শরয়ী নীতিমালা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ

মুফতী হাফিজুর রহমান

বর্তমানে জন্মনিয়ন্ত্রণের বেশ কিছু পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি ও উদ্দেশ্য ভেদে তার শরঈ বিধানে তারতম্য হবে। নিম্নে জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রচলিত পদ্ধতি ও তার শরয়ী বিধান সম্বন্ধে কিছুটা বিস্তৃত আলোচনা পেশ করা হলো।

মৌলিকভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি দু’ভাগে বিভক্ত। (ক) স্থায়ী পদ্ধতি (খ) অস্থায়ী পদ্ধতি।

(ক) স্থায়ী পদ্ধতি

জন্মনিয়ন্ত্রণের এ পদ্ধতিতে এমন উপায় গ্রহণ করা হয় যাতে স্থায়ীভাবে নারী-পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা তথা সন্তান জন্ম দেয়ার শক্তি চির তরে নিঃশেষ হয়ে যায়। জন্মনিয়ন্ত্রণের স্থায়ী পদ্ধতি কয়েক ভাগে বিভক্ত।

১। vasectomy  (অণ্ডকোষের নিঃসরণ নালীর ছেদন) : এটি একটি পুরুষকে বন্ধ্য করণের সহজ অস্ত্রোপাচারবিশেষ। এ পদ্ধতির মাধ্যমে পুরুষের শুক্রকীটবাহী নালিকা অংশত বা সম্পূর্ণ কেটে ফেলা হয়।

২। tubal ligation : এ পদ্ধতির মাধ্যমে নারীর শুক্রনালি কেটে ফেলা হয় কিংবা বেধে দেয়া হয়। যাতে ধাতুর প্রবেশ পথ বন্ধ হয়ে প্রজনন প্রক্রিয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।

৩। hysterectomy : এ পদ্ধতির মাধ্যমে নারীর জরায়ু কেটে ফেলে দেয়া হয়। যাতে গর্ভধারণের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।

৪। ওষুধ সেবন, তরল ওষুধ পুশ করণ কিংবা অন্য কোনো প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রজনন ক্ষমতা চিরতরে নষ্ট করে দেয়া।

শরঈ বিধান

উপরোল্লিখিত জন্মনিয়ন্ত্রণের স্থায়ী ব্যবস্থার কোনো পদ্ধতিই শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ নয়; বরং সুষ্পষ্ট হারাম। কায়েস রা. থেকে বর্ণিত, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, একদা আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে যুদ্ধাভিযানে বের হলাম। তখন আমাদের নিকট জৈবিক চাহিদা পূরণের কিছুই ছিল না। (এতে আমরা যৌন পীড়নে ভুগতাম।) ফলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বললাম, (এ পরিস্থিতিতে) আমরা কি আমাদের যৌন শক্তি চিরতরে নিঃশেষ করে দেব না! উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা থেকে বারণ করলেন। অতঃপর আমাদের নিকট এ আয়াতটি পাঠ করলেন; অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমরা ঐসব সুস্বাদু বস্তু হারাম করো না যেগুলো আল্লাহ তোমাদের জন্য হালাল করেছেন এবং সীমালংঘন করো না। আল্লাহ সীমালংঘনকারীদের পছন্দ করেন না। সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০৭৫।

তবে যদি নারী কিংবা পুরুষ দুরারোগ্য জটিল কোনো ব্যধিতে আক্রান্ত হয় যা নিরাময়ে স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ ব্যতিরেকে কোনো উপায় নেই তাহলে সে ক্ষেত্রে জন্মনিয়ন্ত্রণের স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণের অবকাশ রয়েছে। যথা নারীর জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়া। এক্ষেত্রে জরায়ু কর্তন ব্যতীত আরোগ্য লাভের অন্য কোনো উপায় না থাকলে জরায়ু কেটে ফেলে দেয়ার অবকাশ রয়েছে।

(খ) জন্মনিয়ন্ত্রণের অস্থায়ী ব্যবস্থা

এক্ষেত্রে বিভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণ করে সাময়িকভাবে প্রজনন প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। জন্মনিয়ন্ত্রণের অস্থায়ী এ পদ্ধতিটি দুই ভাগে বিভক্ত। (ক) প্রাকৃতিক ব্যবস্থা (খ) কৃত্রিম ব্যবস্থা

(ক) প্রাকৃতিক ব্যবস্থা

জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক ব্যবস্থা হল ঋতুস্রাবের পূর্বাপরের সময় গণনা করে নিরাপদ কাল মেনে চলা। ঋতুর সূচনা সময় থেকে পবিত্রকালের মধ্যবর্তী সময় (যা সাধারণত চৌদ্দতম দিন হয়ে থাকে) এবং তার পূর্বাপর কয়েকদিন সহবাস থেকে বিরত থেকে নিরাপদ কাল মেনে চলা হয়। ঋতুস্রাব সূচনার নবম দিন হতে ১৯ তম দিন পর্যন্ত সময় সহবাস নিয়ন্ত্রণ করে সাধারণত জন্মনিয়ন্ত্রণের এ প্রাকৃতিক ব্যবস্থা গ্রহণ হয়।

শরঈ বিধান

স্ত্রীর অধিকার লংঘন না হলে জন্মনিয়ন্ত্রণের এ প্রাকৃতিক ব্যবস্থা গ্রহণের অবকাশ রয়েছে।

(খ) কৃত্রিম ব্যবস্থা

এক্ষেত্রে কৃত্রিম বিভিন্ন উপায় গ্রহণ করে প্রজনন প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কৃত্রিম এ ব্যবস্থাটি কয়েক ভাগে বিভক্ত।

১। কনডম ব্যবহার করা।

২। jelly, cream, foam  (জেলি, ক্রিম, ফোম) প্রভৃতি উপাদান ব্যবহার করে শুক্রাণুকে দুর্বল বা অকেজো করে দেয়া।

৩। ডুস (douche) ব্যবহার করে জরায়ু ধুয়ে ফেলা।

৪। কৃত্রিম পদ্ধতি গ্রহণ করে জরায়ুর মুখ বন্ধ করে দেয়া।

৫। আযল করা (withdrawal)। অর্থাৎ যৌন মিলন কালে বীর্য প্রত্যাহার করা।

শরঈ বিধান

বিনা প্রয়োজনে জন্মনিয়ন্ত্রণের এ অস্থায়ী পদ্ধতিগুলো গ্রহণ করা মাকরুহে তানযিহী।

৬। পিল (pill) খাওয়া

৭। ইঞ্জেকশন গ্রহণ করা

শরঈ বিধান

এ পদ্ধতি দুটি আযল পদ্ধতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ার সাথে সাথে দেহের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হওয়ার কারণে মাকরুহের মাঝে আরো কঠোরতা আরোপিত হবে।

যেসব ক্ষেত্রে অস্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ বৈধ

১। অতি দুর্বলতার দরুণ গর্ভধারণের ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া।

২। গর্ভধারণের ফলে দুগ্ধস্বল্পতা হেতু পূর্বের শিশুর স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা দেখা দেয়া।

৩। সামাজিক অবক্ষয় ও দুষিত পরিবেশের কারণে সন্তান অসৎ ও বিপথগামী হওয়ার প্রবল আশঙ্কা হওয়া।

৪। স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার মনোমালিন্যের কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের ইচ্ছা পোষণ করা।

৫। বিজ্ঞ মুসলিম ডাক্তারের অভিমত অনুসারে সন্তান গ্রহণে মায়ের জীবন নাশের আশঙ্কা হওয়া।

৬। মা বংশগত কোনো মারাত্মক ব্যধিতে আক্রান্ত হওয়া এবং তা নবজাতকের মাঝে সংক্রমিত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা হওয়া।

যেসব উদ্দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের অবকাশ নেই

১। নিজের দেহসৌষ্ঠব ও দৈহিক সৌন্দর্যকে দীর্ঘায়িত করার লক্ষে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

২। কন্যা সন্তান জন্ম নেয়ার ভয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৩। গর্ভধারণের কষ্ট, প্রস্রাব বেদনা, প্রসূতিস্রাব, দুগ্ধদান ইত্যাদির কষ্ট ও ঝামেলা থেকে পরিত্রাণের উদ্দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৪। অধিক সন্তান গ্রহণকে লজ্জার বিষয় মনে করে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৫। আর্থিক অভাব অনটনের আশঙ্কায় জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

উল্লেখিত উপলক্ষ্যগুলো সামনে রেখে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা অবৈধ। বিশেষত পঞ্চম উপলক্ষ্যটি ইসলামী আকিদা-বিশ্বাসের সাথে পরিপূর্ণ সাংঘর্ষিক। জন্ম, মৃত্যু, জীবিকা, সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ একমাত্র আল্লাহ তাআলার হাতে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ভূপৃষ্ঠে বিচরণশীল সকল প্রাণীর জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহরই। তিনি তাদের স্থায়ী ও অস্থায়ী অবস্থিতি সম্বন্ধে অবহিত। সুষ্পষ্ট কিতাবে সবকিছুই রয়েছে। সূরা হুদ, আয়াত ৬।

আহার দানের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন, স্বীয় সন্তানদেরকে দারিদ্র্যের কারণে হত্যা করো না। আমি তোমাদেরকে ও তাদেরকে আহার্য দান করি।  সূরা আনআম, আয়াত ১৫২

আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, দারিদ্র্যের ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না। তাদেরকে এবং তোমাদেরকে আমিই আহার্য দান করে থাকি। নিশ্চয় তাদেরকে হত্যা করা মহাপাপ।

সূত্রসমূহ

সূরা বানী ইসরাঈল ৩১, সূরা হুদ ৬, সূরা আনআম ১৫২, সূরা বানী ইসরাঈল ৩১, সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০৭৫, সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৪৩৮, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২০৫০, সুনানে বাইহাকী কুবরা, হাদীস ১৩২৫৪, শরহে সহীহ মুসলিম লিননাবাবী ৯/১১৩, আলবাহরুর রায়েক ৩/৩৪৯, রদ্দুল মুহতার ৩/১৭৬, কিফাইয়াতুল মুফতী ৫/২৭০, আহসানুল ফাতাওয়া ৮/৩৪৭, আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল ৮/৩৫৮, আলইসলাম ওয়াততিব্বুল হাদীস, মুফতী দিলাওয়ার হুসাইন ২২৪

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *