মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম
মাহে রমাযান ছিলো আমাদের জন্য রাব্বুল আলামীনের অনন্য দান। রমাযানের দিবস রজনীতে মুমিনের জীবন ছিলো ইবাদতে সাজানো পুষ্পোদ্যান। সারাদিন ক্ষুধার্ত অবস্থায় কাটিয়েছি। হাতের নাগালে অনেক সুস্বাদু খাবার ছিলো। প্রভুর ভয় আমাদেরকে ওই খাবার মুখে তুলতে দেয়নি। রঙ বেরঙের শরবতে ভরে যেতো ইফতারের দস্তরখান। রবের হুকুম অমান্য হবে বলে তাতে চুমুক দেইনি। এ যেন তাকওয়া অনুশীলনের কুদরতী আয়োজন।
আর রাতের তারাবীহ ছিলো প্রভুর সঙ্গে কথোপকথনের সুবর্ণ সুযোগ। কালামুল্লাহর তিলাওয়াতে ছিলো অপূর্ব ঈমানী স্বাদ। সেই স্বাদ আস্বাদন করে বান্দা ডুবে যেতো প্রভুর ইশকের দরিয়ায়। সাহরী, ইফতার, দান-সদকা মাসটির সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিতো।
কিছুদিন আগেই আমাদের থেকে বিদায় নিয়েছে মহিমান্বিত সেই পবিত্র মাস । রমাযান বিদায় নেয়ার পর শয়তানের মুক্তি মিলেছে। বনী আদমকে সত্যপথ থেকে বিচ্যুত করতে সে বদ্ধপরিকর। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ধোঁকা দিয়ে যাবে। তার ধোঁকার শিকার হয়ে অনেক মানুষ রমাযানের পর ইবাদতে জমে থাকতে পারে না। কেউ একেবারে ছেড়ে দেয়। আবার কেউ রমাযানের চেয়ে ইবাদত অনেক কমিয়ে দেয়। এর কোনোটিই ঠিক নয়। আমরা রমাযানেও আল্লাহর বান্দা। অন্য মাসেও আল্লাহর বান্দা। পরকালে রমাযানের হিসেব যেমন নেয়া হবে। সারা বছরের হিসেবও কড়ায়-গণ্ডায় নেয়া হবে। তাই রমাযানের রিয়াযত মুজাহাদা করার পর ইবাদত থেকে হাত ঝেড়ে ফেলার কোনো সুযোগ নেই।
তাছাড়া কিছুদিন যিকির-আযকার করে তা ছেড়ে দেয়া অনুচিত। এটি ইস্তিকামাত/দৃঢ়পদ থাকার পরিপন্থী। যারা কোনো নেক আমলের উপর স্থির থাকতে পারে না, তাদের ব্যাপারে অনেক হুশিয়ারী বাণী উচ্চারিত হয়েছে। বনী ইসরাঈলের বিখ্যাত বুযুর্গ ছিল বালআম বাউরা। সে যা দু‘আ করত, তা কবূল হয়ে যেত। কিন্তু সে নেক কাজের উপর স্থির থাকতে পারেনি। যার ফলে তার জিহ্বা ঝুলে গিয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলা তার ব্যাপারে বলেন,
وَلَوْ شِئْنَا لَرَفَعْنَاهُ بِهَا وَلَكِنَّهُ أَخْلَدَ إِلَى الْأَرْضِ وَاتَّبَعَ هَوَاهُ فَمَثَلُهُ كَمَثَلِ الْكَلْبِ إِنْ تَحْمِلْ عَلَيْهِ يَلْهَثْ أَوْ تَتْرُكْهُ يَلْهَثْ
অর্থ : আমি ইচ্ছা করলে সেই আয়াতসমূহের মাধ্যমে তাকে উচ্চ মর্যাদা দান করতে পারতাম। কিন্তু সে তো দুনিয়ার দিকেই ঝুঁকে পড়ল এবং নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করল। সুতরাং তার দৃষ্টান্ত ওই কুকুরের মতো হয়ে গেল, যার উপর তুমি হামলা করলেও সে জিহবা বের করে হাঁপাতে থাকবে। আর তাকে (তার অবস্থায়) ছেড়ে দিলেও জিহ্বা বের করে হাঁপাতে থাকবে। -সুরা আ’রাফ; আয়াত ১৭৬।
এখন কথা হলো, ইস্তিকামাত কাকে বলে?
হযরত উমর রাযি. অতি সাবলীল ভাষায় ইস্তিকামাতের বিষয়টি বুঝিয়েছেন। তিনি বলেন,
الاستقامة أن تستقيم على الأمر والنهي ولا تروغ منه روغان الثعلب
অর্থ : করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়ের উপর অবিচল থাকার নাম ইস্তিকামাত। শিয়ালের মতো এদিক সেদিক ছুটোছুটি করলে ইস্তিকামাত অর্জন করা সম্ভব নয়। -তাফসীরে খাযেন ৩/২৫৫।
এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে পরিষ্কার ভাষায় আদেশ করেন,
فَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ وَمَنْ تَابَ مَعَكَ وَلَا تَطْغَوْا
অর্থ : তোমাকে যেভাবে হুকুম করা হয়েছে, সেভাবে তুমি নিজেও সরল পথে স্থির থাকো এবং যারা তোমার সঙ্গে আছে তারাও। আর সীমালংঘন করো না। -সূরা হুদ; আয়াত ১১২।
সুতরাং রমাযানে যেসব আমল করেছি, তা রমাযানের পরও অব্যাহত রাখা অতীব জরুরী। এখানে রমাযানের বিশেষ কিছু আমলের বর্ণনা দেয়া হলো, যেগুলো আমরা সারা বছর সচল রাখতে পারি।
১। রোযা রাখা।
রোযা শুধু রমাযানেই সীমাবদ্ধ নয়। সারা বছর এ রোযার ধারা অব্যাহত রাখা চাই। বিভিন্ন দিনে রোযা রাখার ফযীলতের কথা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। সেসব ফযীলত জেনে তার সওয়াব অর্জনের চেষ্টা করা উচিত। বছরের বিশেষ কিছু দিনে রোযা রাখার কিছু হাদীস নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
ক. রমাযানের পর শাওয়াল মাস। এ মাসে ছয়টি রোযা রাখার মাঝে অনেক ফযীলত রয়েছে। হাদীস শরীফে আছে,
من صام رمضان ثم أتبعه ستا من شوال كان كصيام الدهر
অর্থ : যে ব্যক্তি রমাযানে রোযা রাখার পর শাওয়ালে ছয়টি রোযা রাখল, সে যেন সারা বছর রোযা রাখল। -সহীহ মুসলিম; হাদীস ২৮১৫।
খ. এরপর জিলহজ্ব মাস। এ মাসের নয় তারিখে হাজী সাহেবরা আরাফার ময়দানে অবস্থান করেন। তাই ওই দিনকে আরাফার দিন বলা হয়। আরাফার দিনে রোযা রাখার চেষ্টা করা চাই। হাদীস শরীফে এসেছে,
صيام يوم عرفة أحتسب على الله أن يكفر السنة التى قبله والسنة التى بعده
অর্থ : আমি আল্লাহ তা‘আলার কাছে আশাবাদী যে, আরাফার দিনের রোযা আগের এক বছর ও পরের এক বছরের গুনাহের কাফফারা হয়ে যাবে। -সহীহ মুসলিম; হাদীস ২৮০৩।
গ. চান্দ্র মাসের প্রথম মাস মুহাররম। এ মাসের দশ তারিখে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। ওই দিনকে আশুরার দিন বলা হয়। আশুরার দিনে রোযা রাখার ব্যাপারে বিশেষ যত্নবান হওয়া চাই। হাদীস শরীফে এসেছে,
وصيام يوم عاشوراء أحتسب على الله أن يكفر السنة التى قبله
অর্থ : আশুরার দিনে রোযা রাখলে আমি আল্লাহ তা‘আলার কাছে আশাবাদী যে, আগের বছরের গুনাহের কাফফারা হয়ে যাবে। -সহীহ মুসলিম; হাদীস ২৮০৩।
ঘ. প্রতি সপ্তাহের সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখা চাই। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
تعرض الأعمال يوم الإثنين والخميس فأحب أن يعرض عملي وأنا صائم
অর্থ : আল্লাহ তা‘আলার দরবারে সোমবার ও বৃহস্পতিবার আমল পেশ করা হয়। রোযাদার অবস্থায় আল্লাহর কাছে আমার আমল পেশ হোক-এটা আমার কাছে অতি প্রিয়। -সহীহ মুসলিম; হাদীস ৭৪৭।
২। বেশী বেশী নফল নামায পড়া।
অন্য মাসের তুলনায় রমাযানে বেশী নামায পড়া হয়। বিশেষ করে তারাবীহের মতো এত দীর্ঘ নফল নামায কম পড়া হয়। পুরো মাস তারাবীহ পড়ার দরুন দীর্ঘ সময় নামায পড়ার যে অভ্যাস গড়ে উঠেছিল, তা ধরে রাখার চেষ্টা করা।
ক. রমাযানে সাহরীর আগে তাহাজ্জুদের অভ্যাস গড়ে উঠেছিল। রমাযানের পরও সেই ধারা চালু রাখা। হাদীস শরীফে এসেছে,
أفضل الصلاة بعد الصلاة المكتوبة الصلاة فى جوف الليل
অর্থ : ফরয নামাযের পর সর্বোত্তম নামায তাহাজ্জুদের নামায। -সহীহ মুসলিম; হাদীস ২৮১৩।
খ. দিনের শুরুতে সূর্যোদয়ের পর চার রাকাত ইশরাকের নামায পড়া। হাদীসে কুদসীতে আছে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, হে বনী আদম! তুমি দিনের শুরুতে আমার জন্য চার রাকাত নামায পড়ো। আমি তোমার সারা দিনের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবো। (সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ৪৭৫)
গ. যত সুন্নাতে মুআক্কাদাহ নামায আছে, সব গুরুত্ব সহকারে আদায় করা। শুধু ফরয পড়ে সুন্নাত তরক করা গুনাহের কাজ। হাদীস শরীফে এসেছে,
من صلى ثنتي عشرة ركعة في يوم وليلة بنى الله له بيتا في الجنة
অর্থ : যে ব্যক্তি দিন রাতে বারো রাকাত নামায (সুন্নতে মুআক্কাদাহ) পড়বে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতে একটি বাড়ি বানিয়ে দিবেন। -সুনানে নাসাঈ; হাদীস ১৮০৮।
৩। কুরআন তিলাওয়াত করা।
রমাযানে কুরআনে কারীমের সঙ্গে এক গভীর হৃদ্যতা গড়ে উঠেছে। কুরআনের স্বাদ পাওয়ার তাওফীক হয়েছে আমাদের অনেকের। এই কুরআনের মহাব্বত ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা। যত বেশী তিলাওয়াত করবো, তত ঈমান বাড়বে। আর ঈমান বাড়লে আল্লাহর সঙ্গে মহাব্বত গভীর থেকে গভীরতর হবে। ফলে এই কুরআনই আমার জন্য কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে। হাদীস শরীফে এসেছে,
الصيام والقرآن يشفعان للعبد يوم القيامة يقول الصيام أي رب منعته الطعام والشهوات بالنهار فيشفعني فيه ويقول القرآن منعته النوم بالليل فشفعني فيه قال فيشفعان
অর্থ : রোযা এবং কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, হে রব! আমি তাকে দিনের বেলা খাবার-দাবার ও স্ত্রী-সম্ভোগ থেকে বিরত রেখেছি, আজ আপনি আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। আর কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতে ঘুমাতে দেইনি, আপনি আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। সুতরাং উভয়ের সুপারিশ কবুল করা হবে। -মুসনাদে আহমদ; হাদীস ৬৬২৬।
৪। দান-সদকার ধারা অব্যাহত রাখা।
রমাযানকে কেন্দ্র করে যাকাতের হিসেব করে থাকি। একে সত্তরের সওয়াব অর্জনের জন্য রমাযানেই যাকাত আদায় করি। আর ঈদের দিনে আদায় করি সদকাতুল ফিতর। পুরো রমাযান দান খয়রাতে আমাদের সম্পদের ইবাদত তাজা হয়ে ওঠে। গরীব দুখীদের মুখে নির্মল হাসি ফুটে ওঠে। তারাও উদযাপন করে ঈদের আনন্দ। রমাযান বিদায় নেবার পর যেন এই ইবাদত বন্ধ না হয়। একে সত্তরের সওয়াব পাওয়ার জন্য শুধু রমাযানে দান করে সারা বছর হাত গুটিয়ে বসে থাকা ঠিক নয়। বছরের যেকোনো সময় গরীবদের বিভিন্ন প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। তাদের বিপদের সময়ও কি রমাযান না বলে সাহায্য করবো না? মাদরাসা মসজিদ ও অন্যান্য দ্বীনী খাতে নফল দানের সুযোগ আসতে পারে। তখনও কি আমরা মাথা নিচু করে এড়িয়ে যাবো? এভাবে দানের হাত গুটিয়ে নেয়া কৃপণতার পরিচয়। দানবীরদের জন্য ফেরেশতাদের দু‘আ শুধু রমাযানেই সীমাবদ্ধ নয়। সারা বছর ফেরেশতারা দানবীরদের জন্য দু‘আ করতে থাকে। হাদীস শরীফে এসেছে, প্রতিদিন সকালে দুইজন ফেরেশতা অবতীর্ণ হয়ে বলতে থাকে হে আল্লাহ! আপনি দানকারীকে ভরপুর বরকত দান করুন। -সহীহ বুখারী; হাদীস ১৩৭৪।
৫। দু‘আ করা।
যত আমল করি না কেন, আল্লাহর দরবারে দু‘আর বিকল্প নেই। ইফতারের আগে যেমন নিয়মিত দু‘আ করেছি, এখনও সেই ধারা অব্যাহত রাখি। জীবনের সকল অবস্থায় আল্লাহর দিকে মনোযোগী হওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলি। আল্লাহর কাছে যত বেশী চাইবো, আল্লাহ তত বেশি খুশী হবেন। আল্লাহ তা‘আলা নিজেই বলেন,
ادعوني استجب لكم
অর্থ : তোমরা আমার কাছে দু‘আ করো, আমি তোমাদের দু‘আ কবূল করবো। -সূরা মুমিন; আয়াত ৬০।
সারকথা, আমরা শুধু রমাযানেই ইবাদতগুযার হবো না। সারা বছর এমনকি সারা জীবন ইবাদতের সাথে লেগে থাকার চেষ্টা করবো। এই চেষ্টায় থাকা অবস্থায় যদি মৃত্যু চলে আসে, তাহলে পরকালে আমাদের জন্য থাকবে অফুরন্ত সুখ-শান্তি ও অসীম নেয়ামত। আমাদের জান্নাত হবে নবী সিদ্দীক ও শহীদদের সঙ্গে। তখন শুধু শান্তি আর শান্তি। খুশী আর খুশী।
আলহামদুলিল্লাহ
মজনু ভাই! অসংখ্য শুকরিয়া। জাযাকুমুল্লাহ।