যাঁর আগমনে ধন্য হলো এ পৃথিবী

সৈয়দ কামারুজ্জামান নাজির

ইসলামপূর্ব আরব প্রেক্ষাপট

পিপাসায় কাতর ব্যক্তির কাছে একটু পানি যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঠিক তেমনই উম্মাহর জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো নবীজী  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাব ও আগমন। পূর্বেকার আরব প্রেক্ষাপট আলোকপাত করার দ্বারা তা স্পষ্ট হয়ে ওঠবে। আরবভূমি ছিলো ভৌগলিকভাবে পৃথিবীর দুর্ভেদ্য ও সুসংহত জায়গা। তিন দিক ছিলো সাগর দ্বারা বেষ্টিত। তাছাড়া অভ্যন্তরীণভাবে পানিশূন্য মরু ও সুউচ্চ পাহাড় দ্বারা সংরক্ষিত। এজন্য বহিরাগত কেউ তাদের ওপর শাসনের লাঠি প্রয়োগ করতে পারেনি। তখনকার দুই পরাশক্তি রোম-পারস্য আরবকে শাসন করার সাহস হয়নি। ফলে কারো অধীনে তারা শাসিত ছিলো না। (তারিখে উম্মতে মুসলিমা ১/১০৩, আল-মানহাল পাবলিশার, পাকিস্তান)

তবে তাদের মাঝে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু রাষ্ট্র ছিলো। শাসন ক্ষমতা স্বতন্ত্রভাবে তাদের হাতেই ছিলো। এছাড়া শাসন ছিলো গোত্রকেন্দ্রিক। গোত্রপতি যিনি তিনি হতেন তাদের শাসক। যুদ্ধ, সন্ধি সবক্ষেত্রে তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত এবং সকলের জন্য আবশ্য পালনীয়। আরবদের মধ্যে হিজাজের গোত্রপতিরা ছিলো কিছুটা ভিন্ন। আরবে তাদের ছিলো ভিন্ন অবস্থান ও মর্যাদা। ন্যায়নীতি ও নিষ্ঠতা তাদের মাঝে তখনও ছিলো। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অধিকাংশ আরব ছিলো মিল্লাতে ইবরাহিমের অনুসারী। আদিকালে তাদের মধ্যে পূজা ও অর্চনার প্রথা ছিলো না। সময়ের পরিক্রমায় দীন বিকৃত হয়ে তাদের মাঝে পাথর ও মূর্তি পূজা দেখা দেয়। আমর ইবনে লুহাইর মাধ্যমে এ প্রথা শুরু হয়। সে শাম থেকে একটি মূর্তি মক্কায় নিয়ে আসে এবং লোকজনকে তার উপাসনায় উদ্বুদ্ধ করে। তার সম্পর্কে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

আমি আমর ইবনে লুহাইকে জাহান্নামে তার নাড়িভুরি টানতে দেখেছি। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ২৮৫৬)

পরবর্তীতে অবস্থা এমন হয় যে, আরবের ঘরে ঘরে মূর্তি ঢুকে পড়ে। মিল্লাতে ইবরাহীমের বিকৃতিসাধনের কারণে সামাজিকভাবেও তাদের অবক্ষয় হয়। পরস্পর যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রাহাজানি প্রচুর পরিমাণে দেখা দেয়। কন্যা সন্তানকে অশুভ ভেবে জীবন্ত পুঁতে ফেলার প্রথা চালু হয়। এভাবে নানা দিক দিয়ে আরববাসীর নৈতিক ও সামাজিক স্খলন হয়। তাদের চারিত্রিক ও সামাজিক সংশোধনের জন্য জরুরী হয়ে ওঠছিলো হিতাকাঙ্ক্ষী একজন মুক্তিদূত আবির্ভাবের। এতো অবক্ষয়ের মাঝে আরবদের স্বভাবজাত ভালো কিছু গুণ ছিলো। সততা-আমানতদারি ও আভিজাত্য ছিলো; মিথ্যা ও প্রতারণা ছিলো না। (আর-রাহীকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ২১-৫২, দারুল ওয়াফা, মিশর)

যার দৃষ্টান্ত আবূ সুফিয়ান রাযি. ও হিরাকলের কথোপকথনে ফুঠে ওঠেছে। এসব বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য তাদের অন্যদের চেয়ে ভিন্নতা দান করেছিলো।

আবির্ভাবের সময়কালে ঐতিহাসিক ঘটনা

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের সময় আরবে কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে। যা থেকে চিন্তাশীল ব্যক্তি অনুধাবন করতে পারে, অচিরেই আরবে বড় ধরনের কোন পরিবর্তন হবে। সেসব ঐতিহাসিক ঘটনার অন্যতম ও প্রসিদ্ধ হলো হস্তিবাহিনীর ঘটনা। সীরাত ও ইতিহাস গ্রন্থ থেকে হস্তিবাহিনীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ হলো-

আবিসিনিয়ার নাজাশী কর্তৃক ইয়ামানের প্রশাসক ছিলো আবরাহা। সে ইয়ামানে এক বিশাল গির্জা নির্মাণ করে। তার উদ্দেশ্য ছিলো মানুষ মক্কায় কাবাঘর যিয়ারতে না গিয়ে এখানে সমবেত হবে। আরবরা তাতে ক্ষুব্ধ হয়। ফলে এক আরব সেই গির্জায় ঢুকে অপবিত্র করে আসে। আবরাহা বিষয়টি জানার পর ফুঁসে ওঠে এবং কাবা ধ্বংস করার শপথ করে। অতঃপর সে বাহিনী প্রস্তুত করে মক্কার দিকে রওয়ানা হয়।

পবিত্র ঘর কাবা ধ্বংস করার অশুভ লক্ষ্যে দম্ভভরে এগিয়ে চলে। পথে বিভিন্ন আরব গোত্রের বাধা আসে কিন্তু তার বিশাল বাহিনীর হাতে তারা পরাভূত হয়। গোত্রপতিদের বন্দি করে করে মক্কার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। একপর্যায় মক্কার কাছাকাছি মুগাম্মাছে এসে যাত্রাবিরতি করে। সেখান থেকে মক্কার ভেতরকার অবস্থা জানার জন্য হুনায়তা নামক এক দূত পাঠায়। সে মক্কায় এসে আব্দুল মুত্তালিবের সাথে সাক্ষাত করে এবং আবরাহার বার্তা দিয়ে তাকে নিয়ে যায়।

সেখানে যু-নফর নামে এক রাজবন্দির সাথে আব্দুল মুত্তালিবের দেখা হয়। যু-নফরের সাথে তার পুরোনো বন্ধুত্ব ছিলো। এ কঠিন বিপদে তার সাহায্য চাইলে সে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে। তবে সে তার পুরনো বন্ধু উনাইসকে তার পরিচয় তুলে সাহায্যের কথা বলে। উনাইস তাকে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়। আব্দুল মুত্তালিবকে সে আবরাহার দরবারে নিয়ে যায় এবং কীর্তি বর্ণনা করে।

আব্দুল মুত্তালিব সুদর্শন ও ভাবগাম্ভীর্যের অধিকারী ছিলেন। এতে আবরাহা অভিভূত হয়ে তার সম্মানে আসন থেকে নিচে নেমে বসে এবং তার বক্তব্য শুনতে আগ্রহী হয়। আব্দুল মুত্তালিব বক্তব্যে তার দুইশো উট দাবি করেন যা সে লুট করে নিয়েছিলো। আবরাহা তার দাবিতে অবাক হয়ে বলে আমি প্রথমে তোমাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম কিন্তু এখন তোমার অদ্ভূত দাবি শুনে অবাক হচ্ছি। তোমার পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য কাবা ধ্বংস করতে এসেছি এ সম্পর্কে তুমি কিছু বলছো না; তুমি উট চাচ্ছো! তখন আব্দুল মুত্তালিব বলেন কাবার মালিক কাবা রক্ষা করবেন, আমি উটের মালিক তাই উট চাই।

অবশেষে তিনি তার উট নিয়ে গোত্রে ফিরে গেলেন এবং লোকজনকে মক্কা ছেড়ে পাহাড়ে চলে যেতে নির্দেশ করেন। মক্কা ছাড়ার সময় তিনি কাবার গিলাফ ধরে প্রার্থনা করেন।

পরদিন প্রত্যুষে আবরাহা আক্রমনের জন্য বাহিনীকে চূড়ান্তরূপে প্রস্তুত করে। বাহিনীতে তখন অনেক হাতি ছিলো এজন্য তাকে হস্তিবাহিনী বলা হয়। হাতিগুলো মক্কামুখী করা হলে নুফাইল ইবনে হাবীব প্রধান হাতি মাহমুদের কানে ফিসফিস করে বলে- হে মাহমুদ! হাঁটু গেড়ে বসে যাও অথবা যেখান থেকে এসেছো সেখানে ফিরে চলো, মনে রেখো তুমি পবিত্র নগরীতে আছো। হাতি তখন হাঁটু ফেলে বসে যায়। হাতি সাধারণত হাঁটু ফেলে বসে না। নুফাইল তখন বাহিনী ছেড়ে পাহাড়ে চলে যায়। সৈন্য বাহিনী কোনভাবেই হাতিকে মক্কামুখী চালাতে পারছে না। অন্যদিকে চালালে ঠিকই চলতে শুরু করে।

আল্লাহ পাক আসমানী গযব হিসেবে সমুদ্র থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি প্রেরণ করেন। পাখিগুলোর ঠোঁট ও পায়ে ছোট ছোট কঙ্কর ছিলো। আকাশ থেকে সেই কঙ্কর নিক্ষেপে হস্তিবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কঙ্কর যার শরীরে বিঁধেছে সে ধ্বংস হয়েছে। ফলে আবরাহা ইয়ামানে ফেরার পথ ধরে। কিন্তু সে পথেই মারা যায়। তার শরীর থেকে চামড়া ও গোশত খসে পড়ছিলো। এভাবে আল্লাহ তা‘আলা দাম্ভিক ও অহঙ্কারীদেরকে ধ্বংস করে তার পবিত্র ঘর রক্ষা করেন।

সূরা ফীলে আল্লাহ পাক কুরাইশদের ওপর এ নিয়ামতের কথা বিবৃত করেছেন। এছাড়া নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাতা আমেনা তাঁকে গর্ভধারণের সময় একটি অলৌকিক স্বপ্ন দেখেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

আমি আমার সেই স্বপ্ন যা তিনি দেখেছিলেন তার থেকে একটি নূর বিদীর্ণ হয়ে শামের প্রসাদসমূহ আলোকিত করেছিলো। (মুসনাদে আহমাদ; হাদীস ১৭২০৩)

তাছাড়া আব্দুল মুত্তালিব কর্তৃক গায়েবী ইশারায় যমযম কূপ খনন সবই ছিলো মুহাম্মাদে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শান-শওকতের পূর্ববার্তা। (সীরাতে ইবনে হিশাম ১/১১১, দারুল হাদীস, কায়রো, মিশর)

জন্ম বৃত্তান্ত

৫৭১ ঈসায়ী সনে পৃথিবী আলোকিত করে আমেনার কোলে মানবতার মুক্তির দূত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম হয়। জন্ম তারিখ নিয়ে ইতিহাসবিদদের মতভেদ আছে। ২, ৮, ৯, ১০ ও ১২ তারিখের মত আছে। তবে এ বিষয়ে সকলেই একমত যে, তাঁর জন্ম হস্তিবাহিনীর বছর রবিউল আউয়াল মাসের সোমবারে হয়েছে।

এক্ষেত্রে মতভেদ হলো তারিখ নির্ধারণের ক্ষেত্রে। ইবনে আব্দুল বার -ইসতিআব- গ্রন্থে মতভেদ বর্ণনা করে আট তারিখের পর নয় তারিখ তাঁর জন্মকে অগ্রগণ্য করেছেন। উমর ইবনে দিহয়াহ -আত-তানবীর ফী মাওলিদিস সিরাজিল মুনীর- গ্রন্থে লিখেন, এ মতের ওপর ইতিহাসবিদদের ঐক্যমত হয়েছে।

বর্ণনার দৃষ্টিকোণের পাশাপাশি বাস্তবতায়ও এটা অগ্রগণ্য। প্রসিদ্ধ জ্যোতির্বিদ আল্লামা মাহমুদ পাশার গাণিতিক হিসেবেও বের হয়েছে যে, ৫৭১ ঈসায়ী সনের ২০ এপ্রিল সোমবার ৯ রবিউল আউয়াল হয়।

আল্লামা যাহিদ কাউসারী রহ. লিখেন, ১২ তারিখ জন্মগ্রহণের মতটি সর্বাধিক দুর্বল মত। কারণ এই মতটিকে ইবনে ইসহাক রহ. কোন সনদ ছাড়া উল্লেখ করেছেন। (মাকালাতুল কাউসারী, পৃষ্ঠা ৩৬২-৩৬৩; আল-মাকতাবাতুল তাউফীকিয়্যা, সৌদিআরব)

নবীজীর আদর্শ মিলাদ নাকি সীরাত

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লামের জন্ম ছিলো মানবজাতির জন্য কল্যাণ ও বরকতস্বরূপ। কিন্তু নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লামের জন্মকে উপলক্ষ্য করে দেশে দেশে ঈদ বা মিলাদ নামে যেসব কর্মকাণ্ড হয় তা অনেক ক্ষেত্রেই শরীয়তগর্হিত।

ঈদে মিলাদুন্নবী ইসলামের শুরু যুগে ছিলো না। হিজরী ছয় শতকে এর উৎপত্তি হয়। ইরবিলের বাদশাহ মুজাফফার উদ্দীনের মাধ্যমে এ প্রথা চালু হয়। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া ৭/১৪০, দারুত তাউফীকিয়্যা লিত-তুরাস, কায়রো, মিশর)

বর্তমানে আমাদের কতিপয় ব্যক্তিবর্গ তা গুরুত্বের সাথে পালন করে আসছে। এ দিনে বিভিন্ন আলোকসজ্জা, অনুষ্ঠান ও র‌্যালী হয়ে থাকে। এগুলো না করলে অনেকের তিরস্কারের শিকার হতে হয়। কিন্তু সুস্থ-বিবেকে ভাবার সময় হয় না যে, ইসলাম তা সমর্থন করে কিনা! একটু চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, কুরআন-সুন্নাহ এরূপ কর্মকাণ্ডকে মোটেই সমর্থন করে না। কুরআনে কারীমে আল্লাহ পাক বলেন,

তাদের কি এমন শরীক দেবতা আছে, যারা তাদের জন্যে সে ধর্ম সিদ্ধ করেছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি। (সূরা শূরা; আয়াত ২১)

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

আমাদের দীনে নেই এমন বিষয় যে নতুন আবিষ্কার করবে তা পরিত্যক্ত। (সহীহ বুখারী; হাদীস ২৫৫০)

এ থেকে স্পষ্ট হয় যে, ইসলাম অসমর্থিত নব আবিষ্কৃত কিছুকে দীন হিসেবে গ্রহণ করা হলে তা পরিত্যক্ত। নববী যুগ ও সাহাবা-তাবেয়ীর যুগেও এ উপলক্ষ্য ছিলো, কিন্তু তারা মিলাদুন্নবী উৎসব করেননি। নববী আদর্শ অনুসরণে সাহাবীদের চেয়ে অগ্রবর্তী এই পৃথিবীতে কে আছে! সাহাবীদের কাছে জন্মোৎসব নববী আদর্শ নয় বলেই তা পালিত হয়নি, তাহলে কোন যুক্তিতে আমরা তা গ্রহণ করি। এছাড়া নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্টভাবে বলে গেছেন,

তোমরা আমার কবরকে (উপলক্ষ্য করে) উৎসব বানিয়ো না। (সুনানে আবু দাউদ; হাদীস ২০৪২)

এই হাদীসে ঈদ নয় এমন কিছুকে ঈদ বানাতে নিষেধাজ্ঞা করা হয়েছে। অর্থাৎ ঈদের মধ্যে যেভাবে দিন-তারিখ নির্ধারণ করে মানুষ সমবেত হয়, সেভাবে তোমরা দিন-তারিখ নির্দিষ্ট করে আমার কবরে সমবেত হয়ো না। এই হাদীস থেকে এই নির্দেশনাও পাওয়া যাচ্ছে যে, নির্দিষ্ট স্থানের মত নির্দিষ্ট সময়ে মনগড়াভাবে শরীয়তের নামে উৎসব না করা। অপর এক বর্ণনায় আছে,

তোমরা শুধু জুমু‘আর রাতকে অন্যান্য রাতের মধ্যে কিয়ামুল লাইলের জন্য নির্দিষ্ট করো না এবং শুধু জুমু‘আর দিনকে অন্যান্য দিনের মধ্যে রোযার জন্য নির্ধারণ করো না। (সহীহ মুসলিম; হাদীস ১১৪৪)

এই হাদীসে শরীয়ত নির্ধারিত ফযীলত আছে এমন দিনেও মনগড়া ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করতে নিষেধ করা হয়েছে। সুতরাং অন্যান্য ক্ষেত্রে নিজ থেকে কোন দিনকে শরীয়তের নামে প্রাধান্য দেওয়া যে অনুমোদিত নয় তা বলাই বাহুল্য।

উল্লেখ্য, উলামায়ে কেরাম জুমু‘আর দিন নফল ইবাদতের বিষয়কে অন্যান্য দলীলের ভিত্তিতে বৈধ বলেছেন। আর এই হাদীসের নিষেধাজ্ঞার অর্থ হলো, অধিক ইবাদত করতে গিয়ে যেন জুমু‘আর নামায আদায়ে দুর্বলতা সৃষ্টি না হয়। তবে ব্যাখ্যা যাই হোক উপরোক্ত মূলনীতি যে এই হাদীস থেকে সাব্যস্ত হয় তা নিয়ে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়।

কেউ কেউ বলে থাকেন, নবীজী আমাদের জন্য রহমত তাই খুশি হওয়া উচিত। প্রমাণ হিসেবে এ আয়াতটি পেশ করেন-

হে নবী! আপনি বলুন আল্লাহর ফযল ও রহমতের কারণে। সুতরাং এজন্য তাদের সন্তুষ্ট ও খুশি থাকা উচিত। (সূরা ইউনুস; আয়াত ৫৭-৫৮)

এর উত্তর হলো, এ আয়াতে দু’টি বিষয়কে আনন্দ-হরষের উপকরণ সাব্যস্ত করেছেন। একটি ফযল, অপরটি হলো রহমত। এতদুভয়ের মর্ম কী? এ সম্পর্কে আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহর ফযলের মর্ম কুরআন, আর রহমতের মর্ম হলো, তোমাদেরকে তিনি কুরআন অধ্যয়ন ও সে অনুযায়ী আমল করার তাওফীক দান করেছেন। তাছাড়া অনেক তাফসীরকারক মনীষী বলেছেন যে, ফযল অর্থ কুরআন আর রহমত অর্থ ইসলাম। (মা‘আরিফুল কুরআন; সংক্ষিপ্ত বাংলা অনুবাদ, পৃষ্ঠা ৬১১)

সুতরাং উক্ত আয়াত দ্বারা মিলাদুন্নবী সাব্যস্ত হয় না।

আবার কেউ বলেন, নবীজীর জন্ম সংবাদ শুনে আবূ লাহাব খুশিতে এক দাসীকে মুক্ত করে দেয়, যার দরূণ তার শাস্তি কিছুটা লাঘব হয়। সুতরাং এ থেকে বুঝা গেলো কারো জন্মকে উপলক্ষ করে খুশি হওয়া ও বরকতময় ভাবা জায়েয।

এর উত্তর হলো, মৌলিকভাবে কারো জন্মে খুশি হওয়া সমস্যা নয়; সমস্যা হলো খুশি প্রকাশের ধরন ও প্রকৃতি নিয়ে। নির্ধারিত দিনকে কেন্দ্র করে বিশেষ প্রকৃতির খুশি প্রকাশ করার মাঝেই যত বিপত্তি। (মা‘আরিফে হাকীমুল উম্মত, পৃষ্ঠা ১২৬-১৩৫)

আমাদের করণীয়

প্রকৃতপক্ষে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম উৎসবমুখর ও ঈদ পালনের জন্য হয়নি। তাঁর আবির্ভাব ছিলো উম্মাহর জন্য রহমতস্বরূপ। তাঁর আদর্শ ও জীবনচরিত হলো হেদায়াতস্বরূপ। তাঁর জীবনাদর্শ অনুসরণের মাঝে প্রকৃত ভালোবাসা ও আনুগত্য। ভালোবাসার নামে বছরে একদিন সমবেত হয়ে উৎসব করা তাঁর জীবনাদর্শ নয়। বরং তা বিজাতীয়দের অন্ধ অনুসরণ। আর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

যে ব্যক্তি বিজাতীদের অনুসরণ করবে সে তাদেরই দলভুক্ত। (সুনানে আবূ দাউদ; হাদীস ৪০৩১)

এজন্য নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবির্ভাবের মূল বার্তা অনুধাবন করতে হবে। কুফর-শিরক, বিদয়াত ও কুসংস্কার মুলোৎপাটনের জন্য আরবের বুকে তাঁর আবির্ভাব হয়েছিলো। এগুলো প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাঁর জন্ম হয়নি। ইতিহাস গ্রন্থে বিবৃত আছে, মক্কা বিজয়ের পর তিনি কাবা ঘরের সকল মূর্তি ভেঙে দিয়েছিলেন। কেননা মূর্তি বা ভাস্কর্য ইসলাম সমর্থন করে না। এছাড়া তিনি অনৈতিক কর্মকাণ্ড রুদ্ধ করেন। আরববাসীর চারিত্রিক শোধনও করেন। জাফর ইবনে আবূ তালিব রাযি. এর বর্ণনায় তা ফুটে উঠেছে।

আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজাশী যখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে জানতে চায়, তখন তিনি বলেন, হে বাদশাহ! আমরা ছিলাম জাহেলী যুগের মানুষ, আমরা মূর্তি পূজা করতাম, মৃত পশু খেতাম, অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার কাজ করতাম, সবলরা দুর্বলকে গ্রাস করে নিতো এরই মধ্যে আমাদের কাছে আমাদের থেকেই আবির্ভূত হলেন একজন নবী ও রাসূল, যার বংশীয় মর্যাদা, আমানতদারিতা, সততা ও ন্যায়-নিষ্ঠতা আমাদের জ্ঞাত ছিলো। তিনি আমাদেরকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করেন যাতে আমরা একত্মবাদে বিশ্বাসী হয়ে পাথর ও মূর্তিপূজা ছেড়ে দেই। তিনি আমাদেরকে সততা ও আমানতদারী এবং আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখতে বলেন। অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ করেন। নামাজ-রোযা ও যাকাতের আদেশ করেন। আমরা তাঁকে বিশ্বাস করে ঈমান এনেছি। এজন্য মক্কাবাসী আমাদের ওপর অত্যাচার শুরু করেছে। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আপনার দেশে আমরা হিজরত করেছি। (সীরাতে ইবনে হিশাম ১/২৩৫)

অতএব, তাঁর আদর্শ অনুকরণে আমাদের সফলতা ও মুক্তির পাথেয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম নমুনা। (সূরা আহযাব; আয়াত ২১)

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উত্তম জীবনাদর্শ সীরাত ও ইতিহাস গ্রন্থে বিস্তৃত হয়ে আছে। উম্মুল মুমিনীন আয়েশাকে রাযি. জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, তাঁর চরিত্র হলো কুরআন। (মুসনাদে আহমাদ; হাদীস ২৪৬৪৫)

কুরআন তাঁর উত্তম নমুনা। যে ব্যক্তি তা আঁকড়ে ধরবে সে ভ্রষ্ট হবে না। তাঁর উত্তম জীবনাদর্শ হলো সত্যবাদিতা ও আমানতদারী। মিথ্যা, প্রতারণা ও ধোঁকা তাঁর জীবনে নেই। এজন্য বাল্যকালেই তাঁর উপাধী হয় আল-আমিন। (সীরাতে ইবনে হিশাম ১/১৩৮; দারুল হাদীস কায়রো, মিশর)

তার জীবনচরিত ছিলো আমাদের জন্য অনুসরণীয়। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক দৃষ্টিকোণে তিনি আমাদের উত্তম জীবনাদর্শ। তিনি ছিলেন একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক। জুলুম-শোষণ, স্বজনপ্রীতি ও অর্থলোভ তাঁর মাঝে ছিলো না। যার দৃষ্টান্ত মাখযুমী গোত্রের এক মহিলার চুরি সংক্রান্ত ঘটনায় ফুটে উঠেছে। অপরাধী সম্ভ্রান্ত ও আভিজাত্যশীল হওয়ায় উসামা রাযি. বিচারাদেশ উড্ড করার সুপারিশ করেন। উসামার আবদার শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেলো। ধমক দিয়ে বললেন, উসামা! তুমি কী আল্লাহ প্রদত্ত আইনে সুপারিশ করছো? শুনে রাখো, মুহাম্মাদের মেয়ে ফাতিমাও যদি চুরি করে তারও হাত কাটা হবে। (সহীহ বুখারী; হাদীস ৪৩০৪)

কিন্তু আজকের সমাজ ও আমাদের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। গুম, খুন, লুটতরাজ ও প্রতারণা স্বাভাবিক বিষয়। নেতা বা দলীয় লোক হলে সাত খুন মাফ।  ধনী বা প্রভাবশালী হলে তিনি আদালত ও বিচারের ঊর্ধ্বে। এসব সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় রোধ করার জন্য নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবির্ভাবের মূলবার্তা আমাদের অনুধাবন করতে হবে। সেজন্য প্রচুর পরিমাণে সীরাত অধ্যয়ন ও আলোচনা করা জরুরী। ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবন সর্বত্র সে জীবনাদর্শ বাস্তবায়ন করতে হবে। তবেই হবে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রকৃত ভালোবাসা ও অনুসরণ।

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *