অভিভাবক বিহীন বিবাহ কি শরীয়াসম্মত?

মুফতী হাফিজুর রহমান

যদি অভিভাবকের অসম্মতিতে বা অনুপস্থিতিতে প্রাপ্তবয়স্ক দুজন পুরুষ কিংবা একজন পুরুষ ও দুজন নারী সাক্ষীর সম্মুখে ইজাব কবুলের মাধ্যমে পাত্র পাত্রী উভয়ের সম্মতিক্রমে বিবাহ সম্পন্ন হয়ে থাকে তাহলে সে বিবাহ শুদ্ধ হয়ে যাবে। তবে এখানে লক্ষণীয় হল, মেয়ের অভিভাবক যদি অসম্মত হয় এবং সে ছেলের তুলনায় শরীয়ত স্বীকৃত কুফু তথা বৈবাহিক সমতার ক্ষেত্রে উচ্চ মর্গিয়া বলে বিবেচিত হয় তাহলে এ বিবাহ শরীয়তসিদ্ধ হবে না। তবে যদি উভয়ের কুফু তথা বৈবাহিক সমতা ঠিক থাকে তাহলে মেয়ের অভিভাবকের অসম্মতিতে ও বিবাহ শুদ্ধ হয়ে যাবে।

১। হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মেয়ে তার ব্যক্তিগত বিষয়ে অভিভাবকের চেয়ে অধিক অধিকার রাখে।

-মুয়াত্তা মালিক, হাদীস নং-৮৮৮, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৪২১, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-১৮৮৮, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-২০৯৮, সুনানে দারেমী, হাদীস নং-২২৩৪, সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-১১০৮, সুনানে নাসায়ী, হাদীস নং-৩২৬০, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৪০৮৪, সুনানে দারাকুতনী, হাদীস নং-৩৫৭৬

২। হযরত সালামা বিনতে আব্দুর রহমান রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা এক মেয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা কতইনা উত্তম পিতা! আমার চাচাত ভাই আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিল আর তিনি তাকে ফিরিয়ে দিলেন। আর এমন এক ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাইছেন যাকে আমি অপছন্দ করি।

এ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার পিতাকে জিজ্ঞাসা করলে পিতা বলে, মেয়েটি সত্যই বলেছে। আমি তাকে এমন পাত্রের সাথে বিয়ে দিচ্ছি যার পরিবার ভাল নয়। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেয়েটিকে বললেন, “এ বিয়ে হবে না, তুমি যাও, যাকে ইচ্ছে বিয়ে করে নাও”।

-সুনানে সাঈদ বিন মানসূর, হাদীস নং-৫৬৮, মুসন্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদীস নং ১০৩০৪, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-১৫৯৫৩, দিরায়া ফী তাখরীজি আহাদীসিল হিদায়া, হাদীস নং-৫৪১

৩। হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, জনৈক কুমারী মেয়ে রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বলল, আমার পিতা আমার অপছন্দ সত্ত্বেও বিয়ে দিয়েছে। তখন রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে মেয়েকে অধিকার দিলেন, যাকে ইচ্ছে বিয়ে করতে পারে বা এ বিয়ে রাখতেও পারে।

-মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২৪৬৯, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১৮৭৫, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-২০৯৬, সুনানুল কুবরা নাসায়ী, হাদীস নং-৫৩৬৬, সুনানে দারা কুতনী, হাদীস নং-৩৫৬৬

৪। হযরত বুরাইদা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক মহিলা নবীজী সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বলল, আমার পিতা আমাকে তার ভাতিজার কাছে বিয়ে দিয়েছে, যাতে তার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। রাবী বলেন, তখন রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়টি মেয়ের ইচ্ছার উপর ন্যস্ত করেন।

অর্থাৎ ইচ্ছে করলে বিয়ে রাখতেও পারবে, ইচ্ছে করলে ভেঙ্গেও দিতে পারবে। তখন মহিলাটি বললো, আমার পিতা যা করেছেন, তা আমি মেনে নিলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল, মেয়েরা যেন জেনে নেয় যে, বিয়ের ব্যাপারে পিতাদের চূড়ান্ত মতের অধিকার নেই।

-সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১৮৭৪, মুসনাদে ইসহাক বিন রাহুয়াহ, হাদীস নং-১৩৫৯, সুনানে দারাকুতনী, হাদীস নং-৩৫৫৫

এ ছাড়াও আরো অনেক হাদীস রয়েছে, যেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, বিবাহের ক্ষেত্রে অভিভাবক নয়;  প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে মেয়েই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার রাখে।

বিপরীতমুখী হাদীসের জবাব

১। অভিভাবকবিহীন বিবাহ বাতিল বলে আয়িশা রা. থেকে যে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে সে ব্যাপারে ইমাম বুখারী রাহ. ও ইমাম তাহাবী রাহ. আপত্তি করেছেন।

২। বিপরীতমুখী হাদীসের বর্ণনাকারী হযরত আয়শা সিদ্দিকা রা. নিজেই তার ভাই আব্দুর রহমানের মেয়ে হাফসাকে তার অভিভাবক আব্দুর রহমানকে ছাড়া নিজে বিয়ে দিয়েছিলেন মুনজির বিন যুবায়েরের সাথে।

-মুয়াত্তা মালিক, হাদীস নং-২০৪০, তাহাবী শরীফ, হাদীস নং-৪২৫৫, সুনানুসসাগীর লিলবায়হাকী, হাদীস নং-২৩৭৪, মারেফাতুস সুনান ওয়াল আসার, হাদীস নং ১৩৫২২, সুনানে কুবরা লিলবায়হাকী, হাদীস নং-১৩৬৫৩, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-১৫৯৫৫

তবে অভিভাবকবিহীন বিবাহ বৈধ হলে ইসলামী শরীয়ত এ ধরনের বিবাহে নিরুৎসাহিত করে। মাতা পিতাকে কষ্ট দেয়া ইসলামী শরীয়তে বৈধ নয়। তাই বাবা মাকে না জানিয়ে তাদেরকে অসন্তুষ্ট করে বিবাহ করলে তা সম্পন্ন হলেও বিধিসম্মত হবে না। তাই যে করেই হোক মাতা পিতাকে সন্তুষ্ট করেই বিবাহ করা চাই।

এক্ষেত্রে মাতা পিতাকেও ছেলে মেয়েদের চাহিদার মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। আমাদের সমাজে অভিভাবকপক্ষ মেয়েদেরকে এক প্রকার জোর করেই বিবাহ দেন। মেয়ের সম্মতি অসম্মতির প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ করেন না। এ ধরনের বিবাহ বস্তুত শুদ্ধ হয় কি না তা বিবেচনার দাবি রাখে।

কারণ বিবাহের ক্ষেত্রে ছেলে মেয়ের পছন্দ ও সম্মতিটাই হলো মূল বিষয়। উপরন্তু বিবাহের ক্ষেত্রে জানাজানি একটি কাঙ্ক্ষিত বিষয়। হাদীসে বিবাহের ক্ষেত্রে ঘোষণা ও জানানোর বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। গোপন বিবাহের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়।

পোস্টটি লাইক ও শেয়ার করুন।

একটি মন্তব্য লিখুনঃ

Your email address will not be published. Required fields are marked *