে তারা মনুষ্যত্ব থেকে বেরিয়ে যায়নি। বরং ইসলামের দৃষ্টিতেঅন্যান্য প্রতিবন্ধীদের মতো তারাও স্নেহ,মমতা, শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা পাওয়ার পূর্ণ অধিকার রাখে। কেননা ইসলাম তো অধিকার আর মর্যাদার মানদণ্ড নির্ণয় করেছে একমাত্র তাকওয়া এবং খোদাভীতির উপর। যার ঘোষণা রাব্বুল আলামীন এভাবে দিয়েছেন,
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ.
অর্থ : আল্লাহ তা‘আলার নিকট সর্বাধিক মর্যাদাবান এবং সম্মানীত সে, যে সর্বাধিক পরহেজগার তথা আল্লাহভীরু। (‘সূরা হুজুরাত’- ১৩)
এই মূলনীতি আর মাপকাঠির মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার সব ধরনের ভেদাভেদ দূরীভূত করতঃ নারী, পুরুষ, হিজড়া নির্বিশেষে সকলকে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদায় ভূষিত করেছেন।
হিজড়া এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি
সমগ্র মুসলিম সমাজ একটি দেহের সাথে তুলনীয় এবং প্রত্যেকে প্রত্যেকের প্রতি দায়িত্ব এবং অধিকারের বন্ধনে আবদ্ধ। এখানে একজনের সুখে সবাই আনন্দিত হয়, ঠিক তেমনি একজনের দুঃখ-ব্যথায় সবাই দুঃখ বা ব্যথিত হয়। আর এমনটিই বলেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। ইরশাদ হচ্ছে,
ترى المؤمنين في تراحمهم وتوادهم وتعاطفهم كمثل الجسد إذا اشتكى عضوا تداعى له سائر جسده بالسهر والحمى.
অর্থ : তুমি মুমিনদেরকে পরস্পর দয়া, ভালোবাসা এবং সহানুভূতি প্রদর্শনে একটি দেহের ন্যায় দেখতে পাবে। দেহের একটি অঙ্গ যখন রোগাক্রান্ত হয় তখন শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রাত জেগে এবং জ্বরাক্রান্ত হয়ে ভেঙ্গে পড়ে। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ৫৬৬৫)
অপর এক হাদীসে এসেছে। হযরত আনাস রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন,
يؤمن احدكم حتى يحب لاخيه أو قال لجاره ما يحب لنفسه.
অর্থ : তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে অপর ভাইয়ের জন্যও তা পছন্দ না করবে। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ১৮০)
সুতরাং হিজড়া যদি মুসলিম সন্তান হয় তাহলে সে আর আমি তো অভিন্ন অঙ্গ। তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বা অপমান করা মানে নিজেকে লাঞ্ছিত করা। আর যদি অমুসলিম হয় তাহলেও মানুষ হিসেবে তার সম্মান রক্ষা করা আমার দায়িত্ব। দয়া ও অনুগ্রহের মাধ্যমে ইসলামের প্রতি তাকে আহ্বান করা আমার কর্তব্য। শুধু হিজড়াই নয়, যেকোনো মানুষের সাথে দুর্ব্যবহার করা, খারাপ মন্তব্য করা কিংবা তিরস্কার করা ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্য অন্যায় এবং মারাত্মক গুনাহের কাজ। এ প্রসঙ্গে মহান রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেছেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِنْ قَوْمٍ عَسَى أَنْ يَكُونُوا خَيْرًا مِنْهُمْ وَلَا نِسَاءٌ مِنْ نِسَاءٍ عَسَى أَنْ يَكُنَّ خَيْرًا مِنْهُنَّ وَلَا تَلْمِزُوا أَنْفُسَكُمْ وَلَا تَنَابَزُوا بِالْأَلْقَابِ بِئْسَ الِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيمَانِ وَمَنْ لَمْ يَتُبْ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ.
অর্থ : হে মুমিনগণ! কেউ যেন অন্য কাউকে উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর নারীকেও যেন উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারিণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না এবং একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাদের মন্দ নামে ডাকা গুনাহ। যারা এহেন কাজ থেকে তওবা না করে তারাই যালেম। (‘সূরা হুজুরাত’- ১১)
যেকোনো মুসলমানকে গালী দেয়া যেমন অন্যায় এবং গুনাহ, হিজড়াদেরকে গালী দেয়া বা মন্দ বলা এর চেয়ে বেশি গুনাহ। কোনো মুসলমানকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা যেমন পাপ, তাদেরকে তুচ্ছজ্ঞান করা এর এরচে’ কোনো অংশে কম নয়; বরং আরো বেশি। কারণ তাদের এই দুর্বলতার কারণে তাদের প্রতি ঠাট্টা-বিদ্রুপ করার অর্থই হলো, আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টিকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা, তাঁর সৃষ্টিকে হাসি-তামাশার বিষয় বানানো। সর্বোপরি এটা আল্লাহ তা‘আলার প্রতি অভিযোগ এবং অনুযোগ আরোপ করার শামিল। তাই ইসলামী শরীয়ার দৃষ্টিতে এটি একটি খুবই গর্হিত এবং অন্যায় কাজ। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
وَالَّذِينَ يُؤْذُونَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ بِغَيْرِ مَا اكْتَسَبُوا فَقَدِ احْتَمَلُوا بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُبِينًا.
অর্থ : যারা বিনা অপরাধে মুমিন নর-নারীকে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ এবং প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে। (‘সূরা আহযাব’- ৫৮)
এ প্রসঙ্গে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
عن ابى هريرة ان رسول الله صلى الله عليه وسلم قال لا تهجروا ولا تدابروا ولا تحسسوا ولا يبع بعضكم على بيع بعض وكونوا عباد الله اخوانا.
অর্থ : তোমরা পরস্পর শত্রুতা করো না, একে অপরের দোষ তালাশ করো না, অন্যকে (তুচ্ছজ্ঞান করে) দূরে ঠেলে দিয়ো না। একজনের উপর আরেকজন ক্রয়-বিক্রয় প্রস্তাব করো না। আল্লাহ তা‘আলার বান্দা হয়ে সকলে ভাই ভাই হয়ে যাও। (সহীহ বুখারী; হা.নং ৬০৬৩, সহীহ মুসলিম; হা.নং ২৫৬৩)
আজ আমাদের সমাজে যারা লিঙ্গ প্রতিবন্ধী তারা তো আমাদেরই কারো না কারো পরিবারের সদস্য। কারো ভাই-বোন, কারো সন্তান। তাই তাদের সাথে খারাপ আচরণ করা এটা শুধু অনৈসলামিকই নয়; সম্পূর্ণ অমানবিকও বটে।
কোনো পরিবারে হিজড়া শিশু জন্ম নিলে শুধু শিশুটিই নয় গোটা পরিবারই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর বিদ্রুপের শিকার হয়। কেমন যেন শিশুটি পাপ নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে। জগতের প্রতিটি মানব শিশুই নিষ্পাপ হয়ে জন্মগ্রহণ করে। কোনো হিজড়া শিশু পাপ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন,
كل مولود يولد على الفطرة فأبواه يهودانه أوينصراه أو يمجسانه.
অর্থ : প্রতিটি মানব শিশুই ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার পিতা-মাতাই তাকে ইহুদী বানায়, খ্রিস্টান বানায় এবং অগ্নি উপাসক বানায়। (সহীহ বুখারী; হা.নং ১৩৮৫)
সুতরাং ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানব শিশুই নিষ্পাপ। কাজেই তাদের হিজড়া বলে তুচ্ছ জ্ঞান করা এবং বিরূপ মনোভাব পোষণ করাকে ইসলাম কিছুতেই সমর্থন করে না। এ ব্যাপারে হাদীসও বর্ণিত হয়েছে। হযরত আবু হুরাইরা রাযি. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
بحسب امرئ من الشر ان يحقر اخاه المسلم.
অর্থ : কোনো মানুষ নিকৃষ্ট হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার অপর ভাইকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ২৫৬৪)
কিন্তু বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় দুর্বল ও অসহায় এই হিজড়া শ্রেণী নানা নিগৃহের শিকার। অথচ সামাজিক সদস্য এবং মানব সন্তান হিসেবে প্রত্যেকেরই রয়েছে সুমহান অধিকার। ইসলাম তাদেরকে সমাজের সদস্য গণ্য করে তাদের অধিকার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে যার দৃষ্টান্ত বিরল।
এজন্য ইসলামী মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা এবং সুমহান আদর্শের ভিত্তিতে এটাই প্রমাণিত হয় যে, হিজড়াদের ততটুকু মান-মর্যাদা রয়েছে যতটুকু সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে একজন সুস্থ মুসলমানের। অনুরূপভাবে একজন হিজড়ার ততখানি সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অধিকার রয়েছে যতটুকু অধিকার রয়েছে একজন সুস্থ ও সবল মানুষের। ইসলামের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে হিজড়াদের মর্যাদা ও অধিকার সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আতাউল্লাহ মুসিলী রহ.সহ অনেকেই হিজড় হয়েও আলমী আকাশের ধ্রুবতারায় পরিণত হয়েছিলেন।
হিজড়াদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে করণীয়
সার্বিকভাবে হিজড়া সম্প্রদায়ের ন্যায্য এবং ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায় ও নিশ্চিত করার মানসে পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে নিম্নোক্ত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করতে হবে।
১. এক্ষেত্রে সবচে’ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকবে পিতা-মাতার। হিজড়া সন্তান জন্ম নিলে সমাজ বাস্তবতার কারণে পিতা-মাতা প্রচণ্ড লজ্জাবোধ করে। পিতা-মাতাকে বুঝতে হবে এতে লজ্জার কোনো কারণ নেই। বরং লজ্জাবোধ করা এক রকম জাহিলিয়াত আর অজ্ঞতা।
প্রাক ইসলামী যুগের লোকেরা কন্যা সন্তান জন্মালেও লজ্জাবোধ করত। ইসলামী শিক্ষার আলো যাদের অন্তরে পৌঁছায়নি তাদের কাছে আজো পর্যন্ত এটা লজ্জার বিষয়। কিন্তু সে লজ্জা তো প্রশংসনীয় কোনো বিষয় নয় এবং একে প্রশ্রয়ও দেয়া উচিৎ নয়। তেমনি হিজড়া সন্তান জন্ম নেয়াটাও কোনো লজ্জার বিষয় নয়; বরং এ সন্তান তাদের প্রেম-ভালোবাসার ফসল। এটা তাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার দান। তাঁর নির্বাচন ও পরীক্ষা। তাঁর এ দানকে সন্তুষ্টির সাথে গ্রহণ করতে হবে এবং এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।
বস্তুত নিখুঁত পুত্র বা কন্যা সন্তানও এক প্রকার পরীক্ষা। আল্লাহ তা‘আলা দেখতে চান পিতা-মাতা তাঁর দানকে কীভাবে গ্রহণ করছে এবং কিভাবে তাকে গড়ে তুলছে। আল্লাহ প্রদত্ত সন্তানকে আল্লাহর বান্দারূপে গড়ে তোলার মধ্যেই পরীক্ষার কৃতকার্যতা নিহিত। সন্তানকে আল্লাহর বান্দারূপে যদি গড়ে তোলার সাধনা করা না হয়, তবে তা হবে পরীক্ষায় অকৃতকার্যতা। এ কথা যেমন পুত্র-কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তেমনি প্রযোজ্য হিজড়া সন্তানের ক্ষেত্রেও। কাজেই কোন লিঙ্গের সন্তান সেটা বড়ো কথা নয়; তার পরিচর্যা কেমন করা হচ্ছে সেটাই আসল কথা।
কোনো পিতা-মাতা যদি এই দৃষ্টিকোণ থেকে তার হিজড়া সন্তানকে গ্রহণ করে এবং এভাবে তার পেছনে মেহনত করে তাহলে তারা আখিরাতের পুরস্কার তো পাবেনই, দুনিয়াতেও এ সন্তানের মাধ্যমে তাদের মুখ উজ্জ্বল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাদের পরিচর্যার ফলে সে সন্তানটি এমন কৃতিত্ববান হয়ে উঠতে পারে যে, তাকে নিয়ে সকলে গর্ব করবে এবং তার যোগ্যতা ও প্রতিভা দ্বারা যুগ ও সমাজের অভাবনীয় কল্যাণ সাধিত হবে।
২. সমাজরে প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব-কর্তব্য হিজড়াদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ করা এবং তাদের প্রতি পূর্বের সব ধরনের নেতিবাচক মনোভাব পরিহার করা।
৩. তাদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের জন্য যথাযথ সুযোগ তৈরি করে দেয়া।
৪. তাদের জন্য আইন ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা।
৫. তাদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণমূলক কর্মসূচী গ্রহণ করা।
৬. পূর্ণ মাত্রায় বিকশিত হওয়ার অধিকার, বেঁচে থাকার অধিকার এবং সর্বক্ষেত্রে সমান আইনী স্বীকৃতি নিশ্চিত করা।
৭. তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিপূর্ণ মূল্যায়ন করার ব্যবস্থা নেয়া।
৮. তাদের জন্য সামাজিক সৃষ্টির সঙ্গে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৯. গৃহহীন হিজড়াদের জন্য নানা পর্যায়ে আবাসন প্রকল্প চালু করা, যেখানে স্বল্পমূল্যে বাসস্থান, চিকিৎসা, বিনোদন, সেবা-যতœ ও খাদ্যের নিশ্চয়তা থাকবে।
১০. বৃদ্ধ বয়সে তাদের জন্য সরকারি ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করা।
১১. তাদের জন্য এমন অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা যাতে তারা বয়োঃসন্ধিক্ষণের এক পর্যায়ে বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় বের হতে বাধ্য না হয়। তাদেরকে স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে উঠার সুযোগ প্রদান করা।
১২. সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র সর্বক্ষেত্রে তাদের কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ এবং সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরীতে নিয়োগদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
১৩. তাদের উত্তরাধিকার নিশ্চিত করা এবং নিজ পরিবারের সাথে সমাজে বসবাস করার ব্যবস্থা করা।
১৪. তাদের জন্য বিনামূল্যে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা। তাদের লিঙ্গ নির্ধারণের উপযুক্ত সময়ে তারা যেন চিকিৎসা সহায়তা লাভ করতে পারে সেজন্য সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা।
১৫. হিজড়াদের প্রতি পিতা-মাতা এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের দায়িত্ব পালনে উৎসাহিত করা। আর এজন্য ইসলামী ব্যক্তিত্ব, আলেম-উলামা, মসজিদের ইমাম ও খতীবদের অগ্রণী ভূমিকা রাখা।
১৬. ইতোমধ্যে যে সকল হিজড়া প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেছে, সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করে তাদেরকে সমাজের মূল স্রােতে নিয়ে আসা। বিষয়টি কঠিন হলেও পণ্ডশ্রম হবে না কিছুতেই। তারাও যে সম্মানিত মানুষ এই বোধ যদি জাগ্রত করে দেয়া যায়, তবে পুনর্বাসনের প্রচেষ্টায় তাদের পক্ষ থেকেও সহযোগিতা পাওয়া যাবে এবং নিজেকে সমাজ প্রতিষ্ঠার সকল প্রচেষ্টায় ব্যাপৃত করবে। ফলে তাকে তার পরিবার ও সমাজের সাথে যুক্ত করে জীবন যাপনের স্বাভাবিক ধারায় নিয়ে আসা যাবে। এজন্য প্রয়োজন সর্বমহলের সুচিন্তিত, সুপরিকল্পিত ও সমুন্নত উদ্যোগ। এ সকল বিষয় সামনে রেখে বাংলাদেশে হিজড়া সম্প্রদায়কে সব ধরনের সামাজিক ও নাগরিক অধিকার প্রদান করা একটি মানবিক ও নৈতিক দায়িত্ব। সাথে সাথে আরো প্রয়োজন দাওয়াতী মেহনত।
১৭. লিঙ্গ প্রতিবন্ধীকে বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে যে, সেও একজন মর্যাদাবান মানুষ ও মুসলিম। সে হিসেবে তার অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। একজন দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে সেও শরীয়তের আওতাধীন। শরীয়ত তাকে সমাজের গলগ্রহ নয়; সামাজিক ভার বহনের মহিমা দান করেছে। সেই মহিমায় উদ্ভাসিত হওয়ার জন্য তাকে গণমানুষের শ্রোতে মিশে যেতে হবে।
তাদের মধ্য থেকে তাকে আদায় করে নিতে হবে আল্লাহ তা‘আলার হক এবং এর পাশাপাশি বান্দার হক। এ উভয়বিধ হক আদায়ের মাধ্যমে তাকে অবতীর্ণ হতে হবে তাকওয়া অর্জনের প্রতিযোগিতায়। সত্যিকারের মুত্তাকী-পরহেজগার হতে পারলে আল্লাহ তা‘আলার কাছে মনুষ্যত্বের মর্যাদায় সে বহু নারী-পুরুষকে অতিক্রম করে যেতে পারবে।
আল্লাহ প্রদত্ত মর্যাদাই প্রকৃত মর্যাদা। যার মাপকাঠি পুরুষ বা নারী হওয়া নয়; বরং শুধুই তাকওয়া। যেমনটি তিনি মহাগ্রন্থ আলকুরআনের ‘সূরা হুজুরাত’-এর ১৩নং আয়াতে ঘোষণা করেছেন। ‘অর্থাৎ তোমাদের মাঝে আল্লাহ তা‘আলার নিকট সেই বেশি মর্যাদাবান যে বেশি মুত্তাকী।’
১৮. এতদসঙ্গে তাদের জন্য শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করাও অত্যন্ত জরুরী। তাদেরকে কুরআনে কারীম শেখানো, নামায-রোযা, হালাল-হারাম, জায়েয-নাজায়েয প্রভৃতি নৈতিক বিষয়াদি সম্পর্কে অবগত করানো। হক্কুল্লাহ এবং হক্কুল ইবাদ সম্পর্কে পরিচয় দান।
মোটকথা, একজন মুসলিম হওয়ার জন্য যা কিছু প্রয়োজন এবং করণীয় আর যা বর্জনীয় সে সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা দায়িত্বশীল মহলকে অবশ্যই নিতে হবে। অন্যথায় জবাবদিহিতার প্রশ্ন থেকেই যাবে নিজ বিবেকের কাছে, সময় ও সমাজের কাছে। সর্বোপরি সকলের মহান প্রভু রাব্বুল আলামীনের কাছে জবাবদিহিতার বিষয়টি সামনে রেখে সমুখের বাধা লঙ্ঘন করে চলতে হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সেই সচেতনতাবোধ আমাদের সকলকে দান করুন।
হিজড়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুশাসন
বর্তমান সমাজের বাস্তবতা লক্ষ্য করলে উপলব্ধ হয়, মুসলিম বাবা-মায়ের সন্তান হয়েও ইসলামী অনুশাসনের সাথে হিজড়াদের কোনো সম্পর্ক নেই। যেন হিজড়া হওয়ার কারণে ইসলামী শরীয়তের বাধ্যবাধকতা থেকে তারা মুক্ত। শরীয়তের বিধানাবলী কেবল পুরুষ ও নারীর জন্যই প্রদত্ত; তাদের জন্য নয়। তাদের জন্য কোনো ধর্মজীবন নেই, পরকাল নেই, হিসাব-নিকাশ নেই। ব্যস, দুনিয়ায় যতদিন বাঁচার বাঁচবে তারপর মুহূর্তেই সব শেষ। এমনকি অনেক মানুষকে এমন বিষ্ময়কর কথা বলতেও শোনা যায় যে, হিজড়ারা মুসলমান কি না? মোটকথা তারা নিজেরা যেমন দীনের অনুসরণ করার কোনো গরজবোধ করছে না, তেমনি অন্যদের কাছেও তাদের দীনী প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। অথচ অন্যদের মতো তারাও দীনের আওতাভুক্ত। শরীয়ত যেমন নারী-পুরুষের জন্য, তেমনি তাদের জন্যও। অন্যদের মতো তাদেরও পরকালীন জবাবদিহীতা আছে। যে জবাবদিহীতার জন্য ইসলাম অন্যদের মতো তাদেরকেও নিজ হিদায়াতের আওতায় রেখেছে।
এজন্য আমাদের ফুকাহায়ে কেরাম তাদের রচনাবলীতে ‘বাবুল খুনসা’ (হিজড়া অধ্যায়) শিরোনামে স্বতন্ত্রভাবে তাদের সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তারা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, হিজড়া তিন ধরনের হয়ে থাকে। (ক) কারো মধ্যে পুরুষালী লক্ষণ প্রবল, (খ) কারো মধ্যে মেয়েলী লক্ষণ প্রবল এবং (গ) কারো মধ্যে উভয় লক্ষণই সমান। এদের মধ্যে প্রথম শ্রেণীকে পুরুষ এবং দ্বিতীয় শ্রেণীকে নারী গণ্য করা হবে। আর তৃতীয় শ্রেণী প্রকৃত হিজড়া। দীনের সাধারণ বিষয়গুলো এদের সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হবে।
পক্ষান্তরে নারী-পুরুষ ভেদে যেসব বিধানে পার্থক্য আছে সেগুলো তারা উপরিউক্ত শ্রেণীভেদ অনুযায়ী পালন করবে। বাকী যারা প্রকৃত হিজড়া তাদের বিস্তারিত বিধি-বিধান কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে নিম্নে আলোচনা করা হলো।
প্রকৃত হিজড়াদের বিস্তারিত শরয়ী বিধান
আযান-ইকামত : ফুকাহায়ে কেরামের মাঝে এ ব্যাপারে কোনো মতবিরোধ নেই যে, এ শ্রেণীর লিঙ্গ প্রতিবন্ধীর আযান দেয়া সহীহ নয়। কেননা সে পুরুষ কিনা এটা সঠিকভাবে কেউ বলতে পারে না। আর যদি নারী হয় তবে তার আযান সহীহ নয়। অধিকন্তু আযান মূলত বিধিত হয়েছে এ’লান তথা নামাযের ঘোষণা উচ্চস্বরে দূরদূরান্তে পৌঁছে দেয়ার জন্যই। আর এ দু’টির কোনোটিই নারীদের জন্য শরীয়তসম্মত নয়। তদ্রƒপ যার জন্য আযান দেয়া বৈধ নয় তার জন্য ইকামত দেয়ারও কোনো অনুমতি নেই। (সুনানে বাইহাকী ১/৪০৮, আলমুগনী ১/৫৩০, আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুওয়াইতিয়্যাহ ২০/২২)
ইমামত : এমন হিজড়াদের জন্য কোনো পুরুষ বা তার মত অন্য কোন হিজড়ার ইমামতি করা জায়েয নেই। শুধু নারীদের ইমামতি করার সুযোগ আছে। তবে এক্ষেত্রেও মাকরূহ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়। নারীদের ইমামতি করার ক্ষেত্রে তাকে নারীদের সামনে দাঁড়াতে হবে; তাদের মাঝে নয়। কেননা তার পুরুষ হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। (আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুওয়াইতিয়্যাহ ২০/২৫)
নামাযে দাঁড়ানো এবং ওড়না পরিধান করা : জামাআতে নামায আদায় করার ক্ষেত্রে এ শ্রেণীর হিজড়াগণ পুরুষের পিছনের কাতারে দাঁড়াবে এবং নামাযে তারা ওড়না ব্যবহার করবে। আর নামাযে বসার ক্ষেত্রে নারীদের ন্যায় বসবে। (আলবাহরুর রায়েক ৯/৩৫, ৩৬, কামুসুল ফিকহ ৩/৩৭৯, কিতাবুল আসল লি ইমাম মুহাম্মাদ ৯/৩২৪)
হজ-ইহরাম : এ ধরনের হিজড়াগণ হজের সকল বিধি-বিধান নারীদের ন্যায় পালন করবে এবং মাহরাম কোনো পুরুষ ছাড়া তাদের হজ করার অনুমতি নেই। (ফাতহুল কাদীর ১০/৫৫৩, আলবাহরুর রায়েক ৯/৩৩৬)
অলঙ্কার পরিধান করা : তাদের জন্য সব ধরনের অলঙ্কার পরিধান করা মাকরূহ। কারণ পুরুষের জন্য অলঙ্কার পরিধান করা হারাম আর নারীদের জন্য মুবাহ তথা অনুমোদিত। আর হারাম কাজ থেকে বেঁচে থাকা ফরয এবং মুবাহ কাজ করা জায়েয। অর্থাৎ এমন কাজ করার দ্বারা কোনো সওয়াব হবে না এবং না করার দরুণ কোনো গুনাহ হবে না। সুতরাং হিজড়ার বিষয়টি অস্পষ্ট, বিধায় সতর্কতা অবলম্বন করতঃ অলঙ্কার পরিধান না করা উচিত। (আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুওয়াইতিয়্যাহ ২০/৩০, ইনায়া আলা ফাতহিল কাদীর ১০/৫৫২, বাদায়িউস সানায়ি’ ৭/৩২৯)
খতনা বিধান : কোনো পুরুষের মাধ্যমে হোক কিংবা নারীর মাধ্যমে, নাবালেগ অবস্থায়ই তাকে খতনা করিয়ে দিতে হবে। আর যদি সে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর খাতনা করতে চায়, তাহলে খতনা করাতে পারে এমন কোনো নারীর সাথে তাকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে দিবে। নতুবা সে খতনা বিহীন জীবন যাপন করবে। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর পুরুষের মাধ্যমে হোক কিংবা নারীর মাধ্যমে হোক সর্বাবস্থায় তার জন্য খতনা করানো মাকরূহ। কারণ খতনা করা একটা সুন্নাত আমল। আর এক্ষেত্রে তা পালন করতে গেলে ফরয আমল লঙ্ঘন হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়। বিধায় সে খতনা বিহীন জীবন যাপন করে। (ফাতাওয়া শামী ১০/৪৪৮, কামুসুল ফিকহ ৩/৩৭৮, আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুওয়াইতিয়্যাহ ২০/৩০)
সতর ও পর্দা বিধান : এমন লিঙ্গ প্রতিবন্ধীর সতর নারীদের সতরের ন্যায় এবং তারা নারীদের মতোই পর্দা বিধান মেনে চলবে। তাছাড়া তারা কোনো পুরুষ বা নারীর সামনে ইস্তিঞ্জা এবং গোসলের জন্য সতর খুলবে না। অর্থাৎ এক কাপড় পরিহিত অবস্থায় থাকবে না এবং গাইরে মাহরাম কোনো নারী-পুরুষ তার সাথে নির্জনতা অবলম্বন করবে না। কোনো হারাম কাজে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা বা অন্যায় কাজ থেকে বেঁচে থাকার জন্য সতর্কতার জন্য মাহরাম কোনো পুরুষ ব্যতীত দূরে কোথাও সফরে বের হবে না। এমনকি শুধু মাহরাম মহিলাদের সাথে সফর করাও মাকরূহ। (আলবাহরুর রায়েক ৯/৩৩৬, আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুওয়াইতিয়্যাহ ২০/২৬, রদ্দুল মুহতার ১০/৪৪৯)
স্তন্যপান ও বৈবাহিক নিষিদ্ধতা : এমন প্রকৃত হিজড়ার স্তনে যদি দুধ আসে তবে তা কাউকে পান করানোর দ্বারা রাজাআত তথা বৈবাহিক নিষিদ্ধতা সাব্যস্ত হবে না। কেননা সে নারী (দুধমাতা) হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট নয়; যা রাজাআত সাব্যস্ত হওয়ার পূর্বশর্ত। তবে যদি কোনো পুরুষ বা নারী তাকে উত্তেজনার সাথে চুমু দেয় তাহলে এর দ্বারা বৈবাহিক নিষিদ্ধতা সাব্যস্ত হয়ে যাবে। অর্থাৎ চুম্বনকারী পুরুষের জন্য হিজড়ার মা এবং নারীর জন্য এ হিজড়ার বাবাকে বিবাহ করা হারাম হয়ে যাবে। (ফাতাওয়া শামী ১০/৪৪৯, আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ ২০/২৭)
বিবাহ-শাদী : এ শ্রেণীর হিজড়াকে যদি কোনো পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করা হয় আর উক্ত পুরুষের জন্য তার সাথে সহবাস করা সম্ভব হয়, তাহলে উক্ত বিবাহ বহাল থাকবে। এমনিভাবে সে যদি কোনো নারীকে বিবাহ করে এবং সে নারীর সাথে সহবাস করতে সক্ষম হয় তাহলেও উক্ত বিবাহ বহাল থাকবে। আর যদি সে সহবাসে সক্ষম না হয় এবং স্ত্রী আদালতের শরণাপন্ন হয়, তাহলে আদালত স্বামীকে এক বছর সময় দিবে। উক্ত সময়ের মধ্যেও যদি সে সহবাসে সক্ষম না হয় তাহলে আদালত তাদের মাঝে বিবাহ বিচ্ছেদ করে দিবে। (কিতাবুল আসল লি ইমাম মুহাম্মাদ ৯/৩২৩, আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুওয়াইতিয়্যাহ ২০/২৭)
বিচার-ফয়সালা এবং সাক্ষ্যদান : এ শ্রেণীর হিজড়ারা সাক্ষ্যদান এবং বিচার ফয়সালার ক্ষেত্রেও নারীদের আওতাভুক্ত। একজন পুরুষ এবং একজন নারীর সাথে তার সাক্ষ্য একজন নারীর ন্যায় গণ্য হবে। (আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুওয়াইতিয়্যাহ ২০/২৮)
স্বীকারোক্তি গ্রহণ : এরা যদি নিজের ব্যাপারে কোনো কিছুর স্বীকারোক্তি প্রদান করে, যার দরুণ তার উত্তরাধিকার অথবা দিয়ত তথা রক্তপণ হ্রাস পায় তাহলে তা গ্রহণ করা হবে। আর যদি এমন দাবী করে যার দ্বারা এগুলো বৃদ্ধি পায় তবে তা গ্রহণ করা হবে না। কারণ এ ব্যাপারে সে অন্যকে দোষারোপকারী। বিধায় অন্যের ব্যাপারে তার কথা গ্রহণ করা হবে না। আর ইবাদত এবং অন্যান্য বিষয়ে তার কথা গ্রহণ করা করা হবে। কেননা ইবাদতের বিষয়টি বান্দা এবং আল্লাহ তা‘আলার মধ্যকার ফয়সালার বিষয়। (আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুওয়াইতিয়্যাহ ২০/২৮, আলমুগনী ৬/৭৭, ৪/৪৬১, ৪৬২)
গোসল ও কাফন-দাফন : এ ধরনের প্রকৃত হিজড়াদের ইন্তিকালের পর কোনো নারী-পুরুষ তাদেরকে গোসল দিবে না; বরং তায়াম্মুম করিয়ে দিবে। এক্ষেত্রে যে তায়াম্মুম করাবে সে যদি হিজড়ার মাহরাম না হয় তাহলে হাতে কোনো কাপড় পেঁচিয়ে নিবে। কারণ পুরুষের জন্য কোনো নারীকে এবং নারীর জন্য কোনো পুরুষকে গোসল দেয়া শরীয়তসম্মত নয়। একজন মুসলিম হিসেবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে তার জানাযার নামায পড়া হবে এবং তাকে নারীদের ন্যায় পাঁচ কাপড়ে কাফন পরানো হবে। কেননা সে যদি নারীদের অন্তর্ভুক্ত হয় তবে তো সুন্নাতসম্মত পন্থায় কাফন পরানো হলো। আর যদি পুরুষের অন্তর্ভুক্ত হয় তাহলেও কোনো অসুবিধা নেই। কারণ পুরুষ তার জীবদ্দশায় তিনের অধিক কাপড়ও পরিধান করে।
দাফনের সময় মাহরাম ব্যক্তিই তাকে কবরে নামাবে এবং চাদর ইত্যাদি দ্বারা তার কবরকে ঢেকে নিবে, এটা উত্তম এবং মুস্তাহাব। কেননা যদি সে প্রকৃতপক্ষে নারীর অন্তর্ভুক্ত হয় তবে তো তা ওয়াজিবের পর্যায়ভুক্ত। আর যদি সে পুরুষের অন্তর্ভুক্ত হয় তবে চাদর দ্বারা ঢাকার দরুণ কোনো সমস্যা হবে না। (ফাতাওয়া শামী ১০/৪৫০, আলবাহরুর রায়েক ৭/৩৩৭, কিতাবুল আসল লি ইমাম মুহাম্মাদ ৯/৩২৩, কামুসুল ফিকহ ৩/৩৭৯)
উত্তরাধিকার বিধান : উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের ক্ষেত্রে এমন প্রকৃত হিজড়াগণ নারী-পুরুষের প্রাপ্ত অংশের মধ্য হতে কম অংশ যেটা হবে তাকে তাই দেয়া হবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো মৃত ব্যক্তি এক ছেলে, এক মেয়ে এবং একজন হিজড়া সন্তান রেখে মারা যায়, তাহলে হিজড়াকে মেয়ের সমপরিমাণ অংশ দেয়া হবে। তদ্রƒপ মৃত ব্যক্তি যদি এক ছেলে এবং এক হিজড়া রেখে মারা যায় তাহলে ছেলে পাবে দুই তৃতীয়াংশ সম্পদ আর হিজড়া পাবে এক তৃতীয়াংশ সম্পদ। (ফাতাওয়া শামী ১০/৪৫০, আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুওয়াইতিয়্যাহ ২০/৩২, আররাযী শরহে সিরাজী; পৃষ্ঠা ৯৪)
শেষকথা
মূলত ইসলামী সমাজ একটি একক ইউনিট। এখানে মানুষ পারস্পরিক সংহতি ও সমতার ভিত্তিতে বসবাস করে। কোনো ব্যক্তির প্রতি ইসলাম কোনো প্রকার বিরূপ মনোভাব পোষণ করে না। কাউকে সমাজের অপ্রয়োজনীয় উপাদান মনে করে না। ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে মানব মর্যাদার মানদণ্ড কোনো বংশ, গোত্র, বর্ণ, ভাষা, সুস্থতা, সৌন্দর্য আর নারী-পুরুষের তারতম্যের ভিত্তিতে নিরূপণ হয় না। একমাত্র তাকওয়া এবং খোদাভীরুতাই এ মর্যাদার মাপকাঠি। অপরের প্রয়োজন পূরণ আর অধিকার অর্জনের প্রতি ইসলাম শুধু দিকনির্দেশনা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। এ ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহ এবং প্রেরণাও দিয়েছে।
ইসলাম সক্ষম ব্যক্তিকে অক্ষম ব্যক্তির স্নেহ-মমতা, শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আর সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতার ব্যাপারে দায়িত্ব প্রদান করেছে। এর দ্বারা শুধুমাত্র সৃষ্টিজীবের প্রতিই মমতা প্রদর্শন হয় না। এতে রয়েছে বান্দার ইহকাল এবং পরকালীন মহাসফলতা। সর্বোপরি রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি এবং নৈকট্য অর্জন। তাঁর সাথে বান্দার তৈরি হয় সুসম্পর্কের সেতুবন্ধ; যা প্রতিটি মুমিন-মুসলমানের জীবনের একমাত্র চাওয়া পাওয়া।
বর্তমানে হিজড়াদেরকে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র যেভাবে অবজ্ঞা আর উপেক্ষা করছে, ইসলাম তা কখনো সমর্থন করে না। সমাজের একজন সদস্য হিসেবে, রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে সর্বোপরি একজন মানুষ হিসেবে সব ধরনের অধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্ম একজন হিজড়াকে পরিপূর্ণ অধিকার দিয়েছে। পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে তাদেরকে একঘরে এবং ছিন্নমূল করে রাখা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই গর্হিত ও নিন্দনীয় কাজ।
আজ সভ্য সমাজে কোনো লোক যদি মানবিক মান-মর্যাদার সাথে সমাজের আরো দশজনের সাথে মিলেমিশে থাকে তাহলে সব রকম সামাজিক সুযোগ-সুবিধা তার জন্য অবারিত থাকে এবং দৈহিক, চৈত্তিক, তাত্ত্বিক সর্বপ্রকার ভালো-মন্দে তাদের সাথে তার ভাগাভাগি লেনদেন থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে যদি কোনো কারণে বিপথগামী হয়ে যায়, তবে দায়িত্ববোধসম্পন্ন ব্যক্তিরা তার সে বিপথগামিতার দায় সম্পূর্ণ তার একার উপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত বসে থাকতে পারে না এবং থাকেও না। মাদক বিরোধী আন্দোলনসহ অপরাপর সামাজিক আন্দোলনসমূহই এর জ্বলন্ত এবং চাক্ষুষ প্রমাণ। হিজড়াদের তো এ রকম কোনো সুবিধাই নেই। তারা সর্বোতভাবে অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত। এ অবস্থায় বিপথগামিতাই তাদের অনিবার্য পরিণতি হওয়ার কথা এবং সঙ্গত কারণেই তার সবটা দায় সমাজপতিদের উপর বর্তায়।
অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়, তাদের প্রতিবন্ধীত্বকে কেউ স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয় না; বরং একটি শারীরিক বা মানসিক সমস্যা বিবেচনা করে চিকিৎসার উপায় নিয়ে এগিয়ে যায়। যেন তারাও মানুষ হিসেবে সুস্থ এবং স্বাভাবিক ধারায় ফিরে আসতে পারে। ঠিক তেমনিভাবে লিঙ্গ প্রতিবন্ধীদের ব্যাপারেও যদি একটি দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করে উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে তাদেরকেও শারীরিক জটিলতা থেকে মুক্ত করে একটি সুস্থ ও সুনির্দিষ্ট ধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
পাশাপাশি পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র যদি তাদের ব্যাপারে সচেতন হয় এবং শিক্ষা-দীক্ষাসহ রাষ্ট্রীয় সকল অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানে সচেষ্ট হয়, তাহলে অচিরেই তাদেরকে ভাসমান এ জীবনধারা থেকে সুস্থ, সুন্দর এবং স্বাভাবিক জীবন ধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। তাই সমাজের প্রতিটি সচেতন নাগরিক বিশেষত হক্কানী আলেম-উলামা, ছাত্র, মসজিদের ইমাম-খতীব, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো হিজড়াদের ব্যাপারে ইসলামী মূল্যবোধের আলোকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা। তাদের সকল অধিকার আদায়ের প্রতি জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। দল, মত নির্বিশেষে সর্বসাধারণের মাঝে হিজড়া সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি এবং সঠিক অবস্থান তুলে ধরা।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে সেই চেতনা এবং সঠিক বুঝ-বুদ্ধি আর সচেতনতা দান করুন। আমীন।
তথ্যসূত্র : ১. কুরআনুল কারীম, ২. সহীহ বুখারী, ৩.সহীহ মুসলিম, ৪. কামূসুল ফিকহ, ৫. সুনানে বাইহাকী, ৬. আলমুগনী, ৭. তাফসীরে কুরতুবী,৮. আলমউসূআতুল ফিকহিয়্যাহ আলকুওয়াইতিয়্যাহ, ৯. আলবাহরুর রায়েক, ১০. কিতাবুল আসল লিইমাম মুহাম্মাদ রহ., ১১. ফাতহুল কাদীর, ১২. আলইনায়া আলা ফাতহিল কাদীর, ১৩. বাদাইয়ুসসানায়ি’, ১৪. ফাতাওয়া শামী, ১৫. আররাযী শরহে সিরাজী, ১৬. দৈনিক যুগান্তর, ১৭. দৈনিক প্রথমআলো, ১৮. দৈনিক সমকাল, ১৯. wordpress.com, ২০. সামাজিক বিজ্ঞান পত্রিকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টাডিজ, ২১. পট্টনায়েক, দেবদূত, ২২. Wilhelm,Amar Das, 23. Peopl of the third sex, 24. Unitarin universalist association, 25. Winjuam,Angelina, 26. Homo sexuality in Buddhism, Matyner, Andrwe, 27. Born Eunuche librery, টেমপ্লেট, Biberef
এই লেখাটির শুরুর দিকে হিজড়াদের ইংরেজিতে ট্রান্সজেন্ডার এবং আরবীতে খুনছা বলা হয়েছে।যা সম্পূর্ণ ভুল। হিজড়া আর ট্রান্সজেন্ডার এক নয়। আশা করি বিষয়টি সংশোধন করে নিবেন।