মাওলানা মাসীহুল্লাহ মুসান্না
রমাযানের রোযার হুকুম
ঈমান ও নামাযের পর রমাযান মাসের রোযা রাখা ইসলামের তৃতীয় ফরয। কোন মুসলমান যদি এই ফরযকে অস্বীকার করে, তাহলে তার ঈমান থাকবে না। প্রত্যেক বোধসম্পন্ন, প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির উপর রমাযানের রোযা রাখা ফরয। এমন ব্যক্তি যদি শরঈ কোন উযর ব্যতীত রোযা না রাখে, তাহলে সে ফাসেক ও গুনাহগার সাব্যস্ত হবে। -সূরা বাকারা : ১৮৫, জাওয়াহিরুল ফিক্হ ৩ : ৫১৮।
রোযার পরিচয়
শরীয়তের দৃষ্টিতে রোযা হলো, সুবহে সাদিক তথা যখন থেকে ফজর নামাযের সময় শুরু হয়, তখন থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোযার নিয়্যতে পানাহার ও স্ত্রীসহবাস থেকে বিরত থাকা। -ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়্যাহ ১ : ১৯৪, আদ-দুররুল মুখতার ২ : ৩৭০।
রোযার নিয়্যত
কোন কিছু করা বা না করার মনে মনে ইচ্ছাপোষণ করাই নিয়্যত। এ জন্য মুখে উচ্চারণ করা জরুরী নয়।
রোযার জন্য নিয়্যত করা শর্ত। নিয়্যত করা ছাড়া যদি কেউ সারাদিন না খেয়ে থাকে, এতে তার রোযা আদায় হবে না।
ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার পূর্বেই রমাযানের রোযার নিয়্যত করে নেয়া উত্তম। তবে সে সময় না করলেও কোন অসুবিধা নেই, বেলা এগারোটা পর্যন্ত নিয়্যত করে নেয়ার সুযোগ রয়েছে।
নিয়্যত করার ক্ষেত্রে মনে মনে শুধু এতটুকু ভেবে নেয়াই যথেষ্ঠ যে, আমি আজ রোযা রাখছি। -ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়্যাহ ১ : ১৯৫, জাওয়াহিরুল ফিক্হ ৩ : ৫১৮।
রোযা রেখে যে সমস্ত কাজ করলে রোযা ভেঙ্গে যাবে
রোযা রেখে কেউ যদি স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে পানাহার কিংবা স্ত্রী সহবাস করে, তাহলে তার রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং তার উপর কাযা ও কাফ্ফারা উভয়টি ওয়াজিব হবে। -আদ-দুররুল মুখতার ২ : ৪০৯।
তবে কিছু কাজ এমন রয়েছে, যেগুলো করার দ্বারা রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং শুধু কাযা ওয়াজিব হবে। কিন্তু, কাফ্ফারা ওয়াজিব হবে না। সেগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো,
১. ইচ্ছাকৃতভাবে মুখ ভরে বমি করা। -জামে তিরমীযী (৭২০), হিদায়া ২ : ৩৩৫ (ফাতহুল কদীর যুক্ত মুদ্রণ)।
২. কুলি করতে গিয়ে গলায় পানি চলে যাওয়া। -আদ-দুররুল মুখতার ২ : ৪০১।
৩. স্বাভাবিকভাবে যেসব জিনিস খাওয়া হয় না, যেমন, কাঁচা গম, লোহা ইত্যাদি; এমন জিনিস খেয়ে ফেলা। -আদ-দুররুল মুখতার ২ : ৪০৩।
৪. আগরবাতি ইত্যাদি জাতীয় কোন কিছুর ধোঁয়া ইচ্ছাকৃতভাবে গ্রহণ করা। -আদ-দুররুল মুখতার ২ : ৩৯৫।
৫. ধূমপান করা। -আদ-দুররুল মুখতার ২ : ৩৯৫।
৬. ভুলে কোন কিছু খেয়ে ফেলার পর রোযা ভেঙ্গে গেছে মনে করে ইচ্ছাকৃতভাবে কোন কিছু আহার করা। -আদ-দুররুল মুখতার ২ : ৪০১।
৭. এখনও সূর্যাস্ত হয়নি, কিন্তু হয়ে গেছে ভেবে ইফতার করে নেয়া অথবা সময় আছে ভেবে সাহরী করা; অথচ সাহরীর সময় শেষ হয়ে গেছে। -আদ-দুররুল মুখতার ২ : ৪০৫।
রোযা রেখে যে সব কাজ করার দ্বারা রোযা ভাঙ্গে না, কিন্তু মাকরূহ হয়ে যায়
১. প্রয়োজন ছাড়া কোন কিছু চাবানো। -আদ-দুররুল মুখতার ২ : ৪১২।
২. বিনা প্রয়োজনে কোন কিছুর স্বাদ গ্রহণ করা। -আদ-দুররুল মুখতার ২ : ৪১২।
৩. টুথপেস্ট/পাউডার দিয়ে দাঁত ব্রাশ করা। -হিদায়া ২ : ৩৪৪ (ফাতহুল কদীরযুক্ত মুদ্রণ), ইমদাদুল ফাতাওয়া ৪ : ৩৭১-৩৭২।
৪. সারাদিন অপবিত্র অবস্থায় গোসল করা ব্যতীত থাকা। -জাওয়াহিরুল ফিক্হ ৩ : ৫১৯।
৫. অপর ভাইয়ের গীবত-শেকায়েত করা। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ (৮৯৮৩)।
৬. কারো সাথে বকা-ঝকা ও ঝগড়া-বিবাদ করা। -জাওয়াহিরুল ফিক্হ ৩ : ৫১৮।
৭. রোযা রেখে এমন কোন কাজ করা, যার দ্বারা শরীরে দুর্বলতা সৃষ্টি হয়। -আদ-দুররুল মুখতার ২ : ৪২০।
যে সমস্ত কাজ করার কারণে রোযা ভাঙ্গে না এবং মাকরূহও হয় না
১. মিসওয়াক করা। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ (৯১৪৮), ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়্যাহ ১ : ১৯৯।
২. তেল লাগানো। -আদ-দুররুল মুখতার ২ : ৪১৭।
৩. সুরমা ব্যবহার করা। -আদ-দুররুল মুখতার ২ : ৪১৭।
৪. সুগন্ধি ব্যবহার করা। -ফাতাওয়ায়ে শামী ২ : ৪১৭।
৫. গরম অথবা পিপাসার কারণে গোসল করা। -আদ-দুররুল মুখতার ২ : ৪১৯।
৬. ভুলে কোন কিছু পানাহার করা। -সুনানে কুবরা লিননাসায়ী (৩২৬২)।
৭. অনিচ্ছাকৃতভাবে গলার ভেতরে ধোঁয়া, ধুলা-বালু, কিংবা মশা ইত্যাদি চলে যাওয়া। -তাবয়ীনুল হাক্বায়িক ১ : ৩২৪।
৮. নিজে নিজেই বমি করে দেয়া। -সহীহ ইবনে খুযাইমাহ (১৯৭৩)।
৯. স্বপ্নদোষ হওয়া। -সহীহ ইবনে খুযাইমাহ (১৯৭৩)।
১০. দাঁত থেকে রক্ত বের হয়ে যদি গলায় না চলে যায়, তাহলে রোযার কোন সমস্যা হবে না। -আল-বাহরুর রাইক ২ : ২৯৪।
যেসব ক্ষেত্রে রোযা না রাখার অনুমতি রয়েছে
১. অসুস্থতার কারণে রোযা রাখার সক্ষমতা না থাকা।
২. অসুস্থ ব্যক্তির অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা হওয়া।
৩. গর্ভবতী নারী, রোযা রাখার দ্বারা তার নিজের কিংবা বাচ্চার কোন ক্ষতির আশঙ্কা করা।
৪. দুগ্ধপোষ্য বাচ্চার ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে মা কিংবা যে মহিলা দুধ পান করায়, তার জন্য রোযা না রাখার অনুমতি রয়েছে।
৫. যদি দীনদার, অভিজ্ঞ চিকিৎসক কোন অসুস্থ ব্যক্তি কিংবা খুবই ক্ষুধার্ত বা পিপাসার্ত ব্যক্তির ব্যাপারে এই পরামর্শ দেয় যে, রোযা ভেঙ্গে ফেলতে হবে; নইলে মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে, সেক্ষেত্রে এমন ব্যক্তির জন্যও রোযা না রাখার অনুমতি রয়েছে। -আদ-দুররুল মুখতার ২ : ৪২২।
৬. মুসাফির ব্যক্তি, যে কমপক্ষে ৭৮ কি.মি. দূরত্বে সফর করেছে বা করছে, তার জন্যও রোযা না রাখার অনুমতি রয়েছে। তবে ভ্রমণে যদি তার কোন কষ্ট না হয়, তাহলে তার জন্য রোযা রেখে নেয়াই উত্তম। -আদ-দুররুল মুখতার ২ : ৪২৩।
উল্লেখ্য, যদি কোন ব্যক্তি রোযাবস্থায় সফর শুরু করে, তাহলে তার জন্য রোযা পুরো করা জরুরী। অনুরূপভাবে কেউ যদি কিছু খেয়ে-দেয়ে তারপর সফর থেকে ফিরে আসে, সেক্ষেত্রে সে দিনের অবশিষ্টাংশ পানাহার থেকে বিরত থাকবে। আর যদি এমন সময়ে ফিরে আসে যে, এখনও রোযার নিয়্যতের সময় বাকি আছে এবং সে কিছু খায়ওনি, তাহলে সে রোযার নিয়্যত করে নিবে। -আদ-দুররুল মুখতার ২ : ৪৩১।
এসব ক্ষেত্রে যখন ওযর শেষ হয়ে যাবে, তখন যতদিনের রোযা কাযা হয়েছে, সে কয়দিনের রোযা কাযা করে নিতে হবে।
কাযা রোযা আদায়ের বিধান
কোন ওযর যেমন, অসুস্থতা, শরঈ সফর ইত্যাদির কারণে রোযা রাখা সম্ভব না হলে, যখনই ওযর শেষ হয়ে যাবে, তখনই হিসেব করে সেসব রোযার কাযা আদায় করে নেয়া জরুরী। কাযা আদায়ের ক্ষেত্রে একত্রে সবগুলো রাখার কোন বাধ্যবাধকতা নেই, বরং পৃথক পৃথকভাবে রাখলেও আদায় হয়ে যাবে। -হিদায়া ২ : ৩৫৪ (ফাতহুল কদীর যুক্ত মুদ্রণ)।
যদি অসুস্থ ব্যক্তি আরোগ্য লাভের পর কিংবা মুসাফির ব্যক্তি সফর থেকে ফেরার পর এই পরিমাণ সময় না পায় যে, এবারের অসুস্থতা কিংবা সফরে যতদিনের রোযা কাযা হয়েছে, সবদিনের রোযা রাখতে পারবে, তাহলে তার উপর সবদিনের রোযার কাযা করা আবশ্যক নয়। বরং সে যে কয়দিন রোযা রাখতে সক্ষম ছিলো বা মুকিম ছিলো, সে কয়দিনের রোযা রাখবে। -আদ-দুররুল মুখতার ২ : ৪২৪, জাওয়াহিরুল ফিক্হ ৩ : ৫২১।
কাফ্ফারা আদায়ের পদ্ধতি
কেউ যদি রমাযান মাসে রোযা রাখাবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করে কিংবা স্ত্রী সহবাস করে রোযা ভেঙ্গে ফেলে তার উপর কাযার সাথে সাথে কাফফারাও ওয়াজিব হয়। কাফ্ফারা হলো, একাধারে ধারাবাহিকভাবে বিরতিহীন দু’মাস রোযা রাখবে। মাঝখানে যদি কোন ধরণের বিরতি চলে আসে, তাহলে তা বাতিল হয়ে যাবে, পুনরায় নতুন করে শুরু করতে হবে। শুধুমাত্র মহিলার ক্ষেত্রে যদি ঋতুস্রাব শুরু হয়ে যায়, তাহলে সে ঐ কয়দিন বাদ দিবে। এরপর তা বন্ধ হয়ে গেলে সাথে সাথে সেই কাফ্ফারা আদায় করা শুরু করে দিবে। -আল-বাহরুর রাইক ২ : ২৯৮।
তবে কারো যদি রোযা রাখার সক্ষমতা না থাকে, সেক্ষেত্রে সে দু’মাস রোযা রাখার পরিবর্তে ৬০ জন গরীব-মিসকিনকে দু’বেলা পেট ভরে আহার করাবে কিংবা একজনকে ৬০ দিন পর্যন্ত দু’বেলা খাওয়াবে; অথবা এর সমপরিমাণ মূল্য সদকা করে দিবে। -আদ-দুররুল মুখতার ৩ : ৪৭৮।
ফিদয়া আদায়ের পদ্ধতি
কোন ব্যক্তি যদি এমন বার্ধক্যে পৌঁছে যায় যে, সে রোযা রাখতে সক্ষম নয়; অথবা কেউ এমন অসুস্থতায় পতিত হলো যে, তা থেকে তার সুস্থ হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই; সেক্ষেত্রে সে রোযা রাখবে না, বরং প্রতি রোযার পরিবর্তে একজন গরীব লোককে দু’বেলা পেট ভরে খাওয়াবে কিংবা সদকায়ে ফিতর পরিমাণ মূল্য দান করে দিবে। -আদ-দুররুল মুখতার ২ : ৪২৭।
সাহরী
রোযাদার ব্যক্তির জন্য সুবহে সাদিকের আগ মুহূর্তে রাতের শেষভাগে সাহরী খাওয়া সুন্নাত এবং বরকত ও সওয়াবের কাজ। অর্ধরজনীর পর যে কোন সময়ে খেলেই সাহরীর সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে। তবে শেষ রাতে খাওয়া উত্তম। -আলমাবসূত লিসসারাখসী ৩ : ৭৭।
ইফতার
সূর্যাস্ত নিশ্চিতের সাথে সাথেই ইফতার করে নিতে হবে। এর চেয়ে বিলম্ব করা মাকরূহ।
ইফতারে খেজুর খাওয়া উত্তম। -বাদাইয়ুস সানাই ২ : ১০৫, জাওয়াহিরুল ফিক্হ ৩ : ৫২২।
ইফতারের সময়ে এই দুআ পড়া সুন্নাত। -সুনানু আবী দাউদ (২৩৫৮)।
اللَهُمَّ لك صُمْتُ، وعلى رِزْقِكَ أفْطَرْتُ
ইফতারের পরে এই দুআ পড়বে। -সুনানু আবী দাউদ (২৩৫৭)।
ذهب الظمأ وابتلَّت العُرُوقُ وثبتَ الأجر إن شاء اللهُ
রোযা রাখা অবস্থায় চিকিৎসা সংক্রান্ত কিছু জরুরী মাসাইল
১. ইনজেকশন ব্যবহার করা যাবে।
২. টিকা নেয়া যাবে।
৩. ইনসুলিন গ্রহণ করলে রোযা ভাঙ্গবে না। -জাওয়াহিরুল ফিক্হ ৩ : ৫২২, জাদীদ ফিকহী মাসায়েল ১ : ১২৩।
৪. রক্ত নেয়া ও দেয়া উভয়টিই করা যাবে। তবে রক্ত দেয়ার ক্ষেত্রে লক্ষণীয় হলো, রোযা রেখে মারাত্মক পর্যায়ের অসুস্থ ব্যক্তিকেই রক্ত দিবে এবং রক্তদাতার নিজের উপর আস্থা থাকতে হবে যে, রক্ত দেয়ার ফলে দুর্বলতা ইত্যাদির কারণে তার রোযার মধ্যে কোন প্রভাব পড়বে না। অন্যাথায়, রক্ত দেয়া তার জন্য মাকরূহ হবে। কারণ, রোযা রেখে এমন কোন কাজ করা মাকরূহ, যার ফলে দেহে দুর্বলতা সৃষ্টি হয়। -জাওয়াহিরুল ফিক্হ ৩ : ৫১৯, জাদীদ ফিকহী মাসায়েল ১ : ১২২।
৫. অক্সিজেন গ্রহণের ক্ষেত্রে যদি শুধু অক্সিজেনই হয়, এর সাথে কোন ধরণের ওষুধের মিশ্রণ না থাকে, তাহলে এর দ্বারা রোযা ভাঙ্গবে না। আর যদি কোন ওষুধের মিশ্রণ থাকে, তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। -রমাযান আওর জাদীদ মাসাইল, মুফতী শুআইবুল্লাহ খান কৃত; পৃষ্ঠা : ১৬৬।
৬. চোখে কোন ধরণের ওষুধ ব্যবহার করলে এর দ্বারা রোযা ভাঙ্গবে না। -জাওয়াহিরুল ফিক্হ ৩ : ৫২০, জাদীদ ফিকহী মাসায়েল ১ : ১২৪।
৭. নাকে ও কানে যে কোন ধরণের ওষুধ ব্যবহার করলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। চাই তা স্প্রের মাধ্যমে হোক বা অন্য কিছুর মাধ্যমে হোক। -জাওয়াহিরুল ফিক্হ ৩ : ৫১৮, জাদীদ ফিকহী মাসায়েল ১ : ১২৭।
৮. ইনহেলার ব্যবহার করলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। -রমাযান আওর জাদীদ মাসাইল, মুফতী শুআইবুল্লাহ খান কৃত; পৃষ্ঠা : ১৪০। ৯. রোযা রেখে ভাপ নিলে এর দ্বারা রোযা ভেঙ্গে যাবে। -জাদীদ ফিকহী মাসায়েল ১ : ১২৭, রমাযান আওর জাদীদ মাসাইল, মুফতী শুআইবুল্লাহ খান কৃত; পৃষ্ঠা : ১৪৩।